আন নিসা, আয়াত ১১-৩৪

পৃষ্ঠা নং ২৮৮

-কানুন নিষ্ক্রিয় ও অপরাধ প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। আজকাল সব দেশেই আইন প্রণয়নের জন্য সংসদ রয়েছে। এখানে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। আর তার সদস্য মনোনয়নের জন্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সারা দুনিয়ায় হৈ চৈ পড়ে যাচ্ছে। অতৎপর নির্বাচিত সদস্যগণ দেশবাসীর মন-মানসিতা, আবেগ-অনুভুতি ও দেশের প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য রেখে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আইন প্রণয়ন করছেন। তারপর জনমত যাচাই করার জন্য তার প্রকাশ ও প্রচার করা হয় এবং জনসমর্থন লাভের পর তা প্রবর্তন করা হয়। আর সেটা কার্যকরী করার জন্য সরকারের প্রশাসনযন্ত্র সচল হয়ে উঠে যার অসংখ্য শাখা-প্রশাখা সারা দেশের সুদক্ষ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ। দেশের শান্তিশৃঙ্খলা, কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্য তার সক্রিয় কর্মতৎপরতা প্রদর্শন করছেন। কিন্তু এত বিপুল আয়োজন সত্ত্বেও প্রচলিত তন্ত্র-মন্ত্রের মোহমুক্ত হয়ে, তথাকথিত সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঠিকাদারদের অন্ধ অনুকরণের উর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে প্রত্যেকেই স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, ফলাফল অত্যন্ত নৈরাস্যজনক।

আল্লাহভীতি ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসই বিশ্ব শান্তির চাবিকাঠি:

সুষ্ঠু বিবেকসম্পন্ন যে কোন ব্যাক্তি চলমান সমাজের প্রথা ও রীতিনীতির বন্ধন ছিন্ন করে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে রসূলে আরবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনীত পয়গাম সম্পর্কে চিন্তা করলে স্পষ্ট উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যে, শুধু আইন ও দন্ডদান করেই পৃথিবীতে কখনো শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জিত হয়নি, বরং ভবিষ্যতেও অর্জিত হবে না। একমাত্র আল্লাহভীতি ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসই বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে। যার ফলে রাজা-প্রজা, শাসক ও শাসিত সর্বপ্রকার দায়-দায়িত্ব উপলব্ধি করতে, তা যথাযথভাবে পালন করতে সচেষ্ট হয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জনসাধারণ একথা বলে দায়িত্ব এড়াতে পারে না যে, এটা সরকারের কাজ। কুরআন মাজীদের পূর্বোল্লিখিত আয়াতসমূহে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এক বৈপ্লবিক বিশ্বাসের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শেষ করা হয়েছে।

উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ের মধ্যে ইনসাফ ও ন্যায়নীতির উপর অটল-অনড় থাকা এবং অন্যকেও অটল রাখার চেষ্ট করার জন্য শাসক-শাসিত নির্বিশেষে সবাইকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর আয়াত সমূহের শেষ দিকে এমন এক তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যা মানুষের ধ্যান-ধারণা ও প্রেরণার জগতে মহা-বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। তা হলো, আল্লাহ তাআলার অপরিসীম ক্ষমতা ও পরাক্রম, তার সম্মুখে উপস্থিতি ও জবাবদিহী এবং প্রতিদান ‍ও প্রতিফল লাভের বিশ্বাস। এটা এমন এক সম্পদ যার দৌলতে আজ থেকে সাতশত বছর পূর্ববর্তি অশিক্ষিত বিশ্বাসী লোকেরাও বিপুল শান্তি ও নিরাপত্তা ভোগ করতো এবং যার অভাবের কারণেই আজকের মহাশুন্যের অভিযাত্রী, কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণকারী উন্নত বিশ্ববাসীরা শান্তি ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত।

আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির ফলে তারা হয়তো মহাশূন্যে আরোহণ করতে, গ্রহ হতে গ্রহান্তরে ভেসে বেড়াতে এবং মহাসাগর পাড়ি দিতে পারবে, কিন্তু সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-কারখানা, উপদান-উপকরণ প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের মুখ্য উদ্দেশ্য অর্থাৎ, সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কোথাও পাবে না। কোন অত্যাধুনিক আবিস্কারের মাঝে কিংবা কোন গ্রহ-উপগ্রহেই তা খুঁজে পাওয়া যাবে না। বরং পাওয়া যাবে একমাত্র রাসূলে আরবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পয়গাম ও শিক্ষার মধ্যে, আল্লাহভীতি ও আখেরাতের বিশ্বাসের মধ্যে। ইরশাদ হয়েছে-

الا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ

অর্থাৎ, মনে রেখা, একমাত্র আল্লাহ্‌র স্মরণের মধ্যেই অন্তরসমূহের প্রশান্তি নিহিত। বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিস্কারসমূহ বস্তুতঃপক্ষে আল্লাহ্‌ তাআলার অফুরন্ত কুদরত ও কল্পনাতীত সৃষ্টি বৈচিত্র্যকে ভাস্বর করে চলেছে, যার সামনে মানুষ তার অক্ষমতা ও অযোগ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু অনুভূতিশীল অন্তর ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন চোখ না হলে তাতেই বা কি লাভ।

কুরআন হাকীম একদিকে পৃথিবীতে ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় বিধি-বিধানের ব্যবস্থা করেছে, অপরদিকে এমন এক অপূর্ব নীতিমালা ঘোষনা করেছে-যাকে পুরোপুরি গ্রহণ ও নিষ্ঠার সাথে বাস্তবায়ন করা হলে, যুলুম ও অনাচার জর্জরিত দুনিয়া সুখ-শান্তির আধারে পরিণত হবে। আখেরাতে বেহেশত লাভের পূর্বে দুনিয়াতেই জান্নাতী সুখের নমুনা উপভোগ করা যাবে।

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا ثُمَّ كَفَرُوا – কারো মতে অত্র আয়াতে মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। আর অনেকের মতে আয়াতটিতে ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। কেননা, প্রথমে তারা হযরত মূসা (আলাইহিচ্ছালাম)-এর প্রতি ঈমান এনেছিল তারপর গো-বৎসের পূজা করে কাফের হয়েছিল, অতঃপর তাওবাহ করে আবার ঈমান এনেছিল, পুনরায় হযরত ঈসা (আলাইহিচ্ছালাম)-কে অস্বীকার করে কুফরীর চরমে উপনীত হয়েছে। (তাফসীরে রূহুল মা‘আনী)

لَّمْ يَكُنِ اللَّهُ لِيَغْفِرَ لَهُمْ وَلَا لِيَهْدِيَهُمْ سَبِيلًا  এ আয়াতের তাৎপর্য এই যে, বার বার কুফরীর মধ্যে লিপ্ত হওয়ার ফলে সত্যকে উপলব্ধি করার এবং গ্রহণ করার যোগ্যতা রহিত হয়ে যায়। ভবিষ্যতে তাওবাহ করা ও ঈমান আনার সৌভাগ্য হয় না। তবে কুরআন-হাদীসের অকাট্য দলীলাদির দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, যত বড় কট্টর কাফের বা মুরতাদই হোক না কেন, যদি সত্যিকারভাবে তাওবাহ করে, তবে পূর্ববর্তী সমুদয় গোনাহ মাফ হয়ে যায়। অতএব, বার বার কুফরী করার পরও যদি তারা সত্যিকারভাবে তাওবাহ করে, তবে তাদের জন্য এখনো ক্ষমার আইন উন্মুক্ত রয়েছে।

এখানে প্রথম আয়াতে মুনাফিকদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তির হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে। তবে এহেন দুঃসংবাদকে بشارت অর্থাৎ, ‘সু-সংবাদ’ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নিজের ভবিষ্যত সম্পর্কে কোন সু-সংবাদ শুনার জন্য প্রত্যেকই উদ্‌গ্রীব থাকে। কিন্তু মুনাফিকদের জন্য এছাড়া আর কোন সংবাদ নেই। বরং তাদের জন্য সু-সংবাদের পরিবর্তে এটাই একমাত্র ভবিষ্যদ্বাণী।

মান-মর্যাদা একমাত্র আল্লাহ্‌ তাআলার সমীপে কামনা করা বাঞ্ছনীয়:

দ্বিতীয় আয়াতে কাফির ও মুশরিকদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য স্থাপন করাকে নিষিদ্ধ করে এধরনের আচরণে লিপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। সাথে সাথে এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার উৎস ও মূল কারণ বর্ণনা করতঃ একেও অযথা-অবান্তর প্রতিপন্ন করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ তাআলা ইরশাদ করেন-

أَيَبْتَغُونَ عِندَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا

অর্থাৎ, “তারা কি ওদের কাছে গিয়ে ইজ্জত-সম্মান লাভ করতে চায়? তবে ইজ্জত-সম্মান তো সম্পুর্ণ আল্লাহ্‌ তাআলার এখতিয়ারাধীন।:”

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ