আন নিসা, আয়াত ৭৬-৯১

পৃষ্ঠা নং-২৬৬

এ আয়াতে শয়তানের কলাকৌশলকে যে দূর্বল বলে অভিহিত করা হয়েছে, সেজন্য আয়াতের মাধ্যমেই দু’টি শর্তের বিষয়ও প্রতীয়মান হয়।

(এক) যে লোকের বিরুদ্ধে শয়তান কলাকৌশল অবলম্বন করবে, তাকে মুসলমান হতে হবে এবং-

(দুই) সে যে কাজে নিয়োজিত থাকবে, তা একান্তভাবেই আল্লাহ্‌র জন্য হতে হবে; কোন পার্থিব বস্তুর আকাঙ্খা কিংবা আত্মস্বার্থ প্রণোদিত হবে না। প্রথম শর্ত الَّذِينَ آمَنُوا বাক্যের দ্বারা এবং দ্বিতীয় শর্ত يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ বাক্যের দ্বারা বোঝা যায়। এ দু’টি শর্তের যে কোন একটির অবর্তমানে শয়তানের কলাকৌশল দুর্বল হয়ে পড়া অবশ্যম্ভাবী নয়।

জেহাদের নির্দেশ অবতীর্ণ হওয়ার পর মুসলমানগণ কর্তৃক তা মুলতবীর আকাঙ্খার কারণঃ জেহাদের হুকুম অবতীর্ণ হবার পর মুসলমানদের পক্ষ থেকে তা স্থগিত  থাকার বাসনা কোন আপত্তির কারণে ছিল না, বরং এটা ছিল একটি আনন্দমিশ্রিত অভিযোগ। তার কারণ, স্বভাবতঃ মানুষ যখন ব্যক্তিগতভাবে একা একা কোন চরম অসুবিধার সম্মুখীন হয়, তখন তার উত্তেজনা হঠাৎ উথলে উঠে এবং তখন কোন বিষয়ের প্রতিশোধ নেয়া তার পক্ষে সহজ হয়ে যায়।  কিন্তু আরাম-আয়েশের সময়ে তাদের মন-মানস কোন যুদ্ধ-বিগ্রহে উদদ্বুদ্ধ হতে চায় না। এটা হল মানুষের একটা সহজাত বৃত্তি। সুতরাং এসব মুসলমান যখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন, তখন কাফেরদের অত্যাচার-উৎপীড়নে অসহ্য হয়ে তারা জেহাদের নির্দেশ কামনা করতেন। কিন্তু মদীনায় হিজরত করে চলে আসার পর যখন তারা শান্তি ও আরাম-আয়েশ লাভে সমর্থ হন, আর এমনি অবস্থায় যখন জেহাদের হুকুম অবতীর্ণ হয়, তখন তাদের পুরাতন সে প্রতিশোধ স্পৃহা অনেকটা প্রশমিত হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের মন-মস্তিষ্কে সেই উন্মাদনা ও উত্তেজনা বিদ্যমান ছিল না। সেজন্য তারা শুধু বাসনা করল যে, এক্ষণই যদি জেহাদের নির্দেশটি না আসত, তবেই ভাল হত। এই বাসনাকে আপত্তি হিসাবে দাঁড় করিয়ে সে সমস্ত মুসলমানকে পাপী সাব্যস্ত করা আদৌ সমীচীন নয়। মুসলমাগণ যদি উল্লেখিত অভিযোগটি মুখেই প্রকাশ করে থাকেন, তবে উল্লেখিত বক্তব্যটি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু যদি অভিযোগটি মুখে প্রকাশ না করে থাকেন এবং তা শুধু মনে মনেই কল্পনাস্বরূপ এসে থাকে তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে তা অপরাধ বা পাপ বলে গণ্যই হয় না। এক্ষেত্রে উভয় অবস্থার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া আয়াতে উল্লেখিত قَالُوا শব্দের দ্বারা এমন কোন সন্দেহ করা উচিত হবে না যে, তাঁরা মনের কল্পনাকে মুখেও প্রকাশ করেছিলেন। কারণ, এর অর্থ এমনও হতে পারে যে, তাঁরা হয়ত মনে মনেই বলে থাকবেন।–(বয়ানুল-কোরআন) কোন কোন তাফসীরকারের মতে এ আয়াতের সম্পর্ক মুসলমানদের সাথে নয়, বরং মুনাফেকদের সাথে। সেক্ষেত্রে কোন প্রশ্নই থাকে না।– (তাফসীরে-কবীর)

রাষ্ট্রশুদ্ধি অপেক্ষা আত্মশুদ্ধি অগ্রবর্তীঃ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ আয়াতে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন প্রথমে নামায ও যাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন, যা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রশুদ্ধির উপকরণ। অর্থাৎ, এতে অত্যাচার-উৎপীড়নের প্রশমন করা যায়। এতেই প্রতিষ্ঠিত হয় সমগ্র দেশময় শান্তি ও শৃংখলা। এতে প্রতীয়মান হয় যে, মানুষকে অপরের সংশোধনের পূর্বে নিজের সংশোধন করা কর্তব্য। বস্তুতঃ মর্যাদার দিক দিয়েও প্রথম পর্যায়ের হুকুমটি হল ফরযে- আইন, আর দ্বিতীয় পর্যায়ের হুকুম হচ্ছে ফরযে-কেফায়াহ্। এতে আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব ও অগ্রবর্তিতাই প্রতীয়মান হয়।–(মাযহারী)

দুনিয়া ও আখেরাতের নেয়ামতের পার্থক্যঃ আয়াতে দুনিয়ার নেয়ামতের তুলনায় আখেরাতের নেয়ামতসমূহকে উত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার কয়েকটি কারণ রয়েছে। তা হল এই-

(১) দুনিয়ার নেয়ামত অল্প এবং আখেরাতের নেয়ামত অধিক।

(২) দুনিয়ার নেয়ামত অনিত্য এবং আখেরাতের নেয়ামত নিত্য-অফুরন্ত।

(৩) দুনিয়ার নেয়ামতসমূহের সাথে নানা রকম অস্থিরতাও রয়েছে, কিন্তু আখেরাতের নেয়ামত এ সমস্ত জঞ্জালমুক্ত।

(৪) দুনিয়ার নেয়ামত লাভ অনিশ্চিত, কিন্তু আখেরাতের নেয়ামত প্রত্যেক মুত্তাকী-পরহেযগার ব্যক্তির জন্য একান্ত নিশ্চিত।– (তাফসীরে-কাবীর)

পাকা ও সুদৃঢ় বাসস্থান নির্মান করা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী নয়ঃ وَلَوْ كُنتُمْ فِي بُرُوجٍ مُّشَيَّدَةٍ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা সুদৃঢ় প্রাসাদে হলেও মৃত্যু তোমাদেরকে বরণ করতেই হবে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, বসবাস করার জন্য কিংবা ধন-সম্পদের হেফাযতের উদ্দেশ্যে সুদৃঢ় ও উত্তম গৃহ নির্মাণ করা তাওয়াক্কুল বা ভরসার পরিপন্থী কিংবা শরীয়তবিরুদ্ধ নয়।–(কুরতুবী)

মানুষ শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র অনুগ্রহেই নেয়ামত লাভ করেঃ  مَّا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ এখানে حَسَنَةٍ (হাসানাতিন)-এর দ্বারা নেয়ামতকে বোঝানো হয়েছে।

এ আয়াতের দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মানুষ যে সমস্ত নেয়ামত লাভ করে তা তাদের প্রাপ্য নয়, বরং একান্ত আল্লাহ্‌ তাআলার অনুগ্রহেই প্রাপ্ত হয়। মানুষ যত ইবাদত-বন্দেগীই করুক না কেন, তাতে সে কোন নেয়ামত লাভের অধিকারী হতে পারে না। কারণ, ইবাদত করার যে সামর্থ্য, তাও আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে লাভ হয়। তদুপরি আল্লাহ্ তাআলার অসংখ্য নেয়ামত তো রয়েছেই। এ সমস্ত নেয়ামত সীমিত ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে কেমন করে লাভ করা সম্ভব? বিশেষ করে আমাদের ইবাদত-বন্দেগী যদি আল্লাহ্ তাআলার শান মোতাবেক না হয়?

অতএব, মহানবী (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন-

“আল্লাহ্ তাআলার রহমত ব্যতীত কোন একটি লোকও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ বলা হল, “আপনিও কি যেতে পারবেন না”? তিনি বললেন, “না আমিও না।”-(মাযহারী)

বিপদাপদ মানুষের কৃতকর্মের ফলঃ এখানে وَمَا أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍ فَمِن نَّفْسِكَ -অর্থ হল বিপদাপদ।–(মাযহারী)

বিপদাপদ যদিও আল্লাহ্ তাআলাই সৃষ্টি করেন, কিন্তু তার কারণ হয় মানুষের কৃত অসৎকর্ম। মানুষটি যদি কাফের হয়ে থাকে, তবে তার উপর আপতিত বিপদাপদ তার জন্য সে সমস্ত আযাবের একটা সামান্য নমুনা হয়ে থাকে যা আখেরাতে তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে। বস্তুতঃ আখেরাতের আযাব এর চাইতে বহুগুণ বেশী। আর যদি লোকটি ঈমানদার হয়, তবে তার উপর আপতিত বিপদাপদ হয় তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত, যা আখেরাতে-

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ