আন নিসা, আয়াত ৭৬-৯১

পৃষ্ঠা নং-২৬৮

কুরআনের উপর গভীর চিন্তা-গবেষণা করুক, এটাই হল কুরআনের চাহিদা। কাজেই কুরআন সম্পর্কিত চিন্তা-গবেষণা কিংবা তার পর্যালোচনা করা শুধুমাত্র ইমাম-মুজতাহিদগণেরই একক দায়িত্ব-এমন মনে করা যথার্থ নয়। জ্ঞান-বুদ্ধির পর্যায়ের মতই অবশ্য চিন্তা-গবেষণা এবং পর্যালোচনারও বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। ইমাম-মুজতাহিদগণের গবেষণা-পর্যালোচনা একটি আয়াত থেকে বহু বিষয় উদ্ভাবন করবে। ওলামা সম্প্রদায়ের চিন্তা-ভাবনা এসব বিষয় উপলব্ধি করবে। আর সাধারণ মানুষ যখন নিজের ভাষায় কুরআনের তরজমা-অনুবাদ পড়ে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, তখন তাতে তাদের মনে সৃষ্টি হবে আল্লাহ্ তাআলার মহত্ত্বের ধারণা ও ভালবাসা। এটাই হল, কৃতকার্যতার মূল চাবিকাঠি। অবশ্য জনসাধারণের জন্য ভুল বোঝাবুঝি ও বিভ্রান্তি থেকে অব্যাহতি লাভ করার জন্য পর্যায়ক্রমিকভাবে কোন বিজ্ঞ আলেমের নিকট কুরআন পাঠ করা উত্তম। আর তা সম্ভব না হলে কোন নির্ভরযোগ্য তাফসীর অধ্যয়ন করবে এবং কোন জটিলতা বা সন্দেহ-সংশয় দেখা দিলে নিজের মনমতো তার কোন সমাধান করবে না, বরং বিজ্ঞ কোন আলেমের সাহায্য নেবে।

কুরআন ও সুন্নাহর তাফসীরের কয়েকটি শর্তঃ উল্লেখিত আয়াতের দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা-পর্যালোচনা করার অধিকার প্রতিটি লোকেরই রয়েছে। কিন্তু আমরা বলছি যে, চিন্তা-ভাবনা গবেষণা-পর্যালোচনার স্তরভেদ রয়েছে, সেমতে প্রত্যকে স্তরের হুকুমও পৃথক পৃথক। যে মুজতাহিদসুলভ গবেষণা দ্বারা কুরআনে হাকীমের ভেতর থেকে বিভিন্ন জটিল বিষয়ের মীমাংসাজনিত সিদ্ধান্ত বের করা হয়, তার জন্য তার লক্ষ্যসমূহ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করে নেয়া অপরিহার্য, যাতে নির্ভুল মর্ম নির্ণয় করা সম্ভব হবে। পক্ষান্তরে যদি তার পটভূমিকা সংক্রান্ত জ্ঞান মোটেই না থাকে, কিংবা স্বল্প পরিমাণ থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, একজন মুজতাহিদের যেসব গুণ-বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন তা তার মধ্যে নেই। বলাবাহুল্য, তাহলে সে আয়াতের দ্বারা যেসব মর্ম উদ্ভাবন করবে, তাও হবে ভ্রান্ত। এমতাবস্থায় আলেম সম্প্রদায় যদি সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেন, তবে তা হবে একান্তই ন্যায়সঙ্গত।

যে লোক কোন দিন কোন মেডিক্যাল কলেজের ছায়াও মাড়ায়নি, সে যদি আপত্তি তুলে বসে যে, দেশের চিকিৎসা ক্ষেত্রে চিকিৎসা শাস্ত্রে সনদপ্রাপ্ত ডাক্তারদের একক আধিপত্য কেন দেয়া হল? একজন মানুষ হিসাবে আমারও সে অধিকার রয়েছে। কিংবা কোন নির্বোধ যদি বলতে শুরু করে যে, দেশে নদীনালা, পুল-নর্দমা প্রভৃতি সংস্কার ও নির্মাণের ঠিকাদার শুধুমাত্র বিজ্ঞ প্রকৌশলীদেরকেই কেন দেয়া হবে? আমিও তো একজন নাগরিক হিসাবে এ দায়িত্ব পালনের অধিকারী। অথবা বিকৃত-বুদ্ধি কোন লোক যদি এমন আপত্তি তুলতে আরম্ভ করে যে, দেশের সংবিধান বা আইন-কানুনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে শুধু আইনবিদদের একছত্র অধিকার হবে কেন? আমিও একজন বুদ্ধিমান নাগরিক হিসাবে একাজ সম্পাদন করতে পারি। তখন নিঃসন্দেহে এসব লোককে বলা হবে যে, দেশের নাগরিক হিসাবে অবশ্যই এসব কাজ সমাধা করার অধিকার তোমারও রয়েছে, কিন্তু এ সমস্ত কার্য সম্পাদনের যোগ্যতা অর্জন করতে গিয়ে যে বছরের পর বছর মাথা ঘামাতে হয়, সুবিজ্ঞ শিক্ষকদের নিকট এসব শাস্ত্র ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় এবং সে জন্য যেসব সনদ হাসিল করতে হয়, তোমরাও প্রথমে সে কষ্টটুকু স্বীকার করে আস। তাহলে সন্দেহাতীতভাবে তোমরাও এ সমস্ত কার্য সম্পাদনে সমর্থ হবে। কিন্তু এ কথাগুলোই যদি কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মত সুক্ষ্ম ও জটিল কাজের বেলায় বলা হয়, তাহলে তখন আলেম সমাজের একছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে শ্লোগান উত্থিত হয়। তাহলে কি সমগ্র বিশ্বে শুধুমাত্র কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানটিই এমন লা-ওয়ারিস রয়ে গেছে যে, এ ব্যাপারে  যে কোন লোক নিজ নিজ ভঙ্গিতে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অধিকার সংরক্ষণ করবে। যদি সে লোক কুরআন-সুন্নাহ্‌র জ্ঞানার্জনে কয়েকটি মাসও ব্যয় না করে থাকে, তবুও কি?

কেয়াস একটি দলীলঃ এ আয়াতের দ্বারা এ কথাও বোঝা যাচ্ছে যে, কোন মাসআলার বিশ্লেষণ যদি কুরআন ও সুন্নাহ্‌র মধ্যে সরাসরি না পাওয়া যায়, তাহলে তাতেই চিন্তা-ভাবনা করে তার সমাধান বের করার চেষ্টা করা কর্তব্য। আর একেই শরীয়তের পরিভাষায় ‘কেয়াস’ বলা হয়।

বহু মতবিরোধ ও তার ব্যাখ্যাঃ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا এ আয়াতে উল্লেখিত اخْتِلَاف كَثِير (বা বহু মতবিরোধ) এর মর্ম এই যে, যদি কোন একটি বিষয়ে মতবিরোধ একটি হয়, তবে বহু বিষয়ে মতবিরোধও বহু হয়ে থাকে। -(বায়ানুল-কুরআন) কিন্তু এখানে (অর্থাৎ, কুরআনে) কোন একটি বিষয়েও কোন মতবিরোধ বা মতপার্থক্য নেই। অতএব, এটা একান্তভাবেই আল্লাহ্‌র কালাম। মানুষের কালামে এমন অপূর্ব সামঞ্জস্য হতেই পারে না। এর কোথাও না আছে ভাষালঙ্কারের কোন ত্রুটি, না আছে তাওহীদ, কুফর, কিংবা হারাম-হলালের বিবরণে কোন স্ববিরোধিতা ও পার্থক্য। তাছাড়া গায়েবী বিষয়সমূহের মাঝেও এমন কোন সংবাদ নেই, যা প্রকৃত বিষয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তদুপরি না আছে কুরআনের ধারাবাহিকতার কোন পার্থক্য যে, একটি হবে অলঙ্কারপূর্ণ আরেকটি হবে অলঙ্কারহীন। প্রত্যেক মানুষের ভাষ্য-বিবৃতি ও রচনা-সঙ্কলনে পরিবেশের কম-বেশী প্রভাব অবশ্যই থাকে- আনন্দের সময় তা এক ধরনের হয়, আবার বিষাদে হয় অন্য রকম। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হয় এক রকম, আবার অশান্তিপূর্ণ পরিবেশে অন্য রকম। কিন্তু কুরআন এ ধরনের যাবতীয় ত্রুটি, পার্থক্য ও স্ববিরোধিতা থেকে পবিত্র ও উর্ধ্বে। আর এটাই হল কালামে-এলাহী হওয়ার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

যাচাই না করে কোন কথা রটনা করা মহাপাপঃ এ আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, কোন শোনা কথা যাচাই, অনুসন্ধান ব্যতিরেকে বর্ণনা করা উচিত নয়। রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, “কোন লোকের পক্ষে মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কোন রকম যাচাই না করেই সমস্ত শোনা কথা প্রচার করে।”

অপর এক হাদীসে তিনি বলেছেনঃ “যে লোক এমন কোন কথা বর্ণনা করে, যার ব্যাপারে সে জানে যে, সেটি মিথ্যা, তাহলে সে দু’জন মিথ্যাবাদীর একজন মিথ্যাবাদী –(ইবনে-কাসীর)

উলুল-আমর কারাঃ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَىٰ أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنبِطُونَهُ مِنْهُمْ –আয়াতে উল্লেখিত إسْتنباط শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে কুপের গভীরতা থেকে পানি তোলা। সে জন্যই কুপ খননকালে প্রথম যে পানি বেরোয় তাকে আরবীতে ماء مستنبط বলা হয়। কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য হল কোন বিষয়ের গভীরে গিয়ে তার প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া।–(কুরতুবী)

‘উলুল-আমর বা দায়িত্বশীল লোক নির্ণয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ