পৃষ্ঠা নং-২৭০
শাস্তি কেয়ামতের দিনেই হোক, কিংবা পার্থিব জীবনেই হোক, যুদ্ধের ক্ষেত্রে যেমন আমার শক্তি অপরাজেয়, তেমনি শাস্তি দানের ক্ষেত্রেও আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।
সুপারিশের স্বরূপ, বিধি ও প্রকারভেদঃ مَّن يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً –এ আয়াতে শাফাআত অর্থাৎ, সুপারিশকে ভাল ও মন্দ দু’ভাগে বিভক্ত করার পর এর স্বরূপ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক সুপারিশ যেমন মন্দ নয়, তেমনি প্রত্যেক সুপারিশ ভালও নয়। আরও বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ভাল সুপারিশ করবে, সে সওয়াবের অংশ পাবে এবং যে ব্যক্তি মন্দ সুপারিশ করবে, সে আযাবের অংশ পাবে। আয়াতে ভাল সুপারিশের সাথে نَصِيبٌ শব্দ এবং মন্দ সুপারিশের সাথে كِفْلٌ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অভিধানে উভয় শব্দের অর্থই এক। অর্থাৎ, কোন কিছুর অংশবিশেষ। কিন্তু সাধারণ পরিভাষায় نَصِيبٌ শব্দটি ভাল অংশ এবং كِفْلٌ শব্দটি মন্দ অংশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যদিও কখনও ভাল অংশেও ব্যবহৃত হয়। যেমন, কুরআন পাকে كِفْلَيْنِ مِن رَّحْمَتِهِ (তাঁর রহমতের দু’টি অংশ) ব্যবহার করা হয়েছে।
شَفَاعَة –এর শাব্দিক অর্থ মিলিত হওয়া বা মিলিত করা। এ কারণেই আরবী ভাষায় شَفْعَةٌ শব্দ জোড় অর্থে এবং বিপরীতে وتر শব্দ বেজোড় অর্থে ব্যবহার করা হয়। অতএব, شَفَاعَة –এর শাব্দিক অর্থ এই দাঁড়ায় যে, কোন দুর্বল অধিকার প্রার্থীর সাথে স্বীয় শক্তি যুক্ত করে তাকে দেয়া কিংবা অসহায় একা ব্যক্তির সাথে নিজে মিলিত হয়ে তাকে জোড় করে দেয়া।
এতে জানা গেল যে, বৈধ শাফাআত ও সুপারিশের একটি শর্ত এই যে, যার পক্ষে সুপারিশ করা হবে, তার দাবী সত্য ও বৈধ হতে হবে এবং অপর শর্ত এই যে, দুর্বলতার কারণে সে স্বীয় দাবী প্রবলদের কাছে স্বয়ং উত্থাপন করতে পারবে না। এতে বোঝা গেল যে, অসত্য সুপারিশ করা অথবা অপরকে তা গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে মন্দ সুপারিশ। নিজ সম্পর্কে ব্যবহার করলে কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তিজনিত চাপ ও জবরদস্তি প্রয়োগ করা হলে জুলুম হওয়ার কারণে তাও অবৈধ। কাজেই এরূপ সুপারিশও মন্দ সুপারিশেরই অন্তর্ভুক্ত।
এখন আলোচ্য আয়াতের সারবস্তু এই যে, যে ব্যক্তি কারো বৈধ অধিকার ও বৈধ কাজের জন্যে বৈধ পন্থায় সুপারিশ করবে, সেও সওয়াবের অংশ পাবে। তেমনিভাবে যে ব্যক্তি কোন অবৈধ কাজের জন্যে অথবা অবৈধ পন্থায় সুপারিশ করবে, সে আযাবের অংশ পাবে।
অংশ পাওয়ার অর্থ এই যে, যার কাছে সুপারিশ করা হয়, সে যখন এ উৎপীড়িতের কিংবা বঞ্চিতের কার্যোদ্ধার করে দেবে, তখন কার্যোদ্ধারকারী ব্যক্তি যেমন সওয়াব পাবে, তেমনি সুপারিশকারীও সওয়াব পাবে।
এমনিভাবে কোন অবৈধ কাজের সুপারিশকারীও গোনাহ্গার হবে। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সুপারিশকারীর সওয়াব কিংবা আযাব তার সুপারিশ কার্যকরী ও সফল হওয়ার উপর নির্ভরশীল নয়; বরং সর্বাবস্থায় সে নিজ অংশ পাবে।
রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ “যে ব্যক্তি কোন সৎকাজে অপরকে উদ্বুদ্ধ করে, সেও ততটুকু সওয়াব পায়, যতটুকু সৎকর্মী পায়।” –(মাযহারী)
ইবনে মাজায় হযরত আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ্ (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানকে হত্যার কাজে একটি বাক্য দ্বারাও সাহায্য করে, তাকে কেয়ামতে আল্লাহ্ তাআলার সামনে উপস্থিত করা হবে এবং তার কপালে লিখিত থাকবেঃ “এ ব্যক্তি আল্লাহ্ অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত ও নিরাশ।” (মাযহারী)
এতে জানা গেল যে, সৎকাজে কাউকে উদ্বুদ্ধ করা যেমন একটি সৎকাজ তেমনি অসৎ ও পাপ কাজে কাউকে উদ্বুদ্ধ করা কিংবা সহযোগিতা প্রদান করা সমান গোনাহ্।
আয়াতের শেষ ভাগে বলা হয়েছেঃ وَكَانَ اللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ مُّقِيتًا আভিধানিক দিক দিয়ে مُقِيت শব্দের অর্থ তিনটিঃ (এক) শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান, (দুই) উপস্থিত ও দর্শক এবং (তিন) রুযী বন্টনকারী। উল্লেখিত বাক্যে তিনটি অর্থই প্রযোজ্য। প্রথম অর্থের দিক দিয়ে বাক্যের অর্থ হবে- আল্লাহ্ তাআলা প্রত্যেক বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। যে কাজ করে এবং যে সুপারিশ করে তাদেরকে প্রতিদান কিংবা শাস্তিদান তাঁর পক্ষে কঠিন নয়।
দ্বিতীয় অর্থের দিক দিয়ে বাক্যের অর্থ হবে- আল্লাহ্ তাআলা প্রত্যেক বস্তুর পরিদর্শক ও প্রত্যেক বস্তুর সামনে উপস্থিত। কে কোন্ নিয়তে সুপারিশ করে; আল্লাহ্র ওয়াস্তে মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যার্থে করে, না ঘুষ হিসেবে তার কাছ থেকে কোন মতলব হাসিলের উদ্দেশ্যে করে, তিনি সে সবই জানেন।
তৃতীয় অর্থের দিক দিয়ে বাক্যের মর্ম হবে রিযিক ও রুযী বন্টনের কাজে আল্লাহ্ স্বয়ং যিম্মাদার। যার জন্যে যতটুকু লিখে দিয়েছেন, সে ততটুকু অবশ্যই পাবে। কারো সুপারিশে তিনি প্রভাবিত হবেন না; বরং যাকে যতটুকু ইচ্ছা দেবেন। তবে সুপারিশকারী ব্যক্তি মাঝখান থেকে সওয়াব পেয়ে যাবে। কেননা, এটা হচ্ছে দুর্বলের সাহায্য।
হাদীসে বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ্ তাআলা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য অব্যাহত রাখেন, যতক্ষণ সে কোন মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যে ব্যাপৃত থাকে। তোমরা সুপারিশ কর, সওয়াব পাবে। অতঃপর আল্লাহ্ স্বীয় পয়গম্বরের মাধ্যমে যে ফয়সালা করেন তাতে সন্তুষ্ট থাক।’
এ কারণেই কুরআন পাকের ভাষায় ইঙ্গিত রয়েছে যে, সুপারিশের সওয়াব আযাব সুপারিশ সফল হওয়ার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং সুপারিশ করলেই সওয়াব সর্বাবস্থায় সওয়াব অথবা আযাব হবে। আপনি ভাল সুপারিশ করলেই সওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবেন এবং মন্দ সুপারিশ করলেই আযাবের যোগ্য হয়ে পড়বেন- আপনার সুপারিশ কার্যকরী হোক বা না হোক।
তাফসীরে বাহ্রে মুহীত, বায়ানুল-কুরআন প্রভৃতি গ্রন্থে مَن يَشْفَعْ বাক্যে مِنْهَا শব্দটিকে سبب সাব্যস্ত করে এদিকে ইঙ্গিত করে বলে বলা হয়েছে। তাফসীরে মাযহারীতে তাফসীরবিদ মুজাহিদের উক্তি বর্ণনা করা হয়েছে যে, সুপারিশকারী সুপারিশের সওয়াব পাবে, যদি তার সুপারিশ গ্রহণ করা নাও হয়। এ বিষয়টি শুধু রসূলুল্লাহ্ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-র সাথেই বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত নয়; বরং অন্যের কাছে সুপারিশ করেই সুপারিশকারী যেন ক্ষান্ত হয়ে যায়, তা গ্রহণ করতে বাধ্য করবে না। স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। হযরত আয়েশা (রদ্বিয়াল্লাহু আনহা)-র মুক্ত করা বাঁদী বারীরা স্বীয় স্বামী মুগীছের কাছ থেকে তালাক নিয়েছিলেন। তালাক দেয়ার পর মুগীছ-