পৃষ্ঠা নং-২০৫
করে নিয়ে অন্যের গুণের দিকে না তাকিয়ে স্বীয় কাজ করে যাওয়াই তার উচিত। কেননা, সে যদি নিজ ত্রুটির জন্যে অনুতাপ ও অন্যের গুণের জন্যে হিংসা করতে থাকে, তবে যতটুকু কাজ করা সম্ভব ততটুকুও করতে পারবে না এবং একেবারে অথর্ব হয়ে পড়বে।
এখানে প্রণিধানযোগ্য দ্বিতীয় বিষয়টি এই যে, আল্লাহ্ তাআলা আয়াতে ক্ষমাকে জান্নাতের পূর্বে উল্লেখ করে সম্ভবতঃ এদিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, জান্নাত লাভ করা আল্লাহ্র ক্ষমা ছাড়া সম্ভব নয়। কেননা, মানুষ যদি জীবনভর পূণ্য অর্জন করে এবং গোনাহ্ থেকে বেঁচে থাকে, তবুও তার সমগ্র পূণ্যকর্ম জান্নাতের মূল্য হতে পারে না। জান্নাত লাভের পন্থা মাত্র একটি। তা’হচ্ছে আল্লাহ্ তাআলার ক্ষমা ও অনুগ্রহ। রসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেছেনঃ
-‘সততা ও সত্য অবলম্বন কর মধ্যবর্তী পথ অনুসরণ কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহের সুসংবাদ লাভ কর। কারও কর্ম তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে না। শ্রোতারা বললোঃ আপনাকেও নয়কি-ইয়া রসূলুল্লাহ! উত্তর হলোঃ আমার কর্ম আমাকেও জান্নাতে নেবে না। তবে আল্লাহ্ যদি স্বীয় রহমত দ্বারা আমাকে আবৃত করে নেন।’
মোটকথা এই যে, আমাদের কর্ম জান্নাতের মূল্য নয়। তবে আল্লাহ্ তাআলার রীতি এই যে, তিনি স্বীয় অনুগ্রহ ঐ বান্দাকে দান করেন, যে সৎকর্ম করে। বরং সৎকর্মের সামর্থ্য লাভ হওয়াই আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টির লক্ষণ। অতএব সৎকর্ম সম্পাদনে ত্রুটি করা উচিত নয়। আল্লাহর ক্ষমাই জান্নাতে প্রবেশের আসল কারণহেতু এর প্রতি গুরুত্বদানের উদ্দেশ্যে একে এককভাবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্যে مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ বলা হয়েছে। ‘পালনকর্তা’ বিশেষণ উল্লেখ করার উদ্দেশ্য আরও কৃপা ও অনুগ্রহ প্রকাশ করা।
আয়াতে জান্নাত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এর বিস্তৃতি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সমান। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের চাইতে অধিক বিস্তৃত কোন বস্তু মানুষ কল্পনা করতে পারে না। এ কারণে বোঝানোর জন্যে জান্নাতের প্রশস্ততাকে এ দু’টির সাথে তুলনা করে বোঝানো হয়েছে যে, জান্নাত খুবই বিস্তৃত। প্রশস্ততাই যখন এমন, তখন দৈর্ঘ্য কতটুকু হবে, তা আল্লাহ্ই ভাল জানেন। আয়াতের এ ব্যাখ্যা তখন হবে, যখন عرض শব্দের অর্থ طول তথা দৈর্ঘ্যের বিপরীত নেয়া হয়। কিন্তু যদি এর অর্থ হয় ‘মূল্য’ তবে আয়াতের অর্থ হবে যে, জান্নাত কোন সাধারণ বস্তু নয়- এর মূল্য সমগ্র নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল। সুতরাং এহেন মূল্যবান বস্তুর প্রতি ধাবিত হও।
তাফসীর-কাবীরে বলা হয়েছে:
-“আবু মুসলিম বলেনঃ আয়াতে উল্লেখিত عرض শব্দের অর্থ ঐ বস্তু যা বিক্রিত বস্তুর মোকাবেলায় মূল্য হিসেবে পেশ করা হয়। উদ্দেশ্য এই যে, যদি জান্নাতের মূল্য ধরা হয়, তবে সমগ্র নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল এবং এতদুভয়ের সবকিছু হবে এর মূল্য। এতে করে জান্নাত যে বিশাল ও অমূল্য বিষয় তা প্রকাশ করাই লক্ষ্য।”
জান্নাতের দ্বিতীয় বিশেষণে বলা হয়েছেঃ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ অর্থাৎ জান্নাত মুত্তাকীগণের জন্যে নির্মিত হয়েছে। এতে বোঝা গেল যে, জান্নাত সৃষ্ট হয়ে গেছে। কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দ্বারা বোঝা যায় যে, জান্নাত সপ্তম আকাশের উপরে অবস্থিত এবং সপ্তম আকাশেই তার যমীন।
আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ্ তাআলা বিশ্বাসী মুত্তাকীদের বিশেষ গুণাবলী ও লক্ষণাদি বর্ণনা করেছেন। এসব গুণ ও লক্ষণের সাথে অনেক তাৎপর্য নিহিত। উদাহরণতঃ কুরআন পাক স্থানে স্থানে সৎলোকদের সংস্পর্শ ও তাদের শিক্ষা থেকে উপকৃত হওয়ার প্রতি জোর দিয়েছে। কোথাও صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ বলে দ্বীনের সরল ও বিশুদ্ধ পথ তাদের কাছ থেকে শিক্ষা করার প্রতি ইশারা করেছে এবং কোথাও وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ বলে তাদের সংস্পর্শের বিশেষ কার্যকারিতা নির্দেশ করেছে। জগতে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাল ও মন্দ উভয় প্রকার লোকই রয়েছে। ভাল লোকদের পোশাকে মন্দরাও অনেক সময় তাদের স্থান দখল করে বসে। এ কারণে সৎ ও মুত্তাকীদের বিশেষ লক্ষণ ও গুণাবলী বর্ণনা করে একথা বুঝিয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিল যে, মানুষ যেন ভ্রান্ত পথপদর্শক ও নেতাদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকে এবং সাচ্চা লোকদের লক্ষণ চিনে নিয়ে তাদের অনুসরণ করে। বিশ্বাসী মুত্তাকীদের গুণাবলী ও লক্ষণ বর্ণনা করার পর তাদের চিরস্থায়ী সাফল্য ও জান্নাতের উচ্চস্তর বিবৃত করে সৎলোকদের সুসংবাদ এবং অসৎ লোকদের জন্য উপদেশ ও উৎসাহ প্রদানের পথ খোলা হয়েছে। উপসংহারে هَٰذَا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ বলে এদিকেই ইশারা করা হয়েছ। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের যেসব গুণ ও লক্ষণ এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্য প্রাথমিক আয়াতসমূহে মানবীয় অধিকার ও পারষ্পরিক জীবন-যাপন সম্পর্কিত গুণাবলী ব্যক্ত হয়েছে। পরবর্তী আয়াত সমূহে আল্লাহ্ তাআলার ইবাদাত ও আনুগত্য সম্পর্কিত গুণাবলী উল্লেখিত হয়েছে। শব্দান্তরে প্রথমোক্ত গুণাবলীকে ‘হুকূকুল-ইবাদ’ (বান্দার হক) এবং শেষোক্ত গুণাবলীকে ‘হুকুকুল্লাহ’ (আল্লাহর হক) বলা যেতে পারে।
উল্লেখিত আয়াতসমূহে মানবীয় অধিকার সম্পর্কিত গুণাবলী আগে এবং আল্লাহর অধিকার সম্পর্কিত গুণাবলীকে পরে উল্লেখ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আসলের দিক দিয়ে যদিও আল্লাহর অধিকার সব অধিকারের চাইতে অগ্রগণ্য, তবুও এতদুভয়ের মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান। তা এই যে, আল্লাহ্ তাআলা বান্দার উপর স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন সত্য, কিন্তু এতে আল্লাহ্ তাআলার নিজস্ব কোন লাভ বা স্বার্থ নাই এবং এসব অধিকারের প্রয়োজনও তাঁর নাই। বান্দা এসব হক আদায় না করলে আল্লাহ্ তাআলার কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় না। তাঁর সত্তা সব কিছুর উর্ধ্বে। তাঁর ইবাদাত দ্বারা স্বয়ং ইবাদাতকারীই উপকৃত। তদুপরি তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দাতাও বটে। তাঁর অধিকারে সর্বাধিক ত্রুটিকারী ব্যাক্তি যখনই স্বীয় কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত হয়ে তাঁর দিকে ধাবিত হয় এবং তাওবা করে, তখনই তাঁর দয়ার দরবার থেকে এক নিমিষের মধ্যে তাওবাকারীর সব গোনাহ্ মাফ হয়ে যেতে পারে। হুকূকুল-ইবাদ কিন্তু এমন নয়। কেননা, বান্দা স্বীয় অধিকারের প্রতি মুখাপেক্ষী। তার প্রাপ্য অধিকার আদায় করা না হলে তার ভয়ানক ক্ষতি হয়। এ ক্ষতি মাফ করে দেয়াও বান্দার পক্ষে সহজ নয়। এ কারণেই বান্দার অধিকার বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী।
এতদ্ব্যতীত পারষ্পরিক অধিকার আদায়ের উপরই বিশ্বজগতের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও মানব সমাজের সংশোধন সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। এর সামান্য ত্রুটিই যুদ্ধ-বিগ্রহ ও গোলযোগের পথ খুলে দেয়। পক্ষান্তরে পারষ্পরিক অধিকার আদায়ের মাধ্যমে উত্তম চরিত্র প্রদর্শন করতে পারলে শত্রু ও মিত্রে পরিণত হয়ে পড়ে এবং শতাব্দীকালের যুদ্ধ ও শান্তি-