আলি ‘ইমরান, আয়াত ১৩৩-১৫৭

পৃষ্ঠা নং-২০৮

সবার পক্ষে সহজ নয়। রসূলুল্ল-হ স-ল্লাল্ল-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম— এর মহব্বতে যে সাহাবায়ে কেরাম স্বীয় ধন-দৌলত, সন্তান-সন্ততি, এমন কি প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করাকে জগতের সবচাইতে বড় সৌভাগ্য মনে করেছেন এবং কার্যক্ষেত্রে তার পরিচয়ও দিয়েছেন, তাঁদের আত্মনিবেদন ও ইশ্‌কে-রসূলের খবর যারা কিছুটা রাখেন, একমাত্র তারাই তাঁদের সে সময়কার মর্মন্তুদ অবস্থা কিছুটা অনুমান করতে পারেন।

এসব আশেকানে রসূল স-ল্লাল্ল-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘র কানে যখন এ সংবাদ প্রবেশ করেছিল, তখন তাঁদের অনুভূতি কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা একমাত্র আল্লাহ্‌ই জানেন। বিশেষ করে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে উত্তেজনা বিরাজ করছে, বিজয়ের পর পরাজয়ের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে, মুসলমান যোদ্ধাদের পা উপড়ে যাচ্ছে; এমনি সংকট মূহুর্তে যিনি ছিলেন সব প্রচেষ্টা ও অধ্যাবসায়ের মূল কেন্দ্র, সকল-আকাঙ্খার প্রতীক, তিনিও তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। এর স্বাভাবিক ফলশ্রুতি ছিল এই যে, সাহাবায়ে কেরামের একটি বিরাট দল ভয়ার্ত হয়ে রণাঙ্গন ত্যাগ করতে লাগলেন। এ পলায়ন জরুরী অবস্থা ও সাময়িক ভয় ভীতির পরিণতি ছিল। খোদা না-খাস্তা, এতে ইসলাম পরিত্যাগ করার কোন ইচ্ছা বা প্ররোচনা কার্যকর ছিল না। কিন্তু আল্ল-হ স্বীয় রসূলের সাহাবীদের এমন পবিত্র ফেরেশতা-তুল্য দল করতে চান, যারা হবে বিশ্বের জন্যে আদর্শ। এ কারণে তাদের সামান্য বিচ্যুতিকেও বিরাট আকারে দেখা হয়েছে।

যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করার কারণে সাহাবীগণের এমন কঠোর ভাষায় সম্বোধন করা হয়েছে, যেমন ইসলাম ত্যাগ করার কারণে করা যেতে পারে। তীব্র অসুন্তোষ প্রকাশের সাথেই এ মৌলিক বিষয়টির প্রতি হুশিয়ার করা হয়েছে যে, ধর্ম, ইবাদাত ও জেহাদ আল্লাহ তাআলার নিমিত্ত— যিনি চিরজীবি ও সদাপ্রতিষ্ঠিত। মহানবী সল্লাল্ল-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত্যু সংবাদ সত্য হলেও তাতে অসাধারণ কি? তাঁর মৃত্যু তো একদিন হবেই। এতে মনোবল হারিয়ে ফেলা এবং দ্বীনের কাজ ত্যাগ করা সাহাবায়ে-কেরামের পক্ষে শোভা পায় না। এ কারণেই বলা হয়েছেঃ

وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ  আয়াতে হুশিয়ার করা হয়েছে যে, রসূলুল্ল-হ স-ল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন না একদিন দুনিয়া থেকে বিদায় নেবেন। তাঁর পরও মুসলমানদের ধর্মের উপর অটল থাকতে হবে। এতে আরও বোঝা যায় যে, সাময়িক বিপর্যয়ের সময় হুযুর সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আহত হওয়া এবং তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পেছনে যে রহস্য ছিল, তা হলো তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সাহাবায়ে-কেরামের সম্ভাব্য অবস্থার একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলা— যাতে তাদের মধ্যে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে হুযুর স্ব-ল্লল্লা’হু আলাইহি ওয়া সল্ল-ম স্বয়ং তা সংশোধন করে দেন এবং পরে সত্যসত্যই যখন তাঁর ওফাৎ হবে, তখন আশেকানে-রসূল যেন সম্বিত হারিয়ে না ফেলেন। বস্তবে তাই হয়েছে। হুযুর স্ব-ল্লল্লা’হু আলাইহি ওয়া সল্ল-ম— এর ওফাতের সময় যখন প্রধান প্রধান সাহাবীগণও শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন, তখন হযরত আবূ বাক্‌র সিদ্দীক রদ্বিয়াল্ল-হু আনহু এ আয়াত তেলাওয়াত করেই তাদের সান্ত্বনা দেন।

অতঃপর দ্বিতীয় আয়াতেও বিপদাপদের সময় অটল থাকার শিক্ষা দিয়ে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের মৃত্যু আল্লাহ তাআলার কাছে লিপিবদ্ধ রয়েছে। মৃত্যুর দিন, তারিখ, সময় সবই নির্ধারিত, নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে কারও মৃত্যু হবে না এবং নির্দিষ্ট সময়ের পরেও কেউ জীবিত থাকবে না। এমতাবস্থায় কারও মৃত্যুতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ার কোন অর্থ নেই।

وَمَن يُرِدْ ثَوَابَ الدُّنْيَا আয়াতে ইশারা করা হয়েছে যে, গনীমতের মাল আহরণের চিন্তায় হুযুর সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম— এর অর্পিত কাজ ছেড়ে তারা ভুল করেছিল। স্মর্তব্য যে, গনীমতের মাল আহরণ করাও প্রকৃতপক্ষে নির্ভেজাল দুনিয়া কামনা নয়— যা শরীয়তে নিন্দনীয়, বরং যুদ্ধক্ষেত্রে গনীমতের মাল আহরণ করে সংরক্ষিত করা এবং নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাও জেহাদের অংশবিশেষ এবং ইবাদাত। উপরোক্ত সাহাবীগণ শুধু জাগতিক লালসার বশবর্তী হয়ে এতে অংশগ্রহণ করেন নি। কেননা, তাঁরা যদি এ মাল আহরণে অংশগ্রহণ নাও করতেন, তবুও শরীয়তের আইন অনুযায়ী তাঁরা ঐ অংশই পেতেন, যা অংশ গ্রহণের পর পেয়েছেন। কাজেই তাঁরা জাগতিক লোভ-লালসার কারণে স্থান ত্যাগ করেছিলেন একথা বলা যায় না। কিন্তু পূর্বোক্ত আয়াতের তাফসীরেও বলা হয়েছে যে, বড়দের সামান্য বিচ্যুতিকেই অনেক বড় মনে করা হয়। মামুলী অপরাধকে কঠোর অপরাধ গণ্য করে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। গনীমতের মাল আহরণ করার সাথে কিছু না কিছু জাগতিক ফায়দার সম্পর্ক অবশ্য ছিল। এ সম্পর্কের মন্দ প্রভাব অন্তরে প্রতিফলিত হওয়াও অসম্ভব ছিল না। কাজেই সাহাবয়ে-কেরামের চারিত্রিক মানকে সমুন্নত রাখার জন্যে তাদের এ কার্যকে ‘দুনিয়া কামনা’ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে— যাতে জাগতিক লালসার সামান্য ধুলিকণাও তাঁদের অন্তরে স্থান লাভ করতে না পারে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ