পৃষ্ঠা নং-২১১
এবং সংশোধনের জন্য ছিল, তা সুস্পষ্ট। যে কোন পিতা তার পুত্রকে এবং ওস্তাদ তাঁর শাগরেদকে যে যৎসামান্য শাসন করে থাকেন, তাকেও প্রচলিত পরিভাষায় শাস্তি বলেই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটা প্রশিক্ষণ ও সংশোধনেরই একটা রূপ এবং শাসকসুলভ শাস্তি থেকে ভিন্নতর।
ওহুদের ঘটনায় মুসলমানদের উপর বিপদ আসার কারণঃ উল্লেখিত বাক্য لِيَبْتَلِيَكُمْ থেকে আয়াতের শেষ পর্যন্ত যা কিছু বলা হয়েছে তাতে তো একথাই বোঝা যায় যে, এসব বিপদের কারণ ছিল একান্তই আল্লাহর ইচ্ছা, কিন্তু পরবর্তী আয়াতে إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا বাক্যের দ্বারা বোঝা যায় যে, সেই সাহাবিগণের পূর্ববর্তী কোন কোন পদস্খলনই এই প্রতিক্রিয়ার কারণ।
এর উত্তর এই যে, বাহ্যিক কারণ অবশ্য সে পদস্খলনই ছিল, যার ভিত্তিতে তাদের দ্বারা আরো কিছু পাপ করিয়ে নেয়ার জন্য শয়তান প্রলুব্ধ হয় এবং ঘটনাচক্রে তার সে লোভ চরিতার্থও হয়ে যায়। কিন্তু এই পদস্খলন এবং তার পশ্চাদবর্তী ফলাফলের মাঝে নিহিত ছিল এই মৌলিক তাৎপর্য لِيَبْتَلِيَكُمْ বাক্যে যা বর্ণনা করা হয়েছে। রূহুল-মা’আনী গ্রন্থে যুজাজ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, -শয়তান তাঁদেরকে এমন কতিপয় পাপের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেগুলো নিয়ে আল্লাহ্ তাআলার সামনে উপস্থিত হওয়া সমীচীন মনে হয়নি। সে কারণেই তারা জেহাদ থেকে সরে পড়েন, যাতে নিজেদের অবস্থার সংশোধন করে পছন্দনীয় অবস্থায় জেহাদ করতে পারেন এবং শহীদ হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে উপস্থিত হতে পারেন।
এক পাপও অপর পাপের কারণ হতে পারেঃ উল্লেখিত আয়াতের দ্বারা বোঝা গেল যে, একটি পাপ অপর একটি পাপকে টেনে আনে। যেমন একটি পুণ্য আরেকটি পুণ্যকে টেনে আনে। অর্থাৎ, পাপকর্ম ও পূণ্যকর্মের মধ্যে একটা আকর্ষণীশক্তি বিদ্যমান রয়েছে। মানুষ যখন কোন একটা পূণ্য বা নেকী সম্পাদন করে, অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, তখন তার পক্ষে অন্যান্য পূণ্যকর্ম সম্পাদন করা সহজ হয়ে যায়। তার মনে নেক কাজের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তেমনিভাবে মানুষ যখন কোন পাপ কার্য সম্পাদন করে ফেলে তখন তা অন্যান্য পাপের পথও সুগম করে দেয়; মনের মধ্যে পাপের আগ্রহ বেড়ে যায়।
আল্লাহর নিকট সাহাবায়ে-কেরামের মর্যাদাঃ ওহুদের ঘটনায় কোন কোন সাহাবীর দ্বারা যেসব পদস্খলন ও অপরাধ সংঘটিত হয়ে গিয়েছিল, তা ছিল অত্যন্ত কঠিন। পঞ্চাশ জন সাহাবীকে যে অবস্থানে সেখান থেকে না সরার নির্দেশ দিয়ে বসানো হয়েছিল, তাঁদের অধিকাংশই সেখান থেকে সরে গিয়েছিলেন। এই সরে পড়ার পেছনে যদিও তাঁদের এই ধারণা কার্যকর ছিল যে, এখন বিজয় অর্জিত হয়ে গেছে এবং এই নির্দেশ পালন করার প্রয়োজনীয়তা আর অবশিষ্ট নাই। কাজেই এখন নীচে নেমে গিয়ে মুসলমানদের সাথে মিলিত হওয়া কর্তব্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা মহানবী (সাঃ)-এর পরিষ্কার হেদায়েতের বিরুদ্ধাচরণই ছিল। এই অন্যায় ও ত্রুটির ফলেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নের ভুলটি সংঘটিত হয়; যদিও এ ব্যাপারেও কোন কোন বিশ্লেষণের সাহায্য নেয়া হয়ে থাকে। যেমন যুজাজ থেকে উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে। তারপর এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া এমন এক অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়, যখন রসূলে কারীম (সাঃ) স্বয়ং তাদের সাথে রয়েছেন এবং পেছন থেকে তাদেরকে ডাকছেন। এসব বিষয়কে যদি ব্যক্তিত্ব এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে পৃথক করে দেখা যায়, তবে নিঃসন্দেহে এটা এত কঠিন ও ভয়ানক অপরাধ ছিল যে, সাহাবিগণ সম্পর্কে বিরুদ্ধবাদীরা যেসব অপবাদ আরোপ করে থাকে, এটা সেসব অপবাদগুলোর মধ্যকার কঠিন অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
কিন্তু লক্ষণীয় যে, আল্লাহ্ তাআলা সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও পদস্খলন সত্ত্বেও এদের সাথে কি আচরণ করেছেন? উল্লেখিত আয়াতে সে প্রসঙ্গটি সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। প্রথমতঃ বাহ্যিক নেয়ামত তন্দ্রা অবতরণ করে তাদের ক্লান্তি শ্রান্তি ও হতাশা দূর করে দেয়া। তারপর বলে দেয়া হয় যে, তখন মুসলমানদের উপর যে বিপদ এসেছিল, তা শাস্তি কিংবা আযাব ছিল না; বরং তাতে কিছুটা অভিভাবকসুলভ শাসনের লক্ষও নিহিত ছিল। অতঃপর পরিষ্কার ভাষায় তাঁদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।
সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে একটি শিক্ষাঃ এখান থেকেই আহলে সুন্নত ওয়াল জমাতের সেই আকীদা ও বিশ্বাসের সমর্থন হয় যে, যদিও সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) সম্পূর্ণভাবে নিষ্পাপ নন, তাঁদের দ্বারা বড় কোন পাপ সংঘটিত হয়ে যাওয়া সম্ভব এবং হয়েছেও; কিন্তু তা সত্ত্বেও উম্মতের জন্যে তাঁদের কোন দোষচর্চা কিংবা দোষ আরোপ করা জায়েয নয়। আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলই (সাঃ) যখন তাঁদের এত বড় পদস্খলন ও অপরাধ মার্জনা করে তাঁদের প্রতি দয়া ও করুণাপূর্ণ ব্যবহার করেছেন এবং তাঁদেরকে ‘রাদিয়াল্লাহু আনহু ওয়া রাদূ আনহু’ –এর মর্যাদায় ভুষিত করেছেন, তখন তাঁদেরকে কোন প্রকার অশালীন উক্তিতে স্মরণ করার কোন অধিকার অপর কারো পক্ষে কেমন করে থাকতে পারে?
সে জন্যই এক সময় কোন এক সাহাবী যখন হযরত ওসমান ও অন্যান্য কয়েকজন সাহাবী সম্পর্কে ওহুদ যুদ্ধের এই ঘটনার আলোচনায় বলেছেন যে, এরা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন; তখন হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর বললেন, -আল্লাহ্ নিজে যে বিষয়ের ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছেন, সে বিষয়ে সমালোচনা করার কোন অধিকার কারো নেই।– (সহীহ বুখারী)
হাফেজ ইবনে-তাইমিয়াহ্ (রাঃ) আকীদায়ে-ওয়াস্তিয়া-গ্রন্থে বলেছেন:
-‘আহলে-সুন্নত ওয়াল জামাতের আকীদা হলো সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যেসব মতবিরোধ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটেছে, সে সম্পর্কে কারো প্রতি কোন আপত্তি উত্থাপন কিংবা প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা। কারণ, ইতিহাসে যেসব রেওয়ায়াতে তাঁদের ত্রুটি-বিচ্যুতিসমূহকে তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মিথ্যা ও ভ্রান্ত যা শত্রুরা রটিয়েছে। আর কোন কোন ব্যাপার রয়েছে যেগুলোতে কম-বেশী করে মূল বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা সংযুক্ত করা হয়েছে। আর যেগুলো প্রকৃতই শুদ্ধ সেগুলোও একান্তই সাহাবীগণের স্ব স্ব ইজতেহাদের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়েছে বিধায় তাঁদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করা সমীচীন নয়। বস্তুতঃ ঘটনা বিশেষের মধ্যে যদি তারা সীমালঙ্ঘন করেও থাকেন, তবুও আল্লাহ্ তা’আলার রীতি হলো إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ অর্থাৎ সৎকাজের মাধ্যমে অসৎ কর্মের কাফ্ফারা হয়ে যায়। বলাবাহুল্য সাহাবায়ে কেরামের সৎকর্মের সমান অন্য কারো কর্মই হতে পারে না। কাজেই তাঁরা আল্লাহ্ তা’আলার ক্ষমার যতটুকু যোগ্য, তেমন অন্য কেওই নয়। সে জন্যই তাদের আমল সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার অন্য কারো নেই। তাদের ব্যাপারে কটুক্তি বা অশালীন মন্তব্য করার অধিকারও অন্য কারো নেই।–(আকীদায়ে-ওয়াস্তিয়া)।