سُورَةُ آلِ عِمۡرَانَ
সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩
পৃষ্ঠা নং-১৬৩
(মাদীনায় অবতীর্ণ: আয়াত ২০০)
পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহ্র নামে শুরু করছি।
الٓمٓ ١
১. আলিফ লাম মীম।
ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡحَيُّ ٱلۡقَيُّومُ ٢
২. আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক।
نَزَّلَ عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَأَنزَلَ ٱلتَّوۡرَىٰةَ وَٱلۡإِنجِيلَ ٣
৩. তিনি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন সত্যতার সাথে; যা সত্যায়ন করে পূর্ববর্তী কিতাবসমুহের।
مِن قَبۡلُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَأَنزَلَ ٱلۡفُرۡقَانَۗ إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بَِٔايَٰتِ ٱللَّهِ لَهُمۡ عَذَابٞ شَدِيدٞۗ وَٱللَّهُ عَزِيزٞ ذُو ٱنتِقَامٍ ٤
৪. নাযিল করেছেন তাওরত ও ইঞ্জিল, এ কিতাবের পূর্বে, মানুষের হেদায়েতের জন্যে এবং অবতীর্ণ করেছেন মীমাংসা। নিঃসন্দেহে যারা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করে, তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন আযাব। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশীল, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।
إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَخۡفَىٰ عَلَيۡهِ شَيۡءٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فِي ٱلسَّمَآءِ ٥
৫. আল্লাহর নিকট আসমান ও যমীনের কোন বিষয়ই গোপন নেই।
هُوَ ٱلَّذِي يُصَوِّرُكُمۡ فِي ٱلۡأَرۡحَامِ كَيۡفَ يَشَآءُۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٦
৬. তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করেন মায়ের গর্ভে, যেমন তিনি চেয়েছেন। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। তিনি প্রবল পরাক্রমশীল, প্রজ্ঞাময়।
هُوَ ٱلَّذِيٓ أَنزَلَ عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ مِنۡهُ ءَايَٰتٞ مُّحۡكَمَٰتٌ هُنَّ أُمُّ ٱلۡكِتَٰبِ وَأُخَرُ مُتَشَٰبِهَٰتٞۖ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمۡ زَيۡغٞ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَٰبَهَ مِنۡهُ ٱبۡتِغَآءَ ٱلۡفِتۡنَةِ وَٱبۡتِغَآءَ تَأۡوِيلِهِۦۖ وَمَا يَعۡلَمُ تَأۡوِيلَهُۥٓ إِلَّا ٱللَّهُۗ وَٱلرَّٰسِخُونَ فِي ٱلۡعِلۡمِ يَقُولُونَ ءَامَنَّا بِهِۦ كُلّٞ مِّنۡ عِندِ رَبِّنَاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٧
৭. তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর, তারা বলেনঃ আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এই সবই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আর বোধশক্তি সম্পন্নেরা ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।
رَبَّنَا لَا تُزِغۡ قُلُوبَنَا بَعۡدَ إِذۡ هَدَيۡتَنَا وَهَبۡ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحۡمَةًۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡوَهَّابُ ٨
৮. হে আমাদের পালনকর্তা! সরল পথ প্রদর্শনের পর তুমি আমাদের অন্তরকে সত্যলংঘনে প্রবৃত্ত করোনা এবং তোমার নিকট থেকে আমাদিগকে অনুগ্রহ দান কর। তুমিই সব কিছুর দাতা।
আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:
সর্বকালের সব পয়গম্বরই তাও‘হীদের প্রতি দা’ওয়াত দিয়েছেন: দ্বিতীয় আয়াতে তাও‘হীদের ইতিহাসভিত্তিক প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। যেমন, মনে করুন, কোন একটি বিষয়ে বিভিন্ন দেশের অধিবাসী ও বিভিন্ন সময়ে জন্মগ্রহণকারী সব মানুষ একমত। পূর্বাপর এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে শত শত, এমন কি হাজার হাজার বছরের ব্যবধান। একজনের উক্তি অন্য জনের কাছে পৌঁছারও কোন উপায় নেই। তা সত্ত্বেও যে-ই আসেন তিনিই যদি পূর্ববর্তীদের মত একই কথা বলেন এবং সবাই একই কর্ম ও একই বিশ্বাসের অনুসারী হন, তবে এমন বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করে নিতে মানব-স্বভাব বাধ্য। উদাহরণত: আল্লাহ্ তা‘আলার অস্তিত্ব ও তাঁর তাও‘হীদের পরিচিতি সম্পর্কিত তথ্যাদিসহ সর্বপ্রথম হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) দুনিয়াতে পদার্পণ করেন। তাঁর ওয়াফাতের পর তাঁর বংশধরদের মধ্যেও এই তথ্যের চর্চা প্রচলিত ছিল। কিন্তু দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার পর এবং আদম সন্তানদের প্রাথমিক কালের আচার-অভ্যাস, সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রভৃতি সর্ববিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত হওয়ার পর হযরত নূ‘হ (‘আলাইহিচ্ছালাম) আগমন করেন। তিনিও মানুষকে আল্লাহ্ সম্পর্কিত ঐসব তত্ত্বের প্রতি দা’ওয়াত দিতে থাকেন, যেসব বিষয়ের প্রতি আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) দা’ওয়াত দিতেন। অতঃপর সুদীর্ঘকাল অতীতের গর্ভে বিলীন হওয়ার পর ইব্রাহীম, ইসমা‘ঈল, ইস‘হাক ও ইয়া’কূব (‘আলাইহিমুচ্ছালাম) ইরাক ও সিরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরাও হুবহু একই দা’ওয়াত নিয়ে কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করেন। এরপর মূসা ও হারূন (‘আলাইহিমাচ্ছালাম) এবং তাঁদের বংশের পয়গম্বরগণ আগমন করেন। তাঁরা সবাই সে একই কালিমায়ে তাও‘হীদের বানী প্রচার করেন এবং এ কালিমার প্রতি মানুষজনকে দা’ওয়াত দিতে থাকেন। এর পরও দীর্ঘকাল অতিবাহিত হয়ে গেলে হযরত ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) সেই একই আহ্বান নিয়ে আগমন করেন। সবার শেষে খ-তামুল-আম্বিয়া হযরত মু‘হাম্মাদ মুস্তফা (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) একই তাও‘হীদের দা’ওয়াত নিয়ে দুনিয়াতে আবির্ভুত হন।
মোটকথা, হযরত আদম থেকে শুরু করে শেষনবী হযরত মু‘হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষায় এবং বিভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণ করেন এবং সবাই একই বাণী উচ্চারণ করেন। তাঁদের অধিকাংশেরই পরস্পর দেখা-সাক্ষাত হয়নি। তাঁদের আবির্ভাবকালে গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশনার আমলও ছিল না যে, এক পয়গম্বর অন্য পয়গম্বরের গ্রন্থাদি ও রচনাবলী পাঠ করে তাঁর দা’ওয়াতের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করবেন। বরং সচরাচর তাঁদের একজন অন্যজন থেকে বহু শতাব্দী পরে জন্মগ্রহণ করেছেন। জাগতিক উপকরণাদির মাধ্যমে পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের কোন অবস্থা তাঁদের জানা থাকারও কথা নয়। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ও‘হী লাভ করেই তাঁদেরকে এ দা’ওয়াত প্রচার করার জন্যে নিযুক্ত করা হয়।
এখন যে ব্যক্তি ইসলাম ও তাও‘হীদের দা’ওয়াতের প্রতি মনে মনে কোনরূপ বইরীভাব পোষণ করে না, সে যদি খোলা মনে, সরলভাবে চিন্তা করে যে, এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মানুষ বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন দেশে একই সত্যের কথা বর্ণনা করলে তা মিথ্যা হতে পারে কি? তবে এতটুকু চিন্তাই তার পক্ষে তাও‘হীদের সত্যতা অকুন্ঠচিত্তে স্বীকার করে নেয়ার জন্যে যথেষ্ট। এক্ষেত্রে বর্ণনাকারী ব্যক্তিবর্গ নির্ভরযোগ্য কি না, তা যাচাই করার প্রয়োজন থাকে না। বরং বিভিন্ন সময়ে জন্মগ্রহণকারী এত বিপুল-
পৃষ্ঠা নং-১৬৪
সংখ্যক লোকের এক বিষয়ে একমত হওয়াই বিষয়টির সত্যতা নিরুপণের জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু পয়গম্বরগণের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, তাঁদের সততা ও সাধুতার উচ্চতম মাপকাঠির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে কারও পক্ষে এরূপ বিশ্বাস করা ছাড়া গত্যন্তর নেই যে, তাঁদের বাণী ষোল আনাই সত্য এবং তাঁদের দা’ওয়াতে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জগতেরই মঙ্গল নিহিত।
প্রথম দিকের দুই আয়াতে বর্ণিত তাও‘হীদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিভিন্ন ‘হাদীসে বলা হয়েছে যে, -কিছু সংখ্যক খ্রীষ্টান একবার হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে ধর্মীয় আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়। তিনি আল্লাহ্র নির্দেশে তাদের সামনে তাও‘হীদের দু’একটি প্রমাণ উপস্থিত করলে খ্রীষ্টানরা নিরুত্তর হয়ে যায়।
তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতেও তাওহী‘দের বিষয়বস্তু বিধৃত হয়েছে। তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলার সর্বব্যাপী জ্ঞানের বর্ণনা রয়েছে যে, এ জ্ঞান থেকে কোন জাহানের কোন কিছু গোপন নয়।
চতুর্থ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলার পরিপূর্ণ শক্তি এবং সর্ববিষয়ে সার্বিক সামর্থ্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি মানুষকে জননীর উদরে তিনটি অন্ধকার পর্যায়ে কিরূপ নিপুণভাবে গঠন করেছেন। তাদের আকার-আকৃতি ও বর্ণ বিন্যাসে এমন শিল্পীসুলভ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন যে, আকৃতি ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে একজনের আকার-আকৃতি অন্যজনের সাথে এমন মিল খায় না যে, স্বতন্ত্র পরিচয় দুরুহ হয়ে পড়ে। এহেন সর্বব্যাপী জ্ঞান ও পরিপূর্ণ শক্তি-সামর্থ্যের যুক্তিসঙ্গত দাবী এই যে, উপাসনা একমাত্র তাঁরই করতে হবে। তিনি ছাড়া আর কারো জ্ঞান ও শক্তি-সামর্থ্য এরূপ নয়। কাজেই অন্য কেওই উপাসনার যোগ্যও নয়।
এভাবে তাও‘হীদ সপ্রমাণ করার জন্যে আল্লাহ্ তা‘আলার প্রধান চারটি ‘সিফাত’ (গুণ) চারটি আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে চিরঞ্জীব ও সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী হওয়ার সিফাত বা গুণ এবং তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ আয়াত পর্যন্ত সর্বব্যাপী জ্ঞান ও সার্বিক শক্তি-সামর্থ্যের সিফাত বর্ণিত হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ চারটি গুণেই যে সত্তা গুণান্বিত, তিনিই একমাত্র উপাসনার যোগ্য।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা খ্রীষ্টানদের বিভ্রান্তিকর মন্তব্যের মূলোৎপাটন করেছেন। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, কুরআনের এসব বাক্য ‘মুতাশাবিহাত’ অর্থাৎ, রূপক। এসব বাক্যের বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। এগুলো আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রসূলের (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) মধ্যকার একটা গোপন রহস্য। এগুলোর প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে সর্ব সাধারণ অবগত হতে পারে না, বরং এসব শব্দের তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া সাধারণ মানুষের জন্যে বৈধ নয়। এগুলো সম্পর্কে বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরী যে, এসব বাক্য দ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলার যা উদ্দেশ্য, তা সত্য। এর অতিরিক্ত ঘাটা-ঘাটি করার অনুমতি নেই।
প্রথম আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনের সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট বা রূপক আয়াতের কথা উল্লেখ করে একটি সাধারণ মূলনীতি ও নিয়মের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এ মূলনীতিটি বুঝে নেয়ার পর অনেক আপত্তি ও বাদানুবাদের অবসান ঘটে। এর ব্যাখ্যা এরূপ: কুরআন মাজীদে দুই প্রকার আয়াত রয়েছে। এক প্রকারকে ‘মুহকামাত’ তথা সুস্পষ্ট আয়াত এবং অপর প্রকারকে ‘মুতাশাবিহাত’ তথা অস্পষ্ট ও রূপক আয়াত বলা হয়।
‘আরবী ভাষার নিয়মাবলী সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত ব্যক্তি যেসব আয়াতের অর্থ সুস্পষ্টরূপে বুঝতে পারে, সেসব আয়াতকে মু‘হকামাত বলে এবং এরূপ ব্যক্তি যেসব আয়াতের অর্থ স্পষ্টরূপে বুঝতে সক্ষম না হয়, সেসব আয়াতকে মুতাশাবিহাত বলে। (মাযহারী, ২য় খন্ড)
প্রথম প্রকার আয়াতকে আল্লাহ্ তা‘আলা ‘উম্মুল কিতাব’ আখ্যা দিয়েছেন। এর অর্থ এই যে, এসব আয়াতই সমগ্র শিক্ষার মূল ভিত্তি। এসব আয়াতের অর্থ যাবতীয় অস্পষ্টতা ও জটিলতা মুক্ত।
দ্বিতীয় প্রকার আয়াতে বক্তার উদ্দেশ্য; অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট হওয়ার কারণে এগুলো সম্পর্কে বিশুদ্ধ পন্থা এই যে, এসব আয়াতকে প্রথম প্রকার আয়াতের আলোকে দেখতে হবে। যে অর্থ প্রথম প্রকার আয়াতের বিপক্ষে যায়, তাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে বক্তার এমন উদ্দেশ্য বুঝতে হবে, যা প্রথম প্রকার আয়াতের বিপক্ষে নয়। এ ব্যাপারে স্বীকৃত মুলনীতি কিংবা কোন ব্যাখ্যা অথবা, কদর্থ করা বৈধ নয়। উদাহরণত: হযরত ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) সম্পর্কে কুরআনের সুস্পষ্ট উক্তি এরূপ إِنْ هُوَ إِلَّا عَبْدٌ أَنْعَمْنَا عَلَيْهِ (সে আমার নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা ছাড়া অন্য কেউ নয়)। অন্যত্র বলা হয়েছে:
إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِندَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ ۖ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ
অর্থাৎ, আল্লাহ্র কাছে ‘ঈসার উদাহরণ হচ্ছে আদমের অনুরূপ। আল্লাহ্ তাকে সৃষ্টি করেছেন মৃত্তিকা থেকে।
এসব আয়াত এবং এই ধরনের অন্যান্য আয়াত থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) আল্লাহ্ তা‘আলার মনোনীত বান্দা এবং তাঁর সৃষ্ট। অতএব ‘তিনি উপাস্য, তিনি আল্লাহ্র পুত্র’ –খ্রীষ্টানদের এসব দাবী সম্পূর্ণ বানোয়াট।
এখন যদি কেউ এসব সুস্পষ্ট প্রমাণ থেকে চোখ বন্ধ করে শুধু ‘আল্লাহ্র বাক্য’ এবং ‘আল্লাহ্র আত্মা’ ইত্যাদি অস্পষ্ট আয়াত সম্বল করে হঠকারিতা শুরু করে দেয় এবং এগুলোর এমন অর্থ নেয়, যা সুস্পষ্ট আয়াত ও পরস্পরাগত বর্ণনার বিপরীত, তবে একে তার বক্রতা ও হঠকারিতা ছাড়া আর কি বলা যায়?
কারণ, অস্পষ্ট আয়াতসমূহের নির্ভুল উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলাই জানেন। তিনিই কৃপা ও অনুগ্রহপুর্বক যাকে যতটুকু ইচ্ছা জানিয়ে দেন। সুতরাং এমন অস্পষ্ট আয়াত থেকে কষ্টকল্পনার আশ্রয় নিয়ে স্বমতের অনুকূলে কোন অর্থ বের করা শুদ্ধ হবে না।
فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ- এ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বর্ণনা করেন যে, যারা সুস্থ স্বভাব-সম্পন্ন তারা অস্পষ্ট আয়াত নিয়ে বেশী তথ্যানুসন্ধান ও ঘাটাঘাটি করে না; বরং তাঁরা সংক্ষেপে বিশ্বাস করে যে, এ আয়াতটিও আল্লাহ্র সত্য কালাম। তবে তিনি কোন বিশেষ হেকমতের কারণে এর অর্থ সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেননি প্রকৃতপক্ষে এ পন্থাই বিপদমুক্ত ও সতর্কতাযুক্ত। এর বিপরীতে কিছুসংখ্যক লোক এমনও আছে, যাদের অন্তর বক্রতাযুক্ত। তারা সুস্পষ্ট আয়াত থেকে চক্ষু বন্ধ করে অস্পষ্ট আয়াত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিতে লিপ্ত থাকে এবং তা থেকে নিজ মতলবের অনুকূলে অর্থ বের করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস পায়। এরূপ লোকদের সম্পর্কে কুরআন ও ‘হাদীসে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।
পৃষ্ঠা নং-১৬৫
وَالرّٰسِخُوْنَ فِی الْعِلْمِ یَقُوْلُوْنَ اٰمَنَّا بِهٖ ۙ -‘জ্ঞানে গভীরতার অধিকারি’ কারা? এ সম্পর্কে আলেমগণের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। অধিকতর গ্রহনযোগ্য উক্তি এই যে, এরা হলেন আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল-জামা‘আহ তাঁরা কুরআন ও সুন্নাহর সে ব্যাখ্যাই বিশুদ্ধ মনে করেন, যা সাহাবায়ে কেরাম, পূর্ববর্তী মনীষীবৃন্দ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের ইজমায় বর্ণীত রয়েছে। তাঁরা সুস্পষ্ট আয়াতসমূহকে কুরআনী শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু মনে করেন এবং অস্পষ্ট আয়াতসমূহের যেসব অর্থ তাঁদের বোধগম্য নয়, নিজেদের জ্ঞানের দৈন্য স্বীকার করে সেগুলোকে তাঁরা আল্লাহ্র নিকটই সোপর্দ করেন। তাঁরা স্বীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ঈমানী শক্তির জন্য গর্বিত নন, বরং সর্বদা আল্লাহ্র কাছে দৃঢ়তা ও অধিকতর জ্ঞান-গরিমা ও অন্তর-দৃষ্টি কামনা করতে থাকেন। তাঁদের মন-মস্তিস্ক অস্পষ্ট আয়াতসমূহের পেছনে পড়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে উৎসাহী নয়। তাঁরা সুস্পষ্ট ও অস্পষ্ট উভয় প্রকার আয়াতকে সত্য মনে করেন। কারণ তাঁদের বিশ্বাস এই যে, উভয় প্রকার আয়াত একই উৎস থেকে আগত। তবে এক প্রকার, অর্থাৎ সুস্পষ্ট আয়াতের অর্থ জানা আমাদের জন্যে উপকারী ও জরুরী ছিল, এজন্যে আল্লাহ্ তা‘আলা তা গোপন রাখেননি, বরং খোলাখুলি বর্ণনা করে দিয়েছেন এবং অন্য প্রকার অর্থাৎ অস্পষ্ট আয়াতের অর্থ আল্লাহ তা‘আলা বিশেষ হেকমতের কারণে বর্ণনা করেননি। কাজেই তা জানা আমাদের জন্য জরুরী নয়। সংক্ষেপে এরূপ আয়াতে বিশ্বাস স্থাপন করাই যথেষ্ট। (মাযহারী)
প্রথম আয়াত দ্বারা জানা যায় যে, পথ-প্রদর্শন ও পথভ্রষ্টটা আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই আসে। আল্লাহ্ যাকে পথ-প্রদর্শন করতে চান, তাঁর অন্তরকে সৎকাজের দিকে আকৃষ্ট করে দেন। আর যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান। তাঁর অন্তরকে সোজাপথ থেকে বিচ্যুত করে দেন।
রসূল (সা,) বলেন: এমন কোন অন্তর নেই যা আল্লাহ্ তা‘আলার দুই আঙ্গুলীর মাঝখানে নয়। তিনি যতক্ষন ইচ্ছা করেন তাকে সৎপথে কায়েম রাখেন এবং যখন ইচ্ছা করেন, সৎপথ থেকে বিচ্যুত করে দেন।
তিনি যথেষ্ট ক্ষমতাশীল। যা ইচ্ছা তাই করেন। কাজেই, যারা ধর্মের পথে কায়েম থাকতে চায়, তাঁরা সর্বদাই আল্লাহ্র নিকট অধিকতর দৃঢ়চিত্ততা প্রদানের জন্যে দু‘আ করে। হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) সর্বদাই অনুরূপ দু‘আ করতেন। এক ‘হাদীসে রসুলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর নিম্নরূপ একটি দু‘আ বর্ণিত হয়েছে, يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ অর্থাৎ হে, অন্তর আবর্তনকারী আমাদের অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর দৃঢ় রাখ।– (মাযহারী, ২য় খন্ড)
رَبَّنَآ إِنَّكَ جَامِعُ ٱلنَّاسِ لِيَوۡمٖ لَّا رَيۡبَ فِيهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُخۡلِفُ ٱلۡمِيعَادَ ٩
৯. হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি মানুষকে একদিন অবশ্যই একত্রিত করবেঃ এতে কোনই সন্দেহ নেই। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর ওয়াদার অন্যথা করেন না।
إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لَن تُغۡنِيَ عَنۡهُمۡ أَمۡوَٰلُهُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُهُم مِّنَ ٱللَّهِ شَيۡٔٗاۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمۡ وَقُودُ ٱلنَّارِ ١٠
১০. যারা কুফুরী করে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর সামনে কখনও কাজে আসবে না। আর তারাই হচ্ছে দোযখের ইন্ধন।
كَدَأۡبِ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡۚ كَذَّبُواْ بَِٔايَٰتِنَا فَأَخَذَهُمُ ٱللَّهُ بِذُنُوبِهِمۡۗ وَٱللَّهُ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ١١
১১. ফেরআউনের সম্প্রদায় এবং তাদের পূর্ববর্তীদের ধারা অনুযায়ীই তারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। ফলে তাদের পাপের কারণে আল্লাহ তাদেরকে পাকড়াও করেছেন আর আল্লাহর আযাব অতি কঠিন।
قُل لِّلَّذِينَ كَفَرُواْ سَتُغۡلَبُونَ وَتُحۡشَرُونَ إِلَىٰ جَهَنَّمَۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمِهَادُ ١٢
১২. কাফেরদিগকে বলে দিন, খুব শিগগীরই তোমরা পরাভূত হয়ে দোযখের দিকে হাঁকিয়ে নীত হবে-সেটা কতই না নিকৃষ্টতম অবস্থান।
قَدۡ كَانَ لَكُمۡ ءَايَةٞ فِي فِئَتَيۡنِ ٱلۡتَقَتَاۖ فِئَةٞ تُقَٰتِلُ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَأُخۡرَىٰ كَافِرَةٞ يَرَوۡنَهُم مِّثۡلَيۡهِمۡ رَأۡيَ ٱلۡعَيۡنِۚ وَٱللَّهُ يُؤَيِّدُ بِنَصۡرِهِۦ مَن يَشَآءُۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَعِبۡرَةٗ لِّأُوْلِي ٱلۡأَبۡصَٰرِ ١٣
১৩. নিশ্চয়ই দুটো দলের মোকাবিলার মধ্যে তোমাদের জন্য নিদর্শন ছিল। একটি দল আল্লাহর রাহে যুদ্ধ করে। আর অপর দল ছিল কাফেরদের এরা স্বচক্ষে তাদেরকে দ্বিগুন দেখছিল। আর আল্লাহ যাকে নিজের সাহায্যের মাধ্যমে শক্তি দান করেন। এরই মধ্যে শিক্ষনীয় রয়েছে দৃষ্টি সম্পন্নদের জন্য।
زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ ٱلشَّهَوَٰتِ مِنَ ٱلنِّسَآءِ وَٱلۡبَنِينَ وَٱلۡقَنَٰطِيرِ ٱلۡمُقَنطَرَةِ مِنَ ٱلذَّهَبِ وَٱلۡفِضَّةِ وَٱلۡخَيۡلِ ٱلۡمُسَوَّمَةِ وَٱلۡأَنۡعَٰمِ وَٱلۡحَرۡثِۗ ذَٰلِكَ مَتَٰعُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَٱللَّهُ عِندَهُۥ حُسۡنُ ٱلۡمََٔابِ ١٤
১৪. মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মত আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তু। আল্লাহর নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়।
۞قُلۡ أَؤُنَبِّئُكُم بِخَيۡرٖ مِّن ذَٰلِكُمۡۖ لِلَّذِينَ ٱتَّقَوۡاْ عِندَ رَبِّهِمۡ جَنَّٰتٞ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُ خَٰلِدِينَ فِيهَا وَأَزۡوَٰجٞ مُّطَهَّرَةٞ وَرِضۡوَٰنٞ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِٱلۡعِبَادِ ١٥
১৫. বলুন, আমি কি তোমাদেরকে এসবের চাইতেও উত্তম বিষয়ের সন্ধান বলবো?- যারা পরহেযগার, আল্লাহর নিকট তাদের জন্যে রয়েছে বেহেশত, যার তলদেশে প্রস্রবণ প্রবাহিত-তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল। আর রয়েছে পরিচ্ছন্ন সঙ্গিনীগণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখেন।
আনুসাঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:
قُلْ لِّلَّذِیْنَ کَفَرُوْا سَتُغْلَبُوْنَ -এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, কাফেররা পরাজিত ও পরাভূত হবে। এতে কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, আমরা জগতের সব কাফেরকে পরাভূত দেখি না, এর কারণ কি? উত্তর এই যে, আয়াতে সারা জগতের কাফের বোঝানো হয়নি, বরং তখনকার মূশরিক ও ইহুদী জাতিকে বোঝানো হয়েছে। সে মতে মুশরিকদের হত্যা ও বন্দী করার মাধ্যমে এবং ইহুদীদেরকে হত্যা, বন্দী, জিযিয়া বা কর আরোপ এবং নির্বাসনের মাধ্যমে পরাজিত করা হয়েছিল।
আলোচ্য আয়াতে বদর যুদ্ধের অবস্থা বর্নিত হয়েছে। এ যুদ্ধে-
পৃষ্ঠা নং-১৬৬
কাফেরদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। তাদের কাছে সাত শত উট ও একশত অশ্ব ছিল। অপরপক্ষে মুসলমান যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিন শতের কিছু বেশী। তাদের কাছে সর্বমোট সত্তুরটি উট, দুইটি অশ্ব, ছয়টি লৌহবর্ম এবং আটটি তরবারী ছিল। মজার ব্যাপার ছিল এই যে, প্রত্যেক দলের দৃষ্টিতেই প্রতিপক্ষ দলের সংখ্যা নিজেদের চেয়ে দ্বিগুণ প্রতিভাত হচ্ছিল। এর ফলে মুসলমানদের আধিক্য কল্পনা করে কাফেরদের অন্তর উপর্যুপরি শঙ্কিঁত হচ্ছিল এবং মুসলমানগণও নিজেদের অপেক্ষা প্রতিপক্ষের সংখ্যা দ্বিগুণ দেখে আল্লাহ্ তা‘আলার দিকে অধিকতর মনোনিবেশ করছিলেন। তারা পূর্ণ ভরসা ও দৃঢ়তার সাথে আল্লাহ্র ওয়াদা فَاِنْ يَّكُمْ مِّنْكُمْ مِّائَةٌ صَابِرَةٌيَّغْلِبُوا مِائَتَيْن (যদি তোমাদের মধ্যে একশত ধৈর্যশীল যোদ্ধা থাকে, তবে তারা দুইশতের বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে) –এর ওপর আস্থা রেখে আল্লাহ্র সাহায্যের আশা করছিলেন। কাফেরদের প্রকৃত সংখ্যা ছিল তিনগুণ। তা যদি মুসলমানদের দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয়ে যেতো, তবে তাঁদের মনে ভয়-ভীতি সঞ্চার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সাধারণ। আবার কোন কোন অবস্থায় উভয় দলই প্রতিপক্ষকে কম দেখেছিল। সূরা আনফালে এ সম্পর্কে বর্ণনা আসবে।
মোট কথা, মক্কায় প্রদত্ত ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী একটি স্বল্প সংখ্যক নিরস্ত্র দলকে বিরাট বাহিনীর বিপক্ষে জয়ী করা চক্ষুস্মান ব্যক্তিদের জন্যে বিরাট শিক্ষণীয় ঘটনা। (ফাওয়ায়েদে- আল্লামা ওসমানী)
দুনিয়ার মহব্বত: হাদীসে বলা হয়েছে حُبُّ الدُّنْيَارَأْسُ كُلُّ خَطِيْئَةٍ (দুনিয়ার মহব্বত সব অনিষ্টের মূল।) প্রথম আয়াতে দুনিয়ার কয়েকটি প্রধান কাম্যবস্তুর নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, -মানুষের দৃষ্টিতে এ সবের প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক করে দেয়া হয়েছে। তাই অনেক মানুষ এদের বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পরকালকে ভুলে যায়। আয়াতে যেসব বস্তুর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো সাধারণভাবে মানুষের স্বাভাবিক কামনা-বাসনার লক্ষ। তন্মধ্যে সর্বপ্রথমে রমণী ও পরে সন্তান-সন্ততির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, দুনিয়াতে মানুষ যা কিছুই অর্জন করতে সচেষ্ট হয়, সবগুলোর মূল কারণ থাকে নারী অথবা সন্তান-সন্ততির প্রয়োজন। এর পর উল্লেখ করা হয়েছে সোনা, রূপা, পালিত পশু ও শস্যক্ষেতের কথা। কারণ, এগুলো দ্বিতীয় পর্যায়ে মানুষের কাংখিত ও প্রিয়বস্তু।
আলোচ্য আয়াতের সারমর্ম এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের মনে এসব বস্তুর প্রতি স্বভাবগতভাবেই আকর্ষণ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এতে অনেক রহস্য নিহিত রয়েছে। একটি এই যে, এসব বস্তুর প্রতি মানুষের স্বভাবগত আকর্ষণ বা মোহ না থাকলে জগতের সমুদয় শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠতো না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শস্যক্ষেতে কাজ করতে অথবা শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিশ্রম করতে অথবা ব্যবসায়ে অর্থ ও কায়িক শ্রম ব্যয় করতে কেউ প্রস্তুত হতো না। মানব স্বভাবে এসব বস্তুর প্রতি প্রকৃতিগত আকর্ষণ সৃষ্টি করার মধ্যেই জগতের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব নির্ভরশীল করে দেয়া হয়েছে। ফলে মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এসব বস্তুর উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রাখার চিন্তায় ব্যাপৃত থাকে। ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠার পর শ্রমিক কিছু পয়সা উপার্জনের চিন্তায় বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়ে। ধনী ব্যক্তি পয়সা খরচ করে শ্রমিক যোগাড় করার চিন্তায় বের হয়। ব্যবসায়ী উৎকৃষ্টতর পণ্যদ্রব্য সুন্দরভাবে সাজিয়ে গ্রাহকের অপেক্ষায় বসে থাকে- যাতে কিছু পয়সা উপার্জন করা যায়। এদিকে গ্রাহক অনেক কষ্টার্জিত পয়সা নিয়ে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র কেনাকাটার উদ্দেশ্যে বাজারে পৌঁছে। চিন্তা করলে দেখা যায়; এসব প্রিয়বস্তুর ভালবাসাই সবাইকে নিজ নিজ গৃহ থেকে বের করে আনে এবং এ ভালবাসাই দুনিয়া জোড়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির সৃষ্টি ও পরিচালন-ব্যবস্থাকে মজবুত ও দৃঢ় একটা নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে।
দ্বিতীয় রহস্য এই যে, জাগতিক নেয়ামতের প্রতি মানুষের মনে আকর্ষণ ও ভালবাসা না থাকলে পারলৌকিক নেয়ামতের স্বাদ জানা যেতো না এবং তৎপ্রতি আকর্ষণও হতো না। এমতাবস্থায় সৎকর্ম করে জান্নাত অর্জন করার এবং অসৎকর্ম থেকে বিরত হয়ে দোযখ থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনও কেউ অনুভব করতো না।
এখানে অধিকতর প্রণিধানযোগ্য হলো তৃতীয় রহস্যটি। অর্থাৎ, এসব বস্তুর ভালবাসা স্বভাবগতভাবে মানুষের অন্তরে সৃষ্টি করে তাদের পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে যে, কে এগুলোর আকর্ষণে মত্ত হয়ে পরকালকে ভুলে যায় এবং কে এসবের আসল স্বরূপ ও ধ্বংসশীল হওয়ার বিষয় অবগত হয়ে শুধু যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অর্জনে সচেষ্ট হয় ও পরকালীন কল্যাণ আহরণের লক্ষ্যে তার সুচারু ব্যবহার করে।
মোটকথা এই যে, জগতের সুস্বাদু ও মোহনীয় বস্তুগুলোকে আল্লাহ্ তা‘আলা কৃপাবশতঃ মানুষের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে ততপ্রতি ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এর অনেকগুলো রহস্যের মধ্যে অন্যতম রহস্য, মানুষের পরীক্ষা নেয়া। বাহ্যিক কাম্যবস্তু ও তার ক্ষণস্থায়ী স্বাদে মত্ত হওয়ার পর মানুষ কিরূপ কাজ করে আল্লাহ্ তা‘আলা তা দেখতে চান। এসব বস্তু লাভ করার পর যদি মানুষ স্রষ্টা ও মালিক আল্লাহ্কে স্মরণ করে এবং এগুলোকে তাঁর মা‘আরেফাত ও মহব্বত লাভের উপায় হিসাবে ব্যবহার করে, তবে বলা যায় যে, সে দুনিয়াতেও লাভবান হয়েছে এবং পরকালেও সফলকাম হবে। জগতের লোভনীয় বস্তু তাঁর পথের প্রতিবন্ধক হওয়ার পরিবর্তে তার পথ প্রদর্শক ও সহায়ক হয়েছে। পক্ষান্তরে এসব বস্তু লাভ করার পর যদি মানুষ এগুলোর মধ্যেই আপাদমস্তক নিমজ্জিত হয়ে স্রষ্টাকে, পরকাল ও হিসাব-নিকাশকে ভুলে যায়, তবে বলতে হবে যে, এসব বস্তুই তার পারলৌকিক জীবনের ধ্বংস ও অনন্তকাল শাস্তিভোগের কারণ হয়েছে। গভীর দৃষ্টিতে দেখলে জগতেও এসব বস্তু তার শাস্তির কারণ ছিল।
আল্লাহ্ তা‘আলা যেসব বস্তুকে মানুষের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে দিয়েছেন, শরীয়ত অনুযায়ী সেগুলো পরিমিত উপার্জন করলে এবং যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সঞ্চয় করলে ইহকাল ও পরকালের কামিয়াবী হাসিল হবে। পক্ষান্তরে অবৈধ পন্থায় সেগুলো ব্যবহার করলে অথবা বৈধ পন্থায় হলেও এগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত নিমজ্জিত হয়ে পরকাল বিস্মৃত হয়ে গেলে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়বে।
এ কারণেই আলোচ্য আয়াতে কয়েকটি বিশেষ লোভনীয় বস্তুর কথা উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে:
ذَٰلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَاللَّهُ عِندَهُ حُسْنُ الْمَآبِ –
পৃষ্ঠা নং- ১৬৭
অর্থাৎ, এসব বস্তু হচ্ছে পার্থিব জীবনে ব্যবহার করার জন্যে; মন বসাবার জন্যে নয়। আর আল্লাহ্র কাছে রয়েছে উত্তম ঠিকানা। অর্থাৎ, সেখানে চিরকাল থাকতে হবে এবং যার নেয়ামত ধ্বংস হবে না, হ্রাস পাবে না।
১৫ নং আয়াতে এ সম্পর্কিত আরও ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: যারা দুনিয়ার অসম্পূর্ণ ও ধ্বংসশীল নেয়ামতে মত্ত হয়ে পড়েছে, আপনি তাদের বলে দিন যে, আমি তোমাদের আরও উতকৃষ্টতর নেয়ামতের সন্ধান বলে দিচ্ছি। যারা আল্লাহ্কে ভয় করে এবং যারা আল্লাহ্র অনুগত, তারাই এ নেয়ামত পাবে। সে নেয়ামত হচ্ছে সবুজ বৃক্ষলতাপূর্ণ বেহেশত- যার তলদেশ দিয়ে নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত হবে। তাতে থাকবে সকল প্রকার আবিলতামুক্ত পরিচ্ছন্ন সঙ্গিনিগণ এবং আল্লাহ্ তাআলার সন্তুষ্টি।
পূর্ববর্তী আয়াতে দুনিয়ার ছয়টি প্রধান নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। অর্থাৎ, রমণীকুল, সন্তান-সন্ততি, সোনা-রূপার ভান্ডার, উৎকৃষ্ট অশ্ব, পালিত জন্তু ও শস্যক্ষেত। এদের বিপরীতে পরকালের নেয়ামতরাজির মধ্যে বহ্যত: তিনটি বর্ণিত হয়েছে। প্রথম- জান্নাতের সবুজ কানন; দ্বিতীয়- পরিচ্ছন্ন সঙ্গিনীগণ এবং তৃতীয়- আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। অবশিষ্টগুলোর মধ্যে সন্তান-সন্ততি উল্লেখ না করার কারণ এই যে, দুনিয়াতে দুই কারণে মানুষ সন্তান-সন্ততিকে ভালবাসে। প্রথমত: সন্তান-সন্ততি পিতার কাজকর্মে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত: মৃত্যুর পর সন্তান-সন্ততি দ্বারা পিতার নামটুকু থেকে যেয়। কিন্তু পরকালে কারও সাহায্যের প্রয়োজন নেই এবং সেখানে মৃত্যুও নেই যে, কোন অভিভাবক অথবা উত্তরাধিকারীর প্রয়োজন হবে। এছাড়া দুনিয়াতে যার যত সন্তান-সন্ততি আছে, সে জান্নাতে তাদেরকে পাবে। পক্ষান্তরে দুনিয়ায় যার সন্তান নেই, প্রথমত: জান্নাতে তার মনে সন্তানের বাসনাই হবে না। আর কারও মনে বাসনা জাগ্রত হলে আল্লাহ্ তাকে তাও দান করবেন। তিরমিযীর এক হাদীসে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ (সা,) বলেন: কোন জান্নাতীর মনে সন্তানের বাসনা জাগ্রত হলে সন্তানের গর্ভাবস্থা, জন্মগ্রহণ ও বয়োপ্রাপ্তি মূহুর্তের মধ্যেই সম্পন্ন হয়ে যাবে এবং তার মনের বাসনা পূর্ণ করা হবে।
এমনিভাবে জান্নাতে সোনা-রূপার উল্লেখ করা হয়নি। কারণ এই যে, দুনিয়াতে সোনা-রূপার বিনিময়ে দুনিয়ার আসবাবপত্র এবং প্রয়োজনীয় সবকিছুই যোগাড় করা যায়। কিন্তু পরকালে ক্রয়-বিক্রয়েরও প্রয়োজন হবে না এবং কোন কিছুর বিনিময়ও দিতে হবে না। বরং জান্নাতীর মন যখন যা চাইবে, তৎক্ষণাৎ তা সরবরাহ করা হবে। এছাড়া জান্নাতে সোনা-রূপার কোন অভাব নেই। হাদীসে বর্ণিত আছে যে, জান্নাতে কোন কোন প্রাসাদের একটি ইট সোনার ও একটি ইট রূপার হবে। মোটকথা, পরকালের হিসাবে সোনা-রূপাকে কোন উল্লেখযোগ্য বস্তুই মনে করা হয়নি।
এমনিভাবে দুনিয়াতে ঘোড়ার কাজ হলো বাহন হয়ে পথের দুরত্ব অতিক্রম করা। জান্নাতে সফর ও যানবাহন প্রভৃতি কোন কিছুই প্রয়োজন হবে না। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, শুক্রবার দিন জান্নাতীদের আরোহণের জন্যে উৎকৃষ্ট ঘোড়া সরবরাহ করা হবে। এগুলোতে আরোহণ করে জান্নাতীরা আত্নীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা করতে যাবে।
মোট কথা, জান্নাতে ঘোড়ারও কোন উল্লেখযোগ্য দুরত্ব নেই। এমনিভাবে পালিত পশু কৃষিক্ষেত্রে কাজে আসে অথবা তা দুগ্ধ দান করে। জান্নাতে দুগ্ধ ইত্যাদি পশুর মাধ্যম ছাড়াই আল্লাহ্ তা‘আলা দান করবেন।
কৃষিকাজের অবস্থাও তদ্রুপ। দুনিয়াতে বিভিন্ন শস্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যে শস্যক্ষেত্রে পরিশ্রম করা হয়। জান্নাতে যাবতীয় শস্যই আপনা-আপনি সরবরাহ হবে। কাজেই সেখানে কৃষিকাজের প্রয়োজনই হবে না। তবুও যদি কেউ কৃষি কাজকে ভালবাসে, তবে তার জন্য সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। তিবরানীর এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, জান্নাতে এক ব্যক্তি কৃষিকাজের বাসনা প্রকাশ করবে। তাকে তৎক্ষণাৎ যাবতীয় সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহ করা হবে। অতঃপর শস্যের বপন, রোপন, পাকা ও কর্তন কয়েক মিনিটের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যাবে। এসব কারণেই জান্নাতের নেয়ামতসমূহের মধ্যে শুধু জান্নাত ও জান্নাতের হুরদের বর্ণনাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে। কারণ, জান্নাতীদের জন্যে কুরআনের ওয়াদাও রয়েছে যে, وَلَهُمْ مَّايَشْتَهُوْنَ অর্থাৎ, তারা যে বাসনাই প্রকাশ করবে, তাই পাবে। এহেন ব্যাপক ঘোষণার পর বিশেষ নেয়ামতের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে কি? তা সত্ত্বেও কয়েকটি বিশেষ নেয়ামত উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো প্রত্যেক জান্নাতী চাওয়া ছাড়াই পাবে। এগুলোর পর আরও একটি সর্ববৃহত নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সাধারণভাবে মানুষ যার কল্পনাও করে না। তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার অশেষ সন্তুষ্টি। হাদীসে বর্ণিত আছে, যখন জান্নাতিগণ জান্নাতে পৌঁছে আনন্দিত ও নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে এবং তাদের কোন আকাঙ্ক্ষাই অপূর্ণ থাকবে না, তখন আল্লাহ্ তাআলা স্বয়ং তাদের সম্বোধন করে বলবেন: এখন তোমরা সন্তুষ্ট ও নিশ্চিন্ত হয়েছ। আর কোন বস্তুর প্রয়োজন নেই তো? জান্নাতিগণ বলবেন? হে আমাদের পালনকর্তা, আপনি এত নেয়ামত দান করেছেন যে, এরপর আর কোন নেয়ামতের প্রয়োজনই থাকতে পারে না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলবেন: এখন আমি তোমাদের সব নেয়ামত থেকে উৎকৃষ্ট একটি নেয়ামত দিচ্ছি। তা এই যে, তোমরা সবাই আমার অশেষ সন্তুষ্টিলাভ করেছ। এখন অসন্তুষ্টির আর কোন আশঙ্কা নেই। কাজেই জান্নাতের নেয়ামতরাজি ছিনিয়ে নেয়ার অথবা হ্রাস করে দেয়ারও কোন আশঙ্কা নেই।
এ দু’টি আয়াতের সারমর্মই হুযুর (সা,) বলেছেন: “দুনিয়া অভিশপ্ত এবং যা কিছু এতে আছে তাও অভিশপ্ত; তবে ঐসব বস্তু নয়, যদ্বারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন করা হয়”।
পৃষ্ঠা নং-১৬৮
ٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَآ إِنَّنَآ ءَامَنَّا فَٱغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ١٦
১৬. যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা ঈমান এনেছি, কাজেই আমাদের গোনাহ ক্ষমা করে দাও আর আমাদেরকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা কর।
ٱلصَّٰبِرِينَ وَٱلصَّٰدِقِينَ وَٱلۡقَٰنِتِينَ وَٱلۡمُنفِقِينَ وَٱلۡمُسۡتَغۡفِرِينَ بِٱلۡأَسۡحَارِ ١٧
১৭. তারা ধৈর্য্যধারণকারী, সত্যবাদী, নির্দেশ সম্পাদনকারী, সৎপথে ব্যয়কারী এবং শেষরাতে ক্ষমা প্রার্থনাকারী।
شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٨
১৮. আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।
إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ وَمَا ٱخۡتَلَفَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّا مِنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَهُمُ ٱلۡعِلۡمُ بَغۡيَۢا بَيۡنَهُمۡۗ وَمَن يَكۡفُرۡبَِٔايَٰتِ ٱللَّهِ فَإِنَّ ٱللَّهَ سَرِيعُ ٱلۡحِسَابِ ١٩
১৯. নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম। এবং যাদের প্রতি কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞান আসার পরও ওরা মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে, শুধুমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ, যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি কুফরী করে তাদের জানা উচিত যে, নিশ্চিতরূপে আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত দ্রুত।
فَإِنۡ حَآجُّوكَ فَقُلۡ أَسۡلَمۡتُ وَجۡهِيَ لِلَّهِ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِۗ وَقُل لِّلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡأُمِّيِّۧنَ ءَأَسۡلَمۡتُمۡۚ فَإِنۡ أَسۡلَمُواْ فَقَدِ ٱهۡتَدَواْۖ وَّإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنَّمَا عَلَيۡكَ ٱلۡبَلَٰغُۗ وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِٱلۡعِبَادِ ٢٠
২০. যদি তারা তোমার সাথে বিতর্কে অবতীর্ণ হয় তবে বলে দাও, “আমি এবং আমার অনুসরণকারীগণ আল্লাহর প্রতি আত্নসমর্পণ করেছি।” আর আহলে কিতাবদের এবং নিরক্ষরদের বলে দাও যে, তোমরাও কি আত্নসমর্পণ করেছ? তখন যদি তারা আত্নসমর্পণ করে, তবে সরল পথ প্রাপ্ত হলো, আর যদি মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তাহলে তোমার দায়িত্ব হলো শুধু পৌছে দেয়া। আর আল্লাহর দৃষ্টিতে রয়েছে সকল বান্দা।
إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡفُرُونَ بَِٔايَٰتِ ٱللَّهِ وَيَقۡتُلُونَ ٱلنَّبِيِّۧنَ بِغَيۡرِ حَقّٖ وَيَقۡتُلُونَ ٱلَّذِينَ يَأۡمُرُونَ بِٱلۡقِسۡطِ مِنَ ٱلنَّاسِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ ٢١
২১. যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে এবং পয়গম্বরগণকে হত্যা করে অন্যায়ভাবে, আর সেসব লোককে হত্যা করে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তির সংবাদ দিন।
أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ حَبِطَتۡ أَعۡمَٰلُهُمۡ فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِ وَمَا لَهُم مِّن نَّٰصِرِينَ ٢٢
২২. এরাই হলো সে লোক যাদের সমগ্র আমল দুনিয়া ও আখেরাত উভয়লোকেই বিনষ্ট হয়ে গেছে। পক্ষান্তরে তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই।
আনুসঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:
شَهِدَ اللهُ আয়াতের ফযীলত: এই আয়াতের একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। ইমাম বাগভী (রহ,) বলেন, সিরিয়া থেকে দু’জন বিশিষ্ট ইহুদী পন্ডিত একবার মদীনায় আগমন করেন। মদীনার আবাসিক এলাকা দেখে তারা মন্তব্য করেন যে, শেষ যামানার নবী যে রকম লোকালয়ে বসবাস করবেন বলে তাওরাতে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে এটা ঠিক সে রকম বলেই মনে হচ্ছে। এরপর তারা জানতে পারেন যে, এখানে একজন মহান ব্যক্তি আছেন, যাঁকে সবাই নবী বলে আখ্যায়িত করে। তারা হযরত নবী কারীম (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)-এর কাছে উপস্থিত হলেন। তাঁর প্রতি দৃষ্টি পড়তেই তাওরাতে বর্ণিত আখেরী নবীর গুণাবলী তাঁদের সামনে ভেসে উঠে। তারা বললেন: আপনি কি মু‘হাম্মাদ? তিনি বললেন: হ্যাঁ। আমি মু‘হাম্মাদ এবং আমি আ‘হমাদ। তারা আরও বললেন: আমরা আপনাকে একটি প্রশ্ন করবো। যদি আপনি সঠিক উত্তর দেন, তবে আমরা আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবো। হযরত নাবী কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) বললেন: প্রশ্ন করুন। তারা বললেন, আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কিত সর্ববৃহৎ সাক্ষ্য কোনটি? এ প্রশ্নের উত্তরেই আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়। হযরত নাবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) আয়াতটি তিলাওয়াত করে তাদের শুনিয়ে দিলে তারা তৎক্ষনাৎ মুসলমান হয়ে যায়।
মুসনাদে আ‘হমাদে উদ্ধৃত ‘হাদীসে আছে, রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) আরাফাতের ময়দানে এ আয়াত পাঠ করার পর বললেন: “হে পরওয়ারদিগার আমিও এর সাক্ষ্য দাতা।”
‘দ্বীন ও ইসলাম শব্দের ব্যাখ্যা: আরবী ভাষায় دِيْن শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। তন্মধ্যে এক অর্থ রীতি ও পদ্ধতি। কুরআনের পরিভাষায় دِيْن সেসব মূলনীতি ও বিধি-বিধানকে বলা হয় যা হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) থেকে শুরু করে শেষ নাবী হযরত মু‘হাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) পর্যন্ত সব পয়গম্বরের মধ্যে সমভাবেই বিদ্যমান রয়েছে। ‘শরীয়ত’ অথবা ‘মিনহাজ’ শব্দটি পরবর্তী পরিভাষা। ‘মাযহাব’ শব্দটি দ্বীনের বিভিন্ন শাখার বিধি-বিধান অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন উম্মতের মধ্যে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে। কুরআন বলে:
۞ شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّىٰ بِهِ نُوحًا অর্থাৎ, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য সে দ্বীনই প্রবর্তন করেছেন, যার নির্দেশ ইতিপূর্বে নূ‘হ ও অন্যান্য পয়গম্বরকে দেয়া হয়েছিল।
এতে বোঝা যায়, সব পয়গম্বরের দ্বীনই এক ও অভিন্ন ছিল। অর্থাৎ, আল্লাহ্র সত্তার যাবতীয় পরাকাষ্ঠার অধিকারী হওয়া এবং সমুদয় দোষ-ত্রুটি থেকে পবিত্র হওয়া এবং তাঁকে ছাড়া কেউ উপাসনার যোগ্য না হওয়ার প্রতি মনে প্রাণে বিশ্বাস স্থাপন করা ও মুখে স্বীকার করা, কিয়ামত দিবস, হিসাব-নিকাশ, পুরস্কার ও শাস্তিদান এবং জান্নাত ও দোযখের প্রতি অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করা ও মুখে স্বীকার করা। আল্লাহ্র প্রেরিত নাবী-রসূল ও তাঁদের বিধানের প্রতিও তেমনিভাবে ঈমান আনা। ‘ইসলাম’ শব্দের প্রকৃত অর্থ আল্লাহ্র নিকট আত্মসমর্পন করা এবং তাঁর অনুগত হওয়া। এ অর্থের দিক দিয়ে প্রত্যেক পয়গম্বরের আমলে যারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং তাঁদের আনীত বিধি-বিধানের আনুগত্য-
পৃষ্ঠা নং-১৬৯
করেছে, তারা সবাই মুসলমান ও মুসলিম নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য ছিল এবং তাদের ধর্মও ছিল ইসলাম। এ অর্থের দিকে লক্ষ্য করেই হযরত নূ‘হ (আ,) বলেন: وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ অর্থাৎ, আমি ‘মুসলিম’ হওয়ার জন্যে আদিষ্ট হয়েছি। –(সূরা ইউনুস)
এ কারণেই হযরত ইবরাহীম (আ,) নিজেকে ও নিজ উম্মতকে ‘উম্মতে মুসলিমা’ বলেছিলেন:
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ
হযরত ঈসা (আ,)-এর সহচরগণ এ অর্থের প্রতি লক্ষ্য করেই সাক্ষ্য দিয়ে বলেছিল: وَاشْهَدْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ ‘সাক্ষী থাকুন যে, আমরা মুসলিম’।
মোটকথা এই যে, প্রত্যেক পয়গম্বরের আমলে তাঁর আনীত দ্বীনই ছিল দ্বীনে ইসলাম এবং আল্লাহ্র কাছে গ্রহণযোগ্য। পরে এগুলো একের পর এক রহিত হয়েছে এবং পরিশেষে দ্বীনে-মু‘হাম্মদীই ‘ইসলাম’ নামে অভিহিত হয়েছে- যা কেয়ামত পর্যন্ত কায়েম থাকবে। যদি ইসলামের দ্বিতীয় অর্থ নেয়া হয় অর্থাৎ, মু‘হাম্মদ (সা,)-এর আনীত ধর্ম, তবে আয়াতের অর্থ হবে এই যে, এ যুগে মু‘হাম্মদ (সা,)-এর শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যশীল ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য। পূর্ববর্তী দ্বীনগুলোকেও তাদের সময়ে ইসলাম বলা হলেও এখন তা রহিত হয়ে গেছে। অতএব উভয় অবস্থাতে আয়াতের প্রকৃত অর্থ একই দাঁড়ায়।
তাই কুরআনের সম্বোধিত উম্মতের সামনে ইসলামের যে কোন অর্থই নেয়া হোক না কেন, সারমর্ম হবে এই যে, রসূলের (সা,) আবির্ভাবের পর কুরআন ও তাঁর শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ধর্মই ইসলাম নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য এবং এধর্মই আল্লাহ্ তাআলার কাছে গ্রহণযোগ্য-অন্য কোন ধর্ম নয়। এ বিষয়বস্তুটি কুরআনের অসংখ্য আয়াতে বিভিন্ন শিরোনামে বিধৃত হয়েছে।
ইসলামেই মুক্তি নিহিত: আজকাল ইসলামের উদারতার নামে কুফর ও ইসলামকে এক করার চেষ্টা করা হয় এবং বলা হয় যে, সৎকর্ম সম্পাদন করলে ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী হলে যে কোন ধর্মাবলম্বীই মুক্তি পাবে-সে ইহুদী, খ্রীষ্টান, অথবা মূর্তিপূজারী যাই হোক। আলোচ্য আয়াত এ উদ্ভট মতবাদের মূলোৎপাটন করে দিয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে এভাবে ইসলামের মূলনীতি বিধ্বস্ত করা হয়। কারণ, এর সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, ইসলামের বাস্তব কোন ভিত্তি নেই। এটা একটা কাল্পনিক বিষয়, যা কুফরের পোশাকেও সুন্দর মানায়। কুরআন মাজীদের অসংখ্য আয়াত পরিষ্কার বলে দিয়েছে যে, আলো ও অন্ধকার যেরূপ এক হতে পারে না, তদ্রুপ অবাধ্যতা ও আনুগত্য উভয়টি আল্লাহ্র কাছে পছন্দনীয় হতে পারে না। যে ব্যক্তি ইসলামের কোন একটি মূলনীতি অস্বীকার করে, সে নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি বিদ্রোহী ও পয়গম্বরগণের শত্রু, প্রচলিত অর্থে সৎকর্ম বা নেক আমল ও প্রথাগত চরিত্রে সে যতই সুন্দর হোক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। সর্বপ্রথম আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের উপরই পরকালের মুক্তি নির্ভরশীল। যে ব্যক্তি এ থেকে বঞ্চিত, তার কোন কর্ম ধর্তব্য নয়। কুরআনে এমন লোকদের সম্পর্কেই বলা হয়েছে। فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا অর্থাৎ, কেয়ামতের দিন আমি তাদের কোন আমল ওজন করব না।
পরিশেষে বলা হয়েছে: وَمَن يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করে, আল্লাহ্ দ্রুত তার হিসাব গ্রহণ করবেন। মৃত্যুর পর প্রথমত: কবর তথা বরযখ-জগতে পরকালের পথে প্রথম পরীক্ষা নেয়া হবে। এরপর বিস্তারিত হিসাব-নিকাশের সময়ই সব বিরোধের স্বরূপ ফুটে উঠবে। মিথ্যাপন্থীরা তাদের স্বরূপ জানতে পারবে এবং শাস্তিও আরম্ভ হয়ে যাবে।
পৃষ্ঠা নং-১৭০
أَلَمۡ تَرَ إِلَى ٱلَّذِينَ أُوتُواْ نَصِيبٗا مِّنَ ٱلۡكِتَٰبِ يُدۡعَوۡنَ إِلَىٰ كِتَٰبِ ٱللَّهِ لِيَحۡكُمَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ يَتَوَلَّىٰ فَرِيقٞ مِّنۡهُمۡ وَهُم مُّعۡرِضُونَ ٢٣
২৩. আপনি কি তাদের দেখেননি, যারা কিতাবের কিছু অংশ পেয়েছে-আল্লাহর কিতাবের প্রতি তাদের আহবান করা হয়েছিল যাতে তাদের মধ্যে মীমাংসা করা যায়। অতঃপর তাদের মধ্যে একদল তা অমান্য করে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ قَالُواْ لَن تَمَسَّنَا ٱلنَّارُ إِلَّآ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَٰتٖۖ وَغَرَّهُمۡ فِي دِينِهِم مَّا كَانُواْ يَفۡتَرُونَ ٢٤
২৪. তা এজন্য যে, তারা বলে থাকে যে, দোযখের আগুন আমাদের স্পর্শ করবে না; তবে সামান্য হাতে গোনা কয়েকদিনের জন্য স্পর্শ করতে পারে। নিজেদের উদ্ভাবিত ভিত্তিহীন কথায় তারা ধোকা খেয়েছে।
فَكَيۡفَ إِذَا جَمَعۡنَٰهُمۡ لِيَوۡمٖ لَّا رَيۡبَ فِيهِ وَوُفِّيَتۡ كُلُّ نَفۡسٖ مَّا كَسَبَتۡ وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ ٢٥
২৫. কিন্তু তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে যখন আমি তাদেরকে একদিন সমবেত করবো যে দিনের আগমনে কোন সন্দেহ নেই আর নিজেদের কৃতকর্ম তাদের প্রত্যেকেই পাবে তাদের প্রাপ্য প্রদান মোটেই অন্যায় করা হবে না।
قُلِ ٱللَّهُمَّ مَٰلِكَ ٱلۡمُلۡكِ تُؤۡتِي ٱلۡمُلۡكَ مَن تَشَآءُ وَتَنزِعُ ٱلۡمُلۡكَ مِمَّن تَشَآءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَآءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَآءُۖ بِيَدِكَ ٱلۡخَيۡرُۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٦
২৬. বলুন ইয়া আল্লাহ্! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।
تُولِجُ ٱلَّيۡلَ فِي ٱلنَّهَارِ وَتُولِجُ ٱلنَّهَارَ فِي ٱلَّيۡلِۖ وَتُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَتُخۡرِجُ ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّۖ وَتَرۡزُقُ مَن تَشَآءُ بِغَيۡرِ حِسَابٖ ٢٧
২৭. তুমি রাতকে দিনের ভেতরে প্রবেশ করাও এবং দিনকে রাতের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দাও। আর তুমিই জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করে আন এবং মৃতকে জীবিতের ভেতর থেকে বের কর। আর তুমিই যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান কর।
لَّا يَتَّخِذِ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلۡكَٰفِرِينَ أَوۡلِيَآءَ مِن دُونِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَۖ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ فَلَيۡسَ مِنَ ٱللَّهِ فِي شَيۡءٍ إِلَّآ أَن تَتَّقُواْ مِنۡهُمۡ تُقَىٰةٗۗ وَيُحَذِّرُكُمُ ٱللَّهُ نَفۡسَهُۥۗ وَإِلَى ٱللَّهِ ٱلۡمَصِيرُ ٢٨
২৮. মুমিনগন যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কেন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর, তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে আল্লাহ তা’আলা তাঁর সম্পর্কে তোমাদের সতর্ক করেছেন। এবং সবাই কে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে।
قُلۡ إِن تُخۡفُواْ مَا فِي صُدُورِكُمۡ أَوۡ تُبۡدُوهُ يَعۡلَمۡهُ ٱللَّهُۗ وَيَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۗ وَٱللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٩
২৯. বলে দিন, তোমরা যদি মনের কথা গোপন করে রাখ অথবা প্রকাশ করে দাও, আল্লাহ সে সবই জানতে পারেন। আর আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সেসব ও তিনি জানেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান।
আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:
আয়াতের শানে-নুযুল: মুসলমানদের অব্যাহত উন্নতি ও ইসলামের ক্রমবর্ধমান প্রসার দেখে বদর যুদ্ধে পরাজিত এবং উ‘হুদ যুদ্ধে বিপর্যস্ত মুশরেক ও অন্যান্য অমুসলিম সম্প্রদায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। তাই সবাই মিলে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যথাসর্বস্ব কোরবান করতে প্রস্তুত হচ্ছিল। অবশেষে দেশময় গভীর ষড়যন্ত্রের ফল স্বরূপ মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরেক, ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের একটি সম্মিলিত ঐক্য গড়ে উঠলো। ওরা সবাই মিলে মদীনার উপর ব্যাপক আক্রমণ ও চূড়ান্ত যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলো। সাথে সাথে তাদের অগণিত সৈন্য দুনিয়ার বুক থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব মুছে ফেলার সংকল্প নিয়ে মদীনা অবরোধ করে বসলো। কুরআনে এ যুদ্ধ ‘গযওয়ায়ে-খন্দক’ নামে উল্লেখিত হয়েছে। রসূলুল্লাহ (সা,) সাহাবীগণের সাথে পরামর্শক্রমে স্থির করেছিলেন যে, শত্রু সৈন্যের আগমন পথে মদীনার বাইরে পরিখা খনন করা হবে।
বায়হাকী, আবু নাঈম ও ইবনে খুযায়মার রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে যে, প্রতি চল্লিশ হাত পরিখা খননের দায়িত্ব প্রতি দশজন মুজাহিদ সাহাবীর উপর অর্পন করা হয়। পরিকল্পনা ছিল কয়েক মাইল লম্বা যথেষ্ট গভীর ও প্রশস্ত পরিখা খনন করা হবে, যাতে শত্রু সৈন্যরা সহজে অতিক্রম করতে না পারে। খনন কাজ দ্রুত সমাপ্ত করাও দরকার ছিল। তাই নিবেদিতপ্রাণ সাহাবিগণ কঠোর পরিশ্রম সহকারে খননকার্যে মশগুল ছিলেন। পেশাব-পায়খানা, পানাহার ইত্যাদি প্রয়োজনে কাজ বন্ধ রাখা দুরুহ ছিল। তাই একটানা ক্ষুধার্ত থেকেও কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছিল। বাস্তবেও কাজটি এমন ছিল যে, আজকালকার আধুনিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত বাহিনীর পক্ষেও এত অল্প সময়ে এ কাজ সমাধা করা সহজ হতো না। কিন্তু এখানে ঈমানী শক্তি কার্যকর ছিল। তাই অতি সহজেই কাজ সমাধা হয়ে গেলো।
হযরত নবী কারীম (সা,)-ও একজন সৈনিক হিসেবে খননকার্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঘটনাক্রমে পরিখার এক অংশে একটি বিরাট প্রস্তরখন্ড বের হলো। এ অংশে নিয়োজিত সাহাবিগণ সর্বশক্তি ব্যয় করেও প্রস্তরখন্ডটি ভেঙ্গে অপসারণ করতে ব্যর্থ হলেন। তাঁরা মূল পরিকল্পনাকারী হযরত সালমান ফারসীর মাধ্যমে হযরত নাবী কারীম (সা,) –এর কাছে সংবাদ পাঠালেন। তিনি তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন এবং কোদাল দিয়ে প্রস্তরখন্ডে প্রচন্ড আঘাত করতেই তা খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেলো এবং একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ উত্থিত হলো। এ স্ফুলিঙ্গের আলোকচ্ছটা বেশ দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়লো। হযরত নাবী কারীম (সা,) বললেন: এ আলোকচ্ছটায় আমাকে হীরা ও পারস্য সাম্রাজ্যের রাজপ্রাসাদ দেখানো হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় বার আঘাত করতেই আরেকটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হলো। তিনি বললেন: এ আলোকচ্ছটায় আমাকে রোম সাম্রাজ্যের লাল বর্ণের রাজপ্রাসাদ ও দালান-কোঠা দেখানো হয়েছে। অতঃপর তৃতীয়বার আঘাত করতেই আবার আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়লো। তিনি বললেন: এতে আমাকে সান‘আ ইয়ামনের সুউচ্চ রাজ-প্রাসাদ দেখানো হয়েছে। তিনি আরও বললেন: আমি তোমাদের সুসংবাদ দিচ্ছি, জিবরাঈল (আ,) আমাকে-
পৃষ্ঠা নং-১৭১
বলেছেন যে, আমার উম্মত অদূর ভবিষ্যতে এসব দেশ জয় করবে।
এ সংবাদে মদীনার মুনাফেকরা ঠাট্টা-বিদ্রূপের একটা সুযোগ পেয়ে বসলো। তারা বলতে লাগলো: দেখ, প্রাণ বাঁচানোই যাদের পক্ষে দায়; যারা শত্রুর ভয়ে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে দিবারাত্র পরিখা খননে ব্যস্ত, তারাই কিনা পারস্য, রোম ও ইয়ামান জয় করার দিবা-স্বপ্ন দেখছে। আল্লাহ তা‘আলা এসব নির্বোধ জালেমদের উত্তরেই আলোচ্য قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ আয়াতটি নাযিল করেন।
এতে মুনাজাত ও দোয়ার ভাষায় অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে জাতিসমূহের উত্থান-পতন ও সাম্রাজ্যের পট পরিবর্তনে আল্লাহ তা‘আলার অপ্রতিহত শক্তি সামর্থের বিষয় বর্ণিত হয়েছে এবং পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য বিজয় সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা,)-এর ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এতে জগতের বৈপ্লবিক ঘটনাবলী সম্পর্কে অজ্ঞ, জাতিসমূহের উত্থান-পতনের ইতিহাস সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এবং কওমে নূ‘হ, ‘আদ, সামুদ প্রভৃতি অবাধ্য জাতিগুলোর ধ্বংসকাহিনী সম্পর্কে উদাসীন ও মূর্খ শত্রুদের হুশিয়ার করা হয়েছে যে, এরা বাহ্যিক শান-শওকতের পূজা করে। এরা জানে না, জগতের সমস্ত শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার করায়ত্ত। সম্মান ও অপমান তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন। তিনি দরিদ্র ও পথের ভিখারীকে রাজ সিংহাসন ও মুকুটের অধিকারী করতে পারেন এবং প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাটদের হাত থেকে রাষ্ট্র ও ঐশ্বর্য্য ছিনিয়ে নিতে পারেন। আজ পরিখা খননকারী ক্ষুধার্ত ও নিঃস্বদের আগামীকাল সিরিয়া, ইরাক ও ইয়ামান সাম্রাজ্যের অধিকারী করে দেওয়া তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন নয়।
ভাল ও মন্দের নিরিখ: আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে بِیَدِکَ الْخَیْرُ অর্থাৎ, তোমার হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। আয়াতের প্রথমাংশে রাজত্ব দান করা ও ছিনিয়ে নেয়া এবং সম্মান ও অপমান উভয়দিক উল্লেখ করা হয়েছিল। এ কারণে এখানেও بیدک الخیر والشر (তোমার হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণ) কিন্তু আয়াতে শুধু خیر (কল্যাণ) শব্দ ব্যবহার করে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যে বিষয়কে কোন ব্যক্তি অথবা জাতি অকল্যাণকর বা বিপজ্জনক মনে করে, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অথবা জাতির জন্যে আপাতদৃষ্টিতে অকল্যাণকর ও বিপজ্জনক মনে হলেও পরিণামের সামগ্রিক ফলশ্রুতির দিক দিয়ে তা অকল্যাণকর নাও হতে পারে।
মোটকথা, আমরা যেসব বিষয়কে মন্দ বলি, সেগুলো পুরোপুরি মন্দ নয়- আংশিক মন্দমাত্র। বিশ্বস্রষ্টা ও বিশ্ব-পালকের দিকে সমৃদ্ধ এবং সামগ্রিক উপযোগিতার দিক দিয়ে কোন বস্তুই মন্দ নয়।
২৭ নং আয়াতে নভোমণ্ডলেও আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতার ব্যাপ্তি বর্ণনা করা হয়েছে-
تُوْلِجُ الَّیْلَ فِی النَّهَارِ وَتُوْلِجُ النَّهَارَ فِی الَّیْلِ
অর্থাৎ, আপনি ইচ্ছা করলেই রাত্রির অংশ দিনে প্রবিষ্ট করে দিনকে বর্ধিত করে দেন এবং দিনের অংশ রাত্রিতে প্রবিষ্ট করে রাত্রিকে বর্ধিত করে দেন।
সবাই জানেন যে, দিবারাত্রির ছোট বা বড় হওয়া সে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কাজেই আয়াতের সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, নভোমণ্ডল, তৎসংশ্লিষ্ট সর্ববৃহৎ গ্রহ সূর্য এবং সর্বক্ষুদ্র উপগ্রহ চন্দ্র-সবই আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতাধীন। অতএব উপাদান-জগত ও অন্যান্য শক্তি যে আল্লাহ তা‘আলারই ক্ষমতাধীন, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
وَتُخْرِجُ الْحَیَّ مِنَ الْمَیِّتِ وَتُخْرِجُ الْمَیِّتَ مِنَ الْحَیِّ আপনি জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন। যেমন, ডিম থেকে বাচ্চা অথবা বীর্য থেকে সন্তান অথবা বীজ থেকে বৃক্ষ বের করেন। পক্ষান্তরে আপনি মৃতকে জীবিত থেকে বের করেন। যেমন, পাখি থেকে ডিম, জীব থেকে বীর্য অথবা বৃক্ষ থেকে ফল ও শুষ্ক বীজ।
জীবিত ও মৃতের ব্যাপক অর্থ নেয়া হলে জ্ঞানী-মূর্খ, পূর্ণ-অপূর্ণ এবং মুমিন ও কাফের সবাই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এভাবে আল্লাহ তা‘আলার সর্বব্যাপী ক্ষমতা সমগ্র আত্মা-জগত ও আধ্যাত্মিক জগতের উপর সুস্পষ্টরূপে পরিব্যাপ্ত হয়। অর্থাৎ, তিনি ইচ্ছা করলেই কাফেরের ঔরসে মুমিন অথবা মূর্খের ঔরসে জ্ঞানী পয়দা করতে পারেন। তাঁরই ইচ্ছায় আযরের গৃহে খলীলুল্লাহ জন্ম গ্রহণ করেন এবং নূ‘হ (আ,)-এর গৃহে তাঁর ঔরসজাত পুত্র কাফের থেকে যায়, আলেমের সন্তান জাহেল থেকে যায় এবং জাহেলের সন্তান আলেম হয়ে যায়।
আয়াতে সমগ্র সৃষ্টজগতের উপর আল্লাহ তা‘আলার একচ্ছত্র ক্ষমতা কিরূপ প্রাঞ্জল ও মনোরম ধারাবাহিকতায় বর্ণিত হয়েছে, উপরোক্ত বিবরণ থেকে সহজেই তা বোঝা যায়। প্রথমেই উপাদান জগত এবং তার শক্তি ও রাজত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। সবশেষে আত্মা ও আধ্যাত্মিকতার বর্ণনা এসেছে। প্রকৃতপক্ষে এটাই সমগ্র বিশ্বশক্তির সর্বোচ্চ শক্তি।
সবশেষে বলা হয়েছে: وَتَرْزُقُ مَنْ تَشَآءُ بِغَیْرِ حِسَابٍ অর্থাৎ, আপনি যাকেই ইচ্ছা অপরিমিত রিযক দান করেন। কোন সৃষ্টজীব জানতে পারে না- যদিও স্রষ্টার খাতায় তা কড়ায়-গণ্ডায় লিখিত থাকে।
আলোচ্য আয়াতের বিশেষ ফযীলত: ইমাম বাগভীর নিজস্ব সনদে বর্ণিত এক হাদীসে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেন: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর সূরা ফাতেহা, আয়াতুল কুরসী, সূরা আলি-‘ইমরানের شَهِدَ اللهُ আয়াত শেষ পর্যন্ত এবং قُلِ اللّٰهُمَّ আয়াত بِغَیْرِ حِسَابٍ পর্যন্ত পাঠ করে, আমি তার ঠিকানা জান্নাতে করে দেব, আমার সকাশে স্থান দেব, দৈনিক সত্তর বার তার প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেব, তার সত্তরটি প্রয়োজন মিটাব, শত্রুর কবল থেকে আশ্রয় দেব এবং শত্রুর বিরুদ্ধে তাকে জয়ী করব।
অমুসলমানদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক কিরূপ হওয়া উচিত কুরআনে এ সম্পর্কিত অনেক আয়াত রয়েছে। সূরা মুমতা‘হিনায় বলা হয়েছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِم بِالْمَوَدَّةِ
“হে মুমিনগণ! আমার ও তোমাদের শত্রু অর্থাৎ, কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যে, তাদের কাছে তোমার বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাবে।”
পারস্পরিক সম্পর্ক কিরূপ হওয়া উচিত: এ বিষয়বস্তুটি কুরআনের বহু আয়াতে সংক্ষেপে এবং কোন কোন স্থানে বিস্তারিতভাবে-
পৃষ্ঠা নং- ১৭২
উল্লেখ করা হয়েছে। এসব আয়াতে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা স্থাপন করতে কঠোর ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। এসব দেখে শুনে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ অমুসলিমদের মনে সন্দেহ জাগে যে, মুসলমানদের ধর্মে কি অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে সদাচার প্রদশর্নেরও কোন অবকাশ নেই? পক্ষান্তরে এর বিপরীতে কুরআনের অনেক আয়াত, রসূলুল্লাহ (সা,)-এর অনেক বাণী এবং খোলাফায়ে-রাশেদীন ও অন্যান্য সাহাবিগণের আচরণ থেকে অমুসলিমদের সাথে দয়া, সদ্ব্যবহার, সহানুভূতি এবং সমবেদনার নির্দেশও পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, এমনসব ঘটনাবলীও প্রমাণিত দেখা যায়, যা অন্যান্য জাতির ইতিহাসে একান্তই বিরল। এসব দেখে একজন স্থুলবুদ্ধি মুসলমানও এক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশাবলীতে পরস্পর বিরোধীতা ও সংঘর্ষ অনুভব করতে পারে। কিন্তু উপরোক্ত উভয় প্রকার ধারণা সত্যিকার কুরআনী শিক্ষার প্রতি অগভীর মনোযোগ ও অসম্পূর্ণ তথ্যানুসন্ধানের ফল। কুরআনের বিভিন্ন স্থান থেকে এতদসম্পর্কিত আয়াতগুলো একত্রিত করে গভীরভাবে চিন্তা করলে অমুসলিমদের অভিযোগও দূর হয়ে যায় এবং আয়াত ও হাদীসসমূহের মধ্যে কোন প্রকার পরস্পর বিরোধিতাও অবশিষ্ট থাকে না। এ উদ্দেশ্যে বিষয়টির পূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছে। এতে বন্ধুত্ব, অনুগ্রহ, সদ্ব্যবহার, সহানুভূতি ও সমবেদনার পারস্পরিক পার্থক্য এবং প্রত্যেকটির স্বরূপ জানা যাবে। আরো জানা যাবে তার কারণ কি কি?
দুই ব্যক্তি অথবা দুই দলের মধ্যে সম্পর্কের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। একটি স্তর হলো আন্তরিক বন্ধুত্ব ও ভালবাসার। এই স্তরের সম্পর্ক একমাত্র মুসলমানদের সাথেই হতে পারে, অমুসলমানদের সাথে এরূপ সম্পর্ক স্থাপন করা কিছুতেই জায়েয নয়।
দ্বিতীয়ত: সমবেদনার স্তর। এর অর্থ সহানুভূতি, শুভাকাঙ্ক্ষা ও উপকার করা। এই স্তরের সম্পর্ক মুসলমানদের সাথে এবং যুদ্ধরত অমুসলিম সম্প্রদায় ছাড়া সব অমুসলমানদের সাথেও স্থাপন করা জায়েয।
সূরা মুমতাহিনায় বলা হয়েছে: “যারা তোমাদের সাথে ধর্মের ব্যাপারে যুদ্ধরত নয় এবং মাতৃভূমি থেকে তোমাদের বহিষ্কার করেনি, তাদের সাথে দয়া ও ন্যায়বিচারের ব্যবহার করতে আল্লাহ্ তোমাদের নিষেধ করেন না”।
তৃতীয়ত: সৌজন্য ও আতিথেয়তার স্তর। এর অর্থ বাহ্যিক সদাচার ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার। এই সম্পর্কের উদ্দেশ্য যদি ধর্মীয় উপকার সাধিত করা অথবা আতিথেয়তা অথবা তাদের অনিষ্ট হয়ে থাকে, তবে সব অমুসলমানের সাথেই এটা জায়েয। সূরা আলি-‘ইমরানের আলোচ্য আয়াতে إِلَّا أَن تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً বলে এ স্তরের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করা জায়েয নয়। তবে যদি তুমি তাদের অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করার লক্ষ্যে বন্ধুত্ব করতে চাও, তাহলে জায়েয। সৌজন্যভাবও বন্ধুত্বের হয়ে থাকে। এজন্য একে বন্ধুত্ব থেকে ব্যতিক্রম্ভুক্ত করা হয়েছে। -(বায়ানুল-কুরআন)
চতুর্থত: লেন-দেনের স্তর। অর্থাৎ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ইজারা, চাকুরী, শিল্প ও কারিগরী ক্ষেত্রে সম্পর্ক স্থাপন করা। এ স্তরের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাও সব অমুসলমানের সাথে জায়েয। তবে এতে যদি মুসলমানদের ক্ষতি হয়, তবে জায়েয নয়। রসূলুল্লাহ (সা,), খোলাফায়ে-রাশেদীন ও অন্যান্য সাহাবী কর্তৃক গৃহীত কর্মপন্থা এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। ফিকাহবিদগণ এ কারণেই যুদ্ধরত কাফেরদের হাতে সামরিক অস্ত্র-শস্ত্র বিক্রয় করা নিষিদ্ধ করেছেন এবং শুধুমাত্র ব্যবসা-বাণীজ্যের অনুমতি দিয়েছেন। তাদের চাকুরী প্রদান করা অথবা তাদের কল-কারখানা বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চাকুরী করা সবই জায়েয।
এ আলোচনা থেকে জানা গেলো যে, আন্তরিক বন্ধুত্ব ও ভালবাসা কোন কাফেরের সাথে কোন অবস্থাতেই জায়েয নয়। তবে অনুগ্রহ, সহানুভূতি ও উপকার সাধন যুদ্ধরত কাফের ছাড়া সবার বেলায়ই জায়েয। এমনিভাবে বাহ্যিক সচ্চরিত্রতা ও সৌহার্দমূলক ব্যবহার সবার সাথেই জায়েয আছে; তবে এর উদ্দেশ্য অতিথির আতিথেয়তা অথবা অমুসলমানকে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করা অথবা তাদের অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করা হতে হবে। রসূলুল্লাহ (সা,) ‘রহমাতুল লিল-‘আলামিন’ হয়ে জগতে আগমন করেন তিনি অমুসলমানদের সাথে যেরূপ অনুগ্রহ, সহানুভূতি ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছেন, তার নযীর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মক্কায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে যে শত্রুরা তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কার করেছিল, তিনি স্বয়ং তাদের সাহায্য করেন। এরপর মক্কা বিজিত হয়ে গেলে সব শত্রু তাঁর করতলগত হয়ে যায়। কিন্তু তিনি একথা বলে সবাইকে মুক্ত করে দেন যে, لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ অর্থাৎ, আজ তোমাদের শুধু ক্ষমাই করা হচ্ছে না, বরং অতীত উৎপীড়নের কারণে তোমাদের কোনরূপ ভৎসনাও করা হবে না। অমুসলিম যুদ্ধবন্দী হাতে আসার পর তিনি তাদের সাথে এমন ব্যবহার করতেন, যা অনেক পিতাও পুত্রের সাথে করেন না। কাফেররা তাঁকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছিল, কিন্তু তাঁর হাত প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে কখনও উত্থিত হয়নি। মুখে বদদো‘আও তিনি করেননি। অমুসলিম বনু-সাকীফের একটি প্রতিনিধি দল তাঁর কাছে উপস্থিত হলে তিনি মসজিদে-নববীতে তাদের অবস্থান করতে দেন-যা ছিল মুসলমানদের দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ সম্মানের স্থান।
হযরত ‘উমর রদিয়াল্লাহু ‘আনহু মুসলমানদের মত অমুসলমান দরিদ্র যিম্মীদেরও সরকারী ধনাগার থেকে ভাতা প্রদান করতেন। খোলাফায়ে-রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের কাজ-কর্মের মধ্যে এ জাতীয় অসংখ্য ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো ছিল সহানুভূতি, সৌজন্য ও লেন-দেনমূলক ব্যবহার, নিষিদ্ধ বন্ধুত্ব নয়।
এ ব্যাখ্যা থেকে জানা গেল যে, ইসলামে অমুসলিমদের জন্যে কতটুকু উদারতা ও সদ্ব্যবহারের শিক্ষা বর্তমান রয়েছে। অপরদিকে বন্ধুত্ব বর্জনের আয়াত থেকে সৃষ্ট বাহ্যিক পরস্পর বিরোধিতাও দূর হয়ে গেল।
এখন প্রশ্ন থেকে যায় যে, কুরআন কাফেরদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব ও ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন এত কঠোরভাবে নিষেধ করে কেন? কোন অবস্থাতেই এরূপ সম্পর্ক জায়েয না রাখার রহস্য কি? এর একটি বিশেষ কারণ এই যে, ইসলামের দৃষ্টিতে জগতের বুকে মানুষের অস্তিত্ব সাধারণ জিন-জানোয়ার অথবা জঙ্গলের বৃক্ষ ও লতা-পাতার মত নয় যে, জন্মলাভ করবে, বড় হবে, এরপর মরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। বরং ইসলাম মনে করে যে, মানুষের জীবন একটি উদ্দেশ্যমূলক জীবন। মানুষের খাওয়া-পরা, উঠা-বসা, নিদ্রা-জাগরণ এমন কি, জন্ম-মৃত্যু সবই একটি উদ্দেশ্যের চারপাশে অবিরত ঘুরছে। এসব কাজকর্ম যতক্ষণ সে উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে, ততক্ষণই তা নির্ভুল ও শুদ্ধ। পক্ষান্তরে উদ্দেশ্যের-
পৃষ্ঠা নং- ১৭৩
বিপরীত হয়ে গেলেই তা অশুদ্ধ।
আল্লাহ্ রাব্বুল-‘আলামীনের আনুগত্য ও এবাদতই যখন মানব-জীবনের লক্ষ্য, তখন জগতের কাজ-কারবার, রাজ্যশাসন, রাজনীতি ও পারিবারিক সম্পর্ক সবই এ লক্ষ্যের অধীন। অতএব যে মানব এ লক্ষ্যের বিরোধী, সে মানবতার প্রধান শত্রু।
বুখারী ও মুসলিমের একটি হাদীসে এ বিষয়বস্তুর এভাবে বর্ণিত হয়েছে: من أحب لله، وأبغض لله، وأعطى لله ومنع لله، فقد استكمل الإيمان، অর্থাৎ, “যে ব্যক্তি স্বীয় বন্ধুত্ব ও শত্রুতাকে আল্লাহ্র ইচ্ছার অধীন করে দেয়, সে স্বীয় ঈমানকে পূর্ণতা দান করে”। এতে বোঝা গেল যে, স্বীয় ভালবাসা, বন্ধুত্ব, শত্রুতা ও বিদ্বেষকে আল্লাহ্র ইচ্ছার অধীন করে দিলেই ঈমান পূর্ণতা লাভ করে। অতএব মুমিনের আন্তরিক বন্ধুত্ব এমন ব্যক্তির সাথেই হতে পারে, যে এ উদ্দেশ্য হাসিলে তাঁর সঙ্গী এবং আল্লাহ্র অনুগত। এ কারণে কাফেরদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব স্থাপনকারীদের সম্পর্কে কুরআনের উল্লেখিত আয়াতসমূহে বলা হয়েছে যে, ওরা কাফেরদেরই অন্তর্ভুক্ত।
আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে: আল্লাহ্ স্বীয় মহান সত্তার প্রতি তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করেন। ক্ষণস্থায়ী স্বার্থের খাতিরে কাফেরদের আন্তরিক বন্ধুত্বে লিপ্ত হয়ে আল্লাহ্কে অসন্তুষ্ট করবে না। বন্ধুত্বের সম্পর্ক অন্তরের সাথে। অন্তরের অবস্থা আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। সুতরাং বাস্তবে কেউ কাফেরের সাথে বন্ধুত্ব রেখে মুখে তা অস্বীকার করতে পারে। এ কারণে দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে: “তোমাদের অন্তরের গোপন ভেদ সম্পর্কে আল্লাহ্ তাআলা ওয়াকিফহাল। অস্বীকৃতি ও অপকৌশল তাঁর সামনে অচল”।