আলি ‘ইমরান, আয়াত ৩০-৬২

يَوۡمَ تَجِدُ كُلُّ نَفۡسٖ مَّا عَمِلَتۡ مِنۡ خَيۡرٖ مُّحۡضَرٗا وَمَا عَمِلَتۡ مِن سُوٓءٖ تَوَدُّ لَوۡ أَنَّ بَيۡنَهَا وَبَيۡنَهُۥٓ أَمَدَۢا بَعِيدٗاۗ وَيُحَذِّرُكُمُ ٱللَّهُ نَفۡسَهُۥۗ وَٱللَّهُ رَءُوفُۢ بِٱلۡعِبَادِ ٣٠

৩০. সেদিন প্রত্যেকেই যা কিছু সে ভাল কাজ করেছে; চোখের সামনে দেখতে পাবে এবং যা কিছু মন্দ কাজ করেছে তাও, ওরা তখন কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের মধ্যে ব্যবধান দুরের হতো! আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদের সাবধান করছেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।

قُلۡ إِن كُنتُمۡ تُحِبُّونَ ٱللَّهَ فَٱتَّبِعُونِي يُحۡبِبۡكُمُ ٱللَّهُ وَيَغۡفِرۡ لَكُمۡ ذُنُوبَكُمۡۚ وَٱللَّهُ غَفُورٞ رَّحِيمٞ ٣١

৩১. বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।

قُلۡ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَۖ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٢

৩২. বলুন, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য প্রকাশ কর। বস্তুতঃ যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ কাফেরদিগকে ভালবাসেন না।

۞إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰٓ ءَادَمَ وَنُوحٗا وَءَالَ إِبۡرَٰهِيمَ وَءَالَ عِمۡرَٰنَ عَلَى ٱلۡعَٰلَمِينَ ٣٣

৩৩. নিঃসন্দেহে আল্লাহ আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম), নূ‘হ (‘আলাইহিচ্ছালাম), ও ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর বংশধর এবং ‘ইমরান (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর খান্দানকে নির্বাচিত করেছেন।

ذُرِّيَّةَۢ بَعۡضُهَا مِنۢ بَعۡضٖۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ٣٤

৩৪. যারা বংশধর ছিলেন পরস্পরের। আল্লাহ শ্রবণকারী ও মহাজ্ঞানী।

إِذۡ قَالَتِ ٱمۡرَأَتُ عِمۡرَٰنَ رَبِّ إِنِّي نَذَرۡتُ لَكَ مَا فِي بَطۡنِي مُحَرَّرٗا فَتَقَبَّلۡ مِنِّيٓۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ٣٥

৩৫. এমরানের স্ত্রী যখন বললো-হে আমার পালনকর্তা! আমার গর্ভে যা রয়েছে আমি তাকে তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত রেখে। আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও, নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞাত।

فَلَمَّا وَضَعَتۡهَا قَالَتۡ رَبِّ إِنِّي وَضَعۡتُهَآ أُنثَىٰ وَٱللَّهُ أَعۡلَمُ بِمَا وَضَعَتۡ وَلَيۡسَ ٱلذَّكَرُ كَٱلۡأُنثَىٰۖ وَإِنِّي سَمَّيۡتُهَا مَرۡيَمَ وَإِنِّيٓ أُعِيذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ ٱلشَّيۡطَٰنِ ٱلرَّجِيمِ ٣٦

৩৬. অতঃপর যখন তাকে প্রসব করলো বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি একে কন্যা প্রসব করেছি। বস্তুতঃ কি সে প্রসব করেছে আল্লাহ তা ভালই জানেন। সেই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম মারইয়াম। আর আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। অভিশপ্ত শয়তানের কবল থেকে।

فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٖ وَأَنۢبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنٗا وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّاۖ كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيۡهَا زَكَرِيَّا ٱلۡمِحۡرَابَ وَجَدَ عِندَهَا رِزۡقٗاۖ قَالَ يَٰمَرۡيَمُ أَنَّىٰ لَكِ هَٰذَاۖ قَالَتۡ هُوَ مِنۡ عِندِ ٱللَّهِۖ إِنَّ ٱللَّهَ يَرۡزُقُ مَن يَشَآءُ بِغَيۡرِ حِسَابٍ ٣٧

৩৭. অতঃপর তাঁর পালনকর্তা তাঁকে উত্তম ভাবে গ্রহণ করে নিলেন এবং তাঁকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন-অত্যন্ত সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তাঁকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পন করলেন। যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কছে আসতেন তখনই কিছু খাবার দেখতে পেতেন। জিজ্ঞেস করতেন “মারইয়াম! কোথা থেকে এসব তোমার কাছে এলো?” তিনি বলতেন, “এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন।”

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

          ভালবাসা একটি গোপন বিষয়। কারো প্রতি কারো ভালবাসা আছে কি না, অল্প আছে কি বেশী আছে, তা জানার একমাত্র মাপকাঠি হলো, অবস্থা ও পারস্পরিক ব্যবহার দেখে অনুমান করা অথবা ভালবাসার চিহ্ন লক্ষণাদি দেখে জেনে নেয়া। যারা আল্লাহ্‌কে ভালবাসার দাবীদার এবং আল্লাহ্‌র ভালবাসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষী, আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ্‌ তা‘আলা স্বীয় ভালবাসার মাপকাঠি তাদের বলে দিয়েছেন। অর্থাৎ, জগতে যদি কেউ পরম প্রভুর ভালবাসার দাবী করে, তবে মু‘হাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লামের অনুসরণের কষ্টিপাথরে তা যাচাই করে দেখা অত্যাবশ্যকীয়। এতে আসল ও মেকী ধরা পড়বে। যার দাবী যতটূকু সত্য হবে, সে রসূলুল্লাহ (সা,)-এর অনুসরণে ততটুকু যত্নবান হবে এবং তাঁর শিক্ষার আলোকে পথের মশালরূপে গ্রহণ করবে। পক্ষান্তরে যার দাবী দুর্বল হবে, রসূলুল্লাহ (সা,)-এর অনুসরণে তাঁর অলসতা ও দুর্বলতা সেই পরিমাণে পরিলক্ষিত হবে।

পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের আলোচনা: হযরত নাবী করীম (সা,)-এর রেসালাতের সন্দেহ পোষণ করার কারণে যেসব লোক তাঁর আনুগত্য করতো না, আলোচ্য আয়াতসমূহে তাদের পথ প্রদর্শনের জন্যে পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের কিছু নযীর বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে তাদের সন্দেহ দূর হয়ে যায়। পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের আলোচনায় হযরত আদম, নূ‘হ, আলি-ইবরাহীম ও আলি-‘ইমরানের কথা সংক্ষেপে উল্লেখিত হয়েছে।

পৃষ্ঠা নং- ১৭৪

এখানে হযরত ঈসা (আ,)-এর আলোচনাই আসল উদ্দেশ্য। এর আগে তাঁর মাতা ও মাতামহীর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এর রহস্য ও উপযোগিতা পরে বর্ণিত হবে। মোটকথা এই যে, শেষ জমানায় মুসলিম সম্প্রদায়কে হযরত ঈসা (আ,)-এর সাথে একযোগে কাজ করতে হবে। এ কারণে তাঁর পরিচয় ও লক্ষণাদির বর্ণনায় কুরআন অন্যান্য পয়গম্বরের তুলনায় অধিক যত্নবান।

পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের শরীয়তে প্রচলিত এবাদত-পদ্ধতির মধ্যে আল্লাহ্‌র নামে সন্তান উতসর্গ করার রেওয়াজও ছিল। এসব উৎসর্গীকৃত সন্তানদের পার্থিব কোন কাজকর্মে নিযুক্ত করা হতো না। এ পদ্ধতি অনুযায়ী মরিয়মের জননী নিজের গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে মান্নত করলেন যে, তাকে বিশেষভাবে বায়তুল-মুকাদ্দাসের খেদমতে নিয়োজিত করা হবে এবং অন্য কোন পার্থিব কাজে নিয়োগ করা হবে না। কিন্তু যখন তিনি কন্যা প্রসব করলেন, তখন এই ভেবে অপেক্ষা করতে পাগলেন যে, কন্যা দ্বারা তো এ কাজ সম্ভবপর নয়। কিন্তু আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাঁর আন্তরিকতার বরকতে কন্যাকেই কবূল করে নিলেন এবং সারা বিশ্বের কন্যাদের মধ্যে তাঁকে বিশেষ মর্যাদা দান করলেন।

এতে বোঝা যায় যে, সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষা ও লালন-পালনের ব্যাপারে জননীর বিশেষ অধিকার রয়েছে। এরূপ না হলে মরিয়মের জননী মান্নত করতেন না।

هُنَالِكَ دَعَا زَكَرِيَّا رَبَّهُۥۖ قَالَ رَبِّ هَبۡ لِي مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّةٗ طَيِّبَةًۖ إِنَّكَ سَمِيعُ ٱلدُّعَآءِ ٣٨

৩৮. সেখানেই যাকারিয়া তাঁর পালনকর্তার নিকট প্রার্থনা করলেন। বললেন, হে, আমার পালনকর্তা! তোমার নিকট থেকে আমাকে পুত-পবিত্র সন্তান দান কর-নিশ্চয়ই তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী।

فَنَادَتۡهُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَهُوَ قَآئِمٞ يُصَلِّي فِي ٱلۡمِحۡرَابِ أَنَّ ٱللَّهَ يُبَشِّرُكَ بِيَحۡيَىٰ مُصَدِّقَۢا بِكَلِمَةٖ مِّنَ ٱللَّهِ وَسَيِّدٗا وَحَصُورٗا وَنَبِيّٗا مِّنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ٣٩

৩৯. যখন তিনি কামরার ভেতরে নামাযে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন ফেরেশতারা তাঁকে ডেকে বললেন যে, আল্লাহ তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন ইয়াহইয়া সম্পর্কে, যিনি সাক্ষ্য দেবেন আল্লাহর নির্দেশের সত্যতা সম্পর্কে, যিনি নেতা হবেন এবং নারীদের সংস্পর্শে যাবেন না, তিনি অত্যন্ত সৎকর্মশীল নবী হবেন।

قَالَ رَبِّ أَنَّىٰ يَكُونُ لِي غُلَٰمٞ وَقَدۡ بَلَغَنِيَ ٱلۡكِبَرُ وَٱمۡرَأَتِي عَاقِرٞۖ قَالَ كَذَٰلِكَ ٱللَّهُ يَفۡعَلُ مَا يَشَآءُ ٤٠

৪০. তিনি বললেন হে পালনকর্তর! কেমন করে আমার পুত্র সন্তান হবে, আমার যে বার্ধক্য এসে গেছে, আমার স্ত্রীও যে বন্ধ্যা। বললেন, আল্লাহ এমনি ভাবেই যা ইচ্ছা করে থাকেন।

قَالَ رَبِّ ٱجۡعَل لِّيٓ ءَايَةٗۖ قَالَ ءَايَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ ٱلنَّاسَ ثَلَٰثَةَ أَيَّامٍ إِلَّا رَمۡزٗاۗ وَٱذۡكُر رَّبَّكَ كَثِيرٗا وَسَبِّحۡ بِٱلۡعَشِيِّ وَٱلۡإِبۡكَٰرِ ٤١

৪১. তিনি বললেন, হে পালনকর্তা আমার জন্য কিছু নিদর্শন দাও। তিনি বললেন, তোমার জন্য নিদর্শন হলো এই যে, তুমি তিন দিন পর্যন্ত কারও সাথে কথা বলবে না। তবে ইশারা ইঙ্গতে করতে পারবে এবং তোমার পালনকর্তাকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করবে আর সকাল-সন্ধ্যা তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করবে।

وَإِذۡ قَالَتِ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ يَٰمَرۡيَمُ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰكِ وَطَهَّرَكِ وَٱصۡطَفَىٰكِ عَلَىٰ نِسَآءِ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٤٢

৪২. আর যখন ফেরেশতা বলল হে মারইয়াম!  আল্লাহ তোমাকে পছন্দ করেছেন এবং তোমাকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। আর তোমাকে বিশ্ব নারী সমাজের উর্ধ্বে মনোনীত করেছেন।

يَٰمَرۡيَمُ ٱقۡنُتِي لِرَبِّكِ وَٱسۡجُدِي وَٱرۡكَعِي مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ ٤٣

৪৩. হে মারইয়াম! তোমার পালনকর্তার উপাসনা কর এবং রুকু’কারীদের সাথে সেজদা ও রুকু’ কর।

ذَٰلِكَ مِنۡ أَنۢبَآءِ ٱلۡغَيۡبِ نُوحِيهِ إِلَيۡكَۚ وَمَا كُنتَ لَدَيۡهِمۡ إِذۡ يُلۡقُونَ أَقۡلَٰمَهُمۡ أَيُّهُمۡ يَكۡفُلُ مَرۡيَمَ وَمَا كُنتَ لَدَيۡهِمۡ إِذۡ يَخۡتَصِمُونَ ٤٤

৪৪. এ হলো গায়েবী সংবাদ, যা আমি আপনাকে পাঠিয়ে থাকি। আর আপনি তো তাদের কাছে ছিলেন না, যখন প্রতিযোগিতা করছিল যে, কে প্রতিপালন করবে মারইয়ামকে এবং আপনি তাদের কাছে ছিলেন না, যখন তারা ঝগড়া করছিলো।

إِذۡ قَالَتِ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ يَٰمَرۡيَمُ إِنَّ ٱللَّهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٖ مِّنۡهُ ٱسۡمُهُ ٱلۡمَسِيحُ عِيسَى ٱبۡنُ مَرۡيَمَ وَجِيهٗا فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِ وَمِنَ ٱلۡمُقَرَّبِينَ ٤٥

৪৫. যখন ফেরেশতাগণ বললো, হে মারইয়াম আল্লাহ তোমাকে তাঁর এক বানীর সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হলো মসীহ-মারইয়াম-তনয় ঈসা, দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি মহাসম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠদের অন্তর্ভূক্ত।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

          هُنَالِكَ دَعَا زَكَرِيَّا হযরত যাকারিয়া (আ,) তখনও পর্যন্ত নিঃসন্তান ছিলেন।

সময়ও ছিল বার্ধক্যের- যে বয়সে স্বাভাবিকভাবে সন্তান হয় না। তবে খোদায়ী শক্তি-সামর্থ্যের প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল যে, আলৌকিকভাবে এহেন বার্ধক্যের মধ্যেও তিনি সন্তান দিতে পারেন। তবে অসময়ে ও অস্থানে দান করার খোদায়ী মহিমা ইতিঃপূর্বে তিনি কখনও প্রত্যক্ষ করেন নি। তাই এযাবৎ সাহস করে দো‘আ করেননি। কিন্তু এসময় যখন তিনি দেখতে পেলেন যে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা ফলের মওসুম ছাড়াই মরিয়মকে ফল দান করেছেন, তখনই তাঁর মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠলো এবং তিনি দো‘আ করার সাহস পেলেন; যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ মওসুম ছাড়াই ফল দিতে পারেন, তিনি বৃদ্ধ দম্পতিকে হয়ত সন্তানও দেবেন। বললেন-

قَالَ رَبِّ هَبْ لِي مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً এতে বোঝা যায় যে, সন্তান হওয়ার জন্যে দো‘আ করা পয়গম্বর ও সজ্জ্বনদের সুন্নত।

অপর এক আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেন:

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِّن قَبْلِكَ وَجَعَلْنَا لَهُمْ أَزْوَاجًا وَذُرِّيَّةً   অর্থাৎ, হযরত নাবী করীম (সা,)-কে যেরূপ স্ত্রী ও সন্তান দান করা হয়েছে, তদ্রুপ এই নেয়ামত পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণকেও দেয়া হয়েছিল। এখন কেউ যদি কোণ পন্থায় সন্তান জন্মগ্রহণের পথে বাধা সৃষ্টি করে, তবে সে শুধু স্বভাবধর্মের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করে না; বরং পয়গম্বরের একটি সার্বজনীন ও সর্মসম্মত সুন্নত থেকেও বঞ্চিত হয়।

পৃষ্ঠা নং-১৭৫

হযরত নাবী কারীম (সা,) বিবাহ ও সন্তানের প্রশ্নটিকে অত্যধিক গুরুত্ব দান করেছেন। তাই যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিবাহ কিংবা সন্তান গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে, তাকে তিনি স্বীয় দলের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার অনুমতি দেননি। তিনি বলেন:

“বিবাহ আমার সুন্নাত। যে ব্যক্তি এ সুন্নাত থেকে বিমুখ হয়, সে আমার দলভূক্ত নয়। তোমরা বিবাহ কর। কেননা, তোমাদের আধিক্যের কারণে আমি অন্যান্য উম্মতের উপর গর্ব করবো”।

كلمة الله (আল্লাহ্‌র বাণী)- হযরত ঈসা (আ,)-কে ‘কালিমাতুল্লাহ’ বলার কারণ এই যে, তিনি শুধু আল্লাহ্‌র নির্দেশে চিরাচরিত প্রথার বিপরীতে পিতার মাধ্যম ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

وَحَصُوْرًا এটা হযরত ইয়া‘হ্‌য়া (আ,)-এর তৃতীয় গুণ। এর অর্থ যাবতীয় কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা। উদাহরণত: উত্তম পানাহার, উত্তম পোষাক পরিধান এবং বিবাহ ইত্যাদি। এ গুণটি প্রশংসার ক্ষেত্রে উল্লেখ করায় বাহ্যত: মনে হয় যে, এটাই উত্তম প্রথা। অথচ বিভিন্ন হাদীসে বিবাহিত জীবন-যাপন করাই যে উত্তম একথা প্রমাণিত আছে। এ সম্পর্কে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এই যে, যদি কারও অবস্থা হযরত ইয়া‘হইয়া (আ,)-এর মত হয়- অর্থাৎ, অন্তরে পরকালের চিন্তা প্রবল হওয়ার কারণে স্ত্রীর প্রয়োজন অনুভূত না হয় এবং স্ত্রী ও সন্তানদের হক আদায় করার মত অবকাশ না থাকে, তবে তার পক্ষে বিবাহ না করাই উত্তম। এ কারণে যেসব হাদীসে বিবাহের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তাতে এ কথাও বলা হয়েছে, من استطاع منكم الباءة অর্থাৎ, যে ব্যক্তি বিবাহের সামর্থ্য রাখে এবং স্ত্রীর হক আদায় করতে পারে, তার পক্ষেই বিবাহ করা উত্তম- অন্যথায় নয়। (বায়ানুল কুরআন)

          হযরত যাকারিয়া (আ,)-এর দু‘আর তাৎপর্য:

أَنَّىٰ يَكُونُ لِي غُلَامٌ

          হযরত যাকারিয়া (আ,) খোদায়ী শক্তি-সামর্থ্যে বিশ্বাসী ছিলেন। ইতিপূর্বে এর নমুনা প্রত্যক্ষ করে নিজে দো‘আও করেছিলেন। এছাড়া দু‘আ কবুল হওয়ার বিষয়ও তিনি অবগত ছিলেন। এত সবের পরেও ‘কিভাবে আমার পূত্র হবে’ বলার মানে কি? এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, এ জিজ্ঞাসা আল্লাহ্‌র শক্তি-সামর্থ্যের সন্দেহের কারণে ছিল না। বরং তিনি পুত্র হওয়ার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন যে, আমরা স্বামী-স্ত্রী বর্তমানে বার্ধক্যের যে পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছি, তা বহাল রেখেই পুত্র দান করা হবে, না এতে কোনরূপ পরিবর্তন করা হবে? আল্লাহ্‌ তা‘আলা উত্তরে বলেছিলেন যে, না তোমরা বার্ধক্যাবস্থায়ই থাকবে এবং এ অবস্থাতেই তোমাদের সন্তান হবে। সুতরাং আয়াতের অর্থে কোনরূপ জটিলতা নেই।

قَالَ آيَتُكَ أَلَّا تُكَلِّمَ النَّاسَ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ إِلَّا رَمْزًا

          প্রতিশ্রুত সেই সুসংবাদটি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগতি এবং পুত্র জন্মগ্রহণের পূর্বেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশে মশগুল হওয়ার উদ্দেশ্যে হযরত যাকারিয়া (আ,) নিদর্শন জানতে চেয়েছিলেন। আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাঁকে এ নিদর্শন দিলেন যে, তিন দিন পর্যন্ত তুমি মানুষের সাথে ইশারা-ঈঙ্গিত ছাড়া কথা বলতে সমর্থ হবে না।

এ নিদর্শনের মধ্যে সূক্ষ্মতা এই যে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে নিদর্শন চাওয়া হয়েছিল। আল্লাহ্‌ তা‘আলা এমন নিদর্শন দিলেন যে, তাতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ছাড়া হযরত যাকারিয়া অন্য কোন কাজের যোগ্যই থাকবেন না। সুতরাং কাঙ্ক্ষিত নিদর্শন পাওয়া গেলো এবং উদ্দেশ্যও পুরোপুরি অর্জিত হলো।

إِلَّا رَمْزًا এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, কথা বলতে অক্ষম হলে ইশারা-ঈঙ্গিত কথার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। এক হাদীসে বর্ণিত আছে, হযরত নাবী কারীম (সা,) এক বাদীকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ্‌ কোথায়? উত্তরে সে আকাশের দিকে ইশারা করলে হযরত (সা,) বললেন: এ বাদী মুসলমান। (কুরতুবী)

ইসলামী শরীয়তে লটারী সম্পর্কিত বিধান এই যে, হানাফী মাযহাব মতে যেসব হকের কারণ শরীয়তানুযায়ী নির্দিষ্ট ও জানা আছে, সেসব হকের মীমাংসা লটারীযোগে করা নাজায়েয এবং তা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণত: শরীকানাধীন বস্তুর মীমাংসা লটারীযোগে করা এবং লটারীতে যার নাম বের হয় তাকে সম্পূর্ণ বস্তুটি দিয়ে দেয়া অথবা কোন শিশুর পিতৃত্বে মতবিরোধ দেখা দিলে লটারিযোগে একজনকে পিতা মনে করে নেয়া। পক্ষান্তরে যেসব হকের কারণ জনগণের রায়ের ওপর ন্যাস্ত, সেসব হকের মীমাংসা লটারীযোগে করা জায়েয। যথা- কোন শরীককে কোন অংশ দেয়া হবে, সে ব্যাপারে লটারীর মাধ্যমে মীমাংসা করা। এক্ষেত্রে লটারীর মাধ্যমে একজনকে পূর্বের অংশ ও অন্যজনকে পশ্চিমের অংশ দেয়া জায়েয। এর কারণ এই যে, লটারী ছাড়াই উভয়পক্ষ একমত হয়ে যদি এভাবে অংশ নিতো অথবা বিচারকের রায়ের ভিত্তিতে এভাবে নিতো, তবুও তা জায়েয হতো। (বায়ানুল-কুরআন)

অর্থাৎ, যেক্ষেত্রে সব শরীকের অংশ সমান হয়, সেখানে কোন এক দিককে এক শরীকের জন্যে নির্দিষ্ট করার উদ্দেশ্যে লটারী জায়েয।

হযরত ঈসা (আ,)-এর আবির্ভাবের একটি প্রমাণ: আলোচ্য আয়াতে হযরত ঈসা  (আ,)-এর একটি অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তিনি শৈশবে যে বয়সে কোন শিশু কথা বলতে সক্ষম হয়না, তখনই কথা বলবেন। অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে যে, জন্মের পর যখন ইহুদীরা মারয়ামের প্রতি অপবাদ আরোপ করত: ভৎসনা করতে থাকে, তখন সদ্যজাত শিশু ঈসা (আ,) বলে ওঠেন: আমি আল্লাহ্‌র বান্দা। এতদসত্ত্বেও আলোচ্য আয়াতে আরও বলা হয়েছে যে, যখন তিনি পৌঢ় বয়সের হবেন, তখনও মানুষের সাথে কথা বলবেন। এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, শৈশবাবস্থায় কথা বলা নিঃসন্দেহে একটি অলৌকিক ব্যাপার। যার উল্লেখ এক্ষেত্রে সমীচীন হয়েছে। কিন্তু পৌঢ় বয়সে কথা বলা কোন অলৌকিক ব্যাপার নয়। মুমিন, কাফের, পণ্ডিত, মূর্খ সবাই এ বয়সে কথা বলে।  কাজেই এক্ষেত্রে বিশেষ গুণ হিসাবে এটা উল্লেখ করার অর্থ কি?

এ প্রশ্নের এক উত্তর বায়ানুল-কুরআনে দেয়া হয়েছে যে, ‘শৈশবাবস্থায় কথা বলা’ বর্ণনা করাই আসল উদ্দেশ্য। ততসঙ্গে ‘পৌঢ় বয়সের কথা’ উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এই যে, তাঁর শৈশাবাবস্থার কথাবার্তাও শিশুসুলভ হবে না; বরং পৌঢ় লোকদের মত জ্ঞানীসুলভ, মেধা সম্পন্ন প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধ হবে।

পৃষ্ঠা নং-১৭৬

وَيُكَلِّمُ ٱلنَّاسَ فِي ٱلۡمَهۡدِ وَكَهۡلٗا وَمِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ٤٦

৪৬. যখন তিনি মায়ের কোলে থাকবেন এবং পূর্ণ বয়স্ক হবেন তখন তিনি মানুষের সাথে কথা বলবেন। আর তিনি সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।

قَالَتۡ رَبِّ أَنَّىٰ يَكُونُ لِي وَلَدٞ وَلَمۡ يَمۡسَسۡنِي بَشَرٞۖ قَالَ كَذَٰلِكِ ٱللَّهُ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُۚ إِذَا قَضَىٰٓ أَمۡرٗا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ٤٧

৪৭. তিনি বললেন, পরওয়ারদেগার! কেমন করে আমার সন্তান হবে; আমাকে তো কোন মানুষ স্পর্শ করেনি। বললেন এ ভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যখন কোন কাজ করার জন্য ইচ্ছা করেন তখন বলেন যে, ‘হয়ে যাও’ অমনি তা হয়ে যায়।

وَيُعَلِّمُهُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَٱلتَّوۡرَىٰةَ وَٱلۡإِنجِيلَ ٤٨

৪৮. আর তাকে তিনি শিখিয়ে দেবেন কিতাব, হিকমত, তওরাত, ইঞ্জিল।

وَرَسُولًا إِلَىٰ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ أَنِّي قَدۡ جِئۡتُكُم بِ‍َٔايَةٖ مِّن رَّبِّكُمۡ أَنِّيٓ أَخۡلُقُ لَكُم مِّنَ ٱلطِّينِ كَهَيۡ‍َٔةِ ٱلطَّيۡرِ فَأَنفُخُ فِيهِ فَيَكُونُ طَيۡرَۢا بِإِذۡنِ ٱللَّهِۖ وَأُبۡرِئُ ٱلۡأَكۡمَهَ وَٱلۡأَبۡرَصَ وَأُحۡيِ ٱلۡمَوۡتَىٰ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۖ وَأُنَبِّئُكُم بِمَا تَأۡكُلُونَ وَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمۡۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَةٗ لَّكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٤٩

৪৯. আর বণী ইসরাঈলদের জন্যে রসূল হিসেবে তাকে মনোনীত করবেন। তিনি বললেন নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকট তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছি নিদর্শনসমূহ নিয়ে। আমি তোমাদের জন্য মাটির দ্বারা পাখীর আকৃতি তৈরী করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুৎকার প্রদান করি, তখন তা উড়ন্ত পাখীতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে। আর আমি সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং শ্বেত কুষ্ঠ রোগীকে। আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। আর আমি তোমাদেরকে বলে দেই যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। এতে প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।

وَمُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيَّ مِنَ ٱلتَّوۡرَىٰةِ وَلِأُحِلَّ لَكُم بَعۡضَ ٱلَّذِي حُرِّمَ عَلَيۡكُمۡۚ وَجِئۡتُكُم بِ‍َٔايَةٖ مِّن رَّبِّكُمۡ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُونِ ٥٠

৫০. আর এটি পূর্ববর্তী কিতাব সমুহকে সত্যায়ন করে, যেমন তওরাত। আর তা এজন্য যাতে তোমাদের জন্য হালাল করে দেই কোন কোন বস্তু যা তোমাদের জন্য হারাম ছিল। আর আমি তোমাদের নিকট এসেছি তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শনসহ। কাজেই আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার অনুসরণ কর।

إِنَّ ٱللَّهَ رَبِّي وَرَبُّكُمۡ فَٱعۡبُدُوهُۚ هَٰذَا صِرَٰطٞ مُّسۡتَقِيمٞ ٥١

৫১. নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদেরও পালনকর্তা-তাঁর এবাদত কর, এটাই হলো সরল পথ।

۞فَلَمَّآ أَحَسَّ عِيسَىٰ مِنۡهُمُ ٱلۡكُفۡرَ قَالَ مَنۡ أَنصَارِيٓ إِلَى ٱللَّهِۖ قَالَ ٱلۡحَوَارِيُّونَ نَحۡنُ أَنصَارُ ٱللَّهِ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَٱشۡهَدۡ بِأَنَّا مُسۡلِمُونَ ٥٢

৫২. অতঃপর ঈসা (আঃ) যখন বণী ইসরায়ীলের কুফরী সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারলেন, তখন বললেন, কারা আছে আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্য কররব? সঙ্গী-সাথীরা বললো, আমরা রয়েছি আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি। আর তুমি সাক্ষী থাক যে, আমরা হুকুম কবুল করে নিয়েছি।

رَبَّنَآ ءَامَنَّا بِمَآ أَنزَلۡتَ وَٱتَّبَعۡنَا ٱلرَّسُولَ فَٱكۡتُبۡنَا مَعَ ٱلشَّٰهِدِينَ ٥٣

৫৩. হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা সে বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি যা তুমি নাযিল করেছ, আমরা রসূলের অনুগত হয়েছি। অতএব, আমাদিগকে মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নাও।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

          দ্বিতীয় উত্তর এই যে, এখানে পৌঢ় বয়সের কথাবার্তার উল্লেখ একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিতস্বরূপ করা হয়েছে। তা এই যে, ইসলামী ও কুরআনী বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত ঈসা (আ,)-কে জীবিতাবস্থায় আকাশে তুলে নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে যে, আকাশে তুলে নেয়ার সময় তাঁর বয়স প্রায় ত্রিশ-পয়ত্রিশের মাঝামাঝি ছিল। অর্থাৎ, তিনি যৌবনের প্রারম্ভিক কালে উত্তোলিত হয়েছেন। অতএব পৌঢ় বয়স-যাকে আরবীতে ‘কুহল’ বলা হয়-তিনি এ জগতে সে বয়স পাননি। কাজেই পৌঢ় বয়সে মানুষের সাথে কথা বলা তখনই সম্ভব, যখন তিনি আবার এ জগতে প্রত্যাবর্তন করবেন। এ কারণেই তাঁর শৈশবস্থায় কথাবার্তা বলা যেমন একটি অলৌকিক ব্যাপার, তেমনি পৌঢ় বয়সে দুনিয়ায় ফিরে এসে কথাবার্তা বলাও হবে একটা অলৌকিক ব্যাপার।

পাখীর আকৃতি গঠন করা তথা চিত্রাঙ্কন করা হযরত ঈসা (আ,)-এর শরীয়তে বৈধ ছিল। আমাদের শরীয়তে এর বৈধতা রহিত হয়ে গেছে।

قَالَ الْحَوَارِيُّونَ -حَوَارِيُّ  শব্দটি حور ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন। অভিধানে এর অর্থ দেয়ালে চুনকাম করার চুন। পরিভাষায় হযরত ঈসা (আ,)-এর খাঁটি ভক্তদের উপাধি ছিল হাওয়ারী-তাদের আন্তরিকতা ও মনের স্বচ্ছতার কারণে অথবা যেহেতু তাঁরা সাদা পোশাক পরিধান করতেন এ জন্য তাদেরকে হাওয়ারী নামে অভিহিত করা হতো। যেমন, রসূলুল্লাহ (সা,)-এর ভক্ত ও সহচরগণের উপাধি ছিল সাহাবী।

কোন কোন তাফসীরবিদ হাওয়ারীদের সংখ্যা দ্বাদশ উল্লেখ করেছেন। ‘হাওয়ারী’ শব্দটি কোন সময় শুধু সাহায্যকারী অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এ অর্থেই এক হাদীসে বলা হয়েছে: প্রত্যেক পয়গম্বরের একজন হাওয়ারী অর্থাৎ, খাঁটি সহচর থাকে আমার হাওয়ারী হলেন যুবায়ের। (কুরতুবী)

আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, ঈসা (আ,) যখন মানুষের অবিশ্বাস ও বিরোধিতা লক্ষ্য করলেন, তখন সাহায্যকারীদের খোঁজ নিলেন এবং مَنْ أَنْصَارِىْ বললেন। এর আগে তিনি একা একাই নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি সূচনা থেকেই কোন সাহায্যকারী দল গঠন করার চিন্তা করেননি। প্রয়োজন দেখা দিতেই দল গঠিত হয়ে যায়। বস্তুত: জগতের সব কাজই এমনি দৃঢ়তা ও সাহসিকতা চায়।

পৃষ্ঠা নং-১৭৭

وَمَكَرُواْ وَمَكَرَ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ ٥٤

৫৪. এবং কাফেরেরা চক্রান্ত করেছে আর আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কুশলী।

إِذۡ قَالَ ٱللَّهُ يَٰعِيسَىٰٓ إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَجَاعِلُ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوكَ فَوۡقَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓاْ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِۖ ثُمَّ إِلَيَّ مَرۡجِعُكُمۡ فَأَحۡكُمُ بَيۡنَكُمۡ فِيمَا كُنتُمۡ فِيهِ تَخۡتَلِفُونَ ٥٥

৫৫. আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ বলবেন, হে ‘ঈসা! আমি তোমাকে নিয়ে নেবো এবং তোমাকে নিজের দিকে তুলে নিবো-কাফেরদের থেকে তোমাকে পবিত্র করে দেবো। আর যারা তোমার অনুগত রয়েছে তাদেরকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যারা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তাদের উপর জয়ী করে রাখবো। বস্তুতঃ তোমাদের সবাইকে আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। তখন যে বিষয়ে তোমরা বিবাদ করতে, আমি তোমাদের মধ্যে তার ফয়সালা করে দেবো।

فَأَمَّا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَأُعَذِّبُهُمۡ عَذَابٗا شَدِيدٗا فِي ٱلدُّنۡيَا وَٱلۡأٓخِرَةِ وَمَا لَهُم مِّن نَّٰصِرِينَ ٥٦

৫৬. অতএব যারা কাফের হয়েছে, তাদেরকে আমি কঠিন শাস্তি দেবো দুনিয়াতে এবং আখেরাতে-তাদের কোন সাহায্যকারী নেই।

وَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ فَيُوَفِّيهِمۡ أُجُورَهُمۡۗ وَٱللَّهُ لَا يُحِبُّ ٱلظَّٰلِمِينَ ٥٧

৫৭. পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে। তাদের প্রাপ্য পরিপুর্ণভাবে দেয়া হবে। আর আল্লাহ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না।

ذَٰلِكَ نَتۡلُوهُ عَلَيۡكَ مِنَ ٱلۡأٓيَٰتِ وَٱلذِّكۡرِ ٱلۡحَكِيمِ ٥٨

৫৮. আমি তোমাদেরকে পড়ে শুনাই এ সমস্ত আয়াত এবং নিশ্চিত বর্ণনা।

إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِندَ ٱللَّهِ كَمَثَلِ ءَادَمَۖ خَلَقَهُۥ مِن تُرَابٖ ثُمَّ قَالَ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ٥٩

৫৯. নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো। তাকে মাটি দিয়ে তৈরী করেছিলেন এবং তারপর তাকে বলেছিলেন হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেলেন।

ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلَا تَكُن مِّنَ ٱلۡمُمۡتَرِينَ ٦٠

৬০. যা তোমার পালকর্তা বলেন তাই হচ্ছে যথার্থ সত্য। কাজেই তোমরা সংশয়বাদী হয়ো না।

فَمَنۡ حَآجَّكَ فِيهِ مِنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَكَ مِنَ ٱلۡعِلۡمِ فَقُلۡ تَعَالَوۡاْ نَدۡعُ أَبۡنَآءَنَا وَأَبۡنَآءَكُمۡ وَنِسَآءَنَا وَنِسَآءَكُمۡ وَأَنفُسَنَا وَأَنفُسَكُمۡ ثُمَّ نَبۡتَهِلۡ فَنَجۡعَل لَّعۡنَتَ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَٰذِبِينَ ٦١

৬১. অতঃপর তোমার নিকট সত্য সংবাদ এসে যাওয়ার পর যদি এই কাহিনী সম্পর্কে তোমার সাথে কেউ বিবাদ করে, তাহলে বল-এসো, আমরা ডেকে নেই আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রদের এবং আমাদের স্ত্রীদের ও তোমাদের স্ত্রীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের আর তারপর চল আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করি এবং তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত করি যারা মিথ্যাবাদী।

إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ ٱلۡقَصَصُ ٱلۡحَقُّۚ وَمَا مِنۡ إِلَٰهٍ إِلَّا ٱللَّهُۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ لَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٦٢

৬২. নিঃসন্দেহে এটাই হলো সত্য ভাষণ। আর এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। আর আল্লাহ; তিনিই হলেন পরাক্রমশালী মহাপ্রাজ্ঞ।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

          আয়াতের গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলোর ব্যাখ্যা: কোন কোন ফেরকার লোকেরা আলোচ্য আয়াতের বিভিন্ন শব্দ ও অর্থে বিকৃতি সাধন করে হযরত ঈসা (আ,)-এর হায়াত এবং আখেরী যামানায় তাঁর পুনরাগমন সম্পর্কিত মুসলমানদের সর্ববাদিসম্মত আকীদাকে ভুল প্রমাণ করতে সচেষ্ট রয়েছে। এ কারণে আয়াতের শব্দাবলীর পূর্ণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন।

وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ আরবী ভাষায় ‘মাক্‌র্’ শব্দের অর্থ সূক্ষ্ম ও গোপন কৌশল। উত্তম লক্ষ অর্জনের জন্যে মাক্‌র্ ভাল এবং মন্দ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে হলে তা মন্দও হতে পারে। এ কারণেই وَلَا يَحِيقُ الْمَكْرُ السَّيِّئُ  আয়াতে مَكْر শব্দের সাথে سَّيِّئ (মন্দ) যোগ করা হয়েছে। বাংলা ভাষার বাচনভঙ্গিতে মাক্‌র্ শব্দটি শুধু ষড়যন্ত্র ও অপকৌশল অর্থে ব্যবহৃত হয়। কাজেই এ নিয়ে আরবী বাচনভঙ্গিতে সন্দেহ করা উচিত নয়। আরবী অর্থের দিক দিয়েই এখানে আল্লাহ্‌কে ‘শ্রেষ্ঠতম কৌশলী’ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ বলা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, ইহুদীরা হযরত ঈসা (আ,)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্র ও গোপন কৌশল অবলম্বন করতে আরম্ভ করে। তারা অনবরত বাদশাহর কাছে বলতে থাকে যে, লোকটি আল্লাহদ্রোহী। সে তাওরাত পরিবর্তন করে সবাইকে বিধর্মী করতে সচেষ্ট। এসব অভিযোগ শুনে বাদশাহ, তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। ইহুদীদের এ ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্যে আল্লাহ্‌ তা‘আলার সূক্ষ্ম ও গোপন কৌশল ও স্বীয় পথে অগ্রসর হচ্ছিল। পরবর্তী আয়াতে এর বর্ণনা রয়েছে। (তাফসীরে-ওসমানী)

إِنِّي مُتَوَفِّيكَ – مُتَوَفي শব্দের ধাতু توفي এবং মূলধাতু وفي অভিধানে এর অর্থ পুরোপুরি লওয়া وفاء – إيفاء ও – إستيفاء এসব শব্দেরও প্রকৃত অর্থ পুরোপুরি লওয়া। আরবী ভাষায় সব অভিধান –গ্রন্থই এর প্রমাণ। মৃত্যূর সময় মানুষ নির্ধারিত আয়ু পূর্ণ করে ফেলে এবং আল্লাহ্‌ প্রদত্ত আত্মা পুরোপুরি নিয়ে নেয়া হয়। এ কারণে রূপক অর্থে শব্দটি মৃত্যূ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। মানুষের দৈনন্দিন নিদ্রা মৃত্যূর একটি হাল্কা নমুনা। কুরআনে এ অর্থেও توفي শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে-

اللَّهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا

আল্লাহ্‌ মৃত্যূর সময় প্রাণ নিয়ে নেন। আর যাদের মৃত্যূ আসে না, তাদের নিদ্রার সময় নিয়ে নেন।

দুররে-মানসুর গ্রন্থে হযরত ইবনে-‘আব্বাসের রেওয়ায়াত এভাবে বর্ণিত হয়েছে: হযরত ইবনে আব্বাস বলেন مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ অর্থাৎ, আমি আপনাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নেব এবং শেষ যামানায় স্বাভাবিক মৃত্যূদান করব।

এ তাফসীরের সারমর্ম এই যে, توفي শব্দের অর্থ মৃত্যু; কিন্তু আয়াতের শব্দে رَافِعُكَ প্রথমে ও مُتَوَفِّيكَ পরে হবে। এখানে مُتَوَفِّيكَ -কে পূর্বে উল্লেখ করার কারণ এদিকে ইঙ্গিত করা যে, নিজের কাছে উঠিয়ে নেয়া চিরতরে নয়; বরং এ ব্যবস্থা কিছুদিনের জন্যে হবে। এরপর তিনি আবার দুনিয়াতে আসবেন, শত্রুদের পরাজিত করবেন এবং অবশেষে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন। এভাবে আকাশ থেকে পুনর্বার-

পৃষ্ঠা নং- ১৭৮

অবতরণ এবং শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভের পর মৃত্যুবরণের ঘটনাটি একাধারে একটি মু’জেযা। এতদসঙ্গে ঈসা (আ,)-এর সম্মান ও মর্যাদার পূর্ণত্বলাভ এবং খ্রীষ্টানদের এ বিশ্বাসের খন্ডন যে, ঈসা (আ,) অন্যতম উপাস্য। নতুবা জীবিত অবস্থায় আকাশে উত্থিত হওয়ার ঘটনা থেকে তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস আরও জোরদার হয়ে যেতো যে, তিনিও আল্লাহ্‌ তা‘আলার মতই চিরঞ্জীব এবং ভালমন্দের নিয়ামক। এ কারণে প্রথমে مُتَوَفِّيكَ বলে এসব ভ্রান্ত ধারণার মূলোৎপাটন করা হয়েছে। এরপর নিজের দিকে উঠিয়ে নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

সত্যি কথা এই যে, কাফের ও মুশরেকরা চিরকালই পয়গম্বরগণের বিরোধিতা ও তাঁদের সাথে শত্রুতা করে এসেছে। অপরদিকে আল্লাহ্‌ তা‘আলারও চিরাচরিত রীতি ছিল এই যে, যখনই কোন জাতি পয়গম্বরের বিরোধিতায় অনমনীয় হয়েছে এবং মু’জেযা দেখার পরও অস্বীকার ও অবিশ্বাস অব্যাহত রেখেছে, তখনই আল্লাহ্‌ তা‘আলা আসমানী আযাব পাঠিয়ে সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। যেমন, ‘আদ, সামুদ এবং সালে‘হ ও লূত পয়গম্বরের কওমের বেলায় করা হয়েছে। অথবা পয়গম্বরকেই কাফেরদের দেশ থেকে হিজরত করিয়ে অন্যদিকে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সেখানে তাঁকে শক্তি ও সৈন্যদল দান করে অবাধ্য কওমের বিরুদ্ধে জয়ী করা হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ,) ইরাক থেকে হিজরত করে সিরিয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। হযরত মুসা (আ,) মিসর থেকে হিজরত করে সিরিয়ায় আগমন করেন এবং সবশেষে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আগমন করেন। ইহুদীদের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য হযরত ঈসা (আ,)-কে আকাশে তুলে নেয়াও প্রকৃতপক্ষে এক প্রকার হিজরতই ছিল- তারপর তিনি আবার দুনিয়াতে পদার্পণ করে ইহুদীদের বিরুদ্ধে পুরোপুরি জয়লাভ করবেন।

এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, এ হিজরত সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে আকাশের দিকেই করানো হলো কেন? এ সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তা‘আলা স্বয়ং বলেন যে, ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মতই। অর্থাৎ, আদম (আ,) যেমন সাধারন সৃষ্টজীব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থায় পিতা-মাতা ব্যতিরেকে জন্মগ্রহণ করেছেন, তেমনি ঈসা (আ,)-এর জন্মও সাধারণ মানুষের জন্ম থেকে পৃথক পন্থায় হয়েছে এবং মৃত্যুও অভিনব পন্থায় শত শত বৎসর পর জগতে পুনরাগমনের পরেই হবে। সুতরাং তাঁর হিজরতও যদি ভিন্ন প্রকৃতিতে ও বিস্ময়কর পন্থায় হয়; তবে তাতে আশ্চর্য কি?

এসব বিস্ময়কর ঘটনার কারণেই মূর্খ খ্রীষ্টানরা ভ্রান্তবিশ্বাসে পরিণত হয়ে তাঁকে খোদা বলতে শুরু করেছে। অথচ চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এসব ঘটনার মধ্যেই তাঁর বন্দেগী, খোদায়ী নির্দেশের প্রতি আনুগত্য এবং মানবিক গুণে গুণান্বিত হওয়ার প্রমাণাদি রয়েছে। এ কারণেই কুরআন প্রতিটি ক্ষেত্রে ওদের উপরোক্ত ভ্রান্ত বিশ্বাস খন্ডনের প্রতি ইঙ্গিত করেছে। আকাশে উত্থিত করার ফলে ওদের বিশ্বাস খুব জোরদার হয়ে যেতো। তাই مُتَوَفِّيكَ শব্দটি অগ্রে উল্লেখ করে এ বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। এতে বোঝা গেল যে, আলোচ্য আয়াতের প্রধান উদ্দেশ্য ইহুদীদের খন্ডন। কারণ, ওরা হযরত ঈসা (আ,)-কে হত্যা করতে ও শূলীতে চড়াতে চেয়েছিল। আল্লাহ্‌ তা‘আলা ওদের সব পরিকল্পনা ধূলিস্যাৎ করে দেন।

কিন্তু শব্দ আগে-পিছে করার ফলে আলোচ্য আয়াতে খ্রীষ্টানদের বিশ্বাসও খন্ডন হয়ে গেছে যে, ঈসা (আ,) খোদা নন যে, তিনি মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাবেন। এক সময় তাঁরও মৃত্যু হবে।

ইমাম রাযী তাফসীরে-কাবীরে বলেন: কুরআন মাজীদে এমনি ধরনের বিশেষ বিশেষ রহস্যের কারণে শব্দ আগে-পিছে করার ভুরি ভুরি নজির রয়েছে। পরবর্তী ঘটনাকে অগ্রে ও অগ্রবর্তী ঘটনাকে পরে বর্ণনা করা হয়েছে। (তপফসীর কপবীর, ২য় খন্ড, ৪৮১ পৃষ্ঠা)

وَرَافِعُكَ إِلَىَّ এতে বাহ্যত: ঈসা (আ,)-কেই সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, আপনাকে উঠিয়ে নেব। সবাই জানেন যে, ঈসা শুধু আত্মার নাম নয়; বরং আত্মা ও দেহ উভয়ের নাম। কাজেই আয়াতে দৈহিক উত্তোলন বাদ দিয়ে শুধু আত্মিক উত্তোলন বোঝা সম্পূর্ণ ভুল। তবে একথা ঠিক যে, আরবী শব্দটি উচ্চ মর্তবার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন- وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ এবং يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ইত্যাদি আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু এটা জানা কথা যে, উচ্চ মর্তবার অর্থে رفع শব্দটির ব্যবহার রূপক। উল্লেখিত আয়াতসমূহে পূর্বাপর আলোচ্য আয়াতে বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষার ভিত্তিতে এ ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু আলোচ্য আয়াতে আসল অর্থ ছেড়ে রূপক অর্থ বোঝার কোন কারণ নেই। এ ছাড়া আয়াতে رفع শব্দের সাথে إِلَى ব্যবহার করার কারণে রূপক অর্থের সম্ভাবনা সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়ে গেছে। এ আয়াতে وَرَافِعُكَ إِلَىَّ এবং সূরা নিসার আয়াতেও ইহুদীদের ভ্রান্ত বিশ্বাস খন্ডন প্রসঙ্গে وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا بَل رَّفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ বলা হয়েছে। অর্থাৎ, ইহুদীরা নিশ্চিতই হযরত ঈসাকে হত্যা করেনি, বরং আল্লাহ্‌ তাঁকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। “নিজের কাছে তুলে নেয়া” সশরীরে তুলে নেয়াকেই বলা হয়।

ঈসা (আ,)-এর সাথে আল্লাহ্‌র পাঁচটি অঙ্গীকার: আলোচ্য ৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা ইহুদীদের বিপক্ষে হযরত ঈসা (আ,)-এর সাথে পাঁচটি অঙ্গীকার করেছেন।

সর্বপ্রথম অঙ্গীকার এই যে, তাঁর মৃত্যু ইহুদীদের হাতে হত্যার মাধ্যমে হবে না, বরং প্রতিশ্রুত সময়ে স্বাভাবিক পন্থায় হবে। প্রতিশ্রুত সময়টি কেয়ামতের নিকটতম যমানায় আসবে। তখন ঈসা (আ,) আকাশ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। বিভিন্ন সহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীসে এর বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে।

দ্বিতীয় অঙ্গীকার ছিল যে, হযরত ঈসা (আ,)-কে আপাতত: উর্ধ্ব জগতে তুলে নেয়া হবে। সাথে সাথে এ অঙ্গীকার পূর্ণ করা হয়।

তৃতীয় অঙ্গীকার ছিল শত্রুদের অপবাদ থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে। এ অঙ্গীকার এভাবে পূর্ণ হয়েছে যে, শেষ নবী (সা,) আগমন করে ইহুদীদের যাবতীয় অপবাদ দূর করে দেন। উদাহরণত: পিতা ব্যতিরেকে জন্মগ্রহণ করার কারণে ইহুদীরা ঈসার (আ,) জন্মবিষয়ে অপবাদ আরোপ করতো। কুরআন এ অভিযোগ খন্ডন করে বলেছে যে, তিনি আল্লাহ্‌র কুদরত ও নির্দেশে পিতা ব্যতিরেকে জন্মগ্রহণ করেছেন। এটা কোন বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। হযরত আদমের জন্মগ্রহণ ছিল আরো বেশী বিস্ময়কর-

পৃষ্ঠা নং-১৭৯

ব্যাপার। কারণ, তিনি পিতা ও মাতা উভয় ব্যতিরেকেই জন্মগ্রহণ করেন।

ইহুদীরা ঈসার (আ,) বিরুদ্ধে খোদায়ী দাবি করার অভিযোগও এনেছিল। কুরআনের অনেক আয়াতে এর বিপরীতে ঈসা (আ,)-এর বন্দেগী ও মানবত্বের স্বীকারোক্তি বর্ণিত হয়েছে।

চতুর্থ অঙ্গীকার وَجَاعِلُ الَّذِينَ اتَّبَعُوكَ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ, অবিশ্বাসীর বিপক্ষে আপনার অনুসারীদের কেয়ামত পর্যন্ত বিজয়ী রাখা হবে। আয়াতে অনুসরণের অর্থ হযরত ঈসার (আ,) নবুওয়াতে বিশ্বাস করা ও স্বীকারোক্তি করা। এর জন্য যাবতীয় বিধি-বিধানে বিশ্বাস করা শর্ত নয়। এভাবে খ্রীষ্টান ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় তাঁর অনুসারীদের অন্তর্ভূক্ত। কারণ, মুসলমানরাও ঈসা (আ,)-এর নবুওয়াতে বিশ্বাসী। এটা ভিন্ন কথা যে, এতটুকু বিশ্বাসই পরকালের মুক্তির জন্যে যথেষ্ট নয়; বরং ঈসা (আ,)-এর যাবতীয় বিধি-বিধানে বিশ্বাস করার উপর পরকালের মুক্তি নির্ভরশীল। হযরত ঈসা (আ,)-এর অকাট্য বিধানাবলীর মধ্যে একটি ছিল এই যে, পরবর্তীকালে মুহাম্মাদ (সা,)-এর প্রতিও ঈমান আনতে হবে। খ্রীষ্টানরা এটি পালন করেনি। ফলে তারা পরকালের মুক্তি থেকে বঞ্চিত।  মুসলমানরা এটিও পালন করেছে। ফলে তারা পরকালের মুক্তির অধিকারী হয়েছে। কিন্তু জগতে ইহুদীদের বিপক্ষে বিজয়ী রাখার অঙ্গীকার শুধু হযরত ঈসার (আ,) নবুওয়াতের উপর নির্ভরশীল ছিল। এ অঙ্গীকার অনুযায়ী ইহুদীদের বিপক্ষে খ্রীষ্টান ও মুসলমানদের বিজয় সব সময় অর্জিত হয়েছে এবং নিশ্চিতরূপেই কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

এ অঙ্গীকারের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, ইহুদী জাতির বিপক্ষে খ্রীষ্টান ও মুসলমান জাতি সর্বদাই বিজয়ী রয়েছে। তাদের রাষ্ট্রই দুনিয়ার যত্রতত্র প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

ইসরাঈলের বর্তমান রাষ্ট্র: ইসরাঈলের বর্তমান রাষ্ট্র দেখে এ ব্যাপারে সন্দেহ করা যায় না। কারণ, প্রথমত: এ রাষ্ট্রটি রাশিয়া ও পাশ্চাত্যের খ্রীষ্টানদের একটি সামরিক ছাউনী ছাড়া কিছুই নয়। ওরা এটিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে। যদি একদিনের জন্যও এর মাথার উপর থেকে রাশিয়া, আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য রাষ্ট্র হাত গুটিয়ে নেয়, তবে বিশ্বের মানচিত্র থেকে এর অস্তিত্ব মুছে যাওয়া সুনিশ্চিত। একারণে বাস্তবধর্মী লোকদের দৃষ্টিতে ইসরাঈলের এ ইহুদী রাষ্ট্রটি একটি আশ্রিত রাষ্ট্রের অতিরিক্ত কিছু নয়। যদি একে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রও ধরে নেয়া হয়, তবুও খ্রীষ্টান ও মুসলমানদের সমষ্টির বিপরীতে এ যে নেহায়তই একটি আপাংক্তেয় রাষ্ট্র, তা কোন সুস্থবুদ্ধি ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারে না। এ থেকেও দৃষ্টি ফিরিয়ে বলা যায় যে, কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে কিছুদিনের জন্যে ইহুদীদের প্রাধান্য বিস্তারের সংবাদ স্বয়ং ইসলামী রেওয়ায়াত সমূহেই দেয়া হয়েছে। যদি দুনিয়ার আয়ু ফুরিয়ে এসে থাকে এবং কেয়ামত নিকটবর্তী হয়ে থাকে, তবে এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ইসলামী রেওয়ায়াতের পরিপন্থী নয়। এহেন ক্ষণস্থায়ী আলোড়নকে সাম্রাজ্য অথবা রাষ্ট্র বলা যায় না।

পঞ্চম অঙ্গীকার এই যে, কেয়ামতের দিন সব ধর্মীয় মতবিরোধের মীমাংসা করা হবে। সময় এলে এ অঙ্গীকারও পূর্ণ হবে যে,

ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ

হযরত ঈসা (আ,)-এর হায়াত ও অবতরণের প্রশ্ন: জগতে একমাত্র ইহুদীরাই একথা বলে যে, ঈসা (আ,) নিহত ও শূলবিদ্ধ হয়ে সমাহিত হয়ে গেছেন এবং পরে জীবিত হননি। কুরআনের সূরা নিসার আয়াতে ওদের এ ধারণার স্বরূপ উদ্ঘাটিত করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতেও وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ বাক্যাংশে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা ঈসার (আ,) শত্রুদের চক্রান্ত স্বয়ং তাদের দিকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ, যেসব ইহুদী তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ঘরে প্রবেশ করেছিল, আল্লাহ তা‘আলা তাদের মধ্য থেকেই এক ব্যক্তির আকার-আকৃতি পরিবর্তন করে হুবুহু ঈসার (আ,) ন্যায় করে দেন। অতঃপর হযরত ঈসাকে (আ,) জীবিতাবস্থায় আকাশে তুলে নেন। আয়াতের ভাষা এরূপ:  وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَٰكِن شُبِّهَ لَهُمْ “তারা ঈসাকে হত্যা করেনি, শূলীতেও চড়ায়নি। কিন্তু আল্লাহ্‌র কৌশলে তারা সাদৃশ্যের ধাঁধাঁয় পতিত হয় এবং নিজের লোককেই হত্যা করে আত্মপ্রসাদ লাভ করে”।

এ দুই দলের বিপরীতে ইসলামের বিশ্বাস আলোচ্য আয়াত ও অন্যান্য কতিপয় আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তা এই যে, আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁকে ইহুদীদের কবল থেকে মুক্তি দেয়ার জন্যে জীবিতাবস্থায় আকাশে তুলে নিয়েছেন। তাঁকে হত্যা করা হয়নি এবং শূলীতেও চড়ানো হয়নি। তিনি জীবিতাবস্থায় আকাশে বিদ্যমান রয়েছেন এবং কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে আকাশ থেকে অবতরণ করে ইহুদীদের বিপক্ষে জয়লাভ করবেন, অবশেষে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন।

এ বিশ্বাসের উপর সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের ইজমা তথা ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাফেজ ইবনে হাজর ‘তালখীস’ গ্রন্থের ৩১৯ পৃষ্ঠায় এ ইজমা উদ্ধৃত করেছেন।

এখানে আমরা একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বিষয়টি চিন্তা করলে আলোচ্য প্রশ্নে বিন্দুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। তা এই যে, সূরা আলি-‘ইমরানের একাদশতম রুকুতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের উল্লেখ প্রসঙ্গে হযরত আদম, নূ‘হ, ইবরাহীম, ‘ইমরানের বংশধরের উল্লেখ একটিমাত্র আয়াতে সংক্ষেপে করেছেন। এরপর প্রায় তিন রুকুর বাইশটি আয়াতে হযরত ঈসা (আ,) ও তাঁর পরিবারের উল্লেখ এমন বিস্তারিতভাবে করা হয়েছে যে, কুরআন যার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর উল্লেখও এমন বিস্তারিতভাবে করা হয়নি। হযরত ঈসা (আ,)-এর মাতামহীর উল্লেখ, তাঁর মান্নতের বর্ণনা, জননীর জন্ম, তাঁর নাম, তাঁর লালন-পালনের বিস্তারিত বিবরণ, ঈসা (আ,)-এর জননীর গর্ভে আগমন, অতঃপর জন্মের বিস্তারিত অবস্থা, জন্মের পর জননী কি পানাহার করলেন, শিশু সন্তানকে নিয়ে গৃহে আগমন, পরিবারের লোকদের ভর্ৎসনা, জন্মের পরপরই ঈসা (আ,)-এর বাকশক্তি প্রাপ্তি, যৌবনে পদার্পণ, স্বজাতিকে ধর্মের প্রতি আহ্বান, তাদের বিরোধিতা, সহচরদের সাহায্য, ইহুদীদের ষড়যন্ত্র, জীবিতাবস্থায় আকাশে উত্থিত হওয়া প্রভৃতি। এরপর মুতাওয়াতির হাদিসসমূহে তাঁর আরও গুণাবলী, আকার আকৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, ইত্যাদির পূর্ণ বিবরণও এমনিভাবে দেয়া হয়েছে যে, সমগ্র কুরআন ও হাদীসে কোন পয়গম্বরের জীবনালেখ্য এমন বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়নি। এ বিষয়টিই সকলের পক্ষে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, এরূপ কেন করা হয়েছে এবং এর তাতপর্য কি?

পৃষ্ঠা নং- ১৮০

সামান্য চিন্তা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হযরত নাবী কারীম (সা,) হলেন সর্বশেষ নবী, তারপর আর কোন নবী আসবেন না। এ কারণে, তিনি অত্যন্ত যত্ন সহকারে কিয়ামত পর্যন্ত সম্ভাব্য ঘটনাবলী সম্পর্কে স্বীয় উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন। তাই একদিকে তিনি পরবর্তীকালে অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং সাধারণ গুণাবলীর মাধ্যমে ও অনেকের বেলায় নাম উল্লেখ করে তাঁদের অনুসরণ করতে জোর তাকিদ করেছেন। অপরদিকে উম্মতের ক্ষতিসাধনকারী পথভ্রষ্ট লোকদের পরিচয়ও বলেছেন।

পরবর্তীকালে আগমনকারী পথভ্রষ্টদের মধ্যে সবচাইতে মারাত্বক হবে দাজ্জাল। তার ফেতনাই হবে সর্বাধিক বিভ্রান্তিকর। হযরত নাবী কারীম (সা,) তার এত বেশী হাল-হাকীকত বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, তার আগমনের সময় সে যে পথভ্রষ্ট, এ বিষয়ে কারো মনে সন্দেহ থাকবে না। এমনিভাবে পরবর্তীকালে আগমনকারী সংস্কারক ও অনুসরণযোগ্য মনীষিগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হবেন হযরত ঈসা (আ,)। আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাঁকে নবুওয়াত ও রিসালাতের সম্মানে ভূষিত করেছেন; দাজ্জালের ফিতনার সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের সাহায্যের জন্যে আকাশে জীবিত রেখেছেন এবং কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দাজ্জাল হত্যার জন্যে নিয়োজিত হবেন। এ কারণে তার জীবনালেখ্য ও গুণাবলী মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ফুটিয়ে তোলা প্রয়োজন ছিল, যাতে তাঁর অবতরণের সময় তাঁকে চেনার ব্যাপারে কোনরূপ সন্দেহ ও বিভ্রান্তির অবকাশ না থাকে।

এর রহস্য ও উপযোগিতা অনেক। প্রথম, তাঁর পরিচয়ে জটিলতা থাকলে তাঁর অবতরণের উদ্দেশ্যই পন্ড হয়ে যাবে। মুসলিম সম্প্রদায় তাঁর সাথে সহযোগিতা করবে না। ফলে তিনি কিভাবে তাদের সাহায্য করবেন?

দ্বিতীয়, হযরত ঈসা (আ,) সে সময় নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনে আদিষ্ট হয়ে জগতে আসবেন না; বরং মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্বদানের উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ (সা,)-এর প্রতিনিধি হিসেবে আগমন করবেন, কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি স্বীয় নবুওয়াতের পদ থেকে অপসারিতও হবেন না। তখন তিনি হবেন প্রাদেশিক শাসকের মত, যিনি নিজ প্রদেশের শাসক পদে অধিষ্টিত থেকেও প্রয়োজন বশত: অন্য প্রদেশে চলে যান। তিনি এ প্রদেশে শাসক হিসেবে না এলেও নিজ প্রদেশের শাসক পদ থেকে অপসারিতও নন। মোটকথা এই যে, হযরত ঈসা (আ,) তখনও নবুওয়াত ও রিসালাতের গুণে গুণান্বিত হবেন। তাঁকে অস্বীকার করা পূর্বে যেরূপ কুফর ছিল, তখনও কুফর হবে। এমতাবস্থায় মুসলিম সম্প্রদায় যারা কুরআনী নির্দেশের ভিত্তিতে পূর্ব থেকেই তাঁর প্রতি বিশ্বাসী- যদি অবতরণের সময় তাঁকে চিনতে না পারে, তবে অবিশ্বাসে লিপ্ত হয়ে পড়বে।

তৃতীয়, ঈসা (আ,)-এর অবতরণের ঘটনা দুনিয়ার অন্তিম পর্যায়ে সংঘটিত হবে। এমতাবস্থায় তাঁর অবস্থা ও লক্ষণাদি অস্পষ্ট হলে অন্য কোন প্রতারকের পক্ষ থেকে এরূপও দাবী করার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল যে, আমিই মসীহ ঈসা ইবনে মারয়াম। এখন কেউ এরূপ করলে লক্ষণাদির সাহায্যে তাকে প্রত্যাখ্যান করা যাবে। উদাহরণত: হিন্দুস্থানে এক সময় মির্যা কাদিয়ানী দাবী করে বসে যে, সে-ই প্রতিশ্রুত মাসীহ। মুসলমান ওলামাগণ এসব লক্ষণের সাহায্যে তার এ ভ্রান্ত দাবী প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বিপদাপদ মুমিনদের জন্যে প্রায়শ্চিত্য স্বরূপ: فَأُعَذِّبُهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ এ আয়াতের বিষয়বস্তুতে সামান্য একটা প্রশ্ন দেখা দেয় যে, কিয়ামতের মীমাংসার বর্ণনায় একথা বলার মানে কি যে, ইহকাল ও পরকালে শাস্তি দেব? কারণ, তখন তো ইহকালের শাস্তি হবেই না।

এর সমাধান এই যে, এ কথাটি অপরাধীকে লক্ষ্য করে বিচারকের এরূপ উক্তির মতই যে, এখন তোমাকে এক বছর শাস্তি ভোগ করতে হবে। এমতাবস্থায় পুনরায় অপরাধে লিপ্ত হলে নিশ্চিতরূপেই দুই বছরের সাজা হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে এক বছরের সাথে অতিরিক্ত এক বছর যুক্ত হয়ে মোট দুই বৎসর সাজা হবে।

আলোচ্য আয়াতেও তদ্রুপ বোঝা দরকার। ইহকালের সাজা তো হয়েই গেছে। এর সাথে পরকালের সাজা যুক্ত হয়ে কিয়ামতের দিন মোট সাজা পূর্ণ করা হবে। অর্থাৎ, ইহকালের সাজা পরকালের সাজার প্রায়শ্চিত্ত হবে না। কিন্তু মুমিনদের অবস্থা এর বিপরীত। ইহকালে তাদের উপর কোন বিপদাপদ এলে গোনাহ মাফ হয়। এবং পরকালের দন্ড লঘু অথবা রহিত হয়। সে কারণেই لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ বাক্যে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, মুমিনগণ ঈমানের কারণে আল্লাহর প্রিয়। প্রিয়জনের সাথে এমনি ব্যবহার করা হয়। পক্ষান্তরে কাফেররা কুফরের কারণে আল্লাহ্‌র ঘৃণার পাত্র। ঘৃণিতদের সাথে এরূপ ব্যবহার করা হয় না। (বায়ানুল কুরআন)

কিয়াসের প্রামাণ্যতা: إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِندَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, কিয়াসও শরীয়তসম্মত প্রমাণ। কেননা, আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেছেন: ঈসা (আ,)-এর জন্ম আদমের জন্মের অনুরূপ। অর্থাৎ, আদম (আ,)-কে যেমন জনক (ও জননী) ব্যতিত সৃষ্টি করা হয়েছে, ঈসা (আ,)-কেও তদ্রূপ জনক ব্যতীত সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব এখানে আল্লাহ্‌ তা‘আলা ঈসা (আ,)-এর সৃষ্টিকে আদম (আ,)-এর সৃষ্টির উপর কিয়াস করার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। (মাযহারী)

মুবাহালার সংজ্ঞা: فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ এ আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলা মহানবী (সা,)-কে মুবাহালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। মুবাহালার সংজ্ঞা এই: যদি সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তিতর্কে মীমাংসা না হয়, তবে তারা সকলে মিলে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করবে, যে পক্ষ এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লা’নতের অর্থ আল্লাহ্‌র রহমত থেকে দূরে সরে পড়া। আল্লাহ্‌র রহমত থেকে দূরে সরে পড়া মানেই খোদায়ী ক্রোধের নিকটবর্তী হওয়া। এর সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহ্‌র ক্রোধ বর্ষিত হোক। এরূপ করার পর যে পক্ষ মিথ্যাবাদী, সে তাঁর প্রতিফল ভোগ করবে। সেসময় সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর পরিচয় অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিতেও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এভাবে প্রার্থনা করাকে ‘মুবাহালা’ বলা হয়। এতে বিতর্ককারীরা একত্রিত হয়ে প্রার্থনা করলেই চলে। পরিবার-পরিজন ও আত্নীয়-স্বজনকে একত্রিত করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু একত্রিত করলে এর গুরুত্ব বেড়ে যায়।

পৃষ্ঠা নং-১৮১

মুবাহালার ঘটনা: এর পটভূমি এই যে, মহানবী (স,) নাজরানের খ্রীষ্টানদের কাছে একটি ফরমান প্রেরন করেন। এতে ধারাবাহীক ভাবে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়: (১) ইসলাম কবুল কর, (২) অথবা জিযিয়া কর দাও, (৩) অথবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। খ্রীষ্টানরা পরষ্পর পরামর্শ করে শোরাহবীল, আব্দুল্লাহ ইবনে শোরাহবীল ও জীবার ইবনে ফয়েজকে হুজুর (স,)-এর কাছে পাঠায়। তাঁরা এসে ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। একপর্যায়ে তাঁরা হযরত ঈসা (আ,)- কে উপাস্য প্রতিপন্য করার জন্যে প্রবল বাদানুবাদের আশ্রয় গ্রহন করে। ইতিমধ্যে মুবাহালার উপরোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়। এতে রসূলে খোদা (সা,) প্রতিনিধিদলকে মুবাহালার আহব্বান জানান এবং নিজেও হযরত ফাতিমা, হযরত ‘আলী এবং ইমাম হাসান-হোসাঈনকে সঙ্গে নিয়ে মুবাহালার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আসেন। এ আত্ববিশ্বাস দেখে শোরাহবীল ভীত হয়ে যায় এবং সাথীদ্বয়কে বলতে থাকে: তোমরা জানো যে, ইনি আল্লাহ্‌র নবী। আল্লাহ্‌র নবীর সাথে মুবাহালা করলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। মুক্তির অন্য কোন পথ খোঁজ। সঙ্গীদ্বয় বলল: তোমার মতে মুক্তির উপায় কি? সে বলল: আমার মতে নবীর শর্তানুযায়ী সন্ধি করাই উত্তম উপায়। অতঃপর এতেই প্রতিনিধিদল সম্মত হয় এবং মহানবী (সা,) তাঁদের ওপর জিযিয়া কর ধার্য করে মীমাংসায় উপনীত হন।– (ইবনে কাসীর, ১ম খন্ড)

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ