আলি ‘ইমরান, আয়াত ৯২-১০৮

পৃষ্ঠা নং- ১৯৫

এমনকি মারামারি পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে। এ সমস্ত আচরণ অবশ্যই আলোচ্য আয়াতের সুস্পষ্ট বিরোধী, নিন্দনীয় এবং সাহাবায়ে-কেরাম ও তাবেয়ীগণের রীতির পরিপন্থী। পূর্ববর্তী মনীষীগণের মধ্যে ইজতেহাদী মতবিরোধ নিয়ে বিপক্ষ দলের সাথে এরূপ ব্যবহারের কথা কখনও শোনা যায়নি।

মুখমণ্ডল শ্বেতবর্ণ ও কৃষ্ণবর্ণ হওয়ার অর্থঃ মুখমণ্ডল শ্বেতবর্ণ ও কৃষ্ণবর্ণ হওয়ার কথা কুরআন মাজীদের অনেক জায়গায় উল্লেখিত হয়েছে।

এসব আয়াতে একই অর্থবোধক বিভিন্ন শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। বিশিষ্ট তাফসীরবিদগণের মতে শুভ্রতা দ্বারা ঈমানের নূরের শুভ্রতা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ মু’মিনদের মুখমণ্ডল ঈমানের নূরে উদ্ভাসিত, আনন্দাতিশয্যে উৎফুল্ল ও হাস্যোজ্জ্ব হবে। পক্ষান্তরে কৃষ্ণবর্ণ দ্বারা কুফরের কালোবর্ণ বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ কাফেরদের মুখমণ্ডল কুফরের পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন হবে। তদুপরি পাপাচারের অন্ধকারে আরও অন্ধকারময় হয়ে যাবে।

উজ্জ্বল মুখ ও কাল মুখ কারাঃ এরা কারা- এ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণের বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত আছে। হযরত ইবনে-আব্বাস বলেনঃ আহ্‌লে সুন্নত সম্প্রদায়ের মুখমণ্ডল শুভ্র হবে এবং বিদআতীদের মুখমণ্ডল কালো হবে। হযরত আতা বলেনঃ মুহাজির ও আনসারগণের মুখমণ্ডল সাদা হবে এবং বানী-কুরায়যা ও বানী নুযায়রের মুখমণ্ড কালো হবে।– (কুরতুবী)

তিরমিযী শরীফে হযরত আবু উমামাহ্ বর্ণিত এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ খারেজী সম্প্রদায়ের মুখমণ্ডল কালো হবে। আর তারা যাদের হত্যা করবে, তাদের মুখমণ্ডল সাদা হবে।

আবু উমামাকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ আপনি এ হাদীস রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাছ থেকে শুনেছেন? তিনি অঙ্গুলি গুণে উত্তর দিলেনঃ হাদীসটি যদি অন্ততঃ সাত বার তাঁর কাছ থেকে না শুনতাম, তবে বর্ণনাই করতাম না।– (তিরমিযী)

হযরত ‘ইকরিমাহ্ বলেনঃ আহলে কিতাবগণের এক অংশের মুখমণ্ডল কালো হবে, অর্থাৎ যারা হুযূর (সাঃ)-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে তিনি নবী হবেন বলে বিশ্বাস করতো কিন্তু নবুওয়াত –প্রাপ্তির পর তাঁকে সাহায্য ও সমর্থন করার পরিবর্তে তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে শুরু করে। -(কুরতুবী)

কতিপয় প্রয়োজনীয় জ্ঞাতব্যঃ আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে কতিপয় প্রয়োজনীয় বিষয় বর্ণনা করা হচ্ছে। (এক)- আল্লাহ্ তাআলা يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ বাক্যের প্রথমে উজ্জ্বলতার উল্লেখ করে পরে মলিন হওয়ার কথা বলেছেন কিন্তু فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ বাক্যের বর্ণনাভঙ্গি পাল্টে দিয়েছেন। অথচ ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যে এখানেও শুভ্রতাকে আগে উল্লেখ করাই উচিত ছিল। আয়াতের ধারাবাহিকতা পাল্টে দিয়ে আল্লাহ্ তাআলা সম্ভবতঃ সৃষ্টির লক্ষ্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। সৃষ্টির লক্ষ্য হচ্ছে সৃষ্ট জীবের প্রতি অনুকম্পা করা, শাস্তি দেয়া নয়। এ কারণে আল্লাহ্ তাআলা সর্বপ্রথম শুভ্র মুখমণ্ডলের কথা বর্ণনা করেছেন; কারণ এরাই আল্লাহর অনুকম্পা ও সওয়াব লাভের যোগ্য। অতঃপর মলিন মুখমণ্ডল উল্লেখ করেছেন। কারণ, আল্লাহর শাস্তির যোগ্য। এরপর আয়াতের শেষাংশে فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ বলে আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় অনুকম্পাও প্রকাশ করেছেন। এভাবে আয়াতের শুরুতে ও শেষাংশে উভয় স্থানেই অনুকম্পা বর্ণনা করেছেন এবং মাঝখানে মলিন মুখমণ্ডলের কথা উল্লেখ করেছেন। এভাবে অসীম অনুকম্পার প্রতি ইঙ্গিত হয়ে গেছে যে, মানবজাতিকে শাস্তিদানের উদ্দেশে সৃষ্টি করা হয়নি; বরং আল্লাহ্ তাআলার অনুকম্পা লাভে ধন্য হওয়ার জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে।

(দুই)- শুভ্র মুখমণ্ডলবিশিষ্টদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা সর্বদা আল্লাহর অনুকম্পার মধ্যে অবস্থান করবে। হযরত ইবনে-আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ এখানে আল্লাহ্‌র অনুকম্পা বলে জান্নাত বুঝানো হয়েছে। তবে জান্নাতকে অনুকম্পা বলার রহস্য এই যে, মানুষ যত এবাদতই করুক না কেন, আল্লাহ্‌র অনুকম্পা ব্যতীত জান্নাতে যেতে পারবে না। কারণ, এবাদত করা মানুষের নিজস্ব পরাকাষ্ঠা নয়; বরং আল্লাহ্ প্রদত্ত সামর্থ্যের বলেই মানুষ এবাদত করতে পারে। সুতরাং ইবাদত করলেই জান্নাতে প্রবেশ অপরিহার্য হয়ে যায় না। বরং আল্লাহ্‌র অনুকম্পার দ্বারাই জান্নাতে প্রবেশ করা সম্ভব।– (তাফসীরে-কাবীর)

(তিন) – আল্লাহ্ তাআলা فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ বাক্যাংশের পর পর هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ বলে একথা ব্যক্ত করেছেন যে, বিশ্বাসীরা আল্লাহ তাআলার যে অনুকম্পায় অবস্থান করবে, তা তাদের জন্যে সাময়িক হবে না বরং সর্বকালীন হবে। এ নেয়ামত কখনও বিলুপ্ত অথবা হ্রাসপ্রাপ্ত করা হবে না। এর বিপরীতে মলিন মুখমণ্ডল বিশিষ্টদের জন্যে একথা বলা হয়নি যে, তারা তাদের সে অবস্থায় চিরকালই থাকবে।

মানুষ নিজের গোনাহর শাস্তিই লাভ করেঃ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنتُمْ تَكْفُرُونَ আয়াতে বলা হয়েছে যে, অদ্যকার শাস্তি আমার পক্ষ থেকে নয়; বরং তোমাদের উপার্জিত। তোমরা পৃথিবীতে অবস্থানকালে এসব উপার্জন করেছিলে। কেননা জান্নাত ও দোযখের বিপদ ও নেয়ামত প্রকৃতপক্ষে তোমাদের কর্মেরই পরিবর্তিত চিত্র। এ বিষয়টি বোঝানোর জন্যেই আয়াতের শেষাংশে বলেছেনঃ وَمَا اللَّهُ يُرِيدُ ظُلْمًا لِّلْعَالَمِينَ

অর্থাৎ – আল্লাহ্ তাআলা বান্দাদের প্রতি অত্যাচার করার কোন ইচ্ছা করেন না। শাস্তি ও পুরস্কার যা কিছু দেয়া হয়, সুবিচার ও অনুকম্পার দাবী হিসেবেই দেয়া হয়।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ