পৃষ্ঠা নং- ১৮৯
যায়, যে সদ্য মায়ের গর্ভ থেকে নিষ্পাপ অবস্থায় ভূমিষ্ট হয়েছে। এগুলো কা’বা গৃহেরই অর্থগত ও আধ্যাত্মিক বরকত। আয়াতের শেষাংশে هدى বলে এসব বরকতই ব্যক্ত করা হয়েছে।
কাবা গৃহের তিনটি বৈশিষ্ট্যঃ আলোচ্য ৯৭ নং আয়াতে কা’বা গৃহের তিনটি বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হয়েছে। প্রথমতঃ এতে আল্লাহর কুদরতের অনেক নিদর্শন রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে মাকামে-ইবরাহীম। দ্বিতীয়তঃ যে ব্যক্তি এতে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ ও বিপদমুক্ত হয়ে যায়; কেউ তাকে হত্যা করতে পারে না। তৃতীয়তঃ সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য এতে হজ্বব্রত পালন করা ফরয; যদি এ গৃহ পর্যন্ত পৌঁছার শক্তি ও সামর্থ্য থাকে।
কা’বা গৃহ নির্মিত হওয়ার দিন থেকে অদ্যাবধি আল্লাহ্ তাআলা এর বরকতে শত্রুর আক্রমণ থেকে মক্কাবাসীদের নিরাপদ রেখেছেন। বাদশাহ্ আবরাহা বিরাট হস্তীবাহিনীসহ কা’বা গৃহের প্রতি ধাবিত হয়েছিল। আল্লাহ্ স্বীয় কুদরতে পক্ষীকূলের মাধ্যমে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেন। মক্কার হারামে প্রবেশকারী মানুষ, এমনকি জীবজন্তু পর্যন্ত বিপদমুক্ত হয়ে যায়। জন্তু-জানোয়ারেরাও এ বিষয়ে সচেতন। এ সীমানায় প্রবেশ করে তারাও নিজেদের নিরাপদ মনে করে। সেখানে বন্য ও হিংস্র জন্তু মানুষ দেখে পালায় না। সাধারণভাবে দেখা যায়, কা’বা গৃহের যে পার্শ্বে বৃষ্টি হয়, সে পার্শ্বস্থিত দেশগুলোতে প্রচুর বারিপাত হয়। আরেকটি বিস্ময়কর নিদর্শন এই যে, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ হাজী সেখানে একত্রিত হয়। তারা জামরাত নামক স্থানে প্রত্যেকেই একেকটি প্রতীক লক্ষ্য করে দৈনিক সাতটি করে কঙ্কর তিন দিন পর্যন্ত নিক্ষেপ করে। যদি এসব কঙ্কর সেখানেই জমা থাকতো, তবে এক বৎসরেই কঙ্করের স্তরের নীচে জামরাত অদৃশ্য হয়ে যেতো এবং কয়েক বৎসরে সেখানে কঙ্করের বিরাট পাহাড় গড়ে উঠত। অথচ হজ্বের তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সেখানে কঙ্করের খুব একটা স্তুপ দেখা যায় না। ইতঃস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কিছু কঙ্কর দেখা যায় মাত্র। এর কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে হুযুর (সাঃ)-বলেনঃ ফেরেশতারা এসব কঙ্কর তুলে নেয়। যাদের হজ্ব কোন কারণে কবূল হয় না, শুধু তাদের কঙ্করই এখানে থেকে যায়। এ কারণেই জামরাত থেকে কঙ্কর তুলে নিক্ষেপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ এগুলো কবূল করা হয়নি। রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এ উক্তির সত্যতা প্রত্যেকেই নিজ চোখে দেখেন। জামরাতের আশেপাশে সামান্য কঙ্করই দৃষ্টিগোচর হয়। অথচ সেগুলো সেখান থেকে সরানোর বা পরিষ্কার করার কোন ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকেও নেই; জনগণের পক্ষ থেকেও নেই।
এ কারণেই শায়খ জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রাহঃ) খাসায়েসে কুবরা নামক গ্রন্থে বলেনঃ রসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কতক মু’জেযা তাঁর ওফাতের পরও দেদীপ্যমান রয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। প্রত্যেকেই তা অবলোকন করতে পারে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে পবিত্র কুরআন। সমগ্র বিশ্ব এ অনন্য কিতাবটির সমতুল্য গ্রন্থ রচনা করতে অক্ষম। এ অক্ষমতা যেমন তাঁর জীবদ্দশায় ছিল, তেমনি আজও রয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। প্রতি যুগের মুসলমান বিশ্বকে একথা বলে চ্যালেঞ্জ করতে পারে যে, فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ কুরআনের সূরার মত একটি সূরা তৈরী কর দেখি! এমনিভাবে জামরাত সম্পর্কে রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেনঃ এসব জামরাতে নিক্ষিপ্ত কঙ্কর অদৃশ্যভাবে ফেরশতারা তুলে নেয়। যাদের হজ্ব কবূল হয় না, শুধু সেসব হতভাগ্যদের কঙ্করই থেকে যায়। তাঁর এ উক্তির সত্যতা প্রতি যুগেই প্রমাণিত হচ্ছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত হবে। নিঃসন্দেহে এটা তাঁর অক্ষয় মু’জেযা এবং কা’বা গৃহ সম্পর্কিত একটি বিরাট নিদর্শন।
মাকামে-ইবরাহীমঃ মাকামে ইবরাহীম কা’বা গৃহের একটি বড় নিদর্শন। এ কারণেই কুরআনে একে স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মাকামে-ইবরাহীম একটি পাথরের নাম। এর উপর দাঁড়িয়েই হযরত ইবরাহীম (আঃ) কা’বা গৃহ নির্মাণ করতেন। এক রেওয়ায়াতে বলা হয়েছেঃ নির্মাণের উচ্চতার সাথে সাথে পাথরটিও আপনা-আপনি উঁচু হয়ে যেতো এবং নীচে অবতরণের সময় নীচু হয়ে যেতো। এ পাথরের গায়ে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর গভীর পদচিহ্ন অদ্যাবধি বিদ্যমান। একটি অচেতন ও জড় পাথরের পক্ষে প্রয়োজনানুসারে উঁচু ও নীচু হওয়া এবং মোমের মত নরম হয়ে নিজের মধ্যে পদচিহ্ন গ্রহণ করা- এসবই আল্লাহর অপার কুদরতের নিদর্শন এবং এতে কা’বা গৃহের শ্রেষ্ঠত্বই প্রমাণিত হয়। এ পাথরটি কা’বা গৃহের নীচে দরজার নিকটে অবস্থিত ছিল। যখন কুরআনে মাকামে-ইবরাহীমে নামায পড়ার আদেশ অবতীর্ণ হয় وَاتَّخِذُوا مِن مَّقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى তখন তাওয়াফকারীদের সুবিধার্থে পাথরটি সেখান থেকে অপসারিত করে কা’বা গৃহের সামনে সামান্য দূরে যমযম কূপের নিকট স্থাপন করা হয়। একে এ স্থানেই একটি নিরাপদ কক্ষে তালাবদ্ধ করা হয়েছিল। কা’বা প্রদক্ষিণের পর দুই রাকাত নামায এর পেছনে দাঁড়িয়ে পড়া হয়। অধুনা কক্ষটি সরিয়ে নিয়ে মাকামে-ইবরাহীমকে একটি কাঁচ-পাত্রে সংরক্ষিত করে দেয়া হয়েছে। আসলে এ বিশেষ পাথরটিকেই মাকামে-ইবরাহীম বলা হয়। তাওয়াফ পরবর্তী নামায এর উপরে অথবা আশেপাশে পড়া উত্তম। কিন্তু শাব্দিক অর্থের দিক দিয়ে মাকামে-ইবরাহীম সমগ্র মসজিদে-হারামকেও বোঝায়। এ কারণেই ফেকাহবিদগণ বলেনঃ মসজিদে-হারামের যে কোন স্থানে তাওয়াফ পরবর্তী নামায পড়ে নিলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে।
কা’বা গৃহে প্রবেশকারীর নিরাপত্তাঃ কা’বা গৃহের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি এতে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ হয়ে যায়। এ নিরাপত্তা একেত শরীয়তের আইন হিসেবে- অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি নির্দেশ এই যে, যে ব্যক্তি এতে প্রবেশ করে, তাকে কষ্ট দেবে না হত্যা করবে না। যদি কেউ হত্যাকাণ্ড করে অথবা অন্য কোন অপরাধ করে এতে প্রবেশ করে, তবুও তাকে সেখানে শাস্তি দেবে না, বরং তাকে হারাম থেকে বের হতে বাধ্য করবে। বের হওয়ার পর তাকে শাস্তি দেবে। এভাবে হারামে প্রবেশকারী ব্যক্তি শরীয়তের আইন অনুযায়ী নিরাপদ হয়ে যায়।
দ্বিতীয়তঃ এ নিরাপত্তা সৃষ্টিগতভাবে। অর্থাৎ, আল্লাহ্ তাআলা সৃষ্টিগতভাবেই প্রত্যেক জাতি ও সম্প্রদায়ের অন্তরে কা’বা গৃহের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ নিহিত রেখেছেন। ফলে বিস্তর মতবিরোধ সত্ত্বেও তারা সবাই এ বিশ্বাসে একমত যে, কা’বা গৃহে প্রবেশকারী ব্যক্তি যতবড় অপরাধী ও শত্রুই হোক না কেন, কা’বা গৃহের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য করে তাকে কিছুই বলা যাবে না; হারাম শরীফকে সাধারণ কলহ-বিবাদ ও যুদ্ধবিগ্রহ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। জাহেলিয়াত যুগের আরব ও তাদের বিভিন্ন গোত্র অসংখ্য পাপাচারে লিপ্ত থাকা সত্ত্বেও কা’বা গৃহের সম্মান রক্ষার জন্যে প্রাণ উৎসর্গ করতেও কুন্ঠিত ছিল না। তাদের যুদ্ধপ্রিয়তা ও নিষ্ঠুরতা সমগ্র জগতে প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু হারামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে তারা পিতার হত্যাকারীকে দেখেও মাথা হেট করে চলে যেতো; কিছুই বলতো না।
মক্কা বিজয়ের সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে হারামের অভ্যন্তরে কিছুক্ষণ যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল কা’বা গৃহকে পবিত্র করা। বিজয়ের পর হুযুর (সাঃ) ঘোষণা করেন যে, এ অনুমতি কা’বা-