পৃষ্ঠা নং-১৯১
‘তাকওয়া’ শব্দটি আরবী ভাষায় বেঁচে থাকা ও বিরত থাকার অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ ‘ভয় করা’ও করা হয়। কারণ, যেসব বিষয় থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়, সেগুলো ভয় করারই বিষয়। তাতে খোদায়ী শাস্তির ভয় থাকে। এ তাকওয়া তথা বেঁচে থাকার কয়েকটি স্তর রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বনিম্ন স্তর হলো কুফর ও শিরক থেকে বেঁচে থাকা। এ অর্থে প্রত্যেক মুসলমানকেই ‘মুত্তাকী’ (আল্লাহরভীরু) বলা যায়-যদিও সে গোনাহে লিপ্ত থাকে। এ অর্থ বোঝানোর জন্যেও কুরআনে অনেক জায়গায় ‘মুত্তাকীন’ ও ‘তাকওয়া’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
দ্বিতীয় স্তর যা আসলে কাম্য- তা হলো এমন সব বিষয় থেকে বেঁচে থাকা, যা আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রসূলের পছন্দনীয় নয়। কুরআন ও হাদীসে তাকওয়ার যে সব ফযীলত ও কল্যাণ প্রতিশ্রুত হয়েছে, তা এ স্তরের ‘তাকওয়ার’ উপর ভিত্তি করেই হয়েছে।
তৃতীয় স্তরটি তাকওয়ার সর্বোচ্চ স্তর। আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম ও তাঁদের বিশেষ উত্তরাধিকারী ওলীগণ এ স্তরের তাকওয়া অর্জন করে থাকেন। অর্থাৎ, অন্তরকে আল্লাহ ব্যতীত সবকিছু থেকে বাঁচিয়ে রাখা এবং আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর সন্তুষ্টি কামনার দ্বারা পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ রাখা। আলোচ্য আয়াতে اتَّقُوْااللهَ বলার পর حَقَّ تُقاتِه বলা হয়েছে। অর্থাৎ, তাকওয়ার ঐ স্তর অর্জন কর, যা তাকওয়ার হক।
তাকওয়ার হক কিঃ এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, রবী, কাতাদাহ ও হাসান বসরী (রাঃ) বলেনঃ রসুলুল্লাহ (সাঃ) থেকেও এমনি বর্ণিত হয়েছে যে, তাকওয়ার হক হল, প্রত্যেক কাজে আল্লাহর আনুগত্য করা, আনুগত্যের বিপরীত কোন কাজ না করা, আল্লাহকে সর্বদা স্মরণ রাখা-কখনও বিস্মৃত না হওয়া এবং সর্বদা তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা-অকৃতজ্ঞ না হওয়া।–(বাহরে মুহীত)
কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে- ‘সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর। হযরত ইবনে আব্বাস ও তাউস বলেনঃ এ আয়াতটি বাস্তবে তাকওয়ার হকেরই ব্যাখ্যা। উদ্দেশ্য এই যে, পূর্ণ শক্তি ব্যয় করে গোনাহ্ থেকে বেঁচে থাকা। এভাবেই তাকওয়ার হক আদায় হবে। অতএব, কোন ব্যক্তি অবৈধ বিষয় থেকে বেঁচে থাকার জন্যে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করা সত্ত্বেও কোন অবৈধ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়লে, তা তাকওয়ার হকের পরিপন্থী হবে না।
পরবর্তী বাক্যে বলা হয়েছে وَلاَتَمُوْتُنَّ اِلاَّوَاَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ এতে বোঝা যায় যে, পূর্ণ ইসলামই প্রকৃতপক্ষে তাকওয়ার। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রসূল (সাঃ) এর পূর্ণ আনুগত্য করা এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকা।
মুসলমানদের জাতীয় শক্তির দ্বিতীয় ভিত্তিঃ وَاعْتَصِمُوْابِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا আয়াতে পারস্পরিক ঐক্যের বিষয়টি অত্যন্ত সাবলীল ও বিজ্ঞজনোচিত ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ, এতে সর্বপ্রথম মানুষকে পারস্পর ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এর ব্যাখ্যা এই যে, ঐক্য ও মৈত্রী যে প্রশংসনীয় ও কাম্য, তাতে জগতের জাতি, ধর্ম ও দেশ-কাল নির্বিশেষে সব মানুষই একমত। এতে দ্বিমতের কোনই অবকাশ নেই। সম্ভবতঃ জগতের কোথাও এমন কোন ব্যক্তি নেই যে, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও বিবাদ-বিসংবাদকে উপকারী ও উত্তম মনে করে। এ কারণে বিশ্বের সব দল ও গোত্রই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানায়। কিন্তু অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, ঐক্য উপকারী ও অপরিহার্য হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত হওয়া সত্ত্বেও মানব জাতি বিভিন্ন দল-উপদল ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। এরপর দলের ভেতরে উপদল এবং সংগঠন সৃষ্টি করার এমন এক কার্যধারা অব্যাহত রয়েছে, যাতে সঠিক অর্থে দুই ব্যক্তির ঐক্য কল্প-কাহিনীতে পর্যবসিত হতে চলেছে। সাময়িক স্বার্থের অধীনে কয়েক ব্যক্তি কোন বিষয় ঐক্যবদ্ধ হয়। স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে কিংবা স্বার্থোদ্ধারে অকৃতকার্য হলে শুধু তাদের ঐক্যই বিনষ্ট হয় না; বরং পরস্পর শত্রুতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।
এ কারণে কুরআন পাক শুধু মৈত্রী, একতা, শৃঙ্খলা ও দলবদ্ধ হওয়ার উপদেশই দান করেনি; বরং তা অর্জন করা ও অটুট রাখার জন্যে একটি ন্যায়ানুগ মুলনীতিও নির্দেশ করেছে-যা স্বীকার করে নিতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। মূলনীতিটি এই যে, কোন মানুষের মস্তিষ্কনিঃসৃত অথবা কিছুসংখ্যক লোকের রচিত ব্যবস্থা ও পরিকল্পনাকে জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাদের কাছ থেকে এমন আশা করা যে, তারা এতে একতাবদ্ধ হয়ে যাবে- বিবেক ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী ও আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছুই নয়। তবে বিশ্ব-জাহানের পালনকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত ব্যবস্থা ও পরিকল্পনায় অবশ্যই সব মানুষের একতাবদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক; একথা কোন জ্ঞানী ব্যক্তিই নীতিগতভাবে অস্বীকার করতে পারে না। এখন মতভেদের একটি মাত্র ছিদ্রপথ খোলা থাকতে পারে যে, বিশ্ব-জাহানের পালনকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত ব্যবস্থা কি এবং কোনটি? ইহুদীরা তাওরাতের ব্যবস্থাকে এবং খ্রীষ্টানরা ইঞ্জীলের ব্যবস্থাকে আল্লাহ প্রদত্ত অবশ্যপালনীয় ব্যবস্থা বলে দাবী করে। এমনকি, মুশরিকদের বিভিন্ন দলও স্ব স্ব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান বলেই দাবী করে থাকে। এ ধরনের মতানৈক্য ও বিভেদকেই কুরআন পাক কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বর্তমানে এ কুরআনী মূলনীতিকে পরিত্যাগ করার কারণেই সমগ্র মুসলিম সমাজ শতধাবিভক্ত হয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। এ বিভেদ মেটানোর আমোষ ব্যবস্থাই وَاعْتَصِمُوْابِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا (আল্লাহর রজ্জুকে সবাই মিলে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর।) আয়াতে ব্যক্ত হয়েছে। এখানে ‘আল্লাহর রজ্জু’ বলে কুরআনকে বোঝানো হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মসউদের রেওয়ায়াতে হুযুর (সাঃ) বলেনঃ
كتاب الله هو حبل الله الممدود من السماء الى الارض অর্থাৎ, কুরআন হল আল্লাহ তাআলার রজ্জু যা আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত প্রলম্বিত।–(ইবনে কাসীর)
যায়েদ ইবনে আরকামের রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে حبل الله هوالقران অর্থাৎ, ‘আল্লাহর রজ্জু হচ্ছে কোরআন।’-(ইবনে কাসীর)
আরবী বাচন পদ্ধতিতে ‘হাবল’ এর অর্থ অঙ্গীকারও হয় এবং এমন যে কোন বস্তুকেই বলা হয় যা উপায় বা মাধ্যম হতে পারে। কুরআন অথবা দ্বীনকে ‘রজ্জু’ বলার কারণ এই যে, এটা একদিকে আল্লাহ তাআলার সাথে বিশ্ববাসী মানুষের সম্পর্ক কায়েম করে এবং অন্যদিকে বিশ্বাস স্থাপনকারীদেরকে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ করে একদলে পরিণত করে।
মোটকথা, কুরআনের এ বাক্যে বিজ্ঞজনোচিত মুলনীতিই বিবৃত হয়েছে। কেননা, প্রথমতঃ আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত জীবন-ব্যবস্থা কুরআনকে কাজে-কর্মে বাস্তবায়িত করা প্রত্যেক মানুষের জন্যে অবশ্য-