পৃষ্ঠা নং-১৯৩
দু’টি আয়াতের সারমর্ম এই যে, নিজেও স্বীয় কাজকর্ম ও চরিত্র আল্লাহ প্রেরিত আইন অনুযায়ী সংশোধন করে এবং অন্যান্য ভাইয়ের কাজকর্ম সংশোধন করারও চিন্তা কর। এ বিষয়বস্তুটিই সুরা ‘ওয়াল আসরে’ বর্ণনা করা হয়েছেঃ
إِلَّا الَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّٰلِحَٰتِ وَتَوَاصَوۡاْ بِالۡحَقِّ وَتَوَاصَوۡاْ بِالصَّبۡرِ
অর্থাৎ, পরকালের ক্ষতি থেকে তারা মুক্ত, যারা নিজেরাও ঈমান ও সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং অপরকেও নির্দেশ দেয়।
জাতীয় ও সমষ্টিগত জীবনের জন্যে একটি শক্তিশালী ঐক্য-সম্পর্ক থাকা অপরিহার্য। পূর্ববর্তী আয়াতে ‘আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর’ বলে তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এমনিভাবে এ ঐক্য সম্পর্ককে স্থিতিশীল রাখার জন্য দ্বিতীয় কাজটিও অপরিহার্য। আলোচ্য আয়াতে তাই বলা হয়েছে। অর্থাৎ, অপরারপর ভাইদেরকেও কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ অনুযায়ী ভাল কাজে আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ করাকে প্রত্যেকেই আপন কর্তব্য মনে করবে যাতে আল্লাহর রজ্জু তার হাত থেকে ফসকে না যায়।
ওস্তাদ মরহুম শায়খুল ইসলাম মাওলানা শাব্বীর আহমদ ওসমানী বলতেনঃ আল্লাহর এ রজ্জু ছিঁড়ে যেতে পারে না। অবশ্য হাত থেকে ফসকে যেতে পারে। তাই এ রজ্জুটি ফসকে যাবার আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে কুরআন পাক নির্দেশ জারি করেছে যে, প্রত্যেক মুসলমান যেমন নিজে সৎকর্ম করা ও গোনাহ থেকে বেঁচে থাকাকে জরুরী মনে করবে, তেমনি অপরকেও সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করাকে একটি কর্তব্য বলে মনে করবে।
‘সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’ করণের কর্তব্য প্রত্যেক ব্যক্তির উপর তখনই আরোপিত হবে, যখন চোখের সামনে কাউকে অসৎকাজ করতে দেখবে। উদাহরণতঃ কোন মুসলমানকে মদ্যপান করতে অথবা চুরি করতে কিংবা ভিন্ন নারীর সাথে অশালীন মেলামেশা করতে দেখলে সাধ্যানুযায়ী তা প্রতিরোধ করা ওয়াজিব হবে। কিন্তু চোখের সামনে এসব কাজ না পড়লে, তা ওয়াজিব নয়; বরং এরূপ কাজ বন্ধ করার দায়িত্ব ইসলামী সরকারের। সরকার অপরাধীর অপরাধ সম্পর্কে তদন্ত করে তাকে শাস্তি দেবে।
‘সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’ বাক্যের দ্বারা এরূপ বুঝার সম্ভাবনা ছিল যে, এ প্রয়োজন হয়তো বিশেষ বিশেষ স্থানেই হবে। অর্থাৎ, যখন চোখের সামনে অসৎকাজ হতে দেখা যায়। কিন্তু يَّدْعُوْنَ اِلَى الْخَيْرِ বলে প্রকাশ করা হয়েছে যে, এ সম্প্রদায়ের কাজ হবে কল্যাণের প্রতি আহবান করা; তখন অসৎকাজ হতে দেখা যাক, বা না যাক অথবা কোন ফরয আদায় করার সময় হোক বা না হোক। উদাহরণতঃ সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া পর্যন্ত নামাযের সময় নয়। কিন্তু এ সম্প্রদায় এ সময়ও এই বলে নামায পড়ার উপদেশ দেবে যে, সময় হলে নামায আদায় করা জরুরী। অথবা রোযার সময় আসেনি। রমযান মাস এখনও দূরে। কিন্তু এ সম্প্রদায় স্বীয় কর্তব্য সম্পর্কে উদাসীন হবে না; বরং পূর্ব থেকেই মানুষকে বলতে থাকবে যে, রমযান মাস এলে রোযা ফরয। মোটকথা, এ সম্প্রদায়ের কাজ হবে কল্যাণের প্রতি আহবান করতে থাকা।
কল্যাণের প্রতি আহবানেরও দু’টি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় অমুসলমানদেরকে ‘খায়র’ তথা ইসলামের প্রতি আহবান করা। প্রত্যেক মুসলমান সাধারণভাবে এবং উল্লেখিত সম্প্রদায়টি বিশেষভাবে জগতের সব জাতিকে ইসলামের প্রতি আহবান করবে মুখেও এবং কর্মের মাধ্যমেও। সেমতে জেহাদের আয়াতে সাচ্চা মুসলমানের সংজ্ঞা এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّٰهُمۡ فِي الۡأَرۡضِ أَقَامُواْ الصَّلَوٰةَ وَءَاتَوُاْ الزَّكَوٰةَ وَأَمَرُواْ بِالۡمَعۡرُوفِ وَنَهَوۡاْ عَنِ الۡمُنكَرِ
অর্থাৎ, তারা সাচ্চা মুসলমান, যাদের আমি পৃথিবীতে শক্তি তথা রাজত্ব দান করলে তারা প্রথমেই পৃথিবীতে আনুগত্যের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে-যার একটি প্রতীক হচ্ছে নামায। তারা নিজেদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তথা যাকাতের মূলনীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে এবং ‘সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ’ করাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে। আজকাল মুসলিম সম্প্রদায় যদি কল্যাণের প্রতি আহবান করাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তবে বিজাতির অনুকরণের ফলে আমাদের মধ্যে যেসব ব্যাধি সংক্রমিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হয়ে যাবে। কারণ, মুসলিম জাতি এ মহান লক্ষ্যে একত্রিত হয়ে গেলে তাদের অনৈক্য দূর হবে। তারা যখন বুঝতে পারবে যে, জ্ঞান-গরিমা ও কর্মের দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য জাতির উপর আমাদের প্রাধান্য অর্জন করতে হবে এবং তাদের শিক্ষাদীক্ষা এবং আল্লাহর আনুগত্যমুখী সভ্যতা ও সংঙ্কৃতির শিক্ষা দানের দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে, তখন সমগ্র জাতি একটি মহান লক্ষ্য অর্জনে ব্রতী হয়ে যাবে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে-কেরামের সাফল্যের চাবিকাঠি এর মধ্যেই নিহিত ছিল। হাদীসে আছে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ আয়াত তিলাওয়াত করে বলেছিলেনঃ এ সম্প্রদায়টি হচ্ছে বিশেষভাবে সাহাবায়ে-কেরামের দল।– (ইবনে-জারীর) কেননা, তাঁদের প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে এ কাজের জন্য দায়ী মনে করতেন।
দ্বিতীয় পর্যায়টি হলো কল্যাণের প্রতি স্বয়ং মুসলমানদেরকে আহবান করা। অর্থাৎ, সব মুসলমান (সাধারণভাবে) এবং উল্লেখিত সম্প্রদায় (বিশেষভাবে) মুসলমানদের মধ্যে প্রচারকার্য চালাবে। এ আহবানও দু’প্রকার। একটি ব্যাপক আহবান, অর্থাৎ, সব মুসলমানদেরকে শরীয়তের প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান ও ইসলামী চরিত্র সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করা এবং দ্বিতীয়টি বিশেষ আহবান। অর্থাৎ, মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কsরআন ও সুন্নাহর শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ তৈরী করা।
পরবর্তী আয়াতে এ আহবানকারী সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য এরূপ বলা হয়েছেঃ وَيَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ অর্থাৎ, তারা সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করে।
ইসলাম যেসব সৎকর্ম ও পূণ্যের নির্দেশ দিয়েছে এবং প্রত্যেক নবী আপন আপন যুগে যেসব সৎকর্মের প্রচলন করেছেন, তা সবই আয়াতের উল্লেখিত ‘মারুফ’ তথা সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। ‘মারুফ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পরিচিত। এসব সৎকর্মও সাধারণ্যে পরিচিত। তাই এগুলোকে ‘মারুফ’ বলা হয়।
এমনিভাবে রসুলুল্লাহ (সাঃ) যেসব সৎকর্মরূপী কাজকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন বলে খ্যাত, তা সবই আয়াতে উল্লেখিত ‘মুনকার’-এর-