আলি ইমরান ১-২৯

পৃষ্ঠা নং-১৭১

বলেছেন যে, আমার উম্মত অদূর ভবিষ্যতে এসব দেশ জয় করবে।

এ সংবাদে মদীনার মুনাফেকরা ঠাট্টা-বিদ্রূপের একটা সুযোগ পেয়ে বসলো। তারা বলতে লাগলোঃ দেখ, প্রাণ বাঁচানোই যাদের পক্ষে দায়; যারা শত্রুর ভয়ে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে দিবারাত্র পরিখা খননে ব্যস্ত, তারাই কিনা পারস্য, রোম ও ইয়ামন জয় করার দিবা-স্বপ্ন দেখছে। আল্লাহ তা’আলা এসব নির্বোধ জালেমদের উত্তরেই আলোচ্য قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ আয়াতটি নাযিল করেন।

এতে মুনাজাত ও দোয়ার ভাষায় অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে জাতিসমূহের উত্থান-পতন ও সাম্রাজ্যের পট পরিবর্তনে আল্লাহ তা’আলার অপ্রতিহত শক্তি সামর্থের বিষয় বর্ণিত হয়েছে এবং পারস্য ও রোম সাম্রাজ্য বিজয় সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এতে জগতের বৈপ্লবিক ঘটনাবলী সম্পর্কে অজ্ঞ, জাতিসমূহের উত্থান-পতনের ইতিহাস সম্পর্কে অনভিজ্ঞ এবং কওমে নূহ, আদ, সামুদ প্রভৃতি অবাধ্য জাতিগুলোর ধ্বংসকাহিনী সম্পর্কে উদাসীন ও মূর্খ শত্রুদের হুশিয়ার করা হয়েছে যে, এরা বাহ্যিক শান-শওকতের পূজা করে। এরা জানে না, জগতের সমস্ত শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার করায়ত্ত। সম্মান ও অপমান তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন। তিনি দরিদ্র ও পথের ভিখারীকে রাজ সিংহাসন ও মুকুটের অধিকারী করতে পারেন এবং প্রবল প্রতাপান্বিত সম্রাটদের হাত থেকে রাষ্ট্র ও ঐশ্বর্য্য ছিনিয়ে নিতে পারেন। আজ পরিখা খননকারী ক্ষুধার্ত ও নিঃস্বদের আগামীকাল সিরিয়া, ইরাক ও ইয়ামন সাম্রাজ্যের অধিকারী করে দেওয়া তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন নয়।

ভাল ও মন্দের নিরিখঃ আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে بِیَدِکَ الْخَیْرُ অর্থাৎ, তোমার হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। আয়াতের প্রথমাংশে রাজত্ব দান করা ও ছিনিয়ে নেয়া এবং সম্মান ও অপমান উভয়দিক উল্লেখ করা হয়েছিল। এ কারণে এখানেও بیدک الخیر والشر (তোমার হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণ) কিন্তু আয়াতে শুধু خیر (কল্যাণ) শব্দ ব্যবহার করে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যে বিষয়কে কোন ব্যক্তি অথবা জাতি অকল্যাণকর বা বিপজ্জনক মনে করে, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অথবা জাতির জন্যে আপাতদৃষ্টিতে অকল্যাণকর ও বিপজ্জনক মনে হলেও পরিণামের সামগ্রিক ফলশ্রুতির দিক দিয়ে তা অকল্যাণকর নাও হতে পারে।

মোটকথা, আমরা যেসব বিষয়কে মন্দ বলি, সেগুলো পুরোপুরি মন্দ নয়- আংশিক মন্দমাত্র। বিশ্বস্রষ্টা ও বিশ্ব-পালকের দিকে সমৃদ্ধ এবং সামগ্রিক উপযোগিতার দিক দিয়ে কোন বস্তুই মন্দ নয়।

২৭ নং আয়াতে নভোমণ্ডলেও আল্লাহ তাআলার ক্ষমতার ব্যাপ্তি বর্ণনা করা হয়েছে-

تُوْلِجُ الَّیْلَ فِی النَّهَارِ وَتُوْلِجُ النَّهَارَ فِی الَّیْلِ

অর্থাৎ, আপনি ইচ্ছা করলেই রাত্রির অংশ দিনে প্রবিষ্ট করে দিনকে বর্ধিত করে দেন এবং দিনের অংশ রাত্রিতে প্রবিষ্ট করে রাত্রিকে বর্ধিত করে দেন।

সবাই জানেন যে, দিবারাত্রির ছোট বা বড় হওয়া সে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সাথে সম্পর্কযুক্ত। কাজেই আয়াতের সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, নভোমণ্ডল, তৎসংশ্লিষ্ট সর্ববৃহৎ গ্রহ সূর্য এবং সর্বক্ষুদ্র উপগ্রহ চন্দ্র-সবই আল্লাহ তাআলার ক্ষমতাধীন। অতএব উপাদান-জগত ও অন্যান্য শক্তি যে আল্লাহ তা’আলারই ক্ষমতাধীন, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

وَتُخْرِجُ الْحَیَّ مِنَ الْمَیِّتِ وَتُخْرِجُ الْمَیِّتَ مِنَ الْحَیِّ আপনি জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন। যেমন, ডিম থেকে বাচ্চা অথবা বীর্য থেকে সন্তান অথবা বীজ থেকে বৃক্ষ বের করেন। পক্ষান্তরে আপনি মৃতকে জীবিত থেকে বের করেন। যেমন, পাখি থেকে ডিম, জীব থেকে বীর্য অথবা বৃক্ষ থেকে ফল ও শুষ্ক বীজ।

জীবিত ও মৃতের ব্যাপক অর্থ নেয়া হলে জ্ঞানী-মূর্খ, পূর্ণ-অপূর্ণ এবং মুমিন ও কাফের সবাই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এভাবে আল্লাহ তা’আলার সর্বব্যাপী ক্ষমতা সমগ্র আত্মা-জগত ও আধ্যাত্মিক জগতের উপর সুস্পষ্টরূপে পরিব্যাপ্ত হয়। অর্থাৎ, তিনি ইচ্ছা করলেই কাফেরের ঔরসে মুমিন অথবা মূর্খের ঔরসে জ্ঞানী পয়দা করতে পারেন। তাঁরই ইচ্ছায় আযরের গৃহে খলীলুল্লাহ জন্ম গ্রহণ করেন এবং নূহ (আঃ)-এর গৃহে তাঁর ঔরসজাত পুত্র কাফের থেকে যায়, আলেমের সন্তান জাহেল থেকে যায় এবং জাহেলের সন্তান আলেম হয়ে যায়।

আয়াতে সমগ্র সৃষ্টজগতের উপর আল্লাহ তা’আলার একচ্ছত্র ক্ষমতা কিরুপ প্রাঞ্জল ও মনোরম ধারাবাহিকতায় বর্ণিত হয়েছে, ‍উপরোক্ত বিবরণ থেকে সহজেই তা বোঝা যায়। প্রথমেই উপাদান জগত এবং তার শক্তি ও রাজত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। সবশেষে আত্মা ও আধ্যাত্মিকতার বর্ণনা এসেছে। প্রকৃতপক্ষে এটাই সমগ্র বিশ্বশক্তির সর্বোচ্চ শক্তি।

সবশেষে বলা হয়েছেঃ وَتَرْزُقُ مَنْ تَشَآءُ بِغَیْرِ حِسَابٍ অর্থাৎ, আপনি যাকেই ইচ্ছা অপরিমিত রিযক দান করেন। কোন সৃষ্টজীব জানতে পারে না- যদিও স্রষ্টার খাতায় তা কড়ায়-গণ্ডায় লিখিত থাকে।

আলোচ্য আয়াতের বিশেষ ফযীলতঃ ইমাম বাগভীর নিজস্ব সনদে বর্ণিত এক হাদীসে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর সূরা ফাতেহা, আয়াতুল কুরসী, সূরা আলে-ইমরানের شَهِدَ اللهُ    আয়াত শেষ পর্যন্ত এবং قُلِ اللّٰهُمَّ আয়াত بِغَیْرِ حِسَابٍ পর্যন্ত পাঠ করে, আমি তার ঠিকানা জান্নাতে করে দেব, আমার সকাশে স্থান দেব, দৈনিক সত্তর বার তার প্রতি রহমতের দৃষ্টি দেব, তার সত্তরটি প্রয়োজন মিটাব, শত্রুর কবল থেকে আশ্রয় দেব এবং শত্রুর বিরুদ্ধে তাকে জয়ী করব।

অমুসলমানদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক কিরূপ হওয়া উচিত কুরআনে এ সম্পর্কিত অনেক আয়াত রয়েছে। সূরা মুমতাহিনায় বলা হয়েছেঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِم بِالْمَوَدَّةِ

“হে মুমিনগণ! আমার ও তোমাদের শত্রু অর্থাৎ, কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যে, তাদের কাছে তোমার বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাবে।”

পারস্পরিক সম্পর্ক কিরূপ হওয়া উচিতঃ এ বিষয়বস্তুটি কুরআনের বহু আয়াতে সংক্ষেপে এবং কোন কোন স্থানে বিস্তারিতভাবে-

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ