আল-ফাতি‘হা, পৃষ্ঠা ৫-৭

পৃষ্ঠা নং-৫

তিনি তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন।

তাকে সকল সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর আকার-আকৃতি এবং বিবেক ও বুদ্ধি দান করেছেন। বর্তমানে তার লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের নিয়মিত সুব্যবস্থাও তিনিই করেছেন। অতঃপর مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ এর মধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ভবিষ্যতেও সে আল্লাহ্‌ তা‘আলারই মুখাপেক্ষী। প্রতিদান দিবসে আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো সাহায্য পাওয়া যাবে না।

প্রথম তিনটি আয়াতের দ্বারা যখন একথা প্রমাণিত হলো যে, মানুষ তার জীবনের তিনটি কালেই একান্তভাবে আল্লাহ্‌র মুখাপেক্ষী, তাই সাধারণ যুক্তির চাহিদাও এই যে, ‘ইবাদতও তাঁরই করতে হবে। কেননা, ‘ইবাদত যেহেতু অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে নিজের অফুরন্ত কাকুতি-মিনতি নিবেদন করার নাম, সুতরাং তা পাওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন অন্য কোন সত্তা নেই। ফলকথা এই যে, একজন বুদ্ধিমান ও বিবেকবান ব্যক্তি মনের গভীরতা থেকেই এ স্বতঃস্ফুর্ত স্বীকৃতি উচ্চারণ করছে যে, আমরা তোমাকে ব্যতীত অন্যকারো ‘ইবাদত করি না। এ মৌলিক চাহিদাই إِيَّاكَ نَعۡبُدُ -তে বর্ণনা করা হয়েছে।

যখন স্থির হলো যে, অভাব পূরণকারী একক সত্তা আল্লাহ্‌ তা‘আলা, সুতরাং নিজের যাবতীয় কাজে সাহায্যও তাঁর নিকটই প্রার্থনা করবে। এ মৌলিক চাহিদারই বর্ণনা وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ -এ করা হয়েছে।

মোটকথা, এ চতুর্থ আয়াতে একদিকে আল্লাহ্‌র তা’রীফ ও প্রশংসার সাথে একথারও স্বীকৃতি রয়েছে যে, ‘ইবাদত ও শ্রদ্ধা পাওয়ার একমাত্র তিনিই যোগ্য। অপরদিকে তাঁর নিকট সাহায্য ও সহায়তার প্রার্থনা করা এবং তৃতীয়ত: আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো ‘ইবাদত না করার শিক্ষাও দেয়া হয়েছে। এতদসঙ্গে এও বলে দেয়া হয়েছে যে, কোন বান্দাই আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কাকেও অভাব পূরণকারী মনে করবে না। অপর কারো নিকট প্রার্থনার হাত প্রসারিত করা যাবে না। অবশ্য কোন নাবী বা কোন ওয়ালীর বরাত দিয়ে প্রার্থনা করা এ আয়াতের মর্মবিরোধী নয়।

এ আয়াতে এ বিষয়ও চিন্তা করা কর্তব্য যে, ‘আমরা তোমারই নিকট সাহায্য চাই।’ কিন্তু কোন্ কাজের সাহায্য চাই, তার কোন উল্লেখ নেই। জমহুর মুফাস্‌সিরীনের অভিমত এই যে, নির্দিষ্ট কোন ব্যাপারে সাহায্যের কথা উল্লেখ না করে ‘আম’ বা সাধারণ সাহায্যের প্রতি ইশারা করা হযেছে যে, আমি আমার ‘ইবাদত এবং প্রত্যেক ধর্মীয় ও পার্থিব কাজে এবং অন্তরে পোষিত প্রতিটি আশা-আকাঙ্খায় কেবল তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

শুধু নামায/সলাত সওম/রোযারই নাম ‘ইবাদত নয়। ইমাম গায্‌যালী (র‘হ,) স্বিয় গ্রন্থ আরবা’ঈন-এ দশ প্রকার ‘ইবাদতের কথা লিখেছেন। যথা- নামায/সলাত, যাকাত, সওম/রোযা, কুরআন তিলাওয়াত,সর্বাবস্থায় আল্লাহ্‌র স্মরণ,’হালাল উপার্জনের চেষ্টা করা, প্রতিবেশী এবং সাথীদের প্রাপ্য পরিশোধ করা, মানুষেকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বিরত থাকার উপদেশ দেয়া, রসূলের সুন্নাহ/সুন্নত পালন করা।

একই কারণে ‘ইবাদতে আল্লাহ্‌র সাথে কাকেও অংশীদার করা চলে না। এর অর্থ হচ্ছে, কারো প্রতি ভালবাসা, আল্লাহ্‌র প্রতি ভালবাসার সমতুল্য হবে না। কারো প্রতি ভয়, কারো প্রতি আশা-আকাঙ্খা পোষণ আল্লাহ্‌র ভয় ও তাঁর প্রতি পোষিত আশা-আকাঙ্খার সমতুল্য হবে না। আবার কারো উপর একান্ত ভরসা করা, কারো আনুগত্য ও খেদমত/সেবা করা, কারো কাজকে আল্লাহ্‌র ‘ইবাদতের সমতুল্য আবশ্যকীয় মনে করা, আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্যকারো নামে মানত করা, আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো সামনে স্বীয় কাকুতি-মিনতি প্রকাশ করা এবং যে কাজে অন্তরের আবেগ-আকুতি প্রকাশ পায়, এমন কাজ আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো জন্য করা, যথা রুকূ’ বা সিজদা করা ইত্যাদি কোন অবস্থাতেই বৈধ হবে না।

শেষ তিনটি আয়াতে মানুষের দু‘আ ও আবেদনের বিষয়বস্তু এবং এক বিশেষ প্রার্থনাপদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে-

ٱهۡدِنَا ٱلصِّرَٰطَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ ٦ صِرَٰطَ ٱلَّذِينَ أَنۡعَمۡتَ عَلَيۡهِمۡ غَيۡرِ ٱلۡمَغۡضُوبِ عَلَيۡهِمۡ وَلَا ٱلضَّآلِّينَ ٧

অর্থাৎ, ‘আমাদিগকে সরল পথ দেখাও; সে সমস্ত মানুষের পথ, যারা তোমার অনুগ্রহ লাভ করেছে। যে পথে তোমার অভিশপ্ত বান্দারা চলেছে সে পথ নয় এবং ঐ সমস্ত লোকের রাস্তাও নয় যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।’

এ তিনটি আয়াতে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। যেমন, সরল পথের হিদায়াতের জন্য যে আবেদন এ আয়াতে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, এর আবেদনকারী যেমনিভাবে সাধারণ মানুষ, সাধারণ মু’মিনগণ, তেমনি আওলিয়া,গ্বউছ-কুতুব এবং নাবী-রসূলগণও বটে। নিঃসন্দেহে যাঁরা হিদায়াত প্রাপ্ত, বরং অন্যের হিদায়াতের উৎসস্বরূপ, তাঁদের পক্ষে পুনরায় সে হিদায়াতের জন্যই বারংবার প্রার্থনা করার উদ্দেশ্য কি? এ প্রশ্নের উত্তর হিদায়াত শব্দের তাৎপর্য পরিপুর্ণরূপে অনুধাবন করার উপর নির্ভরশীল।

ইমাম রাগ্বেব ইস্‌ফাহানী (র‘হ,) ‘মুফরদাতুল কুরআনে’ হিদায়াত শব্দের অতি ‍সুন্দর ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এর সারমর্ম হচ্ছে-‘কাউকে গন্তব্যস্থানের দিকে অনুগ্রহের সাথে পথ প্রদর্শন করা’। তাই হিদায়াত করা প্রকৃত প্রস্তাবে একমাত্র আল্লাহ্‌ তা‘আলারই কাজ এবং এর বিভিন্ন স্তর রয়েছে। হিদায়াতের একটি স্তর হচ্ছে সাধারণ ও ব্যাপক। এতে সমগ্র সৃষ্টি অন্তর্ভুক্ত। জড়পদার্থ, উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগত পর্যন্ত এর আওতাধীন। প্রসঙ্গত: প্রশ্ন উঠতে পারে যে, প্রাণহীন জড়পদার্থ বা ইতর প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে হিদায়াতের সম্পর্ক কোথায়?

কুরআনের শিক্ষায় স্পষ্টত:-ই এ তথ্য ব্যক্ত হয়েছে যে, সৃষ্টির প্রতিটি স্তর, এমনকি প্রতিটি অণু-পরমাণু পর্যন্ত নিজ নিজ অবস্থানুযায়ী প্রাণ ও অনুভুতির অধিকারী। স্ব-স্ব পরিমন্ডলে প্রতিটি বস্তুর বুদ্ধি-বিবেচনা রয়েছে। অবশ্য এ বুদ্ধি ও অনুভুতির তারতম্য রয়েছে। কোনটাতে তা স্পষ্ট এবং কোনটাতে নিতান্তই অনুল্লেখ্য। যে সমস্ত বস্তুতে তা অতি অল্পমাত্রায় বিদ্যমান সেগুলোকে প্রাণহীন বা অনুভুতিহীন বলা যায়। বুদ্ধি ও অনুভূতির ক্ষেত্রে এ তারতম্যের জন্যই সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতিকেই শরী’আতের ‘হুকুম-আ’হাকামের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। কারণ, সৃষ্টির এ দু’টি স্তরের মধ্যেই বুদ্ধি ও অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হয়েছে। কিন্তু, তাই বলে একথা বলা যাবে না যে, একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতি ছাড়া সৃষ্টির অন্য কোন কিছুর মধ্যে বুদ্ধি-

পৃষ্ঠা নং-৬

ও অনুভূতির অস্তিত্ব নেই। কেননা, আল্লাহ্‌ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:

وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ ۗ

অর্থাৎ-এমন কোন বস্তু নেই যা আল্লাহ্‌র প্রশংসার তাসবী‘হ পাঠ করে না, কিন্তু তোমরা তাদের তাসবী‘হ বুঝতে পার না। [সূরা বানী-ইসরাঈল]

সূরা নূরে ইরশাদ হয়েছে:

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يُسَبِّحُ لَهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالطَّيْرُ صَافَّاتٍ ۖ كُلٌّ قَدْ عَلِمَ صَلَاتَهُ وَتَسْبِيحَهُ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ

অর্থাৎ, ‘তোমরা কি জান না যে, আসমান-জমিনে যা কিছু রয়েছে, সকলেই আল্লাহ্‌র পবিত্রতা বর্ণনা ও গুণগান করে? বিশেষত: পাখীকুল যারা দু’পাখা বিস্তার করে শূন্যে উড়ে বেড়ায়, তাদের সকলেই স্ব-স্ব দু‘আ তাসবী‘হ সম্পর্কে জ্ঞাত এবং আল্লাহ্‌ তা‘আলাও তাদের তাসবী‘হ সম্পর্কে খবর রাখেন।’

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ