আল-বাকারা

سُورَةُ البَقَرَةِ

২-সূরা আল-বাক্বারা

(মদীনায় অবতীর্ণ: আয়াত ২৮৬)

بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি।

الٓمٓ ١

১.আলিফ লা-ম মীম।

 ذَٰلِكَ ٱلۡكِتَٰبُ لَا رَيۡبَۛ فِيهِۛ هُدٗى لِّلۡمُتَّقِينَ ٢

২.এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য,

ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡغَيۡبِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ ٣

৩.যারা অদেখা বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।

وَٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيۡكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبۡلِكَ وَبِٱلۡأٓخِرَةِ هُمۡ يُوقِنُونَ ٤

৪.এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে সেসব বিষয়ের উপর যা কিছু তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেসব বিষয়ের উপর যা তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। আর আখিরাতকে (পরকাল) যারা নিশ্চিত বলে বিশ্বাস করে।

সূরা বাক্বরার ফযীলত:

এ সূরা বহু আ’হকাম সম্বলিত সবচাইতে বড় সূরা। নবী কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন যে, সূরা বাক্বরহ পাঠ কর। কেননা, এর পাঠে বরকত লাভ হয় এবং পাঠ না করা অনুতাপ ও দুর্ভাগ্যের কারণ। যে ব্যক্তি এ সূরা পাঠ করে তার উপর কোন আহ্‌লে-বাতিল তথা জাদুকরের জাদু কখনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

     নবী কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ সূরাকে سنام القران (সিনা-মুল্ ক্বুরআ-ন) ও ذروة القران (যারওয়াতুল্ ক্বুরআ-ন) বলে উল্লেখ করেছেন। সিনা-ম ও যারওয়াহ বস্তুর উৎকৃষ্টতম অংশকে বলা হয়। সূরা বাক্বরায় আয়াতুল কুরসী নামে যে আয়াতখানা রয়েছে তা ক্বুরআন শরীফের অন্যান্য সকল আয়াত থেকে উত্তম। [ইব্‌ন কাছীর]

     হযরত ইব্‌ন মাস‘ঊদ (রদ্বিয়াল্লহু ‘আনহু) বলেছেন যে, এ সূরায় এমন দশটি আয়াত রয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি সে আয়াতগুলো রাতে নিয়মিত পাঠ করে, তবে শয়তান সে ঘরে প্রবেশ করতে পারবেনা এবং সে রাতের মত সকল বলা-মুসীবত, রোগ-শোক ও দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা থেকে নিরাপদে থাকবে। তিনি আরো বলেছেন, যদি বিকৃতমস্তিস্ক লোকের উপর এ দশটি আয়াত পাঠ করে দম করা হয়, তবে সে ব্যক্তি সুস্থতা লাভ করবে। আয়াত দশটি হচ্ছে: সূরার প্রথম চার আয়াত, মধ্যের তিনটি অর্থাৎ, আয়াতুল কুরসী ও তার পরের দু’টি আয়াত এবং শেষের তিনটি আয়াত।

     আ‘হকাম ও মাসায়েল: বিষয়বস্তু ও মাসায়েলের দিক দিয়েও সূরা বাক্বরহ্ সমগ্র কুরআনের অনন্য বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদার অধিকারী। এ সূরায় এক হাজার আদেশ, এক হাজার নিষেধ, এক হাজার ‘হিকমত এবং এক হাজার সংবাদ ও কাহিনী রয়েছে।

আনুসঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

‘হুরূফে মুক্বত্ত্ব‘আ-তঃ অনেকগুলো সূরার প্রারম্ভে কতকগুলো বিচ্ছিন্ন বর্ণ দ্বারা গঠিত এক-একটা বাক্য উল্লেখিত হয়েছে। যথা الٓمٓصٓ ـ حمٓ ـ الٓمٓ এগুলোকে কুরআনের পরিভাষায় ‘হুরূফে মুক্বত্ত্ব‘আ-ত’ বলা হয়। এ অক্ষরগুলোর প্রত্যেকটিকে পৃথক পৃথকভাবে সাকিন পড়া হয়। যথা مِيْمْ ـ لاَمْ ـ الف (আলিফ-লা-ম্-মীম)।

     কোন কোন তাফসীরকার এ ‘হরফগুলোকে সংশ্লিষ্ট সূরার নাম বলে অভিহিত করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, এগুলো আল্লাহ্‌র নামের তত্ত্ব বিশেষ।

অধিকাংশ সা‘হাবী, তাবে‘য়ী এবং ‘উলামাদের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত মত হচ্ছে যে, ‘হুরূফে মুক্বত্ত্ব‘আ-তগুলো এমনি রহস্যপূর্ণ যার মর্ম ও মাহাত্ম্য একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলাই জানেন। অন্য কাকেও এ বিষয়ে জ্ঞান দান করা হয়নি।

     এ প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী লিখেছেনঃ হযরত আবূ বাক্‌র সিদ্দীক্ব,‘উমার,‘উছমান, ‘আলী, ইব্‌নে মাস’ঊদ (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহুম আজ্‌মা’য়ীন) প্রমুখ সা’হাবাগণ এ সম্বন্ধে অভিমত পোষণ করেন যে, এগুলো আল্লাহ্ তা‘আলার রহস্যজনিত বিষয় এবং  তাঁর পক্ষ থেকেই অবতীর্ণ। এ বিশ্বাস রেখে এগুলোর তিলাওয়াত করতে হবে। কিন্তু এগুলোর রহস্য উদ্ধারের ব্যাপারে এবং তত্ত্ব-সংগ্রহে আমাদের ব্যস্ত হওয়া উচিত হবে না।

     ইব্‌নে কাছীর ও কুরতুবীর বরাত দিয়ে এ মন্তব্যকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কোন কোন ‘আলিম এ শব্দগুলোর যে অর্থ বর্ণনা করেছেন, সেগুলোকে ভূল প্রতিপন্ন করাও উচিত হবে না। কেননা, তাঁরা উপমাস্থলে এবং এগুলোকে সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যেই এসব অর্থ বর্ণনা করেছেন।

         ذَٰلِكَ ٱلۡكِتَٰبُ لَا رَيۡبَۛ فِيهِۛ  সাধারণতঃ ذَٰلِكَ কোন দূরবর্তী বস্তুকে ইঙ্গিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়। الْکِتٰبُ দ্বারা কুরআন মাজীদকে বোঝানো হয়েছে।

         رَيۡبَۛ অর্থ সন্দেহ-সংশয়। আয়াতের অর্থ হচ্ছে, এটি এমন এক কিতাব যাতে সন্দেহ-সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। এটি বাহ্যতঃ দূরবর্তী ইশারার স্থল নয়। কারণ, এ ইশারা কুরআন শরীফের প্রতিই করা হয়েছে, যা মানুষের সামনেই রয়েছে। কিন্তু দূরবর্তী ইশারার শব্দ ব্যবহার করে একথাই বোঝানো হয়েছে যে, সূরতুল ফা-তি’হাতে যে স্বিরতুল্-মুস্তাক্বীমের প্রার্থনা করা হয়েছেল, সমগ্র কুরআন শরীফ সে প্রার্থনারই প্রত্যুত্তর। এটি স্বিরা-তুল্-মুস্তাক্বীমের বিস্তারিত ব্যাখ্যাও বটে। অর্থ হচ্ছে: আমি তোমাদের প্রার্থনা শুনেছি এবং হিদায়াতের উজ্জ্বল সূর্যসদৃশ্য পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছি। যে ব্যক্তি হিদায়াত লাভের ইচ্ছুক সে যেন এ কিতাব অনুধাবন করে এবং তদনুযায়ী ‘‘আমল করে।

     এতদসঙ্গে এ কথাও বলে দেয়া হচ্ছে যে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কোন কালামে বা বক্তব্যে সন্দেহ ও সংশয় দু’কারণে হতে পারে। কারো বুদ্ধিমত্তার স্বল্পতার দরুন সন্দেহ উপস্থিত হতে পারে। যার উল্লেখ কয়েক আয়াত পরেই স্বয়ং কুরআন কারীমেই রয়েছে, যেমন-

         وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ  যদি তোমরা এতে সন্দেহ পোষণ কর। (অতএব, স্বল্পতাহেতু কারো মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও এরূপ বলা ন্যায়সঙ্গত যে, এ কিতাবে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই।)

         هُدٗى لِّلۡمُتَّقِينَ যারা আল্লাহ্ তা‘আলাকে ভয় করে, তাদের জন্য হিদায়াত। অর্থাৎ, যে বিশেষ হিদায়াত পরকালের মুক্তির উপায়, তা কেবল মুত্তাক্বীদেরই প্রাপ্য। অবশ্য কুরআনের হিদায়াত মানবজাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমস্ত বিশ্বচরাচরের জন্য ব্যাপক। সুরতুল্-ফা-তি’হার তাফসীরে বর্ণনা করা হয়েছে যে, হিদায়াতের তিনটি স্তর রয়েছে।

     (এক) সমগ্র মানবজাতি, প্রাণীজগত তথা সমগ্র সৃষ্টির জন্যই ব্যাপৃত।

     (দুই) মুসলমানদের জন্য খাস তথা বিশেষ।

     (তিন) যারা আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ নৈকট্য লাভ করেছে, তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তথাপি হিদায়াতের স্তরের কোন সীমারেখা নেই।

     কুরআনের কোথাও ‘আ-ম’ বা সাধারণ এবং কোথাও বিশেষ হিদায়াতের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এখানে বিশেষ বা সুনির্দিষ্ট হিদায়াতের কথা বলা হয়েছে। এজন্যই হিদায়াতের সঙ্গে মুত্তাক্বীদেরকে বিশেষভাবে যুক্ত করা হয়েছে বলেই এরূপ সংশয় প্রকাশ করা সমীচীন হবে না। হিদায়াতের বেশী প্রয়োজন তো সে সমস্ত লোকেরই ছিল, যারা মুত্তাক্বী নয়। কেননা, ইতিমধ্যে হিদায়াতের স্তর বিন্যাস করে এসব সংশয়ের অবসান করে দেয়া হয়েছে। তাই এখন আর একথা বলা ঠিক নয় যে, কুরআন শুধু মুত্তাক্বীদের জন্যই হিদায়াত বা পথপ্রদর্শক, অন্যের জন্য নয়।

     মুত্তাক্বীগণের গুণাবলী: পরবর্তী দু’টি আয়াতে মুত্তাক্বিগণের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। যারা হিদায়াতপ্রাপ্ত, তাদের পথই হচ্ছে স্বির-তুল্-মুস্তাক্বীম। যারা সরল-সঠিক পুণ্যপন্থা লাভ করতে চায়, তাদের উচিত সে দলে শরীক হয়ে বা অংশগ্রহণ করে তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা এবং সে সকল লোকের স্বভাব-চরিত্র, আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে জীবনের পাথেয়রূপে গ্রহণ করা। আর এজন্যই মুত্তাক্বিগণের বিশেষ গুণাবলীর সঙ্গে সঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে:

أُوْلَٰٓئِكَ عَلَىٰ هُدٗى مِّن رَّبِّهِمۡۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٥

৫. তারাই নিজেদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত, আর তারাই যথার্থ সফলকাম।

إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ سَوَآءٌ عَلَيۡهِمۡ ءَأَنذَرۡتَهُمۡ أَمۡ لَمۡ تُنذِرۡهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ ٦

৬. নিশ্চিতই যারা কাফের হয়েছে তাদেরকে আপনি ভয় প্রদর্শন করুন আর নাই করুন তাতে কিছুই আসে যায় না, তারা ঈমান আনবে না।

خَتَمَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمۡ وَعَلَىٰ سَمۡعِهِمۡۖ وَعَلَىٰٓ أَبۡصَٰرِهِمۡ غِشَٰوَةٞۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ٧

৭. আল্লাহ্‌ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখসমূহ পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।

وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ ٨

৮.আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ্‌ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়।

يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَمَا يَخۡدَعُونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمۡ وَمَا يَشۡعُرُونَ ٩

৯. তারা আল্লাহ্‌ এবং ঈমানদারগণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এতে তারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না।

فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضٗاۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمُۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ ١٠

১০. তাদের অন্তঃকরণ ব্যধিগ্রস্ত আর আল্লাহ্‌ তাদের ব্যধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আযাব, তাদের মিথ্যাচারের দরুন।

وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَا تُفۡسِدُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ قَالُوٓاْ إِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُونَ ١١

১১. আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, আমরা তো মীমাংসার পথ অবলম্বন করেছি।

أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلۡمُفۡسِدُونَ وَلَٰكِن لَّا يَشۡعُرُونَ ١٢

১২. মনে রেখো, তারাই হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না।

وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ كَمَآ ءَامَنَ ٱلنَّاسُ قَالُوٓاْ أَنُؤۡمِنُ كَمَآ ءَامَنَ ٱلسُّفَهَآءُۗ  أَلَآ إِنَّهُمۡ هُمُ ٱلسُّفَهَآءُ وَلَٰكِن لَّا يَعۡلَمُونَ ١٣

১৩. আর যখন তাদেরকে বলা হয়, অন্যান্যরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন, তখন তারা বলে, আমরাও কি ঈমান আনব বোকাদেরই মত! মনে রেখো, প্রকৃতপক্ষে তারাই বোকা, কিন্তু তারা তা বোঝে না।

وَإِذَا لَقُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَوۡاْ إِلَىٰ شَيَٰطِينِهِمۡ قَالُوٓاْ إِنَّا مَعَكُمۡ إِنَّمَا نَحۡنُ مُسۡتَهۡزِءُونَ ١٤

১৪.আর তারা যখন ঈমানদারদের সাথে মিশে, তখন বলে, আমরা ঈমান এনেছি। আবার যখন তাদের শয়তানদের সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথে রয়েছি। আমরা তো (মুসলমানদের সাথে) উপহাস করি মাত্রা।

ٱللَّهُ يَسۡتَهۡزِئُ بِهِمۡ وَيَمُدُّهُمۡ فِي طُغۡيَٰنِهِمۡ يَعۡمَهُونَ ١٥

১৫.বরং আল্লাহ্‌ই তাদের সাথে উপহাস করেন। আর তাদেরকে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন যেন তারা নিজেদের অহংকার ও কুমতলবে হয়রান ও পেরেশান থাকে।

أُوْلَٰٓئِكَ عَلَىٰ هُدٗى مِّن رَّبِّهِمۡۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ

অর্থাৎ, তারাই আল্লাহ্ প্রদত্ত সৎপথপ্রাপ্ত এবং তারাই পূর্ণ সফলকাম। উপরোক্ত দু’টি আয়াত দ্বারা মুত্তাক্বীদের গুণাবলীর বর্ণনার মধ্যে ঈমানের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, এর মূলনীতিগুলো এবং তৎসঙ্গে সৎকর্মের মূলনীতিগুলোও স্থান পেয়েছে। তাই ঐ সমস্ত গুণাবলীর বিশ্লেষণ পরবর্তী আয়াতে দেয়া হয়েছে।

ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡغَيۡبِ وَيُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَمِمَّا رَزَقۡنَٰهُمۡ يُنفِقُونَ

অর্থাৎ, আল্লাহ্‌কে যারা ভয় করে, তারা এমন লোক যে, অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, স্বলাত তথা নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং স্বীয় জীবিকা থেকে সৎপথে ব্যয় করে।

     আলোচ্য আয়াতে মুত্তাক্বীদের তিনটি গুণের উল্লেখ করা হয়েছে। অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন, স্বলাত তথা নামায প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বীয় জীবিকা থেকে সৎপথে ব্যয় করা। উপরোক্ত আলোচনার মধ্যে বেশ কতকগুলো জরুরী বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে।

     প্রথম: ঈমানের সংজ্ঞা: ঈমানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে দু’টি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ٱلَّذِينَ يُؤۡمِنُونَ بِٱلۡغَيۡبِ ঈমান এবং গায়ব। শব্দ দু’টির অর্থ যথাযথভাবে অনুধাবন করলেই ঈমানের পুরোপুরি তাৎপর্য ও সংজ্ঞা হৃদয়ঙ্গম করা হবে। ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কারো কথাকে তার বিশ্বস্ততার নিরিখে মনে-প্রাণে মেনে নেয়া। এজন্যই অনুভুতিগ্রাহ্য কোন বস্তুতে কারো কথায় বিশ্বাস করার নাম ঈমান নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়ে যে, কোন ব্যক্তি যদি এক টকুরো সাদা কাপড়কে সাদা এবং এক টুকরো কালো কাপড়কে কালো বলে এবং আর এক ব্যক্তি তার কথা সত্য বলে মেনে নেয়, তাহলে একে ঈমান বলা যায় না। এতে বক্তার কোন প্রভাব বা দখল নেই। অপরদিকে রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কোন সংবাদ কেবলমাত্র রসূলের উপর বিশ্বাসবতঃ মেনে নেয়াকেই শরী’আতের পরিভাষায় ঈমান বলে।

         غَيۡبِ এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে এমনসব বস্তু যা বাহ্যিকভাবে মানবকুলের জ্ঞানের ঊর্ধ্বে এবং যা মানুষ পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারে না, চক্ষু দ্বারা দেখতে পায় না, কান দ্বারা শুনতে পায় না, নাসিকা দ্বারা ঘ্রাণ নিতে পারে না, জিহ্বা দ্বারা স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না, হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারে না, ফলে সে সম্পর্কে জ্ঞানলাভও করতে পারে না।

     কুরআনে غَيۡبِ শব্দ দ্বারা সে সমস্ত বিষয়কেই বোঝানো হয়েছে যেগুলোর সংবাদ রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দিয়েছেন এবং মানুষ যে সমস্ত বিষয়ে স্বীয় বুদ্ধিবলে ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জ্ঞান লাভে সম্পুর্ণ অক্ষম।

         غَيۡبِ শব্দ দ্বারা ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব ও সত্তা, সিফাত বা গুণাবলী এবং তক্বদীর সম্পর্কিত বিষয়সমূহ, বেহেশত-দোযখের অবস্থা, ক্বিয়ামত এবং ক্বিয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাসমূহ, ফেরেশ্‌তাকুল, সমস্ত আসমানী কিতাব, পূর্ববর্তী সকল নবী ও রসূলগণের বিস্তারিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত যা সূরা বাক্বরার-امن الرسول আয়াতে দেয়া হয়েছে। এখানে ঈমানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এবং শেষ আয়াতে ঈমানের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

     উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন ঈমান বিল-গ্বাইব বা অদৃশ্যে বিশ্বাসের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে হিদায়াত এবং শিক্ষা নিয়ে এসেছিলেন, সে সবগুলোকে আন্তরিকভাবে মেনে নেয়া। তবে শর্ত হচ্ছে যে, সেগুলো রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শিক্ষা হিসেবে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হতে হবে। আহ্‌লে-ইসলামের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ঈমানের এ সংজ্ঞাই দিয়েছেন। ‘’আক্বায়েদে-ত্ব’হাবী’ ও ‘’আক্বায়েদে-নস্বফী’-তে এ সংজ্ঞা মেনে নেয়াকেই ঈমান বলে অভিহিত করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শুধু জানার নামই ঈমান নয়। কেননা, স্বয়ং ইবলীস এবং অনেক কাফিরও রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নবুওয়াত যে সত্য তা আন্তরিকভাবে জানতো, কিন্তু না মানার কারণে তারা ঈমানদারের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।

     দ্বিতীয়ত: ইক্বামতে-স্বলাত: ইক্বামত বা প্রতিষ্ঠা অর্থ শুধু স্বালাত/নামায আদয় করা নয়, বরং স্বলাত/নামাযকে সকল দিক দিয়ে ঠিক করাকে প্রতিষ্ঠা করা বলা হয়। ‘ইক্বামত’ অর্থে স্বলাত/নামাযে সকল ফার্‌দ্ব/ফরয, ওয়াজিব,সুন্নাহ/সুন্নত, মুস্তা’হাব পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, এতে সব সময় সুদৃঢ় থাকা এবং এর ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করা সবই বোঝায়। ফার্‌দ্ব/ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাহ/সুন্নত ও নফল প্রভৃতি সকল স্বলাত/নামাযের জন্য একই শর্ত। এক কথায় স্বলাত/নামাযে অভ্যস্ত হওয়া ও তা শরী’আতের নিয়মানুসারে আদায় করা এবং এর সকল নিয়ম-পদ্ধতি যথার্থভাবে পালন করাই ইক্বামতে-স্বলাত।

     তৃতীয়ত: আল্লাহ্‌র পথে ব্যয়: আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় অর্থে এখানে ফার্‌দ্ব/ফরয যাকাহ/যাকাত, ওয়াজিব স্বদাক্বাহ/সদকা এবং নফল দান-খয়রাত প্রভৃতি যা আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয় করা হয় সে সবকিছুই বোঝানো হয়েছে। কুরআনে সাধারণত: نفاق শব্দ নফল দান-খয়রাতের জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে ফার্‌দ্ব/ফরয যাকাহ/যাকাত উদ্দেশ্য সেসব ক্ষেত্রে زكوة শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।

         وممّا رزقنهم এ সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, আল্লাহ্‌র রাস্তায় তথা সৎপথে অর্থ ব্যয় করার একটা প্রবল আকাঙ্খা প্রত্যেক সৎ মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে জাগ্রত করাই এ আয়াতের উদ্দেশ্য। একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি চিন্তা করবে যে, আমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে, তা সবই তো আল্লাহ্‌র দান ও আমানাহ/আমানত। যদি আমরা সমস্ত ধন-সম্পদ তাঁর পথে ব্যয় করি, তবেই মাত্র এ নি’আমতের হক্ব আদায় হবে। পরন্তু এটা আমাদের পক্ষ থেকে কারো প্রতি কোন ই’হসান বা অনুগ্রহ হবে না তবে এ আয়াতে ممّا শব্দ যোগ করে একথা বোঝানো হয়েছে যে, যে ধন-সম্পদ আমাদেরকে দেয়া হয়েছে তা সবই ব্যয় করতে হবে এমন নয়; বরং কিয়দংশ ব্যয় করার কথাই বলা হয়েছে।

     মুত্তাক্বীদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমে অদৃশ্যে বিশ্বাস, এরপর স্বলাত/নামায প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমানের গুরুত্ব সকলেরই জানা যে, ঈমানই প্রকৃত ভিত্তি এবং সকল ‘‘আমল ক্ববূল হওয়া ঈমানের উপরই নির্ভরশীল। কিন্তু যখনই ঈমানের সাথে ‘আমলের কথা বলা হয়, তখন সেগুলোর তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হতে থাকে। কিন্তু এখানে শুধু স্বলাত/নামায এবং অর্থ ব্যয় পর্যন্ত ‘‘আমল রয়েছে তা ফার্‌দ্ব/ফরযই হোক অথবা ওয়াজিব, সবই হয় মানুষের দেহ অথবা ধন-সম্পদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ‘ইবাদতে-বদনী তথা দৈহিক ‘ইবাদতের মধ্যে স্বলাম/নামায সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখানে স্বলাত/নামাযের বর্ণনায় এবং যেহেতু আর্থিক ‘ইবাদত সবই انفاق শব্দের অন্তর্ভুক্ত সুতরাং এ উভয় প্রকার ‘ইবাদতের বর্ণনার মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে যাবতীয় ‘ইবাদতের বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। পূর্ণ আয়াতের অর্থ হচ্ছে: তারাই মুত্তাক্বী যাদের ঈমান পূর্ণাঙ্গ এবং ‘‘আমলও পূর্ণাঙ্গ। ঈমান এবং ‘‘আমল এ দুয়ের সমন্বয়েই ইসলাম। এ আয়াতে ঈমানের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দেয়ার সাথে সাথে ইসলামের বিষয়বস্তুর প্রতিও ইঙ্গীত করা হয়েছে।

     ঈমান ও ইসলামের পার্থক্য: অভিধানে কোন বস্তুতে আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন ঈমান এবং কারো অনুগত হওয়াকে ইসলাম বলে।

     ঈমানের আধার হল অন্তর ইসলামের আধার অন্তরসহ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কিন্তু শরী’আতে ঈমান ব্যতীত ইসলাম এবং ইসলাম ব্যতীত ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ, আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত এ বিশ্বাসের মৌখিক স্বীকৃতির সাথে সাথে কর্মের দ্বারা আনুগত্য ও তাবেদারী প্রকাশ করা না হয়।

     মোটকথা, আভিধানিক অর্থে ঈমান ও ইসলাম স্বতন্ত্র অর্থবোধক বিষয়বস্তুর অন্তর্গত। অর্থগত পার্থক্যের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু শরী’আত ঈমানবিহীন ইসলাম এবং ইসলামবিহীন ঈমান অনুমোদন করে না।

     প্রকাশ্য আনুগত্যের সাথে যদি অন্তরের বিশ্বাস না থাকে, তবে কুরআনের ভাষায় একে ‘নিফা-ক্ব’ বলে। নিফা-ক্বকে কুফর হতেও বড় অন্যায় সাব্যস্ত করা হয়েছে।

     বলা হয়েছে-‘মুনাফিক্বদের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।’ অনুরূপভাবে আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে যদি মৌখিক স্বীকৃতি এবং আনুগত্য না থাকে, কুরআনের ভাষায় একেও কুফরী বলা হয়।

     বলা হয়েছে-‘কাফিরগণ রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং তাঁর নবুওয়াতের যথার্থতা সম্পর্কে এমন সুস্পষ্টভাবে জানে, যেমন জানে তাদের নিজ নিজ সন্তানদেরকে।’

     অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

وَجَحَدُوْا بِهَاوَاسْتَيْقَنَتْهَااَنْفُسُهُمْ ظُلْماً وَعُلُوًّا

অর্থাৎ, তারা আমার নিদর্শন বা আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে, অথচ তাদের অন্তরে এর পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। তাদের এ আচরণ কেবল অন্যায় ও অহঙ্কারপ্রসূত।

     ঈমান ও ইসলামের ক্ষেত্র এক, কিন্তু আরম্ভ ও শেষের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। অর্থাৎ, ঈমান যেমন অন্তর থেকে আরম্ভ হয় এবং প্রকাশ্য ‘আমলে পৌঁছে পূর্ণতা লাভ করে, তদ্রূপ ইসলামও প্রকাশ্য ‘‘আমল’ থেকে আরম্ভ হয় এবং অন্তরে পৌঁছে পূর্ণতা লাভ করে। অন্তরের বিশ্বাস প্রকাশ্য ‘‘আমল পর্যন্ত না পৌঁছলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। অনুরূপভাবে প্রকাশ্য আনুগত্য ও তাবেদারী আন্তরিক বিশ্বাসে না পৌঁছালে গ্রহণযোগ্য হয় না। ইমাম গাযালী এবং ইমাম সুব্‌কীও এ মত পোষণ করেছে।

     অন্য আয়াতে মুত্তাক্বীদের এমন আরো কতিপয় গুণাবলীর বর্ণনা রয়েছে, যাতে ঈমান বিল-গ্বায়ব এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসের প্রসঙ্গটা আরো একটু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত ‘আব্‌দুল্লাহ্ ইব্‌ন ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আন্‌হু) বলেছেন যে, রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে মু’মিন ও মুত্তাক্বী শ্রেণীর লোক বিদ্যমান ছিলেন, একশ্রেণী তাঁরা যাঁরা প্রথমে ‘হাদীস ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। অন্য শ্রেণী হল যাঁরা প্রথমে আহ্‌লে-কিতাব ইহুদী-নাস্বারা ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এখানে পূর্ববর্তী আয়াতে প্রথম শ্রেণীর বর্ণনা ছিল। আর অন্য আয়াতে দ্বিতীয় শ্রেণীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তাই এ আয়াতে কুরআনের প্রতি ঈমান আনার সাথে সাথে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে বিশ্বাস করার কথাও বলা হয়েছে। ‘হাদীসের বর্ণনানুযায়ী এ দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা যাঁরা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কোন না কোন আসমানী কিতাবের অনুসারী ছিলেন, তাঁরা দ্বিগুণ পুণ্যের অধিকারী ছিলেন। প্রথমত: কুরআনের প্রতি ঈমান এবং ‘আমলের জন্য, দ্বিতীয়ত: পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনার জন্য। তবে পার্থক্য এই যে, সেগুলো সম্পর্কে বিশ্বাসের বিষয় হবে এই যে, কুরআনের পূর্বে আল্লাহ্ তা‘আলা যেসব কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যেগুলো সত্য ও হক্ব এবং সেযুগে এর উপর ‘‘আমল করা ওয়াজিব ছিল। আর এ যুগে কুরআন অবতীর্ণ হবার পর যেহেতু অন্যান্য আসমানী কিতাবের হুকুম-আ’হকাম এবং পূর্ববর্তী শরী’আতসমূহ মনসূখ তথা রহিত হয়ে গেছে, তাই এখন ‘‘আমল একমাত্র কুরআনের আদেশানুযায়ীই করতে হবে।

     খ্বত্‌মে নবুওয়াত সম্পর্কিত একটি দলীলঃ এ আয়াতের বর্ণনা রীতিতে একটা মৌলিক বিষয়ের মীমাংসাও প্রসঙ্গক্রমে বলে দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-ই শেষ নবী এবং তাঁর নিকট প্রেরিত ও‘হী-ই শেষ ও‘হী। কেননা, কুরআনের পরে যদি আরো কোন আসমানী কিতাব অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো, তবে পূর্ববর্তী কিতাবগওলোর প্রতি যেভাবে ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে, পরবর্তী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনার কথাও একইভাবে বলা হতো; রবং এর প্রয়োজনই ছিল বেশী। কেননা, তাওরাত ও ইনজীলসহ বিভিন্ন আসামানী কিতাবের প্রতি ঈমান তো পূর্ব থেকেই বর্তমান ছিল এবং এগুলো সম্পর্কে কম-বেশী সবাই অবগতও ছিল। তাই রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পরেও যদি ও‘হী ও নবুওয়াতের ধারাবহিকতা অব্যাহত রাখা আল্লাহ্‌র অভীপ্রায় হতো,তবে

     অবশ্যই পূর্ববর্তী কিতাবসমূহ এবং নবী-রসূলগণের প্রতি ঈমান আনার বিষয়টির মত পরবর্তী কিতাব ও নবী-রসূলের প্রতি ঈমান আনার বিষয়টিরও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন হতো, যাতে পরবর্তী লোকেরা এ সম্পর্কে বিভ্রান্তির কবল থেকে নিরাপদ থাকতে পারে।

     কিন্তু কুরআনের যেসব জায়গায় ঈমানের উল্লেখ রয়েছে, সেখানেই পূর্ববর্তী নবিগণের এবং তাঁদের প্রতি প্রেরিত কিতাবসমূহেরও উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কোথাও পরবর্তী কোন কিতাবের উল্লেখ নেই। কুরআন কারীমে এ বিষয়ে অন্যান্য পঞ্চাশটি স্থানে উল্লেখ রয়েছে। সর্বত্রই রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পূর্ববর্তী নবী ও ও‘হীর কথা বলা হলেও কোন একটি আয়াতেও পরবর্তী কোন ও‘হীর উল্লেখ তো দূরের কথা কোন ইশারা-ইঙ্গিতও দেখা যায় না।

     আখিরাতের প্রতি ঈমান: এ আয়াতে মুত্তাক্বিগণের দ্বিতীয় গুণ বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তারা আখিরাতে বিশ্বাস রাখে। এখানে আখিরাত বলতে পরকালের সে আবাসস্থলের কথা বোঝানো হয়েছে, যাকে কুরআন পাকে ‘দারুল-ক্বরার’, ‘দারুল-‘হায়াওয়ান’ এবং ‘‘উক্ববা’ নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। সমগ্র কুরআন তার আলোচনা ও তার ভায়াবহতার বর্ণনায় পরিপূর্ণ।

     আখিরাতের প্রতি ঈমান একটি বৈপ্লবিক বিশ্বাস: আখিরাতের প্রতি ঈমান প্রসঙ্গটি ঈমান বিল-গ্বইব-এর আলোচনায় কিছুটা বর্ণিত হয়েছে। পূণরায় এ সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভুত হচ্ছে এ জন্য যে, যেসব বিষয়ের প্রতি ঈমান আনা অপরিহার্য সেগুলোর মধ্যে এ বিষয়টি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া ঈমান অনুযায়ী ‘‘আমল করার প্রকৃত প্রেরণা ও এখান থেকেই সৃষ্টি হয়।

     ইসলামী ‘আক্বায়েদগুলোর মধ্যে আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা একটা বৈপ্লবিক বিশ্বাস, যা দুনিয়ার রূপই পাল্টে দিয়েছে। এ বিশ্বাসে, উদ্বুদ্ধ হয়েই ও‘হীর অনুরাগিগণ প্রথমে নৈতিকতা ও কর্মে এবং পরবর্তীতে ব্যক্তিগত, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পর্যন্ত দুনিয়ার অন্যান্য সকল জাতির মোকাবেলায় একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আসনে উত্তীর্ণ হতে সমর্থ হয়েছে। পরন্তু তাউ’হীদ ও রিসালাতের ন্যায় এ ‘আক্বীদাও সমস্ত নবী-রসূলের শিক্ষা ও সর্বপ্রকার ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেই সর্বসম্মত বিশ্বাসরূপে চলে আসছে। যেসব লোক জীবন ও এর ভোগ-বিলাসকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে গণ্য করে, জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যে তিক্ত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, সে তিক্ততাকেই সর্বাপেক্ষা কষ্ট বলে মনে করে, আখিরাতের জীবন, সেখানকার হিসাব-নিকাশ, শাস্তি ও পুরস্কার প্রভৃতি সম্পর্কে যাদের এতটুকুও আস্থা নেই, তারা যখন সত্য-মিথ্যা কিংবা ‘‘হালাল-’হারামের মধ্যে পার্থক্য করাকে তাদের জীবনের সহজ-স্বাচ্ছন্দ্যের পথে বাধা রূপে দেখতে পায়, তখন সামান্য একটু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে সকল মূল্যবোধকে বিসর্জন দিতে এতটুকুও কুন্ঠাবোধ করে না, এমতাবস্থায় এ সমস্ত লোককে যে কোন দুস্কর্ম থেকে বিরত রাখার মত আর কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। যা কিছু অন্যায়, অসুন্দর বা সামাজিক জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলার পক্ষে ক্ষতিকর, সেসব অনাচার কার্যকরভাবে উৎখাত করার কোন শক্তি সে আইনেরও নেই, এ কথা পরীক্ষিত সত্য। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কোন দুরাচারের চরিত্রশুদ্ধি ঘটানোও সম্ভব হয় না। অপরাধ যাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, আইনের শাস্তি সাধারণতঃ তাদের ধাত-সওয়া হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত আর তাদের মধ্যে শাস্তিকে যারা ভয় করে, তাদের সে ভয়ের আওতাও শুধুমাত্র ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে, যতটুকুতে ধরা পড়ার ভয় বিদ্যমান। কিন্তু গোপনে লোকচক্ষুর অন্তরালে যেখানে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে না, সেরূপ পরিবেশে এ সমস্ত লোকের পক্ষ্যেও  যে কোন গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়ার পথে কোন বাধাই থাকে না।

     প্রকারান্তরে আখিরাতের প্রতি ঈমানই এমন এক কার্যকর নিয়ন্ত্রণবিধি, যা মানুষকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্বত্রই যে কোন গর্হিত আচরণ থেকে অম্লান শিখা অবিরাম সমুজ্ঝ্বল করে দেয় যে, আমি প্রকাশ্যেই থাকি আর গভীর নির্জনেই থাকি, রাজপথে থাকি কিংবা কোন বদ্ধঘরে লুকিয়েই থাকি, মুখে বা ভাব-ভঙ্গিতে প্রকাশ করি আর নাই করি, আমার সকল আচরণ, আমার সকল অভিব্যক্তি, এমনকি অন্তরে লুকায়িত প্রতিটি আকাঙ্খা পর্যন্ত সর্বত্র বিরাজমান এক মহাসত্তার সামনে রয়েছে। তাঁর সদাজাগ্রত দৃষ্টির সামনে কোন কিছুই আড়াল করার সাধ্য আমার নেই। আমার সত্তার সঙ্গে মিশে রয়েছে এমনসব প্রহরী, যারা আমার প্রতিটি আচরণ এবং অভীব্যক্তি প্রতিমুহুর্তেই লিপিদ্ধ করছেন।

     উপরোক্ত বিশ্বাসের মাধ্যমেই প্রাথমিক যুগে এমন মহোত্তম চরিত্রের অগণিত লোক সৃষ্টি হয়েছিলেন, যাদের চাল-চলন এবং আচার-আচরণ দেখেই মানুষ ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়তো।

     এখন লক্ষণীয় আর একটি বিষয় হচ্ছে, আয়াতের শেষে يُؤۡمِنُون শব্দ ব্যবহার না করে يُوقِنُون ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা, বিশ্বাসের বিপরীতে অবিশ্বাস এবং ইয়াক্বীনের বিপরীতে সন্দেহ-সংশয়। এ শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হলেই শুধু উদ্দেশ্য সফল হয় না, বরং এমন দৃঢ় প্রত্যয় রাখতে হবে, যে প্রত্যয় স্বচক্ষে দেখা কোন বস্তু সম্পর্কেই হতে পারে।

     মুত্তাক্বীদের এই গুণ পরকালে আল্লাহ্ তা‘আলার সম্মুখে উপস্থিতি এবং হিসাব-নিকাশ, প্রতিদান এবং সবকিছুরই একটি পরিপূর্ণ নকশা তার সামনে দৃশ্যমান করে রাখবে। যে ব্যক্তি অন্যের হক বা অধিকার নষ্ট করার জন্য মিথ্যা মামলা করে বা মিথ্যা সাক্ষী দেয়, আল্লাহ্‌র আদেশের বিপরীত পথে ‘‘হারাম ধন-সম্পদ উপার্জন করে এবং দুনিয়ার হীন উদ্দেশ্য সফল করার জন্য শরী’আত বিরোধী কাজ করে, সে ব্যক্তি পরকালে বিশ্বাসী হয়ে, প্রকাশ্যে ঈমানের কথা যদি স্বীকার করে এবং শরী’আতের বিচারে তাকে মু’মিনও বলা হয়, কিন্তু কুরআন যে ইয়াক্বীনের কথা ঘোষণা করেছে, এমন লোকের মধ্যে সে ইয়াক্বীন থাকতে পারে না। আর সে কুরআনী ইয়াক্বীনই মানবজীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিতে পারে। আর এর পরিণামেই মুত্তাক্বীগণকে হিদায়াত বলা হয়েছে যে, তারাই সরল-সঠিক পথের পথিক, যা তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে দান করা হয়েছে আর তারাই সম্পূর্ণ সফলকাম হয়েছে।

     সূরা বাক্বরার প্রথম পাঁচটি আয়াতে কুরআনকে হিদায়াত বা পথপ্রদর্শনের গ্রন্থরূপে ঘোষণা করে সকল সন্দেহ ও সংশয়ের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়ার পর সে সমস্ত ভাগ্যবান ব্যক্তিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁরা এ গ্রন্থের হিদায়াতে পরিপূর্ণভাবে উপকৃত ও লাভবান হয়েছেন এবং যাঁদেরকে কুরআনের পরিভাষায় মু’মিন ও মুত্তাক্বী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তাঁদের বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী এবং পরিচয়ও বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তী পনেরটি আয়াতে সে সমস্ত লোকের বিষয় আলোচিত হয়েছে, যারা এ হিদায়াতকে অগ্রাহ্য ও অস্বীকার করে বিরুদ্ধাচরণ করেছে।

     এরা দু’টি দলে বিভক্ত। একদল প্রকাশ্যে কুরআনকে অস্বীকার করে বিরুদ্ধাচরণের পথ অবলম্বন করেছে। কুরআন তাদেরকে কাফির বলে আখ্যায়িত করেছে। অপর দল হচ্ছে, যারা হীন পার্থিব উদ্দেশ্যে অন্তরের ভাব ও বিশ্বাসের কথাটি খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করতে সাহস পায়নি, বরং প্রতারণার পথ অবলম্বন করেছে; মুসলমানদের নিকট বলে, আমরা মুসলামন; কুরআনের হিদায়াত মানি এবং আমরা তোমাদের সাথেই আছি। অথচ তাদের অন্তরে লুকায়িত থাকে কুফ্‌র্ ও অস্বীকৃতি। আবার কাফিরদের নিকট গিয়ে বলে, আমরা তোমাদের ধলভুক্ত, তোমাদের সাথেই রয়েছি। মুসলামনদিগকে ধোঁকা দেয়ার জন্য এবং তাদের গোপণ কথা জানার জন্যই তাদের সাথে মেলামেশা করি। কুরআন তাদেরকে ‘মুনাফিক্ব’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এ পনেরটি আয়াত যারা কুরআন অমান্য করে তাদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তন্মধ্যে ৬ ও ৭ আয়াতে প্রকাশ্যে যারা অস্বীকার করে তাদের কথা ও স্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে। আর পরবর্তী তেরটি আয়াতেই মুনাফিক্বদের সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। এতে তাদের স্বরূপ, নিদর্শন, অবস্থাও পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে।

     এ আয়াতগুলোর বিস্তারিত আলোচনায় মনোনিবেশ করলে বোঝা যায় যে, কুরআন সূরা বাক্বরার প্রথম বিশটি আয়াতে একদিকে হিদায়াতের উৎসের সন্ধান দিয়ে বলেছে যে, এ উৎস হচ্ছে আল্লাহ্‌র কিতাব এই কুরআন; অপরদিকে বিশ্ববাসীকে এ হিদায়াত গ্রহণ করা ও না করার নিরিখে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে। যারা গ্রহণ করেছে, তাদেরকে মু’মিন-মুত্তাক্বী বলেছে, আর যারা অগ্রাহ্য করেছে তাদেরকে কাফির ও মুনাফিক্ব বলে আখ্যা দিয়েছে।

     কুরআনের এ শিক্ষা থেকে একটি মৌলিক জ্ঞাতব্য বিষয় এও প্রমাণিত হয় যে, বিশ্ববাসীকে এমনভাবে দু’টি ভাগ করা যায়, যা হবে আদর্শভিত্তিক। বংশ,গোত্র,,দেশ,ভাষা ও বর্ণ এবং ভৌগোলিক বিভক্তি এমন কোন ভেদরেখা নয়, যার ভিত্ত্বিতে মানবজাতিকে বিভক্ত করা যেতে পারে।

     আলোচ্য ৬ ও ৭ আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা সেসমস্ত কাফির সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, যারা তাদের কুফরীর দরুন বিরুদ্ধাচরণ ও শত্রুতার পথ বেছে নিয়েছে। আর যারা এ বিরুদ্ধাচরণের বশীভূত তারা কোন সত্য কথা শুনতে এবং কোন সুস্পষ্ট দলীল-প্রামাণের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে প্রস্তুত ছিল না। এ সমস্ত লোকের জন্য আল্লাহ্‌র বিধান হচ্ছে যে, তাদেরকে দুনিয়াতেই একটি নগদ শাস্তিস্বরূপ তাদের অন্তঃকরণে সীল-মোহর এঁটে দেয়া হয়েছে। তাদের চোখ-কান থেকে হক্ব বা সত্য গ্রহণের যোগ্যতা রহিত করে দেয়া হয়েছে। তাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে, সত্যকে উপলব্ধি করার মত বুদ্ধি, দেখবার মত দৃষ্টিশক্তি এবং শোনার মত শ্রবণশক্তি আর তাদের অবশিষ্ট নেই। আয়াতে এ সমস্ত লোকের জন্য কঠোর শাস্তির বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

     কাফিরের সংজ্ঞা: كُفْر এর শাব্দিক অর্থ গোপন করা। না-শুকরী বা অকৃতজ্ঞতাকেও কুফর বলা হয়। কেননা, এতে ই’হছানকারীর ই’হছান (উপকারকারীর উপকারকে) গোপন করা হয়। শরী’আতের পরিভাষায় কুফর বলতে বোঝায় যে, সমস্ত বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করা ফার্‌দ্ব/ফরয, এর যে কোনটিকে অস্বীকার করা।

     যথা-ঈমানের সারকথা হচ্ছে যে, রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক প্রাপ্ত ও‘হীর মাধমে উম্মতকে যে শিক্ষাদান করেছেন এবং যেগুলো অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে সেগুলোকে আন্তরিকভাবে স্বীকার করা এবং সত্য বলে জানা। কোন ব্যক্তি যদি এ শিক্ষামালার কোন একটিকে ‘হক্ব বলে না মানে, তাহলে তাকে কাফির বলা যেতে পারে।

     ‘ইনযার’ শব্দের অর্থ: ‘ইনযার’ শব্দের অর্থ হচ্ছে এমন সংবাদ দেয়া যাতে ভয়ের সঞ্চার হয়। আর ابْشَار এমন সংবাদকে বলা হয়, যা শুনে আনন্দ লাভ হয়। সাধারণ অর্থে ইনযার বলতে ভয় প্রদর্শন করা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শুধু ভয় প্রদর্শনকে ‘ইনযার’ বলা হয় না, বরং শব্দটি দ্বারা এমন ভয় প্রদর্শন বোঝায়, যা দয়ার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। যেভাবে মা সন্তানকে আগুন,সাপ,বিচ্ছু এবং হিংস্র জীবজন্তু হতে ভয় দেখিয়ে থাকেন! ‘নাযীর’ বা ভয়-প্রদর্শনকারী ঐ সমস্ত ব্যক্তি যাঁরা অনুগ্রহ করে মানবজাতিকে যথার্থ ভয়ের খবর জানিয়ে দিয়েছেন। এজন্যই নবী-রসূলগণকে বিশেষভাবে নাযীর বলা হয়। কেননা, তাঁরা দয়া ও সতর্কতার ভিত্তিতে অবিশ্যম্ভাবী বিপদ হতে ভয় প্রদর্শন করার জন্যই প্রেরিত হয়েছেন। নবীগণের জন্য ‘নাযীর’ শব্দ ব্যবহার করে একদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যাঁরা তাবলীগের দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের কর্তব্য হচ্ছে- সাধারণ মানুষের প্রতি যথার্থ মমতা ও সমবেদনা সহকারে কথা বলা।

     এ আয়াতে রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে যে, এ সমস্ত জেদী-অহংকারী লোক, যারা সত্যকে জেনে-শুনেও কুফরী ও অস্বীকৃতির উপর দৃঢ় অনড় হয়ে আছে, অথবা অহংকারের বশবর্তী হয়ে কোন সত্য কথা শুনতে কিংবা সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ দেখতেও প্রস্তুত নয়, তাদের পথে এনে ঈমানের আলোকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে বিরামহীন চেষ্টা করছেন তা ফলপ্রসূ হওয়ার নয়। এদের ব্যাপারে চেষ্টা করা না করা একই কথা।

     পাপের শাস্তি পার্থিব সামর্থ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া: এ দু’টি আয়াতের দ্বারা বোঝা গেল, কুফর ও অন্যান্য সব পাপের আসল শাস্তি তো পরকালে হবেই; তবে কোন কোন পাপের আংশিক শাস্তি দুনিয়াতেও হয়ে থাকে দুনিয়ার এ শাস্তি ক্ষেত্রবিশেষে নিজের অবস্থা সংশোধন করার সামর্থ্যকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। শুভবুদ্ধি লোপ পায়।

     মানুষ আখিরাতের হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে গাফেল বা অলশ হয়ে গোমরাহীর (পথভ্রষ্টতা) পথে এমন দ্রুততার সাথে এগুতে থাকে; যাতে অন্যায়ের অনুভুতি পর্যন্ত তাদের অন্তর থেকে দূরে চলে যায়। এ সম্পর্কে কোন কোন বুযুর্গ মন্তব্য করেছেন যে, পাপের শাস্তি এরূপও হয়ে থাকে যে, একটি পাপ অপর একটি পাপকে আকর্ষণ করে, অনুরূপভাবে একটি নেকীর (ভালকাজ) বদলায় অপর একটি নেকী আকৃষ্ট হয়।

     ‘হাদীসে আছে, মানুষ যখন কোন একটি গোনাহ্‌র কাজ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। সাদা কাপড়ে হঠাৎ কালো দাগ লাগার পর যেমন তা খারাপ লাগে, তেমনি প্রথমাবস্থায় অন্তরে পাপের দাগও অস্বস্তির সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় যদি সে ব্যক্তি তাওবা না করে, আরো পাপ করতে থাকে, তবে পর পর দাগ পড়তে পড়তে অন্তঃকরণ দাগে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তার অন্তর থেকে ভাল-মন্দের পার্থক্য সম্পর্কিত অনুভুতি পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে যায়।

     উপদেশ দান করা সর্বাবস্থায় উপকারী: এ আয়াতে সনাতন কাফিরদের প্রতি রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নাস্বী’হাহ/নসীহত বা উপদেশ করা না করা সমান বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ সাথে عَلَيۡهِمۡ এর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ সমতা কাফিরদের জন্য, রসূলের জন্য নয়। তবে তাদেরকে জানানোর এবং সংশোধণ করার চেষ্টা করার ছাওয়াব অবশ্যই পাওয়া যাবে। তাই সমগ্র কুরআনে কোন আয়াতেই এসব লোককে ঈমান ও ইসলামের দিকে দা’ওয়াত দেয়া নিষেধ করা হয়নি। এতে বোঝা যাচ্ছে, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইসলামের দা’ওয়াত দেয়ার কাজে নিয়োজিত, তা ফলপ্রসু হোক বা না হোক, সে এ কাজের ছাওয়াব পাবেই।

     একটি সন্দেহের নিরসন: এ আয়াতের বিষয়বস্তুর অনুরূপ ভাষা সূরায়ে মুত্বফ্‌ফিফীনের এক আয়াতেও উল্লেখিত হয়েছে যথা:

كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُبِهِمْ مَاكَانُوْا يَكْسِبُوْنَ

অর্থাৎ, এমন নয়; বরং তাদের অন্তরে তাদের কর্মের মরিচা গাঢ় হয়ে গেছে। তাতে বোঝানো হয়েছে যে, তাদের মন্দ কাজ ও অহংকারই তাদের অন্তরে মরিচার আকার ধারণ করেছে। এ মরিচাকে আলোচ্য আয়াতে ‘সীলমোহার’ বা আবরণ শব্দের দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এরূপ সংশয় সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, যখন আল্লাহ্‌ তাদের অন্তরে সীলমোহার এঁটে দিয়েছেন এবং গ্রহণ-ক্ষমতাকে রহিত করেছেন, তখন তারা কুফরী করতে বাধ্য। কাজেই তাদের শাস্তি হবে কেন? এর উত্তর হচ্ছে যে, তারা নিজেরাই অহংকার ও বিরুদ্ধাচরণ করে নিজেদেরে যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে, তাই এজন্য তারাই দায়ী। যেহেতু বান্দাদের সকল কাজের সৃষ্টি আল্লাহ্‌ই করেছেন, তিনি এ স্থলে সীলমোহরের কথা বলে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা নিজেরাই যখন সত্য গ্রহণের ক্ষমতাকে রহিত করতে উদ্যত হয়েছে, তখন আমি আমার কর্ম-পদ্ধতী অনুযায়ী তাদের এ খারাপ যোগ্যতার পরিবেশ তাদের অন্তরে সৃষ্টি করে দিয়েছি।

     উপরোক্ত আয়াতের মধ্যে দু’টি আয়াতে মুনাফিক্বদের সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে যে, কিছু সংখ্যক লোক আছে, যারা বলে যে, আমরা ঈমান এনেছি, অথচ তারা আদৌ ঈমানদার নয়, বরং তারা আল্লাহ্‌ তা‘আলা ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরদেরকে ব্যতীত অন্য কাউকেই প্রতারিত করছে না।

     এতে তাদের ঈমানের দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাদের এ দাবীও মুলতঃ প্রতারণামূলক। এটা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহ্‌কে কেউ ধোকা দিতে পারে না এবং তারাও একথা হয়তো ভাবে না যে, তারা আল্লাহ্‌কে ধোকা দিতে পারবে, বরং রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং মুসলমানদের সাথে ধোকাবাজি করার দরুনই বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ্‌র সাথে ধোকাবাজি করছে। [কুরতুবী]

     এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক প্রকৃত প্রস্তাবে আত্ম-প্রবঞ্চনায় লিপ্ত। কেননা, আল্লাহ্‌ তা‘আলা সমস্ত ধোকা ও প্রতারণার উর্ধ্বে। অনুরূপ তাঁর রসূল এবং মু’মিনগণও ও‘হীর দৌলতে বা কারণে ছিলেন সমস্ত ধোকা-প্রতারণা থেকে নিরাপদ। কারো পক্ষে তাঁদের কোন ক্ষতি করা ছিল অস্বাভাবিক। পরন্তু তাদের এ ধোকার ক্ষতিকর পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতের উভয় ক্ষেত্রে তাদেরই উপর পতিত হতো। তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, তাদের অন্তর রোগাক্রান্ত বা অসুস্থ। তাই আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাদের এ রোগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।

     রোগ সে অবস্থাকেই বলা হয়, যে অবস্থায় মানুষ স্বাভাবিক অবস্থার বাইরে চলে যায় এবং তাদের কাজ-কর্মে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। যার শেষ পরিণাম ধ্বংস ও মৃত্যু। হযরত জুনাইদ বাগ্বদাদী (র‘হঃ) বলেন, যেভাবে অসতর্কতার দরুন মানুষের শরীরে রোগের সৃষ্টি হয়, তেমনিভাবে প্রবৃত্তির প্ররোচনার অনুকরণের দ্বারা মানুষের অন্তরেও রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

     এ আয়াতে তাদের অন্তর্নিহিত কুফরকে রোগ বলা হয়েছে যা আত্মিক ও দৈহিক উভয় বিবেচনায়েই বড় রোগ। রূ’হানী (অন্তরের) ব্যধি তো প্রকাশ্য; কেননা, প্রথমত: এ থেকে স্বীয় পালনকর্তার না-শুকরি ও অবাধ্যতা সৃষ্টি হয়। যাকে কুফর বলা হয়, তা মানবাত্মার জন্য সর্বাপেক্ষা কঠিন ব্যধি। এতদসঙ্গে মানবসভ্যতার জন্যও অত্যন্ত ঘৃণা দোষ। দ্বিতীয়ত: দুনিয়ার হীন উদ্দেশ্য হাসিল বা অর্জনের জন্য সত্যকে গোপন করা এবং স্বীয় অন্তরের কথাকে প্রকাশ করার হিম্মত বা সাহস না করা এ ব্যাপারটিও অন্তরের বড় রোগ। মুনাফিক্বদের দৈহিক রোগ এজন্য যে, তারা সর্বদাই এ ভয়ের মধ্যে থাকে যে, না জানি কখন কোথায় তাদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ে। দিবারাত্র এ চিন্তায় ব্যস্ত থাকাও একটি মানসিক তথা শারিরীক ব্যধিই বটে। তাছাড়া এর পরিণাম অনিবার্যভাবেই ঝগড়া ও শত্রুতা। কেননা, মুসলামানদের উন্নতি ও অগ্রগতি দেখে তারা সব সময়ই হিংসার আগুনে দগ্ধ হতে থাকে, কিন্তু সে হতভাগা নিজের অন্তরের কথাটুকুও প্রকাশ করতে পারে না। ফলে সে শারিরীক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকে।

‘আল্লাহ্‌ তাদের রোগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।’ এর অর্থ এই যে, তারা ইসলামও মুসলমানদের উন্নতি দেখে জ্বলে-পুড়ে দিন দিন ছাই হতে থাকে। আল্লাহ্‌ তো দিন দিন তার দ্বীনের উন্নতি দিয়েই যাচ্ছেন।

     ১১ ও ১২ নং আয়াতে মুনাফিক্বদের সে ভুলের আলোচনা করা হয়েছে যে, তারা ফিৎনা-ফাসাদকে মীমাংসা এবং নিজেদেরকে মীমাংসাকারী মনে করে। কুরআন পরিস্কাভাবে বলে দিয়েছে যে, ফাসাদ ও মীমাংসা মৌখিক দাবীর উপর নির্ভরশীল নয়। অন্যথায় কোন চোর বা ডাকাতও নিজেকে ফাসাদ সৃষ্টিকারী বলতে রাজী নয়। এ ব্যাপারটি একান্তভাবে ব্যক্তি বা ব্যাক্তি-সমষ্টির আচরণের উপর নির্ভরশীল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আচরণ যদি ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টির কারণ হয়, তবে এসব কাজ যারা করে তাদেরকে ফাসাদ সৃষ্টিকারী মুফ্‌সিদই বলতে হবে। চাই একাজে ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা তার উদ্দেশ্য হোক বা না-ই হোক।

     ১৩ নং আয়াতে মুনাফিক্বদের সামনে সত্যিকার ঈমানের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে اٰمِنُوْا كَمَا اٰمَنَ النَّاسُ অর্থাৎ, অন্যান্য লোক যেভাবে ঈমান এনেছে, তোমরাও অনুরূপভাবে ঈমান আন। এখানে ‘নাস’ শব্দের দ্বারা সাহাবীগণকে বোঝানো হয়েছে। কেননা কুরআন অবতরণের যুগে তাঁরাই ঈমান এনেছিলেন। আর আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে সা’হাবীগণের ঈমানের অনুরূপ ঈমানই গ্রহণযোগ্য। যে বিষয়ে তাঁরা যেভাবে ঈমান এনেছিলেন অনুরূপ ঈমান যদি অন্যরা আনে তবেই তাকে ঈমান বলা হয়; অন্যথায় তাকে ঈমান বলা চলে না। এতে বোঝা গেল যে, সা’হাবীগণের ঈমানই ঈমানের কষ্টি পাথর। যার নিরিখে অবশিষ্ট সকল উম্মতের ঈমান পরীক্ষা করা হয়। এ কষ্টিপাথরের পরীক্ষায় যে ঈমান সঠিক প্রমাণিত না হয়, তাকে ঈমান বলা যায় না এবং অনুরূপ ঈমানদারকে মু’মিন বলা চলে না। এর বিপরীতে যত ভাল কাজই হোক না কেন, আর তা যত ভাল নিয়্যতেই করা হোক না কেন, আল্লাহ্‌র নিকট তা ঈমানরূপে স্বীকৃতি পায় না। সে যুগের মুনাফ্বিরা সা’হাবীগণকে বোকা বলে আখ্যায়িত করেছে। বস্তুতঃ এ ধরনের গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা সর্বযুগেই চলে আসছে। যারা ভ্রষ্টকে পথ দেখায়, তাদের ভাগ্যে সাধারণতঃ বোকা,অশিক্ষিত,মূর্খ প্রভৃতি আখ্যাই জুটে থাকে। কিন্তু কুরআন পরিস্কার ভাষায় ঘোষণা করেছ যে, এসব লোক নিজেরাই বোকা। কেননা, এমন উজ্জ্বল ও প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী থাকা সত্ত্বেও তাতে বিশ্বাস স্থাপন করার মত জ্ঞান-বুদ্ধি তাদের হয়নি।

     ১৪ নং আয়াতে মুনাফিক্বদের কপটতা ও দ্বিমুখী নীতির বর্ণানা দেয়া হয়েছে যে, তারা যখন মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে আমরা মুসলমান হয়েছি; ঈমান এনেছি। আর যখন তাদের দলের কাফিরদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথেই রয়েছি, মুসলামানদের সাথে উপহাস করার উদ্দেশ্যে এবং তাদের বোকা বানাবার জন্য মিশেছি।

     ১৫ নং আয়াতে তাদের এ বোকামীর উত্তর দেয়া হয়েছে। তারা মনে করে, আমরা মুসলমানদিগকে বোকা বানাচ্ছি। অথচ বাস্তবে তারা নিজেরাই বোকা সাজছে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে একটু ঢিল দিয়ে উপহাসের পাত্র করেছেন। প্রকাশ্যে তাদের কোন শাস্তি না হওয়াতে তারা আরো গাফলতীতে পতিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের উপহাস ও ঠাট্টার প্রত্যুত্তরে তাদের প্রতি এরূপ আচরণ করেছেন বলেই একে উপহাস বা বিদ্রূপ বলা হয়েছে।

أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشۡتَرَوُاْ ٱلضَّلَٰلَةَ بِٱلۡهُدَىٰ فَمَا رَبِحَت تِّجَٰرَتُهُمۡ وَمَا كَانُواْ مُهۡتَدِينَ ١٦

১৬.তারা সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করে। বস্তুতঃ তারা তাদের এ ব্যবসায় লাভবান হতে পারেনি এবং তারা হিদায়াতও লাভ করতে পারেনি।

مَثَلُهُمۡ كَمَثَلِ ٱلَّذِي ٱسۡتَوۡقَدَ نَارٗا فَلَمَّآ أَضَآءَتۡ مَا حَوۡلَهُۥ ذَهَبَ ٱللَّهُ بِنُورِهِمۡ وَتَرَكَهُمۡ فِي ظُلُمَٰتٖ لَّا يُبۡصِرُونَ ١٧

১৭.তাদের অবস্থা সে ব্যক্তির মত, যে লোক কোথাও আগুন জ্বালালো এবং তার চারদিককার সবকিছুকে যখন আগুন স্পষ্ট করে তুললো, ঠিক এমনি সময় আল্লাহ্‌ তার চারদিকের আলোকে উঠিয়ে নিলেন এবং তাদেরকে অন্ধকারে ছেড়ে দিলেন। ফলে, তারা কিছুই দেখতে পায় না।

صُمُّۢ بُكۡمٌ عُمۡيٞ فَهُمۡ لَا يَرۡجِعُونَ ١٨

১৮.তারা বধির, মূক ও অন্ধ। সুতরাং তারা ফিরে আসবে না।

أَوۡ كَصَيِّبٖ مِّنَ ٱلسَّمَآءِ فِيهِ ظُلُمَٰتٞ وَرَعۡدٞ وَبَرۡقٞ يَجۡعَلُونَ أَصَٰبِعَهُمۡ فِيٓ ءَاذَانِهِم مِّنَ ٱلصَّوَٰعِقِ حَذَرَ ٱلۡمَوۡتِۚ وَٱللَّهُ مُحِيطُۢ بِٱلۡكَٰفِرِينَ ١٩

১৯.আর তাদের উদাহরণ সেসব লোকের মত যারা দুর্যোগপূর্ণ ঝড়ো রাতে পথ চলে, যাতে থাকে আঁধার, গর্জন ও বিদ্যুৎচমক। মৃত্যুর ভয়ে গর্জনের সময় কানে আঙ্গুল দিয়ে রক্ষা পেতে চায়। অথচ সমস্ত কাফেরই আল্লাহ্‌ কর্তৃক পরিবেষ্ঠিত।

يَكَادُ ٱلۡبَرۡقُ يَخۡطَفُ أَبۡصَٰرَهُمۡۖ كُلَّمَآ أَضَآءَ لَهُم مَّشَوۡاْ فِيهِ وَإِذَآ أَظۡلَمَ عَلَيۡهِمۡ قَامُواْۚ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ لَذَهَبَ بِسَمۡعِهِمۡ وَأَبۡصَٰرِهِمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٠

২০.বিদ্যুতালোকে যখন সামান্য আলোকিত হয়, তখন কিছুটা পথ চলে। আবার যখন অন্ধকার হয়ে যায়, তখন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। যদি আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করেন, তাহলে তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি ছিনিয়ে নিতে পারেন। আল্লাহ্‌ যাবতীয় বিষয়ের উপর সর্বময় ক্ষমতাশীল।

يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١

২১. হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ‘ইবাদত কর, যিনি তোমাদিগকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদিগকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে।

ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فِرَٰشٗا وَٱلسَّمَآءَ بِنَآءٗ وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجَ بِهِۦ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ رِزۡقٗا لَّكُمۡۖ فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢

২২. যে পবিত্রসত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব, আল্লাহ্‌র সাথে তোমরা অন্য কাকেও সমকক্ষ করো না। বস্তুত: এসব তোমরা জান।

وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا فَأۡتُواْ بِسُورَةٖ مِّن مِّثۡلِهِۦ وَٱدۡعُواْ شُهَدَآءَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٢٣

২৩. এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মত একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এস। তোমাদের সেসব সাহায্যকারীদেরকে সঙ্গে নাও-এক আল্লাহ্‌কে ছাড়া, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো।

আনুসঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

১৬ নং আয়াতে মুনাফিকদের সে অবস্থার বর্ণনা রয়েছে যে, তারা ইসলামকে কাছে থেকে দেখেছে এবং তার স্বাদও পেয়েছে, আর কুফরীতে তো পূর্ব থেকেই লিপ্ত ছিল। অতঃপর ইসলাম ও কুফর উভয়কে দেখে-বুঝেও তাদের দুনিয়ার ঘৃণ্য উদ্দেশ্য হাসিল বা অর্জনের জন্য ইসলামের পরিবর্তে কুফরকে গ্রহণ করেছে। তাদের এ কাজকে ব্যবসায়ের সাথে তুলনা করে জানানো হয়েছে যে, তাদের ব্যবসায়ের কোন যোগ্যতাই নেই। তারা উত্তম ও মূল্যবান বস্তু ঈমানের পরিবর্তে নিকৃষ্ট ও মূল্যহীন বস্তু কুফর খরিদ করেছে বা কিনে নিয়েছে।

     ১৭-২০ এই চার আয়াতে দু’টি উদাহরণ দিয়ে মুনাফিকদের কার্যকলাপকে ঘৃণ্য আচরণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে মুনাফিকদের দু’শ্রেণীর লোকের পরিপ্রেক্ষিতেই এখানে পৃথক দু’টি উদাহরণ পেশ বা উপস্থাপন করা হয়েছে।

     মুনাফিকদের একশ্রেণীর লোক হচ্ছে তারা, যারা কুফরীতে সম্পূর্ণরূপে নিমগ্ন থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের কাছে থেকে আর্থিক স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে মুখে ঈমানের কথা প্রকাশ করতো। দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক হচ্ছে তারা, যারা ইসলামের সত্যতায় প্রভাবিত হয়ে কখনো প্রকৃত মু’মিন হতে ইচ্ছে করতো, কিন্তু দুনিয়ার উদ্দেশ্যে তাদরেকে এ ইচ্ছা থেকে বিরত রাখতো। এভাবে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দিনাতিপাত করতো।

আলোচ্য আয়াতগুলোর মধ্যে তাদেরকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ্‌র নাগালের ঊর্ধ্বে নয়। সব সময়, সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের ধ্বংসও করতে পারেন। এমনকি তাদের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তিকে পর্যন্ত রহিত করে দিতে পারেন। এই তেরটি আয়াতে মুনাফিকদের অবস্থার পূর্ণ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে অনেক আহকাম ও মাসআলা এবং গুরুত্বপূর্ণ হিদায়াত বা উপদেশ রয়েছে। যথা-

     কূফর ও নিফাক্ব সেযুগেই ছিল, না এখনও আছে: আলোচ্য আয়াতগুলোতে আমরা জানতে পারি যে, মুনাফিকদের কপটতা নির্ধারণ করা এবং তাদেরকে মুনাফিক বলে চিহ্নিত করার দু’টি পদ্ধতি রয়েছে।

     প্রথমত: আল্লাহ্ তা‘আলা ও‘হীর মাধ্যমে তাঁর রসূলকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, অমুক ব্যক্তি আন্তরিকভাবে মুসলমান নয়; বরং মুনাফিক্ব।

     দ্বিতীয়ত: এই যে, তাদের কথা-বার্তা ও কার্যকলাপে ইসলাম ও ঈমানবিরোধী কোন কাজ প্রকাশ পাওয়া।

     রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর তিরোধানের পরে ও‘হী বন্ধ হওয়ায় প্রথম পদ্ধতিতে মুনাফিক্বদের সনাক্ত করার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় পদ্ধতিটি এখনও রয়েছে। যে ব্যক্তি কথা-বার্তায় ঈমান ও ইসলামের দাবীদার, কিন্তু কার্যকলাপে তার বিপরীত তাকে মুনাফিক্ব বলা হবে।

     ঈমান ও কুফরের তাৎপর্য: আলোচ্য আয়াতে চিন্তা করলে ঈমান ও ইসলামের পূর্ণ তাৎপর্যটি পরিস্কার হয়ে যায়। অপরদিকে কুফরের ‘হাক্বীক্বতও প্রকাশ পায়। কেননা, এ আয়াতগুলোতে মুনাফিক্বদের ঈমানের দাবী ءَامَنَّا بِٱللَّهِ এবং কুরআনের পক্ষ থেকে এই দাবীর খন্ডনে ঘোষিত وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ বাক্যে উল্লেখ করা হয়েছে।

     এখানে আরো কিছু বিশেষ চিন্তা-ভাবনার অপেক্ষা রাখেঃ যে সমস্ত মুনাফিক্বের বর্ণনা কুরআনে দেয়া হয়েছে, সাধারণতঃ তারা ছিল ইহুদী। আল্লাহ্ তা‘আলার অস্তিত্ব ও রোজ ক্বিয়ামতের বিশ্বাস করা তাদের ধর্মমতেও প্রমাণিত ছিল, তাদেরকে রসূললুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর রিসালত ও নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনার কথা এখানে বলা হয়নি। বরং মাত্র দু’টি বিষয়ে ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে। তা হচ্ছে, আল্লাহ্র প্রতি ও শেষবিচার দিনের প্রতি। এতে তাদেরকে মিথ্যবাদী বলা চলে না। তা সত্বেও কুরআন কর্তৃক তাদেরকে মিথ্যাবাদী এবং তাদের ঈমানকে অস্বীকার করার কারণ কি? আসল কথা হচ্ছে যে, কোন না কোন প্রকারে নিজ নিজ ধারণা ও ইচ্ছানুযায়ী আল্লাহ্ এবং পরকাল স্বীকার করাকে ঈমান বলা যায় না। কেননা, ‘হাদীসরাও তো কোন না কোন দিক দিয়ে আল্লাহ্কে মেনে নেয় এবং কোন একটি নিয়ামক সত্তাকে সবচাইতে বড় একক ক্ষমতার অধিকারী বলে স্বীকার করে। আর ভারতের ‘হাদীসগণ ‘পরলোক’ নাম দিয়ে আখিরাতের একটি ধারণাও পোষণ করে থাকে। কিন্তু কুরআনের দৃষ্টিতে একেও ঈমান বলা যায় না। বরং একমাত্র সে ঈমানই গ্রহণযোগ্য, যাতে আল্লাহ্র প্রতি তাঁর নিজের বর্ণনাকৃত সকল গুণাগুনসহ যে ঈমান আনা হয় এবং পরকালের ব্যাপারে আল্লাহ্ ও রসূলের বর্ণনাকৃত অবস্থা ও গুণাগুণের সাথে যে বিশ্বাস স্থাপন করা হয়।

     কুফ্‌র ও ঈমানের সংজ্ঞা: কুরআনের ভাষায় ঈমানের তাৎপর্য বলতে গিয়ে সূরা বাক্বরার এয়োদশতম আয়াতে বলা হয়েছে  যাতে বোঝা যাচ্ছে যে, ঈমানের যথার্থতা সঠিক বলে প্রমাণিত না হবে, তা আল্লাহ্ ও রসূলের নিকট ঈমান বলে স্বীকৃতি লাভ করতে পারে না।

     যদি কোন ব্যক্তি কুরআনের বিষয়কে কুরআনের বর্ণনার বিপরীত পথে অবলম্বন করে বলে যে, আমি তো এ ‘আক্বীদাকে মানি, তবে তা শরী’আতে গ্রহণযোগ্য নয়। যথা-আজকাল ক্বাদিয়ানীরা বলে বেড়ায় যে, আমরা তো খত্মে নবুওয়াতে বিশ্বাস করি। অথচ এ বিশ্বাসে তারা রসূললুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বর্ণনা ও সা’হাবিগণের ঈমানের সম্পূর্ণ বিপরীত পথ অবলম্বন করেছে। আর এ পর্দার অন্তরালে মির্জা গোলাম ক্বাদিয়ানির নবুওয়াত প্রতিষ্ঠার পথ বের করছে। তাই কুরআনের বর্ণনায় এদেরকেও وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ আওতাভুক্ত করা হয়।

     শেষকথা, যদি কোন ব্যাক্তি সা’হাবিগণের ঈমানের পরিপন্থি কোন বিশ্বাসের কোন নতুন পথ ও মত তৈরী করে সে মতরে অনুসারী হয় এবং নিজেকে মু’মিন বলে দাবী করে, মুসলামানদের স্বলাত/নামায স্বওম/রোযা ইত্যাদিতে শরীকও হয়, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত কুরআনের প্রদর্শিত পথে ঈমান আনয়ন না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত কুরআনের ভাষায় তাদেরকে মু’মিন বলা হবে না।

     একটি সন্দেহের নিরসণ: ‘হাদীস ও ফিক্ব্হ্শাস্ত্রের একটা সুপরিচিত সিদ্ধান্ত এই যে, আহলে-ক্বিবলাকে কাফির বলা যাবে না। এর উত্তরও এ আয়াতেই বর্ণিত হয়েছে যে, আহ্লে-ক্বিব্লা তাদেরকেই বলা হবে যারা দ্বীনের প্রয়োজনীয় যাবতীয় বিষয়ে স্বীকৃতি জানায়; কোন একটি বিষয়েও অবিশ্বাস পোষণ করে না বা অস্বীকৃতি জানায় না। পরন্তু শুধু ক্বিব্লামুখী হয়ে স্বলাত/নামায পড়লেই ঈমানদার হতে পারে না। কারণ, তারা সা’হাবিগণের ন্যায় দ্বীনের যাবতীয় যরুরিয়্যাত তথা চাওয়া-পাওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়।

মিথ্যা একটি জঘন্য অপরাধঃ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ

     আয়াতে মুনাফিক্বদের কথা চিন্তা করলে দেখা যায় যে, তারা প্রথম স্তরের কাফির হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের জানামতে মিথ্যাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইত। তাই তারা ঈমানের ব্যাপারে আল্লাহ্ এবং ক্বিয়ামতরে দিনের কথা বলেই ক্ষান্ত হতো, রসূলের প্রতি ঈমানের প্রসঙ্গ দৃঢ়তার সাথে পাশ কাটিয়ে যেতো। কেননা, এতে করে তাদের পক্ষে সরাসরি মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার ভয় ছিল। এতে বোঝা যায় যে, মিথ্যা এমন একিট জঘন্য ও নিকৃষ্ট অপরাধ যা কোন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন লোকই পছন্দ করে না, সে কাফির-ফাসিক্বই হোক না কেন। নবী এবং ওলীগণের সাথে দুর্ব্যবহার করা প্রকারান্তরে আল্লাহ্‌র সাথে দুর্ব্যবহারেরই শামিল:

     উপরোক্ত আয়াতে মুনাফিক্বদের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে একথাও বর্ণনা করা হয়েছে যে, يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ অর্থাৎ, এরা আল্লাহ্কে ধোকা দেয়। অথচ এ মুনাফিক্বদের হয়তো একজনও এমন ছিল না, যে আল্লাহ্কে ধোকা দেয়ার মনোভাব পোষণ করত। বরং তারা রসূললুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং মু’মিগণকে ধোকা দেয়ার উদ্দেশ্যে এ সমস্ত ঘৃণ্য কাজ করেছে।

     আলোচ্য আয়াতে তাদের এ আচরণকে আল্লাহ্কেই ধোকা দেয়া বলে উল্লেখিত হয়েছে এবং প্রকারান্তরে বলে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্র রসূল বা কোন ওলীর সাথে দুর্ব্যবহার করে, প্রকৃত প্রস্তাবে তারা আল্লহ্র সাথেই মন্দ আচরণ করে। প্রসঙ্গতঃ আল্লাহ্র রসূল এবং তাঁর অনুসারিগণের বিপুল মর্যাদার প্রতিও ইঙ্গিত করা হয়েছে।

     মিথ্যা বলা পাপ: আলোচ্য আয়াতে মুনাফিক্বদের কঠোর শাস্তির কারণ- بِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ অর্থাৎ, তাদের মিথ্যাচারকে স্থির করা হয়েছে। অথচ তাদের কুফর ও নিফাক্বের অন্যায়ই ছিল সবচাইতে বড়।

     দ্বিতীয় বড় অন্যায় হচ্ছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করা। কিন্তু এতদসত্ত্বেও কঠোর শাস্তির কারণ তাদের মিথ্যাচারকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, মিথ্যা বলার অভ্যাসই তাদের প্রকৃত অন্যায়। এ বদ-অভ্যাসই তাদের কুফ্র্ ও নিফাক্ব পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। এজন্যই অন্যায়ের পর্যায়ে যদিও কুফ্‌র্ ও নিফাক্ব সর্বাপেক্ষা বড়, কিন্তু এসবের ভিত্তি ও বুনিয়াদ হচ্ছে মিথ্যা। তাই কুরআন মিথ্যা বলাকে মুর্তিপুজার সাথে যুক্ত করে ইরশাদ করেছে:

فَٱجۡتَنِبُواْ ٱلرِّجۡسَ مِنَ ٱلۡأَوۡثَٰنِ وَٱجۡتَنِبُواْ قَوۡلَ ٱلزُّورِ

অর্থাৎ, মুর্তিপুজার অপবিত্রতা ও মিথ্যা বলা  হতে বিরত থাকা।

     পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ্‌র হিদায়াতকে মানা না মানার ভিত্তিতে মানবজাতিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে, প্রত্যেকের কিছু কিছু অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। অতঃপর আলোচ্য আয়াতে তিনটি দলকেই সমগ্র কুরআনের মৌল শিক্ষার প্রতি আহবান করা হয়েছে এতে সৃষ্টিজগতের সবকিছুর আরাধনা পরিহার করে এক আল্লাহ্‌র ‘ইবাদতের প্রতি এমন পদ্ধতিতে দা’ওয়াত দেয়া হয়েছে যাতে সামান্য জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিও একটু চিন্তা করলেই তাও‘হীদের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য হয়।

         نَاس (নাস) ‘আরবী ভাষায় সাধারণভাবে মানুষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ফলে পূর্বে আলোচিত মানব সমাজের তিন শ্রেনীই এ আহবানের অন্তর্ভুক্ত। তাদরকে  লক্ষ করে বলা হয়েছে, ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ‘ইবাদত শব্দের অর্থ নিজের  অন্তরে মাহাত্ম্য ও ভীতি জাগ্রত রেখে সকল শক্তি আনুগত্য ও তাবেদারীতে নিয়োজিত করা এবং সকল অবাধ্যতা ও নাফরমানী থেকে দূরে থাকা। [রূ’হুল বায়ান পৃঃ ৭৪]

     ‘রব’ শব্দের অর্থ পালনকর্তা। ইতিপুর্বে এর বিস্তারিত আলাচনা হয়েছে। তদনুসারে আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, স্বীয় পালনকর্তার ‘ইবাদত কর।

     এ ক্ষেত্রে ‘রব’ শব্দের পরিবর্তে ‘আল্লাহ্ বা তাঁর গুণবাচক নামসমূহের মধ্য থেকে অন্য যে কোন একটা ব্যবহার করা যেতে পারতো, কিন্তু তা না করে ‘রব’ শব্দ ব্যবহার করে বোঝানো হয়েছে যে, এখানে দাবীর সাথে দলীল-প্রমাণও পেশ-উপস্থাপণ করা হয়েছে। কেননা, ‘ইবাদতের যোগ্য একমাত্র  সে সত্তাই হতে পারে, যে সত্তা তাদের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যিনি বিশেষ এক পলননীতির মাধমে সকল গুণে গুণাণ্বিত করে মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করেছেন এবং পার্থিব জীবনে বেঁচে থাকার স্বাভাবিক সকল ব্যবস্থাই করে দিয়েছন।

     মানুষ যত মূর্খই হোক এবং নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি ও দৃষ্টিশক্তি যতই হারিয়ে থাকুক না কেন, একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে যে, পালনের সকল দায়িত্ব নেয়া আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আর সাথে সাথে একথাও উপলব্ধি করতে পারবে যে মানুষকে এ অগণিত নি’আমত না পাথর-নির্মিত মূর্তি দান করেছে, না অন্য কোন শক্তি। আর তারা করবেই বা কিরূপে? তারা তো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার বা বেঁচে থাকার জন্য নিজেরাই সে মহাশক্তি ও সত্তার মুখাপেক্ষী। যে নিজেই অন্যের মুখাপেক্ষী সে অন্যের অভাব কি করে দুর করবে? যদি কেউ বাহ্যিক অর্থে কারো প্রতিপালন করেও, তবে তাও প্রকৃতপ্রস্তাবে সে সত্তার ব্যবস্থাপনার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।

     এর সারমর্ম এই যে, যে সত্তার ‘ইবাদতের জন্য দা’ওয়াত দেয়া হয়েছে, তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্তা আদৌ ’ইবাদতের যোগ্য নয়।

‘আমল নাজাত ও জান্নাত বা বেহেশ্‌ত পাওয়ার নিশ্চিত উপায় নয়:

         لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ বাক্যটিতে لَعَلَّ শব্দ আশা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি এমন ক্ষেত্রে বলা হয়, যেখানে কোন কাজ হওয়া নিশ্চিত হয়ে থাকে। ঈমান তাউ‘হীদের পরিণাম নাজাত  সম্বন্ধে আল্লাহ্‌র ও’য়াদা নিশ্চিত, কিন্তু সে বস্তুকে আশারূপে বর্ণনা করার তাৎপর্য এই যে, মানুষের কোন কাজই মুক্তি ও বেহেশতের মূল্য বা বিনিময় হতে পারে না। বরং একমাত্র আল্লাহ্‌র মেহেরবানী বা দয়াতেই মুক্তি সম্ভব। ঈমান আনা ও ‘‘আমল করার তাউফীক্ব হওয়া আল্লাহ্‌র মেহেরবানী বা দয়ার নমুনা, কারণ নয়।

তাও‘হীদের বিশ্বাসই দুনিয়াতে শান্তি ও নিরাপত্তার জামিন বা নিশ্চয়তা:

ইসলামের মৌলিক ‘আক্বীদা তাও‘হীদ বিশ্বাস শুধু একটি ধারণা বা মতবাদমাত্রই নয়; বরং মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষরূপে গঠন করার একমাত্র উপায়ও বটে। যা মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেয়, সকল সংকটেআশ্রয় দান করে এবং সকল দুঃখ-দুর্বিপাকের মর্মসাথী। কেননা, তাও‘হীদ বিশ্বাসের সারমর্ম হচ্ছে  এই  যে, সৃষ্ট সকল বস্তুর পরিবর্তন-পরিবর্দ্ধন একমাত্র একক সত্তার ইচ্ছাশক্তির অনুগত এবং তাঁর ক্বুদরতের প্রকাশ।

     এ দু’টি আয়াতে এমন এক কালাম বা বাক্য পেশ বা উপস্থাপন করা হচ্ছে, যা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারোই হতে পারে না। ব্যক্তিগত মেধা কিংবা দলগত উদ্যোগের দ্বারাও এ কালামের অনুরূপ রচনা করা সম্ভব নয়। সমগ্র মানবজাতির এ অপারগতার আলোকেই এ সত্য প্রমাণিত যে, এ কালাম আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নয়। এ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা সমগ্র বিশ্বের মানুষকে উদ্দেশ্য করে চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, যদি তোমরাএ কালামকে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন মানুষের কালাম বলে মনে কর, তবে যেহেতু তোমরাও মানুষ, তোমাদেরও অনুরূপ কালাম রচনা করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা থাকা উচিত। কাজেই সমগ্র কুরআন নয় বরং এর ক্ষুদ্রতম একটি সূরা-ই রচনা করে দেখাও। এতে তোমাদিগকে আরো সুযোগ দেয়া যাবে যে, একা না পারলে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ মিলে, যারা তোমাদের সাহায্য-সহায়তা করতে পারে এমন সব লোক নিয়েই ছোট একটি সূরা রচনা করে দেখাও। কিন্তু না, তা পারবেনা। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, তোমাদের সে যোগ্যতাই নেই। তারপর বলা হয়েছে, ক্বিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করেও যখন পারবে না, তখন দোযখ বা জাহান্নামের আগুন ও শাস্তির ভয় কর। কেননা,এতে পরিস্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এটা মানব রচিত কালাম নয়, বরং এমন অসীম শক্তিশালী সত্তার কালাম যা মানুষের ধরা-ছোঁয়া ও নাগালের উর্ধ্বে। যাঁর শক্তি সকলের উর্ধ্বে এমন এক মহা-সত্তা ও শক্তির কালাম। সুতরাং তাঁর বিরোধিতা থেকে বিরত থেকে দোযখ বা জাহান্নামের কঠোর শাস্তি হতে আত্মরক্ষা কর।মোটকথা, এ দুটি আয়াতে কুরআনুল্ কারীমকে রসূললুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সর্বাপেক্ষা বড় ‘মু‘জিযা হিসেবে অভীহিত করে তাঁর রিসালত ও সত্যবাদিতার দলীল-প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। রসূললুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ‘মু‘জিযার তো কোন শেষ নেই এবং প্রত্যেকটিই অত্যন্ত বিষ্ময়কর। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ স্থলে তাঁর জ্ঞান ও বিদ্যার ‘মু‘জিযা অর্থাৎ, কুরআনের বর্ণনায় সীমাবদ্ধ রেখে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে, সর্বশ্রেষ্ট ‘মু‘জিযা হচ্ছে কুরআন এবং এ ‘মু‘জিযা অন্যান্য নবী রসূলগণের সাধারণ ‘মু‘জিযা অপেক্ষা স্বতন্ত্র। কেননা, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর অপার ক্বুদরতে রসূল প্রেরণের সাথে সাথে কিছু ‘মু‘জিযাও প্রকাশ করেন। আর এসব ‘মু‘জিযা যে সমস্ত রসূলের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো তাঁদের জীবন কাল পর্যন্তই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কুরআনই এমন এক বিচিত্র ‘মু‘জিযা যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত বাকী থাকবে।

وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡب

رَيۡب শব্দের অর্থ সন্দেহ, সংশয়। কিন্তু ইমাম রাগ্বিব ইসফাহানীর মতে رَيۡب এমন সন্দেহ ও ধারণাকে বলা হয়, যসম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, সামান্য একটু চিন্তা করলেই যে সন্দেহ দূরীভূত হয়ে যায়। এজন্য কুরআনে অমুসলিম জ্ঞানী সমাজের পক্ষেও رَيۡب এ পতিত হওয়া স্বাভাবিক নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কুরআন একটি গতিশীল ও ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী মু’জিযা:

অন্যান্য সমস্ত নবী ও রসূলগণের ‘মু‘জিযাসমূহ তাঁদের জীবন পর্যন্তই ‘মু‘জিযা ছিল। কিন্তু কুরআনের ‘মু‘জিযা রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর তিরোধানের পরও পূর্বের মতই ‘মু‘জিযা সুলভ বৈশিষ্টসহই বিদ্যমান রয়েছে। আজ পর্যন্ত একজন সাধারণ মুসলমানও দুনিয়ার যে কোন জ্ঞানী-গুণীকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারে যে, কুরআনের সমতুল্য কোন আয়াত ইতিপূর্বেও কেউ তৈরী করতে পারেনি, এখনও কেউ পারবে না, আর যদি সাহস থাকে তবে তৈরী করে দেখাও।

     সুতরাং কুরআনের রচনাশৈলী, যার নমুনা আর কোন কালেই কোন জাতি পেশ করতে পারেনি, সেটাও একটি গতিশীল দীর্ঘস্থায়ী ‘মু‘জিযা। রসূলের যুগে যেমন এর নযীর পেশ করা যায়নি, অনুরূপভাবে আজও তা কেউ পেশ করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে না।

     অনন্য কুরআন: উপরোক্ত সাধারণ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ বিষয়টিও পরিস্কার হওয়ার প্রয়োজন যে,কিসের ভিত্তিতে কুরআনকে রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সর্বাপেক্ষা বড় ‘মু‘জিযা বলা হয়? আর কি কারণে কুরআন শরীফ সর্বযুগে অনন্য ও অপরাজেয় এবং সারা বিশ্ববাসী কেন এর নযীর পেশ করতে অপারগ?

     দ্বিতীয়ত: মুসলামানদের এ দাবী যে, চৌদ্দ শত বৎসরের এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কুরআনের এ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কেউ কুরআনের বা এর একটি সূরার অনুরূপ কোন রচনাও পেশ করতে পারিনি, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ দাবীর যথার্থতা কতটুকু এ দু’টিট বিষয়ই দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ।

     কুরআন মু‘জিযা হওয়ার অন্যান্য কারণসমূহ: প্রথম কথা হচ্ছে যে, কুরআনকে ‘মু‘জিযা বলে অভিহিত করা হলো কেন, আর কি কি কারণে সারা বিশ্ব এর নযীর বা স্বাদৃস্য পেশ করতে অপারগ হয়েছে। এ বিষয়ে প্রাচীনকাল থেকেই আ’লেমগণ বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। আর প্রত্যেক মুফাস্সিরই স্ব স্ব বর্ণনা ভঙ্গিতে এর বিবরণ দিয়েছেন। এখানে অতি সংক্ষেপে কয়েকটি প্রয়োজনীয় বিষয় বর্ণনা করা হল।

     সর্বপ্রথম লক্ষণীয় এই যে, এ আশ্চর্য এবং সর্ববিধ জ্ঞানের আধার মহান গ্রন্থটি কোন্ পরিবেশে এবং কার উপর অবতীর্ণ হয়েছেল। আরো লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে যে, সে যুগের সমাজ পরিবেশে কি এমন কিছু জ্ঞানের উপকরণ বিদ্যমান ছিল, যার দ্বারা এমন পূর্ণাঙ্গ একটি গ্রন্থ রচিত হতে পারে, যাতে সৃষ্টির আদি থেকে অস্ত পর্যন্ত সর্ববিধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যাবতীয় উপকরণ সন্নিবেশিত করা স্বাভাবিক হতে পারে? সমগ্র মানব সমাজের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সকল দিক সম্বলিত নির্ভূল পথ-নির্দেশ এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করার মত কোন সূত্রের সন্ধান কি সে যুগের জ্ঞান-ভান্ডারে বিদ্যমান ছিল, যদ্বারা মানুষের দৈহিক ও আত্মিক উভয় দিকেরই সুষ্ঠু বিকাশের বিধানাবলী থেকে শুরু করে পারিবারিক নিয়ম-শৃংখলা, সমাজ সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা তথা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রেও সর্বোত্তম ও সর্বযুগে সমভাবে প্রযোয্য আইন-কানুন বিদ্যমান থাকতে পারে?

     যে ভূ-খন্ডে এবং যে মহান ব্যক্তির প্রতি এ গ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে, এর ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক অবস্থা জানতে গেলে সাক্ষাৎ ঘটবে এমন একটা ঊষর শুল্ক মরুময় এলাকার সাথে যা ছিল বাত্হা বা মক্কা নামে পরিচিত। যে এলাকার ভূমি না ছিল কৃষিকাজের উপযোগী, না ছিল এখানে কোন কারিগরি শিল্প। আবহাওয়াও এমন স্বাস্থ্যকর ছিল না, যা কোন বিদেশী পর্যটককে আকৃষ্ট করতে পারে। রাস্তা-ঘাটও এমন ছিল না, যেখানে সহজে যাতায়াত করা যায়। সেটি ছিল অবশিষ্ট দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এমন একটি মরুময় উপদ্বীপ, যেখানে শুষ্ক পাহাড়-পর্বত এবং ধু-ধু বালুকাময় প্রান্তর ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়তো না। কোন জনবসতি বা বৃক্ষলতার অস্তিত্বও বড় একটা দেখা যেতো না।

     এ বিরাট ভূ-ভাগটির মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য শহরেরও অস্তিত্ব ছিল না। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট গ্রাম এবং তার মধ্যে উট-ছাগল প্রতিপালন করে জীবন ধারণকারী কিছু মানুষ বসবাস করতো। ছোট ছোট গ্রামগুলো তো দূরের কথা, নামেমাত্র যে কয়টি শহর ছিল, সেগুলোতেও লেখাপড়ার কোন চর্চাই ছিল না। না ছিল কোন স্কুল-কলেজ, না ছিল কোন বিশ্ববিদ্যালয়। শুধুমাত্র ঐতিহ্যগতভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে এমন একটা সুসমৃদ্ধ ভাষাসম্পদ দান করেছিলেন, যে ভাষা গদ্য ও পদ্য বাক-রীতিতে ছিল অনন্য। আকাশের মেঘ-গর্জনের মতো সে ভাষার মাধুরী অপূর্ব সাহিত্যরসে সিক্ত হয়ে তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতো। অপূর্ব রসময় কাব্যসম্ভার বৃষ্টিধারার মত আবৃত হতো পথে-প্রান্তরে। এ সম্পদ ছিল এমনি এক বিস্ময় আজ পর্যন্তও যার রসাস্বাদন করতে গিয়ে যে কোন সাহিত্য প্রতিভা হতবাক হয়ে যায়। কিন্তু এটি ছিল তাদের স্বভাবজাত এক সাধারণ উত্তরাধিকার। কোন মক্তব-মাদরাসার মাধ্যমে এ ভাষাজ্ঞান অর্জন করার রীতি ছিল না। অধিবাসীদের মধ্যে এ ধরনের কোন আগ্রহও পরিলক্ষিত হতো না। যারা শহরে বাস করতো, তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। পণ্যসামগ্রী একস্থান থেকে অন্যস্থানে আমদানী-রপ্তানীই ছিল তাদের একমাত্র পেশা।

     সে দেশেই সর্বপ্রাচীন শহর মক্কার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সে মহান ব্যাক্তিত্বের আবির্ভাব, যাঁর প্রতি আল্লাহ্‌র পবিত্রতম কিতাব কুরআন নাযিল করা হয়। প্রসঙ্গতঃ সে মহা-মানবের অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা যাক।ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তিনি পিতৃহারা হন, জন্মগ্রহণ করেন অসহায় এতীম হয়ে। মাত্র সাত বছর বয়সেই মাতৃবিয়োগ ঘটে। মাতার স্নেহ-মমতার কোলে লালিত-পালিত হওয়ার সুযোগও তিনি পাননি। পিতৃ-পিতামহগণ ছিলেন এমন দরাজদিল (পাষান হৃদয়) যার ফলে পারিবারিক সূত্র থেকে উত্তরাধিকাররূপে সামান্য সম্পদও তাঁর ভাগ্যে জুটেনি যার দ্বারা এ অসহায় এতীমের যোগ্য লালন-পালন হতে পারতো। পিতৃ-মাতৃহীন অবস্থায় নিতান্ত কঠোর দারিদ্র্যের মাঝে লালিত-পালিত হন। যদি তখনকার মক্কায় লেখাপড়ার চর্চা থাকতো তবুও এ কঠোর দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনে লেখাপড়া করার কোন সুযোগ গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে কোন অবস্থাতেই সম্ভবপর হতো না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তদানিন্তন আরবে লেখাপড়ার কোন চর্চাই ছিল না, যে জন্য ‘আরব জাতিকে উম্মী তথা নিরক্ষর জাতি বলা হতো। কুরআন পাকেও এ জাতিকে উম্মী জাতি নামেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই সে মহান ব্যক্তি বাল্যকালাবধি যে কোন ধরনের লেখাপড়া থেকে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন রয়ে যান। সে দেশে তখন এমন কোন জ্ঞানী ব্যক্তিরও অস্তিত্ব ছিল না, যার সহচর্য থেকে এমন কোন জ্ঞান-সূত্রের সন্ধান পাওয়া সম্ভব হতো, যে জ্ঞান কুরআন পাকে পরিবেশন করা হয়েছে। যেহেতু একটা অনন্য সাধারণ ‘মু‘জিযা প্রদর্শনই ছিল আল্লাহ্ তা‘আলার উদ্দেশ্য, তাই মামুলী একটু  অক্ষর জ্ঞান যা দুনিয়ার যে কোন এলাকার লোকই কোন না কোন উপায়ে আয়ত্ত করতে পারে, তাও আয়ত্ত করার কোন সুযোগ তাঁর জীবনে হয়ে উঠেনি। অদৃশ্য শক্তির বিশেষ ব্যবস্থাতেই তিনি এমন নিরক্ষর  উম্মী রয়ে গেলেন যে, নিজের নামটুকু পর্যন্ত দস্তখত করতে তিনি শিখেননি।

     তদানিন্তন ‘আরবের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বিষয় ছিল কাব্য চর্চা। স্থানে স্থানে কবিদের জলসা-মজলিস বসতো। এসব মজলিসে অংশগ্রহণকারী চারণ ও স্বভাব কবিগণের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা হতো। প্রত্যেকেই উত্তম কাব্য রচনা করে প্রাধান্য অর্জন করার চেষ্টা করতো। কিন্তু তাঁকে আল্লাহ্ তা‘আলা এমন রুচি দান করেছিলেন যে, কোন দিন তিনি এধরনের কবি জলসায় শরীক হননি বা অংশগ্রহণ করেন নি। জীবনেও কখনও একচ্ছত্র কবিতা রচনা করারও চেষ্টা করেননি।

     উম্মী হওয়া সত্ত্বেও ভদ্রতা-নম্রতা, চরিত্রমাধুর্য ও অত্যন্ত প্রখর  ধীশক্তি এবং সত্যবাদিতা ও আমনতদারীর অসাধারণ গুণ বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হতো, ফলে ‘আরবের ক্ষমতাদর্পী বড়লোকগুলোও তাঁকেই শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখতো সমগ্র মক্কা নগরীতে তাঁকে আল-আমীন বলে অভিহিত করা হতো।

     এ নিরক্ষর ব্যক্তি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মক্কা নগরীতে অবস্থান করেছেন। ভিন্ন কোন দেশে ভ্রমণেও যাননি। যদি এমন ভ্রমণও করতেন, তবুও ধরে নেয়া যেত যে, তিনি সেসব সফরে অভিজ্ঞতা ও বিদ্যার্জন করেছেন। মাত্র সিরিয়ায় দুটি বাণিজ্যিক সফর করেছেন, যাতে তাঁর কোন কর্তৃত্ব ছিল না। তিনি দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত মক্কায় এমনভাবে জীবনযাপন করেছেন যে, কোন পুস্তক বা লেখনী স্পর্শ করেছেন বলেও জানা যায় না, কোন মক্তবেও যাননি, কোন কবিতা বা ছড়াও রচনা করেননি। ঠিক চল্লিশ বছর বয়সে তাঁর মুখ থেকে সে বাণী নিঃসৃত হতে লাগল, যাকে কুরআন বলা হয়। যা শাব্দিক ও অর্থের গুণগত দিক দিয়ে মানুষকে স্তম্ভিত করতো। সুস্থ বিবেকবান লোকদের জন্য কুরআনের এ গুণগত মান মু‘জিযা হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু তাতেই তো শেষ নয়। বরং এ কুরআন সারা বিশ্ববাসীকে বারংবার চ্যালেঞ্জ সহকারে আহবান করেছে যে, যদি একে আল্লাহ্‌র কালাম বলে বিশ্বাস করতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকে, তবে এর নযীর পেশ করে দেখাও।

     একদিকে কুরআনের আহবান অপরদিকে সমগ্র বিশ্বের বিরোধী শক্তি যা ইসলাম ও ইসলামের নবীকে ধ্বংস করার জন্য স্বীয় জান-মাল, শক্তি-সামর্থ ও মান-ইয্যত তথা সবকিছু নিয়োজিত করে দিন-রাত চেষ্টা করছিল। কিন্তু এ সামান্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে কেউ সাহস করেনি। ধরে নেয়া যাক, এ গ্রন্থ যদি অদ্বিতীয় ও অনন্য সাধারণ নাও হতো, তবু একজন উম্মী লোকের মুখে এর প্রকাশই কুরআনকে অপরাজেয় বলে বিবেচনা করতে যে কোন সুস্থবিবেক সম্পন্ন লোকই বাধ্য হতো। কেননা, একজন উম্মী লোকের পক্ষে এমন একটা গ্রন্থ রচনা করতে পারা কোন সাধারণ ঘটনা বলে চিন্তা করা যায় না।

     দ্বিতীয় কারণ: পবিত্র কুরআন ও কুরআনের নির্দেশাবলী সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য অবতীর্ন হয়েছে। কিন্তু এর প্রথম সম্বোধন ছিল প্রত্যক্ষভাবে ‘আরব জনগণের প্রতি। যাদের অন্য কোন জ্ঞান না থাকলেও ভাষা শৈলীর উপর ছিল অসাধারণ বুৎপত্তি। এদিক দিয়ে ‘আরবরা সারাবিশ্বে এক শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিল। কুরআন তাদেরকে লক্ষ্য করেই চ্যালেঞ্জ করেছে যে, কুরআন যে আল্লাহ্‌র কালাম তাতে যদি তোমরা সন্দিহান হয়ে থাক, তবে তোমরা এর অনুরূপ একটি সাধারণ সূরা রচনা করে দেখাও। যদি আল-কুরআনের এ চ্যালেঞ্জ শুধু এর অন্তর্গত গুণ,নীতি,শিক্ষাগত তথ্য এবং নিগুঢ় তত্ত্ব পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা হতো, তবে হয়তো এ উম্মী জাতির পক্ষে কোন অজুহাত পেশ করা যুক্তিসঙ্গত হতে পারতো, কিন্তু ব্যাপার তা নয়, বরং রচনা-শৈলীর আঙ্গিক সম্পর্কেও এতে বিশ্ববাসীকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য অন্যান্য জাতির চাইতে ‘আরববাসীরাই ছিল বেশী উপযুক্ত। যদি এ কালাম মানব ক্ষমতার উর্ধ্বে কোন অলৌকিক শক্তির রচনা না হতো, তবে অসাধারণ ভাষাজ্ঞান সম্পন্ন ‘আরবদের পক্ষে এর মোকাবেলা কোন মতেই অসম্ভব হতো না, বরং এর চাইতেও উন্নতমানের কালাম তৈরী করা তাদের পক্ষে সহজ ছিল। দু’একজনের পক্ষে তা সম্ভব না হলে, কুরআন তাদেরকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এমনটি রচনা করারও সুযোগ দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও সমগ্র ‘আরববাসী একবারে নিশ্চুপ রয়ে গেল কয়েকটি বাক্যও তৈরী করতে পারলো না।

     ‘আরবের নেতৃস্থানীয় লোকগুলো কুরআন ও ইসলামকে সম্পূর্ণ উৎখাত এবং রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে পরাজিত করার জন্য যেভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল, তা শিক্ষিত লোকমাত্রই অবগত। প্রাথমিক অবস্থায় রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং তাঁর স্বল্পসংখ্যক অনুসারীর প্রতি নানা উৎপীড়নের মাধ্যমে ইসলাম থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এতে ব্যর্থ হয়ে তারা তোষামোদের পথ ধরলো। ‘আরবের বড় সরদার উতবা ইব্‌ন রাবীয়া সকলের প্রতিনিধিরূপে রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলো, আপনি ইসলাম প্রচার থেকে বিরত থাকুন। আপনাকে সমগ্র ‘আরবের ধন-সম্পদ, রাজত্ব এবং সুন্দরী মেয়ে দান করা হবে। তিনি এর উত্তরে কুরআনের কয়েকটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন। এ প্রচেষ্টা সফল না হওয়ায় তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। হিজরতের পূর্বে ও পরে সর্বশক্তি নিয়োগ করে যুদ্ধে অবতীর্ন হল। কিন্তু কেউই কুরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে অগ্রসর হল না, তারা কুরআনের অনুরূপ একটি সূরা এমনকি কয়েকটি ছত্রও তৈরী করতে পারল না। ভাষাশৈলী ও পান্ডিত্বের মাধ্যমে কুরআনের মোকাবেলা করার ব্যাপারে ‘আরবদের এহেন নীরবতাই প্রমাণ করে যে, কুরান মানবরচিত গ্রন্থ নয়, বরং তা আল্লাহ্‌র কালাম। মানুষ তো দূরের কথা, সমগ্র সৃষ্টিজগত মিলেও এ কালামের মোকাবেলা করতে পারে না।‘আরববাসীরা যে এ ব্যাপারে শুধু নির্বাকই রয়েছে তাই নয়, তাদের একান্ত আলোচনায় এরূপ মন্তব্য করতেও তারা কুন্ঠিত হয়নি যে, এ কিতাব কোন মানুষের রচনা হতে পারে না। ‘আরবদের মধ্যে যাদের কিছুটা সুস্থ্য বিবেক ছিল তারা শুধু মুখেই একথা প্রকাশ করেনি, এরূপ স্বীকৃতির সাথে সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই ইসলাম গ্রহণও করেছে। আবার কেউ কেউ পৈত্রিক ধর্মের প্রতি অন্ধ আবেগের কারণে অথবা বনী-আব্দে মানাফের প্রতি বিদ্বেষবশতঃ কুরআনকে আল্লাহ্‌র কালাম বলে স্বীকার করেও ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে।

     কুরাইশদের ইতিহাসই সে সমস্ত ঘটনার সাক্ষী। তারই মধ্য থেকে এখানে কয়েকিট ঘটনার উল্লেখ করা হচ্ছে, যাতে অতি সহজে বুঝা যাবে যে, সমগ্র ‘আরববাসী কুরআনকে অদ্বিতীয় ও নযীরবিহীন কালাম বলে স্বীকার করেছে এবং এর নযীর পেশ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি নিতে সচেতনভাবে বিরত রয়েছে!

     রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং কুরআন নাযিলের কথা মক্কার গন্ডী ছাড়িয়ে ’হিজাযের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার পর বিরুদ্ধবাদীদের অন্তরে এরূপ সংশয়ের সৃষ্টি হলো যে, আসন্ন হজ্জ্বের মওসুমে ‘আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে ‘‘হাজীগণ যখন মক্কায় আগমন করবে, তখন তারা রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কথা-বার্তা শুনে প্রভাবান্বিত না হয়ে পারবে না। এমতাবস্থায় এরূপ সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করার পন্থা নিরূপণ করার উদ্দেশ্যে মক্কার সম্ভ্রান্ত ক্বুরইশরা একটি বিশেষ পরামর্শ সভার আয়োজন করলো। এ বৈঠকে ‘আরবের বিশিষ্ট সরদারগণও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ওলীদ ইব্‌ন মুগ্বীরা বয়সে ও বিচক্ষণতায় ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। সবাই তার নিকট এ সমস্যার কথা উত্থাপন করলো। তারা বললো, এখন চারিদিক থেকে মানুষ আসবে এবং মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করবে। তাদের সেসব প্রশ্নের জবাবে আমরা কি বলবো? আপনি আমাদেরকে এমন একটি উত্তর বলে দিন, যেন আমরা সবাই একই কথা বলতে পারি।

     অনেক ভাবন-চিন্তার পর তিনি উত্তর দিলেন, যদি তোমাদের কিছু বলতেই হয়, তবে তাঁকে জাদুকর বলতে পার। লোকদেরকে বলো যে, এ লোক জাদু-বলে পিতা-পুত্র ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন। সমবেত লোকেরা তখনকার মত প্রস্তাবে একমত ও নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। তখন থেকেই তারা অগন্তুকদের নিকট একথা বলতে আরম্ভ করলো, কিন্তু আল্লাহ্‌র জ্বালানো প্রদীপ কারো ফুৎকারে নির্বাপিত হবার নয়। ‘আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধারণ লোকদের অনেকেই কুরআনের অমীয় বাণী শুনে মুসলামন হয়ে গেল। ফলে মক্কার বাইরেও ইসলামের বিস্তার সূচিত হলো। [খ্বসায়েসে কুবরা]

     এমনিভাবে বিশিষ্ট ক্বুরইশ সরদার নযর ইব্‌ন হারেস তার স্বজাতিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আজ তোমরা এমন এক বিপদের সম্মুখীন হয়েছ, যা ইতিপূর্বে কখনও দেখা যায়নি। মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমাদেরই মধ্যে যৌবন অতিবাহিত করেছেন, তোমরা তাঁর চরিত্রমাধুরে্‌য বিমুগ্ধ ছিলে, তাঁকে তোমরা সবার চাইতে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করতে, আমানতদার বলে অভিহিত করতে! কিন্তু যখন তাঁর মাথার চুল সাদা হতে আরম্ভ করেছে, আর তিনি আল্লাহ্র কালাম তোমাদেরকে শোনাতে শুরু করেছেন, তখন তোমরা তাঁকে জাদুকর বলে অভিহিত করছ। আল্লাহ্র কসম; তিনি জাদুকর নন। আমি বহু জাদুকর দেখেছি, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষ করেছি, তাদের সঙ্গে মেলা-মেশা করেছি, কিন্তু মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোন অবস্থাতেই তাদের মত নন। তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। আরও জেনে রেখো! আমি অনেক জাদুকরের কথা-বার্তা শুনেছি, কিন্তু তাঁর কথা-বার্তা জাদুকরের কথা-বার্তার সাথে কোন বিচারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তোমরা তাঁকে কবি বল, অথচ আমি অনেক কবি দেখেছি, এ বিদ্যা আয়ত্ত করেছি, অনেক বড় বড় কবির কবিতা শুনেছি, অনেক কবিতা আমার মুখস্থও আছে, কিন্তু তাঁর কালামের সাথে কবিদের কবিতার কোন সাদৃশ্য আমি খুঁজে পাইনি। কখনও কখনও তোমরা তাঁকে পাগল বল, তিনি পাগলও নন। আমি অনেক পাগল দেখেছি, তাদের পাগলামীপূর্ণ কথা-বার্তাও শুনেছি, কিন্তু তাঁর মধ্যে তাদের মত কোন লক্ষণই পাওয়া যায় না। হে আমার জাতি! তোমরা ন্যায়নীতির ভিত্তিতে এ ব্যাপারে চিন্তা কর, সহজে এড়িয়ে যাওয়ার মত ব্যক্তি তিনি নন।

     হযরত আবূ বাক্‌র (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেছেন, আমার ভাই আনীস একবার মক্কায় গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে এসে আমাকে বলেছিলেন যে, মক্কায় এক ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহ্‌র রসূল বলে দাবী করছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেখানকার মানুষ এ সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করে? তিনি উত্তর দিলেন, তাঁকে কেউ কবি কেউ পাগল, কেউবা জাদুকর বলে। আমার ভাই আনীস একজন বিশিষ্ট কবি এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞ লোক ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, আমি যতটুকু লক্ষ্য করেছি, মানুষের এসব কথা ভূল ও মিথ্যা। তাঁর কালাম কবিতাও নয়,  জাদুও নয়, আমার ধারণায় সে কালাম সত্য।

     আবূ যর (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেন যে, ভাইয়ের কথা শুনে আমি মক্কায় চলে এলাম। মসজিদে ‘হারামে অবস্থান করলাম এবং ত্রিশ দিন শুধু অপেক্ষা করেই অতিবাহিত করলাম। এ সময় যমযম কূপের পানি ব্যতীত আমি অন্য কিছুই পানাহার করিনি। কিন্তু এতে আমার ক্ষুধার কষ্ট অনুভব হয়নি! দূর্বলতাও উপলব্ধি করিনি। শেষ পর্যন্ত কা’বা প্রাঙ্গন থেকে বের হয়ে লোকের নিকট বললাম, আমি রোম ও পারস্যের বড় বড় জ্ঞানী-গুণী লোকদের অনেক কথা শুনেছি, অনেক জাদুকর দেখেছি, কিন্তু মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণীর মত কোন বাণী আজও পর্যন্ত কোথাও শুনিনি। কাজেই সবাই আমার কথা শোন এবং তাঁর অনুসরণ কর। আবূ যরের এ প্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়েই মক্কা বিজয়ের বছর তাঁর ক্বওমের প্রায় এক হাজার লোক মক্কায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।

     ইসলাম ও রসূলের বড় শত্রু আবূ জাহ্ল্ এবং আখ্নাস ইব্‌ন শোরাইকও লোকচক্ষুর অগোচরে কুরআন শুনত, কুরআনের অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গি এবং অনন্য রচনারীতির প্রভাবে প্রভাবান্বিত হতো। কিন্তু গোত্রের লোকেরা যখন তাদেরকে বলতো যে, তোমরা যখন এ কালামের গুণ সম্পর্কে এতই অবগত এবং একে অদ্বিতীয় কালামরূপে বিশ্বাস কর, তখন কেন তা গ্রহণ করছ না? প্রত্তুত্তরে আবূ জাহ্‌ল্ বলতো, তোমরা জান যে, বনী আবদে মানাফ এবং আমাদের মধ্যে পূর্ব থেকেই বিরামহীন শত্রুতা চলে আসছে; তারা যখন কোন কাজে অগ্রসর হতে চায়, তখন আমরা তার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে বাধা দেই। উভয় গোত্রই সমপর্যায়ের। এমতবস্থায় তারা যখন বলছে যে, আমাদের মধ্যে এমন এক নবীর আভির্ভাব হয়েছে, যাঁর নিকট আল্লাহ্‌র বানী আসে, তখন আমরা কিভাবে তাদের মোকাবেলা করব, তাই আমার চিন্তা। আমি কখনও তাদের একথা মেনে নিতে পারি না।মোটকথা, কুরআনের এ দাবী ও চ্যালেঞ্জ সারা ‘আরববাসী যে পরাজয় বরণ করেই ক্ষান্ত হয়েছে তাই নয়, বরং একে অদ্বিতীয় ও অনন্য বলে প্রকাশ্যভাবে স্বীকারও করেছে। যদি কুরআন মানব রচিত কালাম হতো, তবে সমগ্র ‘আরববাসী তথা সমগ্র বিশ্ববাসী অনুরূপ কোন না কোন একটি ছোট সূরা রচনা করতে অপারগ হতো না এবং এ কিতাবের অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা স্বীকারও করতো না। কুরআন ও কুরআনের বাহক রসূলের বিরোদ্ধে জান-মাল, ধন-সম্পদ, মান-ইজ্জত সবকিছু ব্যয় করার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল, কিন্তু কুরআনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে দু’টি শব্দও রচনা করতে কেউ সাহসী হয়নি।

     এর কারণ এই যে, সমস্ত মানুষ তাদের মূর্খতাজনিত কার্যকলাপ ও ‘‘আমল সত্ত্বেও কিছুটা বিবেকসম্পন্ন ছিল মিথ্যার প্রতি তাদের একটা সহজাত ঘৃণাবোধ ছিল। কুরআন শুনে তারা যখন বুঝতে পারলো যে, এমন কালাম রচনা আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়, তখন তারা কেবল একগুয়েমীর মাধ্যমে কোন বাক্য রচনা করে তা জনসম্মুখে তুলে ধরা নিজেদের জন্য লজ্জার ব্যাপার বলে মনে করতো। তারা জানতো যে, আমরা যদি কোন বাক্য পেশ করিও, তবে সমগ্র ‘আরবের শুদ্ধভাষী লোকেরা তুলনামূলক পরীক্ষায় আমাদেরকে অকৃতকার্যই ঘোষণা করবে এবং এজন্য অনর্থক লজ্জিত হতে হবে। এজন্য সমগ্র জাতিই চুপ করে ছিল। আর যারা কিছুটা ন্যায়পথে চিন্তা করেছে, তারা খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নিতেও কুন্ঠিত হয়নি যে, এটা আল্লাহ্‌র কালাম।

     এসব ঘটনার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, ‘আরবের একজন সরদার আস’আদ ইব্‌ন যিরার রসূলের চাচা ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু)-এর নিকট স্বীকার করেছেন যে, তোমরা অনর্থক মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিরুদ্ধাচরণ করে নিজেদের ক্ষতি করছ এবং পারস্পরিক সম্পর্কচ্ছেদ করছ। আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলতে পারি যে, নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহ্‌র রসূল এবং তিনি যে কালাম পেশ করেছেন তা আল্লাহ্‌র কালাম এতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।

     তৃতীয় কারণ: তৃতীয় কারণ হচ্ছে এই যে, কুরআন কিছু গায়েবী সংবাদ এবং ভবিষ্যতে ঘটবে এমন অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছে, যা হুবহু সংঘটিত হয়েছে। যথা-কুরআন ঘোষণা করেছে, রোম ও পারস্যের যুদ্ধে প্রথমত: পারস্যবাসী জয়লাভ করবে এবং দশ বছর যেতে না যেতেই পূণরায় রোম পারস্যকে পরাজিত করবে। এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর মক্কার সরদারগণ হযরত আবূ বাক্‌র সিদ্দীক্ব (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু)-এর সাথে এ ভবিষ্যদ্বাণীর যথার্থতা সম্পর্কে বাজী ধরল। শেষ পর্যন্ত কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী জয়লাভ করলো এবং বাজীর শর্তানুযায়ী যে মাল দেয়ার কথা ছিল, তা তাদের দিতে হলো। রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অবশ্য এ মালগ্রহণ করেননি। কেননা, এরূপ বাজী ধরা শরী’আত অনুমোদন করে না। এমন আরো অনেক ঘটনা কুরআনে উল্লেখিত রয়েছে, যা গায়েবের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং নিকট অতীতে হুবুহু ঘটেছেও।

     চতুর্থ কারণ: চতুর্থ কারণ এই যে, কুরআন কারীমে পূর্ববর্তী উম্মত, শরী’আত ও তাদের ইতিহাস এমন পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে যুগের ইহুদী-খৃষ্টানদের পন্ডিতগণ, যাদেরকে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের বিজ্ঞ লোক মনে করা হতো, তারাও এতটা অবগত ছিল না। রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকটা শিক্ষা ছিল না। কোন শিক্ষিত লোকের সাহায্যও গ্রহণ করেননি। কোন কিতাব কোনদিন স্পর্শও করেননি। এতদসত্ত্বেও দুনিয়ার প্রথম থেকে তাঁর যুগ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ববাসীর ঐতিহাসিক অবস্থা এবং তাদের শরী’আত সম্পর্কে অতি নিখুঁতভাবে বিস্তারিত আলোচনা করা আল্লাহ্র কালাম ব্যতীত কিছুতেই তাঁর পক্ষে সম্ভব হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তা‘আলাই যে তাঁকে এ সংবাদ দিয়েছেন এতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

     পঞ্চম কারণ: পঞ্চম কারণ হচ্ছে এই যে, কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানুষের অন্তর্নিহিত বিষয়াদি সম্পর্কিত যেসব সংবাদ দেয়া হয়েছে পরে সংশ্লিষ্ট লোকদের স্বীকারোক্তিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সব কথাই সত্য। এ কাজও আল্লাহ্ তা‘আলারই কাজ, তা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

     ষষ্ঠ কারণ: ষষ্ঠ কারণ হচ্ছে যে, কুরআনে এমন সব আয়াত রয়েছে যাতে কোন সম্প্রদায় বা কো ব্যক্তি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, তাদের দ্বারা অমুক কাজ হবে না; তারা তা করতে পারবে না। ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি তারা নিজেরদেরক আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা বলেই মনে করে, তবে তারা নিশ্চয়ই তাঁর নিকট যেতে পছন্দ করবে। সুতরাং এমতাবস্থায় তাদের পক্ষে মৃত্যুকামনা করা অপছন্দনীয় হতে পারে না। এ প্রসেঙ্গ ইরশাদ হচ্ছে:

وَلَن يَتَمَنَّوۡهُ أَبَدَۢا তারা কখনও তা চাইবে না।

মৃত্যু কামনা করা তাদের পক্ষে কঠিন ছিল না। বিশেষ করে ঐ সমস্ত লোকদের জন্য যারা কুরআনকে মিথ্যা বলে অভিহিত করতো। কুরআনের ইরশাদ মোতাবেক তাদের মৃত্যু কামনা করার ব্যাপারে ভয় পাওয়ার কোন কারণ ছিল না। ইহুদীদের পক্ষে মৃত্যু কামনার (মোবাহালা) এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মুসলামানদেরকে পরাজিত করার অত্যন্ত সুবর্ণ সুযোগ ছিল। কুরআনের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গে সঙ্গেই তাতে সম্মত হওয়া তাদের পক্ষে উচিত ছিল। ন্তিু ইহুদী ও মুশরিকরা মুখে কুরআনকে যতই মিথ্যা বলুক না কেন, তাদের মন জানতো যে, কুরআন সত্য, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং মৃত্যু কামনার চ্যালেঞ্জে সাড়া দিলে সত্য-সত্যই তা ঘটবে। এজন্যই তারা কুরআনের এ প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সাহস পায়নি এবং একটি বারের জন্যও মুখ দিয়ে মৃত্যুর কথা বলেনি।

     সপ্তম কারণ: কুরআন কারীম শ্রবণ করলে মু’মিন, কাফির, সাধারণ-অসাধারণ নির্বিশেষে সবার উপর দু’ধরনের প্রভাব সৃষ্টি হতে দেখা যায়। যেমন, হযরত যুবাইর ইব্‌ন মুতআম (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে একদিন রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে মাগ্বরিবের স্বলাত/নামাযে সূরা ত্বূর পড়তে শুনেন। রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন শেষ আয়াতে পৌঁছলেন, তখন হযরত যুবাইর (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেন যে, মনে হলো, যেন আমার অন্তর উড়ে যাচ্ছে। তাঁর কুরআন পাঠ শ্রবণের এটাই ছিল প্রথম ঘটনা। তিনি বলেন, সেদিনই কুরআন আমার উপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছিল। আয়াতটি হচ্ছে:

أَمۡ خُلِقُواْ مِنۡ غَيۡرِ شَيۡءٍ أَمۡ هُمُ ٱلۡخَٰلِقُونَ ٣٥ أَمۡ خَلَقُواْ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَۚ بَل لَّا يُوقِنُونَ ٣٦ أَمۡ عِندَهُمۡ خَزَآئِنُ رَبِّكَ أَمۡ هُمُ ٱلۡمُصَۜيۡطِرُونَ ٣٧

অর্থাৎ, তারা কি নিজেরাই সৃষ্ট হয়েছে, না তারাই আকাশ ও যমীন সৃষ্টি করেছে? কোন কিছুতেই ওরা ইয়াক্বীন করছে না। তাদের নিকট কি তোমার পালনকর্তার ভান্ডারসমূহ গচ্ছিত রয়েছে, তারাই রক্ষক?অষ্টম কারণ: অষ্টম কারণ হচ্ছে, কুরআনকে বারংবার পাঠ করলেও মনে বিরক্তি আসে না। বরং যতই বেশী পাঠ করা যায়, ততই তাতে আগ্রহ বাড়তে থাকে। দুনিয়ার যত ভাল ও আকর্ষণীয় পুস্তকই হোক না কেন, বড়জোড় দু-চারবার পাঠ করার পর তা আর পড়তে মন চায় না, অন্যে পাঠ করলেও তা শুনতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু কুরআনের এ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, যত বেশী পাঠ করা হয়, ততই মনের আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে। অন্যের পাঠ শুনতেও আগ্রহ জন্মে।

     নবম কারণ: নবম কারণ হচ্ছে, কুরআন ঘোষণা করেছে যে, কুরআনের সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ্ গ্রহণ করেছেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এর মধ্যে বিন্দুবিসর্গ পরিমাণ পরিবর্তন-পরিবর্ধন না হয়ে তা সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ্ তা‘আলা এ ওয়া’দা এভাবে পূরণ করছেন যে, প্রত্যেক যুগে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছিলেন এবং রয়েছেন, যারা কুরআনকে এমনভাবে স্বীয় স্মৃতিপটে ধারণ করেছেন যে, এর প্রতিটি যের-যবর তথা স্বরচিহ্ন পর্যন্ত অবিকৃত রয়েছে। নাযিলের সময় থেকে চৌদ্দ শতাধিক বছর অতিবাহিত হয়েছে; এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও এ কিতাবে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন পরিলক্ষিত হয়নি। প্রতি যুগেই নারি-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে কুরআনের ‘হাফিয ছিলেন ও রয়েছেন। বড় বড় ‘আলিম যদি একটি যের-যবর বেশ-কম করেন, তবে ছোট বাচ্চারাও তাঁর ভূল ধরে ফেলে। পৃথিবীর কোন ধর্মীয় কিতাবের এমন সংরক্ষণ ব্যবস্থা সে ধর্মের লোকেরা এক দশমাংশও পেশ করতে পারবে না। আর কুরআনের মত নির্ভূল দৃষ্টান্ত বা নযীর স্থাপন করা তো অন্য কোন গ্রন্থ সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না। অনেক ধর্মীয় গ্রন্থ সম্বন্ধে এটা স্থির করাও মুশকিল যে, এ কিতাব কোন ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তাতে কয়টি অধ্যায় ছিল।

     গ্রন্থাকারে প্রতি যুগে কুরআনের যত প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে, অন্য কোন ধর্ম-গ্রন্থের ক্ষেত্রে তা হয়নি। অথচ ইতিহাস সাক্ষী যে, প্রতি যুগেই মুসলামানদের সংখ্যা কাফের-মুশরিকদের তুলনায় কম ছিল এবং প্রচার মাধ্যমও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকদের তুলানায় কম ছিল। এতদসত্ত্বেও কুরআনের প্রচার ও প্রকাশের তুলানায় অন্য কোন ধর্মগ্রন্থের প্রচার ও প্রকাশনা সম্ভব হয়নি। তারপরেও কুরআনের সংরক্ষণ আল্লাহ্ তা‘আলা শুধু গ্রন্থ ও পুস্তকেই সীমাবদ্ধ রাখেননি যা জ্বলে গেলে বা অন্য কোন কারণে নষ্ট হয়ে গেলে আর সংগ্রহ করার সম্ভাবনা থাকে না। তাই স্বীয় বান্দাগণের স্মৃতিপটেও সংরক্ষিত করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ না করুক সমগ্র বিশ্বের কুরআনও যদি কোন কারণে ধ্বংস হয়ে যায়, তবু এ গ্রন্থ পূর্বের ন্যায়ই সংরক্ষিত থাকবে। কয়েকজন ‘হাফিয একত্রে বসে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তা লিখে দিতে পারবেন (ইনশা-আল্ল-হ)। এ অদ্ভুত সংরক্ষণও আল-কুরআনেরই বিশেষত্ব এবং এ যে আল্লাহ্রই কালাম তার অন্যতম উজ্জ্বল প্রমাণ। যেভাবে আল্লহ্র সত্তা সর্বযুগে বিদ্যমান থাকবে, তাতে কোন সৃষ্টির হস্তক্ষেপের কোন ক্ষমতা নেই, অনুরূপভাবে তাঁর কালাম সকল সৃষ্টির রদ-বদলের ঊর্ধ্বে এবং সর্বযুগে বিদ্যমান থাকবে। কুরআনের এই ভবিষ্যদ্বানীর সত্যতা বিগত চৌদ্দশত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। এ প্রকাশ্য ‘মু‘জিযার পর কুরআন আল্লহ্‌র কালাম হওয়াতে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় থাকতে পারে না।

     দশম কারণ: কুরআনে ‘ইল্‌ম ও জ্ঞানের যে সাগর পুঞ্জীভূত করা হয়েছে, অন্য কোন কিতাবে আজ পর্যন্ত তা করা হয়নি। ভবিষ্যতেও তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই সংক্ষিপ্ত ও সীমিত শব্দসম্ভারের মধ্যে এত জ্ঞান ও বিষয়বস্তুর সমাবেশ ঘটেছে যে, তাতে সমগ্র সৃষ্টির সর্বকালের প্রয়োজন এবং মানবজীবনের প্রত্যেক দিক পরিপূর্ণভাবে আলোচিত হয়েছে। আর বিশ্ব-পরিচালনার সুন্দরতম নিয়ম এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের নির্ভূল বিধান বর্ণিত হয়েছ। এ ছাড়া মাথার উপরে ও নীচে যত সম্পদ রয়েছে সে সবের প্রসঙ্গ ছাড়াও জীব-বিজ্ঞান,  উদ্ভিদ বিজ্ঞান এমনকি রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির সকল দিকের পথনির্দেশ সম্বলিত এমন সমাহার বিশ্বের অন্য কোন আসমানী কিতাবে দেখা যায় না।

     শুধু আপাতঃদৃষ্টিতে পথনির্দেশই নয়, এর নমুনা পাওয়া এবং সে সব নির্দেশ একটা জাতির বাস্তব জীবনে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়ে তাদের জীবনধারা এমনকি ধ্যান-ধারণ, অভ্যাস এবং রুচিরও এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন দুনিয়ার অন্য কোন গ্রন্থের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে এমন নযীর আর একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা নিরক্ষর উম্মী জাতিকে জ্ঞানে, রুচিতে, সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে এত অল্পকালের মধ্যে এমন পরিবর্তিত করে দেয়ার নযীরও আর দ্বিতীয়টি নেই।

     সংক্ষেপে এই হচ্ছে কুরআনের সেই বিস্ময় সৃষ্টিকারী প্রভাব, যাতে কুরআনকে আল্লাহ্র কালাম বলে প্রতিটি মানুষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। যাদের বুদ্ধি-বিবেচনা বিদ্বেষের কালিমায় সম্পূর্ণ কলূষিত হয়ে যায়নি, এমন কোন লোকই কুরআনের এ অনন্য সাধারণ মু’জিযা সম্পর্কে অকুন্ঠ স্বীকৃতি প্রদান করতে কার্পণ্য করেনি। যারা কুরআনকে জীবন বিধান হিসাবে গ্রহণ করেনি, এমন অনেক অ-মুসলিম লোকও কুরআনের এ নযীরবিহীন মু’জিযার কথা স্বীকার করেছেন। ফ্রান্সের বিখ্যাত মণীষী ডঃ মারড্রেসকে ফরাসী সরকারের পক্ষ থেকে কুরআনের বাষট্টিটি সূরা ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁর স্বীকারোক্তিও এ ব্যাপারে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘নিশ্চয়ই কুরআনের বর্ণনাভঙ্গি সৃষ্টিকর্তার বর্ণনাভঙ্গিরই স্বাক্ষর। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কুরআনে যেসব তথ্যাদি বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ্‌র বাণী ব্যতীত অন্য কোন বাণীতে তা থাকতে পারে না।’

     এতে সন্দেহ পোষণকারীরাও যখন এর অনন্য সাধারণ প্রভাব লক্ষ্য করে, তখন তারাও এ কিতাবের সত্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। বিশ্বের সর্বত্র শতাধিক কোটি মুসলামান ছড়িয়ে রয়েছে, তাদের মধ্যে কুরআনের বিশেষ প্রভাব দেখে খৃষ্টান মিশনগুলোতে কর্মরত সকলেই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, যেসব মুসলামন কুরআন বুঝে পড়ার সুযোগ লাভ করেছে, তাদের মধ্যে একটি লোকও ধর্মত্যাগী-মুরতাদ হয়নি।

     মোটকথা, কুরআনের অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যথাযোগ্য বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব না হলেও সংক্ষিপ্তভাবে যতটুকু বলা হলো, এতেই সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, কুরআন আল্লাহ্‌রই কালাম এবং রসূলে আকরম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর একটি সর্বশ্রেষ্ঠ ‘মু‘জিযা।

فَإِن لَّمۡ تَفۡعَلُواْ وَلَن تَفۡعَلُواْ فَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِي وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُۖ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ٢٤

২৪. আর যদি তা না পার-অবশ্য তা তোমরা কখনও পারবে না, তাহলে সে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা কর, যার জ্বালানী হবে মানুষ ও পাথর। যা প্রস্তুত করা হয়েছে কাফেরদের জন্য।

وَبَشِّرِ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أَنَّ لَهُمۡ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُۖ كُلَّمَا رُزِقُواْ مِنۡهَا مِن ثَمَرَةٖ رِّزۡقٗا قَالُواْ هَٰذَا ٱلَّذِي رُزِقۡنَا مِن قَبۡلُۖ وَأُتُواْ بِهِۦ مُتَشَٰبِهٗاۖ وَلَهُمۡ فِيهَآ أَزۡوَٰجٞ مُّطَهَّرَةٞۖ وَهُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٢٥

২৫. আর হে নবী (সা,), যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজসমূহ করেছে, আপনি তাদেরকে এমন বেহেশতের সুসংবাদ দিন, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহমান থাকবে। যখনই তারা খাবার হিসেবে কোন ফল প্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, এতো অবিকল সে ফলই যা আমরা ইতিপূর্বেও লাভ করেছিলাম। বস্তুতঃ তাদেরকে একই প্রকৃতির ফল প্রদান করা হবে। এবং সেখানে তাদের জন্য শুদ্ধচারিনী রমণীকূল থাকবে। আর সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে।

۞إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَسۡتَحۡيِۦٓ أَن يَضۡرِبَ مَثَلٗا مَّا بَعُوضَةٗ فَمَا فَوۡقَهَاۚ فَأَمَّا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ فَيَعۡلَمُونَ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّهِمۡۖ وَأَمَّا ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَيَقُولُونَ مَاذَآ أَرَادَ ٱللَّهُ بِهَٰذَا مَثَلٗاۘ يُضِلُّ بِهِۦ كَثِيرٗا وَيَهۡدِي بِهِۦ كَثِيرٗاۚ وَمَا يُضِلُّ بِهِۦٓ إِلَّا ٱلۡفَٰسِقِينَ ٢٦

২৬. আল্লাহ্‌ পাক নিঃসন্দেহে মশা বা তদুর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুতঃ যারা মুমিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভূল ও সঠিক। আর যারা কাফের তারা বলে, এরূপ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহ্‌র মতলবই বা কি ছিল। এ দ্বারা আল্লাহ্‌ তা‘আলা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাকেও বিপথগামী করেন না।

ٱلَّذِينَ يَنقُضُونَ عَهۡدَ ٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ مِيثَٰقِهِۦ وَيَقۡطَعُونَ مَآ أَمَرَ ٱللَّهُ بِهِۦٓ أَن يُوصَلَ وَيُفۡسِدُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ٢٧

২৭. (বিপথগামী ওরাই) যারা আল্লাহ্‌র সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ্‌ পাক যা অবিচ্ছিন্ন রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন, তা ছিন্ন করে, আর পৃথিবীর বুকে অশান্তি সৃষ্টি করে। ওরা যথার্থই ক্ষতিগ্রস্ত।

كَيۡفَ تَكۡفُرُونَ بِٱللَّهِ وَكُنتُمۡ أَمۡوَٰتٗا فَأَحۡيَٰكُمۡۖ ثُمَّ يُمِيتُكُمۡ ثُمَّ يُحۡيِيكُمۡ ثُمَّ إِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٢٨

২৮.কেমন করে তোমরা আল্লাহ্‌র ব্যাপারে কুফরী অবলম্বন করছ? অথচ তোমরা ছিলে নিষ্প্রাণ। অতঃপর তিনিই তোমাদেরকে প্রাণ দান করেছেন, আবার মৃত্যু দান করবেন। পুনরায় তোমাদেরকে জীবনদান করবেন। অতঃপর তারই প্রতি প্রত্যাবর্তন করবে।

هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰٓ إِلَى ٱلسَّمَآءِ فَسَوَّىٰهُنَّ سَبۡعَ سَمَٰوَٰتٖۚ وَهُوَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٞ ٢٩

২৯. তিনিই সে সত্ত্বা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু জমীনে রয়েছে সে সমস্ত। তারপর তিনি মনোসংযোগ করেছেন আকাশের প্রতি। বস্তুতঃ তিনি তৈরী করেছেন সাত আসমান। আর আল্লাহ্‌ সর্ববিষয়ে অবহিত।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

জান্নাতবাসীদেরকে একই আকৃতি বিশিষ্ট বিভিন্ন ফলমূল পরিবেশনের উদ্দেশ্য হবে পরিতৃপ্তি ও আনন্দ সঞ্চার। কোন কোন ভাষ্যকারের মতে ফলসমূহ পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার অর্থ বেহেশ্‌তের ফলাদি আকৃতিগতভাবে ইহজগতে প্রাপ্ত ফলের অনুরূপই হবে। সেগুলো যখন জান্নাতবাসীদের মাঝে পরিবেশন করা হবে, তখন তারা বলে উঠবে, অনুরূপ ফল তো আমরা দুনিয়াতেও পেতাম। কিন্তু স্বাদ ও গন্ধ হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। দুনিয়ার ফলের সঙ্গে তার কোন তুলনাই চলবে না, শুধু নামের মিল থাকবে।

     জান্নাতে পূত-পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন স্ত্রী লাভের অর্থ, তারা হবে পার্থিব যাবতীয় বাহ্যিক ও গঠনগত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও চরিত্রগত কলুষতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত এবং প্রস্রাব পায়খানা, রজঃস্রাব, প্রসবোত্তর স্রাব প্রভৃতি যাবতীয় ঘৃণ্য বিষয়ের ঊর্ধ্বে। অনুরূপভাবে নীতিভ্রষ্টতা, চরিত্রহীনতা, অবাধ্যতা প্রভৃতি আভ্যন্তরীণ ত্রুটি ও কদর্যতার লেশমাত্রও তাদের মধ্যে পাওয়া যাবে না।

     পরিশেষে বলা হয়েছে যে, জান্নাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ভোগ-বিলাসের উপকরণসমূহকে যেন দুনিয়ার পতনশীল ও ক্ষীয়মান উপকরণসমূহের ন্যায় মনে না করা হয় যাতে যে কোন মুহূর্তে বিলুপ্তি ও ধ্বংসপ্রাপ্তির আশংঙ্কা থাকে। বরং জান্নাতবাসিগণ অনন্তকাল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের এই অফুরন্ত উপকরণসমূহ ভোগ করতঃ বিমল আনন্দস্ফূর্তি ও চরম তৃপ্তি লাভ করতে থাকবেন।

     আলোচ্য আয়াতে মু’মিনদের জান্নাতের সুসংবাদ লাভের জন্য ঈমানের সাথে সাথে সৎকাজেরও শর্ত আরোপ করা হয়েছে। তাই সৎকর্মহীন ঈমান মানুষকে এ সুসংবাদের অধিকারী করতে পারে না। যদিও কেবলমাত্র ঈমানই স্থায়ী দোযখবাস হতে অব্যাহতি প্রদান করতে পারে। সুতরাং মু’মিন যত পাপীই হোক না কেন, এক না এক কালে দোযখ থেকে মুক্তি লাভ করে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিন্তু সৎকাজ ভিন্ন কেউ দোযখের শাস্তি থেকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি লাভের অধিকারী হতে পারবে না। [রূহুল বায়ান]

     কয়েক আয়াত পূর্বে দাবী করা হয়েছে যে, কুরআন কারীমে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এ যে আল্লাহ্‌র বাণী এ সম্পর্কে কেউ যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করে, তবে তাকে কুরআনের ক্ষুদ্রতম সূরার অনুরূপ একটি সূরা প্রণয়ন করে পেশ করতে আহবান করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতসমূহে কুরআন অবিশ্বাসীদের এক অমূলক সন্দেহ বর্ণনাপূর্বক তা অপনোদন করা হয়েছে সন্দেহটি এই যে, কুরআন কারীমে মশা-মাছির ন্যায় তুচ্ছ বস্তুর আলোচনাও স্থান লাভ করেছে। বস্তুতঃ এটা মহান আল্লাহ্ ও তাঁর পবিত্র কালামের মর্যাদার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এ গ্রন্থ প্রকৃতই যদি আল্লাহ্‌র বাণী হতো, তবে এরূপ নিকৃষ্ট ও তুচ্ছ বস্তুর আলোচনা স্থান পেত না। কারণ, কোন মহান সত্তা এ ধরণের নগণ্য বস্তুর আলোচনা করতে লজ্জা ও অপমান বোধ করেন।

     প্রত্যুত্তরে বলা হয়েছে যে, কোন তুচ্ছ ও নগণ্য বস্তুর উপমা অনুরূপ নগণ্য বস্তুর মাধ্যমে দেয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও বিবেকসম্মত। এতদুদ্দেশে কোন ঘৃণ্য ও নগণ্য বস্তুর উল্লেখ সম্ভ্রম ও আত্মমর্যাদাবোধের মোটেও পরিপন্থি নয়। এ কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা এ ধরণের বস্তুসমূহের উল্লেখে মোটেও লজ্জাবোধ করেন না। সাথে সাথে এও ব্যক্ত করে দেয়া হয়েছে যে, এ ধরণের নির্বুদ্ধিতামূলক সন্দেহের উদ্রেক শুধু তাদের মনেই হতে পারে, যাদের মন-মস্তিস্ক আল্লাহ্‌দ্রোহিতার ফলে সম্পূর্ণ ভাবে বুদ্ধি-বিবেচনা ও অনুধাবনশক্তি বিবর্জিত হয়ে পড়েছে। মু’মিনদের মন-মস্তিস্কে এ ধরণের অবাস্তব সন্দেহের উদ্রেক কখনো হতে পারে না। অতঃপর এর অন্য এক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে যে, অনুরূপ উপমার মাধ্যমে মানুষের এক পরীক্ষাও হয়ে যায়, এসব দৃষ্টান্ত দূরদর্শী চিন্তাশীলদের জন্য যোগায় হিদায়াতের উপকরণ। আর চিন্তাশক্তি বিবর্জিত দুর্বিনীতদের পক্ষে অধিকতর পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরিশেষে এ কথাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, মহান কুরআনে বর্ণিত এসব উপমার দ্বারা এমন উদ্ধত ও অবাধ্যজনই বিপথগামী হয়, যারা আল্লাহ্‌ তা‘আলার সাথে কৃত অঙ্গীকার ভংগ করে এবং যেসব সম্পর্ক আল্লাহ্‌ তা‘আলা অক্ষুন্ন রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন, তারা তা ছিন্ন করে। যার পরিণামস্বরূপ ধরার বুকে অশান্তি বিস্তার লাভ করে।

উপমার ক্ষেত্রে কোন তুচ্ছ ও নগণ্য বস্তুর উল্লেখ দুষণীয় নয়:

إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَسۡتَحۡيِۦٓ أَن يَضۡرِبَ এ আয়াত দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, কোন প্রয়োজনীয় বিষয়ের বিশ্লষণ প্রসঙ্গে কোন নিকৃষ্ট, নগণ্য ও ঘৃণ্য বস্তুর উল্লেখ কোন ত্রুটি বা অপরাধ নয় কিংবা বক্তার মহানমর্যাদার পরিপন্থীও নয়। কুরআন, ‘হাদীস এবং প্রথম যুগের ‘উলামায়ে কেরাম ও প্রখ্যাত উসলাম বিশেষজ্ঞগণের বাণী ও রচনাবলীতে এ ধরনের বহু উপমার সন্ধান মেলে, যা সাধারণভাবে একবারেই তুচ্ছ ও নগণ্য বলে মনে হয়। কুরআন-’হাদীস এসব তথাকথিত লজ্জা ও সম্ভ্রমের তোয়াক্কা না করে প্রকৃত উদ্দেশ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে এরূপ উপমা বর্জন মোটেও বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেনি। يَنقُضُونَ عَهۡدَ ٱللَّهِ  (আল্লাহ্‌র সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে) এতে প্রমাণিত হয় যে, কোন অঙ্গীকার ভঙ্গ করা বা চুক্তি লঙ্ঘন করা জঘন্য অপরাধ। এর পরিণতিতে সে যাবতীয় পুণ্য থেকে বঞ্চিতও হয়ে যেতে পারে। وَيَقۡطَعُونَ مَآ أَمَرَ ٱللَّهُ بِهِۦٓ أَن يُوصَلَ (এবং আল্লাহ্‌ তা‘আলা যে সব সম্পর্ক অটুট রাখতে বলেছেন, তারা তা ছিন্ন করে)। এতে বুজা যায়, যে সব সম্পর্ক শরী’আত অক্ষুন্ন রাখতে বলেছে, তা বজায় রাখা একান্ত আবশ্যক এবং তা ছিন্ন করা সম্পূর্ণ ‘‘হারাম। গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, একজন মানুষের প্রতি আল্লাহ্‌র এবং অন্যান্য মানুষ তথা সমগ্র সৃষ্টিকুলের অধিকার ও প্রাপ্য আদায় করার নির্ধারিত পদ্ধতি ও তৎসংশ্লিষ্ট সীমা ও বাঁধানের সমষ্টির নামই দ্বীন বা ধর্ম। বিশ্বের শান্তি ও অশান্তি এসব সম্পর্ক যথাযথভাবে বজায় রাখা বা না রাখার উপরই রির্ভরশীল। এজন্যই وَيُفۡسِدُونَ فِي ٱلۡأَرۡضِۚ   (তারা ভুপৃষ্ঠে অশান্তির সৃষ্টি করে) বাক্যাংশের মাধ্যমে উল্লেখিত সম্পর্ক ক্ষুন্ন করাকেই বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হওয়ার একমাত্র কারণ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বস্তুতঃ এ হল যাবতীয় অশান্তি ও কলহের মূল কারণ। أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ (তারাই প্রকৃত প্রস্তাবে ক্ষতিগ্রস্ত।)-এ বাক্যের মাধ্যমে যারা উল্লেখিত নির্দেশাবলী অমান্য করবে তাদেরকে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পরকালের ক্ষতিই প্রকৃত ক্ষতি। সে তুলানায় পার্থিব ক্ষতি উল্লেখযোগ্য কোন বিষয়ই নয়।

     আলোচ্য আয়াত দ্বারা আল্লাহ্ তা‘আলার করুণা ও অনুগ্রহসমূহ বর্ণনার পর বিস্ময় প্রকাশ করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌র অগণিত দয়া ও সুখ-সম্পদে পরিবেষ্টিত থাকা সত্ত্বেও কেউ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ ও অবাধ্যতা প্রদর্শনে কিভাবে লিপ্ত থাকতে পারে! এতে বিশেষ জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, এসব প্রমাণাদি সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে চিন্তা করার জন্য প্রয়োজনীয় কষ্টটুকু স্বীকার করতে তারা যদি প্রস্তুত না থাকে, তবে অন্ততঃ দাতার দানের স্বীকৃতি এবং তার প্রতি যথাযোগ্য ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রদর্শন করা তো প্রত্যেক সভ্য ও রুচিজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের স্বাভাবিক ও অবশ্য কর্তব্য।

     প্রথম আয়াতে সেসব বিশেষ বিশেষ অনুগ্রহাদির বর্ণনা রয়েছে, যা মানুষের মূল সত্তার সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং যা প্রত্যেক মানুষের অভ্যন্তরে উপস্থিত। যথা-প্রথমাবস্থায় সে ছিল নিষ্প্রাণ অনুকণা, পরে তাতে আল্লাহ্ তা‘আলা প্রাণ সঞ্চার করেছেন।

     দ্বিতীয় আয়াতে সেসব সাধারণ অনুগহের বিবরণ রয়েছে, যদ্দ্বারা সমগ্র মানবজাতি ও গোটা সৃষ্টি যথাযথভাবে উপকৃত হয় এবং যা মানুষের টিকে থাকার জন্য একান্ত আবশ্যক। এসবের মধ্যে প্রথমে ভুমি ও তার উৎপন্ন ফসলের আলোচনা রয়েছে, যার সাথে মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। অতঃপর যে আসমানসমূহের সাথে ভুমির সজীবতা ও উৎপাদন ক্ষমতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সে গুলোর আলোচনা করা হয়েছে।

وَكُنتُمۡ أَمۡوَٰتٗا فَأَحۡيَٰكُمۡۖ  এখানে তোমরা ছিলে নিষ্প্রাণ। অতঃপর তিনিই তোমাদেরকে প্রাণ দিয়েছেন। এখানে أَمۡوَٰتٌ  শব্দটি مَيْتٌ এর বহুবচন। মৃত ও নিষ্প্রাণ বস্তুকে مَيْتٌ বলা হয়। আয়াতের মর্ম এই যে, মানুষ তার সৃষ্টির মূল উৎস সম্পর্কে নিবিষ্ট মনে চিন্তা করলে বুঝতে পারবে যে, সৃষ্টির সূচনা ঐ নিষ্প্রাণ অণুকণাসমূহ থেকেই হয়েছে, যা আংশিকভাবে জড়বস্তুর আকৃতিতে, আংশিকভাবে প্রবহমান বস্তুর আকৃতিতে এবং আংশিকভাবে খাদ্যের আকৃতিতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। মহান আল্লাহ্ সেসব ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত নিষ্প্রাণ অণুকণাসমূহকে বিভিন্ন স্থান থেকে একত্রিত করেছেন। অবশেষে সেগুলোতে প্রাণ সংযোগ করে জীবন্ত মানুষে রূপান্তরিত করেছেন। এ হলো মানব সৃষ্টির সূচনা পর্বের কথা।

         ثُمَّ يُمِيتُكُمۡ ثُمَّ يُحۡيِيكُمۡ (অনন্তর তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন আবার পুনরুজ্জীবিত করবেন।) অর্থাৎ-যিনি তোমাদের ইতস্তঃ বিক্ষিপ্ত অসংখ্য অণুকণা সমন্বয়ে তাতে প্রাণ সঞ্চার করেছেন, তিনিই মরজগতে তোমাদের আয়ুর নির্ধারিত কাল পেরিয়ে গেলে তোমাদের জীবনশিখা নিভিয়ে দেবেন এবং এক নির্ধারিত সময়ের পর ক্বিয়ামতের দিন তোমাদের দেহের নিষ্প্রাণ বিক্ষিপ্ত কণাগুলোকে আবার সমন্বিত করে তোমাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করবেন।

     প্রথম মৃত্যু হল তোমাদের সৃষ্টিধারায় সূচনাপর্বের, নিষ্প্রাণ ও জড় অবস্থা যা থেকে আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদেরকে জীবন দান করেছেন। আর দ্বিতীয় মুত্যু হল মরজগতে মানুষের আয়ু শেষ হয়ে যাওয়াকালীন মৃত্যু। বস্তুতঃ তৃতীয়বার জীবন লাভ হবে ক্বিয়ামতের দিন।

     মৃত্যু ও পুনরুজ্জীবনের মধ্যবর্তী সময়: আলোচ্য আয়াতে ইহলৌকিক জীবন ও মৃত্যুর পরবর্তী এমন এক জীবনের বর্ণনা রয়েছে, যার সূচনা হবে ক্বিয়ামতের দিন থেকে। কিন্তু যে কবরদেশের প্রশ্নোত্তর এবং পুরস্কার ও শাস্তির কথা কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াতে এবং বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ‘হাদীস দ্বারা প্রমাণিত- এখানে তার কোন উল্লেখ নেই। মানুষ ইহকালে যে জীবন লাভ করে এবং পরকালে যে জীবন লাভ করবে, ক্ববরের জীবন অনুরূপ কোন জীবন নয়, বরং তা কল্পনাময় স্থাপিক জীবনের মতই এক মধ্যবর্তী অবস্থা। একে ইহলৌকিক জীবনের পরিসমাপ্তি এবং পরলৌকিক জীবনের প্রারম্ভও বলা যেতে পারে। সুতরাং এটি এমন স্বতন্ত্র জীবন নয়, পৃথকভাবে যার আলোচনা করার প্রয়োজন থাকতে পারে।هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ جَمِيعٗا (তিনিই সে মহান আল্লাহ্ যিনি তোমাদের উপকারার্থে পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুসামগ্রী সৃষ্টি করেছেন।) এখানে এমন এক সাধারণ ও ব্যাপক অনুগ্রহের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যা শুধু মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমগ্র প্রাণীজগত সমভাবে এদ্বারা উপকৃত। এ জগতে মানুষ যত অনুগ্রহই লাভ করেছে বা করতে পারে সংক্ষেপে তা এই একটি শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। কেননা, মানুষের আহার-বিহার, পোশাক-পরিচ্ছদ, ওষুধ-পত্র বসবাস ও সুখ-স্বচ্ছন্দ্যের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপকরণ এ মাটি থেকেই উৎপন্ন ও সংগৃহীত হয়ে থাকে।

     জগতের কোন বস্তুই অহেতুক নয়: বিশ্বের সব কিছুই যে মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট, আলোচ্য আয়াতে এ তথ্যের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, পৃথিবীতে এমন কোন বস্তু নেই, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের উপকার সাধন করে না, তা সে উপকার ইহলৌকিক হোক, বা পরকাল সম্পর্কিত উপদেশ ও শিক্ষা সংক্রান্ত হোক। অনেক জিনিস সরাসরি মানুষের আহার ও ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে সেগুলোর উপকার সহজেই অনুধাবনযোগ্য। আবার এমনও অগণিত বস্তু রয়েছে, যার আবেদন ও উপকারিতা মানুষ অলক্ষ্যে ভোগ করে যাচ্ছে, অথচ তা অনুভব করতে পারছে না। এমনকি বিষাক্ত দ্রব্যাদি,বিষধর জীবজন্তু প্রভৃতি যেসব বস্তু দৃশ্যতঃ মানুষের পক্ষ্যে ক্ষতিকর বলে মনে করা হয়, গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝা যায়, সেগুলোও কোন না কোন দিক দিয়ে মানুষের জন্য কল্যাণকরও বটে। যেসব জন্তু একদিকে মানুষের জন্য ‘‘হারাম, অপরদিকে তদ্বারা তারা উপকৃতও হয়ে চলেছে।

     প্রখ্যাত সাধক আরিফ বিল্লাহ্ ইব্‌ন ‘আত্বা এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা সারা বিশ্বকে এ উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছেন যেন জগতের যাবতীয় বস্তু তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত থাকে; আর তোমরা যেন সর্বতোভাবে আল্লাহ্‌র আরাধনায় নিয়োজিত থাক। তবেই যেসব বস্তু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তোমরা তা নিঃসন্দেহে লাভ করবে। সুতরা বুদ্ধিমানের কাজ হবে সেসব বস্তুর অন্বেষণে ও সাধন চিন্তায় নিয়েজিত থেকে সে মহান সত্তাকে ভুলে না বসা, যিনি এগুলোর একক স্রষ্টা।

وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ خَلِيفَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَجۡعَلُ فِيهَا مَن يُفۡسِدُ فِيهَا وَيَسۡفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَۖ قَالَ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٠

৩০.আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদিগকে বললেনঃ আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতাগণ বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা নিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না।

وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلۡأَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبِ‍ُٔونِي بِأَسۡمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٣١

৩১.আর আল্লাহ্‌ তা‘আলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম। তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্য হয়ে থাক।

قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡحَكِيمُ ٣٢

৩২.তারা বলল, তুমি পবিত্র! আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে তুমি যা আমাদিগকে শিখিয়েছ (সেগুলো ব্যতীত) নিশ্চয় তুমিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, ‘হিকমাহ/‘হিকমাত/’হিকমাহ/‘হিকমাত/হেকমতওয়ালা।

قَالَ يَٰٓـَٔادَمُ أَنۢبِئۡهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡۖ فَلَمَّآ أَنۢبَأَهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡ قَالَ أَلَمۡ أَقُل لَّكُمۡ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ غَيۡبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَأَعۡلَمُ مَا تُبۡدُونَ وَمَا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٣٣

৩৩.তিনি বললেন, হে আদম, ফেরেশতাদেরকে বলে দাও এসবের নাম। তারপর যখন তিনি বলে দিলেন সে সবের নাম, তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আসমান ও যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভাল করেই অবগত রয়েছি? এবং সেসব বিষয়ও জানি যা তোমরা প্রকাশ কর, আর যা তোমরা গোপন কর!

وَإِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ ٱسۡجُدُواْ لِأٓدَمَ فَسَجَدُوٓاْ إِلَّآ إِبۡلِيسَ أَبَىٰ وَٱسۡتَكۡبَرَ وَكَانَ مِنَ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٤

৩৪.এবং যখন আমি হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে সেজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখনই ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করলো। সে (নির্দেশ) পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।

وَقُلۡنَا يَٰٓـَٔادَمُ ٱسۡكُنۡ أَنتَ وَزَوۡجُكَ ٱلۡجَنَّةَ وَكُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَيۡثُ شِئۡتُمَا وَلَا تَقۡرَبَا هَٰذِهِ ٱلشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٣٥

৩৫.এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং ওখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাক, কিন্তু এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। অন্যথায় তোমরা যালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়বে।

فَأَزَلَّهُمَا ٱلشَّيۡطَٰنُ عَنۡهَا فَأَخۡرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِۖ وَقُلۡنَا ٱهۡبِطُواْ بَعۡضُكُمۡ لِبَعۡضٍ عَدُوّٞۖ وَلَكُمۡ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُسۡتَقَرّٞ وَمَتَٰعٌ إِلَىٰ حِينٖ ٣٦

৩৬.অনন্তর শয়তান তাদের উভয়কে ওখান থেকে পদস্খলিত করেছিল। পরে তারা যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে দিল এবং আমি বললাম, তোমরা নেমে যাও। তোমরা পরস্পর একে অপরের শক্র হবে এবং তোমাদেরকে সেখানে কিছুকাল অবস্থান করতে হবে ও লাভ সংগ্রহ করতে হবে।

فَتَلَقَّىٰٓ ءَادَمُ مِن رَّبِّهِۦ كَلِمَٰتٖ فَتَابَ عَلَيۡهِۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ٣٧

৩৭.অতঃপর হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) স্বীয় পালনকর্তার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিলেন, অতঃপর আল্লাহ্‌ পাক তাঁর প্রতি (করুণাভরে) লক্ষ্য করলেন। নিশ্চয়ই তিনি মহা-ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

এ আয়াতের সারসংক্ষেপ এই-মহান পরওয়ারদেগার আল্লাহ্ তা‘আলা যখন আদম (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-কে সৃষ্টি করেন এবং বিশ্বে তাঁর খেলাফত প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা করেন, তখন এ সম্পর্কে ফেরেশতাদের পরীক্ষা নেয়ার জন্য তাঁর এ ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এতে ইঙ্গিত ছিল যে, তাঁরা যেন এ ব্যাপারে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করেন। কাজেই ফেরেশতাগণ অভিমত প্রকাশ করলেন যে, মানব জাতির মাঝে এমনও অনেক লোক হবে, যারা শুধু বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে। সুতরাং এদের উপর খেলাফত ও শৃংখলা বিধানের দায়িত্ব অর্পণের হেতু তাঁদের পুরোপুরি বোদগম্য নয়। এ দায়িত্ব পালনের জন্য ফেরেশতাগণই যোগ্যতম বলে মনে হয়। কেননা, পুণ্য ও সততা তাঁদের প্রকৃতিগত গুণ। তাঁদের দ্বারা পাপ ও অকল্যাণ সাধন আদৌ সম্ভব নয়-তাঁরা সদা অনুগত। এ জগতের শাসনকার্য পরিচালনা ও শৃংখলা বিধানের কাজও হয়তো তাঁরাই সুষ্ঠূভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন। তাঁদের এ ধারণা যে ভুল ও অমূলক, তা আল্লাহ্ তা‘আলা শাসকোচিত ভংগীতে বর্ণনা করে বলেন যে, বিশ্ব খেলাফতের প্রকৃতি ও আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তোমরা মোটেও ওয়াকেফহাল বা অবগত নও। তা কেবল আমিই পূর্ণভাবে পরিজ্ঞাত।

     অতঃপর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে ফেরেশতাদের উপর হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অনুপম মর্যাদার বর্ণনা দিয়ে দ্বিতীয় উত্তরটি দেয়া হয়েছে যে, বিশ্ব খেলাফতের জন্য ভূ-পৃষ্ঠের অন্তর্গত সৃষ্ট বস্তুসমূহের নাম, গুণাগুণ, বিস্তারিত অবস্থা ও যাবতীয় লক্ষণাদি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা একান্ত আবশ্যক। বস্তুতঃ ফেরেশতাগণের এ যোগ্যতা ও গুণাবলী নেই।

আদম সৃষ্টি প্রসংগে ফেরেশতাদের সাথে আলোচনার তাৎপর্য:

একথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, ফেরেশতাদের সমাবেশে আল্লাহ্ তা‘আলার এ ঘটনা প্রকাশ করার তাৎপর্য কি এবং এতে কি উদ্দেশ্য নিহিত ছিল? তাঁদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ, না তাদেরকে এ সম্পর্কে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করানো?

     একথা সুস্পষ্ট যে, কোন বিষয় বা সমস্যা সম্পর্কে পরামর্শের প্রয়োজনীয়তা তখনই দেখা দেয়, যখন সমস্যার সমস্ত দিক কারো কাছে অস্পষ্ট থাকে; নিজস্ব অভিজ্ঞান ও জ্ঞান সম্পর্কে পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা না থাকে। আর তখনই কেবল অন্যান্য জ্ঞানী-গুনীদের সাথে পরামর্শ করা হয়। অথবা পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সেখানেও হতে পারে, যেখানে অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ সমঅধিকার সমপন্ন হয়। তাই তাদের অভিমত জানার উদ্দেশ্যে পরামর্শ করা হয়। যেমনটি বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের সাধারণ পরিষদসমূহে প্রচলিত। কিন্তু একথা সুস্পষ্ট যে, এ দু’টোর কোনটাই এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা গোটা বস্তুজগতের স্রষ্টা এবং প্রতিটি বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কে তাঁর পরিপূর্ণ জ্ঞান রয়েছে। তাঁর প্রজ্ঞা ও দুরদর্শিতার সামনে প্রকাশ্য  অপ্রকাশ্য, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সবকিছুই সমান। তাই তাঁর পক্ষে কারো সাথে পরামর্শ করার কি প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে।

     অনুরূপভাবে এখানে এমনও নয় যে, সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত, যেখানে প্রত্যেক সদস্য সমঅধিকার সম্পন্ন বলে প্রত্যেকের পরামর্শ গ্রহণ করা আবশ্যক হতে পারে। কেননা, আল্লাহ্ তা‘আলাই সবকিছুর স্রষ্টা ও মালিক। ফেরেশতা ও মানব-দানব সবই তাঁর সৃষ্টি এবং সবই তাঁর আয়ত্তাধীন। তাঁর কোন কাজ বা পদক্ষেপ সম্পর্কে কারো কোন প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই যে, এ কাজ কেন করা হলো বা কেন করা হলো না।

         لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ আল্লাহ্ তা‘আলার কাজ সম্পর্কে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই, কিন্তু অন্যান্য সবাইকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

     সারকথা, প্রকৃত প্রস্তাবে এখানে পরামর্শ গ্রহণ উদ্দেশ্যও নয় এবং এর কোন আবশ্যকতাও ছিল না। কিন্তু রূপ দেয়া হয়েছে পরামর্শ গ্রহণের যাতে মানুষ পরামর্শরীতি এবং তার প্রয়োজনীয়তার শিক্ষা লাভ করতে পারে। যেমন কুরআন কারীমে রসূলে কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে বিভিন্ন কাজে ও ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, অথচ তিনি ছিলেন ও‘হীর বাহক। তাঁর সব কাজকর্ম এবং তাঁর প্রত্যেক অধ্যায় ও দিক ও‘হীর মাধ্যমেই বিশ্লষণ করে দেয়া হতো। কিন্তু তাঁর মাধ্যমে পরামর্শ গ্রহণ রীতির প্রচলন করা এবং উম্মতকে তা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে তাঁকেও পরামর্শ গ্রহণের তাকীদ দেয়া হয়েছে।

     যেহেতু হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর মাঝে ফেরেশতা ও জ্বিন উভয় সম্প্রদায়ের যাবতীয় জ্ঞানের সমাহার ঘটেছে, সুতরাং উভয় সম্প্রদায়ের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চ পদমর্যাদা একেবারে সুস্পষ্ট। এখন আল্লাহ্ তা‘আলা এ বিষয়টি কার্যকরভাবে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করলেন যে, ফেরেশতা ও জ্বিনদের দ্বারা হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর প্রতি এমন বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করানো হোক, যদ্দ্বারা কার্যতঃ স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনি তাদের উভয়ের চাইতে উত্তম ও পূর্ণতর। এ জন্য যে সম্মান প্রদর্শনমূলক কাজের প্রস্তাব করা হয়েছে, তারই বর্ণনা প্রসংগে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, “আমি ফেরেশতাদেরকে হুকুম করলাম, তোমরা আদমকে সেজদা কর। সমস্ত ফেরেশতা সেজদায় পতিত হল, কিন্তু ইবলীস সেজদা করতে অস্বীকার করলো এবং অহঙ্কারে স্ফীত হয়ে উঠলো।”

     সেজদার নির্দেশ কি জ্বিনদের প্রতিও ছিল? এ আয়াতে বাহ্যতঃ যে কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তা এই যে, আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে সেজদা করার হুকুম ফেরেশতাদেরকে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে যখন একথা বলা হলো যে, ইবলীস ব্যতীত সব ফেরেশতাই সেজদা করলেন, তখন তাতে প্রামণিত হলো যে, সেজদার নির্দেশ সকল বিবেকসম্পন্ন সৃষ্টির প্রতিই ছিল। ফেরেশতা ও জ্বিন সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু নির্দেশ প্রদান করতে গিয়ে শুধু ফেরেশতাগণের উল্লেখ এজন্য করা হলো যে, তারাই ছিল সর্বোত্তম ও সর্বশ্যেষ্ঠ। যখন তাদেরকে হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়া হলো, তাতে জ্বিন জাতি অতি উত্তম রূপে এ নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত বলে জানা গেল।

     সম্মানসূচক সেজদা ইসলামে নিষিদ্ধ: এ আয়াতে হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে সেজদা করতে হযরত ইউসুফ (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর পিতা-মাতা ও ভাইগণ মিশর পৌঁছার পর হযরত ইউসুফকে সেজদা করেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। এটা ব্যতীত অপরের উপাসনা শির্‌ক্ ও কুফরী। কোন কালে কোন শরী’আতে এরূপ কাজের বৈধতার কোন সম্ভাবনাই থাকতে পারে না। সুতরাং এ অর্থ এছাড়া অন্য কোন কিছুই হতে পারে না যে, প্রাচীন কালের সেজদা আমাদের কালের সালাম, মুসাফা‘হা, মু‘আনাকা, হাতে চুমো খাওয়া এবং সম্মান প্রদর্শনার্থে দাঁড়িয়ে যাওয়ার সমার্থক ও সমতুল্য ছিল। ইমাম জাস্‌সাস আ`হাকামুল্ কুরআন গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, পূর্ববর্তী নবীগণের শরী’আতে বড়দের প্রতি সম্মানসূচক সেজদা করা বৈধ ছিল। শরী’আতে মু’হাম্মাদীতে তা রহিত হয়ে গেছে। বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পদ্ধতি হিসেবে এখন শুধু সালাম ও মুসাফা’হার অনুমতি রয়েছে। রুকূ’-সেজদা এবং স্বলাত/নামাযের মত করে হাত বেঁধে দাঁড়ানোকে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

     এর বিশ্লেষণ এই যে, শির্‌ক্, কুফ্‌র্ এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো ‘ইবাদত করা কোন শরী’আতেই বৈধ ছিল না। কিন্তু কিছু কিছু কাজ এমনও রয়েছে, যা মূলতঃ শির্‌ক্ বা কুফ্‌র্ নয়। কিন্তু মানুষের অজ্ঞানতা ও অসাবধানতার দারুন সে সমস্ত কার্যাবলী শির্‌ক্ ও কুফ্‌রের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এসব কার্যাবলী পুর্ববর্তী নবীগণের শরী’আতে আদৌ নিষিদ্ধ ছিল না। বরং সেগুলোকে শির্‌ক্‌রূপে প্রতিপন্ন করা থেকে মানুষকে বিরত রাখা হত মাত্র। যেমন, প্রাণীদের ছবি আঁকা ও ব্যবহার করা মূলতঃ কুফ্‌র্ বা শির্‌ক্ নয়। এজন্য পূর্ববর্তী শরী’আতে তা বৈধ ছিল। যেমন, হযরত সুলাইমান (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে يَعۡمَلُونَ لَهُۥ مَا

يَشَآءُ مِن مَّحَٰرِيبَ وَتَمَٰثِيلَ (এবং জ্বিনেরা তার জন্য বড় বড় মি’হরাব তৈরী করতো এবং ছবি অঙ্কন করতো)।অনুরূপভাবে সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে সেজদা করা পূর্ববর্তী শরী’আতসমূহে বৈধ ছিল, কিন্তু পরবর্তী কালে মানুষের অজ্ঞানতার ফলে এ সব বিষয়ই শির্‌ক্ ও পৌত্তলিকতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পথেই নবীগণের দ্বীন ও শরী’আতে বিকৃতি ও মূলচ্যুতি ঘটেছে। পরবর্তী নবী ও শরী’আত এসে তা একবারে বিলূপ্ত করে দিয়েছে। শরী’আতে মু’হাম্মাদী যেহেতু অবিনশ্বর ও চিরন্তন শরী’আত- রসূলে কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মাধ্যমে যেহেতু নবুওয়াত ও রিসালতের পরিসমাপ্তি ঘটেছে এবং তাঁর শরী’আতই যেহেতু একে বিকৃতি ও মূলচ্যুতি থেকে বাঁচাবার জন্য এমন প্রতিটি ছিদ্রপথই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যাতে শির্‌ক্ ও পৌত্তলিকতা প্রবেশ করতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সেসব বিষয়ই এ শরী’আতে ‘‘হারাম করে দেয়া হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কোন যুগে শির্‌ক্ ও মুর্তি পূজার উৎস বা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ছবি ও চিত্রাঙ্কন এবং তার ব্যবহারও এজন্যই ‘‘হারাম করা হয়েছে। সম্মানসূচক সেজদা একই কারণে ‘‘হারাম হয়েছে। আর এমন সব সময়ে স্বলাত/নামায পড়াও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, যে সব সময়ে মুশরিক ও কাফিরগণ নিজেদের তথাকথিত উপাস্যদের পুজা ও উপাসনা করত। কারণ, এ বাহ্যিক সাদৃশ্য পরিণামে যেন শির্‌কের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়।

     কোন কোন ‘আলেম বলেছেন, ‘ইবাদতের মূল যে স্বলাত/নামায, তাতে চার রকমের কাজ রয়েছে। যথা-দাঁড়ানো, বসা, রুকূ’ ও সেজদা করা। তন্মধ্যে প্রথম দু’টি মানুষ অভ্যাসগতভাবে নিজস্ব প্রয়োজনেও করে এবং স্বলাত/নামাযের মধ্যে ‘ইবাদত হিসেবেও করে। কিন্তু রুকূ’-সেজদা এমন কাজ, যা মানুষ কখনো অভ্যাসগতভাবে করে না, বরং তা শুধু ‘ইবাদতের জন্যই নির্দিষ্ট। এ জন্য এ দু’টোকে শরী’আতে মু’হাম্মাদীতে ‘ইবাদতের পর্যায়ভুক্ত করে আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো উদ্দেশ্যে তা করা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।

     এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, সেজদায়ে তা’য্বীমী বা সম্মানসূচক সেজদার বৈধতার প্রমাণ তো কুরআন কারীমে উল্লেখিত আয়াতসমূহে পাওয়া যায়, কিন্তু তা রহিত হওয়ার দলীল কি?

     উত্তর এই যে, রসূলে কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অনেক ‘মোতাওয়াতির’ ও মশহুর বা প্রসিদ্ধ ‘হাদীস দ্বারা সেজদায়ে তা’য্বীমী ‘‘হারাম বলে প্রমাণিত হয়েছে। রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, “যদি আমি আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো প্রতি সেজাদয়ে তা’য্বীমী করা জায়েয মনে করতাম, তবে স্বামীকে সেজদা করার জন্য স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম, কিন্তু এই শরী’আতে সেজদায়ে তা’য্বীমী সম্পুর্ণ ‘‘হারাম বলে কাউকে সেজদা করা কারো পক্ষে জায়েয নয়।”

     এই ‘হাদীসটি বিশ জন সা’হাবীর রেওয়ায়েত থেকে প্রমাণিত। প্রসিদ্ধ গ্রন্থ তাদরীবুররাবী-তে বর্ণনা করা হয়েছে, যে রেওয়ায়েত দশ জন সা’হাবী নকল করে থাকেন, সেটি ‘হাদীসে মোতাওয়াতিরের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায় যা (‘হাদীসে মোতাওয়াতির) কুরআন কারীমের ন্যায়ই অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য।

     এটা আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর ঘটনার সমাপ্তিপর্ব। এখানে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ফেরেশতাদের উপর হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও বিশ্ব খিলাফতের যোগ্যতা যখন স্পষ্ট করে বলে দেয়া হলো এবং ফেরেশতাগণও তা মেনে নিলেন আর ইবলীস যখন আত্মম্ভরিতা ও হঠকারিতার দরুন কাফির হয়ে বেরিয়ে গেল, তখন হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) এবং তাঁর সহধর্মিনী হাওয়া (‘আলাহাচ্ছালাম) এ নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন যে, তোমরা জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং সেখানকার নিয়ামত/না’মত পরিতৃপ্তিসহ ভোগ করতে থাকো। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট গাছ সম্পর্কে নির্দেশ দেয়া হলো যে, এর ধারে কাছেও যেও না। অর্থাৎ, সেটির ভোগ পূর্ণভাবে পরিহার করবে। শয়তান আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর কারণে ধিকৃত ও অভিশপ্ত হয়েছিল, সুতরাং সে কোন প্রকারে সুযোগ পেয়ে এবং এ গাছের উপকারাদি বর্ণনা করে তাঁদের উভয়কে সে গাছের ফল খেতে প্ররোচিত করল। নিজেদের বিচ্যুতির দরুন তাঁদেরকেও পৃথিবীতে নেমে যেতে নির্দেশ দেয়া হলো। তাঁদেরকে বলে দেয়া হলো যে, পৃথিবীতে বসবাস জান্নাতের মত নির্ঝঞ্জাট ও শান্তিপূর্ণ হবে না, বরং সেখানে মতানৈক্য ও শত্রুতার উন্মেষ ঘটবে। ফলে বেঁচে থাকার স্বাদ পূর্ণভাবে লাভ করতে পারবে না।

         وَقُلۡنَا يَٰٓـَٔادَمُ ٱسۡكُنۡ أَنتَ وَزَوۡجُكَ ٱلۡجَنَّةَ [এবং আমি আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে সস্ত্রীক জান্নাতে অবস্থান করতে নির্দেশ দিলাম]। এটা আদম সৃষ্টি ও ফেরেশতাদের সেজদার পরবর্তী ঘটনা। কোন কোন বিশেষজ্ঞ এ নির্দেশ থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আদম সৃষ্টি ও সেজদার ঘটনা জান্নাতের বাইরে অন্য কোথাও ঘটেছিল। এর পরে তাদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করানো হয়েছে। কিন্তু এ অর্থও সুনিশ্চিত নয়। বরং এমনও হতে পারে যে, সৃষ্টি ও সেজদা উভয় ঘটনা বেহেশতেই ঘটেছিল, কিন্তু তাঁদের বাসস্থান কোথায় হবে সে সম্পর্কে তাঁদেরকে কোন সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। তাঁদের বাসস্থান সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত এ ঘটনার পর শোনানো হলো।

         وَكُلَا مِنۡهَا رَغَدًا حَيۡث شِئۡتُمَا  … رَغَدًا ‘আরবী অভিধান অনুযায়ী সেসব নিয়ামত/না’মত ও আহার্যবস্তুকে বলা হয়, যা লাভ করতে কোন শ্রম সাধনার প্রয়োজন হয় না এবং এত পর্যাপ্ত ও ব্যাপক পরিমাণে লাভ হয় যে, তাতে হ্রাসপ্রাপ্তি বা নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার কোন আশঙ্কাই থাকে না। অর্থাৎ, আদম ও হাওয়া (‘আলাইহিমাচ্ছালাম)-কে বলা হলো যে, তোমরা জান্নাতের ফল-মুল পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবহার করতে থাক। ওগুলো লাভ করতে হবে না এবং তা হ্রাস পাবে কিংবা শেষ হয়ে যাবে, এমন কোন চিন্তাও করতে হবে না।

         فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ কোন বিশেষ গাছের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছিল যে, এর ধারে কাছেও যেও না। প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, সে গাছের ফল না খাওয়া। কিন্তু তাকীদের (কোন কাজ বা কথার প্রতি জোর দেয়া) জন্য বলা হয়েছে, কাছেও যেও না। সেটি কি গাছ ছিল, কুরআন কারীমে তা উল্লেখ করা হয়নি। কোন নির্ভযোগ্য ও বিশুদ্ধ ‘হাদীস দ্বারাও তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। কোন কোন মুফাস্‌সির সেটিকে গমের গাছ বলেছেন, আঞ্জীরের গাছ। কিন্তু কুরআন ও ‘হাদীসে যা অনির্দিষ্ট রেখে দেয়া হয়েছে, তা নির্দিষ্ট করার কোন প্রয়োজন পড়ে না।

         فَتَكُونَا مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ অর্থাৎ, যদি এই নিষিদ্ধ গাছের ফল খাও, তবে তোমরা উভয়েই যালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে।

         فَأَزَلَّهُمَا ٱلشَّيۡطَٰنُ عَنۡهَا … زَلَّة শব্দের অর্থ বিচ্যুতি বা পদস্খলন। অর্থাৎ, শয়তান আদম ও হাওয়াকে পদস্খলিত করেছিল বা তাঁদের বিচ্যুতি ঘটিয়েছিল। কুরআনের এসব শব্দে পরিস্কার একথা বোঝা যায় যে, আদম ও হাওয়া কর্তৃক আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুম লঙ্ঘন সাধারণ পাপীদের মত ছিল না, বরং শয়তানের প্রতারণায় প্রতারিত হয়েই তাঁরা এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পরিণামে যে গাছের ফল নিষিদ্ধ ছিল, তা খেয়ে বসলেন।

মাধ্যমসমূহ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়: وَلَا تَقۡرَبَا هَٰذِهِ ٱلشَّجَرَةَ

অর্থাৎ, ‘এ গাছের ধারে-কাছেও যেও না’। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে একথা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, সে বৃক্ষের ফল না খাওয়া ছিল এই নিষেধাজ্ঞার প্রকৃত উদ্দেশ্য। কিন্তু সাবধানতা সূচক নির্দেশ ছিল এই যে, সে গাছের কাছেও যেও না। এর দ্বারাই ফিক্বহ্‌শাস্ত্রে কারণ-উপকরণের নিষিদ্ধতার মাসআলাটি প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ, কোন বস্তু নিজস্বভাবে অবৈধ বা নিষিদ্ধ না হলেও যখন তাতে এমন আশঙ্কা থাকে যে, ঐ বস্তু গ্রহণ করলে অন্য কোন ‘‘হারাম ও অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে, তখন ঐ বৈধ বস্তুও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। যেমন, গাছের কাছে যাওয়া তার ফল-ফসল খাওয়ার কারণও হতে পারতো। সেজন্য তাও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। একে ফিক্বহ্‌শাস্ত্রের পরিভাষায় উপকরণের নিষিদ্ধতা বলা হয়।

     নবীগণের নিস্পাপ হওয়া: এ বর্ণনার দ্বারা হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে বিশেষ গাছ বা তার ফল খেতে নিষেধ করা হয়েছিল এবং এ ব্যাপারেও সাবধান করে দেয়া হয়েছিল যে, শয়তান তোমাদের শত্রু। কাজেই সে যেন তোমাদেরকে পাপে লিপ্ত করে না দেয়! এতদসত্ত্বেও হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর তা খাওয়া বাহ্যিকভাবে পাপ বলে গণ্য। অথচ নবীগণ পাপ থেকে মুক্ত ও পরিশুদ্ধ থাকার কথা যুক্তি-বুদ্ধির দ্বারা এবং লিখিত ও বর্ণনাগতভাবে প্রমাণিত। চার ইমাম ও উম্মতের সম্মিলিত অভিমতওে নবীগণ ছোট-বড় যাবতীয় পাপ থেকে মুক্ত ও পবিত্র। কারণ নবীগণ (‘আলাইহিমুচ্ছালাম)-কে গোটা মানব জাতির অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছিল। যদি তাদের দ্বারাও আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছার পরিপন্থী ছোট বড় কোন পাপ কাজ সম্পন্ন হত, তবে নবীগণের বাণী ও কার্যাবলীর উপর আস্থা ও বিশ্বাস উঠে যেত। যদি নবীগণের উপর আস্থা ও বিশ্বাস না থাকে, তবে দ্বীন ও শরী’আতের স্থান কোথায়? অবশ্য কুরআন কারীমের বহু আয়াতে অনেক নবী (‘আলাইহিমুচ্ছালাম) সম্পর্কে এ ধরনের ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, যাতে প্রতীয়মান হয় যে, তাঁদের দ্বারা পাপ সংঘটিত হয়েছে এবং আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে এজন্য তাঁদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর ঘটনাও এ শ্রেণীমুক্ত।

     এ ধরনের ঘটনাবলী সম্পর্কে উম্মতের সর্বসম্মত অভিমত এই যে, কোন ভূল বুঝাবুঝি বা অনিচ্ছাকৃত কারণে নবীদের দ্বারা এ ধরনের কাজ সংঘটিত হয়ে থাকবে। কোন নবী (‘আলাইহিমুচ্ছালাম) জেনে শুনে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুমের পরিপন্থী কোন কাজ করেননি। এ ত্রুটি ইজতিহাদগত ও অনিচ্ছাকৃত এবং তা ক্ষমার যোগ্য। শরী’আতের পরিভাষায় একে পাপ বলা চলে না এবং এ ধরনের ভ্রান্তিজনক ও অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি সেসব বিষয়ে হতেই পারে না, যার সম্পর্ক শিক্ষা-দীক্ষা এবং শরী’আতের প্রচারের সাথে রয়েছে, বরং তাঁদের ব্যক্তিগত কাজ-কর্মে এ ধরনের ভূলত্রুটি হতে পারে।

     কিন্তু যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে নবীগণের স্থান ও মর্যাদা অত্যন্ত উচ্চে এবং যেহেতু মহান ব্যক্তিবর্গের দ্বারা ক্ষুদ্র ত্রুটি বিচ্যুতি সংঘটিত হলেও তাকে অনেক বড় মনে করা হয়, সেহেতু কুরআন ‘হাকীমে এ ধরনের ঘটনাবলীকে অপরাধ ও পাপ বলে অভিহিত করা হয়েছে, যদিও প্রকৃতপক্ষে সেগুলো আদৌ পাপ নয়।

     হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর এ ঘটনা সম্পর্কে তাফসীরবিদগণ বহু কারণ বর্ণনা করেছেন এবং বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন:

          ১. হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে যখন নিষেধ করা হয়েছিল, তখন এক নির্দিষ্ট গাছের প্রতি ইঙ্গিত করেই তা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে শুধুমাত্র সে গাছটিই উদ্দেশ্যে ছিল না, বরং সে জাতীয় যাবতীয় গাছই এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেমন, ‘হাদীসে বর্ণিত আছে যে, একদিন রসূলুল্ল-হ্‌ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক খন্ড রেশমী কাপড় ও এক খন্ড স্বর্ণ হাতে নিয়ে ইরশাদ করলেন, এ বস্তু দু’টি আমার উম্মতের পুরুষদের জন্যে ‘‘হারাম। একথা সুস্পষ্ট যে, ঐ বিশেষ কাপড় ও স্বর্ণখন্ডের ব্যবহারই শুধু ‘‘হারাম ছিল না,  যে দু’টি রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাতে ছিল বরং যাবতীয় রেশমী কাপড় ও স্বর্ণ সম্পর্কেই ছিল এ হুকুম। ন্তিু এখঅনে হয়তো এ ধারণাও হতে পারে যে, এ নিষেধাজ্ঞার সম্পর্ক সেই বিশেষ কাপড় ও স্বর্ণখন্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যেগুলো সে সময় তাঁর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাতে ছিল। অনুরূপভঅবে হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর হয়তো  এ ধারণা হয়েছিল যে, যে গাছের প্রতি ইঙ্গিত করে নিষেধ করা হয়েছিল, এ নিষেধের সম্পর্ক ঐ বিশেষ গাছটিতেই  সীমাবদ্ধ। শয়তান এ ধঅরণা তাঁর অন্তরে সঞ্চার করে বদ্ধমূল করে দিয়েছিল এবং ক্বসম খেয়ে খেয়ে বিশ্বাস জন্মালো যে, ‘আমি তোমাদের হিতাকাঙ্খী, তোমাদেরকে এমন কোন কাজের পরামর্শ দিচ্ছি না, যা তোমাদের পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে। যে গাছ সম্পর্কে নিষেধ করা হয়েছে, সেটি অন্য গাছ।’

     তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, শয়তান এ প্রবঞ্চনা তাঁর অন্তঃকরণে সঞ্চারিত করেছিল যে, এ গাছ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা আপনার সৃষ্টির সূচনা পর্বের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। যেমন, সদ্যজাত শিশুকে জীবনের প্রথম পর্যায়ে শক্ত ও গুরুপাক আহার থেকে বিরত রাখা হয়। কিন্তু সময় ও শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে সব ধরনের আহার্য গ্রহণেরই অনুমতি দিয়ে দেয়া হয়। সুতরাং আপনি এখন শক্ত-সমর্থ হয়েছেনড় এখন সে বিধি-নিষেধ কার্যকর নয়।

     আবার এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, শয়তান যখন হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছাল্লাম)-কে সে গাছের উপকারিতা ও গুণাবলীর বর্ণনা দিচ্ছিল, যেমন- সে গাছের ফল খেলে আপনি অনন্তকাল নিশ্চিন্তে জান্নাতের নি’আমতাদি ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতে পারবেন, তখন তাঁর সৃষি।টর প্রথম পর্বে সে গাছ সম্পর্কে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথঅ তাঁর মনে ছিল না। কুরআন কারীমের فَنَسِيَ وَلَمۡ نَجِدۡ لَهُۥ عَزۡمٗا (অর্থাৎ, আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) ভুলে গেলেন এবং আমি তাঁর মধ্যে (সংকল্পের) দৃঢ়তা পাইনি।) আয়াতও এ সম্ভাব্যতা সমর্থন করে।

     যাহোক, এ ধরনের বহু সম্ভাবনা থাকতে পারে। তবে সারকথা এই যে, হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) বুঝে-শুনে, ইচ্ছাকৃতভাবে এ হুকুম অমান্য করেননি, বরং তাঁর দ্বারা ভুল হয়ে গিয়েছিল বা ইজতিহাদগত বিচ্যুতি ঘটেছিল, যা প্রকৃতপক্ষে কোন পাপ নয়। কিন্তু হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর শানে-নবুওয়াত এবং আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে তাঁর উচ্চ মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে এই বিচ্যুতিকেও যথেষ্ট বড় মনে করা হয়েছিল। আর কুরআন কারীম সেজন্যই একে পাপ বলে অভিহিত করেছে। অবশ্য আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার পর তা ক্ষমা করে দেয়ার বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

     এ বিতর্ক অনাবশ্যক যে, শয়তান জান্নাত থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আদম (‘আলাইহিচ্ছালা)-কে প্রতারিত করার জন্য কিভাবে আবার সেখানে প্রবেশ করল? কারণ, শয়তানের প্রবঞ্চনার জন্যে জান্নাতে প্রবেশের কোন প্রয়োজন নেই। কেননা, আল্লাহ্ তা‘আলা শয়তান ও জ্বিন জাতিকে দূর থেকেও প্রবঞ্চনা ও প্রতারণা করার ক্ষমতা দিয়েছেন।অনুরূপভাবে এ প্রশ্ন যে, হযরত আদম ও হাওয়া (‘আলাইহিমাচ্ছালাম)-কে পুর্বাহ্নেই সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল যে, শয়তান তোমাদের শত্রু। সুতরাং তোমাদেরকে দিয়ে যেন এমন কোন কাজ করিয়ে না বসে, যে কারণে তোমাদেরকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত হতে হয়। এতদসত্ত্বেও হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) শয়তান কর্তৃক কেমন করে প্রতারিত হলেন? উত্তরে বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা জ্বিন ও শয়তানকে বিভিন্ন আকার অবয়বে আত্মপ্রকাশের শক্তি দিয়েছেন। হতে পারে, সে এমন রূপ ধারণ করে সামনে এসেছিল যে, হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) বুঝতেই পারেনি যে, সে’ই শয়তান।

     হযরত আদম হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) ইতিপূর্বে কখনও এ ধরনের শাসন ও কোপদৃষ্টির সম্মুখীন হননি। তিনি এমন পাষাণচিত্তও ছিলেন না যে, বেমালুম সয়ে যেতে পারেন। তাই চরমভাবে বিচলিত হয়ে মনে মনে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে লাগলেন। কিন্তু নবিসুলভ প্রাজ্ঞদৃষ্টি এবং সে কারণে চরমভাবে সঞ্চারিত ভীতির দরুন মুখ থেকে কোন কথঅই বের হচ্ছিল না। ক্ষমা-ভিক্ষা মর্যাদার পরিপন্থী বিবেচিত হয়ে অধিক শঅন্তি ও কোপনলের কারণ রূপে পরিগণিত হতে পারে এমন আশঙ্কায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় ও হতবাক হয়ে বসে থাকেন মহান আল্লাহ্ অন্তর্যামী এবং অত্যন্ত দয়ালু ও করুণাময়। এ কারুণ অবস্থা দেখে আল্লাহ্ তা‘আলা নিজেই ক্ষমা প্রার্থনারীতি সম্বলিত কয়েকটি বচন তাঁদেরকে শিখিয়ে দিলেন। তারই বর্ণনা এ আয়াতসমূহে দেয়া হয়েছে বলা হয়েছে যে, হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) স্বীয় প্রভুর কাছ থেকে কয়েকটি শব্দ লাভ করলেন। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁদের প্রতি করুণাভরে লক্ষ করলেন। (অর্থাৎ, তাঁদের তাওবা গ্রহণ করে নিলেন। নিংসন্দেহে তিনি মহা ক্ষমাশীল এবং অীত দয়ালু)। কিন্তু যেহেতু পৃথিবীতে আগমনের মধ্যে আরও অনেক তাৎপর্য ও কল্যাণ নিহিত ছিল। যেমন, তাঁদের বংশধরদের মধ্য থেকে ফেরেশতা ও জ্বিন জাতির মাঝে এক নতুন জাতি ‘মানব’ জাতির আবির্ভাব ঘটা, তাদেরকে এক ধরনের কর্ম-স্বাধীনাত দিয়ে তাদের প্রতি শরী’আতী বিধান প্রয়োগের যোগ্য করে গড়ে তোলা, বিশ্বে আল্লাহ্‌র খেলাফত প্রতিষ্ঠা এবং অপরাধীর শাস্তি বিধান, শরী’আতের আইন ও নির্দেশাবলী প্রবর্তন। এই নতুন জাতি উন্নতি সাধন করে বিশেষ মার্যাদার অীধকারী হয়ে এমন এক স্তরে পৌঁছবে, যা ফেরেশতাদের নাগালের সম্পূর্ণ বাইরে। এসব উদ্দেশ্য সম্পর্কে আদম সৃষ্টির পূর্বে বর্ণনা করে দেয়া হয়েছিল।

এজন্য অপরাধ ক্ষমা করে দেয়ার পরও পৃথিবীতে অবতরণের নির্দেশ রহিত করা হয়নি, অবশ্য তার রূপ পাল্টে দেয়া হয়েছে। আর এখানকার এ নির্দেশ মহাজ্ঞানী ও রহস্যবিদসুলভ এবং পৃথিবীতে আগমন আল্লাহ্‌র খেলাফতের সম্মানসূচক। পরবর্তী আয়াতসমূহে উক্ত পদ-সংশ্লিষ্ট সেসব দায়িত্ব ও কর্তবের‌্যর বর্ণনা দেয়অ হয়েছে, যা আল্লাহ্ তা’আর একজন খলীফা হিসেবে তাঁর উপর অর্পিত হয়েছিল। এজন্য পৃথিবীতে অবতরণের নির্দেশ পূনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে, আমি তাদের সবাইকে নীচে নেমে যেতে নির্দেশ দিলাম। অতঃপর যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোন পথ-নির্দেশ বা হিদায়াত (অর্থাৎ, ও‘হীর মাধ্যমে শরী’আতের বিধান) আসে, তখন যেসব লোক আমার সে হিদায়াতের অনুসরণ করবে, তাদের না থাকবে কোন ভয়, না থারা সন্তপ্ত হবে। (অর্থাৎ, কোন অতীত বস্তু হারাবার গ্লানিও থাকবে না এবং ভবিষ্যতে কোন কষ্টেরও আশঙ্কা থাকবে না।)

         تَلَقَّىٰٓ শব্দের অর্থ আগ্রহ ও উৎসাহ সহ কাউকে সংবর্ধনা জানানো এবং তাকে গ্রহণ করা। এর মর্ম এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে যখন তাদেরকে তাওবার বাক্যগুলো শিখিয়ে দেয়া হলো, তখন হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) যথোচিত মর্যদা ও গুরুত্বসহ তা গ্রহণ করলেন।

         كَلِمَٰتٖ তথা যে সব বাক্য হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে তাওবার উদ্দেশ্যে বলে দেয়া হয়েছিল, তা কি ছিল? এ সম্পর্কে মুফাস্‌সির সা’হাবাগণের কয়েক ধরনের রেওয়ায়াত রয়েছে। হযরত ইব্‌নে ‘আব্বাসের অভিমতই এক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ, যা কুরআন কারীমের অন্যত্র বর্ণনা করা হয়েছে।

رَبَّنَا ظَلَمۡنَآ أَنفُسَنَا وَإِن لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَتَرۡحَمۡنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ

          অর্থাৎ, হে আমাদের পরওয়ারদেগার, আমরা আমাদের নিজেদের উপর অত্যাচার করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তবে আমরা নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে পরিগণিত হয়ে যাব।

         تَابَ… تَوْبَةٌ (তাওবা)-এর প্রকৃত অর্থ, ফিরে আসা। যখন তাওবার সম্বন্ধ মানুষের সঙ্গে হয়, তখন তার অর্থ হবে তিনটি বস্তুর সমষ্টি:

     ১. কৃত পাপকে পাপ মনে করে সেজন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া।

     ২.পাপ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা।

     ৩.ভবিষ্যতে আবার এরূপ না করার দৃঢ়সংকল্প গ্রহণ করা।

     এ তিনটি বিষয়ের যে কোন একটির অভাব থাকলে তাওবা হবে না। সুতরাং মৌখিকভাবে ‘আল্লাহ্ তাওবা’ বা অনুরূপ শব্দ উচ্চারণ করা নাজাত লাভের জন্যে যথেষ্ট নয়। فَتَابَ عَلَيۡهِۚ এর মধ্যে তাওবার সম্বন্ধ আল্রাহ্‌র সাথে। এর অর্থ তাওবা গ্রহণ করা।

প্রথম যুগের কোন কোন মনীষীর কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, কারো দ্বারা পাপ সংঘিটিত হলে সে কি করবে? উত্তরে বলা হয়েছিল যে, তাই করবে যা আদি পিতা-মাতা হযরত আদম ও হাওয়া (‘আলাইহিমাচ্ছালাম) করেছিলেন। অনুরূপভাবে হযরত মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) নিবেদন করেছিলেন- رَبِّ إِنِّي ظَلَمۡتُ نَفۡسِي فَٱغۡفِرۡ لِي (হে আমার পালনকর্তা, আমি আমার নফসের উপর অত্যাচার করেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন) হযরত ইউনুছ (‘আলাইহিচ্ছালাম) পদস্খলনের পর নিবেদন করেন لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنتَ سُبۡحَٰنَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ অর্থাৎ, হে আল্লাহ্, তুমি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই। তুমি অতি পবিত্র। আমি অত্যাচারীদের অর্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছি।

     জ্ঞাতব্য: হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর দ্বারা যে ইজতিহাদগত বিচ্যুতি বা ত্রুটি সাধিত হয়েছিল, প্রথতঃ কুরআন কারীম তার সম্বন্ধ উভয়ের সাথে করেছে। বলা হয়েছে, فَأَزَلَّهُمَا ٱلشَّيۡطَٰنُ عَنۡهَا فَأَخۡرَجَهُمَا (অতঃপর শয়তান উভয়কে পদস্খলিত করে দেয়)।

     পৃথিবীতে অবতরণের হুকুমও হযরত হাওয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে বলা হয়েছে, ٱهۡبِطُواْ (তোমরা নেমে যাও)। কিন্তু পরে তাওবা ও তা ক্ববূলের ক্ষেত্রে একবচন ব্যবহার করে শুধু হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত হাওয়ার উল্লেখ নেই। এছাড়া অন্যত্রও এ পদস্খলন প্রসঙ্গে শুধু হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর উল্লেখ করা হয়েছে: عَصىٰٓ ءاَدَمُ

অর্থাৎ, আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) স্বীয় পালনকর্তার হুকুম লঙ্ঘন করলেন।

     এর কারণ হয়তো আল্লাহ্ তা‘আলা নারী জাতির প্রতি বিশেষ রে‘আয়াত (লক্ষ,বিবেচনা ইত্যাদি) প্রদর্শন করে হযরত হাওয়ার বিষয়টি গোপন রেখেছেন এবং পাপ ও ভর্ৎসনার ক্ষেত্রে সরাসরি তাঁর উল্লেখ করেননি। এক জায়গায় উভয়ের তাওবারও বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

         رَبَّنَا ظَلَمۡنَآ (হে আমাদের প্রভু, আমরা আমাদের নফসের উপর জুলুম করেছি)। এ ব্যাপারে কারো সংশয় থাকা উচিত নয় যে, হযরত হাওয়ার অপরাধও ক্ষমা হয়েছে। এছাড়া স্ত্রী যেহেতু স্বতন্ত্রভাবে তাঁর (হাওয়ার) উল্লেখের প্রয়োজনবোধ করা হয়নি।–(কুরতুবী)

তাওবা গ্রহণের অধিকার আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো নেই:

          এ আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাওবা গ্রহণের অধিকরাী আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতিত অন্য কেউ নয়। খ্রীষ্টান ও ইহুদীগণ এ ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুলে পড়ে আছে। তারা পাদ্রী-পুরুহিতাদের কাছে কিছু হাদিয়া উপটৌকনের বিনিময়ে পাপ মোচন করিয়ে নেই এবং মনে করে যে, তারা মাফ করে দিলেই আল্লাহ্‌র নিকটেও মাফ হয়ে যায়। বর্তমানে বহু মুসলমানও এ ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ করে। অথচ কোন পীর বা আলিম কারো পাপ মোচণ করিয়ে দিতে পারেন না; তাঁরা বড়জোর দু’আ করতে পারেন।

قُلۡنَا ٱهۡبِطُواْ مِنۡهَا جَمِيعٗاۖ فَإِمَّا يَأۡتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدٗى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٣٨

৩৮.আমি হুকুম করলাম, তোমরা সবাই নীচে নেমে যাও। অতঃপর যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোন হিদায়াত পৌঁছে, তবে যে ব্যক্তি আমার সে হিদায়াত অনুসারে চলবে, তার উপর না কোন ভয় আসবে, না (কোন কারণে) তারা চিন্তাগ্রস্ত ও সন্তপ্ত হবে।

وَٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَكَذَّبُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَآ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٣٩

৩৯.আর যে লোক তা অস্বীকার করবে এবং আমার নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাবে, তারাই হবে জাহান্নামবাসী; অন্তকাল সেখানে থাকবে।

يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَوۡفُواْ بِعَهۡدِيٓ أُوفِ بِعَهۡدِكُمۡ وَإِيَّٰيَ فَٱرۡهَبُونِ ٤٠

৪০.হে বনী-ইসরাঈলগণ, তোমরা স্মরণ কর আমার সে অনুগ্রহ যা আমি তোমাদের প্রতি করেছি এবং তোমরা পূরণ কর আমার সাথে কৃত প্রতিজ্ঞা, তাহলে আমি তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করব। আর ভয় কর আমাকেই।

وَءَامِنُواْ بِمَآ أَنزَلۡتُ مُصَدِّقٗا لِّمَا مَعَكُمۡ وَلَا تَكُونُوٓاْ أَوَّلَ كَافِرِۢ بِهِۦۖ وَلَا تَشۡتَرُواْ بِ‍َٔايَٰتِي ثَمَنٗا قَلِيلٗا وَإِيَّٰيَ فَٱتَّقُونِ ٤١

৪১.আর তোমরা সে গ্রন্থের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, যা আমি অবতীর্ণ করেছি সত্যবক্তা হিসেবে তোমাদের কাছে। বস্তুতঃ তোমরা তার প্রাথমিক অস্বীকারকারী হয়ো না আর আমার আয়াতের অল্প মূল্য দিও না। এবং আমার (আযাব) থেকে বাঁচ।

وَلَا تَلۡبِسُواْ ٱلۡحَقَّ بِٱلۡبَٰطِلِ وَتَكۡتُمُواْ ٱلۡحَقَّ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٤٢

৪২.তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বে সত্যকে তোমরা গোপন করো না।

وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرۡكَعُواْ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ ٤٣

৪৩.আর নামায কায়েম কর, যাকাত দান কর এবং নামাযে অবনত হও তাদের সাথে, যারা অবনত হয়।

۞أَتَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبِرِّ وَتَنسَوۡنَ أَنفُسَكُمۡ وَأَنتُمۡ تَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٤٤

৪৪.তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদেরকে ভূলে যাও, অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা চিন্তা কর না?

وَٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى ٱلۡخَٰشِعِينَ ٤٥

৪৫.ধৈর্য্যর সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব।

ٱلَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُم مُّلَٰقُواْ رَبِّهِمۡ وَأَنَّهُمۡ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ٤٦

৪৬.যারা একথা খেয়াল করে যে, তাদেরকে সম্মুখীন হতে হবে স্বীয় পরওয়ারদেগারের এবং তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।

يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَنِّي فَضَّلۡتُكُمۡ عَلَى ٱلۡعَٰلَمِينَ ٤٧

৪৭.হে বনী-ইসরাঈলগণ! তোমরা স্মরণ কর আমার অনুগ্রহের কথা, যা আমি তোমাদের উপর করেছি এবং (স্মরণ কর) সে বিষয়টি যে, আমি তোমাদেরকে উচ্চমর্যাদা দান করেছি সমগ্র বিশ্বের উপর।

وَٱتَّقُواْ يَوۡمٗا لَّا تَجۡزِي نَفۡسٌ عَن نَّفۡسٖ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يُقۡبَلُ مِنۡهَا شَفَٰعَةٞ وَلَا يُؤۡخَذُ مِنۡهَا عَدۡلٞ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٤٨

৪৮.আর সে দিনের ভয় কর, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও ক্ববূল হবে না; কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না এবং তারা কোন রকম সাহায্যও পাবে না।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

          আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর পৃথিবীতে অবতরণ শাস্তিস্বরূপ নয়: قُلۡنَا ٱهۡبِطُواْ مِنۡهَا جَمِيعًاۖ (তোমরা জান্নাত থেকে নেমে যাও)-এর পূর্ববর্তী আয়াতেও জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরণের নির্দেশ ছিল। এখানে পুনরায় এর উল্লেখ করার মাঝে সম্ভবতঃ এ উদ্ধেশ্যই নিতিহ রয়েছে যে, প্রথম আয়াতে পৃথিবীতে অবরণের হুকুম ছিল শাস্তিমূলক। সেজন্যই তার সাথে সাথে মানবের পারস্পরিক শত্রুতারও বিবরণ দেয়া হয়েছে। এখানে পৃথিবীতে অবতরণের নির্দেশে বিশেষ উদ্দ্যেশ্য নিহিত রয়েছে। আর তা হলো বিশ্বে খেলাফতে ইলাহির পূর্ণতাসাধন। এজন্য এর সাথে হিদায়াত প্রেরণের উল্লেখও রয়েছে, যা খেলাফতে ইলাহির সম্বন্ধীয় কর্তব্যের অন্তর্ভূক্ত। এতে বুঝা গেল যে, পৃথিবীতে অবতরণের প্রথম নির্দেশটি যদিও শাস্তিমূলক ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে যখন অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হলো, তখন অন্যান্য মঙ্গল ও ‘হিকমাহ/‘হিকমাত/’হিকমাহ/‘হিকমাত/হেকমতসমূহের (তাৎপর্য) বিবেচনায় পৃথিবীতে প্রেরণের হুকুমের রূপ পরিবর্তন করে মূল হুকুম বহাল রাখা হলো এবং তাদের অবতরণ হলো বিশ্বের শাসক খলীফা হিসেবে।

     শোক-সন্তাপ থেকে শুধু তারাই মুক্তি পেতে পারে যারা আল্লাহ্‌র বাধ্য ও অনুগত:

فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ (যারা আমার হিদায়াতের অনুসরণ করবে; তাদের আশঙ্কা নেই এবং কোন চিন্তাও করতে হবে না)। এ আয়াতে আসমানী হিদায়াতের অনুসারিগণের জন্য দু’ধরনের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

     প্রথমত: তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং-

     দ্বিতীয়ত: তারা চিন্তাগ্রস্ত হবে না।

          خَوۡفٌ আগত দূঃখ-কষ্টজনিত আশঙ্কার নাম। আর حَزَنٌ বলা হয়, কোন উদ্দেশ্য সফল না হওয়ার কারণে সৃষ্ট গ্লানি ও দুশ্চিন্তাকে। লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে যে, এ দু’টি শব্দে যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে এমনভাবে কেন্দ্রীভূত করে দেয়া হয়েছে যে, স্বাচ্ছন্দ্যের একবিন্দুও এর বাইরে নেই।

     অতঃপর এ দু’টি শব্দের মধ্যে তত্ত্বগত ব্যবধানও রয়েছে। এখানে فَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ এর ন্যায় لَاحزن عَلَيۡهِمۡ না বলে ক্রিয়াবাচক শব্দ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ এর ব্যবহারের মধ্যে এ ইংগিতই রয়েছে যে, কোন উদ্দেশ্য সফল না হওয়া জনিত গ্লানি ও দুশ্চিন্তা থেকে শুধু তাঁরাই মুক্ত থাকতে পারেন, যাঁরা আল্লাহ্‌র ওলীর স্তরে পৌঁছতে পেরেছেন। যাঁরা আল্লাহ্ প্রদত্ত হিদায়াতসমূহের পুর্ণ অনুস্মরণকারী, তাঁরা ব্যতীত অন্য কোন মানুষ এ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। তা’ সে সারা বিশ্বের রাঝাধিরাজই হোক, বা সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তিই হোক। কেননা, এদের মধ্যে কেউই এমন নয়, যার স্বভাব এ ইচ্ছাবিরুদ্ধ কোন অবস্থার সম্মুখীন হবে না এবং সেজন্য দুশ্চিন্তায় লিপ্ত হবে না। অপরেপক্ষে আল্লাহ্‌র ওলিগণ নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্খাকে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার মাঝে বিলীন করে দেন। এজন্য কোন ব্যাপারে তাঁরা সফলকাম না হলে মোটেও বিচলিত হন না। কুরআন কারীমের অন্যত্র একথা প্রকাশ করা হয়েছে যে, বিশিষ্ট জান্নাতবাসিগণের অবস্থা হবে এই যে, তাঁরা জান্নাতে পৌঁছার পর আল্লাহ্‌র সেসব নি’আমতের জন্য শুকরিয়া আদায় করবেন, যার দ্বারা তিনি তাঁদের সন্তাপ ও দুশ্চিন্তা দুর করে দিয়েছেন।

          আয়াতসমূহের পুর্বাপর সম্পর্ক: সূরা বাক্বারাহ্ কুরআন সংক্রান্ত আলোচনা দিয়ে আরম্ভ করা হয়েছে এবং তাতে বলে দেয়া হয়েছে যে, কুরআনের হিদায়াত যদিও গোটা সৃষ্টজগতের জন্য ব্যাপক, কিন্তু এর দ্বারা শুধু মু’মিনগণই উপকৃত হবে। এর পরে যারা এর প্রতি ঈমান আনেনি, তাদের জন্য নির্ধারিত কঠিন শাস্তির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে এক শ্রেণী ছিল সরাসরি কাফির ও অবিশ্বাসীদের। অপর একটা শ্রেণী ছিল মুনাফিক ও কপটদের।

          জ্ঞাতব্য: সূরা বাক্বারাহ্ যেহেতু মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে, সুতরা এতে মুশরিক ও মুনাফিকদের বিবরণের পর যে কোন আসমানী গ্রন্থে বিশ্বাসী আহলে-কিতাবদেরকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে সম্বোধন করা হয়েছে। এ সূরার চল্লিশতম আয়াত থেকে আরম্ভ করে একশত তেইশতম আয়াত পর্যন্ত শুধু এদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছ। সেখানে তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য প্রথমে তাদের বংশগত কৌলিন্য, বিশ্বের বুকে তাদের যশ-খ্যাতি, মান-মর্যাদা এবং তাদের প্রতি আল্লাহ্ তা‘আলার অগণিত অনুকম্পাধার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। অতঃপর তাদের পদচ্যুতি ও দুস্কৃতির জন্য সাবধান করে দেয়া হয়েছে এবং সঠিক পথের দিকে আহবান করা হয়েছে। প্রথম সাত আয়াতে এসব বিষয়েরই আলোচনা করা হয়েছে। সংক্ষেপে প্রথম তিন আয়াতে ঈমানের দাওয়াত এবং চার আয়াতে সৎকাজের শিক্ষা ও প্রেরণা রয়েছে। তৎপর অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে তাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। বিস্তারিত সম্বোধনের সূচনা ও সমাপ্তিপর্বে গুরুত্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيل (হে ইসরাঈলের বংশধর) শব্দসমষ্টি দ্বারা সংক্ষিপ্ত সম্বোধনের সূচনা হয়েছিল, সেগুলোই পুনরুল্লেখ করা হয়েছে।

          يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ এখানে ইসরাঈল (إِسۡرَٰٓءِيلَ ) হিব্রু ভাষার শব্দ। এর অর্থ ‘আবদুল্লাহ্’ (আল্লাহ্‌র দাস)। ইয়া’কূব (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর অপর নাম। ‘উলামায়ে কেরামের মতানুসারে রসূল (সল্লাল্লহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ব্যতীত অন্য কোন নবির একাধিক নাম নেই। কেবল-হযরত ইয়া’কূব (’’আলাইহিচ্ছালাম)-এর দু’টি নাম রয়েছে- ইয়া’কূব ও ইসরাইল। কুরআন কারীম এক্ষেত্রে তাদেরকে বনী-ইয়া’কূব (بَنِى يعقوب ) বলে সম্বোধন না করে বনী-ইসরাঈল নাম ব্যবহার করেছে। এর তাৎপর্য এই যে, স্বয়ং নিজেদের নাম ও উপাধি থেকেই যেন তারা বুঝতে পারে যে, তারা ‘আব্দুল্লাহ্” অর্থাৎ, আল্লাহ্‌র আরাধনাকারী দাসের বংশধর এবং তাদের তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলতে হবে। এ আয়াতে বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করে ইরশাদ হয়েছে:

          ‘এবং তোমরা আমার অঙ্গীকার পুরণ কর।’ অর্থাৎ, তোমরা আমার সাথে যে অঙ্গীকার করেছিলে, তা পুরণ কর। হযরত ক্বাতাদাহ (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু)-এর মতে তাওরাতে বর্ণিত সে অঙ্গীকারের কথাই কুরআনের এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে:

۞وَلَقَدۡ أَخَذَ ٱللَّهُ مِيثَٰقَ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ وَبَعَثۡنَا مِنۡهُمُ ٱثۡنَيۡ عَشَرَ نَقِيبًاۖ

          অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা বনী-ইসরাঈল থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন এবং আমি তাদের মাঝে থেকে ১২জনকে দলপতি নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলাম-(সূরা মা-য়িদাহ, আয়াত-১২)। সমস্ত রসূলের উপর ঈমান আনার সর্বাধিক গুরত্বপুর্ণ অঙ্গীকারই এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। যাঁদের মধ্যে আমাদের প্রিয় রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-ও বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়া, নামায/স্বলাত, যাকাত এবং অন্যান্য স্বদাক্বাহ-খয়রাতও এ অঙ্গীকারভুক্ত। যার মূল মর্ম হল রসূলে কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর ঈমান ও তার পুরোপুরি অনুসরণ। এ জন্যই হযরত ইব্‌নে ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু)-বলেছেন যে, অঙ্গীকারের মূল অর্থ মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পুর্ণ অনুসরণ।

          ‘আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পুরণ করব।’ অর্থাৎ, উল্লোখিত আয়াতে আল্লাহ্ এ ও’য়াদা করেছেন যে, যারা এ অঙ্গীকার পালন করবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের যাবতীয় পাপ মোচন করে দেবেন এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদেরকে জান্নাতের সুখ-সম্পদের দ্বারা গোৗরবান্বিত করা হবে।

     মূল বক্তব্য এই যে, হে বনী-ইসরাঈল, তোমরা মু’হা্ম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াছাল্লাম)-এর অনুসরণ করার ব্যাপারে আমার সাথে যে অঙ্গীকার করেছ, তা পুরণ কর, তবে আমিও তোমাদের সাথে কৃত ক্ষমা ও জান্নাত বিষয়ক অঙ্গীকার পুরণ করবো। আর শুধু আমাকেই ভয় কর। একথা ভেবে সাধারণ ভক্তদেরকে ভয় করো না যে, সত্য কথা বললে তারা আর বিশ্বাসী থাকবে না, ফলে আমদানী বন্ধ হয়ে যাবে।

     মুহাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উম্মতের বিশেষ মর্যাদা: তাফসীরে কুরতুবীতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা বনী-ইসরাঈলকে প্রদত্ত সুখ-সম্পদ ও অনুগ্রহরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর যিক্‌র ও অনুসরণের আহবান করেছেন এবং উম্মতে মু’হাম্মাদিয়াকে তাঁর দয়া ও করুণার উদ্ধৃতি না দিয়েই একই কাজের উদ্দেশ্যে আহবান করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে: فَٱذۡكُرُونِيٓ أَذۡكُرۡكُمۡ (তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব।) এখানে উম্মতে-মু’হাম্মদীর এক বিশেষ মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে, দাতার ও করুণাময়ের সাথে তাদের সম্পর্ক মাধ্যমহনি-একেবারে সরাসরি। এরা দাতাকে চেনে।

     অঙ্গীকার পালন করা ওয়াজিব এবং তা লঙ্ঘন করা ‘হারাম: এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, অঙ্গীকার ও চুক্তির শর্তাবলী পালন করা অবশ্য কর্তব্য আর তা লঙ্ঘন করা ‘‘হারাম। সূরা মা-য়িদাহ’-তে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। أَوۡفُواْ بِٱلۡعُقُودِۚ (তোমরা কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তি পালন কর)।

     রসূলে কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন যে, অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদিগকে নির্ধারিত শাস্তিপ্রাপ্ত হওয়ার পুর্বে এই শাস্তি দেয়া হবে যে, হাশরের ময়দানে যখন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমগ্র মানবজাতি সমবেত হবে, তখন অঙ্গীকার লঙ্ঘনকারীদের মাথার উপর নিদর্শনস্বরূপ একটি পতাকা উত্তোলন করে দেয়া হবে এবং যত বড় অঙ্গীকার করবে, পতাকাও তত উঁচু ও বড় হবে এভাবে তাদেরকে হাশরের ময়াদানে লজ্জিত ও অপমানিত করা হবে।

     পাপ বা পুণ্যের প্রবর্তকের ‘আমলনামায় তার সম্পাদনকারীর সমান পাপ-পূণ্য লেখা হয়ঃ أَوَّلَ كَافِرِۢ بِهِۦۖ যে কোন পর্যায়ে কাফির হওয়া চরম অপরাধ ও জুলুম। কিন্তু এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, প্রথম কাফিরে পরিণত হয়ো না। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, যে ব্যক্তি প্রথম কুফরী গ্রহণ করবে, তার অনুসরণে পরবর্তীকালে যত লোক এ পাপে লিপ্ত হবে, তাদের সবার কুফরী ও অবিশ্বাসজনিত পাপের বোঝার সমতুল্য বোঝা তাকে একাই বহন করতে হবে। কারণ, সে-ই ক্বিয়ামত পর্যন্ত সংঘটিতব্য এ অবিশ্বাস-প্রসুত পাপের মূল কারণ ও উৎস। সুতরাং তার শাস্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।

     এতে বুঝা গেল যে, কোন ব্যক্তি যদি অন্য কারও পাপের কারণে পরিণত হয়, তবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত লোক তার কারণে এ পাপে জড়িত হবে, তাদের সবার সমতুল্য পাপ তার একারই হবে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি অন্য কারও পূণ্যের কারণ হয়, তাকে অনুসরণ করে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত লোক সৎকাজ সাধন করে যে পরিমাণ পূণ্য লাভ করবে, তাদের সবার সমতুল্য পুণ্য সে ব্যক্তির ‘আমলনামায় লিপিবদ্ধ করে দেয়া হবে। এ মর্মে কুরআন কারীমে অসংখ্য আয়াত এবং রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অগণিত ‘হাদীস রয়েছে।

وَلَا تَشۡتَرُواْ بِ‍َٔايَٰتِي ثَمَنًا قَلِيلًا

(এবং তোমরা আমার আয়াতসমূহ কোন নগণ্য বস্তুর বিনিময়ে বিক্রয় করো না।) আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলার আয়াতসমূহের বিনিমেয় মূল্য গ্রহণ নিষিদ্ধ হওয়ার অর্থ হলো মানুষের মর্জি ও স্বার্থের তাগিদে আয়াতসমূহের মর্ম বিকৃত বা ভুলভাবে প্রকাশ করে কিংবা তা গোপন রেখে টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পদ গ্রহণ করা। এ কাজটি উম্মতের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে ‘হারাম।

     কুরআন শিখিয়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয: এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, আল্লাহ্ তা‘আলার আয়াতসমূহ ঠিক ঠিক ভাবে শিক্ষা দিয়ে বা ব্যক্ত করে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা সঙ্গত কিনা? এই প্রশ্নটির সম্পর্ক উল্লেখিত আয়াতের সঙ্গে নয়। স্বয়ং এ মাসাআলাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য ও পর্যালোচনা সাপেক্ষ। কুরআন শিক্ষা দিয়ে বিনিময় বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয কি না, এ সম্পর্কে ফিক্বাহ্‌শাস্ত্রবিদগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম মালেক, শাফি’য়ী ও আ’হমাদ ইব্‌নে ‘হাম্বল জায়েয বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইমাম ‘আযম আবূ ‘হানীফাহ (র’হঃ) প্রমুখ কয়েকজন ইমাম তা নিষেধ করেছেন। কেননা, রসূলে কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কুরআনকে জীবিকা অর্জনের মাধ্যমে পরিণত করতে বারণ করেছেন।

     অবশ্য পরবর্তী ‘হানাফী ইমামগণ বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে, পুর্বে কুরআনের শিক্ষকমন্ডলীর জীবনযাপনের ব্যয়ভার ইসলামী বাইতুলমাল (ইসলামী ধনভান্ডার) বহন করত, কিন্তু বর্তমানে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতীতে এ শিক্ষকমন্ডলী কিছুই লাভ করেন না। ফলে যদি তাঁর জীবিকার অন্বেষণে চাকরী-বাকরী, ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য পেশায় আত্মনিয়োগ করেন, তবে ছেলেমেয়েদের কুরআন শিক্ষার ধারা সম্পুর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্য কুরআন শিক্ষার বিনিময়ে প্রয়োজনানুপাতে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ইমামতি,আযান, ‘হাদীস ও ফিক্বাহ্ শিক্ষাদান প্রভৃতি যে সব কাজের উপর দ্বীন ও শরী’আতে স্থায়িত্ব ও অস্তিত্ব নির্ভর করে সেগুলোকেও কুরআন শিক্ষাদানের সাথে সংযুক্ত করে প্রয়োজনমত এগুলোর বিনিময়েও বেতন বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। (দুররে মুখতার, শামী)

     ঈসালে ছাওয়াব উপলক্ষে খ্বতমে-কুরআনের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা সর্বসম্মতভাবে না জায়েযঃ আল্লামা শামী ‘দুররেমুখতারের শরা’হ’ (নোট) এবং ‘শিফাউল-আলীল’ নামক গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে এবং অকাট্য দলীলাদিসহ একথা প্রমাণ করেছেন যে, কুরআন শিক্ষাদান বা অনুরূপ অন্যান্য কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণের যে অনুমতি পরবর্তীকালের ফক্বীহগণ (স্কলার) দিয়েছেন, তার কারণ এমন এক ধর্মীয় প্রয়োজন যে, তাতে বিচ্যুতি দেখা দিলে গোটা শরী’আতের বিধান ব্যবস্থার মূলে আঘাত আসবে। সুতরাং এ অনুমতি এ সব বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখা একান্ত আবশ্যক। এ জন্য পারিশ্রমকের বিনিময়ে মৃতদের ‘ঈসালে-ছাওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরআন খ্বতম করানো বা অন্য কোন দু’আ-কালাম ও অযীফা পড়ানো ‘হারাম। কারণ, এর উপর কোন ধর্মীয় মৌলিক প্রয়োজন নির্ভশীল নয়। এখন যেহেতু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কুরআন পড়া ‘হারাম, সুতরাং যে পড়বে এবং যে পড়াবে, তারা উভয়ই গোনাহ্‌গার হবে। বস্তুতঃ যে পড়েছে সে-ই যখন কোন ছাওয়াব পাচ্ছে না, তখন মৃত আত্মার প্রতি সে কি পৌঁছাবে? কবরের পাশে কুরআন পড়ানো বা পারিশ্রমিকের বিনমেয়ে কুরআন খ্বতম করানোর রীতি সা’হাবী,তাবে’য়ীন এবং প্রথম যুগের উম্মতগণের দ্বারা কোথাও বর্ণিত বা প্রমাণিত নেই। সুতরাং এগুলো নিঃসন্দেহে বিদ’আত।

সত্য গোপন করা এবং তাতে সংযোজন ও সংমিশ্রণ ‘হারাম:

وَلَا تَلۡبِسُواْ ٱلۡحَقَّ بِٱلۡبَٰطِلِ (সত্যকে অসত্যের সাথে মিশ্রিত করো না।) এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শ্রোতা ও সম্বোধিত ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করে উপস্থাপন করা সম্পুর্ণ না জায়েয। অনুরূপভাবে কোন ভয় বা লোভের বশবর্তী হয়ে সত্য গোপন করাও ‘‘হারাম।

     জ্ঞাতব্য: ধৈর্য ধারণ করার জন্য কেবল অপ্রয়োজনীয় কামনা-বাসনাগুলোই পরিহার করতে হয়। কিন্তু স্বলাত/নামাযের ক্ষেত্রে অনেকগুলো কাজও সম্পন্ন করতে হয় এবং বহু বৈধ কামনাও সাময়িকভাবে বর্জন করতে হয়। যেমন-পানাহার ,কথাবার্তা, চলাফেরা এবং অন্যাণ্য মানবীয় প্রয়োজনাদি, যেগুলো শরী’আতানুসারে বৈধ ও অনুমোদিত, সেগুলোও নামাযের সময় বর্জন করতে হয়। তাও নির্ধারিত সময়ে দিন-রাতে পাঁচবার করতে হয়। এজন্য কিছু সংখ্যক নির্দিষ্ট কার্যাবলী সম্পন্ন করা এবং নির্ধারিত সময়ে যাবতীয় বৈধ ও অবৈধ বস্তু থেকে দৈর্য ধারণ করার নাম নামায।

     মানুষ অপ্রয়োজনীয় কামনাসমূহ বর্জন করতে সংকল্পবদ্ধ হলে কিছু দিন পর তার স্বাভাবিক চাহিদাও লোপ পেয়ে যায়, কোন প্রতিবন্ধকতা ও জটিলতা থাকে না। কিন্তু স্বলাত/নামাযের সময়সূচীর অনুসরণ এবং তৎসম্পর্কিত যাবতীয় শর্তাবলী যথাযথভাবে পালন এবং এসব সময়ে প্রয়োজনীয় আশা-আকাংখা থেকে বিরত থাকা প্রভৃতি মানব স্বভাবের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন ও আয়াসসাধ্য। এজন্য এখানে সন্দেহের উদ্ভব হতে পারে যে, ঈমানকে সহজলব্ধ করার জন্য  ধৈর্য ও স্বলাত/নামাযরূপ ব্যবস্থাপত্রের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তার অনুশীলনও কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে স্বলাত/নামায সম্পর্কিত শর্তাবলী ও নিয়মাবলী পালন ও অনুসরণ করা স্বলাত/নামায সংক্রান্ত এসব জটিলতার প্রতিবিধান প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, নিঃসন্দেহে স্বলাত/নামায কঠিন ও আয়াসসাধ্য কাজ। কিন্তু যাদের অন্তঃকরণে বিনয় বিদ্যমান, তাদের পক্ষে এটা মোটেও কঠিন কাজ নয়। এতে স্বলাত/নামাযকে সহজসাধ্য কারার ব্যবস্থা প্রদান করা হয়েছে।
স্বলাত/নামায কঠিন বোধ হওয়ার কারণ সম্পর্কে চিন্তা করলে বুঝা যাবে যে, মানবমন কল্পনারাজ্যে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে অভ্যস্ত। আর মানুষের যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও মনেরই অনুসরণ করে। কাজেই যাবতীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মনেরই অনুসরণে মুক্তভাবে বিচরণ করতে প্রয়াসী। স্বলাত/নামায এরূপ স্বাধীনতার সম্পুর্ণ পরিপন্থী। না বলা, না হাসা, না খাওয়া, না চলা প্রভৃতি নানাবিধ বাধ্যবাধকতার ফলে মন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এবং মনের অনুগত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও এথেকে কষ্ট বোধ করতে থাকে।

     সারকথা: নামাযের মধ্যে ক্লান্তি ও শান্তি বোধের একমাত্র কারণ হচ্ছে মনের বিচ্ছিন্ন চিন্তাধারার অবাধ বিচরণ। এর প্রতিবিধান মনের স্থিরতার দ্বারাই হতে পারে। خشوع বা বিনয়ের অর্থ মূলতঃ سكون القلب বা মনের স্থিরতা। কাজেই বিনয়কে স্বলাত/নামায সহজসাধ্য হওয়ার কারণরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠে যে, মনের স্থিরতা অর্থাৎ বিনয় কিভাবে লাভ করা যায়? একথা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত যে, যদি কোন ব্যক্তি তার অন্তরের বিচিত্র চিন্তাধারা ও নানাবিধ কল্পনাকে তার মন থেকে সরাসরি দুরীভুত করতে চায়, তবে এতে সফলাত লাভ করা প্রায় অসম্ভব। বরং এর প্রতিবিধান এই যে, মানবমত যেহেতু একই সময়ে বিভিন্ন দিকে ধাবিত হতে পারে না, সুতরাং যদি তাকে একটি মাত্র চিনতায় মগ্ন ও নিয়োজিত করে দেয়া যায়, তবে অন্যান্য চিন্তা ও কল্পনা আপনা থেকেই বেরিয়ে যাবে। এজন্য خشوع বা বিনয়ের বর্ণনার পর এমন এক চিন্তার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে, যাতে নিমগ্ন থাকলে অন্যান্য চিন্তা ও কল্পনা প্রদমিত ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং এগুলো দমে যাওয়ার ফলে হৃদয়ের অস্থিরতা দুর হয়ে স্থিরতা জন্মাবে। স্থিরতার দরুন স্বলাত/নামায অনায়াসলব্ধ হবে এবং স্বলাত/নামাযের উপর স্থায়িত্ব লাভ হবে। আর নামাযের নিয়মানুবর্তিতার দরুন গর্ব-অহঙ্কার ও যশ-খ্যাতির মোহও হ্রাস পাবে তাছাড়া ঈমানের পথে যেসব বাধা-বিপত্তি রয়েছে তা দুরীভুত হয়ে পুর্ণ ঈমান লাভ সম্ভব হবে।

         وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ … صَلَوٰةএর শাব্দিক অর্থ প্রার্থনা বা দু’আ। শরী’আতের পরিভাষায় সে বিশেষ ‘ইবাদত, যাকে স্বলাত/নামায বলা হয়। কুরআন কারীমে যতবার স্বলাত/নামাযের তাকীদ/জোর দেয়া হয়েছে-সাধারণতঃ إقاَمَة শব্দের মাধ্যমেই দেয়া হয়েছে। স্বলাত/নামায পড়ার কথা শুধু দু’এক জায়গায় বলা হয়েছে। এজন্য إقاَمَةُالصَّلَوٰةْ (স্বলাত/নামায প্রতিষ্ঠা)-এর মর্ম অনুধাবন করা উচিত। إقاَمَة এর শাব্দিক অর্থ সোজা করা, স্থায়ী রাখা। সাধারণতঃ যেসব খুঁটি দেয়াল বা গাছ প্রভৃতির আশ্রয়ে সোজাভাবে দাঁড়ানো থাকে, সেগুলো স্থায়ী থাকে এবং পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। এজন্য إقاَمَة স্থায়ী ও স্থিতিশীলকরণ অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

     কুরআন ও সুন্নাহ্‌র পরিভাষায় إقاَمَةُالصَّلَوٰةْ অর্থ, নির্ধারিত সময় অনুসারে যাবতীয় শর্তাদি ও নিয়মাবলী রক্ষা করে স্বলাত/নামায আদায় করা। শুধু স্বলাত/নামায পড়াকে إقاَمَةُالصَّلَوٰةْ বলা হয় না। স্বলাত/নামযের যত গুণাবলী, ফলাফল, লাভ ও বরকতের কথা কুরআন-’হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে, তা সবই إقاَمَةُالصَّلَوٰةْ (নামায প্রতিষ্ঠ)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেমন, কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে- إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ تَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِوَٱلۡمُنكَرِۗ

(নিশ্চয়ই স্বলাত/নামায মানুষকে যাবতীয় অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।)

     নামাযের এ ফল ও ক্রিয়ার তখনই প্রকাশ ঘটবে, যখন স্বলাত/নামায উপরে বর্ণিত অর্থে প্রতিষ্ঠা করা হবে। এজন্য অনেক নামাযীকে অশ্লীল ও ন্যক্কারজনক কাজে জড়িত দেখে এ আয়াতের মর্ম সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ঠিক হবে না। কেননা, তারা নামায পড়েছে বটে কিন্তু প্রতিষ্ঠা করেনি!

         وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ আভিধানিকভাবে যাকাতের অর্থ দু’রকম-পবিত্র করা ও বর্ধিত হওয়া। শরী’আতের পরিভাষায় সম্পদের সে অংশকে যাকাত বলা হয়, যা শরী’আতের নির্দেশানুসারে সম্পদ থেকে বের করা হয় এবং শরী’আত মোতাবেক খরচ করা হয়।

যদিও এখানে সমসাময়িক বনী-ইস্‌রাঈলদিগকে সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু তাতে একথা প্রমাণিত হয় না যে, স্বলাত/নামায ও যাকাত ইসলাম পুর্ববর্তী বনী-ইস্‌রাঈলদের উপরই ফরয ছিল। কিন্তু সূরা মা-য়িদায় বর্ণিতঃ “নিশ্চই আল্লাহ্ তা‘আলা বনী-ইস্‌রাঈল থেকে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন এবং আমি তাদের মধ্য থেকে ১২জন দলপতি মনোনীত করে প্রেরণ করলাম। আর আল্লাহ্ তা‘আলা বললেন, যদি তোমরা স্বলাত/নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত আদায় কর, তবে নিশ্চয়ই আমার সহায্য তোমাদের সাথে থাকবে।” এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বনী-ইস্‌রাঈলের উপর স্বলাত/নামায ও যাকাত ফরয ছিল। অবশ্য তার রূপ ও প্রকৃতি ছিল ভিন্ন।

         وَٱرۡكَعُواْ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ … ركوعরুকূ’র শাব্দিক অর্থ ঝুঁকা বা প্রণত হওয়া। এ অর্থের পরিপ্রেক্ষিতে এ শব্দ সেজদার স্থলেও ব্যবহৃত হয়। কেননা, সেটাও ঝুঁকারই সর্বশেষ স্তর। কিন্তু শরী’আতের পরিভাষায় ঐ বিশেষ ঝুঁকাকে রুকূ’ বলা হয়, যা স্বলাত/নামাযের মধ্যে প্রচলিত ও পরিচিত। আয়াতের অর্থ এই যে, রুকূ’কারীগণের সাথে রুকূ’ কর।’ এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, স্বলাত/নামাযের সমগ্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে রুকূ’কে বিশেষভাবে কেন উল্লেখ করা হলো/ উত্তর এই যে, এখানে স্বলাত/নামাযের একটি অংশ উল্লেখ করে গোটা স্বলাত/নামাযকেই বুঝানো হয়েছে। যেমন, কুরআন কারীমের এক জায়গায় وَقُرۡءَانَ ٱلۡفَجۡرِۖ  (ফজর স্বলাত/নামাযের কুরআন পাঠ) বলে সম্পূর্ণ ফজরের স্বলাত/নামাযকে বুঝানো হয়েছে। তাছাড়া ‘হাদীসের কোন কোন রিওয়ায়াতে ‘সিজদা’ শব্দ ব্যবহার করে পুর্ণ এক রকা’আত বা গোটা স্বলাত/নামাযকেই বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এর মর্ম এই যে, নামাযীগণের সাথে স্বলাত/নামায পড়। কিন্তু এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, নামাযের অন্যান্য অংশের মধ্যে বিশেষভাবে রুকূ’র উল্লেখের তাৎপর্য কি?

     উত্তর এই যে, ইহুদীদের নামাযে সিজদাসহ অন্যান্য সব অঙ্গই ছিল, কিন্তু রুকূ’ ছিল না। রুকূ’ মুসলমানদের নামাযের বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম। এজন্য رَٰكِعِين শব্দ দ্বারা উম্মতে মু’হাম্মাদীর নামাযিগণকে বুঝানো হবে, যাতে রুকূ’ও অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তখন আয়াতের অর্থ হবে এই যে, তোমরাও উম্মতে মু’হাম্মদীর নামাযিগণের সাথে স্বলাত/নামায আদায় কর। অর্থাৎ, প্রথম ঈমান গ্রহণ কর, পরে জামা’আতের সাথে স্বলাত/নামায আদায় কর।

     স্বলাত/নামাযের জামা’আত সম্পর্কিত নির্দেশাবলী: স্বলাত/নামাযের হুকুম এবং তা ফরয হওয়া তো وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ শব্দের দ্বারাই বুঝা গেল। এখানে … (রুকুকারীদের সাথে) শব্দের দ্বারা স্বলাত/নামায জামা’আতের সাথে আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ হুকুমটি কোন্ ধরনের? এ ব্যাপারে ‘উলামা ফক্বীহ্‌গণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সাহাবা (রদ্বিয়াল্লাহু আজমা’য়ীন), তাবে’য়ীন এবং ফুক্বাহাদের মধ্যে একদল জামা’আতকে ওয়াজিব বলেছেন এবং তা পরিত্যাগ করাকে কঠিন পাপ বলে অভিহিত করেছেন। কোন কোন সাহাবা (রদ্বিয়াল্ল-হু আজমা’য়ীন) তো শরী‘আতসম্মত ‘উযর/আপত্তি ব্যতীত জামা’আতহীন স্বলাত/নামায জায়েয নয় বলেও মন্তব্য করেছেন। যারা জামা’আত ওয়াজিব হওয়ার প্রবক্তা এ আয়াতটি তাঁদের দলীল।

     অধিকাংশ ‘উলামা, ফুক্বাহা, সাহাবা ও তাবেঈনের মতে জামা’আত হল সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্। কিন্তু ফজরের সুন্নতের ন্যায় সর্বাধিক তাকীদ/গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। ওয়াজিবের একেবারে নিকটবর্তী।

     ‘আমলহীন উপদেশ প্রদানকারীরে নিন্দা: ۞أَتَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبِرِّوَتَنسَوۡنَ أَنفُسَكُمۡ

(তোমরা অন্যকে সৎকাজের নির্দেশ দাও, অথচ নিজেদেরকে ভুলে বস।) এ আয়াতে ইহুদী আলেমদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। এতে তাদেরকে ভর্ৎসনা করা হচ্ছে যে, তারা তো নিজেদের বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনকে মু‘হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অনুসরণ রতে এবং ইসলামের উপর স্থির থঅকতে নির্দেশ দেয়। (এ থেকে বুঝা যায়, ইহুদী আলেমগণ দ্বীন ইসলামকে নিশ্চিতভঅবে সত্য বলে মনে করত।) নিজেরা প্রবুত্তির কামনার দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত ছিল যে, ইসলাম গ্রহণ করতে কখনো প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু যারাই অপরকে পুণ্য ও মঙ্গলের প্রেরণা দেয়, অথচ নিজের ক্ষেত্রে তা কারের্য পরিণত করে না, প্রকৃত প্রস্তাবে তারা সবাই ভর্ৎসনা ও ন্দিাবাদের অন্তুর্ভূক্ত। এ শ্রেণীর লোকদের সম্পর্কে ‘হাদীসে করুণ পরিণতি ও ভয়ঙ্কর শাস্তির প্রতিশ্রুতি রয়েছে। হযরত ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) থেকে বর্নিত আছে, রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, মি’রাজের রাতে আমি এমন কিছুসংখ্যক লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের জিহ্বা ও ঠোঁট আগনের কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল। আমি জিবরীল (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? জিবরীল বললেন, এরা আপনার উম্মতের পার্থিব স্বার্থপুজারী উপদেশদানকারী, যারা অপরকে তো সৎকাজের নির্দেশ দিত, কিন্তু নিজের খবর রাখতে না। (কুরতুবী)

     রসূলুল্ল-হ্ সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, কতিপয় জান্নাতবাসী কতক নরকবাসীকে অগ্নিদগ্ধ হতে জিজ্ঞেস করবেন যে, তোমরা কিভাবে দোযখে প্রবেশ করলে, অথচ আল্লাহ্‌র কসম, আমরা তো সেসব সৎকাজের দৌলতেই জান্নাত লাভ করেছি, যা তোমাদেরই কাছে শিখেছিলাম? দোযখবাসীরা বলবে, আমরা মুখে অবশ্য বলতাম কিন্তু নিজে তা কাজে পরিণত করতাম না।

     পাপী ওয়া‘য়েয উপদেশ প্রদান করতে পারে কিনা: উল্লেখিত বর্ণনা থেকে একথা যেন বুঝা না হয় যে, ‘আমলহীন বিরুদ্ধাচারীর পক্ষে অপরকে উপদেশ দান করা জায়েয নয় এবং কোন ব্যক্তি যদি কোন পাপে লিপ্ত থাকে, তবে সে অপরকে উক্ত পাপ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে পারে না। কারণ, সৎকাজের জন্য ভিন্ন নেকী ও সৎকাজের প্রচার-প্রসারের জন্য পৃথক ও স্বতন্ত্র নেকী। আর এটা সুস্পষ্ট যে, এক নেকী পরিহার করলে অপর নেকীও পরিহার করতে হবে এমন কোন কথা নেই। কোন ব্যক্তি স্বলাত/নামায না পড়লে অপরকেও স্বলাত/নামায পড়তে বলতে পারবে না, এমন কথঅ নয়। অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি স্বলাত/নামায না পড়লে রোযাও রাখতে পারবে না, এমন কোন কথা নেই। তেমনিভাবে কোন অবৈধ কাজ থেকে বারণ না করা পৃথক পাপ। একটি পাপ করেছে বলে অপর পাপও করতে হবে এমন কোন বাধ্য বাধকতা নেই।

     যদি প্রত্যেক মানুষ নিজে পাপী বলে সৎকাজের নির্দেশ দান ও অসৎ কাজ থেকে বাধাদান করা ছেড়ে দেয় এবং বলে যে, যখন সে নিজে নিষ্পাপ হতে পারবে, তখনই অপরকে উপদেশ দেবে, তাহলে ফল দাঁড়াবে এই যে, কোন তবলীগকারীই অবশিষ্ট থাকবে না। কেননা, এমন কে আছে, যে পরিপূর্ণ নিষ্পাপ? হযরত ‘হাসান (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) ইরশাদ করেছেনঃ শয়তান তো তাই চায় যে, মানুষ এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে তাবলীগের দায়িত্ব পালন না করে বসে থাক।

     মূল কথা এই যে, ۞أَتَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبِرِّوَتَنسَوۡنَ أَنفُسَكُمۡ

(তোমরা কি অপরকে সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং নিজেদেরকে ভুলে বস?) আয়াতের অর্থ এই যে, উপদেশদানকারী (ওয়া’য়েযকে) ‘আমলহীন থাকা উচিত নয়। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ওয়া’য়েয কিংবা ওয়া’য়য নয় এমন কারো পক্ষেই যখন ‘আমলহীন থাকা জায়েয নয়, তাহলে এখঅনে বিশেষভাবে ওয়া’য়েযের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা কি? উত্তর এই যে, বিষয়টি উভয়ের জন্য না-জায়েয, কিন্তু ওয়া’য়েয বহির্ভুতদের তুলনায় ওয়া’য়েযের অপরাধ অধিক মারাত্মক। কেননা, ওয়া’য়েয অপরাধকে অপরাধ মনে করে জেনে-শুনে করছে। তার পক্ষে এ ‘উযর/বিপত্তি গ্রহণযোগ্য নয় যে, এটা যে অপরাধ তা আমার জানা ছিল না। অপরপক্ষে ওয়া’য়েয বহির্ভুত মূর্খদের অবস্থঅ সম্পুর্ণ বিপরীত। এছাড়া ওয়া’য়েয ও ‘আলিম যদি কোন অপরাধ করে, তবে তা হয় ধর্মের সাথে এক প্রকারের পরিহাস। হযরত আনাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) থেকে বর্ণিত, রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা‘আলা অশিক্ষিত লোকদেরকে যত ক্ষমা করবেন, শিক্ষিতদেরকে তত ক্ষশা করবেন না।

     দু’টি মানসিক ব্যাধি ও তার প্রতিকারঃ সম্পদ-প্রীতির ও যশ-খ্যাতির মোহ এমন ধরনের দু’টির মানসিক ব্যাধি যদ্দরুন ইহলৌকিক ও পরলৌকিক উভয় জীবনই নিষ্প্রভ ও অসার হয়ে পড়ে। গভীরভঅবে চিন্তা করলে বুঝা যাবে যে, মানবেতিহাসে এযাবৎ যতগুলো মানবতা বিধ্বংসী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং যত বিশৃংখলা ও অশিইন্ত বিস্তার লাভ করেছে, সেগুলোর উৎপত্তিই হয়েছিল উল্লেখিত এ দু’টি ব্যাধি থেকে।

সম্পদ প্রাপ্তির পরিণতি ও ফলাফল:

     ১-অর্থগৃধ্নুতা ও কৃপণতার অন্যতম জাতীয় ক্ষতির দিক হল এই যে, তার সম্পদ জাতির কোন উপকারে আসে না। দ্বিতীয় ক্ষতিটি তার ব্যক্তিগত। এ প্রকৃতির লোককে সমাজে কখনও সু-নজরে দেখা হয় না।

     ২-স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতাঃ তার সম্পদলিপ্সা পূরণার্থ জিনিসে ভেজাল মেশানো, মাপে কম দেয়া, মজুদদারী, মুনাফাখোরী, প্রবঞ্চনা-প্রতারণা প্রভৃতি ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন তার মজ্জাগত হয়ে যায়। স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে সে অপরের রক্ত নিংড়ে নিতে চায়। পরিশেষে পুঁজিপতি ও মজুরদের পারস্পারিক বিবেদের উৎপত্তি হয়।

     ৩-এমন লোক যত সম্পদই লাভ করুক, কিন্তু আরো অধিক উপার্জনের চিন্তা তাকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে, অবকাশ ও অবসর বিনোদনের সময়েও তার একই ভাবনা থাকে যে, কিভাবে তার পুঁজি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে যে সম্পদ তার সুখ-সাচ্ছন্দ্যর মাধ্যম পরিণত হতে পারত, তা পরিণামে তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।

     ৪-সত্য কথা যত উজ্জ্বল হয়েই সামনে উদ্ভাসিত হোক না কেন, তার এমন কোন কথা মেনে নেয়ার সৎসাহস থাকে না, যাকে সে তার উদ্দেশ্য সাধন ও সম্পাদ লাভের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করে। এসব বিষয় পরিশেষে গোটা সমাজের শান্তি ও স্বস্তি বিঘ্নিত করে।

     গভীরভাবে চিন্তা করলে যশ-খ্যাতির মোহের অবস্থাও প্রায় একই রকম বলে পরিলক্ষিত হবে। এর ফলশ্রুতিস্বরূপ অহঙ্কার, স্বার্থান্বেষঅ, অধিখার হরণ, ক্ষমতা লিপ্সা এবং এর পডরিণতিতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও অনুরূপ আরো অগণিত অমানবিক সমাজবিরোধী ও নৈতিকতা বিবর্জিত দাঙ্গা-হাঙ্গামার উৎপত্তি ঘটে, যা পরিণামে গোটা বিশ্বকে নরকে পরিণত করে দেয়। এই উভয় ব্যাধির প্রতিকার কুরআন কারীম এভাবে উপস্থাপন করেছে-

     বলা হয়েছে وَٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ (তোমরা ধৈর্য ও স্বলাত/নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর)। অর্থাৎ, ধৈর্য ধারণ করে ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাকে বশীভুত করে ফেলো। তাতে সম্পদপ্রীতি হ্রাস পাবে। কেননা, সম্পদ বিভিন্ন আস্বাদ ও কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার মাধ্যম বলেই ধন-প্রেমেরে উদ্ভব হয়। যখন এসব আস্বাদ ও কামনা-বাসনার অন্ধ অনুসরণ পরিহার করতে দৃঢ়-সংকল্প হবে, তখন প্রাথমিক অবস্থায় খানিকটা কষ।ট বোধ হলেও ধীরে ধীরে এসব কামনা যথোচিত ও ন্যায়সঙ্গত পর্যাপয়ে নেমে আসবে এবং ন্যায় ও মধ্যমপন্থা তোমাদের স্বভঅব ও অভ্যাসে পরিণত হবে। তখন আর সম্পদের প্রাচুর্যর কোন আবশ্যকতা থাকবে না। সম্পদের মোহও এতে প্রবল হবে না যে, নিজস্ব লাভ-ক্ষতির বিবেচনা ও নেশা তোমাকে অন্ধ করে দেবে।

আর স্বলাত/নামায দ্বারা যশ-খ্যাতির আকর্ষণও দমে যাবে।

     কেননা, স্বলাত/নামাযের মধ্যে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সব ধরনের বিনয় ও নম্রতাই বিদ্যমান। যখন যথা নিয়মে ও যথাযথভাবে স্বলাত/নামায আদায় করার অভ্যাস গড়ে উঠবে, তখন সর্বক্ষণ আল্লাহ্ তা‘আলার সামনে নিজের অক্ষমতা ও ক্ষুদ্রতার ধারণা বিরাজ করতে থঅকবে। ফলে অহঙ্কার, আত্মম্ভরিতা ও মান-মর্যদার মোহ হ্রাস পাবে।

     বিনয়ের নিগুঢ় তত্ত্ব: إِلَّا عَلَى ٱلۡخَٰشِعِينَ (কিন্তু বিনয়ীদের পক্ষে মোটেও কঠিন নয়।) কুরআন ও সুন্নাহ্‌য় সেখানে خُشُوْع বা বিনয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদানের বর্ণনা রয়েছে, সেখানে এর অর্থ অক্ষমতা ও অপারগতাজনিত সেই মানসিক অবস্থঅকেই বোঝঅনো হয়েছে, যা আল্লাহ্ তা‘আলার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁর সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা ও দীনতার অনুভুতি থেকে সৃষ্টি হয়। এর ফলে ‘ইবাদত-উপাসনা সহজতর হয়ে যায়। কখনও এর লক্ষণাদি দেহেও প্রকাশ পেতে থঅকে। তখন সে শিষ্টাচারসম্পন্ন বিনম্র ও কোমলমন বলে পরিদৃষ্ট হয়। যদি হৃদয়ে আল্লাহ্‌ভীতি ও নম্রতা না থাকে, মানুষ বাহ্যিকভাবে যতিই শিষ্টাচারের অীধকারী ও বিনম্র হোক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে সে বিনয়ের অীধকারী হয় না। বিনয়ের লক্ষণাদি ইচ্ছকৃতভঅবে প্রকাশ করাও বাঞ্চনীয় নয়।

     হযরত ‘উমার (রদ্বি:) একবার এক যুবককে নতশিরে বসে থাকতে দেখে বললেন, ‘মাথা উঠাও, বিনয় হৃদয়ে অবস্থান করে।’

     ইব্‌রাহীম নখ’য়ী (র‘হ:) বলেন যে, মোটা কাপড় পরা, মোটা খাওয়া এবং মাথা নত করে থাকার নামই বিনয় নয়।

         خُشُوْع বা বিনয় অর্থ حَقٌّ বা অধিকারের ক্ষেত্রে ইতর-ভদ্র নির্বিশেষে সবার সংগে একই রকম ব্যবহার করা এবং আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার উপর যা ফরয করে দিয়েছেন তা পালন করতে গিয়ে হৃদয়কে শুধু তারই জন্য নির্দিষ্ট ও কেন্দ্রিভুত করে নেয়া।

     সারকথা– ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম উপায়ে বিনয়ীদের রূপ ধারণ করা শয়তান ও প্রবৃত্তির প্রতারণা মাত্র। আর তা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। অবশ্য যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তবে তা ক্ষমার্হ।

     জ্ঞাতব্য: خُشُوْع এর সাথে সাথে অপর একটি শব্দ خُضُوْع ও ব্যবহৃত হয়। কুরআন কারীমে বিভিন্ন জায়গায় তা রয়েছে এ শব্দ দু’টি প্রায় সমার্থক। কিন্তু خُشُوْع শব্দ মূলতঃ কন্ঠ ও দৃষ্টির নিন্মমুখিতা ও বিনয় প্রকাশার্থ ব্যবহৃত হয়-যখন তা কৃত্রিম হবে না বরং অন্তরের ভীতি ও নম্রতার ফলশ্রুতিস্বরূপ হবে। কুরআন কারীমে আছে وَخَشَعَتِ الْأَصْوَاتُ (শব্দ নীচু হয়ে গেল)। এবং خُضُوْع শব্দে দৈহিক ও বাহ্যিক বিনয় ও ক্ষুদ্রতাকে বোঝায়। কুরআন করীমে আছে  فَظَلَّتْ أَعْنَاقُهُمْ لَهَا خَاضِعِيْنَ (অতঃপর তাদের কাঁধ তার সামনে ঝুকিয়ে দিল।)

     স্বলাত/নামাযে বিনয়ের ফেকাহগত মর্যাদা: স্বলাত/নামাযে خُشُوْع বিনয়ের তাকীদ (গুরুত্বারুপ করা) বার বার এসেছে। ইরশাদ হয়েছে. وَاَقِمِ وَٱلصَّلَوٰةَ لِذِكْرِىْ (আমার স্মরণে স্বলাত/নামায প্রতিষ্ঠা কর)। এবং একথা স্পষ্ট যে, غفلت অমনোযোগীতা স্মরণের পরিপন্থী। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ থেকে غافل (অমনোযোগী) সে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করার দায়িত্ব করতে সমর্থ নয়। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,

         وَلَاتَكُنْ مِّنَ الْغَافِلِيْنَ (এবং অমনোযোগীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না)। রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন- স্বলাত/নামায বিনয় ও ক্ষুদ্রতা প্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। অন্য কথায়, অন্তরে বিনয় ও ক্ষুদ্রতাবোধ না থাকলে তা স্বলাত/নামাযই নয়। অপর এক ‘হাদীসে আছে-যার স্বলাত/নামায তাকে অশ্লীলতা ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত না রাখে, সে আল্লাহ্‌র র‘হমত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আর গাফেল বা অমনোযোগীর স্বলাত/নামায তাকে অশ্লীলতা ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে না। এ থেকে বুঝা গেল, যে লোক অন্যমনস্ক হয়ে স্বলাত/নামায পড়ে, সে আল্লাহ্‌র র‘হমত থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। ইমাম গাযালী (র‘হঃ) উল্লেখিত আয়াত ও রিওয়ায়াতসমূহ এবং অন্যান্য প্রমাণাদির উদ্ধৃতি দিয়ে ইরশাদ করেছেন, এগুলোর দ্বারা বুঝা যায় যে,  خشوعবা বিনয় স্বলাত/নামাযের শর্ত এবং স্বলাত/নামাযের বিশুদ্ধতা এরই উপর নির্ভরশীল। হযরত মু‘আয ইব্‌ন জাবাল (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু), সুফিয়ান ছাউরী ও ‘হাসান বসরী (রদ্বিয়াল্লা-হু ‘আনহুম আজমা‘ঈন) প্রমুখের অভীমত এই যে, খুশু বা বিনয় ব্যতীত স্বলাত/নামায আদায় হয় না, বরং তা ভঙ্গ হয়ে যায়।

     কিন্তু ইমাম চতুষ্টয় এবং অধিকাংশ ফক্বীহ্‌গণের মতে খুশু’ স্বলাত/নামাযের শর্ত না হলেও তাঁরা একে স্বলাত/নামাযের রূহ বা আত্মা বলে মন্‌তব্য করে এ শর্ত আরোপ করেছেন যে, তাকবীরে-তা‘হারীমার সময় বিনয়সহ মনের একাগ্রতা বজায় রেখে আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে স্বলাত/নামাযের অতটুকু অংশের ছাওয়াব লাভ করবে না যে অংশে খুশু উপস্থিত ছিল না, তবে ফিক্বাহ্‌ অনুযায়ী তাকে স্বলাত/নামায পরিত্যাগকারীও বলা চলবে না এবং স্বলাত/নামায পরিত্যাগকারীর উপর যে শাস্তি প্রযোজ্য, তার জন্য সে শাস্তিবিধানও করা যাবে না।

     খুশুহীন স্বলাত/নামাযও সম্পূর্ণ নিরর্থক নয়: সবশেষে খুশু’র এ অসাধারণ গুরুত্ব সত্ত্বেও মহান পরওয়ারদিগারের দরবারে আমাদের এই কামনা যেন অন্যমনস্ক ও গাফেল নামাযীও সম্পূর্ণভাবে স্বলাত/নামায পরিত্যাগকারীর পর্যায়ভূক্ত না হয়। কেননা, যে অবস্থায়ই হোক সে অন্ততঃ ফরয আদায়ের পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সমাান্য সময়ের জন্য হলেও অন্তরকে যাবতীয় আকর্ষণ থেকে মুক্ত করে আল্লাহ্‌র প্রতি নিয়োজিত করেছে। কমপক্ষে নিয়তের সময় শুধু সে আল্লাহ্ তা‘আলারই ধ্যানে নিমগ্ন ছিল। এধরনের স্বলাত/নামাযে অন্ততঃ এতটুকু উপকার অবশ্যই হবে যে, তাদের নাম অবাধ্য ও বেনামাযীদের তালিকা বহির্ভূত থাকবে।

     জ্ঞাতব্য: আলোচ্য আয়াতে যে দিনের কথা বলা হয়েছে, সেটি হল ক্বিয়ামতের দিন। দাবী আদায় করে দেয়ার অর্থ- যেমন, কেউ স্বলাত/নামায-স্বওম/রোযার বিনিময়ে তাকে হিসাবমুক্ত করে দেয়া হোক, তবে তা গৃহীত হবে না। বিনিময় অর্থ, টাকা-পয়সা বা ধন-সম্পদের বিনিময়ে দায়মুক্ত করে দেয়া। এ দু’টির কোনটিই গ্রহণ করা হবে না। ঈমান ব্যতীত সুপারিশ গৃহীত না হওয়ার কথা কুরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বারাও বুঝা যায়। প্রকৃত প্রস্তাবে এদের পক্ষে কোন সুপারিশই হবে না। ফলে তা গ্রহণ করার কোন প্রশ্নই উঠেবে না।

     মোট কথা, দুনিয়াতে সাহায্য করার যত পদ্ধতি আছে ঈমান ব্যতীত সেগুলোর কোনটাই আখিরাতে কার্যকর হবে না।

وَإِذۡ نَجَّيۡنَٰكُم مِّنۡ ءَالِ فِرۡعَوۡنَ يَسُومُونَكُمۡ سُوٓءَ ٱلۡعَذَابِ يُذَبِّحُونَ أَبۡنَآءَكُمۡ وَيَسۡتَحۡيُونَ نِسَآءَكُمۡۚ وَفِي ذَٰلِكُم بَلَآءٞ مِّن رَّبِّكُمۡ عَظِيمٞ ٤٩

৪৯.আর (স্মরণ কর) সে সময়ের কথা, যখন আমি তোমাদিগকে মুক্তিদান করেছি ফেরআউনের লোকদের কবল থেকে যারা তোমাদিগকে কঠিন শাস্তি দান করত; তোমাদের পুত্রসন্তানদেরকে জবাই করত এবং তোমাদের স্ত্রীদিগকে অব্যাহতি দিত। বস্তুতঃ তাতে পরীক্ষা ছিল তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে, মহা পরীক্ষা।

وَإِذۡ فَرَقۡنَا بِكُمُ ٱلۡبَحۡرَ فَأَنجَيۡنَٰكُمۡ وَأَغۡرَقۡنَآ ءَالَ فِرۡعَوۡنَ وَأَنتُمۡ تَنظُرُونَ ٥٠

৫০.আর যখন আমি তোমাদের জন্য সাগরকে দ্বিখন্ডিত করেছি, অতঃপর তোমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছি এবং ডুবিয়ে দিয়েছি ফেরআউনের লোকদিগকে অথচ তোমরা দেখছিলে।

وَإِذۡ وَٰعَدۡنَا مُوسَىٰٓ أَرۡبَعِينَ لَيۡلَةٗ ثُمَّ ٱتَّخَذۡتُمُ ٱلۡعِجۡلَ مِنۢ بَعۡدِهِۦ وَأَنتُمۡ ظَٰلِمُونَ ٥١

৫১.আর যখন আমি মূসার সাথে ওয়াদা করেছি চল্লিশ রাত্রির অতঃপর তোমরা গোবৎস বানিয়ে নিয়েছ মূসার অনুপস্থিতিতে। বস্তুতঃ তোমরা ছিলে যালেম।

ثُمَّ عَفَوۡنَا عَنكُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٥٢

৫২.তারপর আমি তাতেও তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নাও।

وَإِذۡ ءَاتَيۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡفُرۡقَانَ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ٥٣

৫৩.আর (স্মরণ কর) যখন আমি মূসাকে কিতাব এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বিধানকারী নির্দেশ দান করেছি, যাতে তোমরা সরল পথ প্রাপ্ত হতে পার।

وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦ يَٰقَوۡمِ إِنَّكُمۡ ظَلَمۡتُمۡ أَنفُسَكُم بِٱتِّخَاذِكُمُ ٱلۡعِجۡلَ فَتُوبُوٓاْ إِلَىٰ بَارِئِكُمۡ فَٱقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ ذَٰلِكُمۡ خَيۡرٞ لَّكُمۡ عِندَ بَارِئِكُمۡ فَتَابَ عَلَيۡكُمۡۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ٥٤

৫৪.আর যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা তোমাদেরই ক্ষতিসাধন করেছ এই গোবৎস নির্মাণ করে। কাজেই এখন তাওবাহ্‌ কর স্বীয় স্রষ্টার প্রতি এবং নিজ নিজ প্রাণ বিসর্জন দাও। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর তোমাদের স্রষ্টার নিকট। তারপর তোমাদের প্রতি লক্ষ্য করা হল। নিঃসন্দেহে তিনিই ক্ষমাকারী, অত্যন্ত মেহেরবান।

وَإِذۡ قُلۡتُمۡ يَٰمُوسَىٰ لَن نُّؤۡمِنَ لَكَ حَتَّىٰ نَرَى ٱللَّهَ جَهۡرَةٗ فَأَخَذَتۡكُمُ ٱلصَّٰعِقَةُ وَأَنتُمۡ تَنظُرُونَ ٥٥

৫৫.আর যখন তোমরা বললে, হে মূসা, কস্মিনকালেও আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহ্‌কে (প্রকাশ্যে) দেখতে পাব। বস্তুতঃ তোমাদিগকে পাকড়াও করল বিদ্যুৎ। অথচ তোমরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে।

ثُمَّ بَعَثۡنَٰكُم مِّنۢ بَعۡدِ مَوۡتِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ ٥٦

৫৬.তারপর, মরে যাবার পর তোমাদিগকে আমি তুলে দাঁড় করিয়েছি, যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নাও।

وَظَلَّلۡنَا عَلَيۡكُمُ ٱلۡغَمَامَ وَأَنزَلۡنَا عَلَيۡكُمُ ٱلۡمَنَّ وَٱلسَّلۡوَىٰۖ كُلُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا رَزَقۡنَٰكُمۡۚ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَٰكِن كَانُوٓاْ أَنفُسَهُمۡ يَظۡلِمُونَ ٥٧

৫৭.আর আমি তোমাদের উপর ছায়া দান করেছি মেঘমালার দ্বারা এবং তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছি ’মান্না’ ও সালওয়া’। সেসব পবিত্র বস্তু তোমরা ভক্ষন কর, যা আমি তোমাদেরকে দান করেছি। বস্তুতঃ তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

জ্ঞাতব্য: কোনো ব্যাক্তি ফির‘আউনের একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, ইসরাঈল বংশে এমন এক ছেলের জন্ম হবে, যার হাতে তোমার রাজ্যের পতন ঘটবে। এজন্য ফির‘আউন নবজাত পুত্রসন্তানদেরকে হত্যা করতে আরম্ভ করলো। আর যেহেতু মেয়েদের দিক থেকে কোনো রকম আশঙ্কা ছিল না, সুতরাং তাদের সম্পর্কে নিশ্চুপ রইলো। দ্বিতীয়ত: এতে তাঁর নিজস্ব একটি মতলবও ছিল যে, সে স্ত্রীলোকদেরকে দিয়ে ধাত্রী-পরিচারিকার কাজও করানো যাবে। সুতরাং এ অনুকম্পাও ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

     এই ঘটনার দ্বারা হয় উল্লেখিত হত্যাকাণ্ডকে  বুঝানো হয়েছে, কিংবা বিপদে ধৈর্যের পরীক্ষা অথবা অব্যাহতি দানের কথা বুঝানো হয়েছে, যা এক অনুগ্রহ ও নেয়ামত/নি‘আমাহ। আর নেয়ামত/নি‘আমার ক্ষেত্রেই শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতার পরীক্ষা হয়।

     জ্ঞাতব্য: এঘটনা ঐ সময়ের, যখন ফির‘আউন সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়ার পর বনী-ইসরাঈলরা কারো কারো মতে মিশরে ফিরে এসেছিল- আবার কারো কারো মতে অন্য কোথাও বসবাস করছিল। তখন মুসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-এর খেদমতে বনী-ইসরাঈলরা আরয করলো যে, আমরা এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ ও নিশ্চিত। যদি আমাদের জন্য কোন শরী‘আত নির্ধারিত হয়, তবে আমাদের জীবন বিধান হিসেবে আমরা তা গ্রহণ ও বরন করে নেবো। মূসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-এর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা অঙ্গিকার প্রদান করলেন যে, তুমি তুর-পর্বতে অবস্থান করে এক মাস পর্যন্ত আমার আরাধনা ও অতন্দ্র সাধনায় নিমগ্ন থাকার পর তোমাকে এক কিতাব দান করবো। মুসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম) তাই করলেন। ফলে তাওরাত লাভ করলেন। কিন্তু অতিরিক্ত দশ দিন উপাসনা-আরাধনায় মগ্ন থাকার নির্দেশ দেয়ার কারণ ছিল এই যে, হযরত মুসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম) একমাস রোযা/স্বওম রাখার পর ইফতার করে ফেলেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলার কাছে রোযাদারের মুখের গন্ধ অত্যন্ত পছন্দনীয় বলে মুসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-কে আরো দশ দিন রোযা/স্বওম রাখতে নির্দেশ দিলেন, যাতে পুনরায় সে গন্ধের উৎপত্তি হয়। এভাবে চল্লিশ দিন পূর্ণ হলো। মুসা (আ,) তো ওদিকে তুর-পর্বতে রইলেন, এদিকে সামেরি নামক এক ব্যক্তি সোনা-রূপা দিয়ে গোবৎসের একটি প্রতিমূর্তি তৈরি করলো এবং তাঁর কাছে পূর্ব থেকে সংরক্ষিত জিবরাঈল (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-এর ঘোড়ার খুরের তলার কিছু মাটি প্রতিমূর্তির ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়ায় সেটি জীবন্ত হয়ে উঠলো এবং অশিক্ষিত বনী-ইসরাঈলরা তারই পূজা করতে আরম্ভ করে দিল।

     এ তাওবার বর্ণনা পরবর্তী তৃতীয় আয়াতে রয়েছে। আর ‘আশার’ অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ্‌ পাকের এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ ছিল। বরং এর অর্থ এই যে, মাফ করে দেয়া এমন এক জিনিস যার প্রতি লক্ষ্য করে বনী-ইসরাঈল আল্লাহ্‌ পাকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে বলে দর্শকদের মনে আশার সঞ্চার হতে পারে।

     জ্ঞাতব্য: মীমাংসার বস্তু দ্বারা হয়ত তাউরাতের অন্তর্ভুক্ত শরী‘আতী বিধানমালাকে বোঝানো হয়েছে। কেননা, শরী‘আতের মাধ্যমে যাবতীয় বিশ্বাসগত ও কর্মগত মতবিরোধের মীমাংসা হয়ে যায়। অথবা মু‘জিযাহ্ বা অলৌকিক ঘটনাবলীকে বোঝানো হয়েছে- যদ্দ্বারা সত্য ও মিথ্যা দাবীর ফয়সালা হয়। অথবা স্বয়ং আউরাতই এর অর্থ। কেননা, এর মধ্যেও মীমাংসাকারীর জন্য প্রয়োজনীয় উভয় গুন ও বৈশিষ্টের সমাবেশ রয়েছে।

     জ্ঞাতব্য: এটা তাদের তাওবার জন্যে প্রস্তাবিত পদ্ধতির বর্ণনা-অর্থাৎ, অপরাধিগণকে হত্যা করে দেয়া। আমাদের শরী‘আতেও এমন কোন কোন অপরাধের জন্য তাওবাহ্ করা স্বত্ত্বেও মৃত্যুদণ্ড বা শারীরিক দণ্ডের ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন, ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি হত্যা। সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত যিনার (ব্যভিচার) শাস্তি ‘রজম’ বা পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করা। আউবার দ্বারা এ শাস্তি থেকে অব্যাহতি নেই। বস্তুতঃ তারা এই নির্দেশ কার্যে পরিণত করেছিল বলে পরকালে দয়া ও করুণার অধিকারী হয়েছে।

     জ্ঞাতব্য: ঘটনা এই–যখন হযরত মুসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম) তূর-পর্বত থেকে তাওরাত নিয়ে এসে বনী-ইসরাঈলের সামনে পেশ করে বললেন যে, এটা আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব, তখন কিছুসংখ্যক উদ্ধত লোক বললো, যদি আল্লাহ স্বয়ং বলে দেন যে, এ কিতাব তাঁর প্রদত্ত, তবে অবশ্যই আমাদের বিশ্বাস এসে যাবে। মুসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম) আল্লাহর অনুমতিক্রমে এতদুদ্দেশে তাদেরকে তূর-পর্বতে যেতে বললেন। বনী-ইসরাঈলরা সত্তুর জন লোককে মনোনীত করে হযরত মুসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-এর সঙ্গে তূর-পর্বতে পাঠাল। সেখানে পৌঁছে তারা আল্লাহর বাণী স্বয়ং শুনতে পেল। তখন তারা নতুন ভান করে বললো, শুধু কথা শুনে তো আমাদের তৃপ্তি হচ্ছে না- আল্লাহই  জানে একথা কে বলছে। যদি আল্লাহকে দেখতে পাই, তবে অবশ্যই মেনে নেবো। কিন্তু যেহেতু এ মরণজগতে আল্লাহকে দেখার ক্ষমতা কারো নেই। কাজেই এই ধৃষ্টতার জন্য তাদের উপর বজ্রপাত হলো এবং সবাই ধ্বংস হয়ে গেল। তাদের এ ধ্বংস-প্রাপ্তির বর্ণনা পরবর্তী আয়াতে রয়েছে।

     জ্ঞাতব্য: ‘মউত’ শব্দ দ্বারা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, তারা বজ্রপাতের ফলে মৃত্যুবরণ করেছিল। তাদের পুনর্জীবিত হওয়ার ঘটনা এরূপ –মুসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম) আল্লাহর দরবারে নিবেদন করলেন, বনী-ইসরাঈল এমনিতেই আমার প্রতি কু-ধারণা পোষণ করে থাকে। এখন তারা ভাববে যে, এ লোকগুলোকে কোথাও নিয়ে গিয়ে কোনো উপায়ে আমি স্বয়ং ধ্বংস করে দিয়েছি। সুতরাং আমাকে মেহেরবানীপুর্বক এ অপবাদ থেকে রক্ষা করুন। তাই আল্লাহ পাক দয়াপরবশ হয়ে তাদেরকে পুনর্জীবিত করে দিলেন।

     জ্ঞাতব্য: উভয় ঘটনাই ঘটেছিল তীহ প্রান্তরে। তাঁর বিস্তারিত বর্ণনা এই যে বনী-ইসরাঈলের আদি বাসস্থান ছিল শাম দেশে। হযরত ইউসুফ (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-এর সময়ে তারা মিশরে এসে বসবাস করতে থাকে, আর ‘আমালেকা’ নামক এক জাতি শাম দেশ দখল করে নেয়। ফির‘আউনের ডুবে মরার পর যখন এরা শান্তিতে বসবাস করতে থাকে, তখন আল্লাহ পাক আমালেকাদের সাথে জিহাদ করে তাদের আদি বাসস্থান পুনর্দখল করতে নির্দেশ দিলেন। বনী-ইসরাঈল এতদুদ্দেশে মিশর থেকে রওয়ানা হল। শামের সীমান্তে পোঁছার পর আমালেকাদের শৌর্য-বীর্যের কথা জেনে তারা সাহস হারিয়ে হীনবল হয়ে পড়লো এবং জিহাদ করতে পরিষ্কার অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলো। তখন আল্লাহ পাক তাদেরকে এ শাস্তি প্রদান করলেন, যাতে তারা একই প্রান্তরে চল্লিশ বছর হতবুদ্ধি হয়ে দিক-বিদিক জ্ঞানশুন্যভাবে বিচরণ করতে থাকে। ঘরে ফেরা আর তাদের ভাগ্যে জোটেনি।

     এ প্রান্তর কোনো বিশাল ভূ-খণ্ড ছিল না। ‘তীহ’ প্রান্তর মিশর ও শাম দেশের মধ্যবর্তী দশ মাইল এলাকা বিশিষ্ট একটি ভূ-ভাগ। বর্ণিত আছে, এরা নিজেদের বাসস্থান মিশরে পৌঁছার জন্য সারা দিন চলার পর রাতে কোনো মঞ্জিলে অবস্থান করত, কিন্তু ভোরে ওঠে দেখতে পেত- যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেখানেই রয়ে গেছে। এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত এ প্রান্তরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শ্রান্ত ও ক্লান্তভাবে বিচরণ করছিল।

وَإِذۡ قُلۡنَا ٱدۡخُلُواْ هَٰذِهِ ٱلۡقَرۡيَةَ فَكُلُواْ مِنۡهَا حَيۡثُ شِئۡتُمۡ رَغَدٗا وَٱدۡخُلُواْ ٱلۡبَابَ سُجَّدٗا وَقُولُواْ حِطَّةٞ نَّغۡفِرۡ لَكُمۡ خَطَٰيَٰكُمۡۚ وَسَنَزِيدُ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٥٨

৫৮.আর যখন আমি বললাম, তোমরা প্রবেশ কর এ নগরীতে এবং এতে যেখানে খুশী খেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে থাক এবং দরজার ভিতর দিয়ে প্রবেশ করার সময় সেজদা করে ঢুক, আর বলতে থাক-‘আমাদিগকে ক্ষমা করে দাও’-তাহলে আমি তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করব এবং সৎ কর্মশীলদেরকে অতিরিক্ত দানও করব।

فَبَدَّلَ ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ قَوۡلًا غَيۡرَ ٱلَّذِي قِيلَ لَهُمۡ فَأَنزَلۡنَا عَلَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ رِجۡزٗا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ بِمَا كَانُواْ يَفۡسُقُونَ ٥٩

৫৯.অতঃপর যালেমরা কথা পাল্টে দিয়েছে, যা কিছু তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল তা থেকে। তারপর আমি অবতীর্ণ করেছি যালেমদের উপর আযাব, আসমান থেকে, নির্দেশ লংঘন করার কারণে।

۞وَإِذِ ٱسۡتَسۡقَىٰ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦ فَقُلۡنَا ٱضۡرِب بِّعَصَاكَ ٱلۡحَجَرَۖ فَٱنفَجَرَتۡ مِنۡهُ ٱثۡنَتَا عَشۡرَةَ عَيۡنٗاۖ قَدۡ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٖ مَّشۡرَبَهُمۡۖ كُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ مِن رِّزۡقِ ٱللَّهِ وَلَا تَعۡثَوۡاْ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِينَ ٦٠

৬০.আর মূসা যখন নিজ জাতির জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, স্বীয় যষ্ঠির দ্বারা আঘাত কর পাথরের উপরে। অতঃপর তা থেকে প্রবাহিত হয়ে এল বারটি প্রস্রবণ। তাদের সব গোত্রই চিনে নিল নিজ নিজ ঘাট। আল্লাহ্‌র দেয়া রিযিক খাও, পান কর আর দুনিয়ার বুকে দাংগা-হাংগামা করে বেড়িও না।

وَإِذۡ قُلۡتُمۡ يَٰمُوسَىٰ لَن نَّصۡبِرَ عَلَىٰ طَعَامٖ وَٰحِدٖ فَٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُخۡرِجۡ لَنَا مِمَّا تُنۢبِتُ ٱلۡأَرۡضُ مِنۢ بَقۡلِهَا وَقِثَّآئِهَا وَفُومِهَا وَعَدَسِهَا وَبَصَلِهَاۖ  قَالَ أَتَسۡتَبۡدِلُونَ ٱلَّذِي هُوَ أَدۡنَىٰ بِٱلَّذِي هُوَ خَيۡرٌۚ ٱهۡبِطُواْ مِصۡرٗا فَإِنَّ لَكُم مَّا سَأَلۡتُمۡۗ  وَضُرِبَتۡ عَلَيۡهِمُ ٱلذِّلَّةُ وَٱلۡمَسۡكَنَةُ وَبَآءُو بِغَضَبٖ مِّنَ ٱللَّهِۗ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَانُواْ يَكۡفُرُونَ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِ وَيَقۡتُلُونَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّۗ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَواْ وَّكَانُواْ يَعۡتَدُونَ ٦١

৬১.আর তোমরা যখন বললে, হে মূসা, আমরা একই ধরনের খাদ্য-দ্রব্যে কখনও ধৈর্য্যধারণ করব না। কাজেই তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট আমাদের পক্ষে প্রার্থনা কর, তিনি যেন আমাদের জন্যে এমন বস্তুসামগ্রী দান করেন যা জমিতে উৎপন্ন হয়, তরকারী, কাকড়ী, গম, মসুরি, পেঁয়াজ প্রভৃতি। মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) বললেন, তোমরা কি এমন বস্তু নিতে চাও যা নিকৃষ্ট সে বস্তুর পরিবর্তে যা উত্তম? তোমরা কোন নগরীতে উপনীত হও, তাহলেই পাবে যা তোমরা কামনা করছ। আর তাদের উপর আরোপ করা হল লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা। তারা আল্লাহ্‌র রোষানলে পতিত হয়ে ঘুরতে থাকল। এমন হলো এ জন্য যে, তারা আল্লাহ্‌র বিধি বিধান মানতো না এবং নবীগনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করত। তার কারণ, তারা ছিল নাফরমান সীমালংঘকারী।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

জ্ঞাতব্য: শাহ আব্দুল ক্বাদের (র‘হিমাহুল্ল-হ্)-এর বক্তব্যানুসারে এ ঘটনা তীহ উপত্যকায় বসবাসকালে সংঘটিত হয়েছিল। যখন বানী-ইসরাঈলের একটানা ‘মান্না ও সাল্‌ওয়া-’ খেতে খেতে বিস্বাদ এসে গেল এবং স্বাভাবিক খাবারের জন্য প্রার্থনা করল (যেমন, পরবর্তী চতুর্থ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে), তখন তাদেরকে এমন এক নগরীতে প্রবেশ করতে হুকুম দেয়া হল, যেখানে পানাহারের জন্য সাধারণভাবে ব্যবহার্য দ্রব্যাদি পাওয়া যাবে। সুতরাং এ হুকুমটি সে নগরীতে প্রবেশ করা সম্পর্কিত। এখানে নগরীতে প্রবেশকালে কর্মজনিত ও বাক্যজনিত দুটি আদবের (শিষ্টাচার) বর্ণনা দেয়া হয়েছে। (‘তাওবাহ্’ বলে প্রবেশ করার মধ্যে বাক্যজনিত এবং প্রণত মস্তকে প্রবেশ করার মধ্যে কার্যজনিত আদব তথা শিষ্টাচার)। এ প্রসঙ্গে বড় জোর একথা বলা যাবে যে, ঘটনার পরের অংশটি আগে এবং আগের অংশটি পরে বর্ণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে জটিলতা তখনই হত, যখন কুরআন মাজীদের ঘটনাই মুখ্য উদ্দেশ্য হত। কিন্তু যখন ফলাফল বর্ণনাই মূল লক্ষ্য, তখন যদি একটি ঘটনার বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রত্যেক অংশের ফলাফল ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং ফলাফলগুলোর কোন প্রতিক্রিয়া ও প্রভাবের কথা বিবেচনা করে যদি আগের অংশকে পরে এবং পরের অংশকে আগে বর্ণনা করা হয়, তবে এতে কোন দোষের কারণ নেই এবং কোন আপত্তিরও কারণ থাকতে পারে না।

     অন্য তাফসীরকারদের মতে এ হুকুম ঐ নগরী সংক্রান্ত ছিল, যেখানে তাদেরকে জিহাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তীহ উপত্যকায় তাদের অবস্থানকাল শেষ হওয়ার পর আবার সেখানে জিহাদ সংঘঠিত হয়েছিল এবং সে নগরীর উপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় ছাইয়াদানা ইউশা’ (يوشع ) (‘আলাইহিচ্ছালাম) নবী ছিলেন। সে নগরীতে জিহাদের হুকুমটি তাঁরই মাধ্যমে এসেছিল।

     প্রথম অভিমত অনুসারে ‘মান্না’ ও ‘সাল্‌ওয়া-’ বর্জন করে সাধারণ খাবার সংক্রান্ত বানী-ইসরাঈলের আবেদনকেও পূর্ববর্তী অপরাধগুলোর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া উচিৎ। তখন মর্ম দাঁড়াবে এই যে, আবেদনটি তো ধৃষ্টতাপূর্ণই ছিল, কিন্তু তবুও তারা যদি এ শিষ্টাচার (আদব) ও নির্দেশ পালন করে, তবে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। এই উভয় অভিমত অনুযায়ী এ ক্ষমা সকল বক্তার জন্য তো সাধারণভাবে প্রযোজ্য হবে। তদুপরি যারা নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার সাথে সৎকার্যাবলী সম্পন্ন করবে, তাদের জন্য এছাড়াও অতিরিক্ত পুরস্কার থাকবে।

     বাক্যের শব্দগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শরী‘আতের বিধানঃ এ আয়াত দ্বারা জানা গেল যে, বানী-ইসরাঈলকে উক্ত নগরীতে حطة বলতে বলতে প্রবেশ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তারা দুষ্টামী করে সে শব্দের পরিবর্তে  حنطة বলতে থাকে। ফলে তাদের উপর আসমানী শাস্তি অবতীর্ণ হল। এই শব্দগত পরিবর্তন এমন ছিল- যাতে শুধু শব্দই পরিবর্তন হয়ে যায়নি, অর্থও সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গিয়েছিল। حطة অর্থ তাওবাহ্ ও পাপ বর্জন করা। আর حنطة অর্থ গম। এ ধরণের শব্দগত পরিবর্তন, তা কুরআনেই হোক বা ‘হাদীসে কিংবা অন্য কোনো আল্লাহ্‌প্রদত্ত বিধানে নিঃসন্দেহে এবং সর্ববাদিসম্মতভাবে ‘‘হারাম। কেননা, এটা এক ধরণের تحريف তথা শব্দগত ও অর্থগত বিকৃতিসাধন।
এখন রইল এই যে, অর্থ ও উদ্দেশ্য পুরোপুরি রক্ষা করে নিছক শব্দগত পরিবর্তন সম্পর্কে কি হুকুম? ইমাম কুরতুবী এ সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, কোন কোন বাক্যাংশে বা বক্তব্যে শব্দই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে এবং মর্ম ও ভাব প্রকাশের জন্য শব্দই অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। এ ধরণের উক্তি ও বাণীর ক্ষেত্রে শব্দগত পরিবর্তনও জায়েজ নয়। যেমন আযানের জন্য নির্ধারিত শব্দের স্থলে সমার্থবোধক অন্য কোন শব্দ পাঠ করা জায়েজ তথা বৈধ নয়।  অনুরূপভাবে নামায/স্বলাতের মাঝে নির্দিষ্ট দু‘আসমুহ। যেমন, ছানা-, আত্তা‘হিয়্যাতু, দু‘আয়ে-ক্বুনূত ও রুকূ’-সিজদার তাসবী‘হসমুহ। এগুলোর অর্থ সম্পূর্ণভাবে ঠিক রেখেও কোন রকম শব্দগত পরিবর্তন জায়েজ বা বৈধ নয়। তেমনিভাবে সমগ্র কুরআন মাজীদের শব্দাবলীরও একই হুকুম। অর্থাৎ কুরআন তিলাওয়াতের সংগে যেসব হুকুম সম্পর্কযুক্ত, তা শুধু ঐ শব্দাবলীতেই তিলাওয়াত করতে হবে, যাতে কুরআন নাযিল বা অবতরণ হয়েছে। যদি কোন ব্যক্তি এসব শব্দাবলীর অনুবাদ অন্য এমন শব্দের দ্বারা করে পাঠ করতে থাকে, যাতে অর্থ পুরোপুরিই ঠিক থাকে, তবে একে শরী‘আতের পরিভাষায় কুরআন তিলাওয়াত বলা যাবে না। কুরআন পাঠ করার জন্য যে ছাওয়াব নির্দিষ্ট রয়েছে, তাও লাভ করতে পারবে না। কারণ কুরআন শুধু অর্থের নাম নয় বরং অর্থের সাথে সাথে যে শব্দাবলীতে তা নাযিল বা অবতরণ হয়েছে, তার সমষ্টির নামই কুরআন। আলোচ্য আয়াতের ভাষ্যে দৃশ্যতঃ বোঝা যায় যে, তাদেরকে তাওবার উদ্দেশ্যে যে শব্দটি বাতলে দেয়া হয়েছিল, তার উচ্চারণও করণীয় ছিল; সেগুলোতে পরিবর্তন সাধন ছিল পাপ। আর তারা যে পরিবর্তন করেছিল তা ছিল শব্দের সাথে সাথে অর্থেরও পরিপন্থী। কাজেই তারা আসমানী ‘আযাব বা শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিল।

     কিন্তু যে উক্তি ও বাক্যাংশে অর্থই মূল উদ্দেশ্য শব্দ নয়, যদি সেগুলোর শব্দগত এমন পরিবর্তন করা হয় যাতে অর্থের ক্ষেত্রে কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে না, তবে অধিকাংশ মু‘হাদ্দেসীন ও ফুক্বাহার (ইসলামী স্কলার) মতে এ পরিবর্তন জায়েজ বা বৈধ। ইমাম মালেক, শাফি‘য়ী ও ইমাম ‘আয্বম (র‘হিমাহুমুল্ল-হ্)- থেকে ইমাম কুরতুবী উদ্ধৃত করেন যে, ‘হাদিসের অর্থভিত্তিক বর্ণনা জায়েজ, কিন্তু শর্ত হচ্ছে এই যে, বর্ণনাকারীকে ‘আরবী ভাষায় পারদর্শী হতে হবে এবং ‘হাদিস বর্ণনার স্থান-কাল পাত্র সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞাত থাকতে হবে- যাতে তার ভুলের কারণে অর্থের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি না হয়।

     উল্লেখিত ৬০তম আয়াতে বলা হয়েছে, হযরত মূসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম) নিজ সম্প্রদায়ের প্রয়োজনে পানির জন্য দু‘আ করলে আল্লাহ্ তা‘আলা পানির ব্যবস্থা করে দিলেন। পাথরের উপর লাঠির আঘাতের সাথে সাথে প্রস্রবণ প্রবাহিত হয়ে পড়ল। এতে বোঝা গেল যে, ইস্তেস্কা (পানির জন্য প্রার্থনা)-এর মূল হল দু‘আ। মূসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-এর শরী‘আতেও বিষয়টিকে শুধু দু‘আতেই সীমিত রাখা হয়েছে। যেমন ইমাম ‘আযম আবূ ‘হানীফাহ্ (র‘হিমাহুল্ল-হ্) বলেন যে, ইস্তেস্কার মূল হলো পানির জন্য দু‘আ করা। এ দু‘আ কোন কোন সময়ে ইস্তেস্কার স্বলাত/নামাযের আকারেও করা হয়েছে। যেমন, ইস্তেস্কার স্বলাত/নামাযের উদ্দেশ্যে রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ঈদগাহে তশরীফ নেয়া এবং সেখানে স্বলাত/নামায, খুৎবাহ্ ও দু‘আ করার কথা বিশুদ্ধ ‘হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। আবার কখনো কখনও স্বলাত/নামায বাদ দিয়ে শুধু বাহ্যিক অর্থে দু‘আ করেই ক্ষান্ত করেছেন। যেমন, বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে যে, রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জুমা/জুমু‘আর খুৎবায় পানির জন্য দু‘আ করেন- ফলে আল্লাহ্ তা‘আলা বৃষ্টি বর্ষণ করেন।

     একথা সর্ববাদিসম্মত যে, ইস্তেস্কা স্বলাত/নামাযের আকারে হোক বা দু‘আ রূপে হোক তা ক্রিয়াশীল ও গুরুত্ববহ হওয়ার জন্য পাপ থেকে তাওবাহ্, নিজের দীনতা-হীনতা ও দাসত্বসুলভ আচরণের অভিব্যক্তি একান্ত আবশ্যক। পাপে অটল এবং আল্লাহ্‌র অবাধ্যতায় অনড় থেকে দু‘আ করলে তা ক্রিয়াশীল হবে বলে আশা করার অধিকার কারো নেই।

     জ্ঞাতব্য: ৬১তম আয়াতে বর্ণিত ঘটনাও তীহ উপত্যকাসংশ্লিষ্ট। মান্না ও সালওয়া-র প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই তারা ওসব সব্জী ও শস্যের জন্য আবেদন করল। এ প্রান্তরের সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি শহর ছিল। সেখানে গিয়ে চাষাবাদ করে উৎপন্ন ফসলাদি ভোগের নির্দেশ দেয়া হলো।

     তাদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনার মধ্যে এটাও একটা যে, ক্বিয়ামাহ/ক্বিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য ইহুদীদের থেকে রাজ্য ছিনিয়ে নেয়া হলো। অবশ্য ক্বিয়ামতের অব্যবহিত পূর্বে, সর্বমোট চল্লিশ দিনের জন্য নিছক লুটেরা দলের ন্যায় অনিয়মিত ও আইন-শৃঙ্খলা বিবর্জিত, ইহুদীদের কিঞ্চিৎ ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। একে কোন বুদ্ধিমান ও বিবেকবানই রাজ্য বলতে পারবে না। আল্লাহ্ তা‘আলা ছাইয়াদানা মূসা (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-এর মাধ্যমে পূর্বেই তাদেরকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, যদি নির্দেশ অমান্য কর, তবে চির কাল তোমরা অন্য জাতির দ্বারা শাসিত হতে থাকবে। যেমন- সুরা আ‘রাফে বলা হয়েছে-

وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكَ لَيَبْعَثَنَّ عَلَيْهِمْ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَن يَسُومُهُمْ سُوءَ الْعَذَابِ

এবং সে সময়টি স্মরণ করুন, যখন আপনার পালনকর্তা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, নিশ্চয় তিনি ইহুদীদের উপর ক্বিয়ামত/ক্বিয়ামাহ্ পর্যন্ত এমন শাসক প্রেরণ (নিয়োগ) করতে থাকবেন, যারা তাদের প্রতি কঠিন শাস্তি পৌঁছাতে থাকবে।’ বস্তুতঃ বর্তমান ইসরাঈল রাষ্ট্রের মর্যাদাও আমেরিকা ও বৃটেনের গোলাম বৈ কিছু নয়।

     তাছাড়াও বহু নবী বিভিন্ন সময়ে ইহুদীদের হাতে নিহত নিগৃহিত হয়েছেন- যা নিতান্ত অন্যায় বলে তারা নিজেরাও উপলব্ধি করত, কিন্তু প্রতিহিংসা ও হঠকারিতা তাদেরকে অন্ধ করে রেখেছিল।

     ইহুদীদের চিরস্থায়ী লাঞ্ছনার অর্থ, বর্তমান ইসরাঈল রাষ্ট্রের ফলে উদ্ভূত সন্দেহ ও তার উত্তরঃ উল্লেখিত আয়াতসমূহে ইহুদীদের শাস্তি, ইহকালে চিরস্থায়ী লাঞ্ছনা-গঞ্জনা এবং ইহকাল ও পরকালে আল্লাহ্‌র গযব ও রোষের বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। বিশিষ্ট তাফসীরকারগণ, সা‘হাবায়ে কেরাম ও তাবে‘য়ীনের বর্ণনানুসারে ওদের স্থায়ী লাঞ্ছনা-গঞ্জনার প্রকৃত অর্থ, কুরআনের প্রখ্যাত ভাষ্যকার ইব্‌ন কাসীরের ভাষায়ঃ “তারা যত ধন-সম্পদের অধিকারীই হোক না কেন, বিশ্ব-সম্প্রদায়ের মাঝে তুচ্ছ ও নগণ্য বলে বিবেচিত হবে। যার সংস্পর্শে আসবে সেই তাদেরকে অপমানিত করবে এবং তাদেরকে দাসত্বের শৃঙ্খলে জড়িয়ে রাখবে।”

     বিশিষ্ট তাফসীরকার ইমাম যাহ্হাকের ভাষায় এ লাঞ্ছনা-অবমাননার অর্থ: ইহুদীরা সর্বদা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপরের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকবে।

      একই মর্মে সুরা ‘আ-লি-‘ইমরানের’ এক আয়াতে রয়েছে:

ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ أَيْنَ مَا ثُقِفُوا إِلا بِحَبْلٍ مِنَ اللَّهِ وَحَبْلٍ مِنَ النَّاسِ

“আল্লাহ্ প্রদত্ত ও মানব প্রদত্ত মাধ্যম ব্যতীত, তারা যেখানে যাবে সেখানেই তাদের জন্য লাঞ্ছনা ও অবমাননা পুঞ্জীভূত হয়ে থাকবে।” আল্লাহ্ প্রদত্ত ও মানব প্রদত্ত মাধ্যমের অর্থ এই যে, যাদেরকে আল্লাহ্ পাক নিজের নিধান অনুসারে আশ্রয় ও অভয় দিয়েছেন। যেমন-অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালকগণ বা রমণীকুল বা এমন সাধক ও উপাসক যে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় না, তারা নিরাপদে থাকবে। আর মানবপ্রদত্ত মাধ্যম অর্থ শান্তিচুক্তি। যার একটি রূপ এও হতে পারে যে, মুসলমানদের সাথে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বা অমুসলিম সংখ্যালঘু হিসাবে জিযিয়া কর প্রদানের প্রতিশ্রুতিতে তাদের দেশে বসবাসের সুযোগ লাভ করবে। কিন্তু কুরআনের আয়াতে مِنَ النَّاسِ বলা হয়েছে مِنَ المسلمينَ বলা হয়নি। সুতরাং এমন হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে যে, অন্যান্য অমুসলিমদের সাথে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তাদের আশ্রয়াধীন হয়ে সাময়িক বসসাব করতে পারবে।

     সারকথা, ইহুদীরা উপরোক্ত দু’অবস্থা ব্যতীত সর্বত্র ও সর্বদাই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে।

     (১) আল্লাহ্ প্রদত্ত ও অনুমোদিত আশ্রয়ের মাধ্যমে, যার ফলে তাদের অপ্রাপ্ত সয়স্ক সন্তান-সন্ততি, নারী প্রভৃতি এই লাঞ্ছনা ও অবমাননা থেকে অব্যাহতি পাবে। কিংবা-

     (২) শান্তিচুক্তির মাধ্যমে নিজেদেরকে এ অবমাননা থেকে মুক্ত রাখতে পারবে। এ চুক্তি মুসলমানদের সাথেও হতে পারে। কিংবা অন্যান্য অমুসলিম জাতির সাথেও হতে পারে।

     এমনিভাবে সূরা ‘আ-লি ‘ইমরানের’ আয়াত দ্বারা সূরা-বাক্বারার আয়াতের বিশদ বিশ্লেষণ হয়ে যায়। অধুনা ফিলিস্তীনে ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে মুসলমানদের মধ্যে যে সন্দেহের অবতারণা হয়েছে, এ দ্বারা তাও দূরীভূত হয়ে যায়। তা এই যে, কুরআনের আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, ইহুদীদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কখনও সম্ভব হবে না। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, ফিলিস্তীনে তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উত্তর সুস্পষ্ট- কেননা, ফিলিস্তীনে ইহুদীদের বর্তমান রাষ্ট্রের গূঢ়তত্ত্ব সম্পর্কে যারা সম্যক অবগত, তারা ভালভাবেই জানেন যে, এ রাষ্ট্র প্রকৃত প্রস্তাবে ইসরাঈলের নয়, বরং আমেরিকা ও বৃটেনের একটি ঘাঁটি ছাড়া অন্যকিছু নয়। এ রাষ্ট্র নিজস্ব সম্পদ ও শক্তির উপর নির্ভর করে একমাসও টিকে থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ। পাশ্চাত্যের খ্রীষ্টান শক্তি ইসলামী বিশ্বকে দূর্বল করার উদ্দেশে তাদের মাঝখানে ইসরাঈল নাম দিয়ে একটি সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছে। এ রাষ্ট্র আমেরিকা-ইউরোপীয়দের দৃষ্টিতে একটা অনুগত আজ্ঞাবহ ষড়যন্ত্র কেন্দ্র ছাড়া অন্য কোন গুরুত্ব বহন করে না। এ যেন কুরআনের বাণী وَحَبْلٍ مِنَ النَّاسِ -এরই বাস্তব রূপ। পাশ্চাত্য শক্তিবলয়, বিশেষ করে আমেরিকার সাথে নানা ধরনের প্রকাশ্য ও গোপন চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে তাদের পক্ষপুষ্ট ও আশ্রিত হয়ে নিছক ক্রীড়নক রূপে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তাও অত্যন্ত লাঞ্ছনা ও অবমাননার ভেতর দিয়ে। সুতরাং বর্তমান ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দরুন কুরআনের কোন আয়াত সম্পর্কে সামান্যতম সন্দেহেরও অবকাশ সৃষ্টি হতে পারে না।

إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَٱلَّذِينَ هَادُواْ وَٱلنَّصَٰرَىٰ وَٱلصَّٰبِ‍ِٔينَ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا فَلَهُمۡ أَجۡرُهُمۡ عِندَ رَبِّهِمۡ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ٦٢

৬২.নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী, নাসারা ও সাবেঈন, (তাদের মধ্য থেকে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ্‌র প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি এবং সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না।

وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّورَ خُذُواْ مَآ ءَاتَيۡنَٰكُم بِقُوَّةٖ وَٱذۡكُرُواْ مَا فِيهِ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٦٣

৬৩.আর আমি যখন তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তুর পর্বতকে তোমাদের মাথার উপর তুলে ধরেছিলাম এই বলে যে, তোমাদিগকে যে কিতাব দেয়া হয়েছে তাকে ধর সুদৃঢ়ভাবে এবং এতে যা কিছু রয়েছে তা মনে রেখো যাতে তোমরা ভয় কর।

ثُمَّ تَوَلَّيۡتُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَۖ فَلَوۡلَا فَضۡلُ ٱللَّهِ عَلَيۡكُمۡ وَرَحۡمَتُهُۥ لَكُنتُم مِّنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٤

৬৪.তারপরেও তোমরা তা থেকে ফিরে গেছ। কাজেই আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও মেহেরবানী যদি তোমাদের উপর না থাকত, তবে অবশ্যই তোমরা ধবংস হয়ে যেতে।

وَلَقَدۡ عَلِمۡتُمُ ٱلَّذِينَ ٱعۡتَدَوۡاْ مِنكُمۡ فِي ٱلسَّبۡتِ فَقُلۡنَا لَهُمۡ كُونُواْ قِرَدَةً خَٰسِ‍ِٔينَ ٦٥

৬৫.তোমরা তাদেরকে ভালরূপে জেনেছ, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমা লঙ্ঘণ করেছিল। আমি বলেছিলামঃ তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও।

فَجَعَلۡنَٰهَا نَكَٰلٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهَا وَمَا خَلۡفَهَا وَمَوۡعِظَةٗ لِّلۡمُتَّقِينَ ٦٦

৬৬.অতঃপর আমি এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত এবং আল্লাহ্‌ভীরুদের জন্য উপদেশ গ্রহণের উপাদান করে দিয়েছি।

وَإِذۡ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوۡمِهِۦٓ إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُكُمۡ أَن تَذۡبَحُواْ بَقَرَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَتَّخِذُنَا هُزُوٗاۖ قَالَ أَعُوذُ بِٱللَّهِ أَنۡ أَكُونَ مِنَ ٱلۡجَٰهِلِينَ ٦٧

৬৭.যখন মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) স্বীয় সম্প্রদায়কে বললেনঃ আল্লাহ্‌ তোমাদের একটি গরু জবাই করতে বলেছেন। তারা বলল, তুমি কি আমাদের সাথে উপহাস করছ? মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) বললেন, মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আমি আল্লাহ্‌র আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا فَارِضٞ وَلَا بِكۡرٌ عَوَانُۢ بَيۡنَ ذَٰلِكَۖ فَٱفۡعَلُواْ مَا تُؤۡمَرُونَ ٦٨

৬৮.তারা বলল, তুমি তোমার পালনকর্তার কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা কর, যেন সেটির রূপ বিশ্লেষণ করা হয়। মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) বললেন, তিনি বলছেন, সেটা হবে একটা গাভী, যা বৃদ্ধ নয় এবং কুমারীও নয়-বার্ধক্য ও যৌবনের মাঝামাঝি বয়সের। এখন আদিষ্ট কাজ করে ফেল।

قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا لَوۡنُهَاۚ قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ صَفۡرَآءُ فَاقِعٞ لَّوۡنُهَا تَسُرُّ ٱلنَّٰظِرِينَ ٦٩

৬৯.তারা বলল, তোমার পালনকর্তার কাছে আমাদের জন্য প্রার্থনা কর যে, তার রঙ কিরূপ হবে? মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) বললেন, তিনি বলেছেন যে, গাঢ় পীতবর্ণের গাভী-যা দর্শকদের চমৎকৃত করবে।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

জ্ঞাতব্য: নীতি বা আইনের মর্ম সুস্পষ্ট। আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলেছেন যে, আমার দরবারে কোন ব্যক্তির বিশেষ মর্যাদা নেই। যে ব্যক্তি বিশ্বাস ও কর্মে পুরোপুরি আনুগত্য স্বীকার করবে, সে পূর্বে যেমনই থাকুক না কেন, আমার নিকট গ্রহণযোগ্য এবং তার ‘আমল পছন্দনীয় ও প্রশংসণীয়। আর এটাও সুস্পষ্ট যে, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পর ‘পূর্ণ আনুগত্য’ মু‘হাম্মদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে মুসলমান হওয়াতেই সীমাবদ্ধ। যার অর্থ এই যে, যে মুসলমান হবে, সে-ই পরকালে নাজাতের অধিকারী হবে। এখানে পূর্ববর্তী ধারণার উত্তর হয়ে গেল। অর্থাৎ এতসব অনাচার ও গর্হিত আচরণের পরও কেউ যদি মুসলমান হয়ে যায়, তবে আমি সব মাফ করে দেব।

     জ্ঞাতব্য: যখন ছাইয়াদানা মূসা (‘আলাইহিচ্ছাল-ম)-কে তূর পর্বতে তাওরাত প্রদান করা হল, তখন তিনি ফিরে এসে তা বানি-ইসরাঈলকে দেখাতে ও শুনাতে আরম্ভ করলেন। এতে হুকুম গুলো কিছুটা কঠোর ছিল- কিন্তু তাদের অবস্হানুযায়ীই ছিল। এ সম্পর্কে প্রথম তারা একথাই বলেছিল যে, যখন স্বয়ং আল্লাহ্‌ তা‘আলা বলে দেবেন যে, ‘এটা আমার কিতাব’ তখনই আমরা মেনে নেব। (যে বর্ণনা উপরে চলে গেছে) মোট কথা, যে সত্তর জন লোক মুসা (‘আলাইহিচ্ছাল-ম)-এর সাথে গিয়েছিল, তারাও ফিরে এসে সাক্ষী দিল। কিন্তু তাদের সাক্ষ্যের সাথে এ কথাটিও নিজেদের পক্ষ হতে সংযুক্ত করে দিল যে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা সর্বশেষ একথাও বলে দিয়েছেন, ‘তোমরা যতটুকু পার ‘আমল কর, আর যা না পার, তা আমি ক্ষমা করে দিব’৷

     তখন তা কতটা তাদের স্বভাবগত দুরন্তপনা ও হঠকারিতা, হুকুম গুলোর কিছুটা কঠোরতা এবং কতকটা এ সংযোগের ফলে তাদের এক সূবর্ণ সুযোগ হয়ে গেল। তারা পরিস্কারভাবে বলে দিল, আমাদের দ্বারা এ গ্রন্থের উপর ‘আমল করা সম্ভব হবেনা৷ ফলে আল্লাহ্‌ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে হুকুম করলেন, ‘তূর পর্বতের একটি অংশ তুলে নিয়ে তাদের মাথার উপর ঝুলিয়ে দাও এবং বল, হয় কিতাব মেনে নাও, নইলে এক্ষুণি মাথার উপর পড়ল। অবশেষে নিরুপায় হয়ে মেনে নিতে হল।

     জ্ঞাতব্য: আল্লাহ্‌র সাধারণ রহমত পৃথিবীতে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, মুমিন-কাফের নির্বিশেষে সবার জন্যই ব্যাপক। তারই প্রভাব হল পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শারীরিক সুস্হতা। তবে বিশেষ রহমতের বিকাশ ঘটবে আখেরাতে, যার ফলে মুক্তি ও আল্লাহ্‌র নৈকট্যলাভ সম্ভব হবে।

     বাহ্যিক দৃষ্টিতে আয়াতের ৬৪ শেষাংশের লক্ষ্য হল সে সমস্ত ইহুদী, যারা মহা-নবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সময়ে উপস্হিত ছিল। হুযুরে আকরাম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর ঈমান না আনাও যেহেতু উল্লেখিত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গেরই অন্তর্ভূক্ত, সেহেতু তাদেরকে পূর্বোক্ত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীদের আওতাভূক্ত করে উদাহরণ স্বরূপ বলা হয়েছে যে, এতদসঙ্গেও আমি দুনিয়াতে তোমাদের উপর তেমন কোন আযাব অবতীর্ণ করিনি, যেমনটি পুর্বকালে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারীদের উপর অবতীর্ণ হয়ে থাকত। এটা একান্তই আল্লাহ্‌র রহমত।

     আর ‘হাদীসের বর্ণনার ভিত্তিতে আযাব অবতীর্ণ না হওয়াটা যেহেতু মহা-নবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এরই বরকত, কাজেই কোন তাফসীরকার মহা-নবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আবির্ভাবকেই আল্লাহ্‌র রহমত ও করুণা বলে বিশ্লেষণ করেছেন। এ বিষয়টির সমর্থনকল্পে বিগত বেঈমানের একটি ঘটনা পরবর্তী আয়াতে বিবৃত হয়েছে।

     ৬৫ আয়াতে বর্ণিত এ ঘটনাটিও হযরত দাঊদ (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-এর আমলেই সংঘটিত হয়। বানী-ইসরাঈলের জন্য শনিবার ছিল পবিত্র এবং সাপ্তাহিক উপাসনার জন্য নির্ধারীত দিন। এ দিন মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রোপকুলের অধিবাসী ছিল বলে মৎস্য শিকার ছিল তাদের প্রিয় কাজ। ফলে নিষেধাজ্ঞা আমান্য করেই তারা মৎস্য শিকার করে। এতে আল্লাহ্‌ তা‘আলার পক্ষ থেকে ‘মসখ’ তথা বিকৃতি বা রূপান্তরের শাস্তি নেমে আসে। তিনদিন পর এদের সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

এ ঘটনার দর্শক ও শ্রোতা দুই শ্রেনীতে বিভক্ত। অবাধ্য শ্রেণী ও অনুগত শ্রেনী৷ অবাধ্যদের জন্যে এ ঘটনাটি ছিল অবাধ্যতা থেকে তাওবাহ করার উপকরণ৷ এ কারণে একে نكال ‘শিক্ষাপ্রদ দৃষ্টান্ত’ বলা হয়েছে৷ অপরদিকে অনুগতদের জন্য এটা ছিল আনুগত্যে অটল থাকার কারণ। এ জন্য একে موعظة  ‘উপদেশপ্রদ’ ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

     আকূতি রূপান্তরের ঘটনাঃ তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে, ইহুদীরা প্রথম কলা-কৌশলের অন্তরালে এবং পরে সাধারণ পদ্ধতিতে ব্যাপকভাবে মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল ছিল সৎ ও বিজ্ঞ লোকদের। তারা এ অপকর্মে বাধা দিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ বিরত হলনা। অবশেষে তারা এদের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে পৃথক হয়ে গেলেন। এমনকি বাসস্হানও দু’ভাগে ভাগ করে নিলেন। একভাগে অবাধ্যরা বসবাস করত আর অপর ভাগে সৎ ও বিজ্ঞ জনেরা বাস করতেন। একদিন তারা অবাধ্যদের বস্তিতে অস্বাভাবীক নীরবতা লক্ষ্য করলেন। অতঃপর সেখানে পোঁছে দেখলেন যে, সবাই বিকৃত হয়ে বানরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

হযরত ক্বতাদাহ্ (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেন, তাদের যুবকরা বানরে এবং বৃদ্ধরা শূকরে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। রূপান্তরিত বানররা নিজ আত্বীয় স্বজনকে চিনত এবং তাদের কাছে এসে অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করত।

     রূপান্তরিত সম্প্রদায়ের বিলুপ্তি: সহীহ্ মুসলিমে ‘আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মাস‘ঊদ (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) কতৃক বর্ণিত আছে যে, কয়েকজন সাহাবী একবার রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ হুযুর! আমাদের যুগের বানর ও শূকরগুলো কি সেই রূপান্তরিত ইহুদী সম্প্রদায়? তিনি বললেন, আল্লাহ্‌ তা‘আলা যখন কোন সম্প্রদায়ের উপর আকৃতি রূপান্তরের আযাব নাযিল করেন, তখন তারা ধরাপৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, বানর ও শূকর পৃথিবীতে পূর্বেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। এদের সাথে রূপান্তরিত বানর ও শূকরদের কোন সম্পর্ক নেই।

     জ্ঞাতব্য: ঘটনার বিবরণ এই যে, বানী-ইসরাঈলদের মধ্যে একটি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। মিশকাতের টীকা গ্রন্থ মিরক্বাতের বর্ণনা অনুযায়ী এর কারণ ছিল বিবাহজনিত। জনৈক ব্যক্তি নিহত ব্যক্তির কন্যার পানিগ্রহণ করার প্রস্তাব করে প্রত্যাখাত হয় এবং এই পানিপ্রার্থী কন্যার পিতাকে হত্যা করে গা ঢাকা দেয়। ফলে হত্যাকারী কে? তা জানা কঠিন হয়ে দাঁডায়৷

     মা‘আলী (র‘হমাতুল্ল-হি ‘আলাইহ) কালবী (র‘হমাতুল্ল-হি ‘আলাইহ)-এর বর্ণনার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তখন পর্যন্তও তাউরাতে হত্যা সম্পর্কে কোন আইন বিদ্যমান ছিলনা। এতে বোঝা যায় ঘটনাটি তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বেকার।

قَالُواْ ٱدۡعُ لَنَا رَبَّكَ يُبَيِّن لَّنَا مَا هِيَ إِنَّ ٱلۡبَقَرَ تَشَٰبَهَ عَلَيۡنَا وَإِنَّآ إِن شَآءَ ٱللَّهُ لَمُهۡتَدُونَ ٧٠

৭০.তারা বলল, আপনি প্রভুর কাছে প্রার্থনা করুন-তিনি বলে দিন যে, সেটা কিরূপ? কেননা, গরু আমাদের কাছে সাদৃশ্যশীল মনে হয়। ইনশাআল্লাহ্‌ এবার আমরা অবশ্যই পথপ্রাপ্ত হব। মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) বললেন, তিনি বলেন যে, এ গাভী ভূকর্ষণ ও জল সেচনের শ্রমে অভ্যস্ত নয়-হবে নিষ্কলঙ্ক, নিখুঁত।

قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٞ لَّا ذَلُولٞ تُثِيرُ ٱلۡأَرۡضَ وَلَا تَسۡقِي ٱلۡحَرۡثَ مُسَلَّمَةٞ لَّا شِيَةَ فِيهَاۚ قَالُواْ ٱلۡـَٰٔنَ جِئۡتَ بِٱلۡحَقِّۚ فَذَبَحُوهَا وَمَا كَادُواْ يَفۡعَلُونَ ٧١

৭১.তারা বলল, এবার সঠিক তথ্য এনেছ। অতঃপর তারা সেটা জবাই করল, অথচ জবাই করবে বলে মনে হচ্ছিল না।

وَإِذۡ قَتَلۡتُمۡ نَفۡسٗا فَٱدَّٰرَٰٔتُمۡ فِيهَاۖ وَٱللَّهُ مُخۡرِجٞ مَّا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٧٢

৭২.যখন তোমরা একজনকে হত্যা করে পরে সে সম্পর্কে একে অপরকে অভিযুক্ত করেছিলে। যা তোমরা গোপন করছিলে, তা প্রকাশ করে দেয়া ছিল আল্লাহ্‌র অভিপ্রায়।

فَقُلۡنَا ٱضۡرِبُوهُ بِبَعۡضِهَاۚ كَذَٰلِكَ يُحۡيِ ٱللَّهُ ٱلۡمَوۡتَىٰ وَيُرِيكُمۡ ءَايَٰتِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ٧٣

৭৩.অতঃপর আমি বললামঃ গরুর একটি খন্ড দ্বারা মৃতকে আঘাত কর। এভাবে আল্লাহ্‌ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শণ সমূহ প্রদর্শন করেন-যাতে তোমরা চিন্তা কর।

ثُمَّ قَسَتۡ قُلُوبُكُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَٱلۡحِجَارَةِ أَوۡ أَشَدُّ قَسۡوَةٗۚ وَإِنَّ مِنَ ٱلۡحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنۡهُ ٱلۡأَنۡهَٰرُۚ وَإِنَّ مِنۡهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخۡرُجُ مِنۡهُ ٱلۡمَآءُۚ وَإِنَّ مِنۡهَا لَمَا يَهۡبِطُ مِنۡ خَشۡيَةِ ٱللَّهِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٧٤

৭৪.অতঃপর এ ঘটনার পরে তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। তা পাথরের মত অথবা তদপেক্ষাও কঠিন। পাথরের মধ্যে এমন ও আছে; যা থেকে ঝরণা প্রবাহিত হয়, এমনও আছে, যা বিদীর্ণ হয়, অতঃপর তা থেকে পানি নির্গত হয় এবং এমনও আছে, যা আল্লাহ্‌র ভয়ে খসেপড়তে থাকে! আল্লাহ্‌ তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।

۞أَفَتَطۡمَعُونَ أَن يُؤۡمِنُواْ لَكُمۡ وَقَدۡ كَانَ فَرِيقٞ مِّنۡهُمۡ يَسۡمَعُونَ كَلَٰمَ ٱللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُۥ مِنۢ بَعۡدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٧٥

৭৫.হে মুসলমানগণ, তোমরা কি আশা কর যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের মধ্যে একদল ছিল, যারা আল্লাহ্‌র বাণী শ্রবণ করত; অতঃপর বুঝে-শুনে তা পরিবর্তন করে দিত এবং তারা তা অবগত ছিল।

وَإِذَا لَقُواْ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قَالُوٓاْ ءَامَنَّا وَإِذَا خَلَا بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ قَالُوٓاْ أَتُحَدِّثُونَهُم بِمَا فَتَحَ ٱللَّهُ عَلَيۡكُمۡ لِيُحَآجُّوكُم بِهِۦ عِندَ رَبِّكُمۡۚ أَفَلَا تَعۡقِلُونَ ٧٦

৭৬.যখন তারা মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে: আমরা মুসলমান হয়েছি। আর যখন পরস্পরের সাথে নিভৃতে অবস্থান করে, তখন বলে, পালনকর্তা তোমাদের জন্যে যা প্রকাশ করেছেন, তা কি তাদের কাছে বলে দিচ্ছ? তাহলে যে তারা এ নিয়ে পালকর্তার সামনে তোমাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে। তোমরা কি তা উপলব্ধি কর না?

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

‘হাদীসে বর্ণীত আছে, বনী-ইসরাঈল কোন বাদানুবাদে প্রবৃত্ত না হলে এতসব শর্তও আরোপিত হত না, বরং যে কোন গরু জবাই করলেই তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারত। বস্তুতঃ মৃতদেহে গরুর গোশতের টুকরো স্পর্শ করাতেই সে জীবিত হয়ে যায় এবং হত্যাকারীর নাম বলে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু বরণ করে।

     এক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির বর্ণনাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়েছে। কারণ, মুসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) ও‘হীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন যে, নিহত ব্যক্তি সত্য বলবে। নতুবা শরী‘আতসম্মত সাক্ষী ছাড়া নিহত ব্যক্তির জবানবন্দীই হত্যা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হতে পারে না।

৭৪ আয়াতে পাথরের তিনটি ক্রিয়া বর্ণীত হয়েছে:

     (১) পাথর থেকে বেশী পানি প্রসরণ,

     (২) কম পানির নিঃসরণ। এ দুটি প্রভাব সবারই জানা।

     (৩) আল্লাহ্‌র ভয়ে নিচে গড়িয়ে পড়া। এ তৃতীয় ক্রিয়াটি কারও কারও অজানা থাকতে পারে। কারণ, পাথরের কোনরূপ জ্ঞান ও অনুভূতি নেই। কিন্তু জানা উচিত যে, ভয় করার জন্যে জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। জন্তু-জানোয়ারের জ্ঞান নেই, কিন্তু আমরা তাদের মধ্যে ভয়-ভীতি প্রত্যক্ষ করি। তবে চেতনার প্রয়োজন অবশ্য আছে। জড় পদার্থর মধ্যে এতটুক চেতনাও নেই বলে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। কারণ, চেতনা প্রাণের উপর নির্ভরশীল। খুব সম্ভব জড় পদার্থের মধ্যে এমন সূক্ষ্ণ প্রাণ আছে যা আমরা অনুভব করতে পারি না। উদাহরণতঃ বহু পণ্ডিত মস্তিস্কের চেতনাশক্তি অনুভব করতে পারেন না। তারা একমাত্র যুক্তির ভিত্তিতেই এর প্রবক্তা। সুতরাং ধারণাপ্রসুত প্রমাণাদির চাইতে কুরআনী আয়াতের যৌক্তিকতা কোন অংশেই কম নয়।

     এছাড়া আমরা এরূপ দাবীও করি না যে, পাথর সব সময় ভয়ের দরুনই নীচে গড়িয়ে পড়ে। কারণ আল্লাহ্‌ তা‘আলা ‘কতক পাথর’ বলেছেন। সুতরাং নীচে গড়িয়ে পড়ার অন্য আরও বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তন্মধ্যে একটি হল আল্লাহ্‌র ভয়।

     এখানে তিন রকমের পাথরের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ও সাবলীল ভঙ্গিতে এদের শ্রেণীবিন্যাস ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা হয়েছে। কতক পাথরের প্রভাবান্বিত হওয়ার ক্ষমতা এত প্রবল যে, তা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত প্রবাহিত হয়ে যায় এবং তদ্বারা সৃষ্ট জীবের উপকার সাধিত হয়। কিন্তু ইহুদীদের অন্তর এমন নয় যে, সৃষ্ট জীবের দুঃখ-দুর্দশায় অশ্রুসজল হবে। কতক পাথরের মধ্যে প্রভাবান্বিত হওয়ার ক্ষমতা কম। ফলে সেগুলোর দ্বারা উপকারও কম হয়। এ ধরনের পাথর প্রথম ধরনের পাথরের তুলনায় কম নরম হয়। কিন্তু ইহুদীদের অন্তর এ দ্বিতীয় ধরনের পাথর অপেক্ষাও বেশী শক্ত।

     কতক পাথরের মধ্যে উপরোক্তরূপ প্রভাব না থাকলেও এতটুকু প্রভাব অবশ্যই আছে যে, আল্লাহ্‌র ভয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে। এ পাথর উপরোক্ত দুই প্রকার পাথরের তুলনায় অধিক দূর্বল। কিন্তু ইহুদীদের অন্তর এ দুর্বলতম প্রভাব থেকেও মুক্ত।

     জ্ঞাতব্য: উদ্দেশ্য এই যে, যারা এমন ধুষ্টতাপূর্ণ ও স্বার্থান্বেষী, তারা অন্যের সদুপদেশে কখনও মন্দ কাজ থেকে বিরত হবে না।

     এখানে ‘আল্লাহ্‌র বাণী’ অর্থাৎ তাওরাত। ‘শ্রবণ করা’ অর্থাৎ নবীদের মাধ্যমে শ্রবণ করা। ‘পরিবর্তন করা’ অর্থাৎ, কোন কোন বাক্য অথবা ব্যাখ্যা অথবা উভয়টিকে বিকৃত করে ফেলা।

     অথবা ‘আল্লাহ্‌র বাণী’ অর্থাৎ, ঐ বাণী, যা মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর সত্যায়নের উদ্দেশে তাঁর সাথে গমনকারী সত্তুর জন ইহুদী তুর পর্বতে শুনেছিল। ‘শ্রবণ’ অর্থাৎ মাধ্যমবিহীনভাবে সরাসরি শ্রবণ। ‘পরিবর্তন’ অর্থাৎ স্বগোত্রের কাছে প্রসঙ্গক্রমে এরূপ বর্ণনা করা যে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা উপসংহারে বলে দিয়েছে: তোমরা যেসব নির্দেশ পালন করতে না পার, তা মাফ। হযরত মু‘হাম্মদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহ ওয়াসাল্লাম)-এর আমলে যেসব ইহুদী ছিল, তাদের দ্বারা উল্লেখিত কোন কূকর্ম সংঘটিত হয়নি সত্য, কিন্তু পূর্ববর্তীদের এসব দুস্কর্মকে তারা অপছন্দ ও ঘৃণা করত না। এ কারণে তারাও কার্যতঃ পূর্ববর্তীদেরই মত।

أَوَ لَا يَعۡلَمُونَ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا يُسِرُّونَ وَمَا يُعۡلِنُونَ ٧٧

৭৭.তারা কি এতটুকুও জানে না যে, আল্লাহ্‌ সেসব বিষয়ও পরিজ্ঞাত যা তারা গোপন করে এবং যা প্রকাশ করে?

وَمِنۡهُمۡ أُمِّيُّونَ لَا يَعۡلَمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ إِلَّآ أَمَانِيَّ وَإِنۡ هُمۡ إِلَّا يَظُنُّونَ ٧٨

৭৮.তোমাদের কিছু লোক নিরক্ষর। তারা মিথ্যা আকাঙ্খা ছাড়া আল্লাহ্‌র গ্রন্থের কিছুই জানে না। তাদের কাছে কল্পনা ছাড়া কিছুই নেই।

فَوَيۡلٞ لِّلَّذِينَ يَكۡتُبُونَ ٱلۡكِتَٰبَ بِأَيۡدِيهِمۡ ثُمَّ يَقُولُونَ هَٰذَا مِنۡ عِندِ ٱللَّهِ لِيَشۡتَرُواْ بِهِۦ ثَمَنٗا قَلِيلٗاۖ فَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا كَتَبَتۡ أَيۡدِيهِمۡ وَوَيۡلٞ لَّهُم مِّمَّا يَكۡسِبُونَ ٧٩

৭৯.অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।

وَقَالُواْ لَن تَمَسَّنَا ٱلنَّارُ إِلَّآ أَيَّامٗا مَّعۡدُودَةٗۚ قُلۡ أَتَّخَذۡتُمۡ عِندَ ٱللَّهِ عَهۡدٗا فَلَن يُخۡلِفَ ٱللَّهُ عَهۡدَهُۥٓۖ أَمۡ تَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٨٠

৮০.তারা বলে: আগুন আমাদিগকে কখনও স্পর্শ করবে না; কিন্তু গণাগনতি কয়েকদিন। বলে দিনঃ তোমরা কি আল্লাহ্‌র কাছ থেকে কোন অঙ্গীকার পেয়েছ যে, আল্লাহ্‌ কখনও তার খেলাফ করবেন না-না তোমরা যা জান না, তা আল্লাহ্‌র সাথে জুড়ে দিচ্ছ।

بَلَىٰۚ مَن كَسَبَ سَيِّئَةٗ وَأَحَٰطَتۡ بِهِۦ خَطِيٓ‍َٔتُهُۥ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨١

৮১.হাঁ, যে ব্যক্তি পাপ অর্জন করেছে এবং সে পাপ তাকে পরিবেষ্টিত করে নিয়েছে, তারাই দোযখের অধিবাসী। তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে।

وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أُوْلَٰٓئِكَ أَصۡحَٰبُ ٱلۡجَنَّةِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ ٨٢

৮২.পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তারাই জান্নাতের অধিবাসী। তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে।

وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَ بَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ لَا تَعۡبُدُونَ إِلَّا ٱللَّهَ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَانٗا وَذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَقُولُواْ لِلنَّاسِ حُسۡنٗا وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ ثُمَّ تَوَلَّيۡتُمۡ إِلَّا قَلِيلٗا مِّنكُمۡ وَأَنتُم مُّعۡرِضُونَ ٨٣

৮৩.যখন আমি বনী-ইসরাঈলের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা আল্লাহ্‌ ছাড়া কারও উপাসনা করবে না, পিতা-মাতা, আত্নীয়-স্বজন, এতীম ও দীন-দরিদ্রদের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, মানুষকে সৎ কথাবার্তা বলবে, নামায প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত দেবে, তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে, তোমরাই অগ্রাহ্যকারী।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

জনগণের সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রেখে ভুল বিষয় পরিবেশন করলে তারা কিছু নগদ অর্থ-কড়িও পেয়ে যেত এবং মান-সম্মানও বজায় থাকত। এ কারণে তারা তাউরাতে শাব্দিক ও মর্মগত উভয় প্রকার পরিবর্তন করারই চেষ্টা করত। উল্লেখিত আয়াতে এ বিষয়ের উপরই কঠোর হুসিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে।

     জ্ঞাতব্য: তাফসীরবিদগণ ইহুদীদের এ বক্তব্যের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তন্মধ্যে একটি হল এই যে, ঈমানদার ব্যক্তি গোনাহগার হলে গোনাহ্‌র পরিমাণে দোযখ ভোগ করবে। কিন্তু ঈমানের ফলস্বরূপ চিরকাল দোযখে থাকবে না। কিছুকাল পরই তা থেকে মুক্তি পাবে।

     অতএব, ইহুদীদের দাবীর সারমর্ম এই যে, তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর প্রচারিত ধর্ম রহিত হয়নি। কাজেই তারা ঈমানদারঃ ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) ও হুযূরে আকরাম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নবুওয়াত অস্বীকার করার পরও তারা কাফের নয়। সুতরাং যদি কোন পাপের কারণে তারা দোযখে চলেও যায়, কিন্তু কিছু দিন পরই মুক্তি পাবে। বলাবাহুল্য, এ দাবীটি একটি অসত্যের উপর অসত্যের ভিত্তি বৈ নয়। কেননা, মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম চিরকালের জন্য- এরূপ দাবীই অসত্য। অতএব, ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) ও হুযূর আকরাম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নবুওয়াত অস্বীকার করার কারণে ইহুদীরা কাফের। কাফেরও কিছুদিন পর দোযখ থেকে মুক্তি পাবে, এমন কথা কোন আসমানী গ্রন্থে নেই- যা আলোচ্য আয়াতে অঙ্গীকার শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। সুতরাং প্রমাণিত হল যে, ইহুদীদের দাবীটি যুক্তিহীন, বরং যুক্তিবিরুদ্ধ।

     গুনাহ্‌র দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়া শুধু কাফেরদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়ে থাকে। কারণ, কুফরের কারণে কোন সৎকর্মই গ্রহণযোগ্য থাকে না। কুফরের পূর্ব কিছু সৎকর্ম করে থাকলেও তা নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণেই কাফেরদের মধ্যে আপাদমস্তক গোনাহ ছাড়া আর কিছুই কল্পনা করা যায় না। ঈমানদারদের অবস্থা কিন্তু তা নয়। প্রথমত: তাদের ঈমানই একটি বিরাট সৎকর্ম। দ্বিতীয়ত: অন্যান্য নেক ‘‘আমল তাদের ‘‘আমলনামায় লেখা হয়। সে জন্য ঈমানদার সৎকর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না। সুতরাং উল্লেখিত বেষ্টনী তাদের বেলায় অবান্তর।

     জ্ঞাতব্য: ‘অল্প কয়েকজন’ অর্থাৎ, তারাই যারা তাউরাতের পুরোপুরি অনুসরণ করত, তাওরাত রহিত হওয়ার পূর্বে তারা মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) প্রবর্তিত শরী‘আতের অনুসারী ছিল এবং তাওরাত রহিত হওয়ার পর ইসলামী শরী‘আতের অনুসারী হয়ে যায়। আয়াত দৃষ্টে বোঝা যায় যে, একত্ববাদে ঈমান এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন এতীম বালক-বালিকা ও দীন-দরিদ্রদের সেবাযত্ন করা, মানুষের সাথে নম্রভাবে কথাবার্তা বলা, নামায পড়া এবং যাকাত দেয়া ইসলামী শরী‘আতসহ পূর্ববর্তী শরী‘আতসমূহেও ছিল।

     শিক্ষা ও প্রচার ক্ষেত্রে কাফেরের সাথেও অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করা বৈধ নয়:

وَقُوْلوْالِلنَّاسِ حُسنًا  আয়াতে এমন কথাকে বুঝানো হয়েছে, যা সৌন্দর্যমণ্ডিত। এর অর্থ এই যে, যখন মানুষের সাথে কথা বলবে, নম্রভাবে হাসিমুখে ও খোলা মনে বলবে- যার সাথে কথা বলবে, সে সৎ হউক বা অসৎ, সুন্নী হউক বা বিদ‘আতী। তবে ধর্মের ব্যাপারে শৈথিল্য অথবা কারও মনোরঞ্জনের জন্য সত্য গোপন করবে না। কারণ, আল্লাহ্‌ তা‘আলা যখন মুসা ও হারুন (‘আলাইহিমাচ্ছালাম)-কে নবুওয়াত দান করে ফির‘আউনের প্রতি পাঠিয়েছিলেন, তখন এ নির্দেশ দিয়েছিলেন فَقُوْلَا لَهُ قَوْلاً لَّيِّناً অর্থাৎ, তোমরা উভয়েই ফির‘আউনকে নরম কথা বলবে। আজ যারা অন্যের সাথে কথা বলে, তারা মুসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর চাইতে উত্তম নয় এবং যার সাথে কথা বলে, সেও ফির‘আউন অপেক্ষা বেশী মন্দ ও পাপিষ্ঠ নয়।

وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ لَا تَسۡفِكُونَ دِمَآءَكُمۡ وَلَا تُخۡرِجُونَ أَنفُسَكُم مِّن دِيَٰرِكُمۡ ثُمَّ أَقۡرَرۡتُمۡ وَأَنتُمۡ تَشۡهَدُونَ ٨٤

৮৪.যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম যে, তোমরা পরস্পর খুনাখুনি করবে না এবং নিজেদেরকে দেশ থেকে বহিস্কার করবে না, তখন তোমরা তা স্বীকার করেছিলে এবং তোমরা তার সাক্ষ্য দিচ্ছিলে।

ثُمَّ أَنتُمۡ هَٰٓؤُلَآءِ تَقۡتُلُونَ أَنفُسَكُمۡ وَتُخۡرِجُونَ فَرِيقٗا مِّنكُم مِّن دِيَٰرِهِمۡ تَظَٰهَرُونَ عَلَيۡهِم بِٱلۡإِثۡمِ وَٱلۡعُدۡوَٰنِ وَإِن يَأۡتُوكُمۡ أُسَٰرَىٰ تُفَٰدُوهُمۡ وَهُوَ مُحَرَّمٌ عَلَيۡكُمۡ إِخۡرَاجُهُمۡۚ أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٨٥

৮৫.অতঃপর তোমরাই পরস্পর খুনাখুনি করছ এবং তোমাদেরই একদলকে তাদের দেশ থেকে বহিস্কার করছ। তাদের বিরুদ্ধে পাপ ও অন্যায়ের মাধ্যমে আক্রমণ করছ। আর যদি তারাই কারও বন্দী হয়ে তোমাদের কাছে আসে, তবে বিনিময় নিয়ে তাদের মুক্ত করছ। অথচ তাদের বহিস্কার করাও তোমাদের জন্য অবৈধ। তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দূগর্তি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ্‌ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।

أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ ٱشۡتَرَوُاْ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا بِٱلۡأٓخِرَةِۖ فَلَا يُخَفَّفُ عَنۡهُمُ ٱلۡعَذَابُ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ٨٦

৮৬.এরাই পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবন ক্রয় করেছে। অতএব এদের শাস্তি লঘু হবে না এবং এরা সাহায্যও পাবে না।

وَلَقَدۡ ءَاتَيۡنَا مُوسَى ٱلۡكِتَٰبَ وَقَفَّيۡنَا مِنۢ بَعۡدِهِۦ بِٱلرُّسُلِۖ وَءَاتَيۡنَا عِيسَى ٱبۡنَ مَرۡيَمَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَأَيَّدۡنَٰهُ بِرُوحِ ٱلۡقُدُسِۗ أَفَكُلَّمَا جَآءَكُمۡ رَسُولُۢ بِمَا لَا تَهۡوَىٰٓ أَنفُسُكُمُ ٱسۡتَكۡبَرۡتُمۡ فَفَرِيقٗا كَذَّبۡتُمۡ وَفَرِيقٗا تَقۡتُلُونَ ٨٧

৮৭.অবশ্যই আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছি। এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রসূল পাঠিয়েছি। আমি মরিয়ম তনয় ঈসাকে সুস্পষ্ট মোজেযা দান করেছি এবং পবিত্র রূহের মাধ্যমে তাকে শক্তিদান করেছি। অতঃপর যখনই কোন রসূল এমন নির্দেশ নিয়ে তোমাদের কাছে এসেছে, যা তোমাদের মনে ভাল লাগেনি, তখনই তোমরা অহংকার করেছ। শেষ পর্যন্ত তোমরা একদলকে মিথ্যাবাদী বলেছ এবং একদলকে হত্যা করেছ।

وَقَالُواْ قُلُوبُنَا غُلۡفُۢۚ بَل لَّعَنَهُمُ ٱللَّهُ بِكُفۡرِهِمۡ فَقَلِيلٗا مَّا يُؤۡمِنُونَ ٨٨

৮৮.তারা বলে, আমাদের হৃদয় অর্ধাবৃত। এবং তাদের কুফরের কারণে আল্লাহ্‌ অভিসম্পাত করেছেন। ফলে তারা অল্পই ঈমান আনে।

আনুষাঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

জ্ঞাতব্য: কোন কোন সময় কারও বক্তব্যের ভেতরই কোন কিছুর অঙ্গীকারও বোঝা যায় যদিও তা সুস্পষ্ট নয়। আলোচ্য আয়াতে ثُمَّ أَقۡرَرۡتُمۡ  অনিশ্চয়তা অপনোদন করে বলা হয়েছে যে, তাদের অঙ্গীকার সাক্ষ্যদানের মতই সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ছিল।

দেশত্যাগ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞার অর্থ এই যে, কাউকে এমন উৎপীড়ন করবে না, যাতে সে দেশত্যাগে বাধ্য হয়।

     বনী-ইসারাঈলকে তিনটি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। প্রথমত: খুনাখুনী না করা, দ্বিতীয়ত: বহিষ্কার অর্থাৎ, দেশ ত্যাগে বাধ্য না করা এবং তৃতীয়ত: স্বগোত্রের কেউ কারও হাতে বন্দী হলে অর্থের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করা।  কিন্তু তারা প্রথমোক্ত দু’টি নির্দেশ অমান্য করে তৃতীয় নির্দেশ পালনে বিশেষ তৎপর ছিল। ঘটনার বিবরণ এরূপঃ মদীনাবাসীদের মধ্যে ‘আওস’ ও ‘খাযরাজ’ নামে দু’টি গোত্রের মধ্যে শত্রুতা লেগেই থাকত। মাঝে মাঝে যুদ্ধও বাধত। মদীনার আশে-পাশে ইহুদীদের দু’টি গোত্র ‘বনী-কোরায়যা’ ও ‘বনী-নুযায়ের’ বসবাস করত। আওস গোত্র ছিল বনী-কোরায়যার মিত্র এবং খাযরাজ ছিল বনী-নুযায়েরের মিত্র। আওস ও খাযরাজের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হলে মিত্রতার ভিত্তিতে বনী-কোরায়যা আওসের সাহায্য করত এবং নুযায়ের খাযরাজের পক্ষ অবলম্বন করত। যুদ্ধে আওস ও খাযরাজের যেমন লোকক্ষয় ও ঘর-বাড়ী বিধ্বস্ত হত, তাদের মিত্র বনী-নুযায়েরেরও তেমনি হত। বনী-কোরায়যাকে হত্যা ও বহিষ্কারের ব্যাপারে শত্রুপক্ষের মিত্র-নুযায়েরেরও হাত থাকত। তেমনি নুযায়েরের হত্যা, বাস্তভিটা থেকে উৎখাত করার কাজে শত্রুপক্ষের মিত্র বনী কুরায়যারও হাত থাকত। তবে তাদের একটি আচরণ ছিল অদ্ভুত। ইহুদীদের দুই দলের কেউ আওস অথবা খাজরাজের হাতে বন্দী হয়ে গেলে প্রতিপক্ষীয় দলের ইহুদী স্বীয় মিত্রদের অর্থে বন্দীকে মুক্ত করে দিত। কেউ এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতঃ বন্দীকে মুক্ত করা আমাদের উপর ওয়াজিব। পক্ষান্তরে যুদ্ধে সাহায্য করার ব্যাপারে কেউ আপত্তি করলে তারা বলতঃ কি করব, মিত্রদের সাহায্যে এগিয়ে না আসা লজ্জার ব্যাপার। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্‌ তাদের এ আচরণেরই নিন্দা করেছেন এবং তাদের এ অপকৌশলের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন।

         إِثۡمْ ও عُدۡوَٰنْ (গোনাহ ও অন্যায়) –আয়াতে ব্যবহৃত এ দু’টি শব্দ দ্বারা দু’রকম হক বা অধিকার নষ্ট করার প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। অর্থাৎ, আল্লাহ্‌র নির্দেশ অমান্য করে তারা একদিকে আল্লাহ্‌র হক নষ্ট করেছে এবং অপরকে কষ্ট দিয়ে বান্দার হকও নষ্ট করেছে।

     ঘটনায় বর্ণিত ইহুদীরা নবী করিম (সল্লাল্ল-হু ‘আলিইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নবুওয়াত স্বীকার না করায় নিঃসন্দেহে কাফের। কিন্তু এখানে তাদের কুফর উল্লেখ করা হয়নি; বরং কতিপয় নির্দেশ পালন না করাকে কুফর বলে অভিহিত করা হয়েছে। অথচ যতক্ষণ কেউ ‘‘হারামকে ‘‘হারাম মনে করে, ততক্ষণ কাফের হয় না। এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, শরী‘আতের পরিভাষায় কঠোর গুনাহ্‌কে শুধু কঠোরতার প্রেক্ষিতেই কুফর বলে দেয়া হয়। আমরা নিজেদের পরিভাষায়ও এর দৃষ্টান্ত অহরহ দেখতে পাই।

উদাহরণত: কাউকে কোন নিকৃষ্ট কাজ করতে দেখলে আমরা বলে দেই: তুই একেবারে চামার। অথচ সে মোটেই চামার নয়। এ ক্ষেত্রে তীব্র ঘৃণা এবং সংশ্লিষ্ট কাজটির নিকৃষ্টতা প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য। مَنْ تَرَكَ الصَّلَوٰةَ مُتَعَمِّداً فَقَدْ كَفَرَ (যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নামায/স্বলাত ছেড়ে দেয়, সে কাফের হয়ে যায়।) এবং এ জাতীয় অন্যান্য ‘হাদীসের বেলায়ও এ অর্থই বুঝতে হবে।

     আয়াতে উল্লিখিত দু’টি শাস্তির প্রথমটি হল পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা ও দুর্গতি। তা এভাবে বাস্তব রূপ লাভ করেছে যে, নবী কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ‘আমলেই মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তিভঙ্গের অপরাধে বনী-কুরায়যা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও বন্দী হয়েছে এবং বনী-নুযায়রকে চরম অপমান ও লাঞ্ছনার সাথে সিরিয়ায় নির্বাসিত করা হয়েছে।

     কুরআন-‘হাদীসের বিভিন্নস্থানে হযরত জিবরাঈল (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে ‘রুহুল কুদুস’ (পবিত্রতা) বলা হয়েছে। কুরআনের আয়াতে قُلْ نَزَّلَهٗ رُوْحُ الْقُدُسِ এবং ‘হাদীসে হযরত হাস্‌সান ইব্‌ন সাবেতের কবিতা রয়েছে-

     জিবরাঈল (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর মাধ্যমে ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে কয়েক রকম শক্তি দান করা হয়েছে। প্রথমত: জন্মগ্রহণের সময় শয়তানের স্পর্শ থেকে রক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া জিবরাঈলের দম করার ফলেই মারয়ামের উদরে হযরত ‘ঈসার গর্ভ সঞ্চারিত হয়। বহু ইহুদী ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর শত্রু  ছিল। এ কারণে দেহরক্ষী হিসেবে জিবরাঈল তাঁর সাথে থাকতেন। এমনকি, শেষ পর্যন্ত জিবরাঈলের মাধ্যমে তাঁকে আকাশে তুলে নেয়া হয়। ইহুদিরা হযরত ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-সহ অনেক নবীকে মিথ্যাবাদী বলেছে এবং হযরত যাকারিয়া ও হযরত ইয়া‘হ্‌ইয়া (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে হত্যা পর্যন্ত করেছে।

وَلَمَّا جَآءَهُمۡ كِتَٰبٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٞ لِّمَا مَعَهُمۡ وَكَانُواْ مِن قَبۡلُ يَسۡتَفۡتِحُونَ عَلَى ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَلَمَّا جَآءَهُم مَّا عَرَفُواْ كَفَرُواْ بِهِۦۚ فَلَعۡنَةُ ٱللَّهِ عَلَى ٱلۡكَٰفِرِينَ ٨٩

৮৯.যখন তাদের কাছে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে কিতাব এসে পৌঁছাল, যা সে বিষয়ের সত্যায়ন করে, যা তাদের কাছে রয়েছে এবং তারা পূর্বে করত। অবশেষে যখন তাদের কাছে পৌঁছল যাকে তারা চিনে রেখেছিল, তখন তারা তা অস্বীকার করে বসল। অতএব, অস্বীকারকারীদের উপর আল্লাহ্‌র অভিসম্পাত।

بِئۡسَمَا ٱشۡتَرَوۡاْ بِهِۦٓ أَنفُسَهُمۡ أَن يَكۡفُرُواْ بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بَغۡيًا أَن يُنَزِّلَ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۖ فَبَآءُو بِغَضَبٍ عَلَىٰ غَضَبٖۚ وَلِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٞ مُّهِينٞ ٩٠

৯০.যার বিনিময়ে তারা নিজেদের বিক্রি করেছে, তা খুবই মন্দ; যেহেতু তারা আল্লাহ্‌ যা নযিল করেছেন, তা অস্বীকার করেছে এই হঠকারিতার দরুন যে, আল্লাহ্‌ স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ নাযিল করেন। অতএব, তারা ক্রোধের উপর ক্রোধ অর্জন করেছে। আর কাফেরদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।

وَإِذَا قِيلَ لَهُمۡ ءَامِنُواْ بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ قَالُواْ نُؤۡمِنُ بِمَآ أُنزِلَ عَلَيۡنَا وَيَكۡفُرُونَ بِمَا وَرَآءَهُۥ وَهُوَ ٱلۡحَقُّ مُصَدِّقٗا لِّمَا مَعَهُمۡۗ قُلۡ فَلِمَ تَقۡتُلُونَ أَنۢبِيَآءَ ٱللَّهِ مِن قَبۡلُ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٩١

৯১.যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ্‌ যা পাঠিয়েছেন তা মেনে নাও, তখন তারা বলে, আমরা মানি যা আমাদের প্রতি অবর্তীণ হয়েছে। সেটি ছাড়া সবগুলোকে তারা অস্বীকার করে। অথচ এ গ্রন্থটি সত্য এবং সত্যায়ন করে ঐ গ্রন্থের যা তাদের কাছে রয়েছে। বলে দিন, তবে তোমরা ইতিপূর্বে নবীদের হত্যা করতে কেন যদি তোমরা বিশ্বাসী ছিলে?

۞وَلَقَدۡ جَآءَكُم مُّوسَىٰ بِٱلۡبَيِّنَٰتِ ثُمَّ ٱتَّخَذۡتُمُ ٱلۡعِجۡلَ مِنۢ بَعۡدِهِۦ وَأَنتُمۡ ظَٰلِمُونَ ٩٢

৯২.সুস্পষ্ট মু’জেযাসহ মূসা তোমাদের কাছে এসেছেন। এরপর তার অনুপস্থিতিতে তোমরা গোবৎস বানিয়েছ। বাস্তবিকই তোমরা অত্যাচারী।

وَإِذۡ أَخَذۡنَا مِيثَٰقَكُمۡ وَرَفَعۡنَا فَوۡقَكُمُ ٱلطُّورَ خُذُواْ مَآ ءَاتَيۡنَٰكُم بِقُوَّةٖ وَٱسۡمَعُواْۖ قَالُواْ سَمِعۡنَا وَعَصَيۡنَا وَأُشۡرِبُواْ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡعِجۡلَ بِكُفۡرِهِمۡۚ قُلۡ بِئۡسَمَا يَأۡمُرُكُم بِهِۦٓ إِيمَٰنُكُمۡ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ٩٣

৯৩.আর যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলাম এবং তুর পর্বতকে তোমাদের উপর তুলে ধরলাম যে, শক্ত করে ধর, আমি যা তোমাদের দিয়েছি আর শোন। তারা বলল, আমরা শুনেছি আর অমান্য করেছি। কুফরের কারণে তাদের অন্তরে গোবৎসপ্রীতি পান করানো হয়েছিল। বলে দিন, তোমরা বিশ্বাসী হলে, তোমাদের সে বিশ্বাস মন্দ বিষয়াদি শিক্ষা দেয়।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

     জ্ঞাতব্য: কুরআনকে তাউরাতের ‘মুসাদ্দিক’ (সত্যায়নকারী) বলা হয়েছে। এর কারণ এই যে, তাউরাতে মু‘হাম্মদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আবির্ভাব ও কুরআন অবতরণের যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, কুরআনের মাধ্যমেও সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং যারা তাওরাতকে স্বীকার করে, তারা কিছুতেই কুরআন ও মু‘হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে অস্বীকার করতে পারে না। তা করতে গেলে প্রকারান্তরে তাওরাতকেই অস্বীকার করা হয়।

     একটি প্রশ্ন ও তার উত্তরঃ এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে যে, তারা যখন সত্যকে সত্য বলেই জানত, তখন তাদেরকে ঈমানদার বলাই উচিত, কাফের বলা হল কেন?

     এর উত্তর এই যে, শুধু জানাকেই ঈমান বলা যায় না। শয়তানের সত্যজ্ঞান সবার চাইতে বেশী । তাই বলে সে ঈমানদার হয়ে যাবে কি? জানাসত্ত্বে অস্বীকার করার কারণে কুফরের তীব্রতাই বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তী আয়াতে তাদের শত্রুতাকে কুফরের কারণ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

     এখানে এক ক্রোধ কুফরের কারণে এবং অপর ক্রোধ হিংসার কারণে। এ জন্যেই ক্রোধের উপর ক্রোধ বলা হয়েছে।শাস্তির সাথে অপমানজনক শব্দ যোগ করে বলা হয়েছে যে, এ শাস্তি কাফেরদের জন্যেই নির্দিষ্ট। কেননা, পাপী ঈমানদারকে যে শাস্তি দেয়া হবে, তা হবে, তাকে পাপমুক্ত করার উদ্দেশ্যে, অপমান করার উদ্দেশ্যে নয়। পরবর্তী আয়াতে তাদের যে উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে তা থেকে কুফর প্রমাণিত হয় এবং হিংসাও বুঝা যায়।

     ‘আমরা শুধু তাওরাতের প্রতিই ঈমান আনব, অন্যান্য গ্রন্থের প্রতি ঈমান আনব না,’ ইহুদীদের এ উক্তি সুস্পষ্ট কুফর। সেই সাথে তাদের উক্তি ‘যা (তাওরাত) আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে’- এ থেকে প্রতিহিংসা বুঝা যায়। এর পরিস্কার অর্থ হচ্ছে এই যে, অন্যান্য আসমানী গ্রন্থ যেহেতু আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়নি, কাজেই আমরা সেগুলোর প্রতি ঈমান আনব না। আল্লাহ্ তা‘আলা তিন পন্থায় তাদের এ উক্তি খণ্ডন করেছেন ।

     প্রথমত: অন্যান্য গ্রন্থের সত্যতা ও বাস্তবতা যখন অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত, তখন সেগুলো অস্বীকার করার কোন কারণ থাকতে পারে না। অবশ্য দলীলের মধ্যে কোন আপত্তি থাকলে তারা তা উপস্থিত করে দুর করে নিতে পারত। অহেতুক অস্বীকারের কোন অর্থ হয় না।

     দ্বিতীয়ত: অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে একটি হচ্ছে কুরআন মাজীদ, যা তাওরাতেরও সত্যায়ন করে। সুতরাং কুরআন মাজীদকে অস্বীকার করলে তাওরাতের অস্বীকৃতিও অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

     তৃতীয়ত: সকল খোদায়ী গ্রন্থের মতেই নবীদের (নবী-রসূল) হত্যা করা কুফর। তোমাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা কয়েকজন নবীকে হত্যা করেছে। অথচ তারা বিশেষভাবে তাওরাতের শিক্ষাই প্রচার করতেন। তোমরা সেসব হত্যাকারীকেই নেতা ও পুরোহিত মনে করেছ। এভাবে কি তোমরা তাওরাতের সাথেই কুফরি করনি? সুতরাং তাওরাতের প্রতি তোমাদের ঈমান আনার দাবী অসার প্রমাণিত হয়ে যায়। মোটকথা, কোন দিক দিয়েই তোমাদের কথা ও কাজ শুদ্ধ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

পরবর্তী আয়াতে আরও কতিপয় যুক্তি দ্বারা ইহুদীদের দাবী খন্ডন করা হয়েছে।

          ঘটনাটি ঘটে তাওরাত অবতরণের পূর্বে। তখন মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর নবুওয়াতের সত্যতা প্রমাণ করার জন্যে যেসব যুক্তি প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত ছিল, আয়াতে بَيِّنَاتٍ বলে সেগুলোকে বোঝানো হয়েছে। যেমন, লাঠি, জ্যোতির্ময় হাত, সাগর দ্বি-খন্ডিত হওয়া ইত্যাদি।

     ইহুদীদের দাবীর খন্ডনে আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমরা একদিকে ঈমানের দাবী কর, অন্যদিকে প্রকাশ্যে শিরকে লিপ্ত হও। ফলে শুধু মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কেই নয়, আল্লাহ্‌কেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে চলেছ। কুরআন অবতরণের সময় হযরত মু‘হাম্মদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ‘আমলে যেসব ইহুদী ছিল, তারা গোবৎসকে উপাস্য নির্ধারণ করেনি সত্য; কিন্তু তারা নিজেদের পূর্ব-পুরুষদের সমর্থক ছিল। অতএব, তারাও মোটামোটিভাবে এ আয়াতের লক্ষ্য।

     আয়াতে বর্ণিত কারণ ও ঘটনাসমূহের সারমর্ম এই যে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার পর তারা একটি কুফরী বাক্য উচ্চারণ করে। পরে মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর শাসানোর ফলে যদিও তাওবাহ্‌ করে নেয়, কিন্তু তাওবারও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। উচ্চস্তরের তাওবার অভাবে তাদের অন্তরে কুফরের কালিমা থেকেই যায়। পরে সেটাই বেড়ে গিয়ে গোবৎস পূজার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোন কোন টীকাকারের বর্ণনা মতে গোবৎস পূজা থেকে তাওবাহ্‌ করতে গিয়ে তাদের কিছু লোককে হত্যা বরণ করতে হয় এবং কিছু লোক ক্ষমা প্রাপ্ত হয়। এদের তাওবাও সম্ভবতঃ দূর্বল ছিল। এছাড়া যারা গোবৎস পূজায় জড়িত ছিল না, তারাও অন্তরে গোবৎস পূজারীদের প্রতি প্রয়োজনীয় ঘৃণা পোষণ করতে পারেনি। ফলে তাদের অন্তরে শির্‌কের প্রভাব কিছু না কিছু অবশিষ্ট ছিল। মোটকথা, তাওবার দূর্বলতা ও শির্‌কের প্রতি প্রয়োজনীয় ঘৃণার অভাব- এতদুভয়ের প্রতিক্রিয়ায় তাদের অন্তরে ধর্মের প্রতি শৈথিল্য দানা বেঁধে উঠেছিল। এ কারণেই অঙ্গীকার নেওয়ার জন্য তুর পর্বতকে তাদের মাথার উপর ঝুলিয়ে রাখার প্রয়োজন দেখা দেয়।

قُلۡ إِن كَانَتۡ لَكُمُ ٱلدَّارُ ٱلۡأٓخِرَةُ عِندَ ٱللَّهِ خَالِصَةٗ مِّن دُونِ ٱلنَّاسِ فَتَمَنَّوُاْ ٱلۡمَوۡتَ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٩٤

৯৪.বলে দিন, যদি আখেরাতের বাসস্থান আল্লাহ্‌র কাছে একমাত্র তোমাদের জন্যই বরাদ্দ হয়ে থাকে-অন্য লোকদের বাদ দিয়ে, তবে মৃত্যু কামনা কর, যদি সত্যবাদী হয়ে থাক।

وَلَن يَتَمَنَّوۡهُ أَبَدَۢا بِمَا قَدَّمَتۡ أَيۡدِيهِمۡۚ وَٱللَّهُ عَلِيمُۢ بِٱلظَّٰلِمِينَ ٩٥

৯৫.কস্মিনকালেও তারা মৃত্যু কামনা করবে না ঐসব গোনাহর কারণে, যা তাদের হাত পাঠিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ্‌ গোনাহগারদের সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছেন।

وَلَتَجِدَنَّهُمۡ أَحۡرَصَ ٱلنَّاسِ عَلَىٰ حَيَوٰةٖ وَمِنَ ٱلَّذِينَ أَشۡرَكُواْۚ يَوَدُّ أَحَدُهُمۡ لَوۡ يُعَمَّرُ أَلۡفَ سَنَةٖ وَمَا هُوَ بِمُزَحۡزِحِهِۦ مِنَ ٱلۡعَذَابِ أَن يُعَمَّرَۗ وَٱللَّهُ بَصِيرُۢ بِمَا يَعۡمَلُونَ ٩٦

৯৬.আপনি তাদেরকে জীবনের প্রতি সবার চাইতে, এমনকি মুশরিকদের চাইতেও অধিক লোভী দেখবেন। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে, যেন হাজার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ু প্রাপ্তি তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ্‌ দেখেন যা কিছু তারা করে।

قُلۡ مَن كَانَ عَدُوّٗا لِّـجِبۡرِيلَ فَإِنَّهُۥ نَزَّلَهُۥ عَلَىٰ قَلۡبِكَ بِإِذۡنِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ وَهُدٗى وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُؤۡمِنِينَ ٩٧

৯৭.আপনি বলে দিন, যে কেউ জিবরাঈলের শত্রু হয়-যেহেতু তিনি আল্লাহ্‌র আদেশে এ কালাম আপনার অন্তরে নাযিল করেছেন, যা সত্যায়নকারী তাদের সম্মুখস্থ কালামের এবং মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা।

مَن كَانَ عَدُوّٗا لِّلَّهِ وَمَلَٰٓئِكَتِهِۦ وَرُسُلِهِۦ وَجِبۡرِيلَ وَمِيكَىٰلَ فَإِنَّ ٱللَّهَ عَدُوّٞ لِّلۡكَٰفِرِينَ ٩٨

৯৮.যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ তাঁর ফেরেশতা ও রসূলগণ এবং জিবরাঈল ও মিকাঈলের শত্রু হয়, নিশ্চিতই আল্লাহ্‌ সেসব কাফেরের শত্রু।

وَلَقَدۡ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ءَايَٰتِۢ بَيِّنَٰتٖۖ وَمَا يَكۡفُرُ بِهَآ إِلَّا ٱلۡفَٰسِقُونَ ٩٩

৯৯.আমি আপনার প্রতি উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ অবতীর্ণ করেছি। অবাধ্যরা ব্যতীত কেউ এগুলো অস্বীকার করে না।

أَوَ كُلَّمَا عَٰهَدُواْ عَهۡدٗا نَّبَذَهُۥ فَرِيقٞ مِّنۡهُمۚ بَلۡ أَكۡثَرُهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ ١٠٠

১০০.কি আশ্চর্য, যখন তারা কোন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়, তখন তাদের একদল তা ছুঁড়ে ফেলে, বরং অধিকাংশই বিশ্বাস করে না।

وَلَمَّا جَآءَهُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٞ لِّمَا مَعَهُمۡ نَبَذَ فَرِيقٞ مِّنَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ كِتَٰبَ ٱللَّهِ وَرَآءَ ظُهُورِهِمۡ كَأَنَّهُمۡ لَا يَعۡلَمُونَ ١٠١

১০১.যখন তাদের কাছে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে একজন রসূল আগমন করলেন-যিনি ঐ কিতাবের সত্যায়ন করেন, যা তাদের কাছে রয়েছে, তখন আহলে কেতাবদের একদল আল্লাহ্‌র গ্রন্থকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করল-যেন তারা জানেই না।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

প্রকৃতপক্ষে ইসলাম যে সত্যধর্ম, তা প্রমাণ করার জন্যে এ ঘটনাটি যথেষ্ট। এখানে আরও দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য:

     প্রথমত: নবী করীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ‘আমলে বিদ্যমান ইহুদীদের সঙ্গে উপরোক্ত যুক্তির অবতারণা করা হয়েছিল- যারা তাঁকে নবী হিসাবে চেনার পরেও শত্রুতা ও হঠকারিতাবশতঃ অস্বীকার করেছিল, সকল যুগের ইহুদীদের সঙ্গে নয়।

     দ্বিতীয়ত: এখানে এরূপ সন্দেহ করা ঠিক নয় যে, মন ও জিহ্বা উভয়টি দ্বারাই কামনা হতে পারে। ইহুদীরা সম্ভবতঃ মনে মনে মৃত্যুর কামনা করেছে। উত্তর এই যে, প্রথমত: আল্লাহ্‌র উক্তি وَلَنْ يَّتَمَنَّوْهُ (কস্মিনকালেও তারা মৃত্যু কামনা করবে না) এ সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত: তারা মনে মনে মৃত্যু কামনা করে থাকলে, তা অবশ্যই মুখেও প্রকাশ করত। কারণ, এতে তাদেরই জয় হত এবং নবী করীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার একটা সুযোগ পেয়ে যেত।

     এরূপ সন্দেহও অমূলক যে, বোধ হয় তারা কামনা করেছে; কিন্তু তার প্রচার হয়নি। কারণ, সর্বযুগেই ইসলামের শত্রু ও সমালোচকদের সংখ্যা ইসলামের মিত্র ও শুভাকাঙ্খীদের সংখ্যার চাইতে বেশী ছিল। এরূপ কোন ঘটনা ঘটে থাকলে তারা কি একে ফলাও করে প্রচার করত না যে, দেখ, তোমাদের নির্ধারিত সত্যের মাপকাঠিতেও আমরা পুরোপুরি উত্তীর্ণ হয়েছি।

     ‘‘আরবের মুশরিকরা পরকালে বিশ্বাসী ছিল না। তাদের মতে বিলাস-ব্যসন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সবই ছিল পার্থিব। এ কারণে তারা দীর্ঘায়ু কামনা করলে তা মোটেই আশ্চর্যের বিষয় ছিল না। কিন্তু ইহুদীরা শুধু পরকালে বিশ্বাসীই ছিল না ; বরং তাদের ধারণামতে পরকালের যাবতীয় আরাম-আয়েস ও নেয়ামতরাজি তাদেরই প্রাপ্য ছিল। এরপরও তাদের পৃথিবীতে দীর্ঘায়ু কামনা করা বিস্ময়কর ব্যাপার নয় কি ?

     সুতরাং পরকালে বিশ্বাস সত্ত্বেও তাদের দীর্ঘায়ু কামনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পারলৌকিক নেয়ামত সম্পর্কিত তাদের দাবী সম্পূর্ণ অন্তঃসারশূন্য। প্রকৃত ব্যাপার তাদেরও ভালভাবে জানা রয়েছে যে, সেখানে পৌছলে জাহান্নামই হবে তাদের আবাসস্থল। তাই যতদিন বেঁচে থাকা যায়, ততদিনই মঙ্গল।

وَٱتَّبَعُواْ مَا تَتۡلُواْ ٱلشَّيَٰطِينُ عَلَىٰ مُلۡكِ سُلَيۡمَٰنَۖ وَمَا كَفَرَ سُلَيۡمَٰنُ وَلَٰكِنَّ ٱلشَّيَٰطِينَ كَفَرُواْ يُعَلِّمُونَ ٱلنَّاسَ ٱلسِّحۡرَ وَمَآ أُنزِلَ عَلَى ٱلۡمَلَكَيۡنِ بِبَابِلَ هَٰرُوتَ وَمَٰرُوتَۚ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنۡ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَآ إِنَّمَا نَحۡنُ فِتۡنَةٞ فَلَاتَكۡفُرۡۖ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنۡهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِۦ بَيۡنَ ٱلۡمَرۡءِ وَزَوۡجِهِۦۚ وَمَا هُم بِضَآرِّينَ بِهِۦ مِنۡ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذۡنِ ٱللَّهِۚ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡۚ وَلَقَدۡ عَلِمُواْ لَمَنِ ٱشۡتَرَىٰهُ مَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنۡ خَلَٰقٖۚ وَلَبِئۡسَ مَا شَرَوۡاْ بِهِۦٓ أَنفُسَهُمۡۚ لَوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ١٠٢

১০২.তারা ঐ শাস্ত্রের অনুসরণ করল, যা সুলায়মানের রাজত্ব কালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। সুলায়মান কুফর করেনি; শয়তানরাই কুফর করেছিল। তারা মানুষকে জাদুবিদ্যা এবং বাবেল শহরে হারুত ও মারুত দুই ফেরেশতার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। তারা উভয়ই একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা পরীক্ষার জন্য; কাজেই তুমি কাফের হয়ো না। অতঃপর তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যদ্দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহ্‌র আদেশ ছাড়া তদ্দ্বারা কারও অনিষ্ট করতে পারত না। যা তাদের ক্ষতি করে এবং উপকার না করে, তারা তাই শিখে। তারা ভালরূপে জানে যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করে, তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্নবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ যদি তারা জানত।

وَلَوۡ أَنَّهُمۡ ءَامَنُواْ وَٱتَّقَوۡاْ لَمَثُوبَةٞ مِّنۡ عِندِ ٱللَّهِ خَيۡرٞۚ لَّوۡ كَانُواْ يَعۡلَمُونَ ١٠٣

১০৩.যদি তারা ঈমান আনত এবং খোদাভীরু হত, তবে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পেত। যদি তারা জানত।

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقُولُواْ رَٰعِنَا وَقُولُواْ ٱنظُرۡنَا وَٱسۡمَعُواْۗ وَلِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٞ ١٠٤

১০৪.হে মুমিন গণ, তোমরা ‘রায়িনা’ বলো না-‘উনযুরনা’ বল এবং শুনতে থাক। আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।

مَّا يَوَدُّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ وَلَا ٱلۡمُشۡرِكِينَ أَن يُنَزَّلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ خَيۡرٖ مِّن رَّبِّكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَخۡتَصُّ بِرَحۡمَتِهِۦ مَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلۡفَضۡلِ ٱلۡعَظِيمِ ١٠٥

১০৫.আহলে-কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের, তাদের মনঃপুত নয় যে, তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি কোন কল্যাণ অবতীর্ণ হোক। আল্লাহ্‌ যাকে ইচ্ছা বিশেষ ভাবে স্বীয় অনুগ্রহ দান করেন। আল্লাহ্‌ মহান অনুগ্রহদাতা।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

উল্লেখিত আয়াতসমূহের তাফসীর ও শানে-নুযূল প্রসঙ্গে অনেক অসমর্থিত ইসরাঈলী রিওয়ায়াত বর্ণিত হয়। সেসব রিওয়ায়াত পাঠ করে অনেক পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরফ ‘আলী থানবী (র‘হিমাহুল্ল-হ্) সুস্পষ্ট ও সহজ ভঙ্গিতে এসব প্রশ্নের উত্তর দান করেছেন। তার বর্ণনাকে যথেষ্ট মনে করে এখানে হুবহু উদ্ধৃত করে দিলাম।

     (১) নির্বোধ ইহুদীরাই হযরত সুলাইমান (‘আলাইহিচ্ছালা-ম)-কে জাদুকর বলে আখ্যায়িত করত, তাই আল্লাহ্‌ তা‘আলা আয়াতের মাঝখানে তার নিস্কলুষতাও প্রকাশ করে দিয়েছেন।

     (২) বর্ণিত আয়াতসমূহে ইহুদীদের নিন্দা করাই উদ্দেশ্য। কারণ, তাদের মধ্যে জাদু বিদ্যার চর্চা ছিল। এসব আয়াত সম্পর্কে পরমাসুন্দরী যোহ্‌রার একটি মুখরোচক কাহিনীও সুবিদিত রয়েছে। কাহিনীটি কোন নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়াত দ্বারা সমর্থিত নয়। শরী’আতের নীতি বিরুদ্ধ মনে করে অনেক ‘আলেম কাহিনীটিকে নাকচ করে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউে একে সদর্থে ব্যাখ্যা করা শরী’আত বিরুদ্ধ মনে না করে নাকচ করেননি। বাস্তবে কাহিনীটি সত্য কি মিথ্যা, এখানে তা আলোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবে এটা ঠিক যে, আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা কাহিনীর উপর নির্ভরশীল নয়।

     (৩) সবকিছু জানা সত্ত্বেও ইহুদীরা আমল বা কাজ করত, ‘ইলম’ বা জানার বিপরীত এবং এ ব্যাপারে তারা মোটেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিত না। তাই আয়াতে প্রথমে তাদের জানার সংবাদ দেয়া হয়েছে এবং পরিশেষে ‘যদি তারা জানত!’ বলে না জানার কথাও বলা হয়েছে। কারণ, যে জানার সাথে তদনূরূপ কাজ ও বিচক্ষণতা ‍যুক্ত হয় না, তা না জানারই শামিল।

     (৪) ঠিক কখন, সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত তথ্য জানা না থাকলেও এক সময় পৃথিবীতে বিশেষ করে বাবেল শহরে জাদু-বিদ্যার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। জাদুর অত্যাশ্চর্য ক্রিয়া দেখে মূর্খ লোকদের মধ্যে জাদু ও নবীগণের মু’জিযার স্বরুপ সম্পর্কে বিভ্রান্তি দেখা দিতে থাকে। কেউ কেউ জাদুকরদেরও সজ্জন ও অনুস্মরণযোগ্য মনে করতে থাকে। এই বিভ্রান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্‌ তা‘আলা বাবেল শহরে ‘হারূত’ ও ‘মারূত’ নামে দু’জন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। তাদের কাজ ছিল জাদুর স্বরূপ ও ভেল্কিবাজি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা-যাতে বিভ্রান্তি দূর হয় এবং জাদুর ’আমল ও জাদুকরদের অনুসরণ থেকে তারা বিরত থাকতে পারে। নবীগণের নবুওয়াতকে যেমন মু’জিযাহ্ ও নিদর্শনাদি দ্বারা প্রমাণ করে দেয়া হয়, তেমনি হারূত ও মারূত যে ফেরেশতা, তার উপর যুক্তি-প্রমাণ খাড়া করে দেয়া হল, যাতে তাদের নির্দেশাবলী জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

একাজে রসূলগণকে নিযুক্ত না করার কারণ এই যে,

     প্রথমত: এতে নবী ও জাদুকরদের মধ্যে পার্থক্য ফুটিয়ে তোলা উদ্দেশ্য ছিল। এদিক দিয়ে তারা যেন ছিলেন একটি পক্ষ। কাজেই উভয়পক্ষকে বাদ দিয়ে তৃতীয় পক্ষকে বিচারক নিযুক্ত করাই বিধেয়।দ্বিতীয়ত: জাদুর বাক্যাবলী মুখে উচ্চারণ ও বর্ণনা ব্যতীত এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভবপর ছিল না। যদিও ‘কুফরে’র বর্ণনা কুফর নয়, এই স্বীকৃত নীতি অনুযায়ী নবীগণ তা করতে পারতেন, তথাপি হিদায়াতের প্রতীক হওয়ার কারণে একাজে তাদের নিযুক্তি সমীচীন মনে করা হয়নি। এ কাজের জন্য ফেরেশতাই মনোনীত হন। কারণ, সৃষ্টি জগতে ফেরেশতাদের দ্বারা এমন কাজও নেয়া হয়, যা সামগ্রিক উপযোগিতার দিক দিয়ে ভাল, কিন্তু অনিষ্টের কারণে স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে মন্দ। যেমন, কোন হিংস্র ও ইতর প্রাণীর লালন-পালন ও দেখাশুনা করা। সৃষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে একাজ সঠিক ও প্রশংসনীয়, কিন্তু জাগিতক কল্যাণ আইনের দৃষ্টিতে অঠিক ও নিন্দনীয়। পক্ষান্তরে পয়গম্বরগণকে শুধু জাগতিক কল্যাণমূলক আইন তদারকের কাজেই নিযুক্ত করা হয়-যা সাধারণতঃ ভাল কাজেই হয়ে থাকে। উপরোক্ত জাদুর উচ্চারণ ও বর্ণনা উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে জাগতিক কল্যাণমূলক কাজ হলেও জাদুর আমলে লিপ্ত হয়ে পড়ার (যেমন, বাস্তবে হেয়ছে) ক্ষীণ সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে পয়গম্বরগণকে এ থেকে দূরে রাখাই পছন্দ করা হয়েছে।

     জাদু ও মু’জিযার পার্থক্য: নবীদের মু’জিযাহ ও ওলীদের কারামাত দ্বারা যেমন অস্বাভাবিক ও অলৌকিক ঘটনাবলী প্রকাশ পায়, জাদুর মাধ্যমেও বাহ্যত তেমনি প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। ফলে মুর্খ লোকেরা বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে জাদুকরদেরকেও সম্মানিত ও মাননীয় মনে করতে থাকে। এ কারণে এতদুভয়ের পার্থক্য বর্ণনা করা দরকার।

          বলাবাহুল্য, প্রকৃত সত্তার দিক দিয়ে এবং বাহ্যিক প্রতিক্রিয়ার দিক দিয়ে এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সত্তার পার্থক্য এই  যে, জাদুর প্রভাবে সৃষ্ট ঘটনাবলীও কারণের আওতাবহির্ভুত নয়। পার্থক্য শুধু কারণটি দৃশ্য কিংবা অদৃশ্য হওয়ার মধ্যে। যেখানে কারণ দৃশ্যমান, সেখানে ঘটনাকে কারণের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়া হয় এবং ঘটনাকে মোটেই বিস্ময়কর মনে করা হয় না। কিন্তু যেখানে কারণ অদৃশ্য, সেখানেই ঘটনাকে অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক মনে করা হয়। সাধারণ লোক ‘কারণ’ না জানার দরুন এ ধরনের ঘটনাকে অলৌকিক মনে করতে থাকে। অথচ বাস্তবে তা অন্যান্য অলৌকিক ঘটনারই মত। কোন দূরপ্রাচ্য থেকে আজকের লেখা পত্র হঠাৎ সামনে পড়লে দর্শকমাত্রই সেটাকে অলৌকিক বলে আখ্যায়িত করবে। অথচ জ্বিন ও শয়তানরা এ জাতীয় কাজের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে। মোটকথা এই যে, জাদুর প্রভাবে দৃষ্ট ঘটনাবলীও প্রাকৃতিক কাজের অধীন! তবে কারণ অদৃশ্য হওয়ার দরুন মানুষ অলৌকিকতার বিভ্রান্তিতে পতিত হয়।

     মু’জিযার অবস্থা এর বিপরীত। মু’জিযাহ প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহ তা’আলার কাজ। এতে প্রাকৃতিক কারণের কোন হাত নেই। ইবরাহীম (’আলাইহিচ্ছালাম)-এর জন্যে নমরুদের জ্বালানো আগুনকে আল্লাহ তা’আলা আদেশ করেছিলেন, ‘ইবরাহীমের জন্য সুশীতল হয়ে যাও।’ কিন্তু এতটুকু শীতল নয় যে, ইবরাহীম কষ্ট অনুভব করে।’ আল্লাহর এই আদেশের ফলে আগুন শীতল হয়ে যায়।

     ইদানিং কোন কোন লোক শরীরে ভেষজ প্রয়োগ করে আগুনের ভেতরে চলে যায়। এটা মু’জিযা নয়; বরং ভেষজের প্রতিক্রিয়া। তবে ভেষজটি অদৃশ্য, তাই মানুষ একে অলৌকিক বলে ধোকা খায়।

     স্বয়ং কুরআনের বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, মু’জিযা সরাসরি আল্লাহ্‌র কাজ। বলা হয়েছে-

         ومارميت إذرميت ولكن اللّهََ رمى

অর্থাৎ-আপনি যে এক মুষ্টি কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তা আপনি নিক্ষেপ করেননি, আল্লাহ্ নিক্ষেপ করেছিলেন। অর্থাৎ, এক মুষ্টি কঙ্কর যে সমবেত সবার চোখে পৌঁছে গেল, এতে আপনার কোন হাত ছিল না। এটা ছিল একান্তভাবেই আল্লহ্‌র কাজ। এই মু’জিযাটি বদর যুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল। রসূলুল্লাহ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একমুষ্টি কঙ্কর কাফের বাহিনীর প্রতি নিক্ষেপ করেছিলেন যা সবার চোখেই পড়েছিল।

মু’জিযা প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াই সরাসরি আল্লাহ্‌র কাজ আর জাদু অদৃশ্য প্রাকৃতিক কারণের প্রভাব। এ পার্থক্যটিই মু’জিযা ও জাদুর স্বরূপ বোঝার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, সাধারণ লোক এই পার্থক্যটি কিভাবে বুঝবে? কারণ, বাহ্যিক রূপ উভয়েরই এক। এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, সাধারণ লোকদের বোঝার জন্যেও আল্লাহ্ তা’আলা কয়েকটি পার্থক্য প্রকাশ করেছেন।

     প্রথমত: মু’জিযা ও কারামত এমন ব্যক্তিবর্গের দ্বারা প্রকাশ পায়, যাঁদের আল্লাহ্‌ভীতি, পবিত্রতা, চরিত্র ও কাজকর্ম সবার দৃষ্টির সামনে থাকে। পক্ষান্তরে জাদু তারাই প্রদর্শন করে, যারা নোংরা, অপবিত্র এবং আল্লাহ্‌র যিক্‌র থেকে দূরে থাকে। এসব বিষয় চোখে দেখে প্রত্যেকেই মু’জিযা ও জাদুর প্রার্থক্য বুঝতে পারে।

দ্বিতীয়ত: আল্লাহ্‌র চিরাচরিত রীতি এই যে, যে ব্যক্তি মু’জিযা ও নবুওয়াত দাবী করে জাদু করতে চায়, তার জাদু প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। অবশ্য নবুওয়অতের দাবী ছাড়া জাদু করলে, তা প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

     পয়গম্বরগণের উপর জাদু ক্রিয়া করে কি না? এ প্রশ্নের উত্তর হবে ‘ইতিবাচক। কারণ, পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, জাদু প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক কারণের প্রবাব। পয়গম্বরগণ প্রাকৃতিক কারণের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হন। এটা নবুওয়াতের মর্যাদার পরিপন্থী নয়। সবাই জানেন, বাহ্যিক কারণ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পয়গম্বরগণ ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হন, রোগাক্রান্তহন এবং আরোগ্য লাভ করেন। তেমনিবাবে জাদুর অদৃশ্য কারণ দ্বারাও তারা প্রভাবান্বিত হতে পারেন। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে যে, ইহদীরা রসূলুল্লাহ (সল্লাল্ল-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর জাদু করেছিল এবং সে জাদুর কিছু প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ পেয়েছিল। ওহীর মাধ্যমে তা জানা সম্ভব হয়েছিল এবং জাদুর প্রভাব দূরও করা হয়েছিল। মূসা (আলাইহিচ্ছালাম)-এর জাদুর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হওয়া কুরআনেই উল্লেখিত রয়েছে-

– يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِن سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَىٰ এবং فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خِيفَةً مُّوسَىٰ

জাদুর কারণেই মূসা (আলাইহিচ্ছালাম)-এর মনে ভিতীর সঞ্চার হয়েছিল।

শরী’আতে জাদু সম্পর্কিত বিধি-বিধান:

          পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে, কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় জাদু এমন অদ্ভুত কর্মকান্ড, যাতে কুফর শিরক এবং পাপচার অবলম্বন করে জ্বিন ও শয়তানকে সন্তুষ্ট করে তাদের সাহায্য নেয়া হয়। কুরআনে বর্ণিত বাবেল শহেরের জাদু ছিল তাই। -(জাস্‌সাস)

এ জাদুকেই কুরআন কুফর বলে অভিহিত করেছে। আবূ মনসূর (রহ:) বলেন, বিশুদ্ধ অভিমত এই যে, জাদুর সকল প্রকারই কুফর নয়; বরং যাতে ঈমানের পরিপন্থী কথাবার্তা এবং কাজকর্ম অবলম্বন করা হয়, তাই কুফর।–(রূহুল মা’আনী)।

          আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, আপনার কোন জায়েয কাজ থেকে যদি অন্যরা না-জায়েয কাজের আশকারা পায়, তবে সে জায়েয কাজটিও আপনার পক্ষে জায়েয থাকবে না। উদাহরণত: কোন আলেমের কোন জায়েয কাজ দেখে যদি সাধারণ লোকেরা বিভ্রান্ত হয় এবং না-জায়েয কাজে লিপ্ত হয়, তবে সে আলেমের জন্য সে জায়েয কাজটিও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। তবে শর্ত এই যে, সংশ্লিষ্ট কাজটি শরীআতের দৃষ্টিতে জরুরী না হওয়া চাই। কুরআন ও হাদীসে এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে।

     ইহুদীদের দাবী ছিল দুটি: (এক) ইহুদীবাদ ইসলামের চাইতে শ্রেষ্ঠ। (দুই) তারা মুসলমানদের শুভাকাঙ্খী। প্রথম দাবীটি তারা প্রমাণ করতে পারেনি। নিছক দাবীতে কিছু হয় না। এছাড়া দাবীটি নিরর্থকও বটে। কারণ, ‘নাসিখ’ (যে রহিত করে) আগমন করলে ‘মনসুখ’ (যাকে রহিত করা হয়) বর্জনীয় হয়ে যায়। তা উত্তম ও অধমের পার্থক্যের উপর নির্ভরশীল নয়। এই উত্তরটি সুস্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত, এ কারণে আয়াতে তা উল্লেখ করা হয়নি। আয়াতে শুধু দ্বিতীয় দাবীটি নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়বস্তুকে শক্তিশালী ও জোরদার করার উদ্দেশ্যে আহলে কিতাবদের সাথে মুশরিকদের উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ, মুশরিকরা যেমন নিশ্চিতরূপেই তোমাদের হিতাকাঙ্খী নয়, তাদেরকেও তেমনি মনে করো।

۞مَا نَنسَخۡ مِنۡ ءَايَةٍ أَوۡ نُنسِهَا نَأۡتِ بِخَيۡرٖ مِّنۡهَآ أَوۡ مِثۡلِهَآۗ أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٌ ١٠٦

১০৬.আমি কোন আয়াত রহিত করলে অথবা বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ্‌ সব কিছুর উপর শক্তিমান?

أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۗ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٍ ١٠٧

১০৭.তুমি কি জান না যে, আল্লাহ্‌র জন্যই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের আধিপত্য? আল্লাহ্‌ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই।

أَمۡ تُرِيدُونَ أَن تَسۡ‍َٔلُواْ رَسُولَكُمۡ كَمَا سُئِلَ مُوسَىٰ مِن قَبۡلُۗ وَمَن يَتَبَدَّلِ ٱلۡكُفۡرَ بِٱلۡإِيمَٰنِ فَقَدۡ ضَلَّ سَوَآءَ ٱلسَّبِيلِ ١٠٨

১০৮.ইতিপূর্বে মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) যেমন জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন, (মুসলমানগন, ) তোমরাও কি তোমাদের রসূলকে তেমনি প্রশ্ন করতে চাও? যে কেউ ঈমানের পরিবর্তে কুফর গ্রহন করে, সে সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়।

وَدَّ كَثِيرٞ مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ لَوۡ يَرُدُّونَكُم مِّنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِكُمۡ كُفَّارًا حَسَدٗا مِّنۡ عِندِ أَنفُسِهِم مِّنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ ٱلۡحَقُّۖ فَٱعۡفُواْ وَٱصۡفَحُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦٓۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٠٩

১০৯.আহলে কিতাবদের অনেকেই প্রতিহিংসাবশতঃ চায় যে, মুসলমান হওয়ার পর তোমাদেরকে কোন রকমে কাফের বানিয়ে দেয়। তাদের কাছে সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর (তারা এটা চায়)। যাক তোমরা আল্লাহ্‌র নির্দেশ আসা পর্যন্ত তাদের ক্ষমা কর এবং উপেক্ষা কর। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِۗ إِنَّ ٱللَّهَ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ١١٠

১১০.তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্যে পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহ্‌র কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তা প্রত্যক্ষ করেন।

وَقَالُواْ لَن يَدۡخُلَ ٱلۡجَنَّةَ إِلَّا مَن كَانَ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰۗ تِلۡكَ أَمَانِيُّهُمۡۗ قُلۡ هَاتُواْ بُرۡهَٰنَكُمۡ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ١١١

১১১.ওরা বলে, ইহুদী অথবা খ্রীস্টান ব্যতীত কেউ জান্নাতে যাবে না। এটা ওদের মনের বাসনা। বলে দিন, তোমরা সত্যবাদী হলে, প্রমাণ উপস্থিত কর।

بَلَىٰۚ مَنۡ أَسۡلَمَ وَجۡهَهُۥ لِلَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَلَهُۥٓ أَجۡرُهُۥ عِندَ رَبِّهِۦ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ١١٢

১১২.হাঁ, যে ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে সমর্পন করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও বটে তার জন্য তার পালনকর্তার কাছে পুরস্কার বয়েছে। তাদের ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

مَا نَنسَخۡ مِنۡ ءَايَةٍ أَوۡ نُنسِهَا এই আয়াতে কুরআনী আয়াত রহিত হওয়ার সম্ভাব্য সকল প্রকারই সন্নিবেশিত রয়েছে। অভিধানে ‘নাস্‌খ’ শব্দের অর্থ দূর করা, লিখা। সমস্ত মুসলিম টীকাকার এ বিষয়ে একমত যে, আয়াতে ‘নাস্‌খ’ শব্দ দ্বারা বিধি-বিধান দূর করা- অর্থাৎ, রহিত করাকে বোঝানো হয়েছে। এ কারণেই ‘হাদীস ও কুরআনের পরিভাষায় এক বিধানের স্থলে অন্য বিধান প্রবর্তন করাকে ‘নাস্‌খ’ বলা হয়। ‘অন্য বিধানটি’ কোন বিধানের বিলুপ্তি ঘোষণাও হতে পারে, আবার এক বিধানের পরিবর্তে অপর বিধান প্রবর্তনও হতে পারে।

     আল্লাহ্‌র বিধানে নাস্‌খের স্বরুপঃ জগতের রাষ্ট্র ও আইন-আদালতে এক নির্দেশকে রহিত করে অন্য নির্দেশ জারী করার ব্যাপারটি সর্বজনবিদিত। রচিত আইনে ‘নাস্‌খ’ বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে।

     (১) ভূল ধারণার উপর নির্ভর করে প্রথমে যদি কোন আইন প্রবর্তন করা হয়, তবে পরে বিষয়টির প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটিত হলে পূর্বেকার আইন পরিবর্তন করা হয়।

     (২) ভবিষ্যত অবস্থার গতি-প্রকৃতি জানা না থাকার কারণে কোন কোন সাময়িক আইন জারী করা হয়। পরে অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে সে আইনও পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু এ ধরনের নাস্‌খ আল্লাহ্‌র আইনে হতে পারে বলে ধারণা করা যায় না।

      তৃতীয় প্রকার নাস্‌খএরূপ: আইন-রচয়িতা আগেই জানে যে, অবস্থার পরিবর্তন হবে এবং তখন এই আইন আর উপযোগী থাকবে না, অন্য আইন জারী করতে হবে। এরুপ জানার পর সাময়িকভাবে এই আইন জারী করে দেন, পরে পূর্বজ্ঞান অনুযায়ী যখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তথন পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইন পরিবর্তন করেন।

     উদাহরণত: রোগীর বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দেন। তিনি জানেন যে, এই ওষুধ দু’দিন সেবন করার পর রোগীর অবস্থার পরিবর্তন হবে এবং তখন অন্য ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে। অবস্থার এহেন পরিবর্তন জানার ফলেই চিকিৎসক প্রথম দিন এক ওষুধ এবং পরে অন্য ওষুধ দেন।

     অভিজ্ঞ চিকিৎসক প্রথম দিনেই চিকিৎসার পূর্ণ প্রোগ্রাম কাগজে লিখে দিতে পারে যে, দুদিন এই ওষুধ, তিন দিন অন্য ওষুধ এবং এক সপ্তাহ পর অমুক ওষুধ সেব্য। কিন্তু এরূপ করা হলে রোগীর পক্ষে জটিলতার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং এতে ভূল বুঝাবুঝির কারণে ত্রুটিরও আশঙ্কা থাকে। তাই ডাক্তার প্রথম দিনেই পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেন না।

     আল্লাহ্‌র আইনে এবং আসমানী প্রন্থসমূহে শুধুমাত্র তৃতীয় প্রকার নাস্‌খই হতে পারে এবং হয়ে থাকে। প্রতিটি নবুওয়াত ও প্রতিটি আসমানী গ্রন্থ পূর্ববর্তী নবুওয়াত ও আসমানী গ্রন্থের বিধান নাস্‌খ তথা রহিত করে নতুন বিধান জারী করেছে। এমনিভাবে একই নবুওয়াত ও শরী‘আতে এমন রয়েছে যে, এক বিধান কিছু দিন প্রচলিত থাকার পর আল্লাহ্‌র ‘হিকমত অনুযায়ী সেটি পরিবর্তন করে তদস্থলে অন্য বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। স‘হীহ্ মুসলিমের ‘হাদীসে আছেঃ لم تكن نبوة قط تناسخت – অর্থাৎ, এমন নবুওয়াত কখনও ছিল না, যাতে নাস্‌খ ও পরিবর্তন করা হয়নি।– (কুরতুবী)বিধান পরিবর্তন সংক্রান্ত বিস্তারিত জানার জন্য উসূলে ফেকাহ দ্রষ্টব্য)

     এখানে ‘অন্যায় আবদার’ বলার কারণ এই যে, প্রতিটি কাজেই আল্লাহ্‌ তা‘আলার ‘হিকমত ও উপযোগিতা নিহিত থাকে। তাতে পন্থা নির্দেশ করার কোন অধিকার বান্দার নেই যে, সে বলবে, একাজটি এভাবে করা হোক।

     জ্ঞাতব্য: তখনকার অবস্থানুযায়ী ক্ষমার নির্দেশই ছিল বিধেয়। পরবর্তীকালে আল্লাহ্‌ স্বীয় প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেন এবং  জিহাদের আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়। অতঃপর ইহুদীদের প্রতিও আইন বলবৎ করা হয় এবং অপরাধের ক্রমানুপাতে দুষ্টদের হত্যা, নির্বাসন, জিয্‌ইয়াহ্ আরোপ ইত্যাদি শাস্তি দেয়া হয়।

     আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ্‌ তা‘আলা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের পারস্পরিক মতবিরোধের উল্লেখ করে তাদের নির্বুদ্ধিতা ও মতবিরোধের কুফল বর্ণনা করেছেন। অতঃপর আসল সত্য উদঘাটন করেছেন। এসব ঘটনায় মুসলমানদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হিদায়াত (পথনির্দেশ) নিহিত রয়েছে যা পরে বর্ণিত হবে। খ্রীষ্টান ও ইহুদী উভয় সম্প্রদায়ই ধর্মের প্রকৃত সত্যকে উপেক্ষা করে ধর্মের নাম-ভিত্তিক জাতীয়তা গড়ে তুলেছিল এবং তারা প্রত্যেকেই স্বজাতিকে জান্নাতি ও আল্লাহ্‌র প্রিয়পাত্র বলে দাবী করতো এবং তাদের ছাড়া অন্যান্য সমস্ত জাতিকে জাহান্নামী ও পথভ্রষ্ট বলে বিশ্বাস করত।

     এ অযৌক্তিক মতবিরোধের ফলশ্রুতিতেই মুশরিকরা একথা বলার সুযোগ পেল যে, খ্রীষ্টধর্ম ও ইহুদীধর্ম উভয়টিই মিথ্যা ও বানোয়াট এবং ওদের মুর্তি পূজাই একমাত্র সত্য ও বিশুদ্ধ ধর্ম।

     আল্লাহ্‌ তা‘আলা উভয় সম্প্রদায়ের মূর্খতা সম্পর্কে মন্তব্য করছেন যে, এরা উভয় জাতিই জান্নাতে যাওয়ার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে উদাসীন; তারা শুধু ধর্মের নাম ভিত্তিক জাতীয়তার অনুসরণ করে। বস্তুত: ইহুদী-খ্রীষ্টান অথবা ইসলাম যে কোন ধর্ম হোক, সবগুলোর প্রাণ হচ্ছে দু’টি বিষয়:

     (এক) বান্দা মনে-প্রাণে নিজেকে আল্লাহ্‌র কাছে সমর্পন করবে। তার আনুগত্যকেই নিজের মত ও পথ মনে করবে। এ উদ্দেশ্যটি যে ধর্মে অর্জিত হয় তা’ই প্রকৃত ধর্ম। ধর্মের প্রকৃত স্বরুপকে পেছনে ফেলে ইহুদী অথবা খ্রীষ্টান জাতীয়তাবাদের ধ্বজা ধরে থাকা ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচায়ক।

     (দুই) যদি কেউ মনে-প্রাণে আল্লাহ্‌ তা‘আলার আনুগত্যের সংকল্প গ্রহণ করে কিন্তু আনুগত্য ও ‘ইবাদাত নিজ খেয়াল-খুশীমত মনগড়া পন্থায় সম্পাদন করে, তবে তাও জান্নাতে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়, বরং এক্ষেত্রেও আনুগত্য ও ‘ইবাদাতের সে পন্থাই অবলম্বন করতে হবে, যা আল্লাহ্ তা‘আলা রসূলের মাধ্যমে বর্ণনা ও নির্ধারণ করেছে।

প্রথম বিষয়টি بَلَىٰۚ مَنۡ أَسۡلَمَ বাক্যাংশের মাধ্যমে এবং দ্বিতীয় বিষয়টি وَهُوَ مُحۡسِنٞ বাক্যাংশের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে। এতে জানা গেল যে, পারলৌকিক মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশের জন্য আনুগত্যের সংকল্পই যথেষ্ট নয়, বরং সৎকর্মও প্রয়োজন। বস্তুতঃ কুরআন ও রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহ্‌র সাথে সামঞ্জস্যশীল শিক্ষা ও পন্থাই সৎকর্ম।

وَقَالَتِ ٱلۡيَهُودُ لَيۡسَتِ ٱلنَّصَٰرَىٰ عَلَىٰ شَيۡءٖ وَقَالَتِ ٱلنَّصَٰرَىٰ لَيۡسَتِ ٱلۡيَهُودُ عَلَىٰ شَيۡءٖ وَهُمۡ يَتۡلُونَ ٱلۡكِتَٰبَۗ كَذَٰلِكَ قَالَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ مِثۡلَ قَوۡلِهِمۡۚ فَٱللَّهُ يَحۡكُمُ بَيۡنَهُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ فِيمَا كَانُواْ فِيهِ يَخۡتَلِفُونَ ١١٣

১১৩.ইহুদীরা বলে, খ্রীস্টানরা কোন ভিত্তির উপরেই নয় এবং খ্রীস্টানরা বলে, ইহুদীরা কোন ভিত্তির উপরেই নয়। অথচ ওরা সবাই কিতাব পাঠ করে! এমনিভাবে যারা মূর্খ, তারাও ওদের মতই উক্তি করে। অতএব, আল্লাহ্‌ কেয়ামতের দিন তাদের মধ্যে ফয়সালা দেবেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছিল।

وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن مَّنَعَ مَسَٰجِدَ ٱللَّهِ أَن يُذۡكَرَ فِيهَا ٱسۡمُهُۥ وَسَعَىٰ فِي خَرَابِهَآۚ أُوْلَٰٓئِكَ مَا كَانَ لَهُمۡ أَن يَدۡخُلُوهَآ إِلَّا خَآئِفِينَۚ لَهُمۡ فِي ٱلدُّنۡيَا خِزۡيٞ وَلَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١١٤

১১৪.যে ব্যাক্তি আল্লাহ্‌র মসজিদসমূহে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে উজাড় করতে চেষ্টা করে, তার চাইতে বড় যালেম আর কে? এদের পক্ষে মসজিদসমূহে প্রবেশ করা বিধেয় নয়, অবশ্য ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়। ওদের জন্য ইহকালে লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে।

وَلِلَّهِ ٱلۡمَشۡرِقُ وَٱلۡمَغۡرِبُۚ فَأَيۡنَمَا تُوَلُّواْ فَثَمَّ وَجۡهُ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ وَٰسِعٌ عَلِيمٞ ١١٥

১১৫.পূর্ব ও পশ্চিম আল্লারই। অতএব, তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই আল্লাহ্‌ বিরাজমান। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ।

وَقَالُواْ ٱتَّخَذَ ٱللَّهُ وَلَدٗاۗ سُبۡحَٰنَهُۥۖ بَل لَّهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ كُلّٞ لَّهُۥ قَٰنِتُونَ ١١٦

১১৬.তারা বলে, আল্লাহ্‌ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি তো এসব কিছু থেকে পবিত্র, বরং নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তার আজ্ঞাধীন।

بَدِيعُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ وَإِذَا قَضَىٰٓ أَمۡرٗا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُۥ كُن فَيَكُونُ ١١٧

১১৭.তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে একথাই বলেন, ‘হয়ে যাও’ তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।

وَقَالَ ٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَ لَوۡلَا يُكَلِّمُنَا ٱللَّهُ أَوۡ تَأۡتِينَآ ءَايَةٞۗ كَذَٰلِكَ قَالَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِم مِّثۡلَ قَوۡلِهِمۡۘ تَشَٰبَهَتۡ قُلُوبُهُمۡۗ قَدۡ بَيَّنَّا ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يُوقِنُونَ ١١٨

১১৮.যারা কিছু জানে না, তারা বলে, আল্লাহ্‌ আমাদের সঙ্গে কেন কথা বলেন না? অথবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন কেন আসে না? এমনি ভাবে তাদের পূর্বে যারা ছিল তারাও তাদেরই অনুরূপ কথা বলেছে। তাদের অন্তর একই রকম। নিশ্চয় আমি উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করেছি তাদের জন্যে যারা প্রত্যয়শীল।

إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗاۖ وَلَا تُسۡ‍َٔلُ عَنۡ أَصۡحَٰبِ ٱلۡجَحِيمِ ١١٩

১১৯.নিশ্চয় আমি আপনাকে সত্যধর্মসহ সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে পাঠিয়েছি। আপনি দোযখবাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন না।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

আল্লাহ্‌র কাছে বংশগত ইহুদী, খ্রীষ্টান ও মুসলমানের কোন মূল্য নেই; গ্রহণীয় বিষয় হচ্ছে ঈমান ও সৎকর্মঃ ইহুদী হউক, অথবা খ্রীষ্টান কিংবা মুসলমান-যে কেউ উপরোক্ত মৌলিক বিষয়াদির মধ্য থেকে কোন একটি ছেড়ে দেয়, অতঃপর শুধু নাম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে নিজেদেরকে জান্নাতের একমাত্র উত্তরাধিকারী মনে করে নেয়, সে আত্ম প্রবঞ্চনা বৈ কিছুই করে না; আসল সত্যের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এসব নামের উপর ভরসা করে কেউ আল্লাহ্‌র নিকটবর্তী ও মক্ববূল হতে পারবে না, যে পর্যন্ত না তার মধ্যে ঈমান ও সৎকর্ম থাকে।

     প্রত্যেক পয়গম্বরের শরী‘আতেই ঈমানের মূলনীতি এক ও অভিন্ন। তবে সৎকর্মের আকার-আকৃতিতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। তাওরাতের যুগে যেসব কাজকর্ম মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) ও তাওরাতের শিক্ষার অনুরুপ ছিল, তা’ই ছিল সৎকর্ম। তদ্রুপ ইঞ্জীলের যুগে নিশ্চিতরূপে তা’ই ছিল সৎকর্ম, যা হযরত ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) ও ইঞ্জীলের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যশীল ছিল। এখন কুরআনের যুগে ঐসব কার্যকলাপই সৎকর্ম রুপে অভিহিত হওয়ার যোগ্য, যা সর্বশেষ নবী (সল্লাল্ল-হ ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণী ও তৎকর্তৃক আনীত গ্রন্থ কুরআন মাজীদের হিদায়াতের অনুরুপ।
মোটকথা, ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের মতবিরোধ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলার ফায়সালা এই যে, উভয় সম্প্রদায় মুর্খতাসূলভ কথাবার্তা বলেছে, তাদের কেউই জান্নাতের ইজারাদার নয়। তাদের কারও ধর্ম ভিত্তিহীন ও বানোয়াট নয়; বরং উভয় ধর্মের নির্ভূল ভিত্তি রয়েছে। ভূল বোঝাবুঝির প্রকৃত কারণ হচ্ছে এই যে, ওরা ধর্মের আসল প্রাণ বিশ্বাস, সৎকর্ম ও সত্য মতবাদকে বাদ দিয়ে বংশ অথবা দেশের ভিত্তিতে কোন সম্প্রদায়কে ইহুদী আর কোন সম্প্রাদায়কে খ্রীষ্টান নামে অভিহিত করেছে।

     যারা ইহুদীদের বংশধর অথবা ইহুদী নগরীতে বাস করে অথবা আদমশুমারীতে নিজেকে ইহুদী বলে প্রকাশ করে, তাদেরকেই ইহুদী মনে করে নেয়া হয়েছে। তেমনিভাবে খ্রীষ্টানদের পরিচিত ও সংখ্যা নিরুপণ করা হয়েছে। অথচ ঈমানের মূলনীতি ভঙ্গ করে এবং সৎকর্ম থেকে বিমুখ হয়ে কোন ইহুদীই ইহুদী এবং কোন খ্রীষ্টানই খ্রীষ্টান থাকতে পারে না।

     কুরআন মাজীদে আহলে-কিতাবদের মতবিরোধ ও আল্লাহ্‌র ফায়সালা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল মুসলমানদের সতর্ক করা, যাতে তারাও ভূল বোঝাবুঝিতে লিপ্ত হয়ে একথা না বলে যে, আমরা পুরুষানুক্রমে মুসলমান, প্রত্যেক অফিস ও রেজিষ্টারে আমাদের নাম মুসলমানদের কোটায় লিপিবদ্ধ এবং আমরা মুখেও নিজেদের মুসলমান বলি, সুতরাং জান্নাত এবং নবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মাধ্যমে মুসলমানদের সাথে ওয়াদাকৃত সকল পুরস্কারের যোগ্য হকদার আমরাই।

     এই ফায়সালা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শুধু দাবী করলে, মুসলমানরূপে নাম লিপিবদ্ধ করালে অথবা মুসলমানদের ঔরসে কিংবা মুসলমানদের আবাসভূমিতে জন্মগ্রহণ করলেই প্রকৃত মুসলমান হয় না, বরং মুসলমান হওয়ার জন্যে পরিপূর্ণরূপে ইসলাম গ্রহণ করা অপরিহার্য। ইসলামের অর্থ আত্মসমর্পন। দ্বিতীয়ত: সৎকর্ম অর্থাৎ, সুন্নাহ্‌ অনুযায়ী ‘‘আমল করাও জরুরী।

     কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কুরআন মাজীদের এই হুশিয়ারী সত্ত্বেও অনেক মুসলমান উপরোক্ত ইহুদী ও খ্রীষ্টানী ভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছে। তারা আল্লাহ্, রসুল, পরকাল ও কেয়ামতের ব্যাপারে উদাসীন হয় বংশগত মুসলমান হওয়াকেই যথেষ্ট মনে করতে শুরু করেছে। কুরআন ও ‘হাদীসে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সাফল্য সম্পর্কে মুসলমানদের সাথে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছে, তারা নিজেকে সেগুলোর যোগ্য হকদার মনে করে সেগুলোর পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা করছে। অতঃপর সেগুলো পূর্ণ হওয়ার লক্ষণ দেখতে না গেয়ে কুরআন ও হাদীসের অঙ্গীকার সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছে। তারা লক্ষ্য করে না যে, কুরআন নিছক বংশগত মুসলমানদের সাথে কোন অঙ্গীকার করেনি-যতক্ষণ না তারা নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহ্‌ তা‘আলা ও তার রসুল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ইচ্ছার অধীন করে দেয়। بَلَىٰۚ مَنۡ أَسۡلَمَ   আয়াতের সারমর্ম তাই।

     আজকাল সমগ্র বিশ্বের মুসলমান নানাবিধ বিপদাপদ ও সঙ্কটে নিমজ্জিত। অনেক আর্বাচীনের ধারণা, এ অবস্থার জন্যে সম্ভবতঃ আমাদের ইসলামই দায়ী। কিন্তু উপরোক্ত বর্ণনায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, ইসলাম নয় বরং ইসলামকে পরিহার করাই এর জন্য দায়ী। আমরা ইসলামের শুধু নামটুকু রেখেছি; আমাদের মধ্যে ইসলামের বিশ্বাস, চরিত্র, ‘‘আমল ইত্যাদি কিছুই নেই।

     এখানে প্রশ্ন হয় যে, আমরা যাই আছি, ইসলামেরই নাম নেই এবং আল্লাহ্‌ তা‘আলা ও রসুল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কেই স্মরণ করি। পক্ষান্তরে যেসব কাফের খোলাখুলিভাবে আল্লাহ্ ও রসুলের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং ইসলামের নাম মুখে উচ্চারণ করাও পছন্দ করে না, তারাই আজ বিশ্বের বুকে সব দিক দিয়ে উন্নত, তারাই বিশাল রাষ্ট্রের অধিকারী এবং তারাই বিশ্বের শিল্প ও ব্যবসায়ের একচ্ছত্র অধিপতি। দুষ্কর্মের শাস্তি হিসেবেই যদি আজ আমরা সর্বত্র লাঞ্চিত ও পদদলিত, তবে কাফের ও পাপাচারীদের সাজা আরও বেশী হওয়া উচিত। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলেই এ প্রশ্নেরও অবসান হয়ে যায়।

     প্রথমত: এক কারণ এই যে, মিত্র ও শত্রুর সাথে একই রকম ব্যবহার করা হয় না। মিত্রের দোষ পদে পদে ধরা হয়। নিজ সন্তান ও শিষ্যকে সামান্য বিষয়ে শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু শত্রুর সাথে তেমনি ব্যবহার করা হয় না। তাকে অবকাশ দেয়া হয় এবং সময় আসলে হঠাৎ পাকড়াও করা হয়।

     মুসলমান যতক্ষণ ঈমান ও ইসলামের নাম উচ্চারণ করে,  আল্লাহ্‌র মাহাত্ম্য ও ভালবাসা দাবী করে, ততক্ষণ সে বন্ধুরই তালিকাভুক্ত থাকে। ফলে তার মন্দ ‘আমলের সাজা সাধারনতঃ দুনিয়াতেই দিয়ে দেয়া হয়-যাতে পরকালের বোঝা কিছুটা হলেও হালকা হয়ে যায়। কাফেরের অবস্থা এর বিপরীত। সে বিদ্রোহী ও শত্রুর আইনের অধীন। দুনিয়াতে হালকা শাস্তি দিয়ে তার শাস্তির মাত্রা হ্রাস করা হয় না। তাকে পুরোপুরি শাস্তির মধ্যেই নিক্ষেপ করা হবে। ‘দুনিয়া মুমিনের জন্যে বন্দীশালা, আর কাফেরদের জন্যে জান্নাত।’- মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর এ উক্তির তাৎপর্যও তাই।

     মুসলমানদের অবনতি ও অস্থিরতা এবং কাফেরদের উন্নতি ও প্রশান্তির মূলে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক কর্মের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এক কর্ম দ্বারা অন্য কর্মের বৈশিষ্ট্য অর্জিত হতে পারে না।

     উদাহরণত: ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আর্থিক উন্নতি আর ওষুধপত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শারীরিক সুস্থতা। এখন যদি কেউ দিবারাত্র ব্যবসায়ে মগ্ন থাকে, অসুস্থতা ও তার চিকিৎসার প্রতি মনোযোগ না দেয়, তবে শুধু ব্যবসায়ের কারণে সে রোগের কবল থেকে মুক্তি পেতে পারে না। এমনিভাবে কেউ ওষুধপত্র ব্যবহার করেই ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ, আর্থিক উন্নতি লাভ করতে পারে না। কাফেরদের পার্থিব উন্নতি এবং আর্থিক প্রাচুর্য তাদের কুফরের ফলশ্রুতি নয়, যেমন মুসলমানদের দারিদ্র ও অস্থিরতা ইসলামের ফলশ্রুতি নয়। বরং কাফেররা যখন পরকালের চিন্তা-ভাবনা পরিহার করে পরিপূর্ণভাবে জাগতিক অর্থ-সম্পদ ও আরাম-আয়েশের পেছনে আত্মনিয়োগ করেছে- ব্যবসা শিল্প, কৃষি ও রাজনীতির লাভজনক পন্থা অবলম্বন করছে এবং ক্ষতিকর পন্থা থেকে বিরত থাকছে, তখনই তারা জগতে উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হচ্ছে। তারাও যদি আমাদের মত ধর্মের নাম নিয়ে বসে থাকত এবং জাগতিক উন্নতির লক্ষ্যে যথাবিহিত চেষ্টা-সাধণা না করত, তবে তাদের কুফর তাদেরকে অর্থ-সম্পদ ও রাষ্ট্রের মালিক বানাতে পারত না। এমতাবস্থায় আমরা কিভাবে আশা করতে পারি যে, আমাদের (তথাকথিত নামের) ইসলাম আমাদের সামনে সকল বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দেবে? ইসলাম ও ঈমাম সঠিক মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও তার আসল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পারলৌকিক মুক্তি ও জান্নাতের অফুরন্ত শান্তি। উপযুক্ত চেষ্টা-সাধণা না করা হলে ইসলাম ও ঈমানের ফলশ্রুতিতে জগতে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশের প্রাচুর্য লাভ করা অবশ্যম্ভাবী নয়।
একথা অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত যে, যে কোন দেশে যে কোন মুসলমান যদি ব্যবসা, শিল্প ও রাজনীতির বিশুদ্ধ মূলনীতি শিক্ষা করে তদনুযায়ী কাজ করে, তবে সেও কাফেরদের অর্জিত জাগতিক ফলাফল লাভে বঞ্চিত হয় না।

     মোটকথা, আলোচ্য আয়াতসমূহ থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ঈমান ও সৎকর্ম পূর্ণরূপে অবলম্বন না করলে শুধু বংশগতভাবে ইসলামের নাম ব্যবহারের দ্বারা কোন শুভ ফল আশা করা যায় না।

     আলোচ্য ১১৪ ও ১১৫নং আয়াতদ্বয়ে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণিত হয়েছে। প্রথম আয়াতটি একটি বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।

ঘটনাটি এই যে, ইসলাম-পূর্বকালে ইহুদীরা হযরত ইয়া‘হ্ইয়া (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে হত্যা করলে খ্রীষ্টানরা তার প্রতিশোধ গ্রহণে বদ্ধপরিকর হয়। তারা ইরাকের একজন অগ্নি-উপাসক সম্রাটের সাথে মিলিত হয়ে সম্রাট তায়তাসের নেতৃত্বাধীন সিরিয়ার ইহুদীদের উপর আক্রমণ চালায়- তাদের হত্যা ও লুন্ঠন করে, তাওরাতের কপিসমূহ জ্বালিয়ে ফেলে, বাইতুল মোকাদ্দাসে আবর্জনা ও শুকর নিক্ষেপ করে, মসজিদের প্রাচীর ক্ষত-বিক্ষত করে সমগ্র শহরটিকে জন-মানবহীন বিরানায় পরিণত করে দেয়। এতে ইহুদীদের শক্তি পদদলিত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)- এর ‘আমল পর্যন্ত বাইতুল-মোকাদ্দাস এমনিভাবে পরিত্যক্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিল।

     ফারুক্বে ‘আযম হযরত ‘উমার (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু)- এর খেলাফত ‘আমলে যখন সিরিয়া ও ‘ইরাক বিজিত হয়, তখন তারই নির্দেশক্রমে বাইতুল-মোকাদ্দাস পুনঃনির্মিত হয়। এরপর দীর্ঘকাল পর্যন্ত সমস্ত সিরিয়া ও বাইতুল-মোকাদ্দাস মুসলমানদের অধিকারে ছিল। অতঃপর বাইতুল-মোকাদ্দাস মুসলমানদের হস্তচ্যুত হয় এবং প্রায় অর্ধশতাব্দীকার পর্যন্ত ইউরোপীয় খ্রীষ্টানদের অধিকারে থাকে। অবশেষে হিজরী ষষ্ঠ শতকে সুলতান সালা‘হুদ্দিন আইয়্যুবী (র‘হমাতুল্ল-হি ‘আলাইহ) বাইতুল-মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করেন।

এ আয়াত থেকে কতিপয় প্রয়োজনীয় মাসআলা এবং বিধানও প্রমাণিত হয়।

     প্রথমত: শিষ্টতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বিশ্বের সকল মসজিদ একই পর্যায়ভূক্ত। বাইতুল-মোকাদ্দাস, মসজিদে-‘‘হারাম ও মসজিদে-নবভীর অবমাননা, যেমনি বড় যুলুম, তেমনি অন্যান্য মসজিদের বেলায়ও তা সমভাবে প্রযোজ্য। তবে এই তিনটি মসজিদের বিশেষ মাহাত্ম্য ও সম্মান স্বতন্ত্রভাবে স্বীকৃত। মসজিদে-‘হারামে এক রকা‘আত নামাযের সওয়াব একলক্ষ রকা‘আত নামাযের সমান এবং মসজিদে নবভী ও বাইতুল-মোকাদ্দাসে পঞ্চাশ হাজার রকা‘আত নামাযের সমান। এই তিন মসজিদে নামায পড়ার উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্ত থেকে সফর করে সেখানে পৌছা বিরাট সওয়াব ও বরকতের বিষয়। কিন্তু অন্য কোন মসজিদে নামায পড়া উত্তম মনে করে দূর-দূরান্ত থেকে সফর করে আসতে বারণ করা হয়েছে।

     দ্বিতীয়ত: মসজিদে যিক্‌র ও নামাযে বাধা দেয়ার যত পন্থা হতে পারে সে সবগুলোই ‘‘হারাম। তন্মধ্যে ধ্যে একটি প্রকাশ্য পন্থা এই যে, মসজিদে গমন করতে অথবা সেখানে নামায ও তিলাওয়াত করতে পরিস্কার ভাষায় নিষেধাজ্ঞা প্রদান। দ্বিতীয় পন্থা এই যে, মসজিদে হট্টগোল করে অথবা আশে-পাশে গান-বাজনা করে মুসল্লীদের নামায ও যিক্‌রে বিঘ্ন সৃষ্টি করা।

     এমনিভাবে নামাযের সময়ে যখন মুসল্লীরা নফল নামায, তাসবী‘হ, তিলাওয়াত ইত্যাদিতে নিয়োজিত থাকেন, তখন মসজিদে সরবে তিলাওয়াত ও যিক্‌র করা এবং নামাযীদের নামাযে বিঘ্ন সৃষ্টি করাও বাধা প্রাদানেরই নামান্তর। এ কারণেই ফিক্ব্‌হ্‌বিদগণ একে না-জায়েয আখ্যা দিয়েছেন। তবে, মসজিদে যখন মুসল্লী না থাকে, তখন সরবে যিক্‌র অথবা তিলাওয়াত করায় দোষ নেই।

     এ থেকে আরও বোঝা যায় যে, যখন মুসল্লীরা নামায, তাসবী‘হ্‌ ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকে, তখন মসজিদে নিজের জন্যে অথবা কোন ধর্মীয় কাজের জন্যে চাঁদা সংগ্রহ করাও নিষিদ্ধ।

     তৃতীয়ত: মসজিদ জনশূন্য করার জন্য সম্ভবপর যত পন্থা হতে পারে সবই ‘‘হারাম। খোলাখুলিভাবে মসজিদকে বিধ্বস্ত করা ও জনশূন্য করা যেমনি এর অন্তর্ভূক্ত তেমনিভাবে এমন কারণ সৃষ্টি করাও এর অন্তর্ভূক্ত, যার ফলে মসজিদ জনশূন্য হয়ে যায়। মসজিদ জনশূন্য হওয়ার অর্থ এই যে, সেখানে নামায পড়ার জন্যে কেউ আসে না কিংবা নামাযীর সংখ্যা হ্রাস পায়।

     মোটকথা, وَلِلَّهِ الۡمَشۡرِقُ وَالۡمَغۡرِبُۚ  আয়াতটিতে কিবলামুখী হওয়ার পূর্ণ স্বরূপ বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে যে, এর উদ্দেশ্য (না‘ঊযু বিল্লাহ) বাইতুল্লাহ্‌ অথবা বাইতুল-মোকাদ্দাসের পূজা করা নয়, কিংবা এ’দুটি স্থানের সাথে আল্লাহ্‌র পবিত্র সত্তাকে সীমিত করে নেয়াও নয়। তার সত্তা সমগ্র বিশ্বকে বেষ্টন করে রেখেছে এবং সর্বত্রই তার মনোযোগ সমান। এরপরও বিভিন্ন তাৎপর্যের কারণে বিশেষ স্থান অথবা দিককে কিবলা নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

আয়াতের এই বিষয়বস্তুকে সু্স্পষ্ট ও অন্তরে বদ্ধমূল করার উদ্দেশেই সম্ভবত: হুযুরে আকরাম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহ ওয়াসাল্লাম) ও সা‘হাবায়ে-কেরামকে হিজরতের প্রথম ষোল-সতের মাস পর্যন্ত বাইতুল-মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়ার আদেশ দেয়া হয়। এভাবে কার্যতঃ বলে দেয়া হয় যে, আমার মনোযোগ সর্বত্র রয়েছে। নফল নামাযসমূহের এক পর্যায়ে এই নির্দেশ অব্যাহত রাখা হয়েছে। সফরে কোন ব্যক্তি উট, ঘোড়া ইত্যাদি যানবাহনে সওয়ার হয়ে পথ চললে তাকে তদবস্থায় ইশারায় নফল নামায পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। তার জন্য যানবাহন যেদিকে চলে সেদিকে মুখ করাই যথেষ্ট।

কোন কোন মুফাস্সির فَأَيۡنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجۡهُ اللَّهِۚ আয়াতকে এই নফল নামাযেরই  বিধান বলে সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু স্মরণ রাখা দরকার যে, এই বিধান সে সমস্ত যানবাহনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যাতে সওয়ার হয়ে চলার সময় কিবলার দিকে মুখ করা কঠিন। পক্ষান্তরে যেসব যানবাহনে সওয়ার হলে কিবলার দিকে মুখ করা কঠিন নয়, যেমন রেলগাড়ী, মাসুদ্রীক জাহাজ, উড়োজাহাজ ইত্যাদিতে নফল নামাযেও কিবলার দিকেই মুখ করতে হবে। তবে নামাযরত অবস্থায় রেলগাড়ী অথবা জাহাজের দিক পরিবর্তন হয়ে গেলে এবং আরোহীর পক্ষে কিবলার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অবকাশ না থাকলে তদবস্থায়ই নামায পূর্ণ করবে।

     এমনিভাবে কিবলার দিক সম্পর্কে নামাযীর জানা না থাকলে, রাত্রির অন্ধকারে দিক নির্ণয় করা কঠিন হলে এবং বলে দেয়ার লোক না থাকলে সেখানও নামাযী অনুমান করে যেদিকেই মুখ করবে, সেদিকই তার কিবলা বলে গণ্য হবে। নামায আদায় করার পর যদি দিকটি ভ্রান্তও প্রমাণিত হয়, তবুও তার নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে- পূর্ণবার পড়তে হবে না।

     জ্ঞাতব্য: (১) বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য বিশেষ ফেরেশতা নিযুক্ত করা- যেমন, বৃষ্টিবর্ষণ ও রিযিক পৌঁছানো ইত্যাদি কোন না কোন রহস্যের উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন উপকরণ ও শক্তিকে কাজে লাগানোও তেমনি। এর কোনটিই এজন্যে নয় যে, মানুষ এগুলোকে ক্ষমতাশালী স্বীকার করে তাদের কাছে সাহায্য চাইবে।

     (২) ইমাম বায়যাভী বলেনঃ পূর্ববর্তী শরী‘আতসমূহে আদি কারণ হওয়ার দরুন আল্লাহ্‌কে ‘পিতা’ বলা হত। একেই মুর্খেরা জন্মদাতা অর্থে বুঝে নিয়েছে। ফলে এরূপ বিশ্বাস করা অথবা বলা কুফর সাব্যস্ত হয়েছে। অনিষ্টের ছিদ্রপথ বন্ধ করার লক্ষ্যে বর্তমানেও এ জাতীয় শব্দ ব্যবহারের অনুমতি নেই।

     জ্ঞাতব্য: ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা ছিল আসমানী কিতাবের অধিকারী। তাদের মধ্যে শিক্ষিত লোকও ছিল। তা সত্ত্বেও আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাদের মূর্খ বলে অভিহিত করেছেন। এর কারণ এই যে, প্রচুর অকাট্য ও শক্তিশালী নিদর্শন প্রতিষ্ঠিত করা সত্ত্বেও সেগুলো অস্বীকার মুর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ কারণেই আল্লাহ্‌ তাদেরকে মুর্খ বলে অভিহিত করেছেন।

وَلَن تَرۡضَىٰ عَنكَ ٱلۡيَهُودُ وَلَا ٱلنَّصَٰرَىٰ حَتَّىٰ تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمۡۗ قُلۡ إِنَّ هُدَى ٱللَّهِ هُوَ ٱلۡهُدَىٰۗ وَلَئِنِ ٱتَّبَعۡتَ أَهۡوَآءَهُم بَعۡدَ ٱلَّذِي جَآءَكَ مِنَ ٱلۡعِلۡمِ مَا لَكَ مِنَ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٍ ١٢٠

১২০.ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্মের অনুসরণ করেন। বলে দিন, যে পথ আল্লাহ্‌ প্রদর্শন করেন, তাই হল সরল পথ। যদি আপনি তাদের আকাঙ্খাসমূহের অনুসরণ করেন, ঐ জ্ঞান লাভের পর, যা আপনার কাছে পৌঁছেছে, তবে কেউ আল্লাহ্‌র কবল থেকে আপনার উদ্ধারকারী ও সাহায্যকারী নেই।

ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَتۡلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ أُوْلَٰٓئِكَ يُؤۡمِنُونَ بِهِۦۗ وَمَن يَكۡفُرۡ بِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ ١٢١

১২১.আমি যাদেরকে গ্রন্থ দান করেছি, তারা তা যথাযথভাবে পাঠ করে। তারাই তৎপ্রতি বিশ্বাস করে। আর যারা তা অবিশ্বাস করে, তারাই হবে ক্ষতিগ্রস্ত।

يَٰبَنِيٓ إِسۡرَٰٓءِيلَ ٱذۡكُرُواْ نِعۡمَتِيَ ٱلَّتِيٓ أَنۡعَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ وَأَنِّي فَضَّلۡتُكُمۡ عَلَى ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٢٢

১২২.হে বনী-ইসরাঈল! আমার অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যা আমি তোমাদের দিয়েছি। আমি তোমাদেরকে বিশ্বাবাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।

وَٱتَّقُواْ يَوۡمٗا لَّا تَجۡزِي نَفۡسٌ عَن نَّفۡسٖ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يُقۡبَلُ مِنۡهَا عَدۡلٞ وَلَا تَنفَعُهَا شَفَٰعَةٞ وَلَا هُمۡ يُنصَرُونَ ١٢٣

১২৩.তোমরা ভয় কর সেদিনকে, যে দিন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি বিন্দুমাত্র উপকৃত হবে না, কারও কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না, কার ও সুপারিশ ফলপ্রদ হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্ত ও হবে না।

۞وَإِذِ ٱبۡتَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ رَبُّهُۥ بِكَلِمَٰتٖ فَأَتَمَّهُنَّۖ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامٗاۖ قَالَ وَمِن ذُرِّيَّتِيۖ قَالَ لَا يَنَالُ عَهۡدِي ٱلظَّٰلِمِينَ ١٢٤

১২৪.যখন ইব্‌রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও! তিনি বললেন আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না।

وَإِذۡ جَعَلۡنَا ٱلۡبَيۡتَ مَثَابَةٗ لِّلنَّاسِ وَأَمۡنٗا وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ مُصَلّٗىۖ وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ ١٢٥

১২৫.যখন আমি কা’বা গৃহকে মানুষের জন্যে সম্মিলন স্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের জায়গা বানাও এবং আমি ইব্‌রাহীম ও ইসমা‘ঈলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।

وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِ‍ۧمُ رَبِّ ٱجۡعَلۡ هَٰذَا بَلَدًا ءَامِنٗا وَٱرۡزُقۡ أَهۡلَهُۥ مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ مَنۡ ءَامَنَ مِنۡهُم بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ قَالَ وَمَن كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُۥ قَلِيلٗا ثُمَّ أَضۡطَرُّهُۥٓ إِلَىٰ عَذَابِ ٱلنَّارِۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ ١٢٦

১২৬.যখন ইব্‌রাহীম বললেন, পরওয়ারদেগার! এ স্থানকে তুমি শান্তিধান কর এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা অল্লাহ ও কিয়ামতে বিশ্বাস করে, তাদেরকে ফলের দ্বারা রিযিক দান কর। বললেনঃ যারা অবিশ্বাস করে, আমি তাদেরও কিছুদিন ফায়দা ভোগ করার সুযোগ দেব, অতঃপর তাদেরকে বলপ্রয়োগে দোযখের আযাবে ঠেলে দেবো; সেটা নিকৃষ্ট বাসস্থান।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক নবী হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর বিভিন্ন পরীক্ষা, তাতে তার সাফল্য এবং পুরস্কার ও প্রতিদানের বিষয় বর্ণিত হয়েছে। হযরত খলীলুল্লাহ্ যখন স্নেহপরবশ হয়ে স্বীয় সন্তান-সন্ততির জন্যেও এ পুরস্কারের প্রার্থনা জানালেন, তখন পুরস্কার লাভের জন্যে একটি নিয়ম-নীতিও বলে দেয়া হল। এতে হযরত খলীলুল্লাহর প্রার্থনাকে শর্তসাপেক্ষে মঞ্জুর করে বলা হয়েছে যে, আপনার বংশধরগণও এই পুরস্কার পাবে, তবে তাদের মধ্যে যারা অবাধ্য ও যালেম হবে, তারা এ পুরস্কার পাবে না।

হযরত খলীলুল্লাহ্‌র পরীক্ষাসমূহ ও পরীক্ষার বিষয়বস্তু:

     এখানে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য।

     প্রথমত: যোগ্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যেই সাধারণতঃ পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা সর্বজ্ঞ। কারও কোন অবস্থা অথবা গুণ-বৈশিষ্ট্যই তাঁর অজানা নয়। এমতাবস্থায় এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য কি ছিল?

     দ্বিতীয়ত: কি কি বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে?

     তৃতীয়ত: কি ধরনের সাফল্য হয়েছে?

     চতুর্থতঃ কি পুরস্কার দেয়া হল?

     পঞ্চমতঃ পুরস্কারের জন্য নির্ধারিত নিয়ম-পদ্ধতির কিছু ব্যাখ্যা ও বিবরণ। এই পাঁচটি প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর লক্ষ্য করুনঃ

     প্রথমত: পরীক্ষার উদ্দেশ্য কি ছিল? কুরআনের একটি শব্দ ربه (তার পালনকর্তা) এ প্রশ্নের সমাধান করে দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, এ পরীক্ষার পরীক্ষক স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা। আর তাঁর ‘আসমায়ে হুসনার’ (সুন্দর নামসমূহ)-মধ্য থেকে এখানে রব (পালনকর্তা) নামটি ব্যবহার করে রবুবিয়্যাতের (পালনকর্তৃত্বের) দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর অর্থ কোন বস্তুকে ধীরে ধীরে পূর্ণত্বের স্তর পর্যন্ত পৌঁছানো।

     হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর এই পরীক্ষা কোন অপরাধের সাজা হিসেবে কিংবা অজ্ঞাত যোগ্যতা যাচাইয়ের উদ্দ্যেশ্যে ছিল না; বরং এর উদ্দেশ্য ছিল পরীক্ষার মাধ্যমে স্বীয় বন্ধুর লালন করে তাঁকে পূর্ণত্বের স্তর পর্যন্ত পৌঁছানো। অতঃপর আয়াতে কর্মকে পূর্বে এবং কারককে পরে উল্লেখ করে ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর মহত্বকে আরও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

     দ্বিতীয়ত: কি কি বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে? এ সম্পর্কে কুরআন শুধু كلمات (বাক্যসমূহ) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সা‘হাবী ও তাবে‘য়ীদের বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত আছে। কেউ খোদায়ী বিধানসমূহের মধ্য থেকে দশটি, কেউ ত্রিশটি এবং কেউ কমবেশী অন্য বিষয় উল্লেখ করেছেন। বাস্তব ক্ষেত্রে এতে কোন বিরোধ নেই, বরং সবগুলোই ছিল হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহর পরীক্ষার বিষয়বস্তু। প্রখ্যাত তাফসীরকার ইব্‌ন-জারীর ও ইব্‌ন কাসীরের অভিমত তাই।

     আল্লাহ্‌র কাছে সূক্ষ্মদর্শিতার চাইতে চারিত্রিক দৃঢ়তার মূল্য বেশীঃ পরীক্ষার এসব বিষয়বস্তু পাঠশালায় অধীত জ্ঞান-অভিজ্ঞতার যাচাই কিংবা তৎসম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান ছিল না, বরং তা ছিল চারিত্রিক মূল্যবোধ এবং কর্মক্ষেত্রে দৃঢ়তা যাচাই করা। এতে বোঝা যায় যে, আল্লাহ্‌র দরবারে যে বিষয়ের মূল্য বেশী, তা শিক্ষাবিষয়ক সুক্ষ্মদর্শিতা নয়, বরং কার্যগত ও চরিত্রগত শ্রেষ্ঠত্ব। এ ধরনের পরীক্ষার বিষয়বস্তুর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই:

     আল্লাহ্‌ তা‘আলার ইচ্ছা ছিল হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে স্বীয় বন্ধুত্বের বিশেষ মূল্যবান পোশাক উপহার দেয়া। তাই তাঁকে বিভিন্ন রকম কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। সমগ্র জাতি, এমন কি তাঁর আপন পরিবারের সবাই মূর্তি পূজায় লিপ্ত ছিল। সবার বিশ্বাস ও রীতিনীতির বিপরীত একটি সনাতন ধর্ম তাঁকে দেয়া হয়। তিনি নবীসূলভ দৃঢ়তা ও সাহসিকতার মাধ্যমে নির্ভয়ে জাতিকে এক আল্লাহ্‌র দিকে আহবান জানান। বিভিন্ন পন্থায় তিনি মূর্তি পূজার নিন্দা ও কুৎসা প্রচার করেন। প্রকৃতপক্ষে কার্যক্ষেত্রে তিনি মূর্তিসমূহের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন। ফলে সমগ্র জাতি তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্যত হয়। বাদশাহ্ নমরুদ ও তার পরিষদবর্গ তাঁকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহ্‌র খলীল প্রভুর সন্তুষ্টির জন্যে এসব বিপদাপদ সত্ত্বেও হাসিমুখে নিজেকে আগুনে নিক্ষেপের জন্যে পেশ করেন। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় বন্ধুকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দেখে আগুনকে নির্দেশ প্রদান করলেন:

قُلۡنَا يَٰنَارُ كُونِي بَرۡدًا وَسَلَٰمًا عَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِيمَ

অর্থাৎ, আমি হুকুম দিয়ে দিলামঃ হে অগ্নি, ইবরাহীমের উপর সুশীতল ও নিরাপত্তার কারণ হয়ে যাও।

     নমরুদের আগুন সম্পর্কিত এ নির্দেশের মধ্যে ভাষা ছিল ব্যাপক। বস্তুতঃ কোন বিশেষ স্থানে আগুনকে নির্দিষ্ট করে এ নির্দেশ দেয়া হয়নি। এ কারণে সমগ্র বিশ্বে যেখানেই আগুন ছিল, এ নির্দেশ আসা মাত্রই স্ব স্ব স্থানে ঠান্ডা হয়ে গেল। নমরুদের আগুন-এর আওতায় পড়ে শীতল হয়ে গেল।

     কুরআনে بَرْداً (শীতল) শব্দের সাথে سَلٰماً (নিরাপদ) শব্দটি যুক্ত করার কারণ এই যে, কোন বস্তু সীমাতিরিক্ত শীতল হয়ে গেলে তাও বরফের ন্যায় শীতল হয়ে কষ্টদায়ক, বরং মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। سَلٰماً বলা না হলে আগুন বরফের ন্যায় শীতল হয়ে কষ্টদায়কও হয়ে যেতে পারত।

     এ পরীক্ষা সমাপ্ত হলে জন্মভূমি ত্যাগ করে সিরিয়ায় হিজরত করার পর দ্বিতীয় পরীক্ষা নেয়া হয়। ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের আশায় স্বগোত্র ও মাতৃভূমিকেও হাসিমুখে ত্যাগ করে পরিবার- পরিজনসহ সিরিয়ায় হিজরত করলেন।

মাতৃভূমি ও স্বজাতি ত্যাগ করে সিরিয়ায় অবস্থান শুরু করতেই নির্দেশ এল, বিবি হাজেরা (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহা) ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু হযরত ইসমা‘ঈল (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে সঙ্গে নিয়ে এখান থেকেও স্থানান্তরে গমন করুন।– (ইব্‌ন-কাসীর)

     জিবরীল (‘আলাইহিচ্ছালাম) আগমন  করলেন এবং তাঁদের সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে কোন শস্যশ্যামল বনানী আসলেই হযরত খলীল বলতেন, এখানে অবস্থান করানো হোক। জিবরীল (‘আলাইহিচ্ছালাম) বলতেন, এখানে অবস্থানের নির্দেশ নেই- গন্তব্যস্থল সামনে রয়েছে। চলতে চলতে যখন শুষ্ক পাহাড় ও উত্তপ্ত বালুকাময় প্রান্তর এসে গেল (যেখানে ভবিষ্যতে বাইতুল্লাহ্ নির্মাণ ও মক্কা নগরী আবাদ করা লক্ষ্য ছিল), তখন সেখানেই তাঁদের থামিয়ে দেয়া হল। আল্লাহ্‌র বন্ধু স্বীয় পালনকর্তার মহব্বতে মত্ত হয়ে এই জনশূন্য তৃণলতাহীন প্রান্তরেই বসবাস আরম্ভ করলেন। কিন্তু পরীক্ষার এখানেই শেষ হল না। অতঃপর হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) নির্দেশ পেলেন যে, বিবি হাজেরা ও শিশুকে এখানে রেখে নিজে সিরিয়ায় ফিরে যাও। আল্লাহ্‌র বন্ধু নির্দেশ পাওযা মাত্রই তা পালন করতে তৎপর হলেন এবং সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ‘আল্লাহ্‌র নির্দেশ মোতাবেক আমি চলে যাচ্ছি’- বিবিকে এতটুকু কথা বলে যাওয়ার দেরীও তিনি সহ্য করতে পারলেন না। হযরত হাজেরা তাঁকে চলে যেতে দেখে কয়েকবার ডেকে অবশেষে কাতরকন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এ জন-মানবহীন প্রান্তরে আমাদের একা ফেলে রেখে কোথায় যাচ্ছেন? কিন্তু হযরত ইবরাহীম নির্বিকার-কোন উত্তর নেই। অবশ্য হাজেরাও ছিলেন খলিলুল্লাহ্‌রই সহধর্মিনী। ব্যাপার বুঝে ফেললেন। ডেকে বললেন, আপনি কি আল্লাহ্‌র কোন নির্দেশ পেয়েছেন? হযরত ইবরাহীম বললেন, হ্যাঁ! খোদায়ী নির্দেশের কথা জানতে পেরে হাজেরা খুশীমনে বললেন,-যান। যে প্রভু আপনাকে চলে যেতে বলেছেন, তিনি আমাদের ধ্বংস হতে দেবেন না।

অতঃপর হযরত হাজেরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে জন-মানবহীন প্রান্তরে কালাতিপাত করতে থাকেন। এক সময় দারুণ পিপাসা তাঁকে পানির খোঁজে বের হতে বাধ্য করল। তিনি শিশুকে উম্মুক্ত প্রান্তরে রেখে ‘স্বফা’ ও ‘মার্‌ওয়া’ পাহাড়ে বার বার ওঠানামা করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও পানির চিহ্নমাত্র দেখলেন না এবং এমন কোন মানুষ দৃষ্টিগোচর হল না, যার কাছ থেকে কিছু তথ্য জানতে পারেন। সাত বার ছোটাছুটি করার পর তিনি নিরাশ হয়ে শিশুর কাছে ফিরে এলেন। এ ঘটনাকে স্মরণীয় করার উদ্দেশেই ‘স্বফা’ ও ‘মার্‌ওয়া’ পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে সাত বার দৌড়ানো কেয়ামত পর্যন্ত ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে হজ্জ্বের বিধি-বিধানে অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে। হযরত হাজেরা যখন দৌড়াদৌড়ি শেষ করে নিরাশ হয়ে শিশুর কাছে ফিরে এলেন, তখন আল্লাহ্‌র রহমত নাযিল হল। জিবরীল (‘আলাইহিচ্ছালাম) আগমন করলেন এবং শুষ্ক মরুভূমিতে পানির একটি ঝর্ণাধারা বইয়ে দিলেন। বর্তমানে এ ধারার নামই যমযম্। পানির সন্ধান পেয়ে প্রথমে জীব-জন্তু আগমন করল। জীব-জন্তু দেখে মানুষ এসে সেখানে আস্তানা গাড়ল। এভাবে মক্কায় জনপদের ভিত্তি রচিত হয়ে গেল। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় কিছু আসবাবপত্রও সংগৃহীত হল।

     হযরত ইসমা‘ঈল (‘আলাইহিচ্ছালাম) নামে খ্যাত এই সদ্যজাত শিশু লালিত-পালিত হয়ে কাজ-কর্মের উপযুক্ত হয়ে গলেন। হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) আল্লাহ্‌র ইঙ্গিতে মাঝে মাঝে এসে বিবি হাজেরা ও শিশুকে দেখে যেতেন। এ সময় আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় বন্ধুর তৃতীয় পরীক্ষা নিতে চাইলেন। বালক ইসমা‘ঈল অসহায় ও দীন-হীন অবস্থায় বড় হয়েছিলেন এবং পিতার স্নেহ-বাৎসল্য থেকেও বঞ্চিত ছিলেন। এমতাবস্থায় পিতা খোলাখোলি নির্দেশ পেলেনঃ এ ছেলেকে নিজ হাতে জবাই করে দাও। কুরআনে বলা হয়েছে:- ‘বালক যখন পিতার কাজে কিছু সাহায্য করার যোগ্য হয়ে উঠল, তখন ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) তাকে বললেনঃ হে বৎস, আমি স্বপ্নে তোমাকে জবাই করতে দেখেছি। এখন বল, তোমার কি অভিপ্রায়? পিতৃভক্ত বালক আরয করলেনঃ ‘পিতাঃ, আপনি যে আদেশ পেয়েছেন, তা পালন করুন। আপনি আমাকেও ইনশা- আল্লাহ্‌ এ ব্যাপারে ধৈর্যশলী পাবেন।’

     এর পরবর্তী ঘটনা সবাই জ্ঞাত আছেন যে, হযরত খলীল (‘আলাইহিচ্ছালাম) পুত্রকে জবাই করার উদ্দেশ্যে মিনা প্রান্তরে নিয়ে গেলেন। অতঃপর আল্লাহ্‌র আদেশ পালনে নিজের পক্ষ থেকে যা করণীয় ছিল, তা পুরোপুরিই সম্পন্ন করলেন। কিন্তু প্রণিধানযোগ্য যে, এখানে উদ্দেশ্য পুত্রকে জবাই করানো ছিল না, বরং পুত্রবৎসল পিতার পরীক্ষা নেয়া উদ্দেশ্য ছিল। স্বপ্নের ভাষা সম্পর্কে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) স্বপ্নে ‘জবাই করে দিয়েছেন’ দেখেননি, বরং জবাই করছেন অর্থাৎ, জবাই করার কাজটি দেখেছেন। অতঃপর হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) তা’ই বাস্তবে পরিণত করেছিলেন। প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে কাজটি দেখানো হয়েছে। এ কারণেই صَدَّقتَ الرُءْيَا বলা হয়েছে যে, স্বপ্নে যা দেখেছিলেন আপনি তা পূর্ণ করে দিয়েছেন। হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) যখন এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ্ তা‘আলা বেহেশত থেকে এর পরিপুরক নাযিল করে তা কুরবানী করার আদেশ দিলেন। এ রীতিটিই পরে ভবিষ্যতের জন্য একটি চিরন্তর রীতিতে পরিণতি লাভ করে।

     এগুলো ছিল বড়ই কঠিন পরীক্ষা, যার সম্মুখীন হযরত খলীলুল্লাহকে করা হয়। এর সাথে সাথেই আরও অনেকগুলো কাজ এবং বিধি-বিধানের বাধ্যবাধকতাও তাঁর উপর আরোপ করা হল। তন্মধ্যে দশটি কাজ খাসায়েলে ফিতরত (প্রকৃতিসুলভ অনুষ্ঠান) নামে অভিহিত। এগুলো হলো শারীরিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কিত ভবিষ্যত উম্মতের জন্যেও এগুলো স্থায়ী বিধি-বিধানে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ নবী হযরত মু‘হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)- ও তাঁর উম্মতকে এসব বিধি-বিধান পালনের জোর তাকিদ (নিশ্চিত করা) দিয়েছেন।

     ইব্‌ন-কাসীর হযরত ‘আবদুল্লাহ ইব্‌নে ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হ ‘আনহু) থেকে বর্ণিত একটি রেওয়ায়াতে উদ্ধৃত করেছেন। এতে বলা হয়েছে: সমস্ত ইসলাম ত্রিশটি অংশে সীমাবদ্ধ। তন্মধ্যে দশটি সূরা বারা-আতে, দশটি সুরা আ‘হযাবে এবং দশটি সূরা মু’মিনূন এ বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) এগুলো পূর্ণরুপে পালন করেছেন এবং সব পরীক্ষায়ই উত্তীর্ণ হয়েছেন।

সূরা বারা-আতে মু’মিনদের গুণাবলী বর্ণনা প্রসঙ্গে মুসলমানের দশটি বিশেষ লক্ষণ ও গুণ এভাবে বর্ণিত হয়েছ:

     -“তারা হলেন তাওবাকারী, ‘ইবাদাতকারী, প্রশংসাকারী, রোযাদার, রুকু’-সেজদাকারী, সৎকাজের আদেশকারী, অসৎকাজে বাধা-প্রদানকারী, আল্লাহ্‌র নির্ধারিত সীমার হেফাযতকারী-এহেন ঈমানদারদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন।”

সূরা মু’মিনূন এ বর্ণিত দশটি গুণ হল এই:

     “নিশ্চিতরূপেই ঐসব মুসলমান কৃতকার্য, যারা নামাযে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করে, যারা অনর্থক বিষয় থেকে দূরে থাকে, যারা নিয়মিত যাকাত প্রদান করে, যারা স্বীয় লজ্জাস্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করে, কিন্তু আপন স্ত্রী ও যাদের উপর বিধিসম্মত অধিকার রয়েছে তাদের ব্যতীত। কারণ, এ ব্যাপারে তাদের অভিযুক্ত করা হবে না। যারা এদের ছাড়া অন্যকে তালাশ করে, তারাই সীমালঙ্ঘনকারী। যারা স্বীয় আমানত ও অঙ্গীকারের প্রতি লক্ষ্য রাখে, যারা নিয়মানুবর্তিতার সাথে নামায পড়ে, এমন লোকেরাই উত্তরাধিকারী হবে। তারা হবে জান্নাতুল ফিরদাউসের উত্তরাধিকারী। সেখানে তারা অনন্তকাল বাস করবে।”

সূরা আ‘হযাবে বর্ণিত দশটি গুণ হল:

     -“নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী, আনুগত্যশীল পুরুষ ও আনুগত্যশীলা নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদিনী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও দৈর্যশীল নারী, বিনয় অবলম্বনকারী পুরুষ ও বিনয় অবলম্বনকারিনী নারী, খয়রাতকারী (দানশীল) পুরুষ ও খয়রাতকারিনী নারী, রোযাদার পুরুষ ও রোযাদার নাবী, লজ্জাস্থানের রক্ষণা-বেক্ষণকারী পুরুষ ও লজ্জাস্থানের  রক্ষণা-বেক্ষণকারিনী নারী, অধিক পরিমাণে আল্লাহ্‌র যিক্‌রকারী পুরুষ ও যিক্‌রকারিনী নারী -তাদের সবার জন্যে আল্লাহ্‌ তা‘আলা মাগফিরাত (ক্ষমা) ও বিরাট পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন।”

     কুরআনের মুফাসসির হযরত ‘আবদুল্লাহ ইব্‌নে ‘আব্বাসের উপরোদ্ধৃত উক্তির দ্বারা বোঝা গেল যে, মুসলমানদের জন্যে যেসব জ্ঞান এবং কর্মগত ও নৈতিক গুণ অর্জন করা দরকার, তার সবই এ তিনটি সূরার কয়েকটি আয়াতে সন্নিবেশিত হয়েছে। এগুলোই কুরআনোক্ত كلمات যেসব বিষয়ে হযরত খলীলুল্লাহর পরীক্ষা নেয়া ۞وَإِذِ ٱبۡتَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ رَبُّهُۥ بِكَلِمَٰتٖ  আয়াতের ইঙ্গিতও এসব বিষয়ের দিকেই।

এ পর্যন্ত আয়াত সম্পর্কিত পাঁচটি প্রশ্নের মধ্যে দু’টির উত্তর সম্পন্ন হল।

     তৃতীয় প্রশ্ন ছিল এ পরীক্ষায় হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)- এর সাফল্যের প্রকার ও শ্রেণী সম্পর্কে। এর উত্তর এই যে, স্বয়ং কুরআনই বিশেষ ভঙ্গিতে তাঁকে সাফল্যের স্বীকৃতি ও সনদ প্রদান করেছে:

         وَ اِبْرٰهٖمَ الَّذِىْ وَفّٰى আর ইবরাহীম পরীক্ষায় পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। অর্থাৎ, প্রতিটি পরীক্ষায় সম্পূর্ণ ও একশ’ ভাগ সাফল্যের ঘোষণা আল্লাহ্ দিয়েছেন।

     চতুর্থ প্রশ্ন ছিল, এই পরীক্ষার পুরস্কার কি পেলেন?  এরও বর্ণনা এই আয়াতেই রয়েছে- বলা হয়েছে: إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا – পরীক্ষার পর আল্লাহ্ বলেন- “আমি তোমাকে মানব সমাজের নেতৃত্বদান করব।”

     এ আয়াত দ্বারা একদিকে বোঝা গেল যে, হযরত খলীল (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে সাফল্যের প্রতিদানে মানবসমাজের নেতৃত্ব দেয়া হয়েছে, অপরদিকে মানবসমাজের নেতা হওয়ার জন্যে যে পরীক্ষা দরকার, তা পার্থিব পাঠশালা বা বিদ্যালয়ের পরীক্ষার অনুরূপ নয়। পার্থিব পাঠশালাসমূহের পরীক্ষায় কতিপয় বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান ও চুলছেরা বিশ্লেষণকেই সাফল্যের মাপকাঠি বিবেচনা করা হয়। কিন্তু নেতৃত্ব লাভের পরীক্ষায় আয়াতে বর্ণিত ত্রিশটি নৈতিক ও কর্মগত গুণে পুরোপুরি গুণান্বিত হওয়া শর্ত।

কুরআনের অন্য এক জায়গায় এ বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে:

     -“যখন তারা শরী‘আতবিরুদ্ধ কাজে সংযমী হল এবং আমার নিদর্শনাবলীতে বিশ্বাসী হল, তখন আমি তাদেরকে নেতা করে দিলাম, যাতে আমার নির্দেশ অনুযায়ী মানুষকে পথ প্রদর্শন করে।”

     এই আয়াতে صبر (সংযম) ও يقين (বিশ্বাস) শব্দদ্বয়ের মধ্যে পূর্বোক্ত ত্রিশটি গুণ সন্নিবেশিত করে দেয়া হয়েছে। صبر হল শিক্ষাগত ও বিশ্বাসগত পূর্ণতা আর يقين কর্মগত ও নৈতিক পূর্ণতা।

     পঞ্চম প্রশ্ন ছিল এই যে, পাপাচারী ও যালেমকে নেতৃত্বলাভের সম্মান দেয়া হবে না বল ভবিষ্যত বংশধরদের নেতৃত্বলাভের জন্যে যে বিধান ব্যক্ত হয়েছে, তার অর্থ কি?

এর ব্যাখ্যা এই যে, নেতৃত্ব এক দিক দিয়ে আল্লাহ্ তা‘আলার খেলাফত তথা প্রতিনিধিত্ব। আল্লাহ্‌র অবাধ্য ও বিদ্রোহীকে এ পদ দেয়া যায় না। এ কারণেই আল্লাহ্‌র অবাধ্য ও বিদ্রোহীকে স্বেচ্ছায় নেতা বা প্রতিনিধি নিযুক্ত না করা মুসলানদের অবশ্য কর্তব্য।

হযরত খলীলুল্লাহর মক্কায় হিজরত ও কাবা নির্মাণের ঘটনা:

     এই আয়াতে কা’বা গৃহের ইতিহাস, হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমা‘ঈল (‘আলাইহিমাচ্ছালাম) কর্তৃক কা’বা গৃহের পুনঃনির্মাণ, কা’বা ও মক্কার কতিপয় বৈশিষ্ট্য এবং কা’বা গৃহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কিত বিধি-বিধান উল্লেখিত হয়েছে। এ বিষয়টি কুরআনের অনেক সূরায় ছড়িয়ে রয়েছে।

হারাম সম্পর্কিত মাসায়েল:

     (১) مَثَابَةً  শব্দ থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহ্ তা‘আলা কা’বা গৃহকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। ফলে তা সর্বদাই মানবজাতির প্রত্যাবর্তনস্থল হয়ে থাকবে এবং মানুষ বরাবর তার দিকে ফিরে যেতে আকাঙ্খী হবে। মুফাস্‌সির শ্রেষ্ঠ হযরত মুজাহিদ বলেনঃ لايقضى احد منها وطرا অর্থাৎ, কোন মানুষ কা’বা গৃহের যিয়ারত করে তৃপ্ত হয় না, বরং প্রতি বারই যিয়ারতের অধিকতর বাসনা নিয়ে ফিরে আসে। কোন কোন ‘আলেমের মতে কা’বা থেকে ফিরে আসার পর আবার সেখানে যাওয়ার আগ্রহ ‘হজ্ব কবূল হওয়ার অন্যতম লক্ষণ। সাধারণভাবে দেখা যায়, প্রথমবার কা’বাগৃহ যিয়ারত করার যতটুকু আগ্রহ থাকে, দ্বিতীয়বার তা আরও বৃদ্ধি পায় এবং যতবারই যিয়ারত করতে থাকে, এ আগ্রহ উত্তরোত্তর ততই বেড়ে যেতে থাকে।

     এবিস্ময়কর ব্যাপারটি একমাত্র কা’বারই বৈশিষ্ট্য। নতুন জগতের শ্রেষ্ঠতম মনোরম দৃশ্যও এক-দু’বার দেখেই মানুষ পরিতৃপ্ত হয়ে যায়। পাঁচ-সাতবার দেখলে আর দেখার ইচ্ছাই থাকে না। অথচ এখানে না আছে কোন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট, না এখানে পৌঁছা সহজ এবং না আছে ব্যবসায়িক সুবিধা, তা সত্ত্বেও এখানে পৌঁছার আকুল আগ্রহ মানুষের মনে অবিরাম ঢেউ খেলতে থাকে। হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে অপরিসীম দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে এখানে পৌঁছার জন্যে মানুষ ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

     (২) এখানে اَمْنًا শব্দের অর্থ مأمن অর্থাৎ, শান্তির আবাসস্থল بيت শব্দের অর্থ শুধু কা’বা গৃহ নয়, বরং সম্পূর্ণ ‘‘হারাম। অর্থাৎ, কা’বা গৃহের পবিত্র প্রাঙ্গণ। কুরআনে بيت الله ও كعبة শব্দ বলে যে সম্পূর্ণ ‘‘হারামকে বোঝানো হয়েছে, তার আরও বহু প্রমাণ রয়েছে। যেমন, এক জায়গায় বলা হয়েছে: هَدْيًا بٰلِغَ الكَعْبَةِ এখানে كعبة বলে সমগ্র ’হারামকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, এতে ক্বুরবানীর কথা আছে। ক্বুরবানী কা’বা গৃহের অভ্যন্তরে হয় না এবং সেখানে ক্বুরবানী করা বৈধও নয়। কাজেই আয়াতের অর্থ হবে যে, ‘আমি কা’বার ‘‘হারামকে শান্তির আলয় করেছি।’ শান্তির আলয় করার অর্থ মানুষকে নির্দেশ দেয়া যে, এ স্থানকে সাধারণ হত্যা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি অশান্তিজনিত কার্যকলাপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে।– (ইব্‌নে-‘আরাবী)।

     (৩) وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ مُصَلّٗىۖ  এখানে মাক্বামে-ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর পদচিহ্ন অঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। কা’বা নির্মাণের সময়  এ পাথরটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন।–(স‘হীহ্ বুখারী)

     হযরত আনাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেন, আমি এই পাথরে হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর পদচিহ্ন দেখেছি। যিয়ারতকারীদের উপর্যুপুরি স্পর্শের দরুন চিহ্নটি এখন অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে।–(ক্বুরতুবী)

     হযরত ‘আবদুল্লাহ্ ইব্‌নে ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) থেকে মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণিত রয়েছে যে, সমগ্র ‘‘হারামটিই মাক্বামে-ইব্‌রাহীম। এর অর্থ বোধ হয় এই যে, তওয়াফের পর দু’রকা‘আত নামায মাক্বামে-ইব্‌রাহীমে পড়ার নির্দেশ আলোচ্য আয়াতে রয়েছে, তা ‘হারামের যে কোন অংশে পড়লেই চলে। অধিকাংশ শাস্ত্রবিদ এ ব্যাপারে একমত।

     (৪) আলোচ্য আয়াতে মাক্বামে-ইব্‌রাহীমকে নামাযের জায়গা করে নিতে বলা হয়েছে। স্বয়ং রসুলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিদায় ‘হজ্বের সময় কথা ও কর্মের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা  করে দিয়েছেন। তিনি তওয়াফের পর কা’বা গৃহের সম্মুখে অনতিদূরে রক্ষিত মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের কাছে আগমন করলেন এবং এ আয়াতটি পাঠ করলেন وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ مُصَلّٗىۖ   অতঃপর মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের পেছনে এমনভাবে দাঁড়িয়ে দু’রকা‘আত নামায পড়লেন যে, কা’বা ছিল তাঁর সম্মুখে এবং কা’বা ও তাঁর মাঝখানে ছিল মাক্বামে-ইব্‌রাহীম।–(স‘হীহ্ মুসলিম)

     এ কারণেই ফিক্ব্‌হ্‌শাস্ত্রবিদগণ বলেছেনঃ যদি কেউ মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের পেছনে সংলগ্ন স্থানে জায়গা না পায়, তবে মাক্বামে-ইব্‌রাহীম ও কা’বা উভয়টিকে সামনে রেখে যে কোন দূরত্বে দাঁড়িয়ে নামায পড়লে নির্দেশ পালিত হবে।

(৫) আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তওয়াফ পরবর্তী দুই রকা‘আত নামায ওয়াজিব।– (জাসসাস, মোল্লা ‘আলী ক্বারী)

     তবে এ দু’রকা‘আত নামায বিশেষভাবে মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের পেছনে পড়া সুন্নত। ‘হারামের অন্যত্র পড়লেও আদায় হবে। কারণ, রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ দু’রকা‘আত নামায কা’বা গৃহের দরজা সংলগ্ন স্থানে পড়েছেন বলেও প্রমাণিত রয়েছে। হযরত ‘আবদুল্লাহ ইব্‌নে ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্লাহ ‘আনহু)ও তাই করেছেন বলে বর্ণিত আছে (জাসসাস)। মোল্লা ‘আলী ক্বারী মানাসেক গ্রন্থে বলেছেন, এ দু’রকা‘আত মাক্বামে-ইব্‌রাহীমের পেছনে পড়া সুন্নত। যদি কোন কারণে সেখানে পড়তে কেউ অক্ষম হয়, তবে ‘‘হারাম অথবা ‘হারামের বাইরে যে কোনখানে পড়ে নিলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে।

     (৬) وطَهِّرْ بَيۡتِيَ এখানে কা’বা গৃহকে পাক-সাফ করার নির্দেশ বর্ণিত হয়েছে। বাহ্যিক অপবিত্রতা ও আবর্জনা এবং আত্মিক অপবিত্রতা উভয়টিই এর অন্তর্ভূক্ত। যেমন, কুফ্‌র্, শির্‌ক্, দুশ্চরিত্রতা, হিংসা, লালসা, কুপ্রবৃত্তি, অহঙ্কার, রিয়া, নাম-যশ ইত্যাদির কলুষ থেকেও কা’বা গৃহকে পবিত্র রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশে بَيۡتِيَ শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ আদেশ যে কোন মসজিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ, সব মসজিদই আল্লাহ্‌র ঘর। কুরআনে বলা হয়েছে:

فِي بُيُوتٍ أَذِنَ اللَّهُ أَن تُرۡفَعَ

হযরত ফারূকে আ’যম (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) মসজিদে এক ব্যক্তিকে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনে বললেনঃ তুমি কোথায় দাঁড়িয়া আছ, জান না? (কুরতুবী) অর্থাৎ, মসজিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত, এতে উচ্চস্বরে কথা বলা উচিত নয়। মোটকথা, আলোচ্য আয়াতে কা’বা গৃহকে যেমন যাবতীয় বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখতে বলা হয়েছে, তেমনি অন্যান্য মসজিদকেও পাক-পবিত্র রাখতে হবে। দেহ ও পোশাক-পরিচ্ছদকে যাবতীয় অপবিত্রতা ও দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু থেকে পাক-সাফ করে এবং অন্তরকে কুফ্‌র্, শির্‌ক্, দুশ্চরিত্রতা, অহঙ্কার, হিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদি থেকে পবিত্র করে মসজিদে প্রবেশ করা কর্তব্য। রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু খেয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে বারণ করেছেন। তিনি ছোট শিশু এবং পাগলদেরও মসজিদে প্রবেশ করতে বারণ করেছেন। কারণ, তাদের দ্বারা মসজিদ অপবিত্র হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

     (৭) لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ আয়াতের শব্দগুলো থেকে কতিপয় বিধি-বিধান প্রমাণিত হয়। প্রথমত: কা’বা গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্য তওয়াফ, ই’তিকাফ ও নামায। দ্বিতীয়ত: তওয়াফ আগে আর নামায পরে। (হযরত ইব্‌নে ‘আব্বাসের অভিমত তাই)। তৃতীয়ত: বিশ্বের বিভিন্ন কোণ থেকে আগমনকারী ‘‘‘হাজীদের পক্ষে নামাযের চাইতে তওয়াফ উত্তম। চতুর্থত: ফরয হোক অথবা নফল কা’বা গৃহের অভ্যন্তরে যে কোন নামায পড়া বৈধ।–(জাসসাস)

وَإِذۡ يَرۡفَعُ إِبۡرَٰهِ‍ۧمُ ٱلۡقَوَاعِدَ مِنَ ٱلۡبَيۡتِ وَإِسۡمَٰعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ ١٢٧

১২৭.স্মরণ কর, যখন ইব্‌রাহীম ও ইসমা‘ঈল কা’বাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিলঃ পরওয়ারদেগার! আমাদের থেকে ক্ববূল কর। নিশ্চয়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ।

رَبَّنَا وَٱجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَيۡنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةٗ مُّسۡلِمَةٗ لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبۡ عَلَيۡنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١٢٨

১২৮.পরওয়ারদেগার! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ কর এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর, আমাদের হজ্বের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। নিশ্চয় তুমি তাওবাহ্‌ ক্ববূলকারী। দয়ালু।

رَبَّنَا وَٱبۡعَثۡ فِيهِمۡ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُزَكِّيهِمۡۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٢٩

১২৯.হে পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন নবী প্রেরণ করুণ যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও ‘হিকমাহ/‘হিকমাত/হেকমত শিক্ষা দিবেন। এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় তুমিই পরাক্রমশালী ‘হিকমাহ/‘হিকমাত/হেকমতওয়ালা।

وَمَن يَرۡغَبُ عَن مِّلَّةِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ إِلَّا مَن سَفِهَ نَفۡسَهُۥۚ وَلَقَدِ ٱصۡطَفَيۡنَٰهُ فِي ٱلدُّنۡيَاۖ وَإِنَّهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ لَمِنَ ٱلصَّٰلِحِينَ ١٣٠

১৩০.ইব্রাহীমের ধর্ম থেকে কে মুখ ফেরায়? কিন্তু সে ব্যক্তি, যে নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করে। নিশ্চয়ই আমি তাকে পৃথিবীতে মনোনীত করেছি এবং সে পরকালে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।

إِذۡ قَالَ لَهُۥ رَبُّهُۥٓ أَسۡلِمۡۖ قَالَ أَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ١٣١

১৩১.স্মরণ কর, যখন তাকে তার পালনকর্তা বললেনঃ অনুগত হও। সে বললঃ আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম।

وَوَصَّىٰ بِهَآ إِبۡرَٰهِ‍ۧمُ بَنِيهِ وَيَعۡقُوبُ يَٰبَنِيَّ إِنَّ ٱللَّهَ ٱصۡطَفَىٰ لَكُمُ ٱلدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ ١٣٢

১৩২.এরই ওছিয়ত করেছে ইব্‌রাহীম তার সন্তানদের এবং ইয়াকুবও যে, হে আমার সন্তানগণ, নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য এ ধর্মকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলমান না হয়ে কখনও মৃত্যুবরণ করো না।

أَمۡ كُنتُمۡ شُهَدَآءَ إِذۡ حَضَرَ يَعۡقُوبَ ٱلۡمَوۡتُ إِذۡ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعۡبُدُونَ مِنۢ بَعۡدِيۖ قَالُواْ نَعۡبُدُ إِلَٰهَكَ وَإِلَٰهَ ءَابَآئِكَ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ إِلَٰهٗا وَٰحِدٗا وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ ١٣٣

১৩৩.তোমরা কি উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়াকুবের মৃত্যু নিকটবর্তী হয়? যখন সে সন্তানদের বললঃ আমার পর তোমরা কার ‘ইবাদাত করবে? তারা বললো, আমরা তোমার পিতৃ-পুরুষ ইব্‌রাহীম, ইসমা‘ঈল ও ইসহাকের উপাস্যের ‘ইবাদাত করব। তিনি একক উপাস্য।

تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسۡ‍َٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٣٤

১৩৪.আমরা সবাই তাঁর আজ্ঞাবহ। তারা ছিল এক সম্প্রদায়-যারা গত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদেরই জন্যে। তারা কি করত, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না।

আনুসঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

হযরত খলীলুল্লাহ (‘আলাইহিচ্ছালাম) আল্লাহ্‌র পথে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেন। অর্থ-সম্পদ, পরিবা-পরিজন এবং কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহ্‌র আদেশ পালনে তৎপর হওয়ার যেসব কীর্তি তিনি স্থাপন করেছেন, তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ও নজীরবিহীন।

     সন্তানের প্রতি স্নেহ ও মমতা শুধু একটি স্বাভাবিক ও সহজাত বৃত্তিই নয়; বরং এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা‘আলারও নির্দেশ রয়েছে। উল্লেখিত আয়াতসমূহ এর প্রমাণ। তিনি সন্তানদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে আল্লাহ্‌র কাছে দু‘আ করেছেন।

     হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর দু‘আ: رَب শব্দ দ্বারা দু‘আ আরম্ভ করেছেন। এর অর্থ, ‘হে আমার পালনকর্তা।’ তিনি এই শব্দের মাধ্যমে দু‘আ করার রীতি শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ, এ জাতীয় শব্দ আল্লাহ্‌র র‘হমত ও কৃপা আকৃষ্ট করার ব্যাপারে খুবই কার্যকর ও সহায়ক। হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর প্রথম দু‘আ এইঃ “তোমার নির্দেশে আমি এই জনমানবহীন প্রান্তরে নিজ পরিবার-পরিজনকে রেখে যাচ্ছি। তুমি একে একটি শান্তিপূর্ণ শহর বানিয়ে দাও- যাতে এখানে বসবাস করা আতঙ্কজনক না হয় এবং জীবনধারণের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র সহজলভ্যহয়।”

     হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর দ্বিতীয় দু‘আয় বলা হয়েছে: পরওয়ারদেগার! শহরটিকে শান্তিধাম করে দাও। অর্থাৎ, হত্যা, লুন্ঠন, কাফেরদের অধিকার স্থাপন, বিপদাপদ থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখ।

     হযরত ইবরাহীমের এই দু‘আ কবুল হয়েছে। মক্কা মুকাররমা শুধু একটি জনবহুল নগরীই নয়, সারা বিশ্বের প্রত্যাবর্তনস্থলও বটে। বিশ্বের চার দিক থেকে মুসলমানগণ এ নগরীতে পৌঁছাকে সর্ববৃহৎ সৌভাগ্য মনে করে। নিরাপদ ও সুরক্ষিতও এতটুকু হয়েছে যে, আজ পর্যন্ত কোন শত্রুজাতি অথবা শত্রুসম্রাট এর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। ‘আস‘হাবে-ফীলের’ ঘটনা স্বয়ং কুরআনে উল্লেখিত রয়েছে। তারা কা‘বা ঘরের উপর আক্রমণের ইচ্ছা করতেই সমগ্র বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিল।

এ শহরটি হত্যা ও লুটতরাজ থেকেও সর্বদা নিরাপদ রয়েছে। জাহেলিয়াত যুগে ‘আরবরা অগণিত আনাচার, কুফ্‌র ও শির্‌কে লিপ্ত থাকা স্বত্ত্বেও কা‘বা ঘর ও তার পার্শ্ববর্তী ‘হারামের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করত। তারা প্রাণের শত্রুকে হাতে পেয়েও ‘হারামের মধ্যে পালটা হত্যা অথবা প্রতিশোধ গ্রহণ করত না। এমনকি, ‘হারামের অধিবাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের রীতি সমগ্র ‘আরবে প্রচলিত ছিল। এ কারণেই মক্কাবাসীরা বাণিজ্যব্যাপদেশে নির্ভিগ্নে সিরিয়া ও ইয়ামানে যাতায়াত করত। কেউ তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করত না।

     আল্লাহ্ তা‘আলা ‘হারামের চতুঃসীমায় জীব-জন্তুকেও নিরাপত্তা দান করেছেন। এই এলাকায় শিকার করা জায়েয নয়। জীব-জন্তুর মধ্যেও স্বাভাবিক নিরাপত্তাবোধ জাগ্রত করে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা সেখানে শিকারী দেখলেও ভয় পায় না।

     হযরত ইবরাহীমের তৃতীয় দু‘আ এই যে, এ শহরের অধিবাসীদের উপজীবিকা হিসাবে যেন ফল-মূল দান করা হয়। মক্কা-মুকাররমা ও পার্শ্ববর্তী ভূমি কোনরূপ বাগ-বাগিচার উপযোগী ছিল না। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছিল না পানির নাম-নিশানা। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা ইবরাহীমের দু‘আ কবুল করে নিয়ে মক্কার অদূরে ‘তায়েফ’ নামক একটি ভূখণ্ড সৃষ্টি করে দিলেন। তায়েফে যাবতীয় ফলমূল প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয় যা মক্কার বাজারেই বেচা-কেনা হয়।

     হযরত খলীলুল্লাহ্ (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর সাবধানতাঃ আলোচ্য আয়াতে মু’মিন ও কাফের নির্বিশেষে সমগ্র মক্কাবাসীর জন্যে শাস্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের দু‘আ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে এক দু‘আয় যখন হযরত খলীল স্বীয় বংশধরের মুমিন ও কাফের নির্বিশেষে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তখন আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলন যে, মু’মিনদের পক্ষে এ দু‘আ কবুল হলো, জালেম ও মুশরিকদের জন্য নয়। সে দু‘আটি ছিল নেতৃত্ব লাভের দু‘আ। হযরত খলীল (‘আলাইহিচ্ছালাম) ছিলেন আল্লাহ্‌র বন্ধুত্বের মহান মর্যাদার উন্নীত ও খোদাভীতির প্রতীক। তাই এ ক্ষেত্রে সে কথাটি মনে পড়ে গেল এবং তিনি দু‘আর শর্ত যোগ করলেন যে, আর্থিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তির এ দু‘আ শুধু মু’মিনদের জন্য করেছি। আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে এ ভয় ও সাবধানতার মূল্য দিয়ে বলা হয়েছে: وَمَنْ كَفَرَ অর্থাৎ, পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আমি সমস্ত মক্কাবাসীকেই দান করব, যদিও তারা কাফের, মুশরিক হয়। তবে মু’মিনদেরকে ইহকাল ও পরকাল সর্বত্রই তা দান করব, কিন্তু কাফেররা পরকালে শাস্তি ছাড়া আর কিছুই পাবে না।

     স্বীয় সৎকর্মের উপর ভরসা না করা ও তুষ্ট না হওয়ার শিক্ষা: হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) আল্লাহ্‌র নির্দেশে সিরিয়ার সুজলা-সুফলা সুদর্শন ভূখণ্ড ছেড়ে মক্কার বিশুষ্ক পাহাড়সমূহের মাঝখানে স্বীয় পরিবার-পরিজনকে এনে রাখেন এবং কা’বা গৃহের নির্মাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এরূপ ক্ষেত্রে অন্য কোন আত্মত্যাগী সাধকের অন্তরে অহংকার দানা বাঁধতে পারত এবং সে তাঁর ক্রিয়াকর্মকে অনেক মূল্যবান মনে করতে পারত। কিন্তু এখানে ছিলেন আল্লাহ্‌র এমন এক বন্ধু যিনি আল্লাহ্‌র প্রতাপ ও মহিমা সম্পর্কে যথার্থভাবে অবহিত। তিনি জানতেন, আল্লাহ্‌র উপযুক্ত ‘ইবাদত ও আনুগত্য কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে। তাই ‘আমল যত বড়ই হোক সেজন্য অহংকার না করে কেঁদে কেঁদে এমনি দু‘আ করা প্রয়োজন যে, হে পরওয়ারদেগার! আমার এ ‘আমল কবুল হোক। কা’বা গৃহ নির্মাণের ‘আমল প্রসঙ্গে হযরত ইব্‌রাহীম তাই বলেছেন, رَبَّنَا تَقَبَّلۡ مِنَّآۖ  হে পরওয়ারদেগার! আমাদের এ ‘আমল কবুল করুন। কেননা, আপনি শ্রোতা, আপনি সর্বজ্ঞ।

         رَبَّنَا وَاجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَيۡنِ لَكَ  -এ দু‘আটিও হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর আল্লাহ্ সম্পর্কিত জ্ঞান ও খোদাভীতিরই ফল, আনুগত্যের অদ্বিতীয় কীর্তি স্থাপন করার পরও তিনি এরূপ দু‘আ করেন যে, আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ কর। কারণ, মা‘রিফাত তথা আল্লাহ্ সম্পর্কিত জ্ঞান যার যত বৃদ্ধি পেতে থাকে সে ততবেশী অনুভব করতে থাকে যে, যথার্থ আনুগত্য তার দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না।

         وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ -এ দু‘আতেও স্বীয় সন্তান-সন্ততিকে অন্তর্ভূক্ত করেছেন। এতে বোঝা যায় যে, তিনি আল্লাহ্‌র প্রেমিক, আল্লাহ্‌র পথে নিজের সন্তান-সন্ততিকে বিসর্জন দিতেও এতটুকু কুন্ঠিত নন। তিনিও সন্তানদের প্রতি কতটুকু মহব্বত ও ভালবাসা রাখেন। কিন্তু এই ভালবাসার দাবীসমূহ কয়জন পূর্ণ করতে পারে? সাধারণ লোক সন্তানদের শুধু শারীরিক সুস্থতা ও আরামের দিকেই খেয়াল রাখে। তাদের যাবতীয় স্নেহ-মমতা এ দিকটিকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু আল্লাহ্‌র প্রিয় বান্দারা শারীরিকের চাইতে আত্মিক এবং জাগতিকের চাইতে পারলৌকিক আরামের জন্যে চিন্তা করেন অধিক। এ কারণেই হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) দু‘আ করলেনঃ “আমাদের সন্তানদের মধ্য থেকে একটি দলকে পূর্ণ আনুগত্যশীল কর।” সন্তানদের জন্যে এ দু‘আর মধ্যে আরও একটি তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, সমাজে যারা গণ্য মান্য, তাদের সন্তানরা পিতার পথ অনুসরণ করলে সমাজে তাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তাদের যোগ্যতা জনগণের যোগ্যতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।– (বা‘হরে-মু‘হীত্ব)

     হযরত খলীলুল্লাহ (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর এ দু‘আটিও কবুল হয়েছে। তাঁর বংশধরের মধ্যে কখনও সত্যধর্মের অনুসারী ও আল্লাহ্‌র আজ্ঞাবহ আদর্শ পুরুষের অভাব হয়নি। জাহেলিয়্যাত ‘আমলে ‘আরবে যখন সর্বত্র মুর্তিপূজার জয়-জয়কার, তখনও ইবরাহীমের বংশধরের মধ্যে কিছু লোক একত্ববাদ ও পরকালে বিশ্বাসী এবং আল্লাহ্‌র আনুগত্যশীল ছিলেন। যেমন যায়েদ ইব্‌নে ‘আমর, ইব্‌নে নওফল এবং ক্বুস ইব্‌নে সা-‘য়িদাহ প্রমুখ। রসূলুল্লাহ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পিতামহ ‘আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম সম্পর্কেও বর্ণিত আছে যে, মুর্তিপূজার প্রতি তাঁরও অশ্রদ্ধা ছিল।–(বা‘হরে-মু‘হীত্ব)

         يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِكَ  -তিলাওয়াতের আসল অর্থ অনুসরণ করা। কুরআন ও ‘   হাদীসের পরিভাষায় এ শব্দটি কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব পাঠ করার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কারণ, যে লোক এসব কালাম পাঠ করে, এর অনুসরণ করাও তার অবশ্য কর্তব্য। আসমানী গ্রন্থ ঠিক যেভাবে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়, হুবহু তেমনিভাবে পাঠ করা জরুরী। নিজের পক্ষ থেকে তাতে কোন শব্দ অথবা স্বরচিহ্নটিও পরিবর্তন পরিবর্ধন করার অনুমতি নেই। ইমাম রাগেব ইস্পাহানী ‘মুফ্‌রদাতুল-কুরআন’ গ্রন্থে বলেন: “আল্লাহ্‌র কালাম ছাড়া অন্য কোন গ্রন্থ অথবা কালাম পাঠ করাকে সাধারণ পরিভাষায় তিলাওয়াত বলা যায় না।”

         وَيُعَلِّمُهُمُ الۡكِتَٰبَ وَالۡحِكۡمَةَ -এখানে কিতাব বলে আল্লাহ্‌র কিতাব বোঝানো হয়েছে। ‘হিকমাহ/‘হিকমত’ শব্দটি ‘আরবী অভিধানে একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যথা- সত্যে উপনীত হওয়া, ন্যায় ও সুবিচার, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ইত্যাদি।–(ক্বামূস)

     ইমাম রাগেব ইস্পাহানী লেখেনঃ এ শব্দটি আল্লাহ্‌র জন্যে ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয় সকল পূর্ণজ্ঞান এবং সুদৃঢ় উদ্ভাবন। অন্যের জন্যে ব্যবহৃত হলে এর অর্থ হয়, বিদ্যমান বস্তুসমূহের বিশুদ্ধ জ্ঞান এবং সৎকর্ম। বিশুদ্ধ জ্ঞান, সৎকর্ম, ন্যায়, সুবিচার, সত্য কথা ইত্যাদি।– (ক্বামূস ও রাগেব)

     এখন লক্ষ্য করা দরখার যে, আয়াতে ‘হিকমাহা/‘হিকমতের কি অর্থ? তাফসীরকার সা‘হাবীগণ হুযুর আকরাম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছ থেকে শিখে কুরআনের ব্যাখ্যা করতেন। এখানে ‘হিকমাহা/‘হিকমত শব্দের অর্থে তাঁদের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সবগুলোর মর্মই এক। অর্থাৎ, রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহ। ইব্‌নে কাসীর ও ইব্‌নে জারীর ক্বতাদাহ্ থেকে এ ব্যাখ্যাই উদ্ধৃত করেছেন। ‘হিকমাহা/‘হিকমতের অর্থ কেউ কুরআনের তাফসীর, কেউ ধর্মে গভীর জ্ঞান, কেউ শরী‘আতের বিধি-বিধানের জ্ঞান, কেউ এমন বিধি-বিধানের জ্ঞান অর্জন বলেছেন, যা শুধু রসূলুল্লাহ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বর্ণনা থেকেই জানা যায়। নিঃসন্দেহে এসব উক্তির সারমর্ম হল রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহ্।

         وَيُزَكِّيهِمۡۖ  – زكوة শব্দ থেকে উদ্ধৃত। এর অর্থ পবিত্রতা। বাহ্যিক ও আত্মিক সর্বপ্রকার পবিত্রতার অর্থেই এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।

     উপরোক্ত ব্যাখ্যার দ্বারা আয়াতের মর্ম সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) ভবিষ্যত বংশধরদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে দু‘আ করেছেন যে, আমার বংশধরের মধ্যে একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন- যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের তিলাওয়াত করে শোনাবেন, কুরআন ও সুন্নাহ্‌র শিক্ষা দেবেন এবং বাহ্যিক ও আত্মিক অপবিত্রতা থেকে তাদের পবিত্র করবেন। দু‘আয় নিজের বংশধরের মধ্য থেকেই পয়গম্বর হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর কারণ প্রথমত: এতে তাদের কল্যাণও নিহিত রয়েছে। কারণ, স্বগোত্র থেকে পয়গম্বর হলে তাঁর চাল-চলন ও অভ্যাস-আচরণ সম্পর্কে তারা উত্তমরূপে অবগত থাকবে। ধোঁকাবাজি ও প্রবঞ্চনার সম্ভাবনা থাকবে না। হাদীসে বলা হয়েছে: প্রত্যুত্তরে ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে বলে দেয়া হয় যে, আপনার দু‘আ কবূল হয়েছে এবং কাঙ্খিত গয়গম্বরকে শেষ যমানায় প্রেরণ করা হবে।’-(ইবনে-জারীর, ইবনে-কাসীর)

     রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্মের বৈশিষ্ট্য: মুসনাদে-আ‘হমাদ গ্রন্থে উদ্ধৃত এক ‘হাদীস বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ ‘আমি আল্লাহ্‌র কাছে তখনও পয়গাম্বর ছিলাম, যখন আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-ও পয়দা/সৃষ্টি হননি; বরং তাঁর সৃষ্টির জন্য উপাদান তৈরী হচ্ছিল মাত্র। আমি আমার সূচনা বলে দিচ্ছিঃ আমি পিতা হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর দু‘আ, ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর সুসংবাদ স্বীয় জননীর স্বপ্নের প্রতীক। ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর সুসংবাদের অর্থ তাঁর এ উক্তি وَمُبَشِّرَۢا بِرَسُولٍ يَأۡتِي مِنۢ بَعۡدِي اسۡمُهُۥٓ أَحۡمَدُۖ  আমি এমন এক পয়গম্বরের সুসংবাদদাতা, যিনি আমার পরে আসবেন। তাঁর নাম আ‘হমাদ।) তাঁর জননী গর্ভাবস্থায় স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর পেট থেকে একটি নুর বের হয়ে সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ আলোকোজ্জ্বল করে তুলেছে। কুরআনে হুজুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আবির্ভাবের আলোচনা প্রসঙ্গে দু’জায়গায় সূরা আ-লি ‘ইমরানের ১৬৪তম আয়াতে এবং সূরা জুমু‘আয় ইবরাহীমের দু‘আয় উল্লিখিত ভাষারই পুরনাবৃত্তি করা হয়েছে। এভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) যে পয়গম্বরের জন্যে দু‘আ করেছিলেন, তিনি হচ্ছেন হযরত মু‘হাম্মাদ মুস্তফা (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)।

     গয়গম্বর প্রেরণের অর্থ তিনটিঃ সূরা বাক্বরার আলোচ্য আয়াতে এবং সূরা আলি-‘ইমরান ও সূরা জুমু‘আর বিভিন্ন আয়াতে হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে একই বিষয়বস্তু অভিন্ন ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। এসব আয়াতে মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পৃথিবীতে পদার্পণ ও তাঁর রিসালাতের তিনটি লক্ষ্য বর্ণিত হয়েছে। প্রথমত: কুরআন তিলাওয়াত, দ্বিতীয়ত: আসমানী গ্রন্থ ও ‘হিকমাহ/‘হিকমতের শিক্ষাদান এবং তৃতীয়ত: মানুষের চরিত্রশুদ্ধি।

     প্রথম উদ্দেশ্য কুরআন তিলাওয়াত: এখানে সর্বপ্রথম প্রণিধানযোগ্য যে, তিলাওয়াতের সম্পর্ক শব্দের সাথে এবং শিক্ষাদানের সম্পর্ক অর্থের সাথে। তিলাওয়াত ও শিক্ষাদান পৃথক পৃথকভাবে বর্ণিত হওয়ার মর্মার্থ এই যে, কুরআনের অর্থসম্ভার যেমন উদ্দেশ্য, শব্দসম্ভারও তেমনি একটি লক্ষ্য। এসব শব্দের ততিলাওয়াত ও হেফাযত ফরয ও গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদত। এখানে আরও একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, যাঁরা মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রত্যক্ষ শিষ্য ও সম্বোধিত ছিলেন তাঁরা শুধু ‘আরবী ভাষা সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল ছিলেন না, বরং অলংকারপূর্ণ ‘আরবী ভাষার একেকজন বাগ্নী কবিও ছিলেন। তাঁদের সামনে কুরআন পাঠ করাই বাহ্যতঃ তাঁদের শিক্ষাদানের জন্য যথেষ্ট ছিল, পৃথকভাবে অনুবাদ ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল না। এমতাবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতকে পৃথক উদ্দেশ্য এবং গ্রন্থ শিক্ষাদানকে পৃথক উদ্দেশ্য সাব্যস্ত করার কি প্রয়োজন ছিল? অথচ কার্যক্ষেত্রে উভয় উদ্দেশ্যই এক হয়ে যায়। চিন্তা করলে এ থেকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উদ্ভব হয়। প্রথম এই যে, কুরআন অপরাপর গ্রন্থের মত নয়- যাতে শুধু অর্থসম্ভারের উপর ‘আমল করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে এবং শব্দসম্ভার থাকে দ্বিতীয় পর্যায়ে; শব্দে সামান্য পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়ে গেলেও ক্ষতির কারণ মনে হয় না। অর্থ না বুঝে এসব গ্রন্থের শব্দ পাঠ করা একেবারেই নিরর্থক, কিন্তু কুরআন এমন নয়। কুআনের শব্দের সাথে বিশেষ বিশেষ বিধি-বিধান সম্পৃক্ত রয়েছে। ফিক্ব্‌হ্‌শাস্ত্রের মূলনীতিসংক্রান্ত গ্রন্থসমূহে কুরআনের সংজ্ঞা এভাবে هوالنظم والمعنى جميعا বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ, শব্দসম্ভার ও অর্থসম্ভারকে অন্য শব্দ অথবা অন্য ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হলে তাকে কুরআন বলা যাবে না, যদিও বিষয়বস্তু একেবারে নির্ভুল ও ত্রুটিমুক্ত হয়। কুরআনের বিষয়বস্তুকে পরিবর্তিত শব্দের মাধ্যমে কেউ নামাযে পাঠ করলে তার নামায হবে না। এমনিভাবে কুরআন সম্পর্কিত অপরাপর বিধি-বিধানও এর প্রতি প্রযোজ্য হবে না। এ কারণেই ফি্ক্ব্‌হ্‌শাস্ত্রবিদগণ কুরআনের মূল শব্দ বাদ দিয়ে শুধু অনুবাদ লিখতে ও মুদ্রিত করতে নিষেধ করেছেন। সাধারণ পরিভাষায় এ জাতীয় অনুবাদকে ‘উর্দূ কুরআন, বাংলা কুরআন অথবা ইংরেজী কুরআন’ বলা হয়। কারণ, ভাষান্তরিত কুরআন প্রকৃতপক্ষে কুরআন বলে কথিত হওয়ারই যোগ্য নয়।

অর্থ না বুঝে কুআনের শব্দ পাঠ করা নিরর্থক নয়-ছাওয়াবের কাজ:

     একথা বলা কিছুতেই সঙ্গত নয় যে, অর্থ না বুঝে তোতাপাখীর মত শব্দ পাঠ করা অর্থহীন। বিষয়টির প্রতি বিশেষ জোর দেয়ার কারণ এই যে, আজকাল অনেকেই কুরআনকে অন্যান্য গ্রন্থের সাথে তুলনা করে মনে করে যে, অর্থ না বুঝে কোন গ্রন্থের শব্দাবলী পড়া ও পড়ানো বৃথা কালক্ষেপণ বৈ কিছুই নয়। কুরআন সম্পর্কে তাদের  এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ, শব্দ ও অর্থ উভয়টির সমন্বিত আসমানী গ্রন্থের নামই কুরআন। কুরআনের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা এবং তার বিধি-বিধান পালন করা যেমন ফরয ও উচ্চস্তরের ‘ইবাদত, তেমনিভাবে তার শব্দ তিলাওয়াত করাও একটি স্বতন্ত্র ‘ইবাদত ও ছাওয়াবের কাজ।

     দ্বিতীয় উদ্দেশ্য গ্রন্থ শিক্ষাদানঃ রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সা‘হাবায়ে-কেরাম কুরআনের অর্থ সম্পর্কে সমধিক জ্ঞান ছিলেন। কিন্তু উপরোক্ত কারণেই তাঁরা শুধু অর্থ বোঝে ও তা বাস্তবায়ন করাকেই যথেষ্ট মনে করেননি। বোঝা এবং ‘আমল করার জন্যে একবার পড়ে নেয়াই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু তাঁরা সারা জীবন কুরআন তিলাওয়াতকে ‘অন্ধের যষ্টি’ মনে করেছেন। কতক সা‘হাবী দৈনিক একবার কুরআন খতম করতেন, কেউ দু’দিনে এবং কেউ তিন দিনে কুরআন খতমে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রতি সপ্তাহে কুরআন খতম করার রীতি মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। কুরআনের সাত মনযিল এই সাপ্তাহিক তিলাওয়াত রীতিরই চিহ্ন। রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সা‘হাবায়ে-কেরামের এ কার্যধারাই প্রমাণ করে যে, কুরআনের অর্থ বোঝা এবং সে অনুযায়ী ‘আমল করা যেমন ‘ইবাদত, তেমনিভাবে শব্দ তিলাওয়াত করাও স্বতন্ত্র দৃষ্টিতে একটি উচ্চস্তরের ‘ইবাদত এবং বরকত, সৌভাগ্য ও মুক্তির উপায়। এ কারণেই রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)- কর্তব্যসমূহের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াতকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছেন। উদ্দেশ্য এই যে, যে মুসলমান আপাততঃ কুরআনের অর্থ বোঝে না, শব্দের ছাওয়াব থেকেও বঞ্চিত হওয়া তার পক্ষে উচিত নয়। বরং অর্থ বোঝার জন্যে চেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরী, যাতে কুরআনের সত্যিকার নূর/আলো ও বরকত প্রত্যক্ষ করতে পারে এবং কুরআন অবতরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। (মা‘আযাল্ল-হ) কুরআনকে তন্ত্র-মন্ত্র মনে করে শুধু ঝাড়-ফুঁক ব্যবহার করা উচিত নয় বরং ‘আল্লামা ইক্ববালের ভাষায় ‘সুরা ইয়াসীন সম্পর্কে শুধু এরূপ ধারণা করা সঙ্গত নয় যে, এ সূরা পাঠ করলে মরণোন্মুখ ব্যক্তির আত্মা সহজে নির্গত হয়।’

     তৃতীয় উদ্দেশ্য পবিত্রকরণ: মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর তৃতীয় কর্তব্য হচ্ছে পবিত্রকরণ। এর অর্থ বাহ্যিক ও আত্মিক না-পাকী থেকে পবিত্র/অপবিত্র থেকে পবিত্র করা। বাহ্যিক না-পাকী সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানরাও ওয়াকিফহাল/জ্ঞাত। আত্মিক না-পাকী হচ্ছে কুফ্‌র, শির্‌ক্, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপর পুরোপুরি ভরসা করা, অহংকার, হিংসা, শত্রুতা দুনিয়া প্রীতি ইত্যাদি। কুরআন ও সুন্নাহতে এসব বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে। পবিত্রকরণকে রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পৃথক কর্তব্য সাব্যস্ত করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কোন শাস্ত্র পুঁথিগতভাবে শিক্ষা করলেই তার প্রয়োগ ও পূর্ণতা অর্জিত হয় না। প্রয়োগ ও পূর্ণতা অর্জন করতে হলে গুরুজনের শিক্ষাধীনে থেকে তাঁর অনুশীলনের অভ্যাসও গড়ে তুলতে হয়। সূফীবাদে কামেল পীরের দায়িত্বও তাই। তিনি কুরআন ও সুন্নাহ্ থেকে অর্জিত শিক্ষাকে কার্যক্ষেত্রে অনুশীলন করে অভ্যাসে পরিণত করার চেষ্টা করেন।

     হিদায়াত ও সংশোধনের দু’টি ধারা: আল্লাহ্‌র গ্রন্থ ও রসূলঃ এ প্রসঙ্গে আরও দু’টি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। প্রথম এই যে, আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির আদিকাল থেকে শেষ নবী মু‘হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পর্যন্ত মানুষের হিদায়াত ও সংশোধনের জন্য দু’টি ধারা অব্যাহত রেখেছেন। একটি আল্লাহ্‌প্রদত্ত গ্রন্থসমূহের ধারা এবং অপরটি রসূলগণের ধারা। আল্লাহ তা‘আলা শুধু গ্রন্থ নাযিল করাই যেমন যথেষ্ট মনে করেননি, তেমনি শুধু রসূল প্রেরণ করেও ক্ষান্ত হননি। বরং সর্বদা উভয় ধারা অব্যাহত রেখেছেন। এতদুভয় ধারা সমভাবে প্রবর্তন করে আল্লাহ তা‘আলা একটি বিরাট শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তা এই যে, মানুষের নির্ভুল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্যে শুধু গ্রন্থ কিংবা শুধু শিক্ষাই যথেষ্ট নয়; বরং একদিকে আল্লাহপ্রদত্ত হিদায়াত ও আল্লাহপ্রদত্ত সংবিধানেরও প্রয়োজন, যাকে কুরআন বলা হয় এবং অপরদিকে একজন শিক্ষকাগুরুরও প্রয়োজন যিনি স্বীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আল্লাহ্‌প্রদত্ত হিদায়াতে অভ্যস্ত করে তুলবেন। কারণ, মানুষই মানুষের প্রকৃত শিক্ষাগুরু হতে পারে। গ্রন্থ কখনও গুরু বা অভিভাবক হতে পারে না-তবে শিক্ষা-দীক্ষায় সহায়ক অবশ্যই হতে পারে। ইসলামের সূচনা একটি গ্রন্থ ও একজন রসূলের মাধ্যমে হয়েছে। এ দু’য়ের সম্মিলিত শক্তিই জগতে একটি সুষ্ঠু ও উচ্চস্তরের আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনিভাবে ভবিষ্যত বংশধরদের জন্যেও একদিকে পবিত্র শরী‘আত ও অন্যদিকে কৃতী পুরুষগণ রয়েছেন। কুরআনও নানাস্থানে এ সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছ। এক জায়গায় বলা হয়েছে: ‘হে মুমিনগণ, আল্লাহ্‌কে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক।’

     সমগ্র কুরআনের সারমর্ম হল সূরা-ফাতি‘হা। আর সূরা ফাতি‘হার সারমর্ম হল সিরাতে-মুস্তাকীমের হিদায়াত। এখানে স্বিরতে মুস্তাকীমের সন্ধান দিতে গিয়ে কুরআনের পথ, রসূলের পথ অথবা সুন্নাহ্‌র পথ বলার পরিবর্তে কিছু আল্লাহ্‌ভক্তের সন্ধান দেয়া হয়েছে যে, তাদের কাছ থেকে সিরাতে-মুস্তাকীমের সন্ধান জেনে নাও। বলা হয়েছে:

‘সিরাতে-মুস্তাকীম হল তাদের পথ, যাদের প্রতি আল্লাহ্‌র না‘মাত/নি‘আমাহ/নেয়ামত বর্ষিত হয়েছে। তাদের পথ নয়, যারা গযবে ও গোমরাহ।’ অন্য এক জায়গায় না‘মাত/নি‘আমাহ/নেয়ামত প্রাপ্তদের আরও ব্যাখ্যা করা হয়েছে:

فَأُوْلَٰٓئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنۡعَمَ اللَّهُ عَلَيۡهِم مِّنَ النَّبِيِّ‍ۧنَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَآءِ وَالصَّٰلِحِينَۚ

-এমনিভাবে রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-ও পরবর্তীকালের জন্যে কিছু সংখ্যক লোকের নাম নির্দিষ্ট করে তাদের অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিরমিযীর রিওয়ায়াতে বলা হয়েছে:

     -‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদের জন্যে দু’টি বস্তু ছেড়ে যাচ্ছি। এতদুভয়কে শক্তভাবে আঁকড়ে থাকলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। একটি আল্লাহ্‌র কিতাব এবং অপরটি আমার সন্তান ও পরিবার-পরিজন। স্ব‘হীহ্ বুখারীতে বর্ণিত ‘হাদীসে রয়েছেঃ ‘আমার পরে তোমরা আবূ বাক্‌র ও ‘ওমারের অনুসরণ করবে।’ অন্য এক ‘হাদীসে আছে, ‘আমার সুন্নাহ/সুন্নত ও খুলাফায়ে-রাশেদীনের সুন্নাহ/সুন্নত অবলম্বন করা তোমাদের কর্তব্য।

     মোটকথা, কুরআনের উপরোক্ত নির্দেশ ও রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শিক্ষা থেকে একথা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মানুষের হিদায়াতের জন্যে সর্বকালেই দু’টি বস্তু অপরিহার্য।

     (১) কুরআনের হিদায়াত এবং-

     (২) তা হৃদয়ঙ্গম করার উদ্দেশ্যে ও আমলের যোগ্যতা অর্জনের জন্যে শরী‘আত-বিশেষজ্ঞ ও আল্লাহ-ভক্তদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের এ রীতি শুধু ধর্মীয় শিক্ষার বেলাতেই প্রযোজ্য নয়; বরং যে কোন বিদ্যা ও শাস্ত্র নিখুঁতভাবে অর্জন করতে হলে এ রীতি অপরিহার্য। একদিকে শাস্ত্রসম্বন্ধীয় উৎকৃষ্ট গ্রন্থাদি থাকতে হবে এবং অন্যদিকে থাকতে হবে শাস্ত্রবিদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। প্রত্যেক শাস্ত্রের উন্নতি ও পূর্ণতার এ দু’টি অবলম্বন থেকে উপকার লাভের ক্ষেত্রে বহু মানুষ ভূল পন্থার আশ্রয় নেয়। ফলে উপকারের পরিবর্তে অপকার এবং মঙ্গলের পরিবর্তে অমঙ্গলই ঘটে বেশী।

     কেউ কেউ কুরআনের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে শুধু ‘উলামা ও মাশায়েখকেই সবকিছু মনে করে বসে। তারা শরী‘আতের অনুসারী কি না, তারও খোঁজ নেয় না। এ রোগটি আসলে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের থেকেই সংক্রামিত হয়েছে। কুরআন বলে: اتخذوا أحبارهم ورهبانهم اربابامن دون الله অর্থাৎ, ‘তারা আল্লাহ্‌কে ছেড়ে তাদের ‘উলামা ও মাশায়েখকে স্বীয় উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে।’ এটা নিঃসন্দেহে শির্‌ক ও কুফরের রাস্তা। লক্ষ লক্ষ মানুষ এ রাস্তায় বের হয়েছে এবং হচ্ছে। পক্ষান্তরে এমন কিছু লোক রয়েছে; যারা কুরআন ও ‘হাদীসের শিক্ষা অর্জনের জন্য কোন উস্তায/ওস্তাদ ও অভিভাবকের প্রয়োজনই মনে করে না। তারা বলে: ‘আল্লাহ্‌র কিতাব কুরআনই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’ এটাও আরেক পথভ্রষ্টতা। এর ফল হচ্ছে ধর্মচ্যুত হয়ে মানবীয় প্রবৃত্তির শিকারে পরিণত হওয়া। কেননা, বিশেষজ্ঞদের সাহায্য ব্যতিরেকে শাস্ত্র অর্জন মানুষের স্বাভাববিরুদ্ধ কাজ। এরূপ ব্যক্তি অবশ্যই ভূল বোঝাবুঝির শিকারে পরিণত হয়। এ ভূল বোঝাবুঝি কোন কোন সময় তাকে ধর্মচ্যুতও করে দেয়।

     কুরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে: إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا الذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ অর্থাৎ, ‘আমিই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর হেফাযত করব।’

     এ ওয়াদার ফলেই কুরআনের প্রতিটি যের ও যবর পর্যন্ত সম্পূর্ণ সংরক্ষিত রয়েছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। সুন্নাহ্‌র ভাষা যদিও এভাবে সংরক্ষিত নয়, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে সুন্নাহ্‌ এবং ‘হাদীসেরও সংরক্ষিত হওয়া উল্লেখিত আয়াতদৃষ্টে অপরিহার্য। বাস্তবে সুন্নাহ্‌ এবং ‘হাদীসও সংরক্ষিত রয়েছে। যখনই কোন পক্ষ থেকে এতে কোন বাধা সৃষ্টি অথবা মিথ্যা রিওয়ায়াত সংমিশ্রিত করা হয়েছে, তখনই ‘হাদীস বিশেষজ্ঞরা এগিয়ে এসেছেন এবং দুধ ও পানিকে পৃথক করে দিয়েছেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ কর্মধারা অব্যাহত থাকবে। রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আমার উম্মতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সত্যপন্থী এমন একদল ‘আলিম থাকবেন, যারা কুরআন ও ‘হাদীসকে বিশুদ্ধ অবস্থায় সংরক্ষিত রাখবেন এবং সকল বাধা-বিপত্তির অবসান ঘটাবেন।

     মোটকথা, কুরআন বাস্তবায়নের জন্যে রসূলের শিক্ষা অপরিহার্য। কুরআনের বাস্তবায়ন ক্বিয়ামত পর্যন্ত ফরয। কাজেই রসুলের শিক্ষাও ক্বিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকা অবশ্যম্ভাবী। অতএব, উল্লেখিত আয়াতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত রসুলের শিক্ষা সংরক্ষিত হওয়ারও ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সা‘হাবায়ে কেরামের ‘আমল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত একে ‘হাদীস বিশারদ ‘উলামা ও বিশুদ্ধ গ্রন্থাদির মাধ্যমে সংরক্ষিত রেখেছেন। সম্প্রতিককালে কিছু লোক ইসলামী বিধি-বিধান থেকে গা বাঁচানোর উদ্দেশে একটি অজুহাত আবিস্কার করেছে যে, ‘হাদীসের বর্তমান ভাণ্ডার সংরক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য নয়। উপরোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে তাদের ধর্মদ্রোহিতার স্বরূপই ফুটে উঠেছে। তাদের বোঝা উচিত যে, ‘হাদীসের ভাণ্ডার থেকে আস্থা উঠে গেলে কুরআনের উপরও আস্থা রাখার উপায় থাকে না।

     সংশোধনের নিমিত্ত বিশুদ্ধ শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, চারিত্রিক প্রশিক্ষণও আবশ্যক: পবিত্রকরণকে একটি স্বতন্ত্র কর্তব্য সাব্যস্ত করার মধ্যে ইঙ্গিত দান করা হয়েছে যে, শিক্ষা যতই বিশুদ্ধ হোক না কেন, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুরুব্বীর অধীন কার্যতঃ প্রশিক্ষণ লাভ না করা পর্যন্ত শুধু শিক্ষা দ্বারাই চরিত্র সংশোধিত হয় না। কারণ, শিক্ষার কাজ হল প্রকৃতপক্ষে সরল ও নির্ভূল পথ প্রদর্শন। এ কথা সুস্পষ্ট যে, পথ জানা থাকাই গন্তব্যস্থলে পৌঁছার জন্যে যথেষ্ট নয়। এ জন্যে সাহস করে পা বাড়াতে হবে এবং চলতেও হবে। সাহসী বুযুর্গদের সংসর্গ ও আনুগত্য ছাড়া সাহস অর্জিত হয় না। যে সব সৌভাগ্যবান ব্যক্তি রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সামনে শিক্ষা অর্জন করেছেন, শিক্ষার সাথে সাথে তাঁদের আত্মিক পরিশুদ্ধিও সম্পন্ন হয়েছে। এভাবে তাঁর প্রশিক্ষণাধীনে ‘সাহাবিগণের যে একটি দল তৈরী হয়েছিল, একদিকে তাঁদের জ্ঞান-বুদ্ধির গভীরতা ছিল বিষ্ময়কর; বিশ্বের দর্শন তাঁদের সামনে হার মেনেছিল এবং অন্যদিকে তাঁদের আত্মিক পবিত্রতা, আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক এবং আল্লাহ্‌র উপর ভরসাও ছিল অভাবনীয়। স্বয়ং কুরআন তাদের প্রশংসায় বলে: ‘যারা পয়গম্বরের সঙ্গে রয়েছে, তারা কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং পরস্পর সদয়। তুমি তাদের রুকু’-সিজদা করতে দেখবে। তারা আল্লাহ্‌র কৃপা ও সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে।’

     এ কারণেই তাঁরা যে দিকে পা বাড়াতেন, সাফল্য ও কৃতকার্যতা তাঁদের পদচুম্বন করত এবং আল্লাহ্‌র সাহায্য ও সমর্থন তাঁদের সাথে থাকত। তাঁদের বিস্ময়কর কীর্তিসমূহ আজও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার মস্তিষ্ককে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। বলাবাহুল্য, এগুলো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণেরই ফল। বর্তমান পৃথিবীতে শিক্ষার মনোন্নয়নের লক্ষ্যে পাঠ্যসুচী পরিবর্তনের চিন্তা সবাই করেন। কিন্তু শিক্ষার প্রাণ সংশোধনের দিক মোটেই মনোযোগ দেয়া হয় না। অর্থাৎ, শিক্ষক ও শিক্ষাগুরুর চারিত্রিক সংশোধন এবং সংস্কারক সুলভ প্রশিক্ষণের উপর জোর দেয়া হয় না। ফলে হাজারো চেষ্টাযত্নের পরও এমন কৃতী পুরুষের সৃষ্টি হয় না, যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও বলিষ্ঠতা অন্যের উপরও প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং অন্যকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে।

     একথা অনস্বীকার্য যে, শিক্ষকবর্গ যে ধরণের জ্ঞানগরিমা ও চরিত্রের অধিকারী হবেন, তাদের শিক্ষাধীন ছাত্রসমাজও বেশীর চেয়ে বেশী তাদের মতই হতে পারবে। একারণে শিক্ষাকে কল্যাণকর ও উন্নত করতে হলে পাঠ্যসূচীর পরিবর্তন-পরিবর্ধনের চাইতে শিক্ষকদের শিক্ষাগত, কর্মগত ও চরিত্রগত অবস্থার প্রতি অধিক নজর দেয়া আবশ্যক।

     এ পর্যন্ত নবুওয়াত ও রিসালাতের তিনটি উদ্দেশ্য বর্ণিত হল। পরিশেষে সংক্ষেপে আরও জানা প্রয়োজন যে, রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর অর্পিত তিনটি কর্তব্য তিনি কতদূর বাস্তবায়িত করেছেন; এ ব্যাপারে তাঁর সাফল্য কতটুকু হয়েছে? এর জন্য এতটুকু জানাই যথেষ্ট যে, তাঁর তিরোধানের সময় সমগ্র ‘আরব উপত্যকার ঘরে ঘরে কুরআন তিলাওয়াত হত। হাজার হাজার ‘হাফেযে কুরআন ছিলেন। শত শত লোক দৈনিক অথবা প্রতি তৃতীয় দিনে কুরআন খতম করতেন। কুরআন ও ‘হিকমাহ/‘হিকমত শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল।

     বিশ্বের সমগ্র দর্শন কুরআনের সামনে নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল। তাওরাত ও ইঞ্জীলের বিকৃত সংকলনসমূহ গল্প-কাহিনীতে পর্যবসিত হয়েছিল, কিন্তু কুরআনের নীতিমালাকে সম্মান ও শিষ্টাচারের মানদন্ড গণ্য করা হত। অপরদিকে ‘তাযকিয়া’ তথা পবিত্রকরণও চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। এককালের দুশ্চরিত্র ব্যক্তিরাও চরিত্র-দর্শনের শ্রেষ্ঠ গুরুর আসনে আসীন হয়েছিলেন। চরিত্রহীনতার রোগীরা শুধু রোগমুক্তই হয়নি, সফল চিকিসৎকের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিল। যারা দস্যু ছিল তারা পথপ্রদর্শক হয়ে গেল। মুর্তিপূজারীরা মূর্তমান ত্যাগ ও সহানুভূতি হয়ে গিয়েছিল। কঠোরতা ও যুদ্ধলিপ্সার স্থলে নম্রতা ও পারস্পরিক শান্তি বিরাজমান ছিল। এক সময় ডাকাতিই যাদের পেশা ছিল, তারাই মানুষের ধন-সম্পদের রক্ষকে পরিণত হয়েছিল।

     মোটকথা, হযরত খলীলুল্লাহ (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর দু‘আর ফলে যে তিনটি কর্তব্য রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর অর্পিত হয়েছিল, তাতে তিনি স্বীয় জীবদ্দশায়ই পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর তিরোধানের পর তাঁর সহচরগণ এগুলোকে পূর্ব থেকে পশ্চিম, দক্ষিণ থেকে উত্তরে তথা সারা বিশ্বে সম্প্রসারিত করে গিয়েছিলেন।

     আলোচ্য আয়াতসমূহে সন্তানদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণের প্রতি পয়গম্বরগণের বিশেষ মনোযোগের কথা বর্ণিত হয়েছে। প্রথমত: আয়াতে ইবরাহিমী দ্বীনের শ্রেষ্ঠত্ব এবং এর দৌলতেই ইহকাল ও পরকালে ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর সম্মান লাভের কথা বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি এ ধর্ম থেকে বিমুখ হয়, সে নির্বোধদের স্বর্গে বাস করে।

         وَمَن يَرۡغَبُ عَن مِّلَّةِ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ إِلَّا مَن سَفِهَ نَفۡسَهُۥ অর্থাৎ, ইবরাহিমী ধর্ম থেকে সে ব্যক্তিই মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে, যার বিন্দুমাত্রও বোধশক্তি নেই। কারণ, এ ধর্মটি হুবহু স্বভাব-ধর্ম। কোন সুস্থস্বভাব ব্যক্তি এ ধর্মকে অস্বীকার করতে পারে না। পরবর্তী আয়াতে এর কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। এতেই এ ধর্মের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব বোঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা এ ধর্মের দৌলতেই হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-কে ইহকালে সম্মান ও মাহাত্ম্য দান করেছেন এবং পরকালেও। ইহলৌকিক সম্মান ও মাহাত্ম্য সারা বিশ্বই প্রত্যক্ষ করেছে। নমরুদের মত পরাক্রমশালী সম্রাট ও তার পারিষদবর্গ একা এই মহাপুরুষের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, ক্ষমতার যাবতীয় কলা-কৌশল তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছে এবং সর্বশেষ ভয়াবহ অগ্নিকুন্ডে তাঁকে নিক্ষেপ করেছে, কিন্তু জগতের যাবতীয় উপাদান ও শক্তি যে অসীম ক্ষমতাবানের আজ্ঞাধীন, তিনি নমরুদের সমস্ত পরিকল্পনাকে ধুলিস্মাৎ করে দিলেন। আল্লাহ তা‘আলা প্রচণ্ড আগুনকেও তাঁর বন্ধুর জন্যে পুষ্পোদ্যানে পরিণত করে দিলেন। ফলে বিশ্বের সমগ্র জাতি তাঁর অপরিসীম মাহাত্মের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হল। বিশ্বের সমস্ত মুমিন ও কাফির, এমনকি পৌত্তলিকেরাও এ মুর্তিসংহারকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। ‘আরবের মুশরিকরা আর যাই হোক, হযরত ইবরাহীমেরই সন্তান-সন্ততি ছিল। এ কারণে মুর্তিপূজা স্বত্ত্বেও হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর সম্মান ও মাহাত্ম্য মনে-প্রাণে স্বীকার করত এবং তাঁরই ধর্ম অনুসরণের দাবী করত। ইবরাহীমী ধর্মের কিছু অস্পষ্ট চিহ্ন তাদের কাজে-কর্মেও বিদ্যমান ছিল। ‘হজ্ব, ‘উমরা, কুরবানী ও অতিথি পরায়ণতা এ ধর্মেরই নিদর্শন। তবে তাদের মুর্খতার কারণে এগুলো বিকৃত হয়ে পড়েছিল।

     বলাবাহুল্য, এটা ঐ নি‘আমাহ/না‘মাত/নেয়ামতেরই ফলশ্রুতি-যার দরুন খলীলুল্লাহকে (‘আলাইহচ্ছালাম)- ‘মানব নেতা’ উপাধি দেয়া হয়েছিলঃ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًاۖ

     ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) ও তাঁর ধর্মের  অপ্রতিরোধ্য প্রাধান্য ছাড়াও এ ধর্মের জনপ্রিয়তা ও স্বভাবধর্ম হওয়ার বিষয়টি সারা দুনিয়ার সামনে প্রতিভাত হয়ে গেছে। ফলে যার মধ্যে এতটুকুও বোধশক্তি ছিল, সে এ ধর্মের সামনে মাথা নত করেছিল। এই ছিল ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর ইহলৌকিক সম্মান ও মাহাত্ম্যের বর্ণনা। পারলৌকিক ব্যাপারটি আমাদের সামনে উপস্থিত নেই, কিন্তু ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর মর্যাদা কুরআনের সে আয়াতেই ফুটে উঠেছে, যাতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা ইহকালে তাঁকে যেমন সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তেমনি পরকালেও তাঁর উচ্চাসন নির্ধারিত রয়েছে।

     ইবরাহিমী ধর্মের মৌলনীতি আল্লাহ্‌র আনুগত্য শুধু মাত্র ইসলামেই সীমাবদ্ধঃ অতঃপর দ্বিতীয় আয়াতে ইবরাহিমী ধর্মের ইবরাহিমী মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে:

إِذۡ قَالَ لَهُۥ رَبُّهُۥٓ أَسۡلِمۡۖ قَالَ أَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ الۡعَٰلَمِينَ

অর্থাৎ, ইব্‌রাহীমকে (‘আলাইহিচ্ছালাম) যখন তাঁর পালকর্তা বললেনঃ আনুগত্য অবলম্বন কর, তখন তিনি বললেনঃ ‘আমি বিশ্বপালকের আনুগত্য অবলম্বন করলাম।’ এ বর্ণনা-ভঙ্গিতে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহ তা‘আলার (أَسۡلِمۡۖ আনুগত্য অবলম্বন কর।) সম্মোধনের উত্তরে সম্মোধনেরই ভঙ্গিতে اسلمت لك (আমি আপনার আনুগত্য অবলম্বন করলাম।) বলা যেত, কিন্তু হযরত খলীল (‘আলাইহিচ্ছালাম) এ ভঙ্গি ত্যাগ করে বলেছেন, أَسۡلَمۡتُ لِرَبِّ الۡعَٰلَمِينَ  অর্থাৎ, আমি বিশ্বপালকের আনুগত্য অবলম্বন করলাম। কারণ প্রথমত: এতে শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ্য রেখে আল্লাহ্‌র স্থানোপযোগী গুণকীর্তনও করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত: এ বিষয়টিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, আমি আনুগত্য অবলম্বন করে কারো প্রতি অনুগ্রহ করিনি; বরং এমন করাই ছিল আমার জন্য অপরিহার্য। কারণ, তিনি রব্বুল ‘আলামীন তথা সারা জাহানের পালনকর্তা। তাঁর আনুগত্য না করে বিশ্ব তথা বিশ্ববাসীর কোনই গত্যন্তর নেই। যে আনুগত্য অবলম্বন করে, সে স্বীয় কর্তব্য পালন করে লাভবান হয়। এতে আরও জানা যায় যে, ইবরাহিমী ধর্মের মৌলনীতির যথার্থ স্বরূপ ও এক ‘ইসলাম’ শব্দের মধ্যেই নিহিত-যার অর্থ আল্লাহ্‌র আনুগত্য। ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর ধর্মের সারমর্মও তাই। ঐসব পরীক্ষার সারমর্মও তাই, যাতে উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহ্‌র এ দোস্ত মর্যাদার উচ্চস্তর শিখরে পৌঁছেছন। ইসলাম তথা আল্লাহ্‌র আনুগত্যের খাতিরেই সমগ্র সৃষ্টি। এরই জন্যে পয়গম্বরগণ প্রেরিত হয়েছিলেন এবং আসমানী গ্রন্থসমূহ নাযিল করা হয়েছে। এতে আরও বোঝা যায় যে, ইসলামই সমস্ত পয়গম্বরের অভিন্ন ধর্ম এবং ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু। হযরত আদম (‘আলাইহিচ্ছালাম) থেকে শুরু করে শেষ নবী সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত আগমনকারী সমস্ত রসুল ইসলামের দিকেই মানুষকে আহবান করেছেন এবং তাঁরা এরই ভিত্তিতে নিজ নিজ উম্মতকে পরিচালনা করেছেন। কুরআন স্পষ্টভাষায় বলেছে:

اِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الاِسْلاَم ………..

وَمَنْ يَّبْتَغِ غَيْرَ الْاِسْلاَمِ دِيْنًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ ………..

‘ইসলামই আল্লাহ্‌র মনোনীত ধর্ম। যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম অন্বেষণ করে, তা কখনও কবুল করা হবে না।’

     জগতে পয়গম্বরগণ যত ধর্ম এনেছেন, নিজ নিজ সময়ে সে সবই আল্লাহ্‌র কাছে মকবুল ছিল। সুতরাং নিঃসন্দেহে সেসব ধর্মও ছিল ইসলাম-যদিও সেগুলো বিভিন্ন নামে অভিহিত হতো। যেমন, মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর ধর্ম, ‘ঈসা (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর ধর্ম, তথা ইহুদী ধর্ম, খ্রীষ্টান ধর্ম ইত্যাদি। কিন্তু সবগুলোর স্বরূপ ছিল ইসলাম, যার মর্ম আল্লাহ্‌র আনুগত্য। তবে এ ব্যাপারে ইবরাহিমী ধর্মের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি নিজ ধর্মের নাম ‘ইসলাম’ রেখেছিলেন এবং স্বীয় উম্মতকে ‘উম্মতে-মুসলিমাহ’ নামে অভিহিত করেছিলেন। তিনি দু‘আ প্রসঙ্গে বলেছিলেন:

رَبَّنَا وَاجۡعَلۡنَا مُسۡلِمَيۡنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَآ أُمَّةٗ مُّسۡلِمَةٗ لَّكَ

অর্থাৎ, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের উভয়কে (ইব্‌রাহীম ও ইসমা‘ঈলকে) মুসলিম (অর্থাৎ, আনুগত্যশীল) কর এবং আমাদের বংশধর থেকেও এক দলকে আনুগত্যকারী কর।’ হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম) তাঁর সন্তানদের প্রতি ওসীয়ত প্রসঙ্গে বলেছেন:

فَلاَ تَمُوْتُنَّ اِلاَّ وَاَنْتُم   ْ مُسْلِمُوْنَ ‘তোমরা মুসলমান হওয়া ছাড়া অন্য ধর্মের উপর মৃত্যুবরণ করোনা।’

     হযরত ইব্‌রাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর পর তাঁরই প্রস্তাবক্রমে মু‘হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উম্মত এ বিশেষ নাম লাভ করেছে। ফলে এ উম্মতের নাম হয়েছে ‘মুসলমান’। এ উম্মতের ধর্মও ‘মিল্লাতে-ইসলামিয়্যাহ নামে অভিহিত।

     কুরআনে বলা হয়েছে: مِّلَّةَ أَبِيكُمۡ إِبۡرَٰهِيمَۚ هُوَ سَمَّىٰكُمُ الۡمُسۡلِمِينَ مِن قَبۡلُ وَفِي هَٰذَا

‘-এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীমের ধর্ম। তিনিই ইতিপূর্বে তোমাদের ‘মুসলমান’ নামকরণ করেছেন এবং এতেও (অর্থাৎ, কুরআনেও) এ নামই রাখা হয়েছে।’

     ধর্মের কথা বলতে গিয়ে ইহুদী, খ্রীষ্টান এবং ‘আরবের মুশরিকরাও বলে যে, তারা ইবরাহিমী ধর্মের অনুসারী, কিন্তু এসব তাদের ভূল ধারণা অথবা মিথ্যা দাবী মাত্র। বাস্তবে মু‘হাম্মদী ধর্মই শেষ যমানায় ইবরাহিমী ধর্ম তথা স্বভাব-ধর্মের অনুরূপ।

     মোটকথা, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যত পয়গম্বর আগমন করেছেন এবং যত আসমানী গ্রন্থ ও শরী‘আত অবতীর্ণ হয়েছে, সে সবগুলোর প্রাণ হচ্ছে ইসলাম তথা, আল্লাহ্‌র আনুগত্য। এ আনুগত্যের সারমর্ম হল রিপুর কামনা-বাসনার বিপরীতে আল্লাহ্‌র নির্দেশের আনুগত্য এবং স্বেচ্ছাচারিতার অনুসরণ ত্যাগ করে হিদায়াতের অনুসরণ।

     পরিতাপের বিষয়, আজ ইসলামের নাম উচ্চারণকারী লক্ষ লক্ষ মুসলমান এ সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা ধর্মের নামেও স্বীয় কামনা-বাসনারই অনুসরণ করতে চায়। কুরআন ও ‘হাদীসের এমন ব্যাখ্যাই তাদের কাছে পছন্দ, যা তাদের কামনা-বাসনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তারা শরী‘আতের পরিচ্ছদকে টেনে ছিন্ন-বিছিন্ন করে নিজেদের কামনার মূর্তিতে পরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে-যাতে বাহ্যদৃষ্টিতে শরী‘আতেরই অনুসরণ করছে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কামনারই অনুসরণ।

     অলস/গাফেলরা জানে না যে, এসব অপকৌশল ও অপব্যাখ্যার দ্বারা সৃষ্টিকে প্রতারিত করা গেলেও স্রষ্টাকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব নয়; তাঁর জ্ঞান প্রতিটি অণু-পরমাণুতে পরিব্যাপ্ত। তিনি মনের গোপন ইচ্ছা ও ভেদকে পর্যন্ত দেখেন ও জানেন। তাঁর কাছে খাঁটি আনুগত্য ছাড়া কোনকিছুই গ্রহণীয় নয়।

     এখন আলোচ্য আয়াতসমূহে, আরও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, ইবরাহীমের ধর্ম বলুন, আর ইসলামই বলুন, তা সমগ্র জাতি বরং সমগ্র বিশ্বের জন্যেই এক অনন্য নির্দেশনামা। এমতাবস্থায় আয়াতে যে বিশেষভাবে ইব্‌রাহীম ও ইয়া’কূব (‘আলাইহিচ্ছালাম) কর্তৃক সন্তানদের সম্বোধন করার কথা বলা হয়েছে এবং উভয় মহাপুরুষ ওসীয়্যতের মাধ্যমে স্বীয় সন্তানদেরকে যে ইসলামে সুদৃঢ় থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এর কারণ কি?

     উত্তর এই যে, এতে বুঝা যায় যে, সন্তানের ভালবাসা ও মঙ্গলচিন্তা রিসালাত এমনকি বন্ধুত্বের স্তরেরও পরিপন্থী নয়। আল্লাহ্‌র বন্ধু যিনি এক সময় পালনকর্তার ইঙ্গিতে স্বীয় আদরের দুলালকে কুরবানী করতে কোমর বেঁধেছিলেন, তিনিই অন্য সময় সন্তানের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলের জন্যে তাঁর পালনকর্তার দরবারে দু‘আও করেন এবং দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সময় সন্তানকে এমন বিষয় দিয়ে যেতে চান, যা তাঁর দৃষ্টিতে সর্ববৃহৎ নি‘আমাহ/না‘মাত/নেয়ামত অর্থাৎ, ইসলাম। উল্লিখিত আয়াত وَوَصَّىٰ بِهَآ إِبۡرَٰهِ‍ۧمُ بَنِيهِ وَيَعۡقُوبُ  আর আয়াত إِذۡ حَضَرَ يَعۡقُوبَ الۡمَوۡتُ إِذۡ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعۡبُدُونَ مِنۢ بَعۡدِيۖ এর সারমর্মও তাই। পার্থক্য এতটুকু যে, সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে নি‘আমাহ/না‘মাত/নেয়ামত ও ধন-সম্পদ হচ্ছে দুনিয়ার ধ্বংসশীল ও নিকৃষ্ট বস্তু নিশ্চয়। অথচ পয়গম্বরগণের দৃষ্টি অনেক উর্ধ্বে। তাঁদের কাছে প্রকৃত ঐশ্বর্য হচ্ছে ঈমান ও সৎকর্ম তথা ইসলাম।

     সাধারণ মানুষ মৃত্যুর সময় সন্তানকে বৃহত্তম ধন-সম্পদ দিয়ে যেতে চায়। আজকাল একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী কামনা করে, তার সন্তান মিল-ফ্যাক্টরীর মালিক হোক, আমদানী ও রফতানীর বড় বড় লাইসেন্স লাভ করুক, লক্ষ লক্ষ এবং কোটি কোটি টাকার ব্যাংক-ব্যালেন্স গড়ে তুলুক। একজন চাকুরীজীবী চায়, তার সন্তান উচ্চপদ ও মোটা বেতনে চাকুরী করুক। অপরদিকে একজন শিল্পপতি মনে-প্রাণে কামনা করে, তার সন্তান শিল্পক্ষেত্রে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করুক। সে সন্তানকে সারা জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ কলা-কৌশল বলে দিতে চায়।

     এমনিভাবে পয়গম্বর এবং তাঁদের অনুসারী ওলীগণের সর্ববৃহৎ বাসনা থাকে, যে বস্তুকে তাঁরা সত্যিকার চিরস্থায়ী এবং অক্ষম সম্পদ মনে করেন, তা সন্তানরাও পুরোপুরিভাবে লাভ করুক। এজন্যেই তাঁরা দু‘আ করেন এবং চেষ্টাও করেন। অন্তিম সময়ে এরই জন্য ওসীয়্যত করেন।

     ধর্ম ও নৈতিকতার শিক্ষা, সন্তানের জন্য বড় সম্পদ: পয়গম্বরগণের এই বিশেষ আচরণের মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্যেও একটি নির্দেশ রয়েছে। তা এই যে, তারা যেভাবে; বরং তার চাইতেও বেশী তাদের কার্যকলাপ ও চরিত্র সংশোধনের ব্যবস্থা করা দরকার। মন্দ পথ ও মন্দ কার্যকলাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করা আবশ্যক। এরই মধ্যে সন্তানদের সত্যিকার ভালবাসা ও প্রকৃত শুভেচ্ছা নিহিত। এটা কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয় যে, সন্তানকে রৌদ্রের তাপ থেকে বাঁচাবার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, কিন্তু চিরস্থায়ী অগ্নি ও ‘আযাবের (আল্লাহপ্রদত্ত শাস্তি) কবল থেকে রক্ষা করার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করবে না। সন্তানের দেহ থেকে কাঁটা বের করার জন্যে সর্ব প্রযত্নে চেষ্টা করেব, কিন্তু তাকে বন্দুকের গুলি থেকে রক্ষা করবে না।

     পয়গম্বরদের কর্মপদ্ধতি থেকে আরও একটি মৌলিক বিষয় জানা যায় যে, সর্বপ্রথম সন্তানদের  মঙ্গলচিন্তা করা এবং পর অন্য দিকে মনোযোগ দেয়া পিতা-মাতার কর্তব্য। পিতা-মাতার নিকট থেকে এটাই সন্তানদের প্রাপ্য। এতে দু’টি রহস্য নিহিত রয়েছে-

     প্রথমত: প্রাকৃতিক ও দৈহিক সম্পর্কের কারণে তারা পিতা-মাতার উপদেশ সহজে ও দ্রুত গ্রহণ করবে। অতঃপর সংস্কার ও প্রচেষ্টায় ও সত্য প্রচারে তারা পিতা-মাতার সাহায্যকারী হতে পারবে।

     দ্বিতীয়ত: এটাই সত্য প্রচারের সব চাইতে সহজ ও উপযোগী পথ যে, প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি আপন পরিবার-পরিজনের সংশোধনের কাজে মনে-প্রাণে আত্মনিয়োগ করবে। এভাবে সত্য প্রচার ও সত্য শিক্ষার ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পরিবারের দায়ত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যেই সীমাব্ধ হয়ে যায়। ফলে পরিবারের লোকজনের শিক্ষার মাধ্যমে সমগ্র জাতিরও শিক্ষা হয়ে যায়। এ সংগঠন-পদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য করেই কুরআন বলে:

يَٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا قُوٓا أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارًا

-‘হে মুমিনগণ, নিজেকে এবং পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা কর।’

     মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন সারা বিশ্বের রসূল। তাঁর হিদায়াত ক্বিয়ামত পর্যন্ত সবার জন্যে ব্যাপক। তাঁকেও সর্বপ্রথম নির্দেশ দেয়া হয়েছে: وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ الۡأَقۡرَبِينَ অর্থাৎ, নিকট আত্মীয়দেরকে আল্লাহ্‌র শাস্তির ভয় প্রদর্শন করুন। আরও বলা হয়েছে: وَأۡمُرۡ أَهۡلَكَ بِالصَّلَوٰةِ وَاصۡطَبِرۡ عَلَيۡهَاۖ অর্থাৎ, পরিবার-পরিজনকে নামায পড়ার নির্দেশ দিন এবং নিজেও নামায অব্যাহত রাখুন।

মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সর্বদাই এ নির্দেশ পালন করেছেন।

     তৃতীয়ত: আরও একটি রহস্য এই যে, কোন মতবাদ ও কর্মসূচীতে পরিবারের লোকজন ও নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজন সহযোগী ও সমমান না হলে সে মতবাদ অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এ কারণেই প্রাথমিক যুগে মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রচারকার্যের জওয়াবে সাধারণ লোকদের উত্তর ছিল যে, প্রথমে আপনি নিজ পরিবার ক্বুরাইশকে ঠিক করে নিন; এরপর আমাদের কাছে আসুন। হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর পরিবারে যখন ইসলাম বিস্তার লাভ করল এবং মক্কা বিজয়ের সময় তা পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করল, তখন এর প্রতিক্রিয়া কুরআনের ভাষায় এরূপ প্রকাশ পেল- يَدْخُلُوْنَ فِىْ دِيْنِ اللهِ اَفْوَاجًا অর্থাৎ, মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকবে।

     আজকাল ধর্মহীনতার যে সয়লাব শুরু হয়েছে, তার বড় কারণ এই যে, পিতা-মাতা ধর্মজ্ঞানে জ্ঞানী ও ধার্মিক হলেও সন্তানদের ধার্মিক হওয়ার বিষয়ে চিন্তা করে না। সাধারণভাবে আমাদের দৃষ্টি সন্তানের পার্থিব ও স্বল্পকালীন আরাম-আয়েশের প্রতিই নিবদ্ধ থাকে এবং আমরা এর ব্যবস্থাপনায়ই ব্যতিব্যস্ত থাকি। অক্ষয় ধন-সম্পদের দিকে মনোযোগ দেই না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে তাওফীক দিন, যাতে আমরা আখিরাতের চিন্তায় ব্যাপৃত হই এবং নিজের ও সন্তানদের জন্যে ঈমান ও নেক ‘আমলকে সর্ববৃহৎ পূঁজি মনে করে তা অর্জনে সচেষ্ট হই।

বাপ-দাদার কৃতকর্মের ফলাফল সন্তানরা ভোগ করবে না:

         لَهَامَاكَسَبَتْ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, বাপ-দাদার সৎকর্ম সন্তানদের উপকারে আসে না- যতক্ষণ না তারা নিজেরা সৎকর্ম সম্পাদন করবে। এমনিভাবে বাপ-দাদার কুকর্মের শাস্তিও সন্তানরা ভোগ করবে না, যদি তারা সৎকর্মশীল হয়। এতে বোঝা যায় যে, মুশরিকদের সন্তান-সন্ততি সাবালক হওয়ার পূর্বে মারা গেলে পিতা-মাতার কুফ্‌র ও শির্‌কের কারণে তারা শাস্তি ভোগ করবে না। এতে ইহুদীদের সে দাবীও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় যে, আমরা যা ইচ্ছা তা-ই করব, আমাদের বাপ-দাদার সৎকর্মের দ্বারাই আমাদের মাগফিরাত/ক্ষমা হয়ে যাবে। কিন্তু তা নয়।

     কুরআন এ বিষয়টি বারবার বিভিন্ন ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছে। এক আয়াতে বলা হয়েছে:

     “প্রত্যেকের ‘আমলের দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে।” অন্য এক আয়াতে আছে: “ক্বিয়ামতের দিন একজনের বোঝা অন্যজন বহন করবে না।” রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলছেনঃ “হে বনী-হাশেম, এমন যেন না হয় যে, ক্বিয়ামতের দিন অন্যান্য লোক নিজ নিজ সৎকর্ম নিয়ে আসবে আর তোমরা আসবে সৎকর্ম থেকে উদাসীন হয়ে শুধু বংশ গৌরব নিয়ে এবং আমি বলব যে, আল্লাহ্‌র ‘আযাব থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারব না। অন্য এক ‘হাদীসে আছেঃ “আমল যাকে পেছনে ফেলে দেয়, বংশ তাকে এগিয়ে নিতে পারে না।”

وَقَالُواْ كُونُواْ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰ تَهۡتَدُواْۗ قُلۡ بَلۡ مِلَّةَ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ حَنِيفٗاۖ وَمَا كَانَ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٣٥

১৩৫.তারা বলে, তোমরা ইহুদী অথবা খ্রীষ্টান হয়ে যাও, তবেই সুপথ পাবে। আপনি বলুন, কখনই নয়; বরং আমরা ইব্রাহীমের ধর্মে আছি যাতে বক্রতা নেই। সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

قُولُوٓاْ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيۡنَا وَمَآ أُنزِلَ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطِ وَمَآ أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَآ أُوتِيَ ٱلنَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمۡ لَا نُفَرِّقُ بَيۡنَ أَحَدٖ مِّنۡهُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُسۡلِمُونَ ١٣٦

১৩৬.তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ্‌র উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইব্‌রাহীম, ইসমা‘ঈল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তদীয় বংশধরের প্রতি এবং মূসা, ঈসা, অন্যান্য নবীকে পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা দান করা হয়েছে, তৎসমুদয়ের উপর। আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি না। আমরা তাঁরই আনুগত্যকারী।

فَإِنۡ ءَامَنُواْ بِمِثۡلِ مَآ ءَامَنتُم بِهِۦ فَقَدِ ٱهۡتَدَواْۖ وَّإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنَّمَا هُمۡ فِي شِقَاقٖۖ فَسَيَكۡفِيكَهُمُ ٱللَّهُۚ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡعَلِيمُ
١٣٧

১৩৭.অতএব তারা যদি ঈমান আনে, তোমাদের ঈমান আনার মত, তবে তারা সুপথ পাবে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারাই হঠকারিতায় রয়েছে। সুতরাং এখন তাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট। তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী।

صِبۡغَةَ ٱللَّهِ وَمَنۡ أَحۡسَنُ مِنَ ٱللَّهِ صِبۡغَةٗۖ وَنَحۡنُ لَهُۥ عَٰبِدُونَ ١٣٨

১৩৮.আমরা আল্লাহ্‌র রং গ্রহণ করেছি। আল্লাহ্‌র রং এর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে?আমরা তাঁরই ‘ইবাদাত করি।

قُلۡ أَتُحَآجُّونَنَا فِي ٱللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمۡ وَلَنَآ أَعۡمَٰلُنَا وَلَكُمۡ أَعۡمَٰلُكُمۡ وَنَحۡنُ لَهُۥ مُخۡلِصُونَ ١٣٩

১৩৯.আপনি বলে দিন, তোমরা কি আমাদের সাথে আল্লাহ্‌ সম্পর্কে তর্ক করছ? অথচ তিনিই আমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের ও পালনকর্তা। আমাদের জন্যে আমাদের কর্ম তোমাদের জন্যে তোমাদের কর্ম। এবং আমরা তাঁরই প্রতি একনিষ্ঠ।

أَمۡ تَقُولُونَ إِنَّ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ وَٱلۡأَسۡبَاطَ كَانُواْ هُودًا أَوۡ نَصَٰرَىٰۗ قُلۡ ءَأَنتُمۡ أَعۡلَمُ أَمِ ٱللَّهُۗ وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن كَتَمَ شَهَٰدَةً عِندَهُۥ مِنَ ٱللَّهِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ١٤٠

১৪০.অথবা তোমরা কি বলছ যে, নিশ্চয়ই ইব্‌রাহীম, ইসমা‘ঈল, ইসহাক, ইয়াকুব (‘আলাইহিচ্ছালাম) ও তাদের সন্তানগন ইহুদী অথবা খ্রীষ্টান ছিলেন? আপনি বলে দিন, তোমরা বেশী জান, না আল্লাহ্‌ বেশী জানেন?

تِلۡكَ أُمَّةٞ قَدۡ خَلَتۡۖ لَهَا مَا كَسَبَتۡ وَلَكُم مَّا كَسَبۡتُمۡۖ وَلَا تُسۡ‍َٔلُونَ عَمَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٤١

১৪১.তার চাইতে অত্যাচারী কে, যে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তার কাছে প্রমাণিত সাক্ষ্যকে গোপন করে? আল্লাহ্‌ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে বেখবর নন। সে সম্প্রদায় অতীত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদের জন্যে এবং তোমরা যা করছ, তা তোমাদের জন্যে। তাদের কর্ম সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে না।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

কুরআন ইয়া’কূব (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর বংশধরকে اسباط শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেছে। এটা سبط –এর বহুবচন। এর অর্থ গোত্র ও দল। তাদের سبط বলার কারণ এই যে, হযরত ইয়া’কূব (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর ঔরসজাত পুত্রদের সংখ্যা ছিল বার জন। পরে প্রত্যেক পুত্রের সন্তানরা এক-একটি গোত্রে পরিণত হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বংশে বিশেষ বরকত দান করেছিলেন। তিনি যখন হযরত ইউসুফ (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর কাছে মিশরে যান, তখন সন্তান ছিল বার জন। পরে ফির‘আউনের সাথে মোকাবেলার পর মূসা (‘আলাইহিচ্ছালাম) যখন মিশর থেকে বনী-ইসরাঈলকে নিয়ে বের হলেন, তখন তাঁর সাথে ইয়া’কূব (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর সন্তানদের মধ্য থেকে প্রত্যেক ভাইয়ের সন্তান হাজার হাজার সদস্যের সমন্বয়ে একটি গোত্র ছিল। তাঁর বংশে আল্লাহ্ তা‘আলা আরও একটি বরকত দান করেছেন এই যে, দশজন নবী ছাড়া সব নবী ও রসুল ইয়া’কূব (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর বংশধরের মধ্যেই পয়দা/সৃষ্টি হয়েছেন। বনী-ইসরাঈল ছাড়া অবশিষ্ট পয়গম্বরগণ হলেন, আদম (‘আলিইহিচ্ছালাম)-এর পর হযরত নূ‘হ, শু‘আইব, হূদ, স্বালে‘হ, লূত্ব, ইব্‌রাহীম, ইস‘হাক্ব, ইয়া’কূব, ইসমা‘ঈল ও মু‘হাম্মাদ মুস্তফা সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

         فَاِنْ اٰمَنُوْا بِمِثْلِ مَاۤ  اٰمَنْتُمْ  بِهٖ  (যদি তারা তদ্রুপ ঈমান আনে, যেরূপ তোমরা ঈমান এনেছ)- সূরা বাক্বরার প্রথম থেকে এ পর্যন্ত ঈমানের স্বরূপ কোথাও সংক্ষেপে এবং কোথাও বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এ আয়াতের বর্ণনা সংক্ষিপ্ত হলেও তাতে বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যার প্রতি ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে। কেননা, ‘তোমরা ঈমান এনেছ’ বাক্যে রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়অসাল্লাম) ও সা‘হাবায়ে-কেরামকে সম্বোধন করা হয়েছে। আয়াতে তাঁদের ঈমানকে আদর্শ ঈমানের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত ঈমান হচ্ছে সে রকম ঈমান, যা রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সা‘হাবায়ে কেরাম অবলম্বন করেছেন। যে ঈমান ও বিশ্বাস এ থেকে চুল পরিমাণও ভিন্ন, তা আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

     এর ব্যাখ্যা এই যে, যে সব বিষয়ের উপর তাঁরা ঈমান এনেছেন, তাতে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারবে না। তাঁরা যেরূপ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে ঈমান এনেছেন, তাতেও প্রভেদ থাকতে পারবে না। নিষ্ঠায় পার্থক্য হলে তা ‘নিফাক্ব’ তথা কপট বিশ্বাসে পর্যবসিত হবে। আল্লাহ্‌র সত্তা, গুণাবলী, ফেরেশতা, নবী-রসুল, আল্লাহ্‌র কিতাব ও এ সবের শিক্ষা সম্বন্ধে যে ঈমান ও বিশ্বাস রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অবলম্বন করেছেন, একমাত্র তাই আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য। এ সবের বিপরীত ব্যাখ্যা করা অথবা ভিন্ন অর্থ নেয়া আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উক্তি ও কর্মের মাধ্যমে ফেরেশতা ও নবী-রসুলগণের যে মর্তবা, মর্যাদা ও স্থান নির্ধারিত হয়েছে, তা হ্রাস করা অথবা বাড়িয়ে দেওয়াও ঈমানের পরিপন্থী।

     এ ব্যাখ্যার ফলে কতিপয় ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের ঈমানের ত্রুটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তারা ঈমানের দাবীদার, কিন্তু ঈমানের স্বরূপ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। ঈমানের মৌখিক দাবী মূর্তিপূজক, মুশরিক, ইহুদী, খ্রীষ্টানরাও করত এবং প্রতিটি যুগে ধর্মভ্রষ্ট বিপথগামীরাও করেছে। যেহেতু আল্লাহ্, রসূল, ফেরেশতা, ক্বিয়ামত-দিবস ইত্যাদির প্রতি তাদের ঈমান তেমন নয়, যেমন রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এ কারণে আল্লাহ্‌র কাছে তা ধিকৃত ও গ্রহণের অযোগ্য সাব্যস্ত হয়ে যায়।

     ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের কোন কোন দল পয়গম্বরদের অবাধ্যতা করেছে। এমনকি কোন কোন পয়গম্বরকে হত্যাও করেছে। পক্ষান্তরে কোন কোন দল পয়গম্বরদের সম্মান ও মহত্ব বৃদ্ধি করতে গিয়ে তাঁদেরকে ‘খোদা’ অথবা ‘খোদার পুত্র’ অথবা খোদার সমপর্যায়ে নিয়ে স্থাপন করেছে। এ উভয় প্রকার ত্রুটি ও বাড়াবাড়িকেই পথভ্রষ্টতা বলে অভিহিত করা হয়েছে। بِمِثْلِ مَاۤ  اٰمَنْتُمْ   আয়াতে।

     ইসলামী শরী‘আতে রসুলের মহত্ব ও ভালবাসা ফরয তথা অপরিহার্য কর্তব্য। এর অবর্তমানে ঈমানই শুদ্ধ হয় না। কিন্তু রসুলকে ‘ইল্‌ম্, কুদরত ইত্যাদি গুণে আল্লাহ্‌র সমতুল্য মনে করা একান্তই পথভ্রষ্টতা ও শির্‌ক। আজকাল কোন কোন মুসলমান রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে ‘আলিমুল-গাইব’ ‘আল্লাহ্‌র মতই সর্বত্র বিরাজমান’ উপস্থিত ও দর্শক (হাযির ও নাযির) বলেও বিশ্বাস করে। তারা মনে করে যে, এভাবে তারা মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মহত্ব ও মহব্বত ফুটিয়ে তুলছে। অথচ এটা স্বয়ং রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশ ও আজীবন সাধনার প্রকাশ্য বিরোধিতা। আলোচ্য আয়াতে এসব মুসলমানের জন্যেও শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ্‌র কাছে মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মহত্ব ও মহব্বত এতটুকু কাম্য যতটুকু সা‘হাবায়ে-কেরামের অন্তরে তাঁর প্রতি ছিল। এতে ত্রুটি করাও অপরাধ এবং একে বাড়িয়ে দেয়াও বাড়াবাড়ি ও পথভ্রষ্টতা।

নবী ও রসূলের যেকোন রকম মনগড়া প্রকারভেদই পথভ্রষ্টতা:

     এমনিভাবে কোন কোন সম্প্রদায় খতমে নবুওয়্যাত অস্বীকার করে নতুন নবীর আগমনের পথ খুলে দিতে চেয়েছে। তারা  কুরআনের সুস্পষ্ট বর্ণনা ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ (সর্বশেষ নবী)-কে উদ্দেশ্য সাধনের পথে প্রতিবন্ধক মনে করে নবী ও রসূলের অনেক মনগড়া প্রকার আবিষ্কার করেছে। এসব প্রকারের নাম রেখেছে ‘নবী-যিল্লী’ (ছায়া-নবী) ‘নবী-বুরুযী’ (প্রকাশ্য-নবী) ইত্যাদী। আলোচ্য আয়াতটি তাদের অবিমৃশ্যকারিতা ও পথভ্রষ্টতার মুখোশটিকেও উন্মোচিত করে দিয়েছে। কারণ, রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রসুলগণের উপর যে ঈমান এনেছেন, তাতে ‘যিল্লী-বুরুযী’ বলে কোন নাম-গন্ধও নেই। সুতরাং এটা পরিষ্কার ধর্মদ্রোহিতা।

     আখেরাতের উপর ঈমান সম্পর্কে কোন অপব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়: কিছুসংখ্যক লোকের মস্তিস্ক ও চিন্তা-ভাবনা শুধু বস্তু ও বস্তুবাচক বিষয়াদির মধ্যেই নিমজ্জিত। অদৃশ্যজগত ও পরজগতের বিষয়াদি তাদের মতে অবান্তর ও অযৌক্তিক। তারা এসব ব্যাপারে নিজ থেকে নানাবিধ ব্যাখ্যা করতে প্রবৃত্ত হয় এবং একে দ্বীনের খেদমত বলে মনে করে। তারা এসব জটিল বিষয়কে বোধগম্য করে দিয়েছে বলে মনে করে গর্বও করে। কিন্তু এসব ব্যাখ্যা بِمِثْلِ مَاۤ  اٰمَنْتُمْ  بِهٖ  উক্তির পরিপন্থী হওয়ার কারণে বাতিল ও অ-গ্রহণযোগ্য। আখেরাতের অবস্থা ও ঘটনাবলী কুরআন ও ‘হাদীসে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, বিনা দ্বিধায় ও বিনা ব্যাখ্যায় তা বিশ্বাস করাই প্রকৃতপক্ষে ঈমান। ‘হাশরের পুনরুত্থানের পরিবর্তে আত্মিক পুনরুত্থান স্বীকার করা এবং ‘আযাব, ছাওয়াব, ‘আমল, ওজন ইত্যাদি বিষয়ে নিজের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা বর্ণনা করা সবই গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার কারণ।

     ইখলাস্বের তাৎপর্য: وَنَحْنُ لَهٗ مُخْلِصُوْنَ বাক্যটিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ্‌র ব্যাপারে নিষ্ঠাবান। নিষ্ঠা বা ইখলাসের অর্থ হযরত সা‘ঈদ ইব্‌নে যুবাইর (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু)-এর বর্ণনা মতে ধর্মে নিষ্ঠাবান হওয়া। অর্থাৎ, আল্লাহ্‌র সাথে কাউকে অংশীদার না করা এবং একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যে সৎকর্ম করা, মানুষকে দেখানোর জন্যে অথবা মানুষের প্রশংসা অর্জনের জন্যে নয়।

 ۞سَيَقُولُ ٱلسُّفَهَآءُ مِنَ ٱلنَّاسِ مَا وَلَّىٰهُمۡ عَن قِبۡلَتِهِمُ ٱلَّتِي كَانُواْ عَلَيۡهَاۚ قُل لِّلَّهِ ٱلۡمَشۡرِقُ وَٱلۡمَغۡرِبُۚ يَهۡدِي مَن يَشَآءُ إِلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ ١٤٢

১৪২.এখন নির্বোধেরা বলবে, কিসে মুসলমানদের ফিরিয়ে দিল তাদের ঐ ক্বিব্‌লা থেকে, যার উপর তারা ছিল? আপনি বলুনঃ পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহ্‌রই। তিনি যাকে ইচ্ছা সরল পথে চালান।

وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَٰكُمۡ أُمَّةٗ وَسَطٗا لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ وَيَكُونَ ٱلرَّسُولُ عَلَيۡكُمۡ شَهِيدٗاۗ وَمَا جَعَلۡنَا ٱلۡقِبۡلَةَ ٱلَّتِي كُنتَ عَلَيۡهَآ إِلَّا لِنَعۡلَمَ مَن يَتَّبِعُ ٱلرَّسُولَ مِمَّن يَنقَلِبُ عَلَىٰ عَقِبَيۡهِۚ وَإِن كَانَتۡ لَكَبِيرَةً إِلَّا عَلَى ٱلَّذِينَ هَدَى ٱللَّهُۗ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَٰنَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِٱلنَّاسِ لَرَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١٤٣

১৪৩.এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্যে এবং যাতে রসূল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য। আপনি যে ক্বিব্‌লার উপর ছিলেন, তাকে আমি এজন্যই ক্বিব্‌লা করেছিলাম, যাতে একথা প্রতীয়মান হয় যে, কে রসূলের অনুসারী থাকে আর কে পিঠটান দেয়। নিশ্চিতই এটা কঠোরতর বিষয়, কিন্তু তাদের জন্যে নয়, যাদেরকে আল্লাহ্‌ পথপ্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ্‌ এমন নন যে, তোমাদের ঈমান নষ্ট করে দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌, মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, করুনাময়।

قَدۡ نَرَىٰ تَقَلُّبَ وَجۡهِكَ فِي ٱلسَّمَآءِۖ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبۡلَةٗ تَرۡضَىٰهَاۚ فَوَلِّ وَجۡهَكَ شَطۡرَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۚ وَحَيۡثُ مَا كُنتُمۡ فَوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ شَطۡرَهُۥۗ وَإِنَّ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ لَيَعۡلَمُونَ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّهِمۡۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا يَعۡمَلُونَ ١٤٤

১৪৪.নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সে ক্বিব্‌লার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল-হারামের দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর। যারা আহলে-কিতাব, তারা অবশ্যই জানে যে, এটাই ঠিক পালনকর্তার পক্ষ থেকে। আল্লাহ্‌ বেখবর নন, সে সমস্ত কর্ম সম্পর্কে যা তারা করে।

وَلَئِنۡ أَتَيۡتَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ بِكُلِّ ءَايَةٖ مَّا تَبِعُواْ قِبۡلَتَكَۚ وَمَآ أَنتَ بِتَابِعٖ قِبۡلَتَهُمۡۚ وَمَا بَعۡضُهُم بِتَابِعٖ قِبۡلَةَ بَعۡضٖۚ وَلَئِنِ ٱتَّبَعۡتَ أَهۡوَآءَهُم مِّنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَكَ مِنَ ٱلۡعِلۡمِ إِنَّكَ إِذٗا لَّمِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ ١٤٥

১৪৫.যদি আপনি আহলে কিতাবদের কাছে সমুদয় নিদর্শন উপস্থাপন করেন, তবুও তারা আপনার ক্বিব্‌লা মেনে নেবে না এবং আপনিও তাদের ক্বিব্‌লা মানেন না। তারাও একে অন্যের ক্বিব্‌লা মানে না। যদি আপনি তাদের বাসনার অনুসরণ করেন, সে জ্ঞানলাভের পর, যা আপনার কাছে পৌঁছেছে, তবে নিশ্চয় আপনি অবিচারকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।

ٱلَّذِينَ ءَاتَيۡنَٰهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ يَعۡرِفُونَهُۥ كَمَا يَعۡرِفُونَ أَبۡنَآءَهُمۡۖ وَإِنَّ فَرِيقٗا مِّنۡهُمۡ لَيَكۡتُمُونَ ٱلۡحَقَّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ١٤٦

১৪৬.আমি যাদেরকে কিতাব দান করেছি, তারা তাকে চেনে, যেমন করে চেনে নিজেদের পুত্রদেরকে। আর নিশ্চয়ই তাদের একটি সম্প্রদায় জেনে শুনে সত্যকে গোপন করে।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

আলোচ্য ১৪২ তম আয়াতে কেবলা পরিবর্তন সম্পর্কে বিরোধিতাকারীদের আপত্তি বর্ণনা করে তার জওয়াব দেয়া হয়েছে। আপত্তি ও জওয়াবের পূর্বে কেবলার স্বরূপ ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জেনে নেয়া বাঞ্ছনীয়।

     কেবলার শাব্দিক অর্থ মুখ করার দিক। প্রত্যেক ‘ইবাদতে মুমিনের মুখ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর দিকেই থাকে। আল্লাহ পবিত্র সত্তা; পূরব-পিশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণের বন্ধন থেকে মুক্ত, তিনি কোন বিশেষ দিকে অবস্থান করেন না। ফলে কোন ‘ইবাদতকারী ব্যক্তি যদি যে দিকে ইচ্ছা সেদিকেই মুখ করত কিংবা একই ব্যক্তি এক সময় একদিকে অন্য সময় অন্যদিকে মুখ করত, তবে তাও স্বাভাবিক নিয়মের পরিপন্থী হতো না।

     কিন্তু অপর একটি রহস্যের কারণে সমস্ত ‘ইবাদতকারীর মুখ একদিকেই হওয়া উচিত। রহস্যটি এই,- ‘ইবাদত বিভিন্ন প্রকার। কিছু ‘ইবাদত ব্যক্তিগত, আর কিছু ‘ইবাদত সমষ্টিগত। আল্লাহর যিকির, রোযা প্রভৃতি ব্যক্তিগত ‘ইবাদত । এগুলো নির্জনে গোপণভাবে সম্পাদন করতে হয়। নামায ও হজ্ব সমষ্টিগত ‘ইবাদত। এগুলো সংঘবদ্ধভাবে এবং প্রকাশ্যে সম্পাদন করতে হয়। সমষ্টিগত উপাসনার বেলায় উপাসনার সাথে সাথে মুসলমানদের সংঘবদ্ধ জীবনের রীতি-নীতিও শিক্ষা দেয়া লক্ষ্য থাকে। এটা সবারই জানা যে, সংঘবদ্ধ জীবনব্যবস্থার প্রধান মৌলনীতি হচ্ছে বহু ব্যক্তি ভিত্তিক ঐক্য ও একাত্মতা। এ ঐক্য যত দৃঢ় ও মজবুত হবে, সংঘবদ্ধ জীবনব্যবস্থাও ততই শক্ত ও সুদৃঢ় হবে। ব্যক্তিকেনিদ্রকতা এবং বিচ্ছিন্নতা উভয়টিই সংঘবদ্ধ জীবনব্যবস্থার পক্ষে নিতান্ত ক্ষতিকর। এরপর ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু কি হবে, তা নির্ধারণ করার ব্যাপারে বিভিন্ন যুগের মানুষ বিভিন্ন মত পোষণ করেছে। কোন কোন সম্প্রদায় বংশকে কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করেছে, কেউ দেশ ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে এবং কেউ বর্ণ ও ভাষাকে।

     কিন্তু আল্লাহ্‌র ধর্ম এবং পয়গম্বরদের শরী‘আত এ সব এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়কে ঐক্যের কেন্দ্র বিন্দু করার যোগ্য মনে করেনি। প্রকৃতপক্ষে এসব বিষয় সমগ্র মানবজাতিকে একই কেন্দ্রে সমবেত করতে সমর্থও নয়। বরং চিন্তা করলে দেখা যায়, এ ধরণের ঐক্য প্রকৃত পক্ষে মানব জাতিকে বহুধা বিভক্ত করে দেয় এবং পারস্পারিক সংঘর্ষ ও মতানৈক্যই সৃষ্টি করে বেশী।

     সকল পয়গম্বরের ধর্ম ইসলাম ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের ঐক্যকেই ঐক্যের মানদণ্ড ও কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করেছে এবং কোটি কোটি উপাস্যের উপসনায় বিভক্ত বিশ্বকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্‌র ‘ইবাদত ও আনুগত্যের প্রতি আহবান জানিয়েছে। বলাবাহুল্য, একমাত্র এ কেন্দ্রবিন্দুতেই পূর্ব ও পশ্চিম, ভূত ও ভবিষ্যতের মানবমণ্ডলী একত্রিত হতে পারে। অতঃপর এ ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের ঐক্যকে বাস্তবে রূপায়ন এবং শক্তিদানের উদ্দেশ্যে তৎসঙ্গে কিছু বাহ্যিক ঐক্যও যোগ করা হয়েছে। কিন্তু এসব বাহ্যিক ঐক্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি নীতির প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে যে, ঐক্যের বিষয়বস্তু কার্যগত ও ইচ্ছাধীন হতে হবে- যাতে সমগ্র মানবমণ্ডলী স্বেচ্ছায় তা অবলম্বন করে ঐক্যসূত্রে গ্রহিত হতে পারে। বংশ, দেশ, ভাষা, বর্ণ প্রভৃতি ঐচ্ছিক বিষয় নয়। যে ব্যক্তি এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, সে অন্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করতে পারে না। যে ব্যক্তি পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, সে বিলেতে অথবা আফ্রিকায় জন্মগ্রহণে সক্ষম নয়। যে ব্যক্তি কৃষ্ণকায়, সে যেমন স্বেচ্ছায় শ্বেতকায় হতে পারে না, ঠিক তেমনিভাবে একজন শ্বেতকায় ব্যক্তিও স্বেচ্ছায় কৃষ্ণকায় হতে পারে না।

     এমন বিষয়কে ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করা হলে মানবতা শতধা, এমনকি সহস্রধা বিভক্ত হয়ে পড়া অপরিহার্য হয়ে যাবে। এ কারণে সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত এ সব বিষয়কে ইসলাম পরিপূর্ণ সম্মান দান করলেও, মানব ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু হতে দেয়নি। তবে ইসলাম ইচ্ছাধীন বিষয়সমূহে চিন্তাগত ঐক্যের সাথে সাথে কার্যগত ও আকারগত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রেখেছে। এতেও এমন বিষয়কে ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা স্বেচ্ছায় অবলম্বন করা প্রত্যেক পুরুষ-স্ত্রী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহুরে-গ্রাম্য, ধনী-দরিদ্রের পক্ষে সমান সহজ। কাজেই ইসলামী শরী‘আত সারা বিশ্বের মানুষকে পোশাক, বাসস্থান ও পানাহারের ব্যাপারে কোন এক নিয়মের অধীন করেনি। কারণ, প্রত্যেক দেশের আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে প্রয়োজনাদিও ভিন্ন ভিন্ন। এমতাবস্থায় সবাইকে একই ধরনের পোশাক ও ইউনিফর্মের অধীনে করে দিলে নানা অসুবিধা দেখা দিবে। যদি ন্যুনতম কোন ইউনিফর্মেরও অধীন করে দেয়া হয়, তাতেও মানবিক সমতার প্রতি অবিচার করা হবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত উৎকৃষ্ট পোশাক ও বস্ত্রের অবমাননা হবে। পক্ষান্তরে আরও বেশী দামের ইউনিফর্মের অধীন করে দেয়া হলে দরিদ্র ও নিঃস্ব লোকদের পক্ষে অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

     এ কারণে ইসলামী শরী‘আত মুসলমানদের জন্যে কোন বিশেষ পোশাক বা ইউনিফর্ম নির্দিষ্ট করেনি, বরং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সব পন্থা ও পোশাক প্রচলিত ছিল, সবগুলো যাচাই করে অপব্যয়, অযথা গর্ব ও বিজাতীয় অনুকরণ-ভিত্তিক পন্থা ও পোশাক পরিচ্ছেদকে নিষিদ্ধ করেছে। অবশিষ্ট প্রত্যেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এমনি বিষয়াদিকে ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু সাব্যস্ত করা হয়েছে, যা ইচ্ছাধীন সহজলভ্য ও সস্তা। উদাহরণতঃ জামা‘আতের নামাযে কাতারবন্দি হওয়া, ইমামের উঠাবসায় পূর্ণ অনুকরণ, হজ্বের সময় পোশাক ও অবস্থানের অভিন্নতা ইত্যাদি।

     এমনিভাবে কেবলার ঐক্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ্‌র পবিত্র সত্তা যদিও যাবতীয় দিকের বন্ধন থেকে মুক্ত; তার জন্য সবদিকই সমান, তথাপি নামাযে সমষ্টিগত ঐক্য সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে বিশ্ববাসীর মুখমন্ডল একই দিকে নিবদ্ধ থাকা একটি উত্তম, সহজ ও স্বাভাবিক ঐক্য পদ্ধতি। এতে পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণের সমগ্র মানবমন্ডলী সহজেই একত্রিত হতে পারে। এখন সমগ্র বিশ্বের মুখ করার দিক কোনটি হবে এর মীমাংসা মানুষের হাতে ছেড়ে দিলে তাও বিরাট মতানৈক্য এবং কলহের কারণ হয়ে যাবে। একারণে এর মীমাংসা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে হওয়াই বিধেয়। হযরত আদম ‘আলাইহিচ্ছালামের পৃথিবীতে অবতরণের পূর্বেই ফেরেশতাদের দ্বারা কা’বা গৃহের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। আদম ও আদম-সন্তানদের জন্যে সর্বপ্রথম কেবলা কা’বাগৃহকেই সাব্যস্ত করা হয়। বলা হয়েছে:

إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِّلْعَالَمِينَ

অর্থাৎ, মানুষের জন্যে সর্বপ্রথম যে গৃহ নির্মিত হয়, তা মক্কায় অবস্থিত এবং এ গৃহ বিশ্ববাসীর জন্যে হিদায়াত ও বরকতের উৎস।

     নামাযে কা’বার দিকে মুখে করাই যথেষ্টঃ এখানে একটি ফিকাহ্-বিষয়ক সুক্ষ্ণ তত্ত্ব উল্লেখযোগ্য। আয়াতে কা’বা অথবা বাইতুল্লাহ বলার পরিবর্তে ‘মসজিদে-‘হারাম’ বলা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, দূরবর্তী দেশসমূহে বসবাসকারী পক্ষে হুবহু কা’বাগৃহ বরাবর দাঁড়ানো জরুরী নয়, বরং পূর্ব পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণের মধ্য থেকে যে দিকটিতে কা’বা অবস্থিত সেদিকে মুখ করলেই যথেষ্ট হবে। তবে যে ব্যক্তি মসজিদে-‘হারামে উপস্থিত রয়েছে কিংবা নিকটস্থ কোন স্থান বা পাহাড় থেকে কা’বা দেখতে পাচ্ছে, তার পক্ষে এমনভাবে দাঁড়ানো জরুরী যাতে কা’বাগৃহ তার চেহারার বরাবর থাকে। যদি কা’বাগৃহের কোন অংশ তার চেহারা বরাবর না পড়ে, তবে তার নামায শুদ্ধ হবে না। কা’বাগৃহ যাদের চোখের সামনে নেই এ বিধান তাদের জন্যে নয়। তারা কা’বাগৃহ কিংবা মসজিদে-‘হারামের দিকে মুখ করলেই যথেষ্ট। وسط  শব্দের অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট বিষয়। আবূ সা‘ঈদ খুদরী রদিয়াল্ল-হু ‘আনহু বলেন: মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) عدل শব্দ দ্বারাوسط  এর ব্যাখ্যা করেছেন। -এর অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট। (কুরতুবী) আলোচ্য আয়াতে মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট বর্ণিত হয়েছে যে, তাদেরকে মধ্যবর্তী উম্মত করা হয়েছে। এর ফলে তারা ‘হাশরের ময়দানে একটি স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে। সকল পয়গাম্বর/নবীর উম্মতরা তাঁদের হিদায়াত ও প্রচারকার্য অস্বীকার করে বলতে থাকবে, দুনিয়াতে আমাদের কাছে কোন আসমানী গ্রন্থ পৌঁছেনি এবং কোন পয়গম্বর/নবীও আমাদের হিদায়াত করেননি। তখন মুসলিম সম্প্রদায় পয়গম্বর/নবীগনের পক্ষে সাক্ষ্যদাতা হিসাবে উপস্থিত হবে এবং সাক্ষ্য দেবে যে, পয়গম্বর/নবীগণ সব যুগেই আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আনীত হিদায়াত তাদের কাছে পৌছে দিয়েছেন, তাদেরকে সঠিক পথে আনার জন্যে তাঁরা সাধ্যমত চেষ্টাও করেছেন ।বিবাদী উম্মতরা মুসলিম সম্প্রদায়ের সাক্ষ্যে প্রশ্ন তুলে বলবেঃ আমাদের আমলে এই সম্প্রদায়ের কোন অস্তিত্বই ছিল না। আমাদের ব্যাপারাদি তাদের জানার কথা নয়, কাজেই আমাদের বিপক্ষে তাদের সাক্ষ্য কেমন করে গ্রহনযোগ্য হতে পারে?

     মুসলিম সম্প্রদায় এ প্রশ্নের উত্তরে বলবে: নিঃসন্দেহে তখন আমাদের অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু আমাদের নিকট তাদের অবস্থা ও ঘটনাবলী সম্পর্কিত তথ্যাবলী একজন সত্যবাদী রসুল ও আল্লাহ্‌র গ্রন্থ কুরআন সরবরাহ করেছে। আমরাও সে গ্রন্থের উপর ঈমান এনেছি এবং তাদের সরবরাহকৃত তথ্যাবলীকে চাক্ষুষ দেখার চাইতেও অধিক সত্য মনে করি; তাই আমাদের সাক্ষ্য সত্য। অতঃপর রসুলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উপস্থাপিত হবেন এবং সাক্ষীদের সমর্থন করে বলবেনঃ তারা যা কিছু বলেছে, সবই সত্য। আল্লাহ্‌র গ্রন্থ এবং আমার শিক্ষার মাধ্যমে তারা এসব তথ্য জানতে পেরেছে।

     ‘হাশরের ময়দানে সংঘটিতব্য এ ঘটনার বিবরণ স‘হীহ্ বুখারী, তিরমিযী, নাসায়ী ও মুসনাদে-আ‘হমাদের একাধিক ‘হাদীসে সংক্ষেপে ও সবিস্তারে বর্ণিত রয়েছে।

     মোটকথা, আলোচ্য আয়াতে মুসলিম সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, এ সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করা হয়েছে। তাই এখানে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য।

মধ্যপন্থার রুপরেখা, তার গুরুত্ব ও কিছু বিবরন:

     (১) মধ্যপন্থার অর্থ ও তাৎপর্য কি?

     (২) মধ্যপন্থার এত গুরুত্বই বা কেন যে, এর উপরই শ্রেষ্টত্বকে নির্ভরশীল করা হয়েছে?

     (৩) মুসলিম সম্প্রদায় যে মধ্যপন্থী, বাস্তবতার নিরীখে এর প্রমান কি? ধারাবাহীকভাবে এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর:

     (১) اعتدال (ভারসাম্য)-এর শাব্দিক অর্থ সমান হওয়া৷ عدل মূল ধাতু থেকে এর উৎপত্তি, আর عدل এর অর্থও সমান হওয়া।

     (২) যে গুরুত্বের কারণে ভারসাম্যকে সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি সাব্যস্ত করা হয়েছে তা একটু ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। বিষয়টি প্রথমে একটি স্থুল উদাহরণ দ্বারা বুঝুন৷ ইউনানী, আয়ুর্বেদিক, এ্যালোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক ইত্যাদি যত নতুন ও পুরাতন চিকিৎসা পদ্ধতি পৃথিবীতে প্রচলিত রয়েছে, সে সবই এ বিষয়ে একমত যে, মেজাযের বা স্বভাবের ভারসাম্যের উপরই মানবদেহের সুস্থতা নির্ভরশীল। ভারসাম্যের ক্রটিই মানবদেহে রোগ-বিকার সৃষ্টি করে। বিশেষতঃ ইউনানী চিকিৎসা পদ্ধতির মূলনিতীই মেজায পরিচয়ের উপর নির্ভরশীল। এ শাস্ত্র  মতে মানবদেহে চারটি উপাদান- রক্ত, শ্লেষ্মা,অম্ল ও পিত্ত দ্বারা  গঠিত। এ চারটি উপাদানের ভারসাম্যই মানবদেহের প্রকৃত সুস্থতা নিশ্চিত করে। পক্ষান্তরে যে কোন একটি উপাদান মেজাযের চাহিদা থেকে বেড়ে বা কমে গেলেই তা হবে রোগ ব্যাধি।  চিকিৎসা দ্বারা এর প্রতিকার না করলে এক পর্যায়ে মৃত্যুর কারন হবে।

     এই স্থূল উদাহরনের পর এখন আধ্যাত্বিকতার দিকে আসুন। আধ্যাত্বিকতায় ভারসাম্যের নাম আত্মিক সুস্থতা এবং ভারসাম্যহিনতার নাম আত্মিক ও চারিত্রিক অসুস্থতা। এ অসুস্থতার চিকিৎসা করে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা না হলে পরিণামে আত্মিক মৃত্যু ঘটে। চক্ষুমান ব্যক্তি মাত্রই জানে যে, যে উৎকৃষ্টতার কারণে মানুষ সমগ্র সৃষ্টিজীবের সেরা, তা তার দেহ বা দেহের উপাদান অথবা সেগুলোর অবস্থা, তাপ শৈত্য নয়। কারণ, এসব উপাদান ও অবস্থার ক্ষেত্রে দুনিয়ার অন্যান্য জীব-জন্তুও মানুষের সমপর্যায়ভূক্ত, বরং তাদের মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে এসব উপাদান মানুষের চাইতেও বেশী থাকে।

     যে বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ ‘আশরাফুল-মাখলুকাত’ তথা সৃষ্টির সেরা বলে গণ্য হয়েছে, তা নিশ্চতই তার রক্ত-মাংস চর্ম এবং তাপ-শৈত্যের উধের্ব অন্য কোন বিষয় যা মানুষের মধ্যে পুরোপুরি বিদ্যমান-অন্যান্য সৃষ্টজীবের মধ্যে ততটুকু নেই। এ বস্তুটি নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করাও কোন সুক্ষ ও কঠিন কাজ নয়। বলাবাহুল্য, তা হচ্ছে মানুষের আত্মিক ও চারিত্রিক পরাকাষ্ঠা বা পরিপূর্ণতা।

     আত্মিক ও চারিত্রিক পরাকাষ্ঠাই যখন মানুষের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি, মানবদেহের মত মানবাত্মাও যখন ভারসাম্য ও ভারসাম্যহীনতার শিকার হয় এবং মানবদেহের সুস্থতা যখন মেযাজ ও উপাদানের ভারসাম্য আর মানবাত্মার সুস্থতা যখন আত্মা ও চরিত্রের ভারসাম্য, তখন কামেল মানব একমাত্র তিনিই হতে পারেন, যিনি দৈহিক ভারসাম্যের সাথে সাথে আত্মিক ও চারিত্রিক ভারসাম্যেরও অধিকারী হবেন। এ উভয়বিধ ভারসাম্য সমস্ত পয়গম্বর/নবীকে বিশেষভাবে দান করা হয়ছিল এবং আমাদের রসুল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহ ওয়াসাল্লাম) তা সর্বাধিক পরিমানে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি সর্বপ্রধান কামেল মানব।

     আলোচ্য আয়াতে পয়গম্বর/নবী প্রেরণ ও গ্রন্থ অবতরণের রহস্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়ছে যে, এগুলোর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে চারিত্রিক ভারসাম্য সৃষ্টি করা হবে এবং লেন-দেন ও পারস্পারিক আদান-প্রদানে বৈষয়িক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মানদন্ড নাযিল করা হয়েছে।

     মানদন্ড অর্থ প্রত্যেক পয়গম্বরের শরী‘আত হতে পারে। শরী‘আত দ্বারা সত্যিকার ভারসাম্য জানা যায় এবং ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়। উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে, মানবমন্ডলীকে আত্মিক ও চারিত্রিক ভারসাম্যের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করাই পরগম্বর ও আসমানী গ্রন্থ প্রেরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য। বলাবাহুল্য, এটাই মানবমন্ডীলর সুস্থতা।

     মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সর্বপ্রকার ভারসাম্য নিহিত: মুসলিম সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا অর্থাৎ, আমি তোমাদেরকে ভারসাম্য সম্প্রদায় করেছি। উপরোক্ত বর্ণনা থেকেই অনুমান করা যায় যে, وَسَطًا শব্দটি উচ্চারণ ও লেখায় একটি সাধারণ শব্দ হলেও তাৎপর্যের দিক দিয়ে কোন সম্প্রদায় অথবা ব্যক্তির মধ্যে যত পরাকাষ্ঠা থাকা সম্ভব, সে সবগুলোকে পরিব্যপ্ত করেছে।

     আয়াতে মুসলিম সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী, ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায় বলে অবিহিত করে বলা হয়েছে যে, মানবীয় মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব তাদের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। যে উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের যাবতীয় কর্মধারা অব্যাহত রয়েছে এবং পয়গম্বর/নবী ও আসমানী গ্রন্থসমূহ প্রেরিত হয়েছে, তাতে এ সম্প্রদায় থেকে স্বতন্ত্র্যের অধিকারী ও শ্রেষ্ঠ।

     কুরআন বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের এ শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণনা করেছে। সূরা আ’রাফের শেষভাগে এ সম্প্রদায় সম্পর্কে বলা হয়েছে: وممن خلقنا امة يهدون بالحق وبه يعدلون অর্থাৎ, আমি যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় রয়েছে, যারা সৎপথ প্রদর্শন করে এবং তদনুযায়ী ন্যায়বিচার করে।

     এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্বিক ও চারিত্রিক ভারসাম্য বিধৃত হয়েছে যে, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ ও কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে আসমানী গ্রন্থের নির্দেশ অনুযায়ী নিজেরাও চলে এবং অন্যদেরকেও চালাবার চেষ্টা করে। কোন ব্যাপারে কলহবিবাদ সৃষ্টি হলে তার মিমাংসাও তারা গ্রন্থের সাহায্যেই করে, যাতে কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের স্বার্থপরতার কোন আশংকা নেই।

     সূরা আ-লি-‘ইমরানে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্বিক ভারসাম্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে:

كنتم خير امة اخرجت للناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن المنكر وتؤمنون بالله অর্থাৎ, তোমরাই সে শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্য যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ করবে, মন্দকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান রাখবে।

অর্থাৎ, মুসলমানরা যেমন সব পয়গম্বর/নবীর শ্রেষ্ঠতম পয়গম্বর/নবী প্রাপ্ত হয়েছে, সব গ্রন্থের সর্বাধিক পরিব্যপ্ত ও পূর্ণতর গ্রন্থ লাভ করেছে, তেমনি সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সুস্থ মেজায এবং ভারসাম্যও সর্বাধিক পরিমাণে প্রাপ্ত হয়েছে। ফলে তারাই সকল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায় সাব্যস্ত হয়ছে। তাদের সামনে জ্ঞানবিজ্ঞান ও তত্ব-রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে। ঈমান, ‘আমল ও খোদাভীতির সমস্ত শাখা-প্রশাখা তাদের ত্যাগের দৌলতে সজীব ও সতেজ হয়ে উঠবে। তারা কোন বিশেষ দেশ ও ভৌগলিক সীমার বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে না। তাদের কর্মক্ষেত্র হবে সমগ্র বিশ্ব এবং জীবনের সকল শাখায় পরিব্যপ্ত । তাদের অস্তিত্বই অন্যের হিতাকাঙ্খী ও তাদের বেহেশতের দ্বারে উপনীত করার কাজে নিবেদিত।

         اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ বাক্যাংশে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এ সম্প্রদায়টি গণমানুষের হিতাকাঙ্খী ও উপকারের নিমিত্তই সৃষ্ট। তাদের অভীষ্ট কর্তব্য ও জাতীয় পরিচয় এই যে, তারা মানুষকে সৎকাজের দিকে পথ দেখাবে এবং মন্দকাজ থেকে বিরত রাখবে।

          বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায়ের হওয়ার প্রমাণ কি? এখন এ প্রশ্নটি আলোচনাসাপেক্ষ। এর বিস্তারিত বিবরণ দিতে হলে বিশ্বের সকল সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, কর্ম, চরিত্র ও কীর্তিসমূহ যাচাই করা একান্ত প্রয়োজন। নিম্নে নমুনাস্বরূপ কতিপয় বিষয় উল্লেখ করা হচ্ছে:

     বিশ্বাসের ভারসাম্য: সর্বপ্রথম বিশ্বাসগত ভারসাম্য নিয়েই আলোচনা করা যাক। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা পয়গম্বর/নবীগণকে আল্লাহ্‌র পুত্র মনে করে তাদের উপাসনা ও আরাধনা করতে শুরু করেছে। যেমন,এক আয়াতে রয়েছেঃ ইহুদীরা বলেছে, ‘উযাইর আল্লাহ্‌র পুত্র এবং খ্রীষ্টানরা বলেছে, মাসী‘হ্ আল্লাহ্‌র পুত্র। অপরদিকে এসব সম্প্রদায়েরই অনেকে পয়গম্বর/নবীর উপর্যুপরি মু’জিযা দেখা সত্ত্বেও তাদের পয়গম্বর/নবী যখন তাদেরকে কোন ন্যায়যুদ্ধে আহবান করেছেন, তখন পরিস্কার বলে দিয়েছেঃ আপনি এবং আপনার পালনকর্তাই যান এবং শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব। আবার কোথাও পয়গম্বর/নবীগণকে স্বয়ং তাদের অনুসারীদেরই হাতেই নির্যাতিতও হতে দেখা গেছে।

     পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থা তা নয়। তারা একদিকে রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি এমন আনুগত্য ও মহব্বত পোষণ করে যে, এর সামনে জান-মাল, সন্তান-সন্ততি, ইজ্জত-আবরু সবকিছু বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। অপরদিকে রসূলকে রসূল এবং আল্লা্হকে আল্লাহ্‌ই মনে করে। এতসব পরাকাষ্ঠা ও শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে তারা আল্লাহ্‌র দাস ও রসূল বলেই বিশ্বাস করে এবং মুখে প্রকাশ করে। তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করতে গিয়েও তারা একটা সীমার ভেতর থাকে।

     কর্ম ও ‘ইবাদাতের ভারসাম্যঃ বিশ্বাসের পরই শুরু হয় ‘আমল ও ‘ইবাদাতের পালা। এক্ষেত্রেও পূর্ববর্তী সম্প্রাদায়গুলোর মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা শরী‘আতের বিধি-বিধানকে কানাকড়ির বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়, ঘুষ-উৎকোচ নিয়ে আসমানী গ্রন্থকে পরিবর্তন করে অথবা মিথ্যা ফতোয়া দেয়, বাহানা ও অপকৌশলের মাধ্যমে ধর্মীয় বিধান পরিবর্তন করে এবং ‘ইবাদাত থেকে গা বাঁচিয়ে চলে। অপরদিকে তাদের উপাসনালয় সমূহে এমন লোকও দেখা যায়, সংসারধর্ম ত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বন করেছে। তারা খোদাপ্রদত্ত ‘হালাল নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামত থেকেও নিজেদের বঞ্চিত রাখে এবং কষ্ট সহ্য করাকেই সওয়াব ও ‘ইবাদাত বলে মনে করে।

     পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায় একদিকে বৈরাগ্যকে মানবতার প্রতি জুলুম বলে মনে করে এবং অপরদিকে আল্লাহ্ ও রসূলের বিধি-বিধানের জন্যে জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। তারা রোম ও পারস্য সম্রাটের সিংহাসনের অধিপতি ও মালিক হয়েও বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ধর্মনীতি ও রাজনীতির মধ্যে কোন বৈরিতা নেই এবং ধর্ম মসজিদ ও খানকায় আবদ্ধ থাকার জন্য আসেনি; বরং হাট-ঘাট, মাঠ-ময়দান, অফিস-আদালত এবং মন্ত্রণালয়সমূহে এর সাম্রাজ্য অপ্রতিহত। তাঁরা বাদশাহীর মাঝে ফকিরী এবং ফকিরীর মাঝে বাদশাহীর শিক্ষা দিয়েছে।

          সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্যঃ এরপর সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি লক্ষ্য করুন। পূর্ববর্তী উম্মতসূহের মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা মানবাধিকারের প্রতি পরওয়াও করেনি; ন্যায়-অন্যায়ের তো কোন কথাই নেই। নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাউকে যেতে দেখলে তাকে নিপীড়ণ, হত্যা ও লুণ্ঠন করাকেই বড় কৃতিত্ব মনে করেছে। জনৈক বিত্তশালীর চারণভূমিতে অপরের উট প্রবেশ করে কিছু ক্ষতিসাধন করায় সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে শতাব্দীব্যাপী যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে যায়। এতে কত মানুষ যে নিহত হয়, তার কোন ইয়ত্তা নেই। মহিলাদের মানবাধিকার দান করা তো দুরের কথা, তাদের জীবিত থাকার অনুমতি পর্যন্ত দেয়া হত না। কোথাও প্রচলিত ছিল শৈশবেই তাদের জীবন্ত সমাহিত করার প্রথা এবং কোথাও মৃত স্বামীর সাথে স্ত্রীকে দাহ করার প্রথা। অপরদিকে এমন নির্বোধ দয়ার্দ্রতারও প্রচলন ছিল যে, পোকা-মাকড় হত্যা করাকেও অবৈধ জ্ঞান করা হত। জীব-হত্যাকে তো দস্তুরমত মহাপাপ বলে সাব্যস্ত করা হত। আল্লাহ্‌র ‘হালাল করা প্রাণীর গোশত ভক্ষণকে মনে করা হত অন্যায়।

     কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায় ও তাদের শরী‘আত এসব ভারসাম্যহীনতার অবসান ঘটিয়েছে। তারা একদিকে মানুষের সামনে মানবাধিকারকে তুলে ধরেছে। শুধু শান্তি ও সন্ধির সময়ই নয়, যুদ্ধক্ষেত্রেও শত্রুর অধিকার সংরক্ষণে সচেতনতা শিক্ষা দিয়েছে। অপরদিকে প্রত্যেক কাজের একটা সীমা নির্ধারণ করেছে, যা লঙ্ঘন করাকে অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। নিজ অধিকারের ব্যাপারে ক্ষমা, মার্জনা ও ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এবং অপরের অধিকার প্রদানে যত্নবান হওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে।

          অর্থনৈতিক ভারসাম্যঃ এরপর অর্থনীতি বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রেও অপরাপর সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তর ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হয়। একদিক রয়েছে পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা। এতে ‘হালাল-‘হারাম এবং অপরের সুখ-শান্তি ও দুঃখ-দুরবস্থা থেকে চক্ষু বন্ধ করে অধিকতর ধন-সম্পদ সঞ্চয় করাকেই সর্ববৃহৎ মানবিক সাফল্য গণ্য করা হয়। অপরদিকে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা । এতে ব্যক্তি মালিকানাকেই অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়। চিন্তা করলে বুঝা যায় যে, উভয় অর্থব্যবস্থার সারমর্মই হচ্ছে ধন-সম্পদের ‍উপাসনা, ধন-সম্পদকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান করা এবং এরই জন্যে যাবতীয় চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করা ।

          মুসলিম সম্প্রদায় ‍ও তাদের শরী‘আত এক্ষেত্রেও ভারসাম্যপূর্ণ অভিনব অর্থব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। ইসলামী শরী‘আত একদিকে ধন-সম্পদকে জীবনের লক্ষ মনে করতে বারণ করেছে এবং সম্মান, ইজ্জত ও কোন পদমর্যাদা লাভকে এর উপর নির্ভরশীল রাখেনি; অপরদিকে সম্পদ বন্টনের নিষ্কলুষ নীতিমালা প্রণয়ন করে দিয়েছে যাতে কোন মানুষ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত না থাকে এবং কেউ সমগ্র সম্পদ কুক্ষিগত করে না বসে। এছাড়া সম্মিলিত মালিকানাভূক্ত বিষয়-সম্পত্তিকে যৌথ ও সাধারণ ওয়াক্‌ফের আওতায় রেখেছে। বিশেষ বস্তুর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। ‘হালাল মালের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছে এবং তা রাখার ও ব্যবহার করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে।

     (সাক্ষদানের জন্য ন্যায়ানুগ হওয়া শর্ত:) لِتَكُوْنُوْا شُهَدَآءَ عَلَى النَّاسِ মুসলিম সম্প্রদায়কে ভারসাম্যপূর্ণ তথা ন্যায়ানুগ করা হয়েছে যাতে তারা সাক্ষদানের যোগ্য হয়। এতে বুঝা যায়, যে ব্যক্তি আদেল বা ন্যায়ানুগ নয়, সে সাক্ষ্যদানেরও যোগ্য নয়। আদেলের অর্থ সাধারণত: ‘নির্ভরযোগ্য’করা হয়। এর সম্পূর্ণ শর্ত ফেকাহ্ গ্রন্থসমুহে উল্লেখিত রয়েছে।

     ইজ্‌মা’ শরী‘আতের দলীলঃ ইমাম কুরতুবী বলেন, ইজ্‌মা’ (মুসলিম ঐকমত্য) যে শরী‘আতের একটি দলীল, আলোচ্য আয়াতটি তার প্রমাণ। কারণ, আল্লাহ তা ‘আলা এ সম্প্রদায়কে সাক্ষ্যদাতা সাব্যস্ত করে আপরাপর সম্প্রদায়ের বিপক্ষে তাদের বক্তব্যকে দলীল করে দিয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ সম্প্রদায়ের ইজমা’ বা ঐকমত্যও একটি দলীল এবং তা পালন করা ওয়াজিব। সা‘হাবীগণের ইজমা’ তাবে‘য়ীগণের জন্যে এবং তাবে ‘য়ীগণের ইজমা’ তাঁদের পরবর্তীদের জন্যে দলীল স্বরূপ।

     তাফসীরে মাজহারীতে বর্ণিত আছে: এ আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ সম্প্রদায়ের যেসব ক্রিয়াকর্ম সর্বসম্মত, তা আল্লাহ্‌র কাছে প্রশংসনীয় ও গ্রহণীয়।.কারণ, যদি মনে করা হয় যে, তারা ভ্রান্ত বিষয়ে একমত হয়েছে, তবে তাদের নির্ভরযোগ্য সম্প্রদায় বলার কোন অর্থ থাকে না।

     ইমাম জাস্সাস বলেন: এই আয়াতের দ্বারা প্রমাণীত হয় যে, প্রত্যেক যুগের মুসলমানদের ইজমা’ই আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণীয়। ‘ইজমা’ শরী‘আতের দলীল’ -এ কথাটি শতাব্দী অথবা বিশেষ কোন যুগের সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত নয়। কারণ, আয়াতে সমগ্র সম্প্রদায়কেই সম্বোধন করা হয়েছে। যারা আয়াত নাযিলের সময়ে বিদ্যমান ছিলেন, তাঁরাই শুধু মুসলিম সম্প্রদায় নন; বরং কিয়ামত পর্যন্ত যত মুসলমান আসবে, তারা সবাই মুসলিম সম্প্রদায়ভূক্ত। সুতরাং প্রতি যুগের মুসলমানই ‘আল্লাহ্‌র সাক্ষ্যদাতা’। তাদের উক্তি দলীল। তারা কোন ভুল বিষয়ে একমত হতে পারে না।

     কাবা শরীফ সর্বপ্রথম কখন নামাযের কেবলা হয়: হিজরতের পূর্বে মক্কা মোকার্‌রমায় যখন নামায ফরয হয়, তখন কা’বা গৃহই নামাযের জন্য কেবলা ছিল, না বাইতুল-মোকাদ্দাস ছিল- এ প্রশ্নে সা‘হাবী ও তাবে‘য়ীগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেনঃ ইসলামের শুরু থেকেই কেবলা ছিল বাইতুল-মোকাদ্দাস। হিজরতের পরও ষোল-সতের মাস পর্যন্ত বাইতুল-মোকাদ্দাসই কেবলা ছিল। এরপর কা’বাকে কেবলা করার নির্দেশ আসে। তবে রসুল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কায় অবস্থানকালে ‘হাজ্‌রে-আসওয়াদ ও রুক্‌নে-ইয়ামানীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন যাতে কা’বা ও বাইতুল-মোকাদ্দাস উভয়টিই সামনে থাকে। মদীনায় পৌঁছার পর এরূপ করা সম্ভবপর ছিল না। তাই তাঁর মনে কেবলা পরিবর্তনের বাসনা দানা বাঁধতে থাকে। -(ইবনে-কাসীর)

     অন্যান্য সা‘হাবা ও তাবে‘য়ীগণ বলেন: মক্কায় নামায ফরয হওয়ার সময় কা’বা গৃহই ছিল মুসলমানদের প্রাথমিক কেবলা। কেননা, হযরত ইবরাহীম ও ইসমাইল (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর কেবলাও তাই ছিল। মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মক্কায় অবস্থানকালে কা’বাগৃহের দিকে মুখ করেই নামায পড়তেন।

     মদীনায় হিজরতের পর তাঁর কেবলা বাইতুল-মোকাদ্দাস সাব্যস্ত হয়। তিনি মদীনায় ষোল/সতের মাস পর্যন্ত বাইতুল-মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়েন। এরপর প্রথম কেবলা অর্থাৎ, কা’বাগৃহের দিকে মুখ করার নির্দেশ অবতীর্ণ হয়।

     বানু-সালামার মুসলমানরা যোহর অথবা ‘আসরের নামায থেকেই কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ কার্যকর করে নেন। কিন্তু কেবলার মসজিদে এ সংবাদ পরদিন ফজরের নামাযে পৌঁছালে তারাও নামাযের মধ্যেই বাইতুল-মোকাদ্দাসের দিক থেকে কা’বার দিকে মুখ করে নেন।- (ইবনে-কাসীর, জাস্সাস)।

         وَمَاكَانَ اللّٰهُ لِيُضِيْعَ إيْمَانَكُمْ – এখানে ‘ঈমান’ শব্দ দ্বারা ঈমানের প্রচলিত অর্থ নেয়া হলে আয়াতের মর্ম হবে এই যে, কেবলা পরিবর্তনের ফলে নির্বোধেরা মনে করতে থাকে যে, এরা ধর্ম ত্যাগ করেছে কিংবা এদের ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে। উত্তরে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ঈমান নষ্ট করবেন না। কাজেই তোমরা নির্বোধদের কথায় কর্ণপাত করো না।

     কোন কোন ‘হাদীসে এবং মনীষীদের উক্তিতে এখানে ঈমানের অর্থ করা হয়েছে নামায। মর্মার্থ এই যে, সাবেক কেবলা বাইতুল-মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে যেসব নামায পড়া হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা সেগুলো নষ্ট করবেন না; বরং তা শুদ্ধ ও মকবুল হয়েছে।

     স‘হীহ বুখারীতে ইবনে-আ’যেব (রদ্বিয়াল্ল-হ ‘আনহু) এবং তিরমিযীতে ইবনে-‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হ ‘আনহু) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, কা’বাকে কেবলা করার পর অনেকেই প্রশ্ন করে যে, যেসব মুসলমান ইতিমধ্যেই ইন্তেকাল করেছেন, তাঁরা বাইতুল-মুকাদ্দাসের দিকে নামায পড়ে গেছেন- কা’বার দিকে নামায পড়ার সুযোগ পাননি, তাঁদের কি হবে? এ প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। এতে নামাযকে ‘ঈমান’ শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, তাদের সব নামাযই শুদ্ধ ও গ্রহণীয়। তাদের ব্যপারে কেবলা পরিবর্তনের কোন প্রতিক্রিয়া হবে না।

     আলোচ্য ১৪৪তম আয়াতের প্রথম বাক্যে কা’বার প্রতি রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আকর্ষণ এবং এর বিভিন্ন কারণ বর্ণিত হয়েছে। এসব কারণের মধ্যে কোন বিরোধ নেই- সবই সম্ভবপর। উদাহরণতঃ মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও‘হী অবতরণ ও নবুওয়াত-প্রাপ্তির পূর্বে স্বীয় স্বভাবগত ঝোঁকে দ্বীনে-ইবরাহিমীর অনুসরণ করতেন। ও‘হী অবতরণের পর কুরআনও তাঁর শরী‘আতকে দ্বীনে-ইবরাহিমীর অনুরূপ বলেই আখ্যা দিয়েছে। হযরত ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল (‘আলাইহিমাচ্ছালাম)-এর কেবলাও কা’বাই ছিল।

     আরও কারণ ছিল এই যে, ‘আরব গোত্রগূলো মৌখিকভাবে হলেও দ্বীনে-ইবরাহীমী স্বীকার করত এবং নিজেদেরকে তার অনুসারী বলে দাবী করত। ফলে কা’বা মুসলমানদের কেবলা হয়ে গেলে তারা ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারত। সাবেক কেবলা বাইতুল-মোকাদ্দাস দ্বারা আহলে-কিতাবদের আকৃষ্ট করা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ষোল/সতের মাসের অভিজ্ঞতার পর সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। কারণ, মদীনার ঈহুদীরা এর কারণে ইসলামের নিকটবর্তী হওয়ার পরিবর্তে দূরেই সরে যাচ্ছিল।

     মোটকথা, কা’বা মুসলমানদের কেবলা সাব্যস্ত হোক- এটাই ছিল মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আন্তরিক বাসনা। তবে আল্লাহ্‌র নৈকট্যশীল পয়গম্বর/নবীগণ কোন দরখাস্ত ও বাসনা পেশ করার অনুমতি আছে বলে, না জানা পর্যন্ত আল্লাহ্‌র দরবারে কোন দরখাস্ত ও বাসনা পেশ করেন না। এতে বুঝা যায় যে, মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ দু‘আ করার অনুমতি পূর্বাহ্নেই পেয়েছিলেন। এজন্য তিনি কেবলা পরিবর্তনের দু‘আ করেছিলেন এবং তা কবুল হবে বলে আশাবাদীও ছিলেন। একারণেই তিনি বারবার আকাশের দিকে চেয়ে দেখতেন যে, ফেরেশতা নির্দেশ নিয়ে আসছে কিনা। আলোচ্য আয়াতে এ দৃশ্যটি বর্ণনা করার পর প্রথমে দু‘আ কবুল করার ওয়াদা করা হয়- فَلَنُوَلِّيَنَّكَ অর্থাৎ- আমি আপনার চেহারা-মোবারক সেদিকেই ফিরিয়ে দেব, যেদিকে আপনি পছন্দ করেন। অতঃপর তৎক্ষণাৎ সে দিকে মুখ করার আদেশ নাযিল করা হয়, যথা, فَوَلِّ وَجْهَكَ এর বর্ণনা পদ্ধতিটি বিশেষ আনন্দদায়ক। এতে প্রথমে ওয়াদার আনন্দ ও পরে ওয়াদা পূরণের আনন্দ একই সাথে উপভোগ করা যায়।

     নামাযে কেবলামূখী হওয়ার মাসআলা: পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের কাছে সবদিকই সমান- قُلْ لِلّٰهِ الْمَشْرِقُ والْمَغْرِبُ পূর্ব-পশ্চিম আল্লাহ্‌রই মালিকানাধীন। কিন্তু উম্মতের স্বার্থে সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্যে একটি দিককে কেবলা হিসাবে নির্দিষ্ট করে সবার মাঝে ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তবে এ দিকটি বাইতুল-মোকাদ্দাসও হতে পারত। কিন্তু মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আন্তরিক বাসনার কারণে কা’বাকে কেবলা সাব্যস্ত করে আলোচ্য আয়াতে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখানে فَوَلِّ وَجْهَكَ إلَى الْكَعْبَة অর্থাৎ, ‘কা’বার দিকে অথবা বাইতুল্লাহ্‌র দিকে মুখ কর’ বলার পরিবর্তে شَطْرَالْمَسْجِدِالْحَرَامِ  (অর্থাৎ মাসজিদে ‘হারামের দিকে) বলা হয়েছে। এতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা স্পষ্ট হয়ে গেছে।

     প্রথমত: ‍যদিও আসল কেবলা বাইতুল্লাহ তথা কা’বা; কিন্তু কা’বার দিকে মুখ করা সেখান পর্যন্তই সম্ভব, যেখান থেকে তা দৃষ্টিগোচর হয়। যারা সেখান থেকে দূরে এবং কা’বা তাদের দৃষ্টির অগোচরে থাকে, তাদের উপরও হুবহু কা’বার দিকে মুখ করার কড়াকড়ি আরোপ করা হলে, তা পালন করা খুবই কঠিন হতো। বিশেষ যন্ত্রপাতি ও অঙ্কের মাধ্যমেও নির্ভুল দিক নির্ণয় করা দূরবর্তী অঞ্চলসমূহে অনিশ্চিত হয়ে পড়তো। অথচ শরী‘আত সহজ-সরল  ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ কারণে বাইতুল্লাহ অথবা কা’বা শব্দের পরিবর্তে মাসজিদুল-‘হারাম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বাইতুল্লাহ অপেক্ষা মাসজিদুল ‘হারাম অনেক বেশি স্থান জুড়ে বিস্তৃত। এ বিস্তৃত স্থানের দিকে মুখ করা দূর-দূরান্তের মানুষের জন্যেও সহজ।

     সংক্ষিপ্ত শব্দ إلى এর পরিবর্তে شطر শব্দটি ব্যবহার করায় কেবলার দিকে মুখ করার ব্যাপারটি আরও সহজ হয়ে গেছে। شطر দু’অর্থে ব্যবহৃত হয়- বস্তুর অর্ধাংশ ও বস্তুর দিক। আলোচ্য আয়াতে এর অর্থ হচ্ছে বস্তুর দিক। এতে বুঝা যায় যে, দূরবর্তী দেশসমূহে বা অঞ্চলে বিশেষভাবে মাসজিদে-‘হারামের দিকে মুখ করাও জরুরী নয়; বরং মাসজিদে-‘হারাম যেদিকে অবস্থিত  সে দিকের প্রতি মুখ করাই যথেষ্ট।- (বা‘হরে-মু‘হীত)

          وَمَاأَنْتَ بِتَابِعٍ قِبْلَتَهُمْ আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে যে, খানায়ে-কা’বা কিয়ামত পর্যন্ত আপনার কেবলা থাকবে। এতে ইহুদী-নাসারাদের সে মতবাদের খণ্ডন করাই ছিল উদ্দেশ্য যে, মুসলমানদের কেবলার কোন স্থিতি নেই; ইতিপূর্বে তাদের কেবলা ছিল খানায়ে-কা’বা, পরিবর্তিত হয়ে বাইতুল-মোকাদ্দাস হল,

     আবার তাও বদলে গিয়ে পুনরায় খানায়ে-কা’বা হলো। আবারও হয়তো বাইতুল-মোকাদ্দাসকেই কেবলা বানিয়ে নেবে।- (বা‘হরে-মু‘হীত)

         وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ এখানে অসম্ভবকে সম্ভব ধরে নিয়ে হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি দ্বারা উম্মতে-মু‘হাম্মদীকে অবহিত করাই উদ্দেশ্য যে, উল্লেখিত নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ এতই কঠিন ব্যাপার যে, স্বয়ং রসূলে-কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-ও যদি এমনটি করেন, (অবশ্য তা অসম্ভব), তবে তিনিও সীমা লঙ্ঘনকারী বলে সাব্যস্ত হবেন।

     ১৪৬ নং আয়াতে রসূলে-কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে রসূল হিসাবে চেনার উদাহরণ সন্তানদের চেনার সাথে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এরা যেমন কোনরকম সন্দেহ-সংশয়হীনভাবে নিজেদের সন্তানদেরকে জানে, তেমনিভাবে তাওরাত ও ইঞ্জীলে বর্ণিত রসূলে কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুসংবাদ, প্রকৃষ্ট লক্ষণ ও নিদর্শনাবলীর মাধ্যমে তাঁকেও সন্দেহাতীতভাবেই চেনে। কিন্তু তাদের যে অস্বীকৃতি তা একান্তভাবেই হঠকারিতা ও বিদ্বেষপ্রসূত।

     এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, পরিপূর্ণভাবে চেনার উদাহরণ পিতা-মাতাকে চেনার সাথে না দিয়ে সন্তান-সন্ততিকে চেনার সাথে দেয়া হয়েছে। অথচ মানুষ স্বভাবতঃ পিতা-মাতাকেও অত্যন্ত ভাল করেই জানে। এহেন উদাহরণ দেয়ার কারণ হল এই যে, পিতা-মাতার নিকট সন্তানাদির পরিচয় সন্তানের নিকট পিতা-মাতার পরিচয় অপেক্ষা বহুগুণ বেশি হয়ে থাকে। কারণ, পিতা-মাতা জন্মলগ্ন থেকে সন্তান-সন্ততিকে স্বহস্তে লালন-পালন করে। তাদের শরীরের এমন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই, যা পিতা-মাতার দৃষ্টির অন্তরালে থাকতে পারে। পক্ষান্তরে পিতা-মাতার গোপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সন্তানরা কখনও দেখে না।

ٱلۡحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡمُمۡتَرِينَ ١٤٧

১৪৭.বাস্তব সত্য সেটাই যা তোমার পালনকর্তা বলেন। কাজেই তুমি সন্দিহান হয়ো না।

وَلِكُلّٖ وِجۡهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَاۖ فَٱسۡتَبِقُواْ ٱلۡخَيۡرَٰتِۚ أَيۡنَ مَا تَكُونُواْ يَأۡتِ بِكُمُ ٱللَّهُ جَمِيعًاۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٤٨

১৪৮.আর সবার জন্যই রয়েছে ক্বিব্‌লা একেক দিকে, যে দিকে সে মুখ করে (‘ইবাদাত করবে)। কাজেই সৎকাজে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এগিয়ে যাও। যেখানেই তোমরা থাকবে, আল্লাহ্‌ অবশ্যই তোমাদেরকে সমবেত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।

وَمِنۡ حَيۡثُ خَرَجۡتَ فَوَلِّ وَجۡهَكَ شَطۡرَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۖ وَإِنَّهُۥ لَلۡحَقُّ مِن رَّبِّكَۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ١٤٩

১৪৯.আর যে স্থান থেকে তুমি বের হও, নিজের মুখ মসজিদে হারামের দিকে ফেরাও-নিঃসন্দেহে এটাই হলো তোমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে নির্ধারিত বাস্তব সত্য। বস্তুতঃ তোমার পালনকর্তা তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অনবহিত নন।

وَمِنۡ حَيۡثُ خَرَجۡتَ فَوَلِّ وَجۡهَكَ شَطۡرَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۚ وَحَيۡثُ مَا كُنتُمۡ فَوَلُّواْ وُجُوهَكُمۡ شَطۡرَهُۥ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَيۡكُمۡ حُجَّةٌ إِلَّا ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ مِنۡهُمۡ فَلَا تَخۡشَوۡهُمۡ وَٱخۡشَوۡنِي وَلِأُتِمَّ نِعۡمَتِي عَلَيۡكُمۡ وَلَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُونَ ١٥٠

১৫০.আর তোমরা যেখান থেকেই বেরিয়ে আস এবং যেখানেই অবস্থান কর, সেদিকেই মুখ ফেরাও, যাতে করে মানুষের জন্য তোমাদের সাথে ঝগড়া করার অবকাশ না থাকে। অবশ্য যারা অবিবেচক, তাদের কথা আলাদা। কাজেই তাদের আপত্তিতে ভীত হয়ো না। আমাকেই ভয় কর। যাতে আমি তোমাদের জন্যে আমার অনুগ্রহ সমূহ পূর্ণ করে দেই এবং তাতে যেন তোমরা সরলপথ প্রাপ্ত হও।

كَمَآ أَرۡسَلۡنَا فِيكُمۡ رَسُولٗا مِّنكُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡكُمۡ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمۡ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمۡ تَكُونُواْ تَعۡلَمُونَ ١٥١

১৫১.যেমন, আমি পাঠিয়েছি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে একজন রসূল, যিনি তোমাদের নিকট আমার বাণীসমুহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন; আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও তাঁর তত্ত্বজ্ঞান এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না।

فَٱذۡكُرُونِيٓ أَذۡكُرۡكُمۡ وَٱشۡكُرُواْ لِي وَلَا تَكۡفُرُونِ ١٥٢

১৫২.সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٣

১৫৩.হে মুমিন গন! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিতই আল্লাহ্‌ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।

وَلَا تَقُولُواْ لِمَن يُقۡتَلُ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ أَمۡوَٰتُۢۚ بَلۡ أَحۡيَآءٞ وَلَٰكِن لَّا تَشۡعُرُونَ ١٥٤

১৫৪.আর যারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না।

وَلَنَبۡلُوَنَّكُم بِشَيۡءٖ مِّنَ ٱلۡخَوۡفِ وَٱلۡجُوعِ وَنَقۡصٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡوَٰلِ وَٱلۡأَنفُسِ وَٱلثَّمَرَٰتِۗ وَبَشِّرِ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٥

১৫৫.এবং অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।

ٱلَّذِينَ إِذَآ أَصَٰبَتۡهُم مُّصِيبَةٞ قَالُوٓاْ إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّآ إِلَيۡهِ رَٰجِعُونَ ١٥٦

১৫৬.যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহ্‌র জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

এ বর্ণনার দ্বারা এ কথাও প্রতিয়মান হয়ে যায় যে, এখানে সন্তানকে শুধু সন্তান হিসাবে চেনাই উদ্দেশ্য নয়৷ কারণ, তার পৈতৃক সম্পর্ক ক্ষেত্রবিশেষে সন্দেহজনকও হতে পারে৷ স্ত্রীর খেয়ানতের দরুন সন্তান তার নিজের নাও হতে পারে৷ বরং এখানে আকার-অবয়বের পরিচয় জানা হলো উদ্দেশ্য৷ পুত্র-কন্যা প্রকৃতপক্ষে নিজের হোক বা নাই হোক, কিন্তু মানুষ সন্তান হিসাবে যাকে প্রতিপালন করে, তার আকার-অবয়ব চেনার ব্যাপারে কখনও সন্দেহ হয় না৷

     আলোচ্য আয়াতে কেবলা পরিবর্তনের বিষয়টি বলতে গিয়ে فول وجهك شطرالمسجدالحرام  বাক্যটি তিনবার এবং وحيث ماكنتم فولواوجوهكم شطره বাক্যটি দু’বার করে পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে৷ এর একটা সাধারণ কারণ এই যে, কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশটি বিরুধীদের জন্য তো এক হৈ-চৈয়ের ব্যাপার ছিলই, স্বয়ং মুসলমানদের জন্যও তাদের ‘ইবাদতের ক্ষেত্রে ছিল একটা বৈপ্লবিক ঘটনা৷ কাজেই এই নির্দেশটি যদি যথার্থ তাকীদ ও গুরুত্ব সহকারে ব্যক্ত করা না হতো, তাহলে মনের প্রশান্তি অর্জন হয়ত যথেষ্ট সহজ হতো না৷ আর সেজন্যই নির্দেশটিকে বার বার পুণরাবৃত্তি করা হয়েছে৷ তদুপরি এতে এরূপ ইঙ্গিতও রয়েছে যে, কেবলার এই যে পরিবর্তন, এটাই সর্বশেষ পরিবর্তন৷ এরপর পুনঃপরিবর্তনের আর কোন সম্ভাবনাই নেই৷ প্রথমবারের নির্দেশ:

     “অতঃপর তুমি তোমার মুখমন্ডল মাসজিদুল-‘হারামের দিকে ফেরাও এবং যেখানেই তুমি থাক না কেন, এরপর থেকে তুমি তোমার চেহারা সেদিকেই ফেরাবে”, -এ নির্দেশটি মুকীম (সফরে না থাকা) অবস্থায় থাকার সময়ের৷ অর্থাৎ, যখন আপনি আপনার স্থায়ী বাসস্থানে অবস্থান করেন, তখন নামাযে মসজিদুল-‘হারামের দিকে মুখ করে দাঁড়াবেন৷ এরপর সমগ্র উম্মতকে লক্ষ্য করে বলা হচ্ছে যে- وحيث ما كنتم নিজের দেশ বা সফরে যেখানেই থাক না কেন, নামাযে বায়তুল্লাহ্‌র দিকেই মুখ ফেরাবে, এ নির্দেশ শুধু মসজিদে-নববীতে নামায পড়ার বেলাতেই নয়; বরং যেকোন স্থানের লোকেরা নিজ নিজ শহরে যখন নামায পড়বে, তখন তারা মসজিদুল-‘‘হারামকেই কেবলা বানিয়ে নামায পড়বে৷

     এ নির্দেশ দ্বিতীয়বার পুনরুল্লেখ করার পূর্বে ومن حيث خرجت অর্থাৎ, “যেখানেই তুমি বের হয়ে যাও না কেন” কথাটা যোগ করে বুঝানো হয়েছে যে, নিজ নিজ বাসস্থানে মুকীম থাকা অবস্থায় যেমন তোমরা মসজিদুল-`হারামের দিকে মুখ করে নামায পড়বে, তেমনি কোথাও সফরে বের হলেও নামাযের সময় মসজিদুল-`হারামের দিকে মুখ করেই দাঁড়াবে৷

     তৃতীয়বারের পুনরুল্লেখের যৌক্তিকতা বর্ণনায় এও বলা হয়েছে যে, বিরোধীরা যাতে কথা বলতে না পারে যে, তাওরাত এবং ইঞ্জীলে তো বলা হয়েছিল যে, তাওরাত এবং ইঞ্জীলে উল্লেখিত নির্দেশসমূহের মধ্যে আখেরী যমানার প্রতিশ্রুত নবীর কেবলা মসজিদুল-‘হারাম হওয়ার কথা, কিন্তু এ রসুল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কা’বার পরিবর্তে বায়তুল-মোকদ্দাসকে কেবলা করে নামায পড়ছেন কেন?

         ولكل وجهة هو موليها শব্দটিতে وجهة শব্দটির আভিধানিক অর্থ এমন বস্তু, যার দিকে মুখ করা হয়৷ হযরত ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেন, এর অর্থ কেবলা৷ এক্ষেত্রে হযরত উবাই ইবনে কা’ব-

وجهة -এর স্থলে قبلة ও পড়েছেন বলে বর্ণিত রয়েছে৷

     তাফসীরের ইমামগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় এই, –প্রত্যেক জাতিরই ‘ইবাদতের সময় মুখ করার জন্য একটা নির্ধারিত কেবলা চলে আসছে৷ সে কেবলা আল্লাহ্‌র তরফ হতে নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে, অথবা তারা নিজেরাই তা নির্ধারণ করে নিয়েছে৷ মোটকথা, ‘ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রত্যেক জাতিই কোন না কোন দিকে মুখ করে দাঁড়ায়৷ এমতাবস্থায় আখেরী নবীর উম্মতগণের জন্য যদি কোন একটা বিশেষ দিককে কেবলা নির্ধারণ করে দেয়া হয়ে থাকে, তবে তাতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কি আছে?

     এ পর্যন্ত কেবলা পরিবর্তনসংক্রান্ত আলোচনা চলে আসছিল৷ এখানে বিষয়টিকে এমন এক পর্যায়ে এনে সমাপ্ত করা হয়েছে, যাতে এ বিষয়টির ভূমিকায় কা’বা নির্মাতা হযরত ইবরাহীমের দু‘আর বিষয়টিও প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হয়ে গেছে৷ অর্থাৎ, হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর বংশধরদের মধ্যে এক বিশেষ মর্যাদায় মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আবির্ভাব৷ এতে এ বিষয়েও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রসূলে কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আবির্ভাবে কা’বা নির্মাতার দু‘আরও একটা প্রভাব রয়েছে৷ কাজেই তাঁর কেবলা যদি কা’বা শরীফকে সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে তাতে বিস্ময়ের কিংবা অস্বীকারের কিছুই নেই৷

         كما ارسلنا -বাক্যে উদাহরণসূচক যে ‘কাফ’ (ك) বর্ণটি ব্যবহার করা হযেছে, তার একটি ব্যাখ্যা তো উল্লেখিত তাফসীরের মাধ্যমেই বুঝা গেছে৷ এছাড়াও আরেকটি বিশ্লেষণ রয়েছে, যা কুরতুবী গ্রহণ করেছেন৷ তা হল এই যে, ‘কাফ’ -এর সম্পর্ক হল পরবর্তী আয়াত فاذكروني -এর সাথে৷ অর্থাৎ, আমি যেমন তোমাদের প্রতি কেবলাকে একটি নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামত হিসাবে দান করেছি এবং অতঃপর দ্বিতীয় নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামত দিয়েছি রসূলের আবির্ভাবের মাধ্যমে, তেমনি আল্লাহ্‌র যিকিরও আরেকটি নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামত৷

     এসব নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামতের শুকরিয়া/কৃতজ্ঞতা আদায় কর, যাতে এসব নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামতের অধিকতর প্রবৃদ্ধি হতে পারে৷ কুরতুবী বলেন, এখানে كما ارسلنا-এর ‘কাফ’টির ব্যবহার ঠিক তেমনি, যেমনটি সূরা আনফালের كمااخرجنا এবং সূরা ‘হিজরের كماانزلنا على المقتسمين -এর মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে৷ فاذكروني اذكركم এতে ‘যিকির’-এর অর্থ হল স্মরণ করা, যার সম্পর্ক হল অন্তরের সাথে৷ তবে জিহ্বা যেহেতু অন্তরের মুখপাত্র, কাজেই মুখে স্মরণ করাকেও ‘যিকির’ বলা যায়৷ এতে বুঝা যায় যে, সে মৌখিক যিকিরই গ্রহণযোগ্য, যার সাথে মনেও আল্লাহ্‌র স্মরণ বিদ্যমান থাকবে৷

     তবে এতদসঙ্গে একথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, কোন লোক যদি মুখে তাসবী‘হ জপে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু তার মন যদি অনুপস্থিত থাকে অর্থাৎ,যিকিরে না লাগে, তবুও তা একেবারে ফায়দাহীন নয়৷ হযরত আবু ‘উসমান (র‘হমাতুল্ল-হি ‘আলাইহি)-এর কাছে জনৈক ভক্ত এমনি অবস্থায় অভিযোগ করছিল যে, মুখে মুখে যিকির করি বটে, কিন্তু অন্তরে তার কোনই মাধুর্য অনুভব করতে পারি না৷ তখন তিনি বললেন, -তবুও আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় কর যে, তিনি তোমার একটি অঙ্গ জিহ্বাকে তো অন্ততঃ তাঁর যিকিরে নিয়োজিত করেছেন৷-(কুরতুবী)

     যিকিরের ফযীলতঃযিকিরের ফযীলত অসংখ্য৷ তন্মধ্যে এটাও কম ফযীলত নয় যে, বান্দা যদি আল্লাহকে স্মরণ করে, তাহলে আল্লাহ তাকে স্মরণ করেন৷ আবু ‘উসমান মাহদী (র‘হমাতুল্ল-হি ‘আলাইহি) বলেছেন যে, আমি সে সময়টির কথা জানি, যখন আল্লাহ তা’আলা আমাদিগকে স্মরণ করেন৷ উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আপনি তা কেমন করে জানতে পারেন? বললেন, তা এজন্যে যে, কুরআন কারীমের ওয়াদা অনুসারে যখন কোন মু’মিন বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ নিজেও তাকে স্মরণ করেন৷ কাজেই বিষয়টি জানা সবার জন্যই সহজ যে, আমরা যখন আল্লাহ্‌র স্মরণে আত্মনিয়োগ করব, আল্লাহ তা’আলাও আমাদের স্মরণ করবেন৷

     আর আয়াতের অর্থ হল এই যে, তোমরা যদি আমাকে আমার হুকুমের আনুগত্যের মাধ্যমে স্মরণ কর, তাহলে আমিও তোমাদেরকে ছাওয়াব ও মাগফিরাত দানের মাধ্যমে স্মরণ করব৷

     হযরত সা‘ঈদ ইবনে জুবাইর (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) ‘যিক্‌রুল্লাহ’র তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যিকির অর্থই হচ্ছে আনুগত্য এবং নির্দেশ মান্য করা৷ তাঁর বক্তব্য হচ্ছে: “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নির্দেশের আনুগত্য করে না, সে আল্লাহ্‌র যিকিরই করে না; প্রকাশ্যে যত বেশী নামায এবং তাসবী‘হই সে পাঠ করুক না কেন৷”

‘যিকিরের তাৎপর্য: মুফাস্সির কুরতুবী ইবনে-খুয়াইয-এর আ‘হকামুল কুরআনের বরাত দিয়ে এ সম্পর্কিত একখানা ‘হাদীসও উদ্ধৃত করেছেন৷ ‘হাদীসটির মর্মার্থ হচ্ছে যে, রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য করে অর্থাৎ, তাঁর ‘হালাল ও ‘হারাম সম্পর্কিত নির্দেশগুলোর অনুসরণ করে, যদি তার নফল নামায-রোযা কিছু কমও হয়, সেই আল্লাহকে স্মরণ করে৷ অন্যদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধাচরণ করে, সে নামায-রোযা, তাসবী‘হ-তা‘হলীল প্রবৃতি বেশী করে করলেও প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহকে স্মরণ করে না৷

     হযরত যুন্নুন মিসরী বলেন: “যে ব্যক্তি প্রকৃতই আল্লাহকে স্মরণ করে সে অন্যান্য সব কিছুই ভুলে যায়৷ এর বদলায় স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই সবদিক দিয়ে তাকে হেফাযত করেন এবং সব কিছুর বদলা তাকে দিয়ে দেন৷”

     হযরত মু’আয (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেন: “আল্লাহর ‘আযাব থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে মানুষের কোন ‘আমলই যিকরুল্লাহ্‌র সমান নয়৷” হযরত আবু হুরায়রা (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বর্ণিত এক হদীসে-কুদসীতে আছে, আল্লাহ তা’আলা বলেন,– “বান্দা যে পর্যন্ত আমাকে স্মরণ করতে থাকে বা আমার স্মরণে যে পর্যন্ত তার ঠোঁট নড়তে থাকে, সে পর্যন্ত আমি তার সাথে থাকি৷

     ধৈর্য ও নামায যাবতীয় সংকটের প্রতিকার: استعينوا بالصبر والصلوة “ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর,” -এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট, যাবতীয় প্রয়োজন ও সমস্ত সংকটের নিশ্চিত প্রতিকার দু’টি বিষয়ের মধ্যেই নিহিত৷ একটি ‘সবর’ বা ধৈর্য এবং অন্যটি “নামায”৷ বর্ণনারীতির মধ্যে استعينوا শব্দটিকে বিশেষ কোন বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট না করে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করার ফলে এখানে যে মর্মার্থ দাঁড়ায় তা এই যে, মানব জাতির যে কোন সংকট বা সমস্যার নিশ্চিত প্রতিকারই ধৈর্য ও নামায৷ যে কোন প্রয়োজনেই এ দু’টি বিষয়ের দ্বারা মানুষ সাহায্য লাভ করতে পারে৷      তাফসীরে মাযহারীতে শব্দ দু’টির ব্যাপক অর্থে ব্যবহারের তাৎপর্য এভাবেই বর্ণিত হয়েছে৷ প্রসঙ্গতঃ স্বতন্ত্রভাবে দুটি বিষয়েরই তাৎপর্য অনুধাবন করা যেতে পারে৷

     সবর-এর তাৎপর্য: ‘সবর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সংযম অবলম্বন ও নফ্‌স-এর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ।

     কুরআন ও ‘হাদীসেরর পরিভাষায় ‘সব্‌র’ (ধৈর্য)–এর তিনটি শাখা রয়েছে। (এক) নফ্‌সকে ‘হালাল এবং না-জায়েয বিষয়াদি থেকে বিরত রাখা (দুই) ‘ইবাদাত ও আনুগত্যে বাধ্য করা এবং (তিন) যে কোন বিপদ ও সংকটে ধৈর্যধারণ করা। অর্থাৎ, যে সব বিপদ-আপদ এসে উপস্থিত হয় সেগুলোকে আল্লাহ্‌র বিধান বলে মেনে নেয়া এবং এর বিনিময়ে আল্লাহ্‌র তরফ/পক্ষ থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা রাখা। অবশ্য কষ্টে পড়ে যদি মুখ থেকে কোন কাতর শব্দ উচ্চারিত হয়ে যায়, কিংবা অন্যের কাছে তা প্রকাশ করা হয়, তবে, তা ‘সব্‌র’ –এর পরিপন্থী নয়। -(ইবনে কাসীর, সা‘ঈদ ইবনে জুবায়ের থেকে)।

     ‘সব্‌র’ –এর উপরোক্ত তিনটি শাখাই প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সাধারণ মানুষের ধারণায় সাধারণতঃ তৃতীয় শাখাকেই সব্‌র হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রথম দু’টি শাখা যে এক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারে মোটেও লক্ষ্য করা হয় না। এমনকি এ দু’টি বিষয়ও যে ‘সব্‌র’- এর অন্তর্ভুক্ত এ ধারণাও যেন অনেকের নেই। কুরআন-’হাদীসের পরিভাষায় ধৈর্যধারণকারী বা ‘সাবের’(সব্‌রকারী) সে সমস্ত লোককেই বলা হয়, যারা উপরোক্ত তিন প্রকারেই ‘সব্‌র’ অবলম্বন করে। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে, হাশরের ময়দানে ঘোষণা করা হবে, “ধৈর্যধারণকারীরা কোথায়?” একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেসব লোক উঠে দাঁড়াবে, যারা তিন প্রকারেই সব্‌র করে জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। এসব লোককে প্রথমেই বিনা হিসাবে বেহেশতে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে। ‘ইবনে-কাসীর’ এ বর্ণনা উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন যে, কুরআনের অন্যত্র-

إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ

অর্থাৎ, সব্‌রকারী বান্দাগণকে তাদের পুরস্কার বিনা হিসাবে প্রদান করা হবে- এ আয়াতে সেদিকেই ইশারা/ইঙ্গিত করা হয়েছে।

     নামায: মানুষের যাবতীয়  সমস্যা ও সংকট দূর করা এবং যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পন্থাটি হচ্ছে নামায/সলাত।

     ‘সব্‌র’ –এর তাফসীর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সর্বপ্রকার ‘ইবাদাতই সব্‌রের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এরপরেও নামায/সলাতকে পৃথকভাবে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে যে, নামায/সলাত এমনই একটি ‘ইবাদাত, যাতে ‘সব্‌র’ তথা ধৈর্যের পরিপূর্ণ নমুনা বিদ্যমান। কেননা, নামায/সলাতের মধ্যে একাধারে যেমন নফ্‌স তথা রিপুকে আনুগত্যে বাধ্য রাখা হয়, তেমনি যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজ, নিষিদ্ধ চিন্তা এমনকি অনেক ‘হালাল ও মুবা‘হ বিষয় থেকেও সরিয়ে রাখা হয়। সেমতে নিজের ‘নফ্‌স’ –এর উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করে সর্বপ্রকার গোনাহ্‌ ও অশোভন আচার-আচরণ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও নিজেকে আল্লাহ্‌র ‘ইবাদাতে নিয়োজিত রাখার মাধ্যমে ‘সব্‌র’ –এর যে অনুশীলন করতে হয়, নামায/সলাতের মধ্যেই তার একটা পরিপূর্ণ নমুনা ফুটে উঠে।

     যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করা এবং সর্বপ্রকার বিপদাপদ থেকে মুক্তিলাভ করার ব্যাপারে নামায/সলাতের একটা বিশেষ ‘তা’ছীর’ বা প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ বিশেষ রোগে কোন কোন অষুধী গুল্ম-লতা ও ডাল-শিকড় গলায় ধারণ করায় বা মুখে রাখায় যেমন বিশেষ ফল লক্ষ্য করা যায়, লোহার প্রতি চুম্বকের বিশেষ আকর্ষণ যেমন স্বাভাবিক, কিন্তু কেন এরূপ হয়, তা যেমন সবিস্তারে ব্যাখ্যা করে বলা যায় না, তেমনি বিপদ মুক্তি এবং যাবতীয় প্রয়োজন মিটানোর ক্ষেত্রে নামায/সলাতের তা’ছীরও ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে এটা পরীক্ষিত সত্য যে, যথাযথ আন্তরিকতা ও মনোযোগ সহকারে নামায/সলাত আদায় করলে যেমন বিপদ মুক্তি অবধারিত, তেমনি যেকোন প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারেও এতে সুনিশ্চিত ফল লাভ হয়।

     হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাই ওয়াসাল্লাম)-এর পবিত্র অভ্যাস ছিল যে, যখনই তিনি কোন কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতেন, তখনই নামায/সলাত আরম্ভ করতেন। আর আল্লাহ্‌ তা‘আলা সে নামায/সলাতের বরকতেই তাঁর যাবতীয় বিপদাপদ দূর করে দিতেন। ‘হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে-

إذا حزبه أمر فزع إلى الصلاة

অর্থাৎ, মহানাবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাই ওয়াসাল্লাম)-কে যখনই কোন বিষয় চিন্তিত করে তুলত, তখনই তিনি নামায/সলাত পড়তে শুরু করতেন।

     আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য: নামায/সলাত এবং ‘সবরে’র মাধ্যমে যাবতীয় সংকটের প্রতিকার হওয়ার কারণ এই যে, এ দু’পন্থায়ই আল্লাহ্‌ তা‘আলার প্রকৃত সান্নিধ্য লাভ হয়।  إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِينَ বাক্যের দ্বারা এদিকে ইশারা করা হয়েছে যে, নামাযী এবং সব্‌রকারিগণের সাথে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্য তথা খোদায়ী শক্তির সমাবেশ ঘটে। যেখানে বা যে অবস্থায় বান্দার সাথে আল্লাহ্‌র শক্তির সমাবেশ ঘটে, সেখানে দুনিয়ার কোন শক্তি কিংবা কোন সংকটই যে টিকতে পারে না, তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন করে না। বান্দা যখন আল্লাহ্‌র শক্তিতে শক্তিমান হয়, তখন তার গতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে যায়। তার অগ্রগমন ব্যাহত করার মত শক্তি কারও থাকে না। বলাবাহুল্য, মকসুদ হাসিল করা এবং সংকট উত্তরণের নিশ্চিত উপায় একমাত্র আল্লাহ্‌র শক্তিতে শক্তিমান হওয়াই হতে পারে।

     আলমে-বরযখে নাবী এবং শহীদগণের  হায়াত: ইসলামী রেওয়ায়াত মোতাবেক প্রত্যেক মৃতব্যক্তি আলমে-বরযখে বিশেষ ধরনের এক হায়াত বা জীবন প্রাপ্ত হয় এবং সে জীবনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কবরের ‘আযাব ও ছাওয়াব অনুভব করে থাকে। এই জীবন-প্রাপ্তির ব্যাপারে মু’মিন-কাফের এবং পূণ্যবান ও গোনাহগারের কোন পার্থক্য নেই। তবে বরযখের এ জীবনের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। এক স্তরে সর্বশ্রেণীর লোকই সমানভাবে শরীক। কিন্তু বিশেষ এক স্তর নাবী-রসূল এবং বিশেষ নেককার বান্দাদের জন্য নির্ধারিত। এ স্তরেও অবশ্য বিশেষ পার্থক্য এবং পরস্পরের বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

     যেসব লোক আল্লাহ্‌র রাস্তায় নিহত হন তাঁদেরকে শহীদ বলা হয়। সাধারণভাবে অবশ্য তাঁদের মৃত বলাও জায়েয। তবে তাঁদের মৃত্যুকে অন্যান্যদের মৃত্যুর সমপর্যায়ভুক্ত মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে।  কেননা, মৃত্যুর পর প্রত্যেকেই বরযখের জীবন লাভ করে থাকে এবং সে জীবনের পুরস্কার অথবা শাস্তি ভোগ করে থাকে। কিন্তু শহীদগণকে সে জীবনে অন্যান্য মৃতের তুলনায় একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদা দান করা হয়। তাহল অনুভূতির বৈশিষ্ট্য, অন্যান্য মৃতের তুলনায় তাঁদের বেশী অনুভূতি দেয়া হয়। যেমন, মানুষের পায়ের গোঁড়ালী ও হাতের আঙ্গুলের অগ্রভাগ, উভয় স্থানেই অনুভূতি থাকে, কিন্তু গোঁড়ালীর তুলনায় আঙ্গুলের অনুভূতি অনেক বেশী তীক্ষ্ণ। তেমনি, সাধারণ মৃতের তুলনায় শহীদগণ বরযখের জীবনে বহুগুন বেশী অনুভূতি প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। এমনকি শহীদের এ জীবনানুভূতি অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের জড়দেহেও এসে পৌঁছে থাকে। অনেক সময় তাঁদের হাড়-মাংসের দেহ পর্যন্ত মাটিতে বিনষ্ট হয় না, জীবিত মানুষের দেহের মতই অবিকৃত থাকতে দেখা যায়। ‘হাদীসেরর বর্ণনা এবং বহু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় এর যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণেই শহীদগণকে জীবিত বলা হয়েছে। তবে সাধারণ নিয়মে তাঁদেরকেও মৃতই ধরা হয় এবং তাঁদের পরিত্যক্ত সম্পদ ওয়ারিসগণের মধ্যে বন্টিত হয়, তাঁদের বিধবাগণ অন্যের  সাথে পুনর্বিবাহ করতে পারে।

     এ আয়াতের ক্ষেত্রে নাবী-রসূলগণ শহীদগণের চাইতেও অনেক বেশী মর্তবা/সম্মানের অধিকারী হয়ে থাকেন। তাঁদের পবিত্র দেহ সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় থাকার পরও বাহ্যিক হুকুম, আহ্‌কামে তার কিছু প্রভাব অবশিষ্ট থাকে। যথা, তাঁদের পরিত্যক্ত কোন সম্পদ বণ্টন করার রীতি নেই। তাঁদের স্ত্রিগণ দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হতে পারেন না।

     মোটকথা, বরযখের এ জীবনে সর্বাপেক্ষা শক্তিসম্পন্ন হচ্ছেন  নাবী-রসূলগণ, অতঃপর শহীদগণ এবং তারপর অন্যান্য সাধারণ মৃত ব্যক্তিবর্গ। অবশ্য কোন কোন ‘হাদীসের দ্বারা জানা যায় যে, ওলী-আওলিয়া এবং নেককার বান্দাগণের অনেকেই বরযখের হায়াতের ক্ষেত্রে শহীদগণের সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে থাকেন। কেননা, আত্মশুদ্ধির সাধনায় রত অবস্থায় যাঁরা মৃত্যুবরণ করেন, তাঁদের মৃত্যুকেও শহীদের মৃত্যু বলা যায়। ফলে তাঁরাও শহীদগণেরই পর্যায়ভুক্ত হয়ে যান। আয়াতের মর্মার্থ অনুযায়ী নিঃসন্দেহে অন্যান্য নেক্কার সালেহগণের তুলনায় শহীদগণের মর্যাদা বেশী।

     যদি কোন শহীদের লাশ মাটিতে বিনষ্ট হতে দেখা যায়, তাহলে এমন ধারণা করা যেতে পারে যে, আল্লাহ্‌র পথে সে নিহত হয়েছে সত্য, তবে হয় তো নিয়ত বিশুদ্ধ না থাকায় তার সে মৃত্যু যথার্থ শহীদের মৃত্যু হয়নি। কিন্তু এমন কোন শহীদের লাশ যদি মাটির নিচে বিনষ্ট অবস্থায় পাওয়া যায়, আল্লাহ্‌র পথে শহীদ হওয়ার ব্যাপারে যার নিষ্ঠায় কোন সন্দেহ নেই, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্য এমন ধারণা করা উচিত হবে না যে, তিনি শহীদ নন অথবা কুরআনের আয়াতের মর্মার্থ এখানে টিকছে না। কেননা, মানুষের লাশ যে কেবলমাত্র মাটিতেই বিনষ্ট হয় তাই নয়। অনেক সময় ভূম্নিস্থ অন্যান্য ধাতু কিংবা অন্য কোন কিছুর প্রভাবেও জড়দেহ বিনষ্ট হওয়া সম্ভব। নাবী-রসূল ও শহীদগণের লাশ মাটিতে ভক্ষণ করে না বলে ‘হাদীসের যে বর্ণনা রয়েছে, তাতে একথা বুঝা যায় না যে, মাটি ছাড়া তাদের লাশ অন্য কোন ধাতু কিংবা রাসায়নিক প্রভাবেও বিনষ্ট হতে পারে না।

     নাবী-রসূলগণের পবিত্র দেহও যে সাধারণ মানব-দেহের মত বিভিন্ন উপকরণের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছে একথার প্রমান পাওয়া যায়। সুতরাং তাঁদের দেহও অস্ত্রের আঘাত কিংবা ওষুধের প্রভাবে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাবান্বিত হয়েছে। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার যে, নাবী-রসূলগণের মৃত্যু পুর্ববর্তী জীবনের তুলনায় শহীদগণের মৃত্যু পূর্ববর্তী জীবন বেশী শক্তিসম্পন্ন হতে পারে না। নাবী-রসূলগণের জীবিত দেহে অস্ত্র এবং অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদানের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ রয়েছে। সুতরাং মাটির সাথে মিশ্রিত অন্য কোন রাসায়নিক পদার্থ কিংবা অন্য কোন উপাদানের প্রভাবে যদি শহীদের লাশে কোন প্রকার বিকৃতি  ঘটে যায়, তবে এর দ্বারা ‘মাটি শহীদের লাশে বিকৃতি ঘটাতে পারে না’ – এ ‘‘হাদীসেরর যথার্থতা বিঘ্নিত হয় না।

     সাধারণ মৃতের তুলনায় শহীদের লাশ অধিককাল পর্যন্ত মাটির দ্বারা প্রভাবান্বিত না হওয়াকে তাদের একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে। সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম দু’অবস্থাতেই হতে পারে। প্রথমত: চিরকাল জড়দেহে অবিকৃত থাকার মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়ত: অন্যান্যের তুলনায় অনেক বেশীদিন অবিকৃত থাকার মাধ্যমে। যদি বলা হয় যে, তাঁদের দেহও সাধারণ লোকের দেহের তুলনায় আশ্চর্যজনকভাবে বেশীদিন অবিকৃত  থাকে এবং ‘হাদীসের দ্বারা একথাই বুঝানো হয়েছে; তবে তাও অবাস্তব হবে না। যেহেতু বরযখের অবস্থা মানুষের সাধারণ পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করা যায় না, সেহেতু কুরআন শহীদের সে জীবন সম্পর্কে لَا تَشْعُرُوْنَ ( তোমরা বুঝতে পার না,) বলা হয়েছে। এর মর্মার্থ হল এই যে, সে জীবন সম্পর্কে অনুভব করার মত অনুভূতি তোমাদের দেয়া হয়নি।

     বিপদে ধৈর্যধারণ:  আল্লাহ্‌ তা‘আলার তরফ থেকে বান্দাদের যে পরীক্ষা  নেয়া হয়, তার তাৎপর্য وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে। কোন বিপদে পতিত হওয়ার আগেই যদি সে সম্পর্কে সংবাদ দিয়ে দেয়া হয়, তবে সে বিপদে ধৈর্যধারণ সহজতর হয়ে যায়। কেননা, হঠাৎ করে বিপদ এসে পড়লে পেরেশানী অনেক বেশী হয়। যেহেতু আল্লাহ্‌ তা‘আলা সমগ্র উম্মতকে লক্ষ্য করেই পরীক্ষার কথা বলেছেন, সেহেতু সবার পক্ষেই অনুধাবন করা উচিত যে, এ দুনিয়া দুঃখ-কষ্ট সহ্য করারই স্থান। সুতরাং এখানে যেসব সম্ভাব্য বিপদ-আপদের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোকে অপ্রত্যাশিত কিছু মনে না করলেই ধৈর্যধারণ করা সহজ হতে পারে। পরীক্ষায় সমগ্র উম্মত সমষ্টিগতভাবে উত্তীর্ন হলে পরে সমষ্টিগতভাবেই তার পুরস্কার দেয়া হবে; এছাড়াও সব্‌রের পরীক্ষায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে যারা যতটুকু উত্তীর্ণ হবেন, তাদের ততটুকু বিশেষ মর্যাদাও প্রদান করা হবে।

     বিপদে ‘ইন্নালিল্লাহ্‌’ পাঠ করা:  আয়াতে সব্‌রকারিগণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা বিপদের সম্মুখীন হলে- ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রা-জি‘ঊন’ পাঠ করে। এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যে, কেউ বিপদে পড়লে যেন এ দু‘আটি পাঠ করে। কেননা, এরূপ বলাতে একাধারে যেমন অসীম ছাওয়াব পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি যদি অর্থের প্রতি যথাযথ লক্ষ্য রেখে পাঠ করা হয়, তবে বিপদে আন্তরিক শান্তিলাভ এবং তা থেকে উত্তরণও সহজতর হয়ে যায়।

أُوْلَٰٓئِكَ عَلَيۡهِمۡ صَلَوَٰتٞ مِّن رَّبِّهِمۡ وَرَحۡمَةٞۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُهۡتَدُونَ ١٥٧

১৫৭.তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ্‌র অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হিদায়াত প্রাপ্ত।

۞إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖ فَمَنۡ حَجَّ ٱلۡبَيۡتَ أَوِ ٱعۡتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِ أَن يَطَّوَّفَ بِهِمَاۚ وَمَن تَطَوَّعَ خَيۡرٗا فَإِنَّ ٱللَّهَ شَاكِرٌ عَلِيمٌ ١٥٨

১৫৮.নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ্‌ তা‘আলার নিদর্শন গুলোর অন্যতম। সুতরাং যারা কা’বা ঘরে হজ্ব বা ওমরাহ পালন করে, তাদের পক্ষে এ দুটিতে প্রদক্ষিণ করাতে কোন দোষ নেই। বরং কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিছু নেকীর কাজ করে, তবে আল্লাহ্‌ তা‘আলার অবশ্যই তা অবগত হবেন এবং তার সে আমলের সঠিক মুল্য দেবেন।

إِنَّ ٱلَّذِينَ يَكۡتُمُونَ مَآ أَنزَلۡنَا مِنَ ٱلۡبَيِّنَٰتِ وَٱلۡهُدَىٰ مِنۢ بَعۡدِ مَا بَيَّنَّٰهُ لِلنَّاسِ فِي ٱلۡكِتَٰبِ أُوْلَٰٓئِكَ يَلۡعَنُهُمُ ٱللَّهُ وَيَلۡعَنُهُمُ ٱللَّٰعِنُونَ ١٥٩

১৫৯.নিশ্চয় যারা গোপন করে, আমি যেসব বিস্তারিত তথ্য এবং হেদায়েতের কথা নাযিল করেছি মানুষের জন্য কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করার পরও; সে সমস্ত লোকের প্রতিই আল্লাহ্‌র অভিসম্পাত এবং অন্যান্য অভিসম্পাতকারীগণের ও।

إِلَّا ٱلَّذِينَ تَابُواْ وَأَصۡلَحُواْ وَبَيَّنُواْ فَأُوْلَٰٓئِكَ أَتُوبُ عَلَيۡهِمۡ وَأَنَا ٱلتَّوَّابُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٠

১৬০.তবে যারা তাওবাহ্‌ করে এবং বর্ণিত তথ্যাদির সংশোধন করে মানুষের কাছে তা বর্ণনা করে দেয়, সে সমস্ত লোকের তাওবাহ্‌ আমি ক্ববূল করি এবং আমি তাওবাহ্‌ ক্ববূলকারী পরম দয়ালু।

إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ وَمَاتُواْ وَهُمۡ كُفَّارٌ أُوْلَٰٓئِكَ عَلَيۡهِمۡ لَعۡنَةُ ٱللَّهِ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ وَٱلنَّاسِ أَجۡمَعِينَ ١٦١

১৬১.নিশ্চয় যারা কুফরী করে এবং কাফের অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করে, সে সমস্ত লোকের প্রতি আল্লাহ্‌র ফেরেশতাগনের এবং সমগ্র মানুষের লা’নত।

خَٰلِدِينَ فِيهَا لَا يُخَفَّفُ عَنۡهُمُ ٱلۡعَذَابُ وَلَا هُمۡ يُنظَرُونَ ١٦٢

১৬২.এরা চিরকাল এ লা’নতের মাঝেই থাকবে। তাদের উপর থেকে আযাব কখনও হালকা করা হবে না বরং এরা বিরাম ও পাবে না।

وَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٣

১৬৩.আর তোমাদের উপাস্য একইমাত্র উপাস্য। তিনি ছাড়া মহা করুণাময় দয়ালু কেউ নেই।

إِنَّ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱخۡتِلَٰفِ ٱلَّيۡلِ وَٱلنَّهَارِ وَٱلۡفُلۡكِ ٱلَّتِي تَجۡرِي فِي ٱلۡبَحۡرِ بِمَا يَنفَعُ ٱلنَّاسَ وَمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مِن مَّآءٖ فَأَحۡيَا بِهِ ٱلۡأَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَآبَّةٖ وَتَصۡرِيفِ ٱلرِّيَٰحِ وَٱلسَّحَابِ ٱلۡمُسَخَّرِ بَيۡنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَعۡقِلُونَ ١٦٤

১৬৪.নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকাসমূহের চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ্‌ তা’ আলা আকাশ থেকে যে পানি নাযিল করেছেন, তদ্দ্বারা মৃত যমীনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবরকম জীব-জন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালার যা তাঁরই হুকুমের অধীনে আসমান ও যমীনের মাঝে বিচরণ করে, নিশ্চয়ই সে সমস্ত বিষয়ের মাঝে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্যে।

সফা মারওয়া দৌড়ানো:

     ‘সফা’ এবং ‘মারওয়া’ বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী দু’টি পাহাড়ের নাম। হজ্ব কিংবা ওমরার সময় কা’বা ঘর তাওয়াফ করার পর এ দু’টি পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াতে হয়। শরী‘আতের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘সা‘য়ী’। জাহেলিয়াত যুগেও যেহেতু এ সা‘য়ীর রীতি প্রচলিত ছিল এবং তখন এ দু’টি পাহাড়ের মধ্যে কয়েকটি মূর্তি সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, এজন্য মুসলমানদের কারো কারো মনে একটা দ্বিধার ভাব জাগ্রত হয়েছিলো যে, বোধহয় এ ‘সা‘য়ী’ জাহেলিয়াত যুগের কোন অনুষ্ঠান এবং ইসলাম যুগে এর অনুসরণ করা হয়ত গোনাহর কাজ।

     কোন কোন লোক যেহেতু জাহেলিয়াত যুগে একে একটা অর্থহীন কুসংস্কার বলে মনে করতেন, সেজন্য ইসলাম গ্রহণের পরও তাঁরা একে জাহেলিয়াত যুগের কুসংস্কার হিসেবেই গণ্য করতে থাকেন। এরূপ সন্দেহের নিরসনকল্পে আল্লাহ পাক যেভাবে বায়তুল্লাহ শরীফের কেবলা হওয়া সম্পর্কিত সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছেন, তেমনিভাবে পরবর্তী আয়াতে বায়তুল্লাহ সংশ্লিষ্ট আরো একটি সংশয়ের অপনোদন করে দিয়েছেন।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

শব্দ বিশ্লেষণঃ شَعَآئِرِ اللهِ -এখানে شَعَآئِرِ শব্দটি شَعِيْرَةٌ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ চিহ্ন বা নিদর্শন। شَعَآئِرِ اللهِ -বলতে সেসব আমলকে বুঝায়, যেগুলোকে আল্লাহ তা‘আলা দ্বীনের নিদর্শন হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

         حج – এর শাব্দিক অর্থ উদ্দেশ্য স্থির করা। কুরআন-সুন্নাহর পরিভাষায় বায়তুল্লাহ শরীফের উদ্দেশ্যে গমন এবং সেখানে বিশেষ সময়ে বিশেষ ধরনের কিছু কর্ম সম্পাদন করাকে বলা হয় হজ্ব।

         عُمْرَة শব্দের আভিধানিক অর্থ দর্শন করা। শরী‘আতের পরিভাষায়, বায়তুল্লাহ শরীফে হাযির হয়ে তাওয়াফ-সা‘য়ী প্রভৃতি বিশেষ ধরনের কয়েকটি ‘ইবাদত সম্পাদন করার নামই ‘উমরা।

     ‘সা‘য়ী’ ওয়াজিব: হজ্ব, ‘উমরা এবং সা‘য়ীর বিস্তারিত বিবরণ ফেকাহর কিতাবসমূহে আলোচিত হয়েছে।

     ‘সা‘য়ী’ করা ইমাম আহমদ (র‘হিমাহুল্ল-হ)-এর মতে সুন্নত, ইমাম মালেক ও ইমাম শাফেয়ীর মতে ফরয, ইমাম আবু হানীফা (র‘হিমাহুল্ল-হ)-এর মতে ওয়াজিব। যদি কোন কারণে তা ছুটে যায়, তবে একটা ছাগল জবাই করে কাফফারা দিতে হবে।

উপরোক্ত আয়াতের শব্দবিন্যাস থেকে এরুপ ধারণা করা ঠিক হবে না যে, আয়াতে তো ‘সফা এবং মারওয়ার মধ্যে সায়ী করাতে গোনাহ হবে না’ বলা হয়েছে। এর দ্বারা বড়জোর এটা একটা মোস্তাহাব কাজ বলে সাব্যস্ত হতে পারে, ওয়াজিব হওয়ার কারণ কি?

     এখানে বুঝা দরকার যে, فَلَا جُنَاحَ (অর্থাৎ, গোনাহ হবে না) কথাটা প্রশ্নের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে বলা হয়েছে। কেননা, প্রশ্ন ছিল, যেহেতু সফা ও মারওয়াতে মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল এবং জাহেলিয়াত যুগের লোকেরা সায়ীর মাধ্যমে সে মূর্তিরই পূজা-অর্জনা করতো, সেহেতু এ কাজটি হারাম হওয়া উচিত। এরুপ প্রশ্নের জবাবেই বলা হয়েছে যে, এতে কোন গোনাহ নেই। আর যেহেতু এটা হযরত ইবরাহীমের প্রবর্তিত সুন্নাত, কাজেই কারো কোন বর্বরসূলভ আমল  দ্বারা এটা গোনাহর কাজ বলে সাব্যস্ত হতে পারে না। প্রশ্নের জবাবে এরুপ বলাতে এ আমলটি ওয়াজিব হওয়ার পরিপন্থী বুঝা যায় না।

     ‘ইলমে-দ্বীনের প্রকাশ ও প্রচার করা ওয়াজিব এবং গোপন করা হারাম: উল্লেখিত আয়াতে এ কথা বলা হয়েছে যে, আল্লাহর যে সমস্ত প্রকৃষ্ট হিদায়ত অবতীর্ণ হয়েছে, সেগুলো মানুষের কাছে গোপন করা এত কঠিন হারাম ও মহাপাপ, যার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নিজেও লা’নত বা অভিসম্পাত করে থাকেন এবং সমগ্র সৃষ্টিও অভিসম্পাত করে। এতে কয়েকটি বিষয় জানা যায়:

     প্রথমত: যে জ্ঞানের প্রচার ও প্রসার বিশেষ জরুরী, তা গোপন করা হারাম। রসূলে-করীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন- ‘যে লোক দ্বীনের কোন বিধানের বিষয় জানা সত্ত্বেও তা জিজ্ঞেস করলে গোপন করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেবেন।’- ‘হাদীসটি হযরত আবু হুরায়রা ও ‘আমর ইবনে ‘আস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) থেকে ইবনে মাজা রিওয়ায়াত করেছেন।

     ফেকাহবিদগণ বলেছেন, এ অভিসম্পাত আরোপিত হবে তখনই, যখন অন্য কোন লোক সেখানে উপস্থিত থাকবে না। যদি অন্যান্য আলেম লোকও সেখানে উপস্থিত থাকেন, তবে একথা বলে দেয়া যেতে পারে যে, অন্য কোন আলেমকে জিজ্ঞাসা করে নাও।-(কুরতুবী, জাসসাস)

     দ্বিতীয়ত: জানা যায় যে, ‘জ্ঞানকে গোপন করার’ অভিসম্পাত সে সমস্ত জ্ঞান ও মাসআলা গোপন করার ব্যাপারেই প্রযোজ্য, যা কুরআন ও সুন্নাহতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে এবং যার প্রকাশ ও প্রচার করা কর্তব্য। পক্ষান্তরে এমন সুক্ষ্ম ও জটিল মাসআলা সাধারণ্যে প্রকাশ না করাই উত্তম, যদ্দারা সাধারণ লোকদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। তখন তা كتمان علم বা জ্ঞানকে গোপন করার হুকুমের আওতায় পড়বে না। উল্লেখিত আয়াতে مِنَ الْبَیِّنٰتِ وَالْهُدٰی বাক্যের দ্বারাও তেমনি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তেমনিভাবে মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেছেন, ‘তোমরা যদি সাধারণ মানুষকে এমনসব ‘হাদীস শোনাও যা তারা পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না, তবে তাদেরকে ফেতনা-ফাসাদেরই সম্মুখীন করবে।’-(কুরতুবী)

     সহীহ বুখারীতে হযরত আলী (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) থেকে উদ্ধৃত রয়েছে, তিনি বলেছেন যে,- সাধারণ মানুষের সামনে ইলমের শুধুমাত্র ততটুকু প্রকাশ করবে, যতটুকু তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ধারণ করতে পারে। মানুষ আল্লাহ ও রসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করুক; তোমরা কি এমন কামনা কর? কারণ, যেকথা তাদের বোধগম্য নয়, তাতে তাদের মনে নানারকম সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হবে এবং তাতে করে তারা আল্লাহ ও রসূলকে অস্বীকারও করে বসতে পারে।

     কোন কোন পাপের জন্য সমগ্র সৃষ্টি লা’নত করেঃ وَیَلْعَنُهُمُ اللّٰعِنُوْنَ -আয়াতে কুরআনে-কারীম লা’নত বা অভিসম্পাতকারীদের নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেনি। তাফসীর শাস্ত্রের ইমাম হযরত মুজাহিদ ও ইকরিমা (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেছেন, এভাবে বিষয়টি অনির্ধারিত রাখাতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, দুনিয়ার প্রতিটি বস্তু এবং প্রতিটি সৃষ্টিই তাদের উপর অভিসম্পাত করে থাকে। এমনকি জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গও তাদের প্রতি অভিসম্পাত করে। কারণ, তাদের অপকর্মের দরুন সেসব সৃষ্টিরও ক্ষতি সাধিত হয়। হযরত বারা’ ইবনে আযেব (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বর্ণিত এক হাদীসেও তার সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে রসূল কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, اللّٰعِنُوْنَ -এর অর্থ হল সমগ্র পৃথিবীতে বিচরণশীল সমস্ত জীব।-(কুরতুবী)

     কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি লা’নত করা ততক্ষণ পর্যন্ত জায়েয নয় যতক্ষণ না তার কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণের বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায়ঃ وَمَاتُوْا وَهُمْ كُفَّارٌ -বাক্যাংশের দ্বারা জাসসাস ও কুরতুবী প্রমুখ উদ্ভাবন করেছেন যে, যে কাফের কুফর অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে বলে নিশ্চিত নয়, তার প্রতি লা’নত করা বৈধ নয়। আর আমাদের পক্ষে যেহেতু কারও শেষ পরিণতির (মৃত্যুর) নিশ্চিত অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়ার কোন উপায় নেই, সেহেতু কোন কাফেরের নাম নিয়ে তার প্রতি লা’নত বা অভিসম্পাত করাও জায়েয নয়। বস্তুতঃ রসূলে কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে সমস্ত কাফেরের নামোল্লেখ করে লা’নত করেছেন, কুফর অবস্থায় তাদের মৃত্যু সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তিনি অবহিত হয়েছিলেন। অবশ্য সাধারণ কাফের ও জালেমদের প্রতি অনির্দিষ্টভাবে লা’নত করা জায়েয।

     এতে একথাও প্রতীয়মান হয়ে যায় যে, লা’নতের ব্যাপারটি যখন এতই কঠিন ও নাযুক যে, কুফর অবস্থায় মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কোন কাফেরের প্রতিও লা’নত করা বৈধ নয়, তখন কোন মুসলমান কিংবা কোন জীব-জন্তুর উপর কেমন করে লা’নত করা যেতে পারে? পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষ, বিশেষতঃ আমাদের নারী সম্প্রদায় একান্ত গাফলতিতে পড়ে আছে। তারা কথায় কথায় নিজেদের আপনজনদের প্রতিও অভিসম্পাত বা লা’নত বাক্য ব্যবহার করতে থাকে এবং শুধু লা’নত বাক্য ব্যবহার করেই সন্তুষ্ট হয় না; বরং তার সমার্থক যে সমস্ত শব্দ জানা থাকে সেগুলোও ব্যবহার করতে কসুর করে না। লা’নতের প্রকৃত অর্থ হল, আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া। কাজেই কাউকে ‘মরদুদ’, ‘আল্লাহর অভিশপ্ত’ প্রভৃতি শব্দে গালি দেয়াও লা’নতেরই সমপর্যায়ভুক্ত।

     আরবের মুশরিকরা যখন নিজেদের বিশ্বাসের পরিপন্থী আয়াত وَ اِلٰـهُكُمْ  اِلٰهٌ  وَّاحِدٌ শুনল, তখন বিস্মিত হয়ে বলতে লাগল, সারা বিশ্বেরই কি একজন মাত্র উপাস্য হতে পারে? যদি এ দাবী যথার্থ হয়ে থাকে, তবে তার কোন প্রমাণ উপস্থাপন করা উচিত। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তারই প্রমাণ পেশ করেছেন আলোচ্য আয়াতে।

     তাওহীদের মর্মার্থ: وَ اِلٰـهُكُمْ  اِلٰهٌ  وَّاحِدٌ বিভিন্নভাবেই আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ বা একত্ববাদ সপ্রমাণিত রয়েছে। উদাহরণতঃ তিনি একক , সমগ্র বিশ্বে না আছে তাঁর তুলনা, না আছে কোন সমকক্ষ। সুতরাং একক উপাস্য হওয়ার অধিকারও একমাত্র তাঁরই।

     দ্বিতীয়ত: উপাস্য হওয়ার অধিকারেও তিনি একক ।  অর্থাৎ, তিনি ছাড়া অন্য আর কেউই ‘ইবাদতের যোগ্য নয়।

     তৃতীয়ত: সত্তার দিক দিয়েও তিনি্ একক । অর্থাৎ অংশী-বিশিষ্ট নন। তিনি অংশী ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে পবিত্র। তাঁর বিভক্তি কিংবা ব্যবচ্ছেদ হতে পারে না।

     চতুর্থতঃ তিনি তাঁর আদি ও অনন্ত সত্তার দিক দিয়েও একক , তিনি তখনও বিদ্যমান ছিলেন, যখন অন্য কোন কিছুই ছিল না এবং তখনও বিদ্যমান থাকবেন যখন কোন কিছুই থাকবে না। অতএব তিনিই একমাত্র সত্তা যাকে واحد বা ‘এক’ বলা যেতে পারে৷ واحد শব্দটিতে উল্লেখিত যাবতীয় দিকের একত্বই বিদ্যমান রয়েছে৷—(জাসসাস)

     তারপর আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত একত্ব সম্পর্কে বাস্তব লক্ষণ ও প্রমাণাদি উপস্থাপিত করা হয়েছে, যা জ্ঞানী-নির্জ্ঞান নির্বিশেষে যে কেউই বুঝতে পারে৷ আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের চিরাচরিত বিবর্তন তাঁরই ক্ষমতার পরিপূর্ণতা ও একত্ববাদের প্রকৃত প্রমাণ৷

     তেমনিভাবে পানির উপর নৌকা ও জাহাজ তথা জলযানসমুহের চলাচলও একটি বিরাট প্রমাণ৷ পানিকে আল্লাহ তা’আলা এমন এক তরল পদার্থ করে সৃষ্টি করেছেন যে, একান্ত তরল ও প্রবাহমান হওয়া সত্ত্বেও তার পিঠের উপর লক্ষ লক্ষ মণ ওজনবিশিষ্ট বিশালকায় জাহাজ বিরাট ওজনের চাপ নিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলাচল করে৷ তদুপরি এগুলোকে গতিশীল করে তোলার জন্য বাতাসের গতি ও নিতান্ত রহস্যপূর্ণভাবে সে গতির পরিবর্তন করতে থাকা প্রভৃতি বিষয়ও এদিকেই ইঙ্গিত করে যে, এগুলোর সৃষ্টি ও পরিচালনার পেছনে এক মহাজ্ঞানী ও মহাবিজ্ঞ সত্তা বিদ্যমান৷ পানীয় পদার্থগুলো তরল না হলে যেমন এ কাজটি সম্ভব হতো না, তেমনি বাতাসের মাঝে গতি সৃষ্টি না হলেও জাহাজ চলতে পারতো না; এগুলোর পক্ষে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করাও সম্ভব হতো না৷ এ বিষয়টিই কুরআন-হাকীম এভাবে উল্লেখ করেছে:

اِنْ يَشَأيُسْكِنِ الرِّيْحَ فَيَظْلَلْنَ رَوَاكِدَ عَلَي ظَهْرِهٖ

অর্থাৎ, “আল্লাহ ইচ্ছা করলে বাতাসের গতিকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন এবং তখন এ সমস্ত জাহাজ সাগর পৃষ্ঠে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে যাবে৷”

         بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ -শব্দের দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সামুদ্রিক জাহাজের মাধ্যমে এক দেশের মালামাল অন্য দেশে আমদানী-রফতানী করার মাঝেও মানুষের এত বিপুল কল্যাণ নিহিত রয়েছে যা গণনাও করা যায় না৷ আর এ উপকারিতার ভিত্তিতেই যুগে যুগে, দেশে দেশে নতুন নতুন বাণিজ্যপন্থা উদ্ভাবিত হয়েছে৷

     এমনিভাবে আকাশ থেকে এভাবে পানিকে বিন্দু বিন্দু করে বর্ষণ করা, যাতে কোনকিছুর ক্ষতিসাধিত না হয়৷ যদি এ পানি প্লাবনের আকারে আসত, তাহলে কোন মানুষ, জীব-জন্তু কিংবা অন্যান্য জিনিসপত্র কিছুই থাকত না৷ অতঃপর পানি বর্ষণের পর ভূ-পৃষ্ঠে তাকে সংরক্ষণ করা মানুষের সাধ্যায়ত্ত ব্যাপার ছিল না৷ যদি তাদেরকে বলা হতো, তোমাদের সবাই নিজ নিজ প্রয়োজনমত ছ’মাসের প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষণ করে রাখ, তাহলে তারা পৃথক পৃথকভাবে কি সে ব্যবস্থা করতে পারত? আর কোনক্রমে রেখে দিলেও সেগুলোকে পচন কিংবা বিনষ্ট হওয়ার হাত থেকে কেমন করে রক্ষা করত? কিন্তু আল্লাহ রব্বুল-আলামীন নিজেই সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন৷ ইরশাদ হয়েছে:

فَأَسْكَنَّاهُ فِي الْأَرْضِ ۖ وَإِنَّا عَلَىٰ ذَهَابٍ بِهِ لَقَادِرُونَ

অর্থাৎ, “আমি পানিকে ভূমিতে ধারণ করিয়াছি, যদিও বৃষ্টির পানি পড়ার পর তাকে প্রবাহিত করেই নিঃশেষ করে দেয়ার ক্ষমতা আমার ছিল৷”

     কিন্তু আল্লাহ তা’আলা পানিকে বিশ্ববাসী মানুষ ও জীব-জন্তুর জন্য কোথাও উন্মুক্ত খাদ-খন্দে সংরক্ষিত করেছেন, আবার কোথাও ভূমিতে বিস্তৃত বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে ভূমির অভ্যন্তরে সংরক্ষণ করেছেন৷ তারপর এমন এক ফল্গুধারা সমগ্র যমীনে বিছিয়ে দিয়েছেন, যাতে মানুষ যে কোনখানে খনন করে পানি বের করে নিতে পারে৷ আবার এই পানিরই একটা অংশকে জমাট বাঁধা সাগর বানিয়ে তুষার আকারে পাহাড়ের চুড়ায় চাপিয়ে দিয়েছেন যা পতিত কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একান্ত সংরক্ষিত; অথচ ধীরে ধীরে গলে প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে৷ সারকথা, উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ তা’আলার পরিপূর্ণ ক্ষমতার কয়েকটি বিকাশস্থলের বর্ণনার মাধ্যমে তাওহীদ বা একত্ববাদই প্রমাণ করা হয়েছে৷

وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَشَدُّ حُبّٗا لِّلَّهِۗ وَلَوۡ يَرَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُوٓاْ إِذۡ يَرَوۡنَ ٱلۡعَذَابَ أَنَّ ٱلۡقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعٗا وَأَنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعَذَابِ ١٦٥

১৬৫.আর কোন লোক এমনও রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহ্‌র সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমনি ভালবাসা পোষণ করে, যেমন আল্লাহ্‌র প্রতি ভালবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমানদার তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী। আর কতইনা উত্তম হ’ত যদি এ জালেমরা পার্থিব কোন কোন আযাব প্রত্যক্ষ করেই উপলব্ধি করে নিত যে, যাবতীয় ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌রই জন্য এবং আল্লাহ্‌র আযাবই সবচেয়ে কঠিনতর।

إِذۡ تَبَرَّأَ ٱلَّذِينَ ٱتُّبِعُواْ مِنَ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُواْ وَرَأَوُاْ ٱلۡعَذَابَ وَتَقَطَّعَتۡ بِهِمُ ٱلۡأَسۡبَابُ ١٦٦

১৬৬.অনুসৃতরা যখন অনুসরণকারীদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে যাবে এবং যখন আযাব প্রত্যক্ষ করবে আর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তাদের পারস্পরিক সমস্ত সম্পর্ক।

وَقَالَ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُواْ لَوۡ أَنَّ لَنَا كَرَّةٗ فَنَتَبَرَّأَ مِنۡهُمۡ كَمَا تَبَرَّءُواْ مِنَّاۗ كَذَٰلِكَ يُرِيهِمُ ٱللَّهُ أَعۡمَٰلَهُمۡ حَسَرَٰتٍ عَلَيۡهِمۡۖ وَمَا هُم بِخَٰرِجِينَ مِنَ ٱلنَّارِ ١٦٧

১৬৭.এবং অনুসারীরা বলবে, কতইনা ভাল হত, যদি আমাদিগকে পৃথিবীতে ফিরে যাবার সুযোগ দেয়া হত। তাহলে আমরাও তাদের প্রতি তেমনি অসন্তুষ্ট হয়ে যেতাম, যেমন তারা অসন্তুষ্ট হয়েছে আমাদের প্রতি। এভাবেই আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাদেরকে দেখাবেন তাদের কৃতকর্ম তাদেরকে অনুতপ্ত করার জন্যে। অথচ, তারা কস্মিনকালেও আগুন থেকে বের হতে পারবে না।

يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ كُلُواْ مِمَّا فِي ٱلۡأَرۡضِ حَلَٰلٗا طَيِّبٗا وَلَا تَتَّبِعُواْ خُطُوَٰتِ ٱلشَّيۡطَٰنِۚ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوّٞ مُّبِينٌ ١٦٨

১৬৮.হে মানব মন্ডলী, পৃথিবীর ‘হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী ভক্ষন কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।

إِنَّمَا يَأۡمُرُكُم بِٱلسُّوٓءِ وَٱلۡفَحۡشَآءِ وَأَن تَقُولُواْ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ١٦٩

১৬৯.সে তো এ নির্দেশই তোমাদিগকে দেবে যে, তোমরা অন্যায় ও অশ্লীল কাজ করতে থাক এবং আল্লাহ্‌র প্রতি এমন সব বিষয়ে মিথ্যারোপ কর যা তোমরা জান না।

وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ ٱتَّبِعُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ قَالُواْ بَلۡ نَتَّبِعُ مَآ أَلۡفَيۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَآۚ أَوَلَوۡ كَانَ ءَابَآؤُهُمۡ لَا يَعۡقِلُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَلَايَهۡتَدُونَ ١٧٠

১৭০.আর যখন তাদেরকে কেউ বলে যে, সে হুকুমেরই আনুগত্য কর যা আল্লাহ্‌ তা‘আলা নাযিল করেছেন, তখন তারা বলে কখনো না, আমরা তো সে বিষয়েরই অনুসরণ করব। যাতে আমরা আমাদের ব