পৃষ্ঠা নং-৩১৩
يَٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ لِلَّهِ شُهَدَآءَ بِالۡقِسۡطِۖ وَلَا يَجۡرِمَنَّكُمۡ شَنَـَٔانُ قَوۡمٍ عَلَىٰٓ أَلَّا تَعۡدِلُواْۚ اعۡدِلُواْ هُوَ أَقۡرَبُ لِلتَّقۡوَىٰۖ وَاتَّقُواْ اللَّهَۚ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ ٨
৮. হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত।
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّٰلِحَٰتِ لَهُم مَّغۡفِرَةٞ وَأَجۡرٌ عَظِيمٞ ٩
৯. যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহান প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আনুসঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:
৮নং আয়াতের বিষয়বস্তু প্রায় এসব শব্দেই সূরা নিসায়ও বর্ণিত হয়েছে। পার্থক্য এতটুকু যে, সেখানে كُوْانُوْا قَوّٰمِيْنَ بِالْقِسْطِ شُهَدَآءَ لِلّٰهِ – বলা হয়েছিল এবং এখানেكُوْانُوْا قَوّٰمِيْنَ لِلّٰهِ شُهَدَآءَ بِالْقِسْطِ -বলা হয়েছে। এ দু’টি আয়াতে শব্দ আগে-পিছে করার একটি সুক্ষ্ম কারণ ‘বাহ্রে-মুহীত’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সারমর্ম এই:
পৃষ্ঠা নং-৩১৪
স্বভাবত: দুটি কারণেই মানুষকে ন্যায় ও সুবিচারে বাধা-প্রদান এবং অন্যায় ও অবিচারে প্ররোচিত করে। (এক) নিজের অথবা বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। (দুই) কোন ব্যক্তির প্রতি শত্রুতা ও মনোমালিন্য। সূরা নিসার আয়াতে প্রথমোক্ত কারণের উপর ভিত্তি করে সুবিচারের আদেশ দেয়া হয়েছে এবং সূরা মায়েদার আলোচ্য আয়াতে শেষোক্ত কারণ হিসেবে বক্তব্য রাখা হয়েছে।
এ কারণেই সূরা-নিসার পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে- وَلَوْ عَلىٰٓ اَنْفُسِكُمْ اَوِالْوَالِدَيْنِ وَالْاَقْرَبِيْنَ অর্থাৎ, ন্যায়বিচারে অধিষ্ঠিত থাক, যদিও তা স্বয়ং তোমাদের অথবা তোমাদের পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায়। সূরা মায়েদার আলোচ্য আয়াতে উল্লেখিত বাক্যের পর বলা হয়েছে وَلَايَجْرِمَنَّكُمْ شَنَانُ قَوْمٍ عَلىٰٓ اَلَّاتَعْدِلُوْا – অর্থাৎ, কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেমন তোমাদেরকে ন্যায়বিচারে পশ্চাদপদ হতে উদ্বুদ্ধ না করে।
অতএব, সূরা নিসার আয়াতের সারমর্ম এই যে, ন্যায় ও সুবিচারের ক্ষেত্রে নিজের এবং পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনেরও পরওয়া করো না। যদি ন্যায় বিচার তাদের বিরুদ্ধে যায়, তবে তাতেই কায়েম থাক। সূরা মায়েদার আয়াতের সারমর্ম এই যে, ন্যায় ও সুবিচারের ক্ষেত্রে কোন শত্রুর শত্রুতার কারণে পশ্চাদপদ হওয়া উচিত নয় যে, শত্রুর ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে সুবিচারের পরিবর্তে অবিচার শুরু করবে।
এ কারণেই সূরা নিসার আয়াতে قسط অর্থাৎ, ‘ইনসাফ’কে অগ্রে উল্লেখ করে বলা হয়েছে- كُوْانُوْا قَوّٰمِيْنَ بِالْقِسْطِ شُهَدَآءَ لِلّٰهِ এবং সূরা মায়েদার আয়াতে لله -কে অগ্রে উল্লেখ করে বলা হয়েছে- كُوْانُوْا قَوّٰمِيْنَ لِلّٰهِ شُهَدَآءَ بِالْقِسْطِ অবশ্য উভয় আয়াত পরিণামের দিক দিয়ে একই উদ্দেশ্য প্রকাশ করে। কেননা, যে ব্যক্তি সুবিচারের জন্যে দণ্ডায়মান হবে, সে আল্লাহ্র জন্যেই দণ্ডায়মান হবে এবং সে সুবিচারই করবে। কিন্তু নিজের আত্মীয়-স্বজনের প্রতি লক্ষ্য রাখার ক্ষেত্রে এরূপ ধারণা হতে পারে যে, এসব সম্পর্কের প্রতি লক্ষ্য রাখাও তো আল্লাহ্র জন্যই। তাই এখানেই قسط শব্দটি অগ্রে উল্লেখ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সুবিচারের বিপক্ষে কারও প্রতি লক্ষ্য রাখা আল্লাহ্র জন্যে হতে পারে না। সূরা মায়েদায় শত্রুদের সাথে ন্যায় বিচারের নির্দেশ দিতে গিয়ে لله শব্দটি অগ্রে এনে মানব স্বভাবকে ভাবাবেগের কবল থেকে দূরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহ্র জন্যে দণ্ডায়মান হয়েছ। এর অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে শত্রুদের সাথেও ন্যায় বিচার কর।
মোটকথা এই যে, সূরা নিসা ও সূরা মায়েদার উভয় আয়াতে দু’টি বিষয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (এক) শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার ব্যাপারে ন্যায় ও সুবিচারে অটল থাক। আত্মীয়তার প্রতি লক্ষ্য করে অথবা কারও শত্রুতা পরবশ হয়ে এতে দুর্বলতা প্রদর্শন করা উচিত নয়। (দুই) সত্য সাক্ষ্য এবং সত্য কথা প্রকাশ করতে পিছপা হবে না – যাতে বিচারকবর্গ সত্য ও বিশুদ্ধ রায় দিতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়।
সত্য সাক্ষ্য দিতে ত্রুটি না করার প্রতি কোরআন পাক অনেক আয়াতে বিভিন্ন ভঙ্গিতে জোর দিয়েছে। এক আয়াতে অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে: وَلَاتَكْتُمُواالشَّهَادَةَ وَمَنْ يَّكْتُمْهَا فَاِنَّهٗٓ اٰثِمٌ قَلْبُهٗ অর্থাৎ, সাক্ষ্য গোপন করো না। যে সাক্ষ্য গোপন করে, তার অন্তর পাপী। এতে প্রমাণিত হয় যে, সত্য সাক্ষ্য দেয়া অপরিহার্য কর্তব্য এবং সাক্ষ্য গোপন করা কঠোর গোনাহ্।
কিন্তু যে বিষয়টি মানুষকে সত্য সাক্ষ্য দিতে বাধাদান করে, কোরআন পাক তার প্রতিও লক্ষ্য রেখেছে। বিষয়টি এই যে, সাক্ষীকে বার বার আদালতে হাজিরা দিতে হয় এবং অনর্থক নানা ধরনের হয়রানীরও সম্মুখীন হতে হয়। ফলে সাধারণ লোক সাক্ষীর তালিকাযুক্ত হওয়াকে সাক্ষাৎ বিপদ বলে মনে করে। নিজের কাজ কারবার তো নষ্ট হয়ই; তদুপরি অর্থহীন যাতনাও ভোগ করতে হয়।
এ কারণেই কোরআন পাক সত্য সাক্ষ্য দেয়াকে অপরিহার্য কর্তব্য সাব্যস্ত করার সাথে সাথে এ কথাও ঘোষণা করেছে যে, وَلَا يُضَآرَّ كَاتِبٌ وَّلَاشَهِيْدٌ অর্থাৎ, মোকদ্দমার বিবরণ লিপিবদ্ধকারী ও সাক্ষ্যদাতার কোন ক্ষতি করা যাবে না।
আজ-কালকার আদালত ও মোকদ্দমা সমূহের খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে, অকুস্থলের সত্য সাক্ষী খুব কমই পাওয়া যায়। সাক্ষীদের তালিকাযুক্ত হওয়ার ভয়ে জ্ঞানী ও ভদ্র ব্যক্তিরা কোথাও দুর্ঘটনার আঁচ পেলে দ্রুত সেখান থেকে পলায়ন করে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বানোয়াট সাক্ষীর দ্বারা মামলা দাঁড় করানো হয়। এর ফল তাই দাঁড়াতে পারে, যা আজকাল আমরা দিবারাত্র প্রত্যক্ষ করে থাকি। শতকরা দশ-পাঁচটি মোকদ্দমারও ন্যায় ও সুবিচারভিত্তিক রায় হতে পারে না। এ ব্যাপারে আদালতকে দোষ দেয়া যায় না। কারণ, তারা প্রাপ্ত সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই রায় দিতে বাধ্য।
সাধারণত: এ মারাত্মক ভুলটির প্রতি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ হয় না। যদি সাক্ষীদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করা হতো এবং তাদেরকে বার বার পেরেশান করা না হতো, তবে কোরআনী শিক্ষা অনুযায়ী কোন সত্যবাদী লোক সাক্ষ্যদান থেকে বিরত থাকতো না। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে এই যে, যে পুলিশ মোকদ্দমার প্রাথমিক তদন্ত করে, সে-ই বার বার ডেকে সাক্ষীকে এমনভাবে পেরেশান করে দেয় যে, সে মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে কোন মোকদ্দমার সাক্ষী না হওয়ার জন্যে ছেলেদেরকেও ওছিয়ত করে যেতে বাধ্য হয়। এরপর যদি মোকদ্দমা আদালতে পৌঁছে, তবে তারিখের পর তারিখ পড়তে থাকে। প্রতি তারিখেই নিরপরাধ সাক্ষীকে হাজিরা দেয়ার সাজা ভোগ করতে হয়। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকাররূপে আইনের এ দীর্ঘসূত্রিতা আমাদের আদালতসমূহকে নোংরা করে রেখেছে। হেজায ও অন্যান্য কতিপয় দেশে প্রচলিত প্রাচীন সাদা-সিধা বিচার পদ্ধতিতে একদিকে যেমন মোকদ্দমার প্রাচুর্য নাই, অন্যদিকে তেমনি সাক্ষীদের পক্ষে সাক্ষদানও কষ্টকর নয়।