আহলে হাদিস নাম প্রমাণে ড. গালিব সাহেবের জাল থিসিস!

(ইবনে যাকির)

‘সকল বিধান বাতিল করো, ওহির বিধান কায়েম করো’। চটকদার একটা শ্লোগান বটে। কিন্তু এ শ্লোগানধারীদের দলীয় নাম তথা ‘আহলে হাদিস’ কি ওহির বিধান দ্বারা প্রমাণিত? ড. আসাদুল্লাহ আল-গালিব সাহেব (আমির, আহলে হাদিস আন্দোলন বাংলাদেশ) বিরাট থিসিস করেছেন কুরআন-সুন্নাহ ও ইতিহাস থেকে আহলে হাদিস নামটি প্রমাণের জন্য।

আহলে হাদিসদের নিকট তার এ থিসিস মহা-সম্পদতুল্য। খুব অবাক হয়েছিলাম প্রথমে বিষয়টা জেনে। এ বিষয়ের উপরও কেউ থিসিস করে ফেলতে পারে! মনে করেছিলাম, বঙ্গদেশে আহলে হাদিস গবেষক অন্তত একজন হলেও পাওয়া গেল। আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু খুব বেশি দূর এগোতে পারলাম না। ৬৬ পৃষ্ঠায় তিনি ‘আহলে হাদিস’ নামটি প্রমাণ করতে গিয়ে প্রথমেই নিয়ে আসলেন একটা ডাহা জাল হাদিস। এরপর আরও বেশকিছু জালিয়াতি। পৃথিবীর বুকে এই একটি হাদিসই এ ব্যাপারে বড় দলিল, অথচ তাও জাল! আসুন, আমরা হাদিসটির দিকে দৃষ্টিপাত করি―

عَنْ اَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ  اَنَّهُ كَانَ إِذَا رَأَي الشَّبَابَ قَالَ مَرْحَبًا بِّوَصِيَّةِ رَسُوْلِ اللهِ  اَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ  اَنْ نُوَسِّعَ لَكُمْ فِيْ الْمَجْلِسِ و أَنْ نُفَهِّمَكُمُ الْحَدِيْثَ فَإِنَّكُمْ خُلُوْفُنَا وَ اَهْلُ الْحَدِيْثِ بَعْدَنَا

“আবু সাঈদ খুদরি (রা.) যখন কোন যুবককে দেখতেন তখন বলতেন : রাসূলুল্লাহ (সা.) এর ওসিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাকে মারহাবা জানাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে তোমাদের জন্য মজলিস প্রশস্ত করার ও তোমাদেরকে হাদিস বুঝাবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কেননা তোমরাই আমাদের পরবর্তী বংশধর ও পরবর্তী ‘আহলে হাদিস’।

(আহলে হাদিস আন্দোলন কি ও কেন? [রাজশাহী : হাদীস ফাউন্ডেশন, জানুয়ারি, ২০০৫] পৃ. ৬)

বর্ণনাটির সনদ নিম্নরূপ―

وأخبرنا ابن الفضل قال: حدثنا أبو سهل أحمد بن محمد بن عبد الله بن زياد القطان قال: حدثنا محمد بن الجهم السمري قال: حدثنا الهيثم بن خالد المقرئ قال: حدثنا يحيى بن المتوكل الباهلي قال: حدثنا محمد بن ذكوان الأزدي قال: حدثنا أبو هارون العبدي

সনদ পর্যালোচনা :

এই সনদের তিনজন বর্ণনাকারীর ব্যাপারে কিলকাল রয়েছে। একজন বর্ণনাকারী হলেন, ইয়াহইয়া ইবনু মুতাওয়াক্কিল আল-বাহিলি। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল তাকে মুনকারুল হাদিস বলেছেন। ইবনু আদি তাকে অত্যন্ত যয়িফ বলেছেন। (আল-কামিল ফি যুআফায়ির রিজাল, ১/২১১।) ইবনু হাজারও যয়িফ বলেছেন। (তাকরিবুত তাহযিব, ৩/৮৯) আলবানি বলেছেন, তিনি সত্যবাদী ছিলেন, কিন্তু হাদিস বর্ণনায় ভুল করতেন। (ইরওয়াউল গালিল, ৩/৮৫)

আরেকজন বর্ণনাকারী হলো, মুহাম্মাদ বিন যাকওয়ান। ইবনু হিব্বান তাকে যয়িফ বলেছেন। ইমাম নাসায়ি এবং দার-কুতনিও যয়িফ বলেছেন। ইমাম বুখারি তাকে মুনকারুল হাদিস বলেছেন। (ইবনে মাজাহ, ১/১২২) ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মায়িন তাকে মুনকারুল হাদিস, যয়িফুল হাদিস ও হাদিস বর্ণনায় অধিক ভুলকারী বলে উল্লেখ করেছেন। (আবু হাতিম, আল-জারহ ওয়াত তাদিল, ১৫/৩২৪) ইবনু হাজার তাকে যয়িফ বলেছেন। (তালখিসুল হাবির, ২/৩৬১; হাদিস নং ৮৩৩) আলবানি তাকে অত্যন্ত যয়িফ বলেছেন। (সিলসিলা যয়িফাহ: ৩৩৮)

আরেকজন বর্ণনাকারী হলো, আবু হারুন আল-আবদি। তার দুর্বলতার ব্যাপারে সমস্ত মুহাদ্দিসিন একমত। (ইবনু মাজাহ, ১/৯০; হা. ন. ২৪৮) ইমাম আহমাদ তার সম্পর্কে বলেন, أبو هارون العبدي متروك الحديث আবু হারুন আল-আবদির হাদিস পরিত্যক্ত। ইমাম বুখারি লিখেছেন, ابو هارون العبدي كذاب আবু হারুন আল-আবদি মিথ্যাবাদী। (বায়হাকি, কিতাবুল কিরায়াত, পৃ. ১৩৮) ইমাম নাসায়ি তার সম্পর্কে বলেন, متروك الحديث واسمه عمارة بن جوين সে মাতরুকুল হাদিস। তার আসল নাম হলো উমারাহ ইবনু জুওয়ায়িন। (নাসায়ি, সুনানুল কুবরা, ৬/৮৫) হাম্মাদ বিন যায়িদ বলেন, كَانَ أَبُوْ هَارُوْنَ الْعَبْدِىْ كَذَّابًا يَرْوِىْ بِالْغَدَاةِ شَيْئًا وَبِالْعَشِيِّ شَيْئًا আবু হারুন আল-আবদি মিথ্যুক। সে সকালে একরকম আর বিকালে আরেকরকম বর্ণনা করে। (আল-জারহ ওয়াত তাদিল, ৩/৩৬৩; রাবি নং ২০০৫) আলবানি তাকে মাতরুক এবং মিথ্যুক বলে আখ্যায়িত করেছেন। (ইরওয়াউল গালিল, ৩/১৭)

তাছাড়া মুহাক্কিক আমর বিন আব্দুল মুনয়িম সালিম লিখেছেন, হাদিসটি মাওযু। (তাহকিক শারফু আসহাবিল হাদিস [কায়রো : মাকতাবাহ ইবনু তাইমিয়াহ, ১৪১৭ হি.] পৃ. ৫১)

তিনি আরও বলেন, মুহাম্মাদ বিন যাকওয়ান ও ইয়াহইয়া বিন মুতাওয়াক্কিল দু’জনই যয়িফ। এরপর তিনি আরো দু’টি সনদের বিশ্লেষণে সেগুলোকেও শায, গায়রে মাহফুয ও যয়িফ বলে উল্লেখ করেন। সম্মানিত মুহাক্কিক এর পূর্বে ২৮ নং হাদিসের সনদে আবু হারুন আল-আবদি সম্পর্কে বলেন :

“আবু হারুন আল-আবদি, তার নাম উমারাহ ইবনু জুওয়াইন, সে মাতরুক। একাধিক আহলে ইলম তাকে মিথ্যুক বলেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন ইবনু আলিয়াহ, হাম্মাদ বিন যায়িদ, ইবনু মায়িন প্রমুখ। এই বর্ণনাটি সে আবু সায়িদ (রা.) থেকে একাকী উল্লেখ করেছে।”

আহলে হাদিস শাইখ যুবায়ের আলি যায়ি-ও আবু হারুন আবদিকে মিথ্যুক বলেছেন। (তাহকিক তিরমিযি, হা/১৯৫০, ২৬৫০; তাহকিক ইবনু মাজাহ, হা/২৪৭, ২৪৯ [উর্দু])

অথচ হাদিসটি উল্লেখপূর্বক ড. আসাদুল্লাহ গালিব (হাফি.) লিখেছেন: হাকিম একে সহিহ বলেছেন এবং যাহাবি তাকে সমর্থন করেছেন (!)। (ডক্টরেট থিসিস, ড. আসাদুল্লাহ গালিব, ৬৬ পৃ. টীকা নং ৫) এ মর্মে তিনি মুস্তাদরাক ১/৮৮, সিলসিলা সহিহাহ হা/২৮০- এর রেফারেন্স দিয়েছেন। কিন্তু হতাশার ব্যাপার হলো, ‘মুস্তাদরাক’ অথবা ‘সহিহা’য় এই শব্দে কোনো হাদিসই নেই! তাহলে ইমাম হাকিম এ হাদিসকে সহিহ বলার প্রশ্নই আসে না। তবে ইমাম হাকিম মুস্তাদরাকে (১/১১৯, হা/২৯৮) একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন― مرحبا بوصية رسول الله صلى الله عليه وسلم كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوصينا بكم “রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ওসিয়ত অনুযায়ী আমি তোমাদেরকে মারহাবা জানাচ্ছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে তোমাদের ব্যাপারে ওসিয়ত করে গেছেন।” এটাকে হাকিম সহিহ বলেছেন। কিন্তু وَاَهْلُ الْحَدِيْثِ بَعْدَنَا “তোমরাই আমাদের পরবর্তী আহলে হাদিস।” অংশটুকু ডক্টর সাহেব জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে বৃদ্ধি করেছেন। আর এটাকেও হাকিমের সূত্রে সহিহ বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। এটা ইমাম হাকিমের উপর নির্জলা অপবাদ। তার পুরো থিসিসের মূল প্রতিপাদ্যই হলো এই হাদিসটি। ভাবতেও পারছি না যে, তিনি জেনেশুনে একটা ডাহা জাল হাদিসের উপর এত বড় থিসিস করবেন এবং এভাবে রেফারেন্সের নামে ধোঁকাবাজি করবেন। এটা তার অনিচ্ছাকৃত ভুলও হতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, পরবর্তীতেও তিনি তার অন্যান্য বই ও বক্তব্যে এই জাল হাদিস এবং জাল রেফারেন্সের উদ্ধৃতি বারংবার দিয়েছেন। (দেখুন: ফিরকা নাজিয়াহ, পৃ. ৩৬; আহলে হাদীস কি ও কেন? পৃ. ৬)

এদিকে লক্ষ্য করেই বিশিষ্ট আহলে হাদিস শাইখ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম তার ‘আকায়িদ ও মাসায়িল’ কিতাবের ১৮৮ পৃষ্ঠায় উপরোক্ত হাদিসটি সম্পর্কে লিখেছেন―

“হাদিসটি অত্যন্ত যয়িফ। কারণ এর সনদে আবু হারুন আল-আবদি রয়েছে। সে একজন পরিত্যক্ত রাবি। এমনকি কোনো কোনো মুহাদ্দিস তাকে মিথ্যাবাদীও বলেছেন। উপরন্তু সে শিয়া মাযহাবপন্থী ছিল। আবু সায়িদ খুদরি (রা.) থেকে এতটুকু সহিহ সূত্রে প্রমাণিত আছে যে, তিনি বলতেন, ‘তোমাদেরকে রাসূল সা. এর ওসিয়ত অনুযায়ী স্বাগতম। রাসূল সা. আমাদেরকে তোমাদের বিষয়ে ওসিয়ত করতেন।’ আলবানি রহ. এই হাদিসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন। আবু হারুন আল-আবদি বর্ণিত উক্ত বর্ণনাকে তিনি আদৌ বিশুদ্ধ বলেন নি। অতএব আলবানি ঐ মর্মের হাদিসটিকে সহিহ বা হাসান বলেছেন এই দাবি করে তার ‘সিলসিলাহ সহিহা’র রেফারেন্স টেনে আনা রীতিমত অন্যায় ও জঘন্য অপরাধ। কারণ বিষয়টি পরবর্তীতে এভাবে তাকলিদি রূপ পরিগ্রহণ করবে। …বরং এ অবস্থা শুরুই হয়ে গেছে। আমার জানা মতে, মাসিক আত-তাহরিকের এক সংখ্যায় এক প্রবন্ধকার প্রসঙ্গক্রমে উক্ত হাদিস পরিবেশনের পর আলবানির ‘সিলসিলাহ সহিহা হা/২৮০’ -কে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেছেন! (ওয়াল্লাহুল মুস্তাআন)”

লেখকের এ আশংকা আজ বাস্তবরূপ পরিগ্রহণ করেছে। এদেশীয় আহলে হাদিসগণ― যারা প্রতিটি হাদিসই তাহকিকের সাথে গ্রহণের দাবিদার, পরবর্তীতে যারাই ‘আহলে হাদিস’ নামটি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, তারাই এ হাদিসটি ব্যবহার করেছেন। সাথে আমিরে মুহতারামের তাহকিকও!

যেমন― মুহতারাম আমিরের একসময়ের একান্ত অনুগামী মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব তার ‘ভ্রান্তির বেড়াজালে ইকামাতে দ্বীন’ বইয়ের ২১৮ পৃষ্ঠায় উপরোক্ত জাল হাদিসটি ‘আহলে হাদিস’ নাম প্রমাণে এক নাম্বার দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, মুস্তাদরাকে হাকিম ও আলবানির ভূয়া উদ্ধৃতিতে। মুফতি আব্দুর রউফ সাহেব তার ‘আহলে হাদিসদের বিরুদ্ধে বিষোদগারের তত্ত্ব রহস্য’ বইয়ের ৯৬-৯৭ পৃ. হাদিসটি উল্লেখ করেছেন। জমঈয়তের দলীয় পত্রিকা ‘মাসিক তর্জুমানুল হাদিস’ ডিসেম্বর-২০১৫ সংখ্যার ২৩-২৪ পৃষ্ঠায় প্রফেসর একেএম শামসুল আলম সাহেব সাহিত্যের রস মাখিয়ে হাদিসটি উপস্থাপন করেছেন। আমার কাছে খুলনার বিশিষ্ট আহলে হাদিস আলিম আযিযুর রহমান সিদ্দিকি সংকলিত ‘বিশ্বনবী (সা.) এবং তার সাহাবায়ে কেরাম ও ইমাম চতুষ্টয় আহলে হাদিস ছিলেন’ নামে একটি পান্ডুলিপি পৌঁছেছে, যেখানে এক নাম্বার প্রমাণ (!) হিসেবে এই হাদিসটি পেশ করা হয়েছে। আরেক আহলে হাদিস আলিম হাফিয আইয়ুব আলি তার ‘আহলে হাদিসদের পরিচয় ও ইতিহাস’ বইয়ের ১৩ পৃষ্ঠায় ‘সাহাবাগণ আহলে হাদিস ছিলেন’ শিরোনামে উপরোক্ত জাল হাদিসটি ইমাম হাকিমের মুস্তাদরাকের ভূয়া উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ করে তাকলিদের চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছেন। গায়রে মুকাল্লিদ দাবিদারদের এরকম তাকলিদি কাজ সত্যিই আশ্চর্যজনক!

হাদিসের কিতাবে অনেক স্থানে ‘আহলে হাদিস’ শব্দটি এসেছে। ‘আহলে হাদিস’ দাবিদারগণ সেগুলোও নিজেদের নামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে উপস্থাপন করে থাকেন। যেমন ইমাম তিরমিযি লিখেছেন, اِبْنُ لَهِيْعَةَ ضَعِيْفٌ عِنْدَ اَهْلُ الْحَدِيْثِ ضَعَّفَهُ يَحْيَيَ بْنُ سَعِيْدٍ الْقَطَّانُ وَغَيْرُه‘ مِنْ قِبَلِ حِفْظِه ইবনে লাহিয়াহ আহলুল হাদিসদের নিকট যয়িফ। তাকে ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল-কাত্তান ও অন্যান্যরা স্মৃতিশক্তির দিক থেকে যয়িফ বলেছেন।” (তিরমিযী, আব্ওয়াবুত তাহারাত- باب ما جاء من الرخصة في ذالك) এ উদ্ধৃতির মাধ্যমে প্রমাণিত হয় ‘আহলে হাদিস’ বলতে হাদিসের আলিম বা বিজ্ঞব্যক্তি, মুহাদ্দিসিন, আয়িম্মায়ে জারহ ও তা‘দিলকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। প্রচলিত বহুধাবিভক্ত, বহু আমিরের আনুগত্যকারী ‘আহলে হাদিস’ নামধারী সর্বসাধারণের দলগুলোকে বোঝানো হয় নি।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ