(অনেকখানি ভালোবাসা, কিঞ্চিত জানা-ভাবা-মানা)
মাওলানা আতিক উল্লাহ
অন্যদের কেমন চিন্তা আমি জানি না, আমার অজ্ঞতার কারণে মাঝেমধ্যে মনে হতো: হাদীস শরীফে তো বিভিন্ন আমলের কথা আছে। সকালে এই দু‘আ পড়তে হয়, বিকেলে ওই দু‘আ পড়লে ভালো হয় ইত্যাদি! কিন্তু কুরআন কারীমে যে এমন কোনও আমল নেই? তাহলে কুরআন মানবো কি করে? কুরআন অনুযায়ী আমল করবো কী করে? হাঁ, কুরআন রাষ্ট্র-সমাজ বিষয়ক বড় বড় মূলনীতি বলা আছে, কুফুর শিরক সম্পর্কে কথা আছে। আছে আরও নানা দিক। কিন্তু হাদীস শরীফের মতো ‘সকাল-সন্ধ্যা’-ধর্মী কোনও আমল নেই যে!
এটা আমার বোঝার ঘাটতি! আমার অপরিপক্কতা। আসলে কুরআনের প্রতিটি আয়াতেই ‘আমল’ বলে দেয়া আছে। একটু খুঁজলেই ‘আমল’টা বের করা সম্ভব। সালাফের তাফসীর মনোযোগ দিয়ে পড়লেই, একেকটা আয়াত থেকে ‘হাজারো’ আমল আবিষ্কার করা সম্ভব! দরকার একটুখানি মনোযোগ!
আমরা হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন আমল জানার চেষ্টা করি। মানারও চেষ্টা করি। বেশ ভাল প্রয়াস। পাশাপাশি কি আমরা একটুখানি কুরআন কারীমের দিকেও ‘দৃকপাত’ করতে পারি না! এই অতলান্ত সমুদ্রে কী কী লুকিয়ে আছে, সেটা আহরণে ব্রতী হতে পারি না!
কুরআন সরাসরি ‘সকাল-সন্ধ্যা’-এর আমলধর্মী কিছু বলে না। কুরআন কারীম প্রতিটি আয়াতে ‘কিছু মানদন্ড’ দিয়ে দেয়। আমাদের কাজ হলো, সে মানদন্ডগুলো চষে, দৈনন্দিন আমল বের করে আনা!
সূরা ফাতিহা:
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার, যিনি সকল সৃষ্টিজগতের পালনকর্তা। যিনি অতি দয়ালু ও চির দয়াময়। যিনি প্রতিদান দিবসের মালিক। (হে আল্লাহ) আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই কাছে সাহায্য চাই। আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করুন। সেই লোকদের পথে, যাদের প্রতি আপনি অনুগ্রহ করেছেন। ওই সকল লোকদের পথে নয়, যাদের প্রতি গযব নাযিল হয়েছে এবং তাদের পথেও নয়, যারা পথহারা!
১. চারটা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে:
এক: রাব্বুল আ-লামীন।
দুই: আর-রাহমা-ন।
তিন: আর-রাহীম।
চার: প্রতিদান দিবসের মালিক।
সূরার শুরুতেই উক্ত চারটা গুণবাচক নাম কেন উল্লেখ করা হলো?
রাব্বে কারীম যেন আমাদেরকে বলছেন: আমার প্রিয় বান্দারা! তোমরা যদি পরিপূর্ণ সত্তা ও অনুপম বৈশিষ্ট্যের জন্যে কারো প্রশংসা করতে চাও বা কাউকে সম্মান দেখাতে চাও, মহান মনে করতে চাও, বড় মনে করতে চাও:
তাহলে আমার প্রশংসা করো। আমিই তো আল্লাহ।
আমার প্রিয়া বান্দারা! তোমরা যদি কারো অনুগ্রহ, লালন-পালন করার জন্যে কারো প্রশংসা করতে চাও, কাউকে বড় মনে করতে চাও:
তাহলে আমার প্রশংসা করো। আমিই তো রাব্বুল আলামীন।
আমার প্রিয় বান্দারা! যদি তোমরা ভবিষ্যতের আশা-আকাঙ্খা, চাওয়া-পাওয়ার জন্যে কারো প্রশংসা করতে চাও, কাউকে বড় মনে করতে চাও:
তাহলে আমার প্রশংসা করো, কারণ আমিই ‘রহমান রহীম’!
আমার প্রিয় বান্দারা! তোমরা যদি ভয়ডরের কারণে কারো প্রশংসা করতে চাও, কাউকে বড় মনে করতে চাও:
তাহলে আমার প্রশংসা করো। আমাকে বড় মনে করো, কারণ আমিই ‘প্রতিদান দিবসের মালিক’!
২. দু‘আ কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হিশেবে দু’টি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে, সেদু’টি কি কি?
সিরাতে মুস্তাকীমের দিকে হিদায়াত লাভের দু‘আ করা, একজন বান্দার শ্রেষ্ঠতম তামান্না। অন্যতম প্রাপ্তি! হিদায়াত লাভ নয়, শুধু হিদায়াতের লাভের জন্যে দু‘আ করতে পারাও বিরাট বড় সৌভাগ্যের বিষয়। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাকে শিখিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে হিদায়াত লাভের দু‘আ করতে হবে:
ক: দু‘আর আগে আল্লাহর প্রশংসা করা। তার পবিত্রতা বর্ণনা করা।
খ: দু‘আর আগে আল্লাহর বন্দেগী করা। ইবাদত করা। আমি আল্লাহর দাস, একথা প্রমাণ করা। একমাত্র আল্লাহকেই উপাস্য হিশেবে গ্রহণ করা।
তাহলে বোঝা গেলো, দু‘আ কবুল হওয়ার জন্যে:
আল্লাহর আসমা ও সিফাতের উসীলা দিয়ে দু‘আ করতে হবে।
আল্লাহর ইবাদতের উসীলা দিয়ে দু‘আ করতে হবে।
প্রতিটি দু‘আর আগে, এই ধাপ অতিক্রম করলে, অবশ্যই দু‘আ কবুল হবে।
৩. ‘ইস্তে‘আনত’ বা আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়াটাও একটা এবাদত। তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে: আমরা আপনারই ইবাদত করি। পরে বলা হয়েছে, আমরা আপনার কাছেই সাহায্য চাই! ইস্তেআনতকে আলাদা করে উল্লেখ করার হেকমত কী?
বান্দা প্রতিটি কাজে ও ইবাদতে আল্লাহর কাছে ইস্তেআনতের মুখাপেক্ষী। আল্লাহর সাহায্য না হলে, বান্দা কোনও কাজই করতে পারবে না। ইবাদত করার সৌভাগ্যও অর্জিত হবে না। ভালো কাজে আগে বাড়তে পারবে না। মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারবে না। তাই বাড়তি গুরুত্ব বোঝানোর জন্যেই ‘ইস্তেআনতকে’ আলাদা করে বর্ণনা করা হয়েছে। যেন বলা হয়েছে: বান্দা রে! তুমি প্রতিটি কাজেই আমার কাছে সাহায্য চাও। আমার কাছে সাহায্য চাওয়া ব্যতীত তুমি কোনও কাজ শুরু করে দিও না যেন!
৪. ইবাদত শুধু আল্লাহর জন্যেই নির্দিষ্ট কেন?
ইবাদত হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিনয় ও আত্মসমর্পণ। অন্য কারো ইবাদত করাকে শরীয়তও সমর্থন করে না। বুদ্ধি-চিন্তাও সমর্থন করে না। একমাত্র আল্লাহই এবাদতের উপযুক্ত। কারণ তিনিই জীবন দান করেছেন। নানাবিধ নেয়ামতে ভূষিত করেছেন। আমাদেরকে অস্তিত্ব দান করেছেন।
৫. ইবাদত ও ইস্তেআনত উভয় ক্ষেত্রেই ‘বহুবচনের সীগাহ’ ব্যবহার করা হলো কেন?
প্রধানতম ইবাদত হলো, সালাত। ফরয সালাতগুলো জামাতের সাথে আদায় করা আবশ্যক। জামাত মানেই জমায়েত। অনেক মানুষ।
৬. সিরাতে মুস্তাকীম লাভের দু‘আ করা হয়েছে। সাহায্য ও রিযিকের চেয়েও সিরাতে মুস্তাকীম কেন বেশি জরুরী?
-দুনিয়াবী যিন্দেগীর জন্যে ‘সিরাতে মুস্তাকীম’ই বেশি প্রয়োজন। একজন মানুষ সিরাতে মুস্তাকীম লাভ করার অর্থ: সে হেদায়াত লাভ করলো। একজন হেদায়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেই মুত্তাকী বলা হয়। আর যে তাকওয়া অবলম্বন করবে, তার জন্যে আল্লাহ তা‘আলা রিযিকের পথ খুলে দিবেন। এমন এমন স্থান থেকে তার রিযিকের বন্দোবস্ত হবে, যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।
৭. সিরাতে মুস্তাকীম ও পুলসিরাতের মাঝে যোগসূত্রটা কি?
কুরআন বলছে: তোমাদেরকে আমল হিশেবেই প্রতিদান দেয়া হবে (নামল ৯০)। আমরা দুনিয়াতে সিরাতে মুস্তাকীমের ওপর অটল থাকলে, আখেরাতে পুলসিরাতেও অটল থাকতে পারবো। দুনিয়াতে সিরাতে মুস্তাকীমের ওপর যে পরিমাণ অটল থাকবো, সে পরিমাণ নিরাপত্তার সাথে পুলসিরাত পার হতে পারবো। সেদিন কেউ পার হবে বিদ্যুত গতিতে। কেউ পার হবে চোখের পলকে।
একটুখানি তাদাব্বুর-তাফাক্কুর:
(এক) সূরা ফাতেহা দুই ভাগে বিভক্ত। একভাগ আল্লাহর জন্যে, আরেক ভাগ বান্দার জন্যে।
ক: ইয়্যা-কা না‘বুদু পর্যন্ত আল্লাহর জন্যে।
খ: ইয়্যাকা নাসতাঈন থেকে শেষ পর্যন্ত বান্দার জন্যে।
(দুই) আল্লাহর সাহায্য ছাড়া, তাওফীক ছাড়া আল্লাহর ইবাদত করার সৌভাগ্য অর্জন করা যাবে না। চতুর্থ আয়াতে এটাই ফুটে উঠেছে।
(তিন) মাগদূব কারা? ইহুদিরা। গযবগ্রস্ত ইহুদিদের অনুসৃত পথ পরিহার করা আবশ্যক। তাদের পথ কী? শরীয়তের উপর নিজের প্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দেয়া।
দা-ল্লীন বলে খ্রিস্টানদেরকে বোঝানো হয়েছে। প্রকারান্তরে তাদের পথও পরিহার করতে বলা হয়েছে। তাদের পথ? বিদআত ও অজ্ঞতা!
একটুখানি আমল!
সূরা ফাতিহার পুরোটাই দু‘আ। রাব্বে কারীম আমাদেরকে শিখিয়েছেন, কিভাবে দু‘আ করতে হবে। কিভাবে দু‘আ করবো? প্রথমেই আমরা আল্লাহ প্রশংসা করবো। তার সানাখানি করবো। আলহামদু দিয়ে শুরু করেছেন। তারপর ‘ইহদিনা’ বলে দু‘আ শুরু করেছেন। হে আমার বান্দারা! এভাবেই আমার কাছে দু‘আ করবে কেমন?
একটুখানি পড়াশোনা!
আমরা কোন সূরা বেশি পড়ি? অবশ্যই সূরা ফাতিহা! যে ইসলামের কিছুই জানে না, নামকাওয়াস্তে মুসলমান, সেও টেনেটুনে সূরা ফাতেহা মুখস্থ বলতে পারে। পড়া তো হলো, এবার একটু বোঝার চেষ্টাও কি করতে পারি না! বাঙলা তাফসীর তো চাইলে সংগ্রহ করা যায়। এখন তো টাকাও লাগে না। কতক্ষণ লাগবে, বড়জোর বিশ মিনিট? একটু চেষ্টা করলেই আমরা সূরাটার তাফসীর পড়ে নিতে পারি! ক্ষতি হবে না কিন্তু! কত কিছুই তো পড়ি! একদিন না হয় খেলার পেজটার একটা সংবাদ কম পড়ে, একটা সূরার তাফসীরই পড়লাম! সমস্যা হবে? আমাদের রব ভীষণ খুশি হবেন কিন্তু! আর নবীজি? আল্লাহু আকবার! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!
একটুখানি জনসংযোগ:
আমাদের কাঙ্খিত পথ কোনটা? আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্তদের পথ। আমরা তাদের পথই অনুসরণ করবো। আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দা কারা? সালেহীন-সৎলোকেরা। নেকআমলধারীরা।
আমরা একটুখানি খুঁজলেই আশেপাশে ‘সালেহ’ পেয়ে যেতে পারি। নেককার পেয়ে যেতে পারি। এমন কাউকে পেলেই, আমরা নিয়মিত তার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে পারি। তার সোহবতে-সান্নিধ্যে থাকতে পারি। দ্বীনকে শিখতে পারি। দ্বীনকে আরও ভালোভাবে মানার প্রেরণা লাভ করতে পারি! এটাও কিন্তু একটা কুরআনি আমল। সূরা ফাতেহার আমল।