কাদিয়ানী ও ‘তারা’!

(মাওলানা আতীকুল্লাহ)

গোলাম কাদিয়ানী
গোলাম কাদিয়ানী

কাদিয়ানি আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯০০ সালে। বৃটিশ ভারতের পাঞ্জাবের কাদিয়ান নামক গ্রামে। মির্যা গোলাম আহমাদ (লা আ) এ-আন্দোলনের প্রবক্তা। ১৮৩৯-১৯০৮। ইংরেজদের একান্ত অনুগত স্যার সৈয়দ আহমাদের অতি উদার পাশ্চাত্যঘেঁষা নীতিই, গোলাম আহমদের ভ্রান্ত কার্যক্রমের পথকে সুগম করে দেয়। ইংরেজরাও সুযোগ কাজে লাগিয়ে, নানা রকমের চর নিয়োগ করে।

ইংরেজরা তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে গোলাম আহমাদকে বেছে নেয়। গোলাম নিজেকে একজন দায়ী হিশেবেই প্রথমে সমাজের কাছে তুলে ধরে। তারপর দাবী করে সে একজন : আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহামপ্রাপ্ত মুজাদ্দিদ। তারপর দাবী করে সে একজন প্রতীক্ষিত মাহদী। তারপর দাবী করে সেই প্রতিশ্রুত মাসীহ। তারপর সে দাবী করে, সে একজন নবী (নাউযুবিল্লাহ)। এবং তার ধারনা মতে, তার নবুয়তের মর্যাদা, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুয়াতের চেয়েও উন্নত। তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গও তৈরী হলো।

সেই শুরু। তারপর থেকেই গোলাম বিষাক্ত কার্যক্রম চালিয়ে যেতে শুরু করে। পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী যফরুল্লাহ খান ছিল কাদিয়ানী। তার প্রকাশ্য পৃষ্ঠপোষকতাতেই কাদিয়ানী মতবাদ শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ায়। ক্ষমতা গ্রহণ করেই সে কাদিয়ানিদের জন্যে, পাঞ্জাবে এক বিরাট এলাকা বরাদ্দ দেয়। এলাকাটার নাম দেয় ‘রাবওয়া’। শব্দটা সংগ্রহ করে কুরআন কারীম থেকে:

আমি মারয়াম ও তার পুত্রকে আশ্রয় দিয়েছি এক অবস্থানযোগ্য স্বচ্ছ পানিবিশিষ্ট ‘রাবওয়া’(টিলায়)। মুমিনুন: ৫০)।

১৯৫৩ সালে যফরুল্লাহ খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন ফুঁসে উঠলো। তার বরখাস্তের দাবিতে। এবং কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণার দাবীতে। এই আন্দোলনে অসংখ্য মর্দে মুমিন শাহাদাত বরণ করেছিলেন। প্রশাসন যফরকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হয়েছিল।

কাদিয়ানীদের বেশিরভাগই বাস করে পাকিস্তান ও ভারতে। অল্পকিছু থাকে ইসরাঈলে। সেখানে তারা বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েই থাকে। এছাড়াও বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য-আমেরিকাসহ বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রেও তাদের উপস্থিতি আছে।

আফ্রিকাতে কাদিয়ানীদের বেশ সক্রিয় তৎফরতা রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুরো আফ্রিকা জুড়ে তাদের প্রচারকই আছে পাঁচ হাজারের উপরে। পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ মদতে তারা চেষ্টা করে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পশকাতর পদে বসার প্রয়াস চালায়।

১৯৭৪ সালে রাবেতায়ে আলমে ইসলামী কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করে। আমরা আজ কাদিয়ানীদের ইতিহাস বলতে বসিনি। সেটা আলাদা লেখায় আসবে। আজ আমরা বর্তমানে কিছু মানুষের কাজের সাথে কাদীয়ানীদের কাজের মিল খুঁজে পাই। সেটাই তুলে ধরার প্রয়াস পারো:

(এক) কাদিয়ানী প্রথম দিকে ইসলামের দিকেই দাওয়াত দিতো। পরে আস্তে আস্তে তাদের অনুসারীদের আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে নানা বিষ ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

বর্তমানের ওরাও, সব সময় কুরআন হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েই কথা বলে। তাদের চিন্তার প্রচার ঘটায়। মানুষের মাঝে কুরআন-হাদীসের কথা বলে আস্থা অর্জন করে। কিন্তু কুরআন কারীমের কিছু আয়াত ও অসংখ্য হাদীস শরীফের মনগড়া ব্যখ্যা করে, তাদের অনুসারীদের মগজ ধোলাই করে। চিন্তাকে বিভ্রান্ত করে। সাধারন মানুষের মাঝে শরীয়তের ভুল ব্যাখ্যা হাজির করে।

(দুই) কাদিয়ানীরা হলো উপনিবেশবাদী চতুর বেনিয়া ব্রিটিশদের তৈরী। আর এরা হলো সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজ আমেরিকার তৈরী।

(তিন) ব্রিটেন কাদিয়ানীদেরকে প্রশাসনের বিভিন্ন উচুঁপদে বসাত। স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে নিয়োগ দিতো। আমেরিকাও ‘তাদেরকে’ বিভিন্ন সম্মানসূচক উপাধি, গুরুত্বপূর্ণ পদ, ফাঁপা বুলিভরা পদক, মিডিয়ার কভারেজ দিয়ে ‘সেলিব্রেটিৎ করে তোলে।

(চার) কাদিয়ানীরা বিট্রিশ সাম্রাজ্যকে পবিত্রজ্ঞানে বিশ্বাস করতো। আস্থা রাখতো। ইশ্বরবৎ ভক্তিশ্রদ্ধা করতো। আর বর্তমানের এরাও: তাদের সরকারকে পূজা করে। পদলেহন করে। তোয়াজ-তাযীম করে। সরকারে সমর্থনে ধর্মকে বিকৃত করে ‘ধর্মীয়’ বিধান দেয়। হালালকে হারাম করে, হারামকে হালাল করে।

এদের সরকারগুলো আবার পূজো করা বড় উপাস্যের। আমেরিকার। বর্তমানের ও রা, দাসানুদাস। এদিক দিয়ে ‘এরা’ কাদিয়ানীদের চেয়েও নিকৃষ্ট। কারন কাদিয়ানীরা সরাসরি ব্রিটিশদের পূজা করতো, আর এরা তাদের সরকারের পূজা করার মাধ্যমে আমেরিকার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে।

(পাঁচ) আগের কাদিয়ানীরা মদ-জুয়াকে বৈধ মনে করতো। আজকের ‘ওরা’ আরও ভয়ংকর। তারা ‘মুয়ালাতে কুফফার’ কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনকে শুধু বৈধই নয়, জরুরীও মনে করে। দাবী করে এটাই হেকমতের দাবী। তারা মনে করে ‘আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান’ বাদ দিয়ে অন্য বিধানে দেশ পরিচালনা বৈধ! এদের আরো ভয়ংকর আকীদা হলো: কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াই করা মুসলমানদেরকে হত্যা করা বৈধ!

(ছয়) আগের কাদিয়ানীরা মনে করতো: যারা তাদের মতবদ গ্রহণ করবে না, তারা কাফের। আর হালের এরা মনে করে: যারা তাদের মতো কুফুরতোষণ নীতি গ্রহণ করবে না, তারা সন্ত্রাসী-খারেজী-চরমপন্থী ক্ষেত্রবিশেষে ‘অমুসলিমও’, ইহুদিদের দালাল!

(সাত) কাদিয়ানীরা বিশ্বাস করতো, জিব্রাইল আ. ওহি নিয়ে গোলাম আহমাদের কাছে আসতো। আর গোলামের এলহামগুলো ছিল কুরআনেরই মতো। আর বর্তমানের ‘ওরা’ মনে করে: তাদের শাসক ও শাসকদের প্রতিনিধির কথাই ওহী। অটাক্য। অনস্বীকার্য।

(আট) গোলাম মনে করতো, সে যা পেশ করবে, সেটাই কুরআন। যে বলবে, সেটাই হাদীস। আর আজকের ‘তারা’ মনে করে, তারা কুরআনের যে ব্যখ্যা দিবে, সেটাই চূড়ান্ত। তাদের যে ব্যখ্যা তাদের সরকার ও আমেরিকার মনোঃপূত হবে সেটাই ‘শিরোধার্য। এর বাইরে আর কিছু থাকতে পারে না।

(নয়) কাদিয়ানী দাবী করতো, ইংরেজ সরকারের আনুগত্য করা আবশ্যক। কারন তারা কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী মনে করতো ব্রিটিশ রাজ ‘ওলীয়ে আমর’-দন্ডমুন্ডের হর্তাকর্তা। আর বর্তমানের ‘তারা’ মনে করে, নিজ সরকার ও আমেরিকার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য করার ফরয। কারন তারা ‘ওলিয়ে আমর’। আর ওলীয়ে আমরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারন করা খারেজীদের আলামত। বাগাওত।

(দশ) কাদিয়ানীদের ব্রিটিশতোষণের প্রধান হাতিয়ার ছিল, তারা কিতালকে অবৈধ ঘোষণা দিয়েছিল। তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে এর জন্যে পথ সুগম করেছিল। তারা শরয়ী পরিভাষা ‘ওলিয়ে আমর’ ব্রিটিশদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে, মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। ব্রিটিশবিরোধী ‘জিহাদ’কে রুদ্ধ করতে চেয়েছিল।

আজিকার ‘তারাও’ ঠিক একই পথ বেছে নিয়েছে। তারা বলে বিদেশী ও আমেরিকানরা মুসলিম দেশে ‘আমন’ নিয়ে এসেছে। তারা আহলুয যিম্মাহ। তারা মুস্তামিন। তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা বৈধ হবে না। অথচা সেই কাফিররা অন্যত্র মুসলিম ভাইবোনদের রক্ত ঝরাচ্ছে। এই লোকেরা ‘শরীয়তের’ পরিভাষা ব্যবহার করে, মানুষকে তো বটেই তাদের অনুসারী ‘আমিল’ (আলিম নয়)-দেরকেও বিভ্রান্ত করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

গত তিনশ বছর ধরে, পাশ্চাত্যের ক্রমাগত প্রচারণা ও শাসনের ফলে, কাদিয়ানীদের মতো অসংখ্য ‘তারা’ তৈরী হয়েছে। তারা কুরআন-হাদীসই পড়ে, তবে ব্যখ্যার সময় তাদের মন-মগজে থাকে পাশ্চাত্যের মনিবদের প্রতি ভয়-ভক্তি-শ্রদ্ধা। তারা কুরআন-হাদীসের সঠিক ব্যখ্যা বলার আগে ভাবে, এটা মনিবদের মনো:পুত হবে কি না।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারনে, সমাজের বৃহত্তর অংশও এদের পেছনে বা সাথেই ছিল ও থেকে আসছে। ফলে, ভুল ও তোষণঘেঁষা ফতোয়াই আস্তে আস্তে গাদ হয়ে সমাজে গাঢ় হয়ে চেপে বসেছে। কুরআন কারীম ও হাদীসের সঠিক রূপ তিনশত বছর ধরে জমে ওঠা ধূলার নিচে চাপা পড়ে গেছে।

কাদিয়ানীরা যখন তাদের প্রচারণা শুরু করেছিল, তাদের আশেপাশের মানুষ ছিল অজ্ঞ ও ইসলামের সঠিক রূপ সম্পর্কে বে-খবর। তাই তারা সহজেই বিভ্রান্ত করতে পেরেছে। আজকের ‘তারা’ও মিডিয়া-রাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের বদান্যতায় সমাজকে চারদিক থেকেই ঘিরে ফেলেছে। মানুষ ভেবেছে তারাই প্রকৃত ‘ব্যক্তি’। তারা দ্বীনেন কান্ডারি।

তবে কাদিয়ানীদে বিরুদ্ধে যেমন একদল হকপছন্দ মানুষ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, বর্তামানের ‘তাদের’ বিরুদ্ধেও আরেক দল অকুতোভয় বান্দা দাঁড়িয়ে গেছে:

-তারা আল্লাহর নূরকে মুখের ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরকে পূর্ণ করবেন, যদিও কাফেররা তা অপ্রীতিকর মনে করে (তাওবা: ৩২)।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ