পৃষ্ঠা নং- ৯৫
করা তার পক্ষে জরুরী হবে।
মাসআলাঃ যেসব দেশে রাত ও দিন কয়েক মাস দীর্ঘ হয়ে থাকে সেসব দেশে বাহ্যতঃ মাসের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায় না৷ অর্থাৎ, রমযান মাসের প্রকাশ্য আগমন ঘটে না৷ কাজেই সেদেশের অধিবাসীদের উপর রোযা ফরয না হওয়াই উচিত৷ ‘হানাফী মাযহাব অবলম্বী ফেকাহ্বিদগনের মধ্যে হালওয়ানী, কেবালী প্রমুখ নামাযের ব্যাপারেও এমনি ফতোয়া দিয়েছেন যে, তাদের উপর নিজেদের দিন-রাত অনুযায়ী নামাযের হুকুম বর্তাবে৷ অর্থাৎ, যে দেশে মাগরিবের সাথে সাথেই সুবহে-সাদেক হয়ে যায়, সেদেশে ‘ইশার নামায ফরয হয় না৷-(শামী)
এর তাকাদা হল এই যে, যে দেশে ছয় মাসের দিন হয় সেখানে শুধু পাঁচ ওয়াক্তের নামায ফরয হবে৷ রমযান আদৌ আসবে না৷ হযরত ‘হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ ‘আলী থানবী (র‘হিমাহুল্ল-হ) ও ‘এমদাদুল-ফাতাওয়া গ্রন্থে রোযা সম্পর্কে এ মতই গ্রহণ করেছেন৷
ومن كان مريضا اوعلي سفر فعدة من ايام اخر—আয়াতে রুগ্ন কিংবা মুসাফিরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে যে, সে তখন রোযা না রেখে বরং সুস্থ হওয়ার পর অথবা সফর শেষ হওয়ার পর ততদিনের রোযা কাযা করে নিবে, এ হুকুমটি যদিও পূর্ববর্তী আয়াতেও উল্লেখ করা হয়েছিল, কিন্তু এ আয়াতে যেহেতু রোযার পরিবর্তে ফিদইয়া দেয়ার ঐচ্ছিকতাকে রহিত করে দেয়া হয়েছে, কাজেই সন্দেহ হতে পারে যে, হয় তো রুগ্ন কিংবা মুসাফিরের বেলায়ও হুকুমটি রহিত হয়ে গেছে৷ সুতরাং এখানে তার পুনরুল্লেখ করা হয়েছে।
পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে রমযানের হুকুম-আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে৷ তারপর একটি সুদীর্ঘ আয়াতে রোযা ও ই’তি’কাফের বিবরণ বর্ণিত হয়েছে৷ এখানে মাঝখানে বর্তমান সংক্ষিপ্ত আয়াতটিকে বান্দাদের অবস্থার প্রতি মহান পরওয়ারদেগারের অনুগ্রহ এবং তাদের প্রার্থনা শ্রবণ ও কবুল করার বিষয় আলোচনা করে নির্দেশ পালনে উৎসাহিত করা হচ্ছে৷ কারণ, রোযা-সংক্রান্ত ‘ইবাদতে অবস্থাবিশেষে অব্যাহতি দান এবং বিভিন্ন সহজতা সত্ত্বেও কিছু কষ্ট বিদ্যমান রয়েছে৷ এ কষ্টকে সহজ করার উদ্যেশ্যে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, আমি আমার বান্দাদের সন্নিকটে রয়েছি, যখনি তারা আমার কাছে কোন বিষয় প্রার্থনা বা দু‘আয করে, আমি তাদের সে দু‘আ কবুল করে নেই এবং তাদের বাসনা পুরণ করে দেই৷
এমতাবস্থায় আমার হুকুম-আহকাম মেনে চলা বান্দাদেরও একান্ত কর্তব্য৷ তাতে কিছুটা কষ্ট হলেও তা’ সহ্য করা উচিত৷ ইমাম ইবনে-কাসীর দু‘আর প্রতি উৎসাহ দান সংক্রান্ত এই মধ্যবর্তী বাক্যটির তাৎপর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, এ আয়াতের দ্বারা রোযা রাখার পর দু‘আ কবুল হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে৷ সে জন্যই রোযার ইফতারের পর দু‘আর ব্যাপারে বিশেষ তৎপরতা অবলম্বন করা উচিত৷ মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন-
للصيام عند فطره دعوة مستجابة
অর্থাৎ, রোযার ইফতার করার সময় রোযাদারের দু‘আ কবুল হয়ে থাকে৷—(আবু দাউদ)
সে জন্যই হযরত ‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) ইফতারের সময় বাড়ীর সবাইকে সমবেত করে দু‘আ করতেন৷
মাসআলাঃ এ আয়াতে فاني قريب ( আমি নিকটেই রয়েছি) বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে,ধীরে -সুস্থে ও নীরবে দু‘আ করাই উত্তম,উচ্চঃস্বরে দু‘আ করা পছন্দনীয় নয়৷ ইমাম ইবনে কাসীর (র‘হিমাহুল্ল-হ) এ আয়াতের শানে-নুযূল বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন, কোন গ্রামের কিছু অধিবাসী রসূলে-কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)- কে জিজ্ঞেস করেছিল যে, ‘যদি আমাদের পরওয়ারদেগার আমাদের নিকটেই থেকে থাকেন, তবে আমরা আস্তে আস্তে দু‘আ করব৷ আর যদি দূরে থেকে থাকেন তবে উচ্চঃস্বরে ডাকব। এরই প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয়েছে৷
احل لكم —বাক্যাংশটি দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, যে বিষয়টিকে এ আয়াত দ্বারা ‘হালাল করা হয়েছে, তা ইতিপূর্বে ‘হারাম ছিল৷ বুখারী এবং অন্যান্য ‘হাদীসের কিতাবে সাহাবী হযরত বারা ইবনে আ’যিবের বর্ণনায় উল্লেখিত হয়েছে যে, প্রথম যখন রমযানের রোযা ফরয করা হয়েছিল, তখন ইফতারের পর থেকে সয্যাগ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত খানা-পিনা ও স্ত্রী-সহবাসের অনুমতি ছিল৷ একবার সয্যাগ্রহণ করে ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথেই এ সবকিছু ‘হারাম হয়ে যেত৷ কোন কোন সাহাবী এ ব্যপারে অসুবিধায় পড়েন৷ কায়স ইবনে-সারমাহ আনসারী নামক জনৈক সাহাবী একবার সমগ্রদিন কঠোর পরিশ্রম করে ইফতারের সময় ঘরে এসে দেখেন, ঘরে খাওয়ার মত কোন কিছুই নেয়৷ স্ত্রী বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি কোনখান থেকে কিছু সংগ্রহ করে আনার চেষ্টা করি৷ স্ত্রী যখন কিছু খাদ্য সংগ্রহ করে ফিরে এলেন ততক্ষণে সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ ইফতারের পর ঘুমিয়ে পড়ার দরুন খানা-পিনা তার জন্য ‘হারাম হয়ে যায়৷ ফলে পরদিন তিনি এ অবস্থাতেই রোযা রাখেন৷ কিন্তু দুপুর বেলায় শরীর দূর্বল হয়ে তিনি বেহুঁশ বা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান৷— (ইবনে-কাসীর)
অনুরূপভাবে কোন কোন সাহাবী গভীর রাত্রে ঘুম ভাঙ্গার পর স্ত্রীদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়ে মানসিক চাপে পতিত হন৷ এসব ঘটনার পর এ আয়াত নাযিল হয়, যাতে পূর্ববর্তী হুকুম রহিত করে সূর্যাস্তের পর থেকে শুরু করে সুবহে-সাদেক উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র রাতেই খানা-পিনা ও স্ত্রী সহবাস বৈধ করা হয়েছে৷ ঘুমাবার পূর্বে কিংবা ঘুম থেকে উঠার পর সম্পর্কে কোন বাধ্যবাধকতাই এতে আর অবশিষ্ট রাখা হয়নি৷ এমনকি ‘হাদীস অনুযায়ী শেষরাত্রে সেহরী খাওয়া সুন্নত সাব্যস্ত করা হয়েছে৷ আলোচ্য আয়াতে এ সম্পর্কিত নির্দেশই প্রদান করা হয়েছে৷
সেহরী খাওয়ার শেষ সময়সীমাঃ حتى يتبين لكم الخيط الابيض আয়াতে রাতের অন্ধকারকে কালো রেখা এবং ভোরের আলো ফোটাকে সাদা রেখার সাথে তুলনা করে রোযার শুরু এবং খানা-পিনা ‘হারাম হওয়ার সঠিক সময়টি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে৷ অধিকন্তু এ সময়সীমার মধ্যে বেশ-কম হওয়ার সম্ভাবনা যাতে না থাকে সেজন্য حتى يتبين শব্দটিও যোগ করে দেয়া হয়েছে৷ এতে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, সন্দেহ প্রবণ লোকদের ন্যায় সুবহে-সাদেক দেখা দেয়ার আগেই খানা-পিনা ‘হারাম মনে করো না অথবা এমন অসাবধানতাও অবলম্বন করো না যে, সুবহে-সাদেকের আলো ফূটে উটার পরও খানা-পিনা করতে থাকবে৷ বরং খানা-পিনা এবং রোযার মধ্যে সুবহে-সাদেকের উদয় সঠিকভাবে নির্ণয়ই হচ্ছে সীমারেখা৷ এ সীমারেখা উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খানা-পিনা বন্ধ করা জরুরী মনে করা যেমন জায়েয নয়, তেমনি সুবহে-সাদেক উদয় হওয়ার ব্যাপারে ইয়াকীন বা স্থির হয়ে-