পৃষ্ঠা নং-১১৪
ঈমান একত্রিত হতে পারে না৷’ তিরমিযীতে হযরত আনাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মদের সাথে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণীর ব্যক্তির উপর লা’নত করেছেন৷
(১) যে লোক নির্যাস বের করে, (২) প্রস্তুতকারক, (৩) পানকারী, (৪) যে পান করায়, (৫) আমদানীকারক, (৬) যার জন্যে আমদানী করা হয়, (৭) বিক্রেতা, (৮) ক্রেতা, (৯) সরবরাহকারী, এবং (১০) এর লভ্যাংশ ভোগকারী৷
অতঃপর শুধু মৌখিক শিক্ষা ও প্রচারের উপরই ক্ষান্ত হননি, বরং যথাযথ আইনের মাধ্যমেও ঘোষণা করা হয়েছে যে, যার নিকট কোন প্রকার মদ থেকে থাকে, তা অমুক স্থানে উপস্থিত কর৷
সাহাবিগণের মধ্যে আদেশ পালনের অনুপম আগ্রহঃ আদেশ পাওয়া মাত্র অনুগত সাহাবীগণ নিজ নিজ ঘরে ব্যবহারের জন্যে রক্ষিত মদ তৎক্ষণাৎ ফেলে দিলেন৷ হযরত রসূলে-কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)—এর প্রেরিত এক ব্যক্তি মদীনার অলি-গলিতে প্রচার করতে লাগলেন যে, মদ্য পান ‘হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, তখন যার হাতে শারাবের পাত্র ছিল, তা তিনি সেখানেই ফেলে দিয়েছিলেন৷ যার কাছে মদের কলস বা মটকা ছিল, তা ঘর থেকে তৎক্ষণাৎ বের করে ভেঙ্গে ফেলেছেন৷ হযরত আনাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) তখন এক মজলিসে মদ্যপানে সাকীর কাজ সম্পাদন করছিলেন৷ আবু ত্বল‘হা, আবু ‘উবায়দা ইবনুল জাররা‘হ, ‘উবাই ইবনে কা‘আব, সোহাইল (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহুম আজমা‘য়ীন) প্রমূখ নেতৃস্থানীয় সাহাবিগণ সে মজলিসে উপস্থিত ছিলেন৷ প্রচারকের ঘোষণা কানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন— এবার সমস্ত শারাব ফেলে দাও৷ এর পেয়ালা, মটকা, হাঁড়ি ভেঙ্গে ফেল৷ অন্য বর্ণনায় আছে— ‘হারাম ঘোষণার সময় যার হাতে শরাবের পেয়ালা ছিল এবং তা ঠোঁট স্পর্শ করছিল, তাও তৎক্ষণাৎ সে অবস্থাতেই দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে৷ সেদিন মদীনায় এ পরিমাণ শারাব নিক্ষিপ্ত হয়েছিল যে, বৃষ্টির পানির মত শরাব প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছিল এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত মদীনার অলি-গলির অবস্থা এমন ছিল যে, যখনই বৃষ্টি হতো তখন শরাবের গন্ধ ও রং মাটির উপর ফুটে উঠত৷
যখন আদেশ হল যে, যার কাছে যে রকম মদ রয়েছে, তা অমুক স্থানে একত্রিত কর৷ তখন মাত্র সেসব মদই বাজারে ছিল যা ব্যবসার জন্যে রাখা হয়েছিল৷ এ আদেশ পালনকল্পে সাহাবীগণ বিনা দ্বিধায় নির্ধারিত স্থানে সব মদ একত্রিত করেছিলেন৷
হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বয়ং সেখানে উপস্থিত হয়ে স্বহস্তে শারাবের অনেক পাত্র ভেঙ্গে ফেললেন এবং অবশিষ্টগুলো সাহাবীগণের দ্বারা ভাঙ্গিয়ে দিলেন৷ জনৈক সাহাবী মদের ব্যবসা করতেন এবং সিরিয়া থেকে মদ আমদানী করতেন৷ ঘটনাচক্রে তখন তিনি মদ আনার উদ্যেশে সিরিয়া গিয়েছিলেন৷ যখন তিনি ব্যবসায়ের এ পণ্য নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং মদীনায় প্রবেশের পূর্বেই মদ ‘হারাম হওয়ার সংবাদ তাঁর কানে পৌঁছলো৷ তখন সে সাহাবীও তাঁর সমুদয় মাল- যা অনেক মুনাফার আশায় আনা হয়েছিল৷ এক পাহাড়ের পাদদেশে রেখে এসে হুযুরে-আকরম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে এসব সম্পদের ব্যাপারে কি করতে হবে তৎসম্পর্কে নির্দেশ প্রার্থনা করলেন৷ মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হুকুম করলেন—মটকাগুলো ভেঙ্গে সমস্ত শরাব ভাসিয়ে দাও৷ অতঃপর বিনা আপত্তিতে তিনি তাঁর সমস্ত পুঁজির বিনিময়ে সংগৃহীত এ পণ্য স্বহস্তে মাটিতে ঢেলে দিলেন৷ এটাও ইসলামের মু’জিযাহ্ এবং সাহাবিগণের বিস্ময়কর আনুগত্যের নিদর্শন, যা এ ঘটনায় প্রমাণ হল৷ যে জিনিসের অভ্যাস হয়ে যায়, সবাই জানে যে, তা ত্যাগ করা বড় কঠিন হয়ে পড়ে৷ মদ্যপানে তাঁরা এমন অভ্যস্ত ছিলেন যে, অল্পদিন তা থেকে বিরত থাকাও স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না৷ কিন্তু নবী কারীমের (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একটিমাত্র নির্দেশই তাঁদের অভ্যাসে এমন অপূর্ব বিপ্লব সৃষ্টি করল যে, তারপর থেকে তাঁরা শারাবের প্রতি তেমনি ঘৃণা পোষণ করতে লাগলেন, যেমন পূর্বে তাঁরা এর প্রতি আসক্ত ছিলেন৷
ইসলামী রাজনীতি এবং সাধারণ রাজনীতির পার্থক্যঃ আলোচ্য আয়াতে ও ঘটনাসমূহে শারাব ‘হারাম হওয়ার আদেশের প্রতি মুসলমানদের আনুগত্যের একটা নমুনা দেখা গেল৷ একে ইসলামের মু’জিযাহ্ বা নবী কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শিক্ষার বৈশিষ্ট অথবা ইসলামী রাজনীতির অপরিহার্য ফলশ্রুতিও বলা যেতে পারে৷ বস্তুতঃ নেশার অভ্যাস ত্যাগ করা যে অত্যন্ত কঠিন তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ তদুপরি ‘আরব দেশের কথা তো স্বতন্ত্র, সেখানে এর প্রচলন এত বেশি ছিল যে, মদ ছাড়া কয়েক ঘন্টা কাটানোও তাঁদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল৷ এমতাবস্থায় তা কি পরশপাথর ছিল যে, মাত্র একটি ঘোষণার শব্দ কানে পৌঁছামাত্র তাঁদের অভ্যাসে আমূল পরিবর্তন সাধিত হল! সে একটি মাত্র ঘোষণাই তাঁদের অভ্যাসে এমন পরিবর্তন সৃষ্টি করেছিল যে, কয়েক মিনিট পূর্বে যে জিনিস এত প্রিয় এবং এত লোভনীয় ছিল, অল্প কয়েক মিনিট পরে তাই অত্যান্ত ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য পরিগণিত হয়ে গেল।
অপরদিকে বর্তমান যুগের তথাকথিত উন্নত মানের রাজনীতির একটি উদাহরণ সামনে রেখে দেখা যাক৷ আজ থেকে কয়েক বৎসর পূর্বে আমেরিকার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এবং সমাজসংস্কারকগণ মদ্যপানের মারাত্মক ক্ষতিকর দিকগুলো অনুধাবন করে দেশে মদ্যপানকে আইন করে বন্ধ করতে চেয়েছিলেন৷ আর এজন্যে জনমত গঠনের সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসাবে অভিহিত প্রচারের আধুনিকতম যন্ত্রগুলোও ব্যবহার করা হয়েছিল৷ সবগুলো প্রচার-মাধ্যমই মদ্যপানের বিরুদ্ধে প্রচারে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল৷ শত শত সংবাদপত্রে নিবন্ধ প্রকাশিত হলো, পুস্তক-পুস্তিকা রচিত হল, লক্ষ লক্ষ পুস্তক ছেপে প্রচার ও বিতরণ করা হল৷ তাছাড়া আমেরিকার সংসদেও এজন্য আইন পাশ করা হল৷ কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমেরিকার যে অবস্থা মানুষের সামনে এবং সেখানকার সরকারী প্রতিবেদনের মাধ্যমে পৃথিবীর সামনে এসেছে, তা হল এই যে, এই আধুনিক উন্নত ও শিক্ষিত জাতি সেই আইনগত নিষেধাজ্ঞার সময়টিতে সাধারণ সময়ের চাইতেও অধিক মাত্রায় মদ্যপান করেছে৷ এমনকি অবশেষে সরকার এ আইন বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়৷
তদানীন্তন ‘আরবের মুসলমান এবং আধুনিক আমেরিকার উন্নত জাতির মধ্যকার পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট, যা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না৷ তবে এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই বিরাট পার্থক্যের প্রকৃত কারণ ও রহস্য কি?
একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে, ইসলামী শরী‘আত মানুষের সংশোধনের জন্য শুধু আইনকেই পর্যাপ্ত মনে করেনি৷ বরং আইনের পূর্বে তাদের মন-মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, ‘ইবাদত-আরাধনা এবং পরকালের চিন্তা নামক পরশমণির পরশে মনোজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে৷ যার ফলে রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)—এর একটিমাত্র আহবানেই তারা স্বীয় জান-মাল, শান-শওকত সবকিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়েছিল৷ মক্কী জীবনে এই মানুষ তৈরীর কাজই বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চলতে থাকে৷ এভাবে আত্মত্যাগীদের একটা বিরাট দল তৈরী হয়ে গেল।