হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত!

(মাওলানা আতীকুল্লাহ)

হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত!
কারবালা প্রান্তর

ষাট হিজরী। ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়ার জন্যে বায়আত নেয়া হচ্ছে। তার বয়েস তখন বেয়াল্লিশ। মদীনার দু’জন মানুষ তখনো বাইআত দেননি। হযরত হুসাইন ও আবদুল্লাহ বিন যুবায়ের (রা.)।

ইয়াযিদের প্রতিনিধি আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের কাছে বাইয়াত চাইল:

-আমি এই রাতটা ভেবে দেখি! পরে জানাবো।

-আচ্ছা ঠিক আছে।

আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাতের আঁধারে মদীনা ছেড়ে মক্কার দিকে পা বাড়ালেন।

এবার হুসাইন (রা.)-এর কাছে বাইয়াত চাওয়া হলো:

-আমি গোপনে বাইয়াত দেব না। দিলে প্রকাশ্যে দেব।

-ঠিক আছে।

তিনিও রাতের বেলা মক্কার পথ ধরলেন।

এ ছিল বাহ্যিক সূচনা। তবে বাইয়াত না পেছনে, দু’জনের চিন্তার গোড়াটা ছিল আরেকটু আগে। হযরত হাসান (রা.) সন্ধি করেছিলেন মুয়াবিয়া রা.-এর সাথে। তখন চুক্তিকে ঘিরে তিনটা চিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল:

ক: এ-চুক্তি পুরোপুরি পরিত্যজ্য। কারণ হাসান বৈধ খলীফা। আর মুয়াবিয়া খলীফা নন।

খ: এ চুক্তি বৈধ। তবে এর মেয়াদ হাসানের মৃত্যু পর্যন্ত।

গ: এ চুক্তি বৈধ। তবে এর মেয়াদ মুয়াবিয়ার মৃত্যু পর্যন্ত।

হুসাইন ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ছিলেন তৃতীয় মতের অনুসারী। তাই তারা মনে করতেন, ইয়াযিদ খিলাফাহর দাবীদার হতে পারে না। তবে হাসান ও মুয়াবিয়ার চুক্তিতে হুসাইনকে পরবর্তীতে খলীফা বানানোর কোনও ধারা ছিল বলে নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে কোনও তথ্য নেই।

সংবাদটা কূফায় পৌঁছলো। কুফাবাসীরা উৎসাহিত হয়ে উঠলো। তারা শুরু থেকেই মুয়াবিয়া বিরোধী ছিল। এখন হলো ইয়াযিদ বিরোধী। চিঠির পর চিঠি আসতে শুরু করলো। তারা হুসাইন (রা.)কে নানাভাবে বোঝাতে চাইল, তারা খুবই বিশ্বস্ত। ইয়াযিদের প্রতি তাদের কোনও শ্রদ্ধা নেই। বাইয়াতও নেই। প্রায় পাঁচশত চিঠি পাঠাল। প্রতিটি চিঠিতেই এক কথা:

আমরা আপনাকে বাইয়াত দিয়েছি। আর কারো সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ নেই।

হুসাইন রা. চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকীলকে পাঠালেন। অবস্থা যাচাই করার জন্যে। মুসলিম কুফায় এসে হানি বিন উরওয়ার ঘরে আতিথ্য গ্রহণ করলেন। লোকের দলে দলে এসে বাইয়াত হতে শুরু করলো।

তখন কূফার আমীর ছিলেন নু‘মান বিন বাশীর। তিনি এসব দেখেও না দেখার ভান করে রইলেন। ইয়াযিদের কাছে সংবাদ পৌঁছে গেল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্যে ওবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে কুফার গভর্নর করে পাঠালো। ইবনে যিয়াদ ছিল মূলত বসরার গভর্নর। এখন কুফার দায়িত্বও তাকে দেয়া হলো।

যিয়াদ রাতের বেলা কুফায় প্রবেশ করলো। মুখোশ পরাবস্থায়। কুফাবাসী মনে করলো, হুসাইন এসেছেন। ইবনে যিয়াদ সালাম দিতে দিতে হাঁটছিল। তারাও সাগ্রহে উত্তর দিতে শুরু করলো:

-ওয়া আলাইকুমুস সালাম হে রাসূলের নাতি!

ইবনে যিয়াদ বুঝতে পারলো, অবস্থা গুরুতর। শান্তচিত্তে গভর্নর প্রাসাদে চলে গেল। সাথে সাথেই তার আযাদকৃত দাস ‘মা‘কিল’কে পাঠাল। শহরের খবরখবর জানার জন্যে। সে খোঁজ করতে করতে হানি-এর ঘরে উপস্থিত হয়ে বাইয়াত গ্রহন করলো। সে নিজের পরিচয় দিল:

-আমি হিমস থেকে এসেছি। এই নিন হাদিয়াস্বরূপ তিন হাজার দীনার!

মা‘কিল এরপর আরও কয়েকদিন মুসলিমের কাছে থেকে গেল। সব খবর বিস্তারিত জানার পর একদিন সুযোগ বুঝে পলায়ন করে ইবনে যিয়াদের কাছে চলে এল।

অসংখ্য মানুষ বাইয়াত গ্রহণ করেছে। মুসলিম বিন আকীল এবার মক্কার খবর পাঠালেন। হুসাইন রা. ইয়াওমুত তারবিয়া (জিলহজ্বের আট তারিখে) মক্কা থেকে রওয়ানা দিলেন।

ইবনে যিয়াদ তৎপর হয়ে উঠলো। হানি বিন উরওয়ার ঘরে এসে প্রশ্ন করলো:

-মুসলিম কোথায়?

-আমি জানি না।

ইবনে যিয়াদ এবার মা‘কিলকে ডেকে পাঠালো। তাকে দেখিয়ে হানিকে জিজ্ঞেস করলো:

-দেখো তো একে চিনতে পারো কি না?

হানি বুঝতে পারলো, মাকিল আগের বার তাদেরকে ধোঁকা দিয়েছিল। সে ইবনে যিয়াদের লোক হয়েই এখানে এসেছিল। এখন আর কিছু করার নেই। ভুল যা হওয়ার আগেই হয়ে গেছে।

তাকে আবার প্রশ্ন করা হলো:

-মুসলিম কোথায়?

-আল্লাহর কসম! তিনি যদি আমার পায়ের নিচেও থাকতেন, তবুও আমি পা ওঠাতাম না।

ইবনে যিয়াদ হানিকে আঘাত করলো। বন্দী করার আদেশ দিয়ে মুসলিমের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো।

আবু মুসলিমের কাছে সংবাদ পৌঁছে গেল। তিনি চার হাজার লোক নিয়ে ইবনে যিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করলেন। কুফাবাসীরাও তার সাথে যোগ দিল।

ইবনে যিয়াদের কাছে তখন কুফার অনেক গন্যমান্য ব্যক্তি ছিল। তাদেরকে ইবনে যিয়াদ বললো:

-তোমরা তোমাদের লোকদেরকে মুসলিম থেকে আলাদা করো। না হলে ইয়াযিদের বাহিনী এসে তোমাদেরকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে।

ইবনে যিয়াদ আরও নানাভাবে ভয় দেখালো। নেতাদেরকে প্রভূত উপহার-উপাচার দিয়ে হাত করে ফেললো। নেতারা বের হয়ে নিজের অনুসারীদেরকে নিয়ে যেতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত মুসলিম বিন আকীলের সাথে মাত্র ত্রিশ জন বাকী থাকলো। বিকেল হতে হতে তারাও সরে পড়লো।

মুসলিম সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়লেন। পুরো কুফা সুনসান। তিনি একা একা রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছেন। কেউ আশ্রয় দিতে রাজী নয়। ভেবে পাচ্ছিলেন না কোন দিকে যাবেন। একটা দরজায় গিয়ে টোকা দিলেন। দরজা খুলল কিনদা গোত্রের এক মাহিলা।

-কী চাই?

-আমি মুসলিম বিন আকীল। একটু খাবার পানি হবে?

পানি দেয়া হলো। এদিকে মহিলার ছেলে গিয়ে ইবনে যিয়াদের লোকদেরকে খবর দিল। তারা এসে মুসলিমকে বন্দী করে নিয়ে গেল।

সত্তরজন লোক এসে বাড়িটা ঘিরে ফেললো। মুসলিম বের হয়ে বীরের মতো তাদের সাথে লড়লেন। কিন্তু অবশেষে বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পন করলেন। ইবনে যিয়াদের সামনে উপস্থিত করা হলো।

-তুমি কেন কুফায় এসেছ?

-হুসাইনের পক্ষে বাইয়াত নেয়ার জন্যে।

-তোমার ওপর কি ইয়াযিদের বাইয়াত ছিল না? আমি এখন তোমাকে হত্যা করবো!

-আমাকে একটুখানি সময় দাও। আমি একটু ওসিয়ত করতে চাই!

-ঠিক আছে!

মুসলিম বিন আকীল দরবারে উপস্থিত সবার দিকে তাকালেন। চোখ পড়লো উমার বিন সাদ বিন আবী ওয়াক্কাসের ওপর:

-আপনিই এখানে আমার নিকটাত্মীয়। আপনাকে শেষ ওসীয়ত করে যাই!

মুসলিম তাকে নিয়ে ঘরের এক কোনে চলে গেলেন:

আপনাকে আমার একটাই ওসীয়ত! আপনি যে কোনও মূল্যে হুসাইনের কুফায় আগমন ঠেকান। মুসলিম তাকে একটা ছোট্ট চিরকুটও দিলেন। তাকে লিখলেন:

-আপনি পরিবার-পরিজন নিয়ে ফিরে যান। কুফাবাসী আপনার সাথে মিথ্যা বলেছে। আমার সাথে মিথ্যা বলেছে। আর মিথ্যাবাদীর মতামতের কোনও মূল্য নেই।

মুসলিম বিন আকীলকে শহীদ করে দেয়া হলো। সেদিন ছিল আরাফার দিন। জিলহজ্জের নয় তারিখ। হুসাইন (রা.) এর আগেই মক্কা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

হুসাইন (রা.) কে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে দেখে, অসংখ্য সাহাবী তাকে নিষেধ করেছেন। বের হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। কেউবা জোরাজুরিও করেছেন।

নিষেধকারীদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং তাঁর ভাই মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফীয়া।

ইবনে উমার বলেছিলেন:

হুসাইন! জিবরীল (আঃ) নবীজিকে দুনিয়া ও আখিরাত- এ দুটি থেকে যে কোন একটি গ্রহণ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তিনি আখিরাতকে বেছে নিয়েছেন। আর তুমি তাঁর অংশ। আল্লাহর কসম! তোমাদের কেউ কখনই দুনিয়ার সম্পদ লাভে সক্ষম হবে না। তোমাদের ভালর জন্যই আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন।

হুসাইন তাঁর প্রস্তাবে সাড়া দিলেন না। ইবনে উমার অশ্রুসজল চোখে বিদায় জানালেন।

ইবনে আব্বাস (রা:) হুসাইনকে বলেছেন:

মানুষের দোষারোপের ভয় না থাকলে আমি তোমার মাথা চেপে ধরে বিরত রাখতাম।

আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা:) হুসাইনকে বলেছেন:

হোসাইন! কোথায় যাও? এমন লোকদের কাছে যাচ্ছো, যারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে এবং তোমার ভাইকে আঘাত করেছে?

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা:) বলেছেন:

হুসাইন তাঁর জন্য নির্ধারিত ফয়সালার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছেন। আল্লাহর শপথ! তাঁর বের হওয়ার সময় আমি যদি উপস্থিত থাকতাম, তাহলে কখনই তাকে যেতে দিতাম না। তবে বল প্রয়োগ করে আমাকে পরাজিত করলে সে কথা ভিন্ন।

আবু সায়ীদ খুদরী (রা.) বলেছেন:

হুসাইন! তুমি যেয়ো না। আমি তোমার বাবাকে বলতে শুনেছি: আল্লাহর কসম! আমি তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েছি। তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছি। তারাও আমার প্রতি বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে কোনও নিয়ত নেই। সংকল্প নেই।

বিখ্যাত কবি ফারাযদাক বলেছেন, আমার সাথে তার দেখা হয়েছিল। তিনি প্রশ্ন করলেন:

-তুমি কোত্থেকে?

-ইরাক থেকে!

-ইরাকবাসীর অবস্থা কী?

তাদের হৃদয় আপনার সাথে আছে আর তাদের তরবারি আছে বনু উমাইয়ার সাথে।

হুসাইনের কাছে মুসলিম বিন আকীলের সংবাদ পৌঁছলো। হুসাইন ফিরে যাওয়ার চিন্তা করলেন। মুসলিমের সন্তানরা বললো:-

আমরা ফিরে যাব না। আমাদের পিতৃহত্যার বদলা নেব।

অগত্য হুসাইন সিদ্ধান্ত বদল করলেন। চলতে চলতে কাদেসিয়া পৌঁছলেন।

ইবনে যিয়াদ হুসাইনের আগমনের সংবাদ জানতে পেরে, হুর বিন ইয়াযিদ তামীমিকে এক হাজার সেনাসহ পাঠালো। হুর এসে হোসাইনের সাথে কথা বললো:

-কোথায় যাচ্ছেন?

-ইরাকে!

আপনি সেখানে যাবেন না। ফিরে যান। না হলে সিরিয়াতে যান। না হলে আমাকে তিক্ত কিছু করতে হবে।

হুসাইন তার কথা না মেনে চলতে থাকলেন। হুরও বাধা-নিষেধ করতে থাকলো। নানাভাবে। হুসাইন কঠিনভাবে হুরকে ধমক দিলেন। হুর বললো:

অন্য কেউ এমন কথা আমাকে বললে, আমি অবশ্যই এর প্রতিশোধ নিতাম।

হুসাইন কারবালার প্রান্তরে পৌঁছলেন। সেখানে ইবনে যিয়াদের বাহিনী তার গতিরোধ করলো। হুসাইন তখন তিনটি প্রস্তাবের যে কোন একটি মেনে নেওয়ার আহবান জানালেন।

এক: তাকে ইয়াযিদের দরবারে যেতে দেয়া হোক। তিনি সেখানে গিয়ে ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করবেন।

হুসাইন জানতেন, ইয়াজিদ তাঁকে হত্যা করতে চায় না।

দুই: অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক।

তিন: অথবা তাঁকে কোনও এক সীমান্তের দিকে চলে যেতে দেয়া হোক। সেখানে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত বসবাস করবেন এবং রাজ্যের সীমানা পাহারা দেয়ার কাজে আত্ম নিয়োগ করবেন।

ইবনে যিয়াদের সৈন্যরা কোন প্রস্তাবই মানতে রাজী হল না। তারা বলল:

-উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ যেই ফয়সালা দিবেন আমরা তা ব্যতীত অন্য কোন প্রস্তাব মানতে রাজী নই।

হুর বিন ইয়াজিদ এ অবস্থা দেখে, দলত্যাগ করে হুসাইনের সাথে যোগ দিলেন। পরে তিনি লড়াই করতে করতে শহীদ হয়েছিলেন।

[highlight]

ইবনে যিয়াদবাহিনীর প্ররোচনায় এ অসম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। একে একে সবাই শহীদ হয়ে গেলেন। বাকী রইলেন শুধু হুসাইন রা.। কেউ চাচ্ছিল না, হুসাইন তার সামনে পড়ৃক। দীর্ঘ সময় একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো। তখন সীমার বিন যুল জাওশান তার দলবল নিয়ে হুসাইন রা.-কে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। তারপর বর্শা দিয়ে আঘাত করে হুসাইনকে ধরাশায়ী করে ফেলল। তারপর সম্মিলিত আক্রমণে হুসাইন রা. শাহাদাত বরণ করেন।

সীমার আরও অগ্রসর হয়ে, হুসাইনের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। কারো কারো মতে, এ জঘন্য কাজটা করেছে ‘সিনান বিন আনাস আন্ নাখঈ’।

[/highlight]

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ