আল-ফাতিহা

سُورَةُ الفَاتِحَةِ

সূরা আল-ফাতি‘হা-১

(মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত ৭)

بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ١

১. পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালূ আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি।

ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٢

২. যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ্‌ তা‘আলার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।

ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ ٣

৩. যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু।

مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ ٤

৪. যিনি বিচার দিনের মালিক।

إِيَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ ٥

৫. আমরা একমাত্র তোমারই ‘ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

ٱهۡدِنَا ٱلصِّرَٰطَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ ٦

৬. আমাদেরকে সরল পথ দেখাও,

صِرَٰطَ ٱلَّذِينَ أَنۡعَمۡتَ عَلَيۡهِمۡ غَيۡرِ ٱلۡمَغۡضُوبِ عَلَيۡهِمۡ وَلَا ٱلضَّآلِّينَ ٧

৭. তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি তোমার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

সূরা আল-ফাতি‘হা

ফযীলত ও বৈশিষ্ট্য:

সূরা আল-ফাতি‘হা কুরআনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সূরা।

প্রথমত: এ সূরা দ্বারাই পবিত্র কুরআন আরম্ভ হয়েছে এবং এ সূরা দিয়েই সর্বশ্রেষ্ঠ ‘ইবাদত সলাত তথা নামায/সলাত আরম্ভ হয়। অবতরণের দিক দিয়েও পূর্ণাঙ্গ সূরারূপে এটিই প্রথম নাযিল তথা অবতীর্ণ হয়। সূরা “‘আলাক্ব/ইক্বরা”, “মুঝ্ঝাম্মিল” ও সূরা ‘মুদ্দাচ্ছিরে’র ক’টি আয়াত অবশ্য সূরা ফাতি‘হার পূর্বে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সূরারূপে এ সূরার অবতরণই সর্বপ্রথম। যে সকল সা’হাবী (রদ্বিয়াল্ল-হু আজমাঈন) সূরা ফাতি‘হা সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন, তাঁদের সে বক্তব্যের অর্থ বোধহয় এই যে, পরিপূর্ণ সূরারূপে এর আগে আর কোন সূরা নাযিল হয়নি। এ জন্যই এ সূরার নাম ‘ফাতি‘হাতুল-কিতাব’ বা কুরআনের উপক্রমণিকা রাখা হয়েছে।

‘সূরা-ফাতি‘হা’ এদিক দিয়ে সমগ্র কুরআনের সার-সংক্ষেপ। এ সূরায় সমগ্র কুরআনের সারমর্ম সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআনের অবশিষ্ট সূরাগুলো প্রকারান্তরে সূরা ফাতি‘হার বিস্তৃত ব্যাখ্যা। কারণ, সমগ্র কুরআন প্রধানত: ঈমান এবং নেক ‘আমলের আলোচনাতেই কেন্দ্রীভূত। আর এ দু’টি মূলনীতিই এ সূরায় সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা করা হয়েছে। তাফসীরে রূ‘হুল মা‘আনী ও রূ‘হুল বায়ানে এর বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। তাই এ সূরাকে স‘হীহ ‘হাদীসে ‘উম্মুল কুরআন’, ‘উম্মুল কিতাব’, ‘কুরআনুন ‘আযীম’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে। [ক্বুরতুবী]

অথবা এ জন্য যে, যে ব্যক্তি কুরআন তিলাওয়াত বা অধ্যয়ন করবে তার জন্য এ মর্মে বিশেষ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, সে যেন প্রথমে পূর্বঘোষিত যাবতীয় ধ্যান-ধারণা অন্তর থেকে দূরীভূত করে একমাত্র সত্য ও সঠিক পথের সন্ধানের উদ্দেশ্যে এ কিতাব তিলাওয়াত আরম্ভ করে এবং আল্লাহ্‌র নিকট এ প্রার্থনা করে যে, তিনি যেন তাকে সির-ত্বল মুস্তাক্বীমের হিদায়াত তথা সরল পথ দান করেন।

রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন যে, যার হাতে আমার জীবন-মরণ, আমি তাঁর শপথ করে বলছি, সূরা ফাতি‘হার দৃষ্টান্ত তাউরা-ত, ইনজীল, যাবূর প্রভৃতি অন্যকোন আসমানী কিতাবে তো নেই-ই, এমন কি পবিত্র কুরআনেও এর দ্বিতীয় নেই। ইমাম তিরমিযী (র’হ,) আবূ হুরইরাহ (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেছেন যে, সূরা ফাতি‘হা প্রত্যেক রোগের রোগ-প্রতিষেধক বিশেষ।

‘হাদীস শরীফে সূরা ফাতি‘হাকে সূরা শিফা-ও বলা হয়েছে। [ক্বুরতুবী]

বুখারী শরীফে হযরত আনাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, সমগ্র কুরআনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সূরা হচ্ছে ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ  [ক্বুরতুবী]

بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

পরম করুণাময় দয়ালূ আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি

بِسۡمِ ٱللَّهِ  কুরআনের একটি আয়াত:

بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ কুরআন শরীফের সূরা নাম্‌লের একটি আয়াত বা অংশ। সূরা তাউবা ব্যতীত প্রত্যেক সূরার প্রথমে بِسۡمِ ٱللَّهِ লেখা হয়। بِسۡمِ ٱللَّهِ সূরা ফাতি‘হার অংশ না অন্যান্য সকল সূরারই অংশ, এতে ইমামগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। ইমাম আবূ ‘হানীফা (র‘হমাতুল্ল-হি ‘আলাইহি) বলেছেন, بِسۡمِ ٱللَّهِ  সূরা নাম্‌ল্‌ ব্যতীত অন্য কোন সূরার অংশ নয়। তবে এটি এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আয়াত যা প্রত্যেক সূরার প্রথমে লেখা এবং দু’টি সূরার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে।

      কুরআন তিলাওয়াত ও প্রত্যেক কাজ বিসমিল্লাহ্‌সহ আরম্ভ করার আদেশ:

জাহিলিয়্যাত যুগে লোকদের অভ্যাস ছিল, তারা তাদের প্রত্যেক কাজ উপাস্য দেব-দেবীদের নামে শুরু করতো। এ প্রথা রহিত করার জন্য জিব্‌রীল (‘আ,) পবিত্র কুরআনের সর্বপ্রথম যে আয়াত নিয়ে এসেছিলেন, তাতে আল্লাহ্‌র নামে কুরআন তিলাওয়াত আরম্ভ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। যথা إقْرَأ بِاسۡمِ رِبِّكَ الَّذِى خَلَقَ অর্থাৎ, পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে।

কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায়, স্বয়ং রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-ও প্রথমে প্রত্যেক কাজ بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ বলে আরম্ভ করতেন এবং কোন কিছু লেখাতে হলেও এ কথা প্রথমে লেখাতেন। কিন্তু  بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ অতীর্ণ হওয়ার পর সর্বকালের জন্য ‘বিস্‌মিল্লাহির্‌ র‘হমানির্‌’ র‘হীম বলে সব কাজ শুরু করার নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে। [ক্বুরতুবী,রু‘হুল মা‘আনী]

কুরআন শরীফের স্থানে স্থানে উপদেশ রয়েছে যে, প্রত্যেক কাজ বিস্‌মিল্লাহ্‌ বলে আরম্ভ কর। রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “যে কাজ বিস্‌মিল্লাহ্‌ ব্যতীত আরম্ভ করা হয়, তাতে কোন বরকত থাকে না।”

এক ‘হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, ঘরের দরজা বন্ধ করতে বিস্‌মিল্লাহ্‌ বলবে, বাতি নিভাতেও বিস্‌মিল্লাহ্‌ বলবে, পাত্র আবৃত করতেও বিস্‌মিল্লাহ্‌ বলবে। কোন কিছু খেতে, পানি পান করতে, ওদ্বূ/অযু করতে, সওয়ারীতে আরোহণ করতে এবং তা থেকে অবতরণকালেও বিস্‌মিল্লাহ্‌ বলার নির্দেশ কুরআন ও ‘হাদীসে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। [ক্বুরতুবী]

বিস্‌মিল্লাহ্‌র তাফসীর:

বিস্‌মিল্লাহ্‌ বাক্যটি তিনটি শব্দ দ্বারা গঠিত।

প্রথমত: ‘বা’ বর্ণ,

দ্বিতীয়ত: ‘ইসম’ ও

তৃতীয়ত: ‘আল্লাহ’।

‘আরবী ভাষায় ‘বা’ বর্ণটি অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তন্মধ্যে তিনটি অর্থ এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে এবং এ তিনটির যে কোন একটি অর্থ এ ক্ষেত্রে গ্রহণ করা যেতে পারে।

এক-সংযোজন। অর্থাৎ, এক বস্তুকে অপর বস্তুর সাথে মিলানো বা সংযোগ ঘটানো অর্থে।

দুই-ইস্তি‘আনাত। অর্থাৎ, কোন বস্তুর সাহায্য নেয়া।

তিন কোন বস্তু থেকে বরকত হাসিল করা।

‘ইস্‌ম্‌’ শব্দের ব্যাখ্যা অত্যন্ত ব্যাপক। মোটামুটিভাবে এতটুকু জেনে রাখা যথেষ্ট যে, ‘ইস্‌ম্‌’ নামকে বলা হয়। ‘আল্লাহ্‌’ শব্দ সৃষ্টিকর্তার নামসমূহের মধ্যে সবচেয়ে মহত্ত্বর ও তাঁর যাবতীয় গুণাবলীর সম্মিলিত রূপ। কোন কোন ‘আলিম একে ইস্‌মে ‘আ’যম বলেও অভিহিত করেছেন।

এ নামটি আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো জন্য প্রযোজ্য নয়। এজন্যই এ শব্দটির দ্বিবচন বা বহুবচন হয় না। কেননা, আল্লাহ্‌ এক; তাঁর কোন শরীক বা অংশীদার নেই। মোটকথা, আল্লাহ্‌ এমন এক সত্তার নাম, যে সত্তা পালনকর্তার সমস্ত গুণাবলীর এক অসাধারণ প্রকাশবাচক। তিনি অদ্বিতীয় ও নজীরবিহীন তথা অতুলনীয়। এজন্য বিস্‌মিল্লাহ্‌ শব্দের মধ্যে ‘বা’-এর তিনটি অর্থের সামঞ্জস্য হচ্ছে আল্লাহ্‌র নামের সাথে, তাঁর নামের সাহায্যে এবং তাঁর নামের বরকতে।

তা‘আওউয শব্দের অর্থ أعُوْذُ بِاللّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ  পাঠ করা।

আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে– যখন কুরআন পাঠ কর, তখন শয়তানের প্রতারণা থেকে আল্লাহ্‌ তা‘আলার নিকট আশ্রয় চাও।

দ্বিতীয়ত: কুরআন পাঠের প্রাক্কালে ‘আঊযু বিল্লা-হ্‌ পাঠ করা ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুন্নাহ/সুন্নত বলে স্বীকৃত হয়েছে। এ পাঠ সলাত/নামাযের মধ্যেই হোক বা সলাত/নামাযের বাইরেই হোক। কুরআন তিলাওয়াত ব্যতীত অন্যান্য কাজে শুধু বিস্‌মিল্লাহ্‌ পাঠ করা সুন্নাহ/সুন্নত, আ‘ঊযু বিল্লা-হ্‌ নয়। তিলাওয়াত কালে উভয়টি পাঠ করা সুন্নাহ/সুন্নত। তবে একটি সূরা শেষ করে শুধুমাত্র সূরা তাউবা ব্যতীত অপর সূরা আরম্ভ করার পূর্বে যখন কুরআন তিলাওয়াত আরম্ভ করা হয় তখন আ‘ঊযু বিল্লা-হ্‌ ও বিস্‌মিল্লাহ্‌ উভয়টিই পাঠ করতে হয়। তিলাওয়াত করার সময় মধ্যে সূরা বারাআত আসলে তখন বিস্‌মিল্লাহ্‌ পড়া নিষেধ। কিন্তু প্রথম তিলাওয়াতই যদি সূরা বারাআত দ্বারা আরম্ভ হয়, তবে তা‘আওউয/আ‘ঊযু বিল্লা-হ্‌ ও তাসমিয়াহ/বিসমিল্লাহ উভয়টিই পাঠ করতে হবে। [ফতোয়া ‘আলমগীরি]

‘বিসমিল্লাহির্‌ র‘হমানির্‌ র‘হীম’, কুরআনের সূরা নাম্‌ল্‌ এর একটি আয়াতের অংশ এবং দু’টি সূরার মাঝখানে একটি পূর্ণাঙ্গ আয়াত। তাই অন্যান্য আয়াতের ন্যায় এ আয়াতটির সম্মান করাও ওয়াজিব। ওদ্বূ/অযু ছাড়া এটি স্পর্শ করা জায়েয নয়। অপবিত্র অবস্থায় যথা হায়েয- (স্ববালগ মেয়েদের প্রতি মাসে নির্ধারিত সময়ে যে রক্ত প্রবাহিত হয়), নেফাসের-(মহিলাদের বাচ্চা প্রসবের পর যে রক্ত প্রবাহিত হয়)-সময়, (পবিত্র হওয়ার পূর্বে) তিলাওয়াতরূপে পাঠ করাও না-জায়েয। তবে কোন কাজ-কর্ম আরম্ভ করার পূর্বে (যথা-পানাহার ইত্যাদি) দু‘আরূপে পাঠ করা সব সময়ই জায়েয।

আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়:

সূরতুল-ফাতি‘হার বিষয়বস্তু: সূরতুল-ফাতি‘হার আয়াত সংখ্যা সাত। প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহ্‌র প্রশংসা এবং শেষের তিনটি আয়াতে মানুষের পক্ষ থেকে আল্লাহ্‌র নিকট প্রার্থনা ও দরখাস্ত তথা আবেদনের বিষয়বস্তুর সংমিশ্রণ। মধ্যের একটি আয়াত প্রশংসা ও দু‘আ মিশ্রিত।

মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হুরইরাহ (রদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বর্ণনা করেছেন যে, রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ্‌ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন: নামায/সলাত (অর্থাৎ, সূরতুল-ফাতি‘হা) আমার এবং আমার বান্দাদের মধ্যে দু’ভাগে বিভক্ত। অর্ধেক আমার জন্য আর অর্ধেক আমার বন্দাদের জন্য। আমার বান্দাগণ যা চায়, তা তাদেরকে দেয়া হবে। অতঃপর রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন যে, যখন বান্দাগণ বলে ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ তখন আল্লাহ্‌ বলেন যে, আমার বান্দাগণ আমার প্রশংসা করছে। আর যখন বলে  ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ তখন তিনি বলেন যে, তারা আমার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করছে। আর যখন বলে مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ তখন তিনি বলেন, আমার বান্দাগণ আমার গুণগান করছে। আর যখন বলে . إِيَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ তখন তিনি বলেন, এ আয়াতটি আমার এবং আমার বান্দাগণের মধ্যে সংযুক্ত। কেননা, এর এক অংশে আমার প্রশংসা এবং অপর অংশে বান্দাগণের দু‘আ ও ‘আরয তথা অনুরোধ রয়েছে। এ সঙ্গে এ কথাও  বলা হয়েছে যে, বান্দাগণ যা চাইবে তারা তা পাবে।

অতঃপর বান্দাগণ যখন বলে ٱهۡدِنَا ٱلصِّرَٰطَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ (শেষ পর্যন্ত) তখন আল্লাহ্‌ বলেন, এসবই আমার বান্দাগণের জন্য এবং তারা যা চাইবে তা পাবে। [তাফসীরে মাযহারী]

ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ (সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌ তা‘আলার)। অর্থাৎ, দুনিয়াতে যে কোন স্থানে যে কোন বন্তুর প্রশংসা করা হয়, বাস্তবে তা আল্লাহ্‌রই প্রশংসা। কেননা, এ বিশ্ব চরাচরে অসংখ্য মনোরম দৃশ্যাবলী, অসংখ্য মনোমুগ্ধকর সৃষ্টিরাজি আর সীমাহীন উপকারী বস্তুসমূহ সর্বদাই মানব মনকে আল্লাহ্‌ তা‘আলার প্রতি আকৃষ্ট করতে থাকে এবং তাঁর প্রশংসায় উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, সকল বস্তুর অন্তরালেই এক অদৃশ্য সত্তার নিপুণ হাত সদা সক্রিয়।

যখন পৃথিবীর কোথাও কোন বস্তুর প্রশংসা করা হয়, তখন প্রকৃতপক্ষে তা উক্ত বস্তুর সৃষ্টিকর্তার প্রতিই বর্তায়। যেমন, কোন চিত্র, কোন ছবি বা নির্মিত বস্তুর প্রশংসা করা হলে প্রকৃতপক্ষে সে প্রশংসা প্রস্তুতকারকেরই করা হয়।

এ বাক্যটি প্রকৃতপক্ষে মানুষের বাস্তবতার একটি নতুন দ্বার উন্মুক্ত করে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের সামনে যা কিছু রয়েছে এ সব কিছুই একটি একক সত্তার সাথে জড়িত এবং সকল প্রশংসাই সে অনন্ত অসীম শক্তির। এসব দেখে কারো অন্তরে যদি প্রশংসাবাণীর উদ্রেক হয় এবং মনে করে যে, তা অন্য কারো প্রাপ্য, তবে এ ধারণা জ্ঞান-বুদ্ধির সংকীর্ণতারই পরিচায়ক। সুতরাং নিঃসন্দেহে একথাই বলতে হয় যে,

ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ যদিও প্রশংসার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে অতি সুক্ষ্মতার সাথে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সকল সৃষ্টবস্তুর উপাসনাই নিষিদ্ধ করা হলো। তাছাড়া এ দ্বারা অত্যন্ত আকর্ষণীয় পদ্ধতীতে একত্ববাদের শিক্ষাও দেয়া হয়েছে। আল-কুরআনের এ ক্ষুদ্র বাক্যটিতে একদিকে আল্লাহ্‌ তা‘আলার প্রশংসা করা হয়েছে এবং অপরদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নিমগ্ন মানব মনকে এক অতীবাস্তবের দিকে আকৃষ্ট করতঃ যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুর পুজা-অর্চনাকে চিরতের নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতদসঙ্গে অতি ‘হিকমতের সাথে বা অকাট্যভাবে ঈমানের সর্বপ্রথম স্তম্ভ ‘তাও‘হীদ’ বা একত্ববাদের পরিপূর্ণ নকশাও তুলে ধরা হয়েছে। একটু চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, বাক্যটিতে যে দাবী করা হয়েছে, সে দাবীর স্বপক্ষে দলীল-প্রমাণও দেয়া হয়েছে।

رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ -এ ক্ষুদ্র বাক্যটির পরেই আল্লাহ্‌ তা‘আলার প্রথম গুণবাচক নাম ‘রব্বুল ‘আলামীন’ -এর উল্লেখ করা হয়েছে। ‘আরবী ভাষায় رَبٌّ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পালনকর্তা। লালন-পালন বলতে বোঝায়, কোন বস্তুকে তার সমস্ত মঙ্গলামঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য রেখে ধীরে ধীরে বা পর্যায়ক্রমে সামনে এগিয়ে নিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেয়া।

এ শব্দটি একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্যই নির্দিষ্ট। সম্বন্ধপদরূপে অন্যের জন্যেও ব্যবহার করা চলে, সাধারণভাবে নয়। কেননা, প্রত্যেকটি প্রাণী বা সৃষ্টিই প্রতিপালিত হওয়ার মুখাপেক্ষী, তাই সে অন্যের প্রকৃত প্রতিপালনের দায়িত্ব নিতে পারে না।

ٱلۡعَٰلَمِينَ শব্দটি عَالَم শব্দের বহুবচন। এতে পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টিই অন্তর্ভূক্ত। যথা– আকাশ-বাতাস, চন্দ্র-সূর্য, তারকা-নক্ষত্ররাজি, বিজলী, বৃষ্টি, ফেরেশতাকুল, জ্বিন, জমীন এবং এতে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে। জীবজন্তু, মানুষ, উদ্ভিদ, জড়পদার্থ সব কিছুই এর অন্তর্ভূক্ত। অতএব رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ -এর অর্থ হচ্ছে-আল্লাহ্‌ তা‘আলা সমস্ত সৃষ্টির পালনকর্তা। তাছাড়া একথাও চিন্তার উর্ধ্বে নয় যে, আমরা যে দুনিয়াতে বসবাস করছি এর মধ্যেও কোটি কোটি সৃষ্টবস্তু রয়েছ। এ সৃষ্টিগুলোর মধ্যে যা কিছু আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় এবং যা আমরা দেখি না সে সবগুলোই এক একটা ‘আলম বা জগত।

তাছাড়া আরো কোটি কোটি সৃষ্টি রয়েছে, যা সৌরজগতের বাইরে, যা আমরা অবলোকন করতে পারি না। ইমাম রাযী (র’হ,) তাফসীরে কাবীরে লিখেছেন যে, এ সৌরজগতের বাইরে আরো সীমাহীন জগত রয়েছে। যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত এবং একথা সর্বজনবিদিত যে, সকল বস্তুই আল্লাহ্‌র ক্ষমতার অধীন। সুতরাং তাঁর জন্য সৌরজগতের অনুরূপ আরো সীমাহীন কতকগুলো জগত সৃষ্টি করে রাখা অসম্ভ মোটেই নয়।

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা পরিস্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ -এর নিখুঁত প্রতিপালন নীতিই পূর্বের বাক্য ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ   -এর দলীল বা প্রমাণ। সমগ্র সৃষ্টির লালন-পালনের দায়িত্ব একই পবিত্র সত্তার; তাই তা’রীফ-প্রশংসারও প্রকৃত প্রাপক তিনিই; অন্য কেউ নয়। এজন্য প্রথম আয়াত ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ  -এ তা’রীফ-প্রশংসার সাথে ঈমানের প্রথম স্তম্ভ আল্লাহ্‌ তা‘আলার একত্ব বা তাও‘হীদের কথা অতী সুক্ষ্মভাবে এসে গেছে।

দ্বিতীয় আয়াতে তাঁর গুণ, দয়ার প্রসঙ্গ رَحۡمَٰن ও رَحِيمِ শব্দদ্বয়ের দ্বারা বর্ণনা করেছেন। উভয় শব্দেই ‘গুণের আধিক্যবোধক বিশেষণ’ যাতে আল্লাহ্‌র দয়ার অসাধারণত্ব ও পূর্ণতার কথা বোঝায়। এ স্থলে এ গুণের উল্লেখ সম্ভবত: এ জন্য যে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা যে সমগ্র সৃষ্টিজগতের লালন-পালন ভরণ-পোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং প্রভাবান্বিত হয়েও নয়; বরং তাঁর র‘হমত বা দয়ার তাগিদেই করেছেন। যদি সমগ্র সৃষ্টির অস্তিত্বও না থাকে, তাতেও তাঁর কোন লাভ-ক্ষতি নেই, আর যদি সমগ্র সৃষ্টি অবাধ্যও হয়ে যায় তবে তাতেও তাঁর কোন ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই।

مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ –এর অর্থ কোন বস্তুর উপর এমন অধীকার থাকা, যাকে ব্যবহার, রদবদল, পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সব কিছু করার সকল অধিকার থাকবে। دِيْن –অর্থ প্রতিদান দেয়া। مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ  এর শাব্দিক অর্থ প্রতিদান দিবসের মালিক বা অধিপতি। অর্থাৎ, প্রতিদান দিবসের অধিকার ও আধিপত্য কোন বস্তুর উপরে হবে, তার কোন বর্ণনা দেয়া হয়নি। তাফসীরে কাশশাফে বলা হয়েছে যে, এতে ‘আম’ বা অর্থের ব্যাপকতার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিদান দিবসের সকল সৃষ্টিরাজি ও সকল বিষয়ই আল্লাহ্‌ তা‘আলার অধিকারে থাকবে।

প্রতিদান দিবসের স্বরূপ ও তার প্রয়োজনীয়তা:

প্রথমত: প্রতিদান দিবস কাকে বলে এবং এর স্বরূপ কি?

দ্বিতীয়ত: সমগ্র সৃষ্টির উপর প্রতিদান দিবসে যেমনিভাবে আল্লাহ্‌ তা‘আলার একক অধিকার থাকবে, অনুরূপভাবে আজও সকল কিছুর উপর তাঁরই তো একক অধিকার রয়েছে; সুতরাং প্রতিদান দিবসের বৈশিষ্ট্য কোথায়?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে এই যে, প্রতিদান দিবস সে দিনকেই বলা হয়, যেদিন আল্লাহ্‌ তা‘আলা ভাল-মন্দ সকল কাজ কর্মের প্রতিদান দিবেন বলে ঘোষণা করেছেন। রোযে জাযা তথা প্রতিদান দিবস শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, দুনিয়া ভাল-মন্দ কাজ কর্মের প্রকৃত ফলাফল পাওয়ার স্থান নয়; বরং এটি হল কর্মস্থল; কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের জায়গা। যথার্থ প্রতিদান বা পুরস্কার গ্রহণেরও স্থান এটা নয়। এতে একথাও বুঝা যাচ্ছো যে, পৃথিবীতে কারো অর্থ-সম্পদের আধিক্য ও সুখ-শান্তির ব্যাপকতা দেখে বলা যাবে না যে, এ লোক আল্লাহ্‌র দরবারে মক্ববূল হয়েছে বা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বা তিনি আল্লাহ্‌র প্রিয় পাত্র। অপর পক্ষে কাকেও বিপদাপদে পতিত দেখেও বলা যাবে না যে, তিনি আল্লাহ্‌র অভিশপ্ত। যেমনি করে কর্মস্থলে বা কারখানার কোন কোন লোককে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যস্ত দেখে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাকে বিপদগ্রস্ত বলে ভাবে না; বরং সে এ ব্যস্ততাকে জীবনের সাফল্য বলেই গণ্য করে এবং যদি কেহ অনুগ্রহ করে তাকে এ ব্যস্ততা থেকে রেহাই দিতে চায়, তবে তাকে সে সবচেয়ে বড় ক্ষতি বলে মনে করে। সে তার এ ত্রিশ দিনের পরিশ্রমের অন্তরালে এমন এক আরাম দেখতে পায়, যা তার বেতনস্বরূপ সে লাভ করে।

এ জন্যই নাবীগণ এ দুনিয়ার জীবনে সর্বাপেক্ষা বেশী বিপদাপদে পতিত হয়েছেন এবং তারপর ওয়ালী-আওলিয়াগণ সবচেয়ে অধিক বিপদে পতিত হন। কিন্তু দেখা গেছে, বিপদের তীব্রতা যত কঠিনই হোক না কেন, দৃঢ়পদে তাঁরা তা সহ্য করেছেন। এমনকি আনন্দিত চিত্তেই তাঁরা তা মেনে নিয়েছেন। মোটকথা, দুনিয়ার আরাম আয়েশকে সত্যবাদিতা ও সঠিকতা এবং বিপদাপদকে অসৎ কাজের নিদর্শন বলা যায় না।

অবশ্য কখনো কোন কোন কর্মের সামান্য ফালাফল দুনিয়াতেও প্রকাশ করা হয় বটে, তবে তা সেকাজের পূর্ণ বদলা হতে পারে না। এগুলো সাময়িকভাবে সতর্ক করার জন্য কিঞ্চিৎ নিদর্শন মাত্র।

مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ -বাক্যটিতে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রই একথা জানেন যে, সেই একক সত্তাই প্রকৃত মালিক, যিনি সমগ্র জগতকে সৃষ্টি করেছেন এবং এর লালন-পালন ও বর্ধনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং যাঁর মালিকানা পূর্ণরূপে প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই সর্বাবস্থায় পরিব্যাপ্ত। অর্থাৎ- প্রকাশ্যে, গোপনে, জীবিতাবস্থায় ও মৃতাবস্থায় এবং যার মালিকানার আরম্ভ নেই, শেষও নেই। এ মালিকানার সাথে মানুষের মালিকানা তুলানাযোগ্য নয়। কেননা, মানুষের মালিকানা আরম্ভ ও শেষের চৌহদ্দীতে সীমাবদ্ধ। এক সময় তা ছিল না; কিছু দিন পরেই তা থাকবে না। অপরদিকে মানুষের মালিকানা হস্তান্তরযোগ্য। বস্তুর বাহ্যিক দিকের উপরই বর্তায়; গোপনীয় দিকের উপর নয়। জীবিতের উপর; মৃতের উপর নয়।

এজন্যই প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহ্‌ তা‘আলার মালিকানা কেবলমাত্র প্রতিদান দিবসেই নয়, বরং পৃথিবীতেও সমস্ত সৃষ্টজগতের প্রকৃত মালিক আল্লাহ্‌ তা‘আলাই। তবে এ আয়াতে আল্লাহ্‌ তা‘আলার মালিকানা বিশেষভাবে প্রতিদান দিবসের এ কথা বলার তাৎপর্য কি? কুরআনের অন্য আয়াতের প্রতি লক্ষ করলেই বোঝা যায় যে, যদিও দুনিয়াতেও প্রকৃত মালিকানা আল্লাহ্‌ তা‘আলারই, কিন্তু তিনি দয়াপরবেশ হয়ে আংশিক বা ক্ষণস্থায়ী মালিকানা মানবজাতিকেও দান করেছেন এবং পার্থিব জীবনের আইনে এ মালিকানার প্রতি সম্মানও দেখানো হয়েছে। বিশ্বচরাচরে মানুষ ধন-সম্পদ, জায়গা-জমি, বাড়ী-ঘর এবং আসবাব-পত্রের ক্ষণস্থায়ী মালিক হয়েও এতে একবারে ডুবে রয়েছে।

আল্লাহ্‌ তা‘আলা مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ -একথা ঘোষণা করে এ অহংকারী ও নির্বোধ মানব-সমাজকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তোমাদের এ মালিকানা, আধিপত্য ও সম্পর্ক মাত্র কয়েক দিনের এবং ক্ষণিকের। এমন দিন অতি সত্বরই আসছে, যে দিন কেওই জাহেরী তথা প্রকাশ্য মালিকও থাকবে না, কেও কারো দাস বা কেও কারো সেবা পাবার উপযোগীও থাকবে না। সমস্ত বস্তুর মালিকানা এক ও একক সত্তার হয়ে যাবে।

সূরা ফাতি‘হার প্রথমে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এ সূরার প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহ্‌র প্রশংসা ও তা’রীফের বর্ণনা করা হয়েছে এবং এর তাফসীরে একথা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, তা’রীফ ও প্রশংসার সাথে সাথে ঈমানের মৌলিক নীতি ও আল্লাহ্‌র একত্ববাদের বর্ণনাও সুক্ষ্মভাবে দেয়া হয়েছে।

তৃতীয় আয়াতের তাফসীরে আপনি অবগত হলেন যে, এর দু’টি শব্দে তা’রীফ ও প্রশংসার সাথে সাথে ইসলামের বিপ্লবাত্মক মহোত্তম ‘আক্বীদা যথা ক্বিয়ামত ও পরকালের বর্ণনা প্রমাণসহ উপস্থিত করা হয়েছে।

এখন চতুর্থ আয়াতের বর্ণনা: إِيَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ -এ আয়াতের এক অংশে তা’রীফ ও প্রশংসা এবং অপর অংশে দু‘আ ও প্রার্থনা। نَعۡبُدُ –عِبَادَةٌ শব্দ থেকে গঠিত।। এর অর্থ হচ্ছে: কারো প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার দরুন তাঁর নিকট নিজের আন্তরিক কাকুতি-মিনতি প্রকাশ করা।  إسْتِعَانَةٌ – نَسۡتَعِينُ -হতে গঠিত এর অর্থ হচ্ছে কারো সাহায্য প্রার্থনা করা। আয়াতের অর্থ হচ্ছে, ‘আমরা তোমারই ‘ইবাদত করি এবং একমাত্র তোমার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ মানবজীবন তিনটি অবস্থায় অতিবাহিত হয়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত। পূর্বের তিনটি আয়াতের মধ্যে ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلۡعَٰلَمِينَ এবং ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ এ দু’টি আয়াতে মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, অতীতে সে কেবল মাত্র আল্লাহ্‌ তা‘আলার মুখাপেক্ষী ছিল, বর্তমানেও সে একমাত্র তাঁরই মুখাপেক্ষী। অস্তিত্বহীন এক অবস্থা থেকে তিনি তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন।

তাকে সকল সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর আকার-আকৃতি এবং বিবেক ও বুদ্ধি দান করেছেন। বর্তমানে তার লালন-পালন ও ভরণ-পোষণের নিয়মিত সুব্যবস্থাও তিনিই করেছেন। অতঃপর مَٰلِكِ يَوۡمِ ٱلدِّينِ এর মধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, ভবিষ্যতেও সে আল্লাহ্‌ তা‘আলারই মুখাপেক্ষী। প্রতিদান দিবসে আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো সাহায্য পাওয়া যাবে না।

প্রথম তিনটি আয়াতের দ্বারা যখন একথা প্রমাণিত হলো যে, মানুষ তার জীবনের তিনটি কালেই একান্তভাবে আল্লাহ্‌র মুখাপেক্ষী, তাই সাধারণ যুক্তির চাহিদাও এই যে, ‘ইবাদতও তাঁরই করতে হবে। কেননা, ‘ইবাদত যেহেতু অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে নিজের অফুরন্ত কাকুতি-মিনতি নিবেদন করার নাম, সুতরাং তা পাওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন অন্য কোন সত্তা নেই। ফলকথা এই যে, একজন বুদ্ধিমান ও বিবেকবান ব্যক্তি মনের গভীরতা থেকেই এ স্বতঃস্ফুর্ত স্বীকৃতি উচ্চারণ করছে যে, আমরা তোমাকে ব্যতীত অন্য কারো ‘ইবাদত করি না। এ মৌলিক চাহিদাই إِيَّاكَ نَعۡبُدُ -তে বর্ণনা করা হয়েছে।

যখন স্থির হলো যে, অভাব পূরণকারী একক সত্তা আল্লাহ্‌ তা‘আলা, সুতরাং নিজের যাবতীয় কাজে সাহায্যও তাঁর নিকটই প্রার্থনা করবে। এ মৌলিক চাহিদারই বর্ণনা وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ -এ করা হয়েছে।

মোটকথা, এ চতুর্থ আয়াতে একদিকে আল্লাহ্‌র তা’রীফ ও প্রশংসার সাথে একথারও স্বীকৃতি রয়েছে যে, ‘ইবাদত ও শ্রদ্ধা পাওয়ার একমাত্র তিনিই যোগ্য। অপরদিকে তাঁর নিকট সাহায্য ও সহায়তার প্রার্থনা করা এবং তৃতীয়ত: আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো ‘ইবাদত না করার শিক্ষাও দেয়া হয়েছে। এতদসঙ্গে এও বলে দেয়া হয়েছে যে, কোন বান্দাই আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কাকেও অভাব পূরণকারী মনে করবে না। অপর কারো নিকট প্রার্থনার হাত প্রসারিত করা যাবে না। অবশ্য কোন নাবী বা কোন ওয়ালীর বরাত দিয়ে প্রার্থনা করা এ আয়াতের মর্মবিরোধী নয়।

এ আয়াতে এ বিষয়ও চিন্তা করা কর্তব্য যে, ‘আমরা তোমারই নিকট সাহায্য চাই।’ কিন্তু কোন্ কাজের সাহায্য চাই, তার কোন উল্লেখ নেই। জমহুর মুফাস্‌সিরীনের অভিমত এই যে, নির্দিষ্ট কোন ব্যাপারে সাহায্যের কথা উল্লেখ না করে ‘আম’ বা সাধারণ সাহায্যের প্রতি ইশারা করা হযেছে যে, আমি আমার ‘ইবাদত এবং প্রত্যেক ধর্মীয় ও পার্থিব কাজে এবং অন্তরে পোষিত প্রতিটি আশা-আকাঙ্খায় কেবল তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

শুধু নামায/সলাত সওম/রোযারই নাম ‘ইবাদত নয়। ইমাম গায্‌যালী (র‘হ,) স্বিয় গ্রন্থ আরবা’ঈন-এ দশ প্রকার ‘ইবাদতের কথা লিখেছেন। যথা- নামায/সলাত, যাকাত, সওম/রোযা, কুরআন তিলাওয়াত, সর্বাবস্থায় আল্লাহ্‌র স্মরণ, ‘হালাল উপার্জনের চেষ্টা করা, প্রতিবেশী এবং সাথীদের প্রাপ্য পরিশোধ করা, মানুষেকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ হতে বিরত থাকার উপদেশ দেয়া, রসূলের সুন্নাহ/সুন্নত পালন করা।

একই কারণে ‘ইবাদতে আল্লাহ্‌র সাথে কাকেও অংশীদার করা চলে না। এর অর্থ হচ্ছে, কারো প্রতি ভালবাসা, আল্লাহ্‌র প্রতি ভালবাসার সমতুল্য হবে না। কারো প্রতি ভয়, কারো প্রতি আশা-আকাঙ্খা পোষণ আল্লাহ্‌র ভয় ও তাঁর প্রতি পোষিত আশা-আকাঙ্খার সমতুল্য হবে না। আবার কারো উপর একান্ত ভরসা করা, কারো আনুগত্য ও খেদমত/সেবা করা, কারো কাজকে আল্লাহ্‌র ‘ইবাদতের সমতুল্য আবশ্যকীয় মনে করা, আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো নামে মানত করা, আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো সামনে স্বীয় কাকুতি-মিনতি প্রকাশ করা এবং যে কাজে অন্তরের আবেগ-আকুতি প্রকাশ পায়, এমন কাজ আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো জন্য করা, যথা রুকূ’ বা সিজদা করা ইত্যাদি কোন অবস্থাতেই বৈধ হবে না।

শেষ তিনটি আয়াতে মানুষের দু‘আ ও আবেদনের বিষয়বস্তু এবং এক বিশেষ প্রার্থনাপদ্ধতি শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে-

ٱهۡدِنَا ٱلصِّرَٰطَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ ٦ صِرَٰطَ ٱلَّذِينَ أَنۡعَمۡتَ عَلَيۡهِمۡ غَيۡرِ ٱلۡمَغۡضُوبِ عَلَيۡهِمۡ وَلَا ٱلضَّآلِّينَ ٧

     অর্থাৎ, ‘আমাদিগকে সরল পথ দেখাও; সে সমস্ত মানুষের পথ, যারা তোমার অনুগ্রহ লাভ করেছে। যে পথে তোমার অভিশপ্ত বান্দারা চলেছে সে পথ নয় এবং ঐ সমস্ত লোকের রাস্তাও নয় যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।’

এ তিনটি আয়াতে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। যেমন, সরল পথের হিদায়াতের জন্য যে আবেদন এ আয়াতে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, এর আবেদনকারী যেমনিভাবে সাধারণ মানুষ, সাধারণ মু’মিনগণ, তেমনি আওলিয়া, গ্বউছ-কুতুব এবং নাবী-রসূলগণও বটে। নিঃসন্দেহে যাঁরা হিদায়াতপ্রাপ্ত, বরং অন্যের হিদায়াতের উৎসস্বরূপ, তাঁদের পক্ষে পুনরায় সে হিদায়াতের জন্যই বারংবার প্রার্থনা করার উদ্দেশ্য কি? এ প্রশ্নের উত্তর হিদায়াত শব্দের তাৎপর্য পরিপুর্ণরূপে অনুধাবন করার উপর নির্ভরশীল।

ইমাম রাগ্বেব ইস্‌ফাহানী (র‘হ,) ‘মুফরদাতুল কুরআনে’ হিদায়াত শব্দের অতি ‍সুন্দর ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এর সারমর্ম হচ্ছে-‘কাউকে গন্তব্যস্থানের দিকে অনুগ্রহের সাথে পথ প্রদর্শন করা’। তাই হিদায়াত করা প্রকৃত প্রস্তাবে একমাত্র আল্লাহ্‌ তা‘আলারই কাজ এবং এর বিভিন্ন স্তর রয়েছে। হিদায়াতের একটি স্তর হচ্ছে সাধারণ ও ব্যাপক। এতে সমগ্র সৃষ্টি অন্তর্ভুক্ত। জড়পদার্থ, উদ্ভিদ এবং প্রাণী জগত পর্যন্ত এর আওতাধীন। প্রসঙ্গতঃ প্রশ্ন উঠতে পারে যে, প্রাণহীন জড়পদার্থ বা ইতর প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে হিদায়াতের সম্পর্ক কোথায়?

কুরআনের শিক্ষায় স্পষ্টতঃই এ তথ্য ব্যক্ত হয়েছে যে, সৃষ্টির প্রতিটি স্তর, এমনকি প্রতিটি অণু-পরমাণু পর্যন্ত নিজ নিজ অবস্থানুযায়ী প্রাণ ও অনুভুতির অধিকারী। স্ব-স্ব পরিমন্ডলে প্রতিটি বস্তুর বুদ্ধি-বিবেচনা রয়েছে। অবশ্য এ বুদ্ধি ও অনুভুতির তারতম্য রয়েছে। কোনটাতে তা স্পষ্ট এবং কোনটাতে নিতান্তই অনুল্লেখ্য। যে সমস্ত বস্তুতে তা অতি অল্পমাত্রায় বিদ্যমান সেগুলোকে প্রাণহীন বা অনুভুতিহীন বলা যায়। বুদ্ধি ও অনুভূতির ক্ষেত্রে এ তারতম্যের জন্যই সমগ্র সৃষ্টিজগতের মধ্যে একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতিকেই শরী‘আতের ‘হুকুম-আ’হাকামের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। কারণ, সৃষ্টির এ দু’টি স্তরের মধ্যেই বুদ্ধি ও অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় দেয়া হয়েছে। কিন্তু, তাই বলে একথা বলা যাবে না যে, একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতি ছাড়া সৃষ্টির অন্য কোন কিছুর মধ্যে বুদ্ধি ও অনুভূতির অস্তিত্ব নেই। কেননা, আল্লাহ্‌ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন:

وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَٰكِن لَّا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ ۗ

অর্থাৎ-এমন কোন বস্তু নেই যা আল্লাহ্‌র প্রশংসার তাসবী‘হ পাঠ করে না, কিন্তু তোমরা তাদের তাসবী‘হ বুঝতে পার না। [সূরা বানী-ইসরাঈল]

সূরা নূরে ইরশাদ হয়েছে:

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يُسَبِّحُ لَهُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَالطَّيْرُ صَافَّاتٍ ۖ كُلٌّ قَدْ عَلِمَ صَلَاتَهُ وَتَسْبِيحَهُ ۗ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِمَا يَفْعَلُونَ

অর্থাৎ, ‘তোমরা কি জান না যে, আসমান-জমিনে যা কিছু রয়েছে, সকলেই আল্লাহ্‌র পবিত্রতা বর্ণনা ও গুণগান করে? বিশেষতঃ পাখীকুল যারা দু’পাখা বিস্তার করে শূন্যে উড়ে বেড়ায়, তাদের সকলেই স্ব-স্ব দু‘আ তাসবী‘হ সম্পর্কে জ্ঞাত এবং আল্লাহ্‌ তা‘আলাও তাদের তাসবী‘হ সম্পর্কে খবর রাখেন।’

একথা সর্বজনবিদিত যে, আল্লাহ্‌ তা‘আলার পরিচয়ের উপরই তাঁর তা’রীফ ও প্রশংসা নির্ভরশীল। আর এ কথাও স্বতঃসিদ্ধ যে, আল্লাহ্‌র পরিচয় লাভ করাই সর্বাপেক্ষা বড় জ্ঞান। এটা বুদ্ধি-বিবেক ও অনুভূতি ব্যতীত সম্ভব নয়, কুরানের অন্যান্য আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয়েছে যে, সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুরই প্রাণ ও জীবন আছে এবং বুদ্ধি ও অনুভূতি রয়েছে। তবে কোন কোনটির মধ্যে এর পরিমাণ এত অল্প যে, সাধারণ দৃষ্টিতে তা অনুভব করা যায় না। তাই পরিভাষাগতভাবে সেগুলোকে প্রাণহীন ও বুদ্ধিহীন জড়পদার্থ বলা হয়। আর এ জন্যেই তাদেরকে শর‘য়ী আদেশের আওতাভুক্ত করা হয়নি। গোটা বস্তুজগত সম্পর্কিত এ মীমাংসা আল-কুরআনে সে যুগেই দেয়া হয়েছিল, যে যুগে পৃথিবীর কোথায়ও আধুনিক কালের কোন দার্শনিকও ছিল না, দর্শনবিদ্যার কোন পুস্তকও রচিত হয়নি। পরবর্তী যুগের দার্শনিকগণ এ তথ্যের যথার্থতা স্বীকার করেছেন এবং প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যেও এ মত পোষণ করার মত অনেক লোক ছিল। মোটকথা, আল্লাহ্‌র হিদায়াতের এ প্রথম স্তরে সমস্ত সৃষ্টিজগত যথা- জড়পদার্থ, উদ্ভিদ, প্রাণীজগৎ, মানবমন্ডলী ও জ্বিন প্রভৃতি সকলেই অন্তর্ভূক্ত। এ সাধারণ হিদায়াতের উল্লেখই আল-কুরআনের  أَعْطَىٰ كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَىٰ আয়াতে করা হয়েছে।

অর্থাৎ, যিনি সমস্ত সৃষ্টিজগতের জন্য বিশেষ অভ্যাস এবং বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব নির্ধারণ করেছেন এবং সে মেযাজ ও দায়িত্বের উপযোগী হিদায়াত দান করেছেন। এ ব্যাপার হিদায়াতের পরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুই অতি নিপুণভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালণ করে চলেছে। যে বস্তুকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, সে সেই কাজ অত্যন্ত গুরুত্ব ও নৈপুণ্যের সাথে পালন করছে। যথা- মুখ হতে নির্গত শব্দ নাক বা চক্ষু কেউই শ্রবণ করতে পারে না, অথচ এ দু’টি মুখের নিকটতম অঙ্গ। পক্ষান্তরে এ দায়িত্ব আল্লাহ্‌ তা‘আলা যেহেতু কানকে অর্পণ করেছেন, তাই একমাত্র কানই মুখের শব্দ শ্রবণ করে ও বোঝে। অনুরূপভাবে কান দ্বারা দেখা বা ঘ্রাণ নেয়ার কাজ করা চলে না। নাক দ্বারা শ্রবণ করা বা দেখার কাজও চলে না।

হিদায়াতের দ্বিতীয় স্তর এর তুলনায় অনেকটা সংকীর্ণ। অর্থাৎ, সে সমস্ত বস্তুর সাথে জড়িত, পরিভাষায় যাদেরকে বিবেকবান বুদ্ধিসম্পন্ন বলা হয়। অর্থাৎ, মানুষ এবং জ্বিন জাতি। এ হিদায়াত নাবী-রসূল ও আসমানী কিতাবের মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের নিকট পৌঁছেছে। কেউ এ হিদায়াতকে গ্রহণ করে মু’মিন হয়েছে আবার কেও একে প্রত্যাখ্যান করে কাফির তথা বে-দ্বীনে পরিণত হয়েছে।

হিদায়াতের তৃতীয় স্তর আরো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। তা শুধু মু’মিন ও মুত্তাক্বী বা ধর্মভীরুদের জন্য। এ হিদায়াত আল্লাহ্‌ তা‘আলার পক্ষ থেকে কোন প্রকাশ মাধ্যম ব্যতীতই মানুষকে প্রদান করা হয়। এরই নাম তাওফীক্ব। অর্থাৎ, এমন অবস্থা, পরিবেশ ও মনোভাব সৃষ্টি করে দেয়া যে, তার ফলে কুরআনের হোদায়াতকে গ্রহণ করা এবং এর উপর ’’আমল করা সহজসাধ্য হয় এবং এর বিরুদ্ধাচরণ কঠিন হয়ে পড়ে। এ তৃতীয় স্তরের পরিসীমা অতি ব্যাপক। এ স্তরই মানবের উন্নতির ক্ষেত্র। নেক কাজের সাথে এ হিদায়াতের বৃদ্ধি হতে থাকে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এ বৃদ্ধির উল্লেখ রয়েছে:

وَالَّذِينَ جَاهَدُوْا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا.

অর্থাৎ, ‘যারা আমার পথে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা করে, আমি তাদেরকে আমার পথে আরো অধিকতার অগ্রসর হওয়ার পথ অবশ্যই দেখিয়ে থাকি।’ এটি সেই কর্মক্ষেত্র যেখানে নাবী-রসূল এবং বড় বড় ওয়ালী-আওলিয়া, কুতুবগণকেও জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আরো অধিকতর হিদায়াত ও তাওফীকের জন্য চেষ্টায় রত থাকতে দেখা গেছে।

হিদায়াতের এ ব্যাখ্যার দ্বারা স্পষ্টভাবে বোঝা গেল যে, হিদায়াত এমন এক বস্তু যা সকলেই লাভ করেছে এবং এর আধিক্য লাভ করার জন্য বড় হতে বড় ব্যক্তির পক্ষেও কোন বাধা-নিষেধ নেই। এজন্যই সূরা ফাতি‘হায় গুরুত্বপূর্ণ দু‘আরূপে হিদায়াত প্রার্থনা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। যা একজন সাধারণ মু’মিনের জন্যও উপযোগী; আবার একজন বড় হতে বড় রসূলের জন্যও উপযোগী। এজন্যই রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শেষ জীবনে সূরা ফাতা’হ-তে মক্কাবিজয়ের ফলাফল বর্ণনা করতে গিয়ে একথাও বলা হয়েছে যে, وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُّسْتَقِيمًا –অর্থাৎ, মক্কা বিজয় এজন্যই আপনার দ্বারা সম্পন্ন করা হয়েছে, যাতে সিরাতে মুস্তাক্বীমের হিদায়াত লাভ হয়।

রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কেবল নিজেই হিদায়াতপ্রাপ্ত ছিলেন না; বরং অন্যের জন্যও ছিলেন হিদায়াতের উৎস। এমতবস্থায় তাঁর হিদায়াত লাভের একমাত্র অর্থ হতে পারে, এ সময় হিাদায়াতের কোন উচ্চতর অবস্থা তিনি লাভ করেছেন।

হিদায়াতের এ ব্যাখ্যা পবিত্র কুরআন বোঝবার ক্ষেত্রে যেসব ফায়দা/উপকারিতা প্রদান করবে সংক্ষেপে তা নিম্নরূপঃ

(এক) পবিত্র কুরআনের কোথাও কোথাও মু’মিন ও কাফির নির্বিশেষে সবার জন্যই হিদায়াত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আবার কোথাও শুধুমাত্র মুত্তাক্বীদের জন্য বিশেষ অর্থে হিদায়াত শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এতেকরে অজ্ঞ লোকদের পক্ষে সন্দেহে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, কিন্তু হিদায়াতের সাধারণ ও বিশেষ স্তরসমূহ জানার পর এ সন্দেহ আপনা-আপনিতেই দুরীভূত হয়ে যাবে। বুঝতে হবে যে, কারো বেলায় ব্যাপক অর্থে এবং কারো বেলায় বিশেষ অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

(দুই) আল-কুরআনের বিভিন্ন স্থানে ইরশাদ হয়েছে যে, জালিম ও ফাসিক্বদিগকে আল্লাহ্‌ তা‘আলা হিদায়াত দান করেন না। অন্যত্র বারবার ইরশাদ হয়েছে যে, তিনি সকলকেই হিদায়াত দান করেন। এর উত্তরও হিদায়াতের সস্তরসমূহের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলে দেয়া হয়েছে যে, হিদায়াতের ব্যাপক অর্থে সকলেই হিদায়াতপ্রাপ্ত এবং বিশষ অর্থে জালিম ও ফাসিক্বরা বাদ পড়েছে।

(তিন) হিদায়াতের তিনটি স্তরের মধ্যে প্রথম ও তৃতীয় স্তর সরাসরি আল্লাহ্‌ তা‘আলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এপর্যায়ের হিদায়াত একান্তভাবে একমাত্র তাঁরই কাজ। এতে নাবী-রসূলগণেরও কোন অধিকার নেই। নাবী-রসূলগণের কাজ শুধু হিদায়াতের দ্বিতীয় স্তরে সীমিত। কুরআনের যেখানে যেখানে নাবী-রসূলগণকে হিদায়াতকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা হিদায়াতের দ্বিতীয় স্তরের ভিত্তিতেই বলা হয়েছে। আর যেখানে ইরশাদ হয়েছেঃ إِنَّكَ لاَ تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ অর্থাৎ, আপনি যাকে তাকেই হিদায়াত করতে পারবেন না, এতে হিদায়াতের তৃতীয় স্তরের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, কাওকে তাওফীক্ব দান করা আপনার কাজ নয়।

মোটকথা, إهدِنَا الصِّرَاطَ المُستَقِيمَ একটি ব্যাপক ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দু‘আ, যা মানুষকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। মানবসমাজের কোন ব্যাক্তিই এর আওতার বাইরে নেই। কেননা, সরল-সঠিক পথ ব্যতীত দ্বীন-দুনিয়া কোনটিরই উন্নতি ও সাফল্য সম্ভব নয়। দুনিয়ার আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যেও সিরাতুল মুস্তাক্বীমের প্রার্থনা পরশপাথরের ন্যায়, কিন্তু মানুষ তা লক্ষ্য করে না। আয়াতের অর্থ হচ্ছে-‘আমাদিগকে সরল পথ দেখিয়ে দিন।’

সরল পথ কোনটি? ‘সোজা সরল রাস্তা’ সে পথকে বলে, যাতে কোন মোড় বা ঘোরপ্যাঁচ নেই। এর অর্থ হচ্ছে, ধর্মের সে রাস্তা যাতে ‘ইফরাত বা ‘তফরীত এর অবকাশ নেই। ইফরাতের অর্থ সীমা অতিক্রম করা এবং তফরীত অর্থ মর্জিমত কাট-ছাট করে নেয়া। ইরশাদ হয়েছেঃ صِرَاطَ الَّذِيْنَ أَنعَمْتَ عَلَيهِمْ অর্থাৎ, যে সকল লোক আপনার অনুগ্রহ লাভ করেছে তাদের রাস্তা। যে সকল ব্যক্তি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ লাভ করেছে, তাদের পরিচয় অন্য একটি আয়াতে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে:

الَّذِينَ انْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيْقِّيْنَ وَالشُّهَدَآءِ وَالصَّالِحِينَ ۚ

     অর্থাৎ, যাদের প্রতি আল্লাহ্‌ পাক অনুগ্রহ করেছেন, তাঁরা হচ্ছেন, নাবীগণ, সিদ্দীক্বীনগণ, শহীদগণ এবং সৎকর্মশীল সালে’হীনগণ। আল্লাহ্ দরবারে মক্ববূল উপরোক্ত লোকদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর নাবীগণের। অতঃপর নাবীগণের উম্মতের মধ্যে যাঁরা সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী, তাঁরা হলেন সিদ্দীক্বীনগণ। যাদের মধ্যে রূ’হানী কামালিয়াত ও পরিপূর্ণতা রয়েছে, সাধারণ ভাষায় তাঁদেরকে ‘আউলিয়া’ বলা হয়। আর যাঁরা দ্বীনের প্রয়োজনে স্বীয় জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন, তাঁদেরকে বলা হয় শহীদ। আর সালে’হীন হচ্ছেন যাঁরা ওয়াজিব, মুস্তা’হাব প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে পুরোপুরি অনুসরণ ও ‘আমলকারী। সাধারণ পরিভাষায় এদেরকে দ্বীনদার বলা হয়।

এ আয়াতের প্রথম অংশে ইতিবাচক বাক্য ব্যবহার করে সরল পথের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। উপরোক্ত চার স্তরের মানুষ যে পথে চলেছেন তাই সরল পথ। পরে শেষ আয়াতে নেতিবাচক বাক্য ব্যবহার করেও এর সমর্থন করা হয়েছে। বলা হয়েছে:

غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّآلِّيْنَ

     অর্থাৎ, যারা আপনার অভিসম্পাতগ্রস্ত তাদের পথ নয় এবং তাদের পথও নয়, যারা পথহারা হয়েছে।

الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ বলতে ঐ সকল লোককে বোঝানো হয়েছে, যারা ধর্মের ‘হুকুম-আ‘হকামকে বুঝে-জানে, তবে স্বীয় অহমীকা ও ব্যক্তিগত স্বার্থের বশবর্তী হয়ে বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যাঁরা আল্লাহ্ তা‘আলার আদেশ মান্য করতে গাফলীত তথা অলশতা করেছে। যেমন, সাধারণভাবে ইহুদীদের নিয়ম ছিল, সামান্য স্বার্থের জন্য দ্বীনের নিয়ম-নীতি বিসর্জন দিয়ে তারা নাবী-রসূলগণের অবমাননা পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করত না।

ضَآلِّيْنَ-তাদেরকে বলা হয়, যারা না বুঝে অজ্ঞতার দরুন ধর্মীয় ব্যাপারে ভূল পথের অনুসারী হয়েছে এবং ধর্মের সীমালঙ্ঘন করে অতিরঞ্জনের পথে অগ্রসর হয়েছে। যথা, নাসারাগণ। তারা নাবীর শিক্ষাকে অগ্রাধিকার প্রদানের নামে এমনি বাড়াবাড়ি করেছে যে, নাবীদিগণকে আল্লাহ্‌র স্থানে উন্নীত করে দিয়েছে। ইহুদীদের বেলায় এটা অন্যায় এজন্য যে, তারা আল্লাহ্‌র নাবীদের কথা মানেনি; এমনকি তাঁদেরকে হত্যা পর্যন্ত করেছে। অপরদিকে নাসারাগণের বেলায় অতিরঞ্জন হচ্ছে এই যে, তারা নাবীগণকে আল্লাহ্‌র পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছে।

আয়াতের সরামর্ম হচ্ছেঃ আমরা সে পথ চাই না, যা নফসানী (মনের চাহিদা পুরণ) উদ্দেশ্যের অনুগত হয় এবং মন্দ কাজে উদ্বুদ্ধ করে ও ধর্মের মধ্যে সীমালঙ্ঘনের প্রতি প্ররোচিত করে। সে পথও চাই না, যে পথ অজ্ঞতা ও মূর্খতার দরুন ধর্মের সীমারেখা অতিক্রম করে এবং এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সোজা-সরল পথ চাই যার মধ্যে না অতিরঞ্জন আছে, আর না কম-কছুরী (কম-বেশি) আছে এবং যা নফসানী (মনস্কামনা) প্রভাব ও সংশয়ের উর্ধ্বে।

সূরা ফা-তি‘হার সাতটি আয়াতের তাফসীর সংক্ষিপ্তাকারে এতটুকু জেনে রাখাই যথেষ্ট।

এখন সমগ্র সূরার সারমর্ম হচ্ছে এই দু‘আ:

‘হে আল্লাহ্‌! আমাদিগকে সরল পথ দান করুন। কেননা, সরল পথের সন্ধান লাভ করাই সবচাইতে বড় জ্ঞান ও সর্বাপেক্ষা বড় কামিয়াবী তথা সফলতা। বস্তুতঃ সরল পথের সন্ধানে ব্যর্থ হয়েই দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি ধ্বংস হয়েছে। অন্যথায় অমুসলিমদের মধ্যেও সৃষ্টিকর্তার পরিচয় লাভ করা এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথ অনুসরণ করার আগ্রহ-আকুতির অভাব নেই। এজন্যই কুরআন পাকে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় পদ্ধতিতেই সিরাতুল মুস্তাক্বীমের পথ তুলে ধরা হয়েছে।

দু‘আ করার পদ্ধতিঃ এ সূরায় একটা বিশেষ ধরনের বর্ণনারীতির মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, যখন আল্লাহ্‌র নিকট কোন দু‘আ বা কোন আকুতি পেশ করতে হয়, তখন প্রথমে তাঁর তা’রীফ বা প্রশংসা কর, তাঁর দেয়া সীমাহীন নি‘আমতের স্বীকৃতি দাও। অতঃপর একমাত্র তিনি ছাড়া অন্য কাকেও দাতা ও অভাব পূরণকারী মনে করো না কিংবা অন্য কাকেই ‘ইবাদতের যোগ্য বলে স্বীকার করো না। অতঃপর স্বীয় উদ্দেশ্যের জন্য আরযি পেশ করা যায়। দু‘আ করতেও এমন ব্যাপক পদ্ধতী অবলম্বন কর, যাতে মানুষের সকল মকসুদ বা উদ্দেশ্য তার অন্তর্ভুক্ত থাকে। যথা, সরল পথ লাভ করা এবং দুনিয়ার যাবতীয় কাজে সরল-সঠিক পথ পাওয়া, যাতে কোথাও কোন ক্ষতি বা পদস্খলনের আশংকা না থাকে। মোটকথা, এখানে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাঁর তা’রীফ-প্রশংসা করার প্রকৃত উদ্দেশ্যই হল মানবকুলকে শিক্ষা দেয়া।

আল্লাহ্‌র তা’রীফ-প্রশংসা করা মানুষের মৌলিক দায়িত্ব:

এসূরার প্রথম বাক্যে আল্লাহ্‌র তা’রীফ বা প্রশংসা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তা’রীফ বা প্রশংসা সাধারণতঃ কোন গুণের বা প্রতিদানের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখ হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে কোন গুণের বা প্রতিদানের উল্লেখ নেই। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌র নি‘আমত অগণিত। কোন মানুষ এর পরিমাপ করতে পারে না। কুরআনে ইরাশদ হয়েছেঃ

وَإِن تَعُدُّواْ نِعْمَةَ اللَّهِ لاَ تُحْصُوهَا  অর্থাৎ, যদি তোমরা আল্লাহ্‌র নি‘আমতের গণনা করতে চাও,  তবে তা পারবে না। মানুষ যদি সারা বিশ্ব হতে মুখ ফিরিয়ে শুধুমাত্র নিজের অস্তিত্বের প্রতিই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, তবে বুঝতে পারবে যে, তার দেহই এমন একটি ক্ষুদ্র জগত যাতে বৃহৎ জগতের সকল নিদর্শন বিদ্যমান। তার দেহ যমীন তুল্য। কেশরাজি উদ্ভিদ তুল্য। তার হাড়গুলো পাহাড়ের মত এবং শিরা-উপশিরা যাতে রক্ত চলাচল করে, সেগুলো নদী-নালা বা সমুদ্রের নমুনা। দু’টি বস্তুর সংমিশ্রণে মানুষের অস্তিত্ব। একটি দেহ ও অপরটি আত্মা। এ কথাও স্বীকৃত যে, মানবদেহে আত্মা সর্বাপেক্ষা উত্তম অংশ আর তার দেহ হচ্ছে আত্মার অনুগত এবং অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট মানের অধিকারী। এ নিকৃষ্ট অংশের পরীক্ষা-নিরীক্ষাকারী ‍চিকিৎসকগণ বলেছেন যে, মানবদেহে আল্লাহ্ তা‘আলা পাঁচ হাজার প্রকার উপাদান রেখেছেন। এতে তিন শতেরও অধিক জোড়া রয়েছে। প্রত্যেকটি জোড়া আল্লাহ্‌র কুদরতে এমন সুন্দর ও মজবুতভাবে দেয়া হয়েছে যে, সর্বদা নড়া-চড়া করা সত্ত্বেও তার মধ্যে কোন পরিবর্তন হয় না এবং কোন প্রকার মেরামতরেও প্রয়োজন হয় না। সাধারণতঃ মানুষের বয়স ষাট-সত্তুর বছর হয়ে থাকে। এ দীর্ঘ সময় তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সর্বদা নড়া-চড়া করছে, অথচ এর মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেনঃ

 نَحْنُ خَلَقْنٰهُمْ وَشَدَدْنَا أَسْرَهُمْ

     অর্থাৎ, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং আমিই তাদের জোড়াগুলোকে মজবুত করেছি।’ এ কুদরতী মজবুতির পরিণাম হয়েছে এই যে, সাধারণভাবে তা অত্যন্ত নরম ও নড়বড়ে জোড়া সত্তুর বছর বা এর চাইতে অধিক সময় পর্যন্ত কর্মরত থাকে। মানুষের অঙ্গগুলোর মধ্যে শুধু চক্ষুর কথাই চিন্তা করলে দেখা যাবে, এতে আল্লাহ্ তা‘আলার অসাধারণ ‘হিকমত প্রকাশিত হয়েছে; সারা জীবন সাধনা করেও এ রহস্যটুকু উদ্ধার করা সম্ভব নয়।

এ চোখের এক পলকের কার্যক্রম লক্ষ্য করলে বুঝতে পারা যাবে যে, এর এক মিনিটের কার্যক্রমে আল্লাহ্‌ তা‘আলার কত নি‘আমত যে কাজ করছে, তা ভেবে অবাক হতে হয় কেননা চক্ষু খুলে এ দ্বারা কত বস্তুকে সে দেখছে। এতে যেভাবে চক্ষুর ভেতরের শক্তি কাজ করছে, অনুরূপভাবে বহির্জগতের সৃষ্টিরাজিও এতে বিশেষ অংশ নিচ্ছে। সূর্যের কিরণ না থাকলে চোখের দৃষ্টিশক্তি কোন কাজ করতে পারে না। সূর্যের জন্য আকাশের প্রয়োজন হয়। মানুষের দেখার জন্য এবং চক্ষু দ্বারা কাজ করার জন্য আহার্য ও বায়ুর প্রয়োজন হয়। এতে বোঝা যায়, চোখের এক পলকের শক্তির জন্য বিশ্বের সকল শক্তি ব্যবহৃত হয়। এ তো একবারের দৃষ্টি এখন দিনে কতবার দেখে এবং জীবনে কতবার দেখে তা হিসাব করা মানুষের শক্তির উর্ধ্বে। এমনিভাবে কান, জিহ্বা, হাত ও পায়ের যত কাজ এতে সমগ্র জগতের শক্তি যুক্ত হয়ে কার্য সমাধা হয়। এ তো সে মহা দান যা প্রতিটি জীবিত মানুষ ভোগ করে। এতে রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্রের কোন পার্থক্য নেই। তাছাড়া আল্লাহ্ তা‘আলার অসংখ্য নি‘আমত এমন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে রয়েছে যা প্রতিটি প্রাণী ভোগ করেও উপকৃত হয়। আকাশ-ভূমি এবং এ দু’টির মধ্যে সৃষ্ট সকল বস্তু চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, বায়ূ প্রভৃতি প্রতিটি প্রাণীই উপভোগ করে।

এরপর আল্লাহ্‌র বিশেষ দান যা মানুষকে ‘হিকমতের তাকীদে কম-বেশী দেয়া হয়েছে, ধন-সম্পদ, মান-সম্মান, আরাম-আয়েশ সবই এর অন্তর্ভুক্ত। যদিও একথা অত্যন্ত মৌলিক যে, সাধারণ নি‘আমত যা সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সমভাবে উপভোগ্য; যথা-আকাশ, বাতাস, জমীন এবং বিরাট এ প্রকৃতি, এ সমস্ত নি‘আমত বিশেষ নি’আমতের (যথা-ধন-সম্পদ) তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও উত্তম। অথচ এসব নি‘আমত সকল মানুষের মধ্যে সমভাবে পরিব্যাপ্ত বলে, এত বড় নি‘আমতের প্রতি মানুষ দৃষ্টিপাত করে না। ভাবে, কি নি‘আমত। বরং আশপাশের সামান্য বস্তু যথা, আহার্য, পানীয়, বসবাসের নির্ধারিত স্থান, বাড়ী-ঘর প্রভৃতির প্রতিই তাদের দৃষ্টি সাধরণতঃ সীমাবদ্ধ থাকে।

মোটকথা, সৃষ্টিকর্তা মানবজাতির জীবন-ধারণ এবং দুনিয়ার জীবনে বেঁচে থাকার সুবিধার্থে যে অফুরন্ত নি‘আমত দান করেছেন, তার অতিঅল্পই এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের পক্ষে দুনিয়ার জীবনে চোখ মেলেই মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই মহান দাতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকা ছিল স্বাভাবিক। বলাবাহুল্য যে, মানবজীবনের সে চাহিদার প্রেক্ষিতে কুরআনের সর্বপ্রথম সূরার সর্বপ্রথম বাক্যে الْحَمْدُ ব্যবহার করা হয়েছে এবং সেই মহান সত্তার তা’রীফ ও প্রশংসাকে ‘ইবাদতের শীর্ষস্থানে রাখা হয়েছে।

রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর কোন নি‘আমত কোন বান্দাকে দান করার পর যখন সে الْحَمْدُ لِلّٰهِ বলে, তখন বোঝতে হবে, যা সে পেয়েছে, এ শব্দ তা অপেক্ষা অনেক উত্তম।

অন্য এক ‘হাদীসে বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি যদি বিশ্বচরাচরের সকল নি‘আমত লাভ করে এবং সেজন্য সে ‘আল্-’হাম্‌দু লিল্লাহ’ বলে, তবে বুঝতে হবে যে, সারা বিশ্বের নি‘আমতসমূহ অপেক্ষা তার الْحَمْدُ لِلّٰهِ বলা অপেক্ষা অতিউত্তম। [ক্বুরতুবী]

কোন কোন ‘আলিমের মন্তব্য উদ্ধৃত করে ক্বুরতুবী লিখেছেন যে, মুখে الْحَمْدُ لِلّٰهِ বলা একটি নি‘আমত এবং এ নি‘আমত সারা বিশ্বের সকল নি‘আমত অপেক্ষা উত্তম। স‘হীহ ‘হাদীসে আছে যে, الْحَمْدُ لِلّٰهِ পরকালের তৌলদন্ডের অর্ধেক পরিপূর্ণ করবে।

হযরত শফীক ইবনে ইব্‌রাহীম الْحَمْدُ -এর ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যখন আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদিগকে কোন নি‘আমত দান করেন, তখন প্রথমে দাতাকে জানো এবং পরে তিনি যা দান করেছেন তাতে সন্তুষ্ট থাক। আর তাঁর দেয়া শক্তি ও ক্ষমতা তোমাদের দেহে যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর অবাধ্যতার নিকটেও যেও না।

দ্বিতীয় শব্দ أللّٰه -এর সাথে  لام বর্ণটি যুক্ত। যাকে ‘আরবী ভাষার নিয়ম অনুযায়ী খাস لام বলা হয়। যা কোন আদেশ বা গুণের বিশেষত্ব বোঝায়। এখানে অর্থ হচ্ছে যে, শুধু তা’রীফ-প্রশংসাই মানবের কর্তব্য। বরং এ তা’রীফ-প্রশংসা তার অস্তিত্বের সাথে সংযুক্ত। বাস্তবপক্ষে তিনি ব্যতীত এ জগতে অন্য কেও তা’রীফ-প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য নয়। এর বিস্তারিত বর্ণনা পূর্বে করা হয়েছে। এতদসঙ্গে এও তাঁর নি‘আমত যে, মানুষকে চরিত্র গঠন শিক্ষাদানের জন্য এ আদেশ দেয়া হয়েছে যে, আমার নি‘আমতসমূহ যে সকল মাধ্যম অতিক্রম করে আসে, সেগুলোরও শুকরিয়া আদায় করতে হবে। আর যে ব্যক্তি ই‘হ্‌সানকারীর শুকরিয়া-কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে না সে বাস্তবপক্ষে আল্লাহ্ তা‘আলারও শুকরিয়া-কৃতজ্ঞতা আদায় করে না।

إِيّاكَ نَعبُدُ وَإِيّاكَ نَستَعينُ‏ -এর অর্থ মুফাস্‌সিরকুল শিরোমণি হযরত ’আব্‌দুল্লাহ্ ইবনে ’আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেছেন, আমরা তোমারই ‘ইবাদত করি, তুমি ব্যতীত অন্য কারো ‘ইবাদত করি না। আর তোমারই সাহায্য চাই, তুমি ব্যতীত অন্য কারো সাহায্য চাই না। [ইব্‌নে জারীর, ইব্‌নে আবী-হাতিম]

সাল্‌ফে স-লি‘হীনদের কেও কেও বলেছেন যে, সূরা ফা-তি’হা কুরআনের সারমর্ম এবং إِيّاكَ نَعبُدُ وَإِيّاكَ نَستَعينُ‏  -সূরা ফা-তি’হার সারমর্ম। কেননা, এর প্রথম বাক্যে রয়েছে শির্‌ক্‌ থেকে মুক্তির ঘোষণা এবং দ্বিতীয় বাক্যে তার পরিপূর্ণ ও কুদরতের স্বীকৃতি। মানুষ দুর্বল, আল্লাহ্‌র সাহায্য ব্যতীত কোন কিছুই সে করতে পারে না। তাই সকল ব্যাপারে আল্লাহ্‌র উপর একান্তভাবে নির্ভর করা ব্যতীত তার গত্যন্তর নেই। এ উপদেশ কুরআনের বিভিন্ন স্থানে দেয়া হয়েছে।

(এক) আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো ‘ইবাদত জায়েয নয়: ইতিপূর্বে ‘ইবাদতের পরিচয় দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, কোন সত্তার অসীমতা, মহত্ত্ব এবং তাঁর প্রতি ভালবাসার ভিত্তিতে, তাঁর সামনে অশেষ কাকুতি-মিনতি পেশ করার নামই ‘ইবাদত। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো সাথে অনুরূপ আচরণ করাই শির্‌ক্‌। এতে বুঝা যাচ্ছে যে, মুর্তিপূজার মত প্রতীকপূজা বা পাথরের মুর্তিকে কুদরতী শক্তির আধার মনে করা বা কারো প্রতি সম্ভ্রম বা ভালবাসা এ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া, যা আল্লাহ্‌র জন্য করা হয়, তাও শির্‌কের অন্তর্ভুক্ত।

কোন বস্তুকে ‘হালাল-‘হারাম জানা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো কথাকে অবশ্য করণীয় মনে করে, তবে প্রকারান্তরে সে তার ’ইবাদতই করে এবং শির্‌কে পতিত হয়। সাধারণ মুসলমান যারা কুরআন, ‘হাদীস সরাসরি বুঝতে পারে না, শরী’আতের ‘হুকুম-আ‘হকাম নির্ধারণের যোগ্যতাও রাখে না; এ জন্য কোন ইমাম, মুজতাহিদ, ‘আলিম বা মুফতীর কথার উপর বিশ্বাস রেখে কাজ করে; তাদের সাথে এ আয়াতের মর্মের কোন সম্পর্ক নেই। কেননা, প্রকৃতপক্ষে তারা কুরআন ও সুন্নাহ্‌ অনুযায়ী ‘আমল করে; আল্লাহ্‌র নিয়ম-বিধানেরই অনুকরণ করে। ‘আলিমগণের নিকট থেকে তারা আল্লাহ্‌র কিতাব ও রসূলের সুন্নাহ্‌র ব্যাখ্যা গ্রহণ করে মাত্র। কুরআনই তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছে:

فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, ‘যদি আল্লাহ্‌র আদেশ তোমাদের জানা না থাকে, তবে ‘আলিমদের নিকট জেনে নাও।’

‘হালাল-‘হারাম নির্ধারণের ব্যাপারে আল্লাহ ব্যতীত অন্য যে কাউকেই অংশীদার করা শির্‌ক্। অনুরূপভাবে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো নামে মান্নত করাও শির্‌ক্। প্রয়োজন মিটানো বা বিপদ মুক্তির জন্য আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো নিকট দু‘আ করাও শির্‌ক্। কেননা, ‘হাদীসে দু‘আকে ‘ইবাদতরূপে গণ্য করা হয়েছে। কাজেই যেসব কার্যকলাপে শির্‌কের নিদর্শন রয়েছে, সেসব কাজ করাও শির্‌কের অন্তুর্ভুক্ত। হযরত ‘আদী ইব্‌নে হাতিম বলেন, ইসলাম ক্ববূল করার পর আমি আমার গলায় ক্রুস পরিহিত অবস্থায় রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দরবারে ইপস্থিত হয়েছিলাম। এটা দেখে রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আদেশ করলেন, এ মূর্তিটা গলা থেকে ফেলে দাও। ‘আদী ইব্‌নে হাতিম যদিও ক্রুস সম্পর্কে তখন নাসারাদের ধারণা পোষণ করতেন না, এতদসত্ত্বেও প্রকাশ্যভাবে শির্‌কের নিদর্শন থেকে বেঁচে থাকা অত্যাবশ্যকীয় বলে রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এমনিভাবে কারো প্রতি রুকূ’ বা সিজদা করা, বাইতুল্লাহ্ তথা আল্লাহ্‌র ঘর ‘কা’বা’ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর তাওয়াফ করা শির্‌কের অন্তুর্ভুক্ত। এসব থেকে বেঁচে থাকার স্বীকারোক্তি এবং আনুগত্যের অঙ্গীকারই إِيّاكَ نَعبُدُ -তে করা হয়েছে।

কারো সাহায্য চাওয়ার বিষয়টি কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ। কেননা, বৈষয়িক সাহায্য তো একজন অপরজনের কাছ থেকে সব সময়ই নিয়ে থাকে। এ ছাড়া দুনিয়ার কাজ-কারবার চলতেই পারে না। যথা- প্রস্তুকারক, দিনমজুর, নির্মাতা, কর্মকার, কুম্ভকার প্রভৃতি সকল শ্রেণীর কারিগরই অন্যের সাহায্যে নিয়োজিত, অন্যের খেদমতে সর্বদা ব্যস্ত এবং প্রত্যেকেই তাদের সাহায্যপ্রার্থী ও সাহায্য গ্রহণে বাধ্য। এরূপ সাহায্য নেয়া কোন ধর্মমতে বা কোন শরী’আতেই নিষেধ নয়। কারণ, এ সাহায্যের সাথে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট প্রার্থিত সাহায্য কোন অবস্থাতেই সম্পৃক্ত নয়। অনুরূপভাবে কোন নাবী বা ওয়ালীর বরাত দিয়েও আল্লাহ্ তা‘আলার সাহায্য প্রার্থনা করা কুরআনের নির্দেশ ও ‘হাদীসের বর্ণনায় বৈধ প্রমাণিত হয়েছে। এরূপ সাহায্য প্রার্থনাও আল্লাহ্‌র সম্পর্কযুক্ত সাহায্য প্রার্থনার অন্তর্ভুক্ত নয়, যা কুরআন ‘হাদীসে শির্‌কের অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আল্লাহ্‌র নিকট বিশেষভাবে সাহায্য দু’প্রকার:

এক, আল্লাহ্‌ ব্যতীত কোন ফেরেশতা, নাবী, ওয়ালী বা কোন মানুষকে একক ক্ষমতাশালী বা একক ইচ্ছাশক্তির অধিকারী মনে করে তাদের নিকট কিছু চাওয়া, এটি প্রকাশ্য কুফরী। একে কাফির-মুশরিকরাও কুফরী বলে মনে করে। তারা নিজেদের দেবীদেরকেও আল্লাহ্‌র ন্যায় সর্বশক্তিমান একক ইচ্ছাশক্তির অধিকারী মনে করে না।

দুই, সাহায্য প্রার্থনার যে পন্থা কাফিরগণ গ্রহণ করে থাকে, কুরআন তাকে বাতিল ও শির্‌ক্‌ বলে ঘোষণা করেছে। তা হচ্ছে কোন ফেরেশতা, নাবী, ওয়ালী বা দেবদেবী সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করা যে, প্রকৃত শক্তি ও ইচ্ছার মালিক তো আল্লাহ্ তা‘আলাই, তবে তিনি তাঁর কুদরতে সে ক্ষমতা ও ইচ্ছাশক্তির কিছু অংশ অমুককে দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমতা দান করেছেন এবং সে ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাধীন। কুরআনে  وَإِيّاكَ نَستَعينُ দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, এরূপ সাহায্য আমরা আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো নিকট চাইতে পারি না।

সাহায্য-সহায়তা সম্পর্কিত এ ধারণা মু’মিন ও কাফির এবং ইসলাম ও কুফুরীর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। কুরআন একে ‘হারাম ও শির্‌ক্ ঘোষণা করেছে এবং কাফিরগণ একে সমর্থন করে এ অনুযায়ী ‘আমল  করছে। এ ব্যাপারে যেখানে সংশয়ের উদ্ভব হয় তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ তার কোন কোন ফেরেশতার উপর পার্থিব ব্যবস্থা পরিচালনার অনেক দায়িত্ব অর্পণ করেছেন বলে বর্ণনা রয়েছে। এরূপ ধারণা সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র নয় যে, ফেরেশতাগণকে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনে আল্লাহ্ নিজেই তো ক্ষমতা দিয়েছেন, তদনুরূপ নাবীগণকেও এমন কিছু কাজ করার ক্ষমতা দিয়েছেন যা অন্য মানুষের ক্ষমতার উর্ধ্বে; যথা, মু’জিযা। অনুরূপ আউলিয়াগণকেও এমন কিছু কাজের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা সাধারণ মানুষ করতে পারে না। যেমন, কারামাত। সুতরাং স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে এরূপ ধারণায় পতিত হওয়া বিচিত্র নয় যে, আল্লাহ্‌ তা‘আলা স্বীয় ক্ষমতার কিয়দংশ যদি তাদের মধ্যে না-ই দিতেন, তবে তাঁদের দ্বারা এমন সব কাজ কি করে হয়ে থাকে? এতে নাবী ও ওয়ালীগণের প্রতি কর্মে স্বাধীন হওয়ার বিশ্বাস জন্মে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বরং মু’জিযা এবং কারামত একমাত্র আল্লাহ্‌রই কাজ। এর প্রকাশ নাবী ও ওয়ালীগণের মাধ্যমে করে থাকেন শুধু তাঁর ‘হিকমত ও রহস্য বোঝাবার জন্য। নাবী ও ওয়ালীগণের পক্ষে সরাসরি এসব কাজ করার ক্ষমতা নেই। এ সম্পর্কে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। যথা, ইরশাদ হয়েছে:

وَمَا رَمَيْتَ إِذْ رَمَيْتَ وَلَكِنَّ ا للّٰهَ رَمَى

     বদর যুদ্ধে রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শত্রুসৈন্যদের প্রতি এক মুষ্টি কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিলেন এবং সে কঙ্কর সকল শত্রু, শত্রু সৈন্যদের চোখে গিয়ে পড়েছিল। সে মু’জিযা সম্পর্কে এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘হে মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! এ কঙ্কর আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহ্ তা‘আলাই নিক্ষেপ করেছেন।’ এতে বোঝা যায় সে, নাবীগণের মাধ্যমে মু’জিযারূপে যেসব অস্বাভাবিক কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো ছিল আল্লাহ্‌রই কাজ। অনুরূপ, হযরত নূ’হ (’আলাইহিচ্ছালা-ম)-কে তাঁর জাতি বলেছিল যে, আপনি যদি সত্য নাবী হয়ে থাকেন, তবে যে শাস্তি সম্পর্কে আমাদিগকে ভীতি প্রদর্শন করেছেন, তা এনে দেখান। তখন তিনি বলেছিলেন: إنما يأتيكم به ا للّٰهُ -মু’জিযারূপে আসমানী বালা নিয়ে আসা আমার ক্ষমতার উর্ধ্বে। যদি আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করেন, তবে আসবে। তখন তোমরা তা থেকে পালাতে পারবে না।

সূরা ইব্‌রাহীমে নাবী ও রসূলগণের এক দলের কথা উল্লেখিত হয়েছে। তারা বলেছেন:

وَمَا كَانَ لَنَا أَن نَّأْتِيَكُم بِسُلْطَانٍ إِلاَّ بِإِذْنِ اللّٰهِ

অর্থাৎ, “কোন মু’জিযা দেখানো আমাদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা ব্যতীত কিছুই হতে পারে না।” তাই কোন নাবী বা ওলী কোন মু’জিযা বা কারামত যখন ইচ্ছা বা যা ইচ্ছা দেখাবেন, এরূপ ক্ষমতা কাউকেই দেয়া হয়নি।

রসূল ও অন্যান্য নাবীগণকে মুশরিক্‌রা কত রকমের মু’জিযা দেখাতে বলেছে, কিন্তু যেগুলোতে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা হয়েছে সেগুলোই প্রকাশ পেয়েছে। আর যেগুলোতে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা হয়নি, সেগুলো প্রকাশ পায়নি। কুরআনের সর্বত্র এ সম্পর্কিত তথ্য বিদ্যমান।

তাই এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, সব কিছুই একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে এবং এতদসঙ্গে নাবী-রসূল ও ওলী-আউলিয়াগণের গুরুত্বের বিশেষভাবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। এ বিশ্বাস এবং স্বীকৃতি ব্যতীত আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি এবং তাঁর বিধানের অনুসরণ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। যেভাবে কোন ব্যক্তি বাল্‌ব ও পাখার গুরুত্ব অনুধাবন না করে একে নষ্ট করে দিয়ে আলো-বাতাস পাওয়ার আশা করতে পারে না, তেমনি নাবী-রসূল ও ওয়ালী-আউলিয়াগণের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি ব্যতীত আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি আশা করা যায় না।

সাহায্য প্রার্থনা ও ওসীলা তালাশ করা এবং তা গ্রহণ করার প্রশ্নে নানা প্রকার প্রশ্ন ও সংশয়ের উৎপত্তি হতে দেখা যায়। আশা করা যায় যে, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সে সংশয় ও সন্দেহের নিরসন হবে।

সির-ত্বল মুস্তাক্বীমের হিদায়াতই দ্বীন-দুনিয়ার সাফল্যের চাবিকাঠি:

আলোচ্য তাফসীরে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে, আল্লাহ্ তা‘আলা যে দু‘আকে সর্বক্ষণ সকল লোকের সকল কাজের জন্য নির্ধারিত করেছেন তা হচ্ছে সির-ত্বল মুস্তাক্বীমের হিদায়াতপ্রাপ্তির দু‘আ। এমনিভাবে আখিরাতের মুক্তি যেমন সে সরল পথে রয়েছে যা মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে, অনুরূপভাবে দুনিয়ার যাবতীয় কাজের উন্নতি-অগ্রগতিও সির-ত্বল মুস্তাক্বীম বা সরল পথের মধ্যেই নিহিত। যে সমস্ত পন্থা অবলম্বন করলে উদ্দেশ্য সফল হয়, তাতে পূর্ণ সফলতাও অনিবার্যভাবেই হয়ে থাকে।

যে সব কাজে মানুষ সফলতা লাভ করতে পারে না, তাতে গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, সে কাজের ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতিতে নিশ্চয়ই কোন ভূল হয়েছে।

সারকথা, সরল পথের হিদায়াত কেবল পরকাল বা দ্বীনী জীবনের সাফল্যের জন্যই নির্দিষ্ট নয়, বরং দুনিয়ার সকল কাজের সফলতাও এরই উপর নির্ভরশীল। এজন্যই প্রত্যেক মু’মিনের এ দু‘আ তাসবী‘হস্বরূপ সর্বদা স্মরণ রাখা কর্তব্য। তবে মনোযোগ সহকারে স্মরণ রাখতে ও দু‘আ করতে হবে; শুধু শব্দের উচ্চারণ যথেষ্ট নয়।

[আর সব বিষয়ে আল্লাহ্‌ই ভাল জ্ঞান রাখেন। ওয়ামা তাউফীক্বী ইল্লা- বিল্লা-হ…]

(বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর)

মূল: তাফসীরে মা‘আরিফুল ক্বুরআন

হযরত মাওলানা মুফতী মু‘হাম্মাদ শাফী’ র‘হমাতুল্ল-হি ‘আলাইহ

অনুবাদ ও সম্পাদনা:

মাওলানা মু‘হিউদ্দীন খান রহ,

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ