আন-নিসা, আয়াত ১১৪-১৫৪

পৃষ্ঠা নং ২৯২

দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ তাআলা সর্বশক্তিমান, যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দিতে পারে এবং যখন ইচ্ছা প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারে। তথাপি তিনি অতি ক্ষমাশীল। আর মানুষের শক্তি ও ক্ষমতা যখন সামান্য ও সীমাবদ্ধ, তাই ক্ষমা ও মার্জনার পথ অবলম্বন করা তার জন্য অধিক বাঞ্ছনীয়।

এ হচ্ছে অন্যায়-অনাচার প্রতিরোধ ও সামাজিক সংস্কার সাধনের ইসলামী মূলনীতি এবং অভিভাবক সুলভ সিদ্ধান্ত। এক দিকে ন্যায়সঙ্গত প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার প্রদান করে ইনসাফ ও ন্যায়নীতিকে সমুন্নত রাখা হয়েছে, অপরদিকে উত্তম চরিত্রে ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে ক্ষমা ও মার্জনা করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। যার অনিবার্য ফলশ্রুতি সম্পর্কে কুরআন কারীমের অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছেঃ

فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ

          অর্থাৎ, “তোমরা ও অন্য যে ব্যক্তির মধ্যে দুশমনী ছিল, এমতাবস্থায় সে ব্যাক্তি আন্তরিক বন্ধু হয়ে যাবে।”

আইন-আদালত বা প্রতিশোধ গ্রহণ করার মাধ্যমে যদিও অন্যায়-অত্যাচার প্রতিরোধ করা যায়, কিন্তু এর দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া অব্যাহত থাকে। যার ফলে পারস্পরিক বিবাদের সূত্রপাত হওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান থাকে। কিন্তু কুরআন কারীম যে অপূর্ব নৈতিকতার আদর্শ শিক্ষা দিয়েছে, তার ফলে দীর্ঘকালের শত্রুতাও গভীর বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হয়ে থাকে।

এখানে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম আয়াতে কুরআন পাক স্পষ্ট ফায়সালা দিয়েছে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ তাআলাকে মান্য করে কিন্তু তাঁর রসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না, অথবা কোন পয়গম্বরকে মান্য করে, আর কোন পয়গম্বরকে অমান্য করে আল্লাহ্‌ তাআলার সমীপে সে ঈমানদার নয়, বরং প্রকাশ্য কাফের, পরকালে তার পরিত্রাণ লাভের কোন উপায় নেই।

একমাত্র ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মে মুক্তি নেই:

কুরআন হাকীমের উপরোক্ত স্পষ্ট ঘোষণা ঐ সব বিভ্রান্ত লোকদের হীনমন্যতা ও গোঁজামিলকেও ফাঁস করে দিয়েছে, যারা অন্যান্য ধর্মানুসারীদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করতে গিয়ে নিজেদের ধর্মমত ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিজাতির পদমূলে উৎসর্গ করতে ব্যগ্র। যারা কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট ফায়সালাকে উপেক্ষা করে অন্যান্য ধর্মানুসারীদেরকে বুঝাতে চায় যে, “মুসলমানদের মতেও শুধু ইসলামই একমাত্র মুক্তিসনদ নয়, বরং ইহুদী ও খৃষ্টানরাও তাদের নিজ নিজ ধর্মে-কর্মে স্থির থেকে পরকালে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে। অথচ তারা অধিকাংশ রসূলকে অথবা অন্ততঃ কোন কোন পয়গম্বরকে অমান্য করে। যার ফলে তাদের কাফির ও জাহান্নামী হওয়ার কথা অত্র আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে।”

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, অমুসলমানদের প্রতি ইনসাফ, ন্যায়নীতি, সমবেদনা, সহানুভূীত, উদারতা ও ইহসান বা হিতকামনার দিক দিয়ে ইসলাম নজীর বিহীন। কিন্তু উদারতা বা সহানুভুতি ব্যক্তিগত অধিকারের আওতায় হয়ে থাকে যা আমরা যে কোন ব্যক্তিকে উৎসর্গ করতে পারি। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ বা অনধিকার চর্চা করা যাবে না। ইসলাম একদিকে অমুসলমানদের প্রতি সদ্ব্যব্যহার ও পরমসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে যেমন উদার ও অবারিত দ্বার, অপরদিকে স্বীয় সীমারেখা সংরক্ষণের ব্যাপারে অতি সতর্ক, সজাগ ও কঠোর। ইসলাম অমুসলমানদের প্রতি উদারতার সাথে সাথে কুফরী ও কু-প্রথার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমান ও অমুসলমানরা দু’টি পৃথক জাতি এবং মুসলমানদের জাতীয় প্রতীক ও স্বাতন্ত্র্য সযত্নে সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। শুধু ইবাদাতের ক্ষেত্রেই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখলে চলবে না, বরং সামাজিকতার ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হবে। একথা কুরআন ও হাদীসে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে।

কুরআন কারীম ও ইসলামের অভিমত যদি এই হতো যে, যে কোন ধর্মের মাধ্যমে মুক্তি লাভ করা সম্ভব, তাহলে ইসলাম প্রচারের জন্য জীবন উৎসর্গ করার কোন প্রয়োজন ছিল না। হযরত রসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের জিহাদ পরিচালনা করা এমন কি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াত ও কুরআন নাযিল করা নিরর্থক হতো। (নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক)

সূরা বাকারার ৬২ তম আয়াত দ্বারা কেউ কেউ হয়ত সন্দেহে পতিত হতে পারেন যে, এতে ইরশাদ করা হয়েছেঃ

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالنَّصَارَىٰ وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ

          অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা সত্যিকারভাবে ঈমান এনেছে (মুসলমান হয়েছে) এবং যারা ইহুদী হয়েছে এবং নাসারা (খৃষ্টান) ও সাবেয়ীনদের মধ্যে যারা আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতি ও কিয়ামতের দিনের প্রতি ঈমান এনেছে আর সৎকাজ করেছে, তাদের পালনকর্তার সমীপে তাদের জন্য পূর্ণ প্রতিদান সংরক্ষিত রয়েছে। তাদের কোন শংকা নেই এবং তারা দূঃখিত হবে না।

অত্র আয়াতে ঈমানদারীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার পরিবর্তে শুধু আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতি ও কিয়ামতের প্রতি ঈমান আনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাই যারা সামান্য পড়াশোনা করে কুরআন উপলব্ধি করতে চায়, তারা অত্র আয়াত দ্বারা ধারণা করে বসেছে যে, শুধু আল্লাহ্‌ তাআলা ও কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস করাই পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট; নবী-রসূলগণের প্রতি ঈমান আনা মুক্তির পূর্বশর্ত নয়। কিন্তু তারা একথা জানে না যে, কুরআনের পরিভাষায় আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতি ঈমান তখনই শুধু গ্রহণযোগ্য ও ধর্তব্য হয় যখন তার সাথে পয়গম্বর, ফেরেশতা ও আসমানী কিতাবের প্রতিও ঈমান আনা হয়। অন্যথায় শুধু আল্লাহ্‌র অস্তিত্ব ও একত্ববাদ তো স্বয়ং শয়তানও স্বীকার করে কুরআন কারীমের ভাষায় শুনুনঃ

فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنتُم بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوا ۖ وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ ۖ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ ۚ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

          অর্থাৎ, তাদের ঈমান ঐ সময় গ্রহণযোগ্য ও তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে, যখন তারা তোমাদের সাধারণ মুসলমানদের মত পুরোপুরি ঈমান আনবে। যার মধ্যে আল্লাহ্‌ তাআলার প্রতি ঈমানের সাথে সাথে নবিগণের প্রতিও ঈমান আনয়ন করা অপরিহার্য। আর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে চিনে রাখো যে, তারা আল্লাহ্‌ ও রসূলের মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট। অতএব, আপনার পক্ষে আল্লাহ্‌ তাআলাই তাদের মোকাবেলায় যথেষ্ট এবং তিনি সব কিছু শুনেন ও জানেন।

সূরা নিসার আলোচ্য আয়াতে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ তাআলার প্রেরিত কোন একজন নবীকেও যে ব্যক্তি অস্বীকার-

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ