আন-নিসা, আয়াত ১১৪-১৫৪

পৃষ্ঠা নং ২৮৯

কাফির ও মুশরিকদের সাথে সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখা এবং অন্তরঙ্গ মেলা-মেশার প্রধান কারণ এই যে, ওদের বাহ্যিক মান-মর্যাদা, ব্যক্তি-সামর্থ্য, ধনবলে-প্রভাবিত হয়ে হীনমন্যতার শিকার হয় এবং মনে করে যে, ওদের সাহায্য-সহযোগিতায় আমাদেরও মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ্‌ তাআলা তাদের ভ্রান্ত ধারণা খন্ডন করে বলেন যে, তারা এমন লোকদের সাহায্যে মর্যাদাবান হওয়ার আকাঙ্খা করছে, যাদের নিজেদেরই সত্যিকার কোন মর্যাদা নেই। তাছাড়া যে শক্তি ও বিজয়ের মধ্যে সত্যিকার ইজ্জত ও সম্মান নিহিত, তাতো একমাত্র আল্লাহ্‌ তাআলার এখতিয়ারভুক্ত। অন্য কারো মধ্যে যখন কোন ক্ষমতা বা সাফল্য পরিদৃষ্ট হয়, তা সবই আল্লাহ্‌ প্রদত্ত। অতএব, মর্যাদা দানকারী মালিককে অসন্তুষ্ট করে তাঁর শত্রুদের থেকে ইজ্জত হাসিল করার অপচেষ্ট কত বড় বোকামী!

এ সম্পর্কে ‘সূরা মুনাফিক্বুন’-এ ইরশাদ হয়েছে:

وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَلَٰكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَعْلَمُونَ

          অর্থাৎ, ইজ্জত-সম্মান একমাত্র আল্লাহ্‌, রসূল এবং ঈমানদারদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু মুনাফিক্বরা তা অবগত নয়।

এখানে আল্লাহ্‌ তাআলার সাথে হযরত রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মুমিনদের উল্লেখ করে বোঝানো হয়েছে যে, ইজ্জতের মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌ তাআলা। তিনি যাকে ইচ্ছা আংশিক মর্যাদা দান করেন। রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মুমিনগণ যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলার একান্ত অনুগত, পছন্দনীয় ও প্রিয়পাত্র, তাই তিনি তাঁদেরকে সম্মান দান করেন। পক্ষান্তরে কাফির ও মুশরিকদের ভাগ্যে সত্যিকার কোন ইজ্জত নেই। অতএব, তাদের সাথে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক স্থাপন করে সম্মান অর্জন করা সুদুর পরাহত। ফারূকে আযম হযরত উমার (রদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন: যে ব্যক্তি বান্দাদের (মাখলূকের) সাহায্যে মর্যাদাবান হওয়ার বাসনা করে আল্লাহ্‌ তাআলা তাকে লাঞ্ছিত করেন।

হযরত আবূ বাকার জাস্‌সাস (রহিমাহুল্লাহ) ‘আহকামুল-কুরআনে’ লিখেছেন, আলোচ্য আয়াতের মর্ম এই যে, কাফির, মুশরিক পাপিষ্ঠ ও পথভ্রষ্টদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে মর্যাদা ও প্রতিপত্তি অর্জনের ব্যর্থ চেষ্টা করা অন্যায় ও অপরাধ। তবে এই উদ্দেশ্যে মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন নিষেধ করা হয়নি। কেননা, সূরা মুনাফিকূনের পূর্বোক্ত আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ তআলা স্বীয় রসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মুমিনদেরকে ইজ্জত দান করেছেন।

এখানে মর্যাদার অর্থ যদি আখেরাতের চিরস্থায়ী ইজ্জত-সম্মান হয়, তবে তা আল্লাহ্‌ তাআলা শুধুমাত্র তাঁর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও মুমিনদের জন্য সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, আখেরাতের আরাম-আয়েশ, ইজ্জত-সম্মান কোন কাফির বা মুশরিক কস্মিনকালেও লাভ করবে না। আর যদি এখানে পার্থিব মান-মর্যাদা ধরা হয়, তবে মুসলমানরা যতদিন সত্যিকার মুমিন থাকবে, ততদিন সম্মান ও প্রতিপত্তি তাদেরই করায়ত্ত্বে থাকবে। অবশ্য তাদের ঈমানের দুর্বলতা, আমলে গাফলতি বা পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে তাদের সাময়িক ভাগ্যবিপর্যয় হলে বা ঘটনাচক্রে অসহায় হতমান হলেও পরিশেষে তারাই আবার মর্যাদা ও বিজয়ের গৌরব লাভ করবে। দুনিয়ার ইতিহাসে এর বহু নজীর রয়েছে। শেষ যুগে হযরত ঈসা (আলাইহিচ্ছালাম) ও ইমাম মাহ্‌দীর নেতৃত্বে মুসলমানরা আবার যখন সত্যিকার ইসলামের অনুসারী হবে, তখন তারাই দুনিয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা ও মর্যাদার অীধকারী হবে।

وَقَدْ نَزَّلَ عَلَيْكُمْ فِي الْكِتَابِ

          অত্র আয়াতে ইতিপূর্বে মক্কা মুকার্‌রমায় অবতীর্ণ সূরা আন্‌‘আম এর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়েছে,-আমি তো মানুষের সংশোধনের নিমিত্তে আগেই হুকুম নাযিল করেছিলাম যে, কাফির ও বদকারের ধারে কাছেও বসবে না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে, কপটাচারী মুনাফিকরা আদেশ লঙ্ঘন করে ওদের সাথে সৌহার্দ্য স্থাপন করতে শুরু করেছে এবং তাদেরকে ইজ্জত-সম্মানের মালিক মোখতার মনে করেছে।

সূরা-নিসা এর আলোচ্য আয়াত এবং সুরা আন্‌‘আম এর যে, আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, এতদুভয়ের সমন্বিত মর্ম এই যে, যদি কোন প্রভাবে কতিপয় লোক একত্রিত হয়ে আল্লাহ্‌ তাআলার কোন আয়াত বা হুকুমকে অস্বীকার বা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে থাকে, তবে যতক্ষণ তারা এহেন গর্হিত ও অবাঞ্ছিত কার্যে লিপ্ত থাকবে, ততক্ষণ তাদের মজলিসে বসা বা যোগদান করা মুসলমানদের জন্যে হারাম।

মোটকথা, বাতিল পন্থীদের মজলিসে উপস্থিতি ও তার হুকুম কয়েক প্রকার।

প্রথমত: তাদের কুফরী চিন্তাধারার প্রতি সম্মতি ও সন্তুষ্টি সহকারে যোগদান করা। এটা মারাত্মক অপরাধ ও কুফরী।

দ্বিতীয়ত: গর্হিত আলোচনা চলাকালে বিনা প্রয়োজনে অপছন্দ সহকারে উপবেশন করা। এটা অত্যন্ত অন্যায় ও ফাসেকী।

তৃতীয়ত: পার্থিব প্রয়োজনবশতঃ বিরক্তি সহকারে বসা জায়েয।

চতুর্থত: জোর-জবরদস্তির কারণে বাধ্য হয়ে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বসা ক্ষমার্হ।

পঞ্চমত: তাদেরকে সৎপথে আনয়নের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হওয়া সওয়াবের কাজ।

কুফরীর প্রতি মৌন সম্মতিও কুফরী: আলোচ্য আয়াতের শেষে ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّكُمْ إِذًا مِّثْلُهُمْ

          অর্থাৎ, এমন মজলিস যেখানে আল্লাহ তাআলার আয়াত ও আহকামকে অস্বীকার, বিদ্রূপ বা বিকৃত করা হয়, সেখানে হৃষ্টচিত্তে উপবেশন করলে তোমরাও তাদের সমতুল্য ও তাদের গোনাহ্‌র অংশীদার হবে। অর্থাৎ, আল্লাহ না করুন, তোমরা যদি তাদের কুফরী কথাবার্তা মনে-প্রাণে পছন্দ কর, তাহলে বস্তুতঃ তোমরাও কাফির হয়ে যাবে। কেননা, কুফরীকে পছন্দ করাও কুফরী। আর যদি তাদের কথাবার্তা পছন্দ না করা সত্ত্বেও বিনা প্রয়োজনে তাদের সাথে উঠা বসা কর এমতাবস্থায় তাদের সমতুল্য হওয়ার অর্থ হবে তারা যেভাবে শরীয়তকে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধন করার অপ্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে, তোমরা তাদের আসরে যোগদান করে সহযোগিতা করায় তাদের মতই ইসলামের ক্ষতি সাধন করছ! নাঊযু বিল্লাহহি মিন যালিক।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ