আল-বাকারা ১৪৭-১৬৪

পৃষ্ঠা নং-৭৮

وجهة -এর স্থলে قبلة ও পড়েছেন বলে বর্ণিত রয়েছে৷

তাফসীরের ইমামগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় এই, –প্রত্যেক জাতিরই ‘ইবাদতের সময় মুখ করার জন্য একটা নির্ধারিত কেবলা চলে আসছে৷ সে কেবলা আল্লাহ্‌র তরফ হতে নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে, অথবা তারা নিজেরাই তা নির্ধারণ করে নিয়েছে৷ মোটকথা, ‘ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রত্যেক জাতিই কোন না কোন দিকে মুখ করে দাঁড়ায়৷ এমতাবস্থায় আখেরী নবীর উম্মতগণের জন্য যদি কোন একটা বিশেষ দিককে কেবলা নির্ধারণ করে দেয়া হয়ে থাকে, তবে তাতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কি আছে?

এ পর্যন্ত কেবলা পরিবর্তনসংক্রান্ত আলোচনা চলে আসছিল৷ এখানে বিষয়টিকে এমন এক পর্যায়ে এনে সমাপ্ত করা হয়েছে, যাতে এ বিষয়টির ভূমিকায় কা’বা নির্মাতা হযরত ইবরাহীমের দু‘আর বিষয়টিও প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হয়ে গেছে৷ অর্থাৎ, হযরত ইবরাহীম (‘আলাইহিচ্ছালাম)-এর বংশধরদের মধ্যে এক বিশেষ মর্যাদায় মহানবী (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আবির্ভাব৷ এতে এ বিষয়েও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রসূলে কারীম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আবির্ভাবে কা’বা নির্মাতার দু‘আরও একটা প্রভাব রয়েছে৷ কাজেই তাঁর কেবলা যদি কা’বা শরীফকে সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে তাতে বিস্ময়ের কিংবা অস্বীকারের কিছুই নেই৷

كما ارسلنا -বাক্যে উদাহরণসূচক যে ‘কাফ’ (ك) বর্ণটি ব্যবহার করা হযেছে, তার একটি ব্যাখ্যা তো উল্লেখিত তাফসীরের মাধ্যমেই বুঝা গেছে৷ এছাড়াও আরেকটি বিশ্লেষণ রয়েছে, যা কুরতুবী গ্রহণ করেছেন৷ তা হল এই যে, ‘কাফ’ -এর সম্পর্ক হল পরবর্তী আয়াত فاذكروني -এর সাথে৷ অর্থাৎ, আমি যেমন তোমাদের প্রতি কেবলাকে একটি নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামত হিসাবে দান করেছি এবং অতঃপর দ্বিতীয় নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামত দিয়েছি রসূলের আবির্ভাবের মাধ্যমে, তেমনি আল্লাহ্‌র যিকিরও আরেকটি নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামত৷ এসব নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামতের শুকরিয়া/কৃতজ্ঞতা আদায় কর, যাতে এসব নি‘আমাহ/নি‘আমত/নেয়ামতের অধিকতর প্রবৃদ্ধি হতে পারে৷ কুরতুবী বলেন, এখানে كما ارسلنا-এর ‘কাফ’টির ব্যবহার ঠিক তেমনি, যেমনটি সূরা আনফালের كمااخرجنا এবং সূরা ‘হিজরের كماانزلنا على المقتسمين -এর মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে৷ فاذكروني اذكركم এতে ‘যিকির’-এর অর্থ হল স্মরণ করা, যার সম্পর্ক হল অন্তরের সাথে৷ তবে জিহ্বা যেহেতু অন্তরের মুখপাত্র, কাজেই মুখে স্মরণ করাকেও ‘যিকির’ বলা যায়৷ এতে বুঝা যায় যে, সে মৌখিক যিকিরই গ্রহণযোগ্য, যার সাথে মনেও আল্লাহ্‌র স্মরণ বিদ্যমান থাকবে৷

তবে এতদসঙ্গে একথাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, কোন লোক যদি মুখে তাসবী‘হ জপে ব্যস্ত থাকে, কিন্তু তার মন যদি অনুপস্থিত থাকে অর্থাৎ,যিকিরে না লাগে, তবুও তা একেবারে ফায়দাহীন নয়৷ হযরত আবু ‘উসমান (র‘হমাতুল্ল-হি ‘আলাইহি)-এর কাছে জনৈক ভক্ত এমনি অবস্থায় অভিযোগ করছিল যে, মুখে মুখে যিকির করি বটে, কিন্তু অন্তরে তার কোনই মাধুর্য অনুভব করতে পারি না৷ তখন তিনি বললেন, -তবুও আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় কর যে, তিনি তোমার একটি অঙ্গ জিহ্বাকে তো অন্ততঃ তাঁর যিকিরে নিয়োজিত করেছেন৷-(কুরতুবী)

যিকিরের ফযীলতঃযিকিরের ফযীলত অসংখ্য৷ তন্মধ্যে এটাও কম ফযীলত নয় যে, বান্দা যদি আল্লাহকে স্মরণ করে, তাহলে আল্লাহ তাকে স্মরণ করেন৷ আবু ‘উসমান মাহদী (র‘হমাতুল্ল-হি ‘আলাইহি) বলেছেন যে, আমি সে সময়টির কথা জানি, যখন আল্লাহ তা’আলা আমাদিগকে স্মরণ করেন৷ উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আপনি তা কেমন করে জানতে পারেন? বললেন, তা এজন্যে যে, কুরআন কারীমের ওয়াদা অনুসারে যখন কোন মু’মিন বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ নিজেও তাকে স্মরণ করেন৷ কাজেই বিষয়টি জানা সবার জন্যই সহজ যে, আমরা যখন আল্লাহ্‌র স্মরণে আত্মনিয়োগ করব, আল্লাহ তা’আলাও আমাদের স্মরণ করবেন৷

আর আয়াতের অর্থ হল এই যে, তোমরা যদি আমাকে আমার হুকুমের আনুগত্যের মাধ্যমে স্মরণ কর, তাহলে আমিও তোমাদেরকে ছাওয়াব ও মাগফিরাত দানের মাধ্যমে স্মরণ করব৷

হযরত সা‘ঈদ ইবনে জুবাইর (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) ‘যিক্‌রুল্লাহ’র তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যিকির অর্থই হচ্ছে আনুগত্য এবং নির্দেশ মান্য করা৷ তাঁর বক্তব্য হচ্ছেঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নির্দেশের আনুগত্য করে না, সে আল্লাহ্‌র যিকিরই করে না; প্রকাশ্যে যত বেশী নামায এবং তাসবী‘হই সে পাঠ করুক না কেন৷”

যিকিরের তাৎপর্যঃ মুফাস্সির কুরতুবী ইবনে-খুয়াইয-এর আ‘হকামুল কুরআনের বরাত দিয়ে এ সম্পর্কিত একখানা ‘হাদীসও উদ্ধৃত করেছেন৷ ‘হাদীসটির মর্মার্থ হচ্ছে যে, রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য করে অর্থাৎ, তাঁর ‘হালাল ও ‘হারাম সম্পর্কিত নির্দেশগুলোর অনুসরণ করে, যদি তার নফল নামায-রোযা কিছু কমও হয়, সেই আল্লাহকে স্মরণ করে৷ অন্যদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধাচরণ করে, সে নামায-রোযা, তাসবী‘হ-তা‘হলীল প্রবৃতি বেশী করে করলেও প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহকে স্মরণ করে না৷

হযরত যুন্নুন মিসরী বলেনঃ “যে ব্যক্তি প্রকৃতই আল্লাহকে স্মরণ করে সে অন্যান্য সব কিছুই ভুলে যায়৷ এর বদলায় স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই সবদিক দিয়ে তাকে হেফাযত করেন এবং সব কিছুর বদলা তাকে দিয়ে দেন৷”

হযরত মু’আয (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেনঃ “আল্লাহর ‘আযাব থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে মানুষের কোন ‘আমলই যিকরুল্লাহ্‌র সমান নয়৷” হযরত আবু হুরায়রা (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বর্ণিত এক হদীসে-কুদসীতে আছে, আল্লাহ তা’আলা বলেন,– “বান্দা যে পর্যন্ত আমাকে স্মরণ করতে থাকে বা আমার স্মরণে যে পর্যন্ত তার ঠোঁট নড়তে থাকে, সে পর্যন্ত আমি তার সাথে থাকি৷

ধৈর্য ও নামায যাবতীয় সংকটের প্রতিকারঃ استعينوا بالصبر والصلوة “ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর,” -এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট, যাবতীয় প্রয়োজন ও সমস্ত সংকটের নিশ্চিত প্রতিকার দু’টি বিষয়ের মধ্যেই নিহিত৷ একটি ‘সবর’ বা ধৈর্য এবং অন্যটি “নামায”৷ বর্ণনারীতির মধ্যে استعينوا শব্দটিকে বিশেষ কোন বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট না করে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করার ফলে এখানে যে মর্মার্থ দাঁড়ায় তা এই যে, মানব জাতির যে কোন সংকট বা সমস্যার নিশ্চিত প্রতিকারই ধৈর্য ও নামায৷ যে কোন প্রয়োজনেই এ দু’টি বিষয়ের দ্বারা মানুষ সাহায্য লাভ করতে পারে৷ তাফসীরে মাযহারীতে শব্দ দু’টির ব্যাপক অর্থে ব্যবহারের তাৎপর্য এভাবেই বর্ণিত হয়েছে৷ প্রসঙ্গতঃ স্বতন্ত্রভাবে দুটি বিষয়েরই তাৎপর্য অনুধাবন করা যেতে পারে৷

সবর-এর তাৎপর্যঃ ‘সবর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সংযম অবলম্বন ও-

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ