আল-বাকারা ১-১৫

পৃষ্ঠা নং-১৪

শর্ত হচ্ছে যে, সেগুলো রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শিক্ষা হিসেবে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হতে হবে। আহ্‌লে-ইসলামের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ঈমানের এ সংজ্ঞাই দিয়েছেন। ‘’আক্বায়েদে-ত্ব’হাবী’ ও ‘’আক্বায়েদে-নস্বফী’-তে এ সংজ্ঞা মেনে নেয়াকেই ঈমান বলে অভিহিত করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শুধু জানার নামই ঈমান নয়। কেননা, স্বয়ং ইবলীস এবং অনেক কাফিরও রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নবুওয়াত যে সত্য তা আন্তরিকভাবে জানতো, কিন্তু না মানার কারণে তারা ঈমানদারের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।

দ্বিতীয়তঃ ইক্বামতে-স্বলাতঃ ইক্বামত বা প্রতিষ্ঠা অর্থ শুধু স্বালাত/নামায আদয় করা নয়, বরং স্বলাত/নামাযকে সকল দিক দিয়ে ঠিক করাকে প্রতিষ্ঠা করা বলা হয়। ‘ইক্বামত’ অর্থে স্বলাত/নামাযে সকল ফার্‌দ্ব/ফরয, ওয়াজিব,সুন্নাহ/সুন্নত, মুস্তা’হাব পরিপূর্ণভাবে আদায় করা, এতে সব সময় সুদৃঢ় থাকা এবং এর ব্যবস্থাপনা সুদৃঢ় করা সবই বোঝায়। ফার্‌দ্ব/ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাহ/সুন্নত ও নফল প্রভৃতি সকল স্বলাত/নামাযের জন্য একই শর্ত। এক কথায় স্বলাত/নামাযে অভ্যস্ত হওয়া ও তা শরী’আতের নিয়মানুসারে আদায় করা এবং এর সকল নিয়ম-পদ্ধতি যথার্থভাবে পালন করাই ইক্বামতে-স্বলাত।

তৃতীয়তঃ আল্লাহ্‌র পথে ব্যয়ঃ আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় অর্থে এখানে ফার্‌দ্ব/ফরয যাকাহ/যাকাত, ওয়াজিব স্বদাক্বাহ/সদকা এবং নফল দান-খয়রাত প্রভৃতি যা আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয় করা হয় সে সবকিছুই বোঝানো হয়েছে। কুরআনে সাধারণতঃ نفاق শব্দ নফল দান-খয়রাতের জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে। যেখানে ফার্‌দ্ব/ফরয যাকাহ/যাকাত উদ্দেশ্য সেসব ক্ষেত্রে زكوة শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।

وممّا رزقنهم এ সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, আল্লাহ্‌র রাস্তায় তথা সৎপথে অর্থ ব্যয় করার একটা প্রবল আকাঙ্খা প্রত্যেক সৎ মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে জাগ্রত করাই এ আয়াতের উদ্দেশ্য। একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি চিন্তা করবে যে, আমাদের নিকট যা কিছু রয়েছে, তা সবই তো আল্লাহ্‌র দান ও আমানাহ/আমানত। যদি আমরা সমস্ত ধন-সম্পদ তাঁর পথে ব্যয় করি, তবেই মাত্র এ নি’আমতের হক্ব আদায় হবে। পরন্তু এটা আমাদের পক্ষ থেকে কারো প্রতি কোন ই’হসান বা অনুগ্রহ হবে না তবে এ আয়াতে ممّا শব্দ যোগ করে একথা বোঝানো হয়েছে যে, যে ধন-সম্পদ আমাদেরকে দেয়া হয়েছে তা সবই ব্যয় করতে হবে এমন নয়; বরং কিয়দংশ ব্যয় করার কথাই বলা হয়েছে।

মুত্তাক্বীদের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমে অদৃশ্যে বিশ্বাস, এরপর স্বলাত/নামায প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহ্‌র পথে ব্যয় করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমানের গুরুত্ব সকলেরই জানা যে, ঈমানই প্রকৃত ভিত্তি এবং সকল ‘‘আমল ক্ববূল হওয়া ঈমানের উপরই নির্ভরশীল। কিন্তু যখনই ঈমানের সাথে ‘আমলের কথা বলা হয়, তখন সেগুলোর তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হতে থাকে। কিন্তু এখানে শুধু স্বলাত/নামায এবং অর্থ ব্যয় পর্যন্ত ‘‘আমল রয়েছে তা ফার্‌দ্ব/ফরযই হোক অথবা ওয়াজিব, সবই হয় মানুষের দেহ অথবা ধন-সম্পদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ‘ইবাদতে-বদনী তথা দৈহিক ‘ইবাদতের মধ্যে স্বলাম/নামায সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখানে স্বলাত/নামাযের বর্ণনায় এবং যেহেতু আর্থিক ‘ইবাদত সবই انفاق শব্দের অন্তর্ভুক্ত সুতরাং এ উভয় প্রকার ‘ইবাদতের বর্ণনার মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে যাবতীয় ‘ইবাদতের বর্ণনা অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। পূর্ণ আয়াতের অর্থ হচ্ছেঃ তারাই মুত্তাক্বী যাদের ঈমান পূর্ণাঙ্গ এবং ‘‘আমলও পূর্ণাঙ্গ। ঈমান এবং ‘‘আমল এ দুয়ের সমন্বয়েই ইসলাম। এ আয়াতে ঈমানের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দেয়ার সাথে সাথে ইসলামের বিষয়বস্তুর প্রতিও ইঙ্গীত করা হয়েছে।

ঈমান ও ইসলামের পার্থক্যঃ অভিধানে কোন বস্তুতে আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন ঈমান এবং কারো অনুগত হওয়াকে ইসলাম বলে।

ঈমানের আধার হল অন্তর ইসলামের আধার অন্তরসহ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কিন্তু শরী’আতে ঈমান ব্যতীত ইসলাম এবং ইসলাম ব্যতীত ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ, আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত এ বিশ্বাসের মৌখিক স্বীকৃতির সাথে সাথে কর্মের দ্বারা আনুগত্য ও তাবেদারী প্রকাশ করা না হয়।

মোটকথা, আভিধানিক অর্থে ঈমান ও ইসলাম স্বতন্ত্র অর্থবোধক বিষয়বস্তুর অন্তর্গত। অর্থগত পার্থক্যের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু শরী’আত ঈমানবিহীন ইসলাম এবং ইসলামবিহীন ঈমান অনুমোদন করে না।

প্রকাশ্য আনুগত্যের সাথে যদি অন্তরের বিশ্বাস না থাকে, তবে কুরআনের ভাষায় একে ‘নিফা-ক্ব’ বলে। নিফা-ক্বকে কুফর হতেও বড় অন্যায় সাব্যস্ত করা হয়েছে।

বলা হয়েছে-‘মুনাফিক্বদের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।’ অনুরূপভাবে আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে যদি মৌখিক স্বীকৃতি এবং আনুগত্য না থাকে, কুরআনের ভাষায় একেও কুফরী বলা হয়।

বলা হয়েছে-“কাফিরগণ রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং তাঁর নবুওয়াতের যথার্থতা সম্পর্কে এমন সুস্পষ্টভাবে জানে, যেমন জানে তাদের নিজ নিজ সন্তানদেরকে।’

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

وَجَحَدُوْا بِهَاوَاسْتَيْقَنَتْهَااَنْفُسُهُمْ ظُلْماً وَعُلُوًّا

অর্থাৎ, তারা আমার নিদর্শন বা আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে, অথচ তাদের অন্তরে এর পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। তাদের এ আচরণ কেবল অন্যায় ও অহঙ্কারপ্রসূত।

ঈমান ও ইসলামের ক্ষেত্র এক, কিন্তু আরম্ভ ও শেষের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। অর্থাৎ, ঈমান যেমন অন্তর থেকে আরম্ভ হয় এবং প্রকাশ্য ‘আমলে পৌঁছে পূর্ণতা লাভ করে, তদ্রূপ ইসলামও প্রকাশ্য ‘‘আমল’ থেকে আরম্ভ হয় এবং অন্তরে পৌঁছে পূর্ণতা লাভ করে। অন্তরের বিশ্বাস প্রকাশ্য ‘‘আমল পর্যন্ত না পৌঁছলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। অনুরূপভাবে প্রকাশ্য আনুগত্য ও তাবেদারী আন্তরিক বিশ্বাসে না পৌঁছালে গ্রহণযোগ্য হয় না। ইমাম গাযালী এবং ইমাম সুব্‌কীও এ মত পোষণ করেছে।

অন্য আয়াতে মুত্তাক্বীদের এমন আরো কতিপয় গুণাবলীর বর্ণনা রয়েছে, যাতে ঈমান বিল-গ্বায়ব এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসের প্রসঙ্গটা আরো একটু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত ‘আব্‌দুল্লাহ্ ইব্‌ন ‘আব্বাস (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আন্‌হু) বলেছেন যে, রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে মু’মিন ও মুত্তাক্বী শ্রেণীর লোক বিদ্যমান ছিলেন, একশ্রেণী তাঁরা যাঁরা প্রথমে ‘হাদীস ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। অন্য শ্রেণী হল যাঁরা প্রথমে আহ্‌লে-কিতাব ইহুদী-নাস্বারা ছিলেন এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এখানে পূর্ববর্তী আয়াতে প্রথম-

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ