আল-বাকারা ১-১৫

পৃষ্ঠা নং-১৭

এ সমস্ত জেদী-অহংকারী লোক, যারা সত্যকে জেনে-শুনেও কুফরী ও অস্বীকৃতির উপর দৃঢ় অনড় হয়ে আছে, অথবা অহংকারের বশবর্তী হয়ে কোন সত্য কথা শুনতে কিংবা সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ দেখতেও প্রস্তুত নয়, তাদের পথে এনে ঈমানের আলোকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যে বিরামহীন চেষ্টা করছেন তা ফলপ্রসূ হওয়ার নয়। এদের ব্যাপারে চেষ্টা করা না করা একই কথা।

পাপের শাস্তি পার্থিব সামর্থ্য থেকে বঞ্চিত হওয়াঃ এ দু’টি আয়াতের দ্বারা বোঝা গেল, কুফর ও অন্যান্য সব পাপের আসল শাস্তি তো পরকালে হবেই; তবে কোন কোন পাপের আংশিক শাস্তি দুনিয়াতেও হয়ে থাকে দুনিয়ার এ শাস্তি ক্ষেত্রবিশেষে নিজের অবস্থা সংশোধন করার সামর্থ্যকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। শুভবুদ্ধি লোপ পায়।

মানুষ আখিরাতের হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে গাফেল বা অলশ হয়ে গোমরাহীর (পথভ্রষ্টতা) পথে এমন দ্রুততার সাথে এগুতে থাকে; যাতে অন্যায়ের অনুভুতি পর্যন্ত তাদের অন্তর থেকে দূরে চলে যায়। এ সম্পর্কে কোন কোন বুযুর্গ মন্তব্য করেছেন যে, পাপের শাস্তি এরূপও হয়ে থাকে যে, একটি পাপ অপর একটি পাপকে আকর্ষণ করে, অনুরূপভাবে একটি নেকীর (ভালকাজ) বদলায় অপর একটি নেকী আকৃষ্ট হয়।

‘হাদীসে আছে, মানুষ যখন কোন একটি গোনাহ্‌র কাজ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। সাদা কাপড়ে হঠাৎ কালো দাগ লাগার পর যেমন তা খারাপ লাগে, তেমনি প্রথমাবস্থায় অন্তরে পাপের দাগও অস্বস্তির সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় যদি সে ব্যক্তি তাওবা না করে, আরো পাপ করতে থাকে, তবে পর পর দাগ পড়তে পড়তে অন্তঃকরণ দাগে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তার অন্তর থেকে ভাল-মন্দের পার্থক্য সম্পর্কিত অনুভুতি পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে যায়।

উপদেশ দান করা সর্বাবস্থায় উপকারীঃ এ আয়াতে সনাতন কাফিরদের প্রতি রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নাস্বী’হাহ/নসীহত বা উপদেশ করা না করা সমান বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ সাথে عَلَيۡهِمۡ এর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এ সমতা কাফিরদের জন্য, রসূলের জন্য নয়। তবে তাদেরকে জানানোর এবং সংশোধণ করার চেষ্টা করার ছাওয়াব অবশ্যই পাওয়া যাবে। তাই সমগ্র কুরআনে কোন আয়াতেই এসব লোককে ঈমান ও ইসলামের দিকে দা’ওয়াত দেয়া নিষেধ করা হয়নি। এতে বোঝা যাচ্ছে, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইসলামের দা’ওয়াত দেয়ার কাজে নিয়োজিত, তা ফলপ্রসু হোক বা না হোক, সে এ কাজের ছাওয়াব পাবেই।

একটি সন্দেহের নিরসনঃ এ আয়াতের বিষয়বস্তুর অনুরূপ ভাষা সূরায়ে মুত্বফ্‌ফিফীনের এক আয়াতেও উল্লেখিত হয়েছে যথাঃ

كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُبِهِمْ مَاكَانُوْا يَكْسِبُوْنَ

অর্থাৎ, এমন নয়; বরং তাদের অন্তরে তাদের কর্মের মরিচা গাঢ় হয়ে গেছে। তাতে বোঝানো হয়েছে যে, তাদের মন্দ কাজ ও অহংকারই তাদের অন্তরে মরিচার আকার ধারণ করেছে। এ মরিচাকে আলোচ্য আয়াতে ‘সীলমোহার’ বা আবরণ শব্দের দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এরূপ সংশয় সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, যখন আল্লাহ্‌ তাদের অন্তরে সীলমোহার এঁটে দিয়েছেন এবং গ্রহণ-ক্ষমতাকে রহিত করেছেন, তখন তারা কুফরী করতে বাধ্য। কাজেই তাদের শাস্তি হবে কেন? এর উত্তর হচ্ছে যে, তারা নিজেরাই অহংকার ও বিরুদ্ধাচরণ করে নিজেদেরে যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে, তাই এজন্য তারাই দায়ী। যেহেতু বান্দাদের সকল কাজের সৃষ্টি আল্লাহ্‌ই করেছেন, তিনি এ স্থলে সীলমোহরের কথা বলে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা নিজেরাই যখন সত্য গ্রহণের ক্ষমতাকে রহিত করতে উদ্যত হয়েছে, তখন আমি আমার কর্ম-পদ্ধতী অনুযায়ী তাদের এ খারাপ যোগ্যতার পরিবেশ তাদের অন্তরে সৃষ্টি করে দিয়েছি।

উপরোক্ত আয়াতের মধ্যে দু’টি আয়াতে মুনাফিক্বদের সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে যে, কিছু সংখ্যক লোক আছে, যারা বলে যে, আমরা ঈমান এনেছি, অথচ তারা আদৌ ঈমানদার নয়, বরং তারা আল্লাহ্‌ তা‘আলা ও মু’মিনদের সাথে প্রতারণা করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা নিজেরদেরকে ব্যতীত অন্য কাউকেই প্রতারিত করছে না।

এতে তাদের ঈমানের দাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হয়েছে যে, তাদের এ দাবীও মুলতঃ প্রতারণামূলক। এটা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহ্‌কে কেউ ধোকা দিতে পারে না এবং তারাও একথা হয়তো ভাবে না যে, তারা আল্লাহ্‌কে ধোকা দিতে পারবে, বরং রসূলুল্ল-হ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং মুসলমানদের সাথে ধোকাবাজি করার দরুনই বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ্‌র সাথে ধোকাবাজি করছে। [কুরতুবী]

এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক প্রকৃত প্রস্তাবে আত্ম-প্রবঞ্চনায় লিপ্ত। কেননা, আল্লাহ্‌ তা‘আলা সমস্ত ধোকা ও প্রতারণার উর্ধ্বে। অনুরূপ তাঁর রসূল এবং মু’মিনগণও ও‘হীর দৌলতে বা কারণে ছিলেন সমস্ত ধোকা-প্রতারণা থেকে নিরাপদ। কারো পক্ষে তাঁদের কোন ক্ষতি করা ছিল অস্বাভাবিক। পরন্তু তাদের এ ধোকার ক্ষতিকর পরিণতি দুনিয়া ও আখিরাতের উভয় ক্ষেত্রে তাদেরই উপর পতিত হতো। তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, তাদের অন্তর রোগাক্রান্ত বা অসুস্থ। তাই আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাদের এ রোগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।

রোগ সে অবস্থাকেই বলা হয়, যে অবস্থায় মানুষ স্বাভাবিক অবস্থার বাইরে চলে যায় এবং তাদের কাজ-কর্মে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। যার শেষ পরিণাম ধ্বংস ও মৃত্যু। হযরত জুনাইদ বাগ্বদাদী (র‘হঃ) বলেন, যেভাবে অসতর্কতার দরুন মানুষের শরীরে রোগের সৃষ্টি হয়, তেমনিভাবে প্রবৃত্তির প্ররোচনার অনুকরণের দ্বারা মানুষের অন্তরেও রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে।

এ আয়াতে তাদের অন্তর্নিহিত কুফরকে রোগ বলা হয়েছে যা আত্মিক ও দৈহিক উভয় বিবেচনায়েই বড় রোগ। রূ’হানী (অন্তরের) ব্যধি তো প্রকাশ্য; কেননা, প্রথমতঃ এ থেকে স্বীয় পালনকর্তার না-শুকরি ও অবাধ্যতা সৃষ্টি হয়। যাকে কুফর বলা হয়, তা মানবাত্মার জন্য সর্বাপেক্ষা কঠিন ব্যধি। এতদসঙ্গে মানবসভ্যতার জন্যও অত্যন্ত ঘৃণা দোষ। দ্বিতীয়তঃ দুনিয়ার হীন উদ্দেশ্য হাসিল বা অর্জনের জন্য সত্যকে গোপন করা এবং স্বীয় অন্তরের কথাকে প্রকাশ করার হিম্মত বা সাহস না করা এ ব্যাপারটিও অন্তরের বড় রোগ। মুনাফিক্বদের দৈহিক রোগ এজন্য যে, তারা সর্বদাই এ ভয়ের মধ্যে থাকে যে, না জানি কখন কোথায় তাদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ে। দিবারাত্র এ চিন্তায় ব্যস্ত থাকাও একটি মানসিক তথা শারিরীক ব্যধিই বটে। তাছাড়া এর পরিণাম অনিবার্যভাবেই ঝগড়া ও শত্রুতা। কেননা, মুসলামানদের উন্নতি ও অগ্রগতি দেখে তারা সব সময়ই হিংসার আগুনে দগ্ধ হতে থাকে, কিন্তু সে হতভাগা নিজের অন্তরের কথাটুকুও প্রকাশ করতে পারে না। ফলে সে শারিরীক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকে।

‘আল্লাহ্‌ তাদের রোগকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন।’ এর অর্থ এই যে, তারা ইসলামও মুসলমানদের উন্নতি দেখে জ্বলে-পুড়ে দিন দিন ছাই হতে থাকে। আল্লাহ্‌ তো দিন দিন তার দ্বীনের উন্নতি দিয়েই যাচ্ছেন।

১১ ও ১২ নং আয়াতে মুনাফিক্বদের সে ভুলের আলোচনা করা হয়েছে যে, তারা ফিৎনা-ফাসাদকে মীমাংসা এবং নিজেদেরকে মীমাংসাকারী মনে করে। কুরআন পরিস্কাভাবে বলে দিয়েছে যে, ফাসাদ ও মীমাংসা মৌখিক দাবীর উপর নির্ভরশীল নয়। অন্যথায় কোন চোর বা ডাকাতও নিজেকে ফাসাদ সৃষ্টিকারী বলতে রাজী নয়। এ ব্যাপারটি একান্তভাবে ব্যক্তি বা ব্যাক্তি-সমষ্টির আচরণের উপর নির্ভরশীল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আচরণ যদি ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টির কারণ হয়, তবে এসব কাজ যারা করে তাদেরকে ফাসাদ সৃষ্টিকারী মুফ্‌সিদই বলতে হবে। চাই একাজে ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা তার উদ্দেশ্য হোক বা না-ই হোক।

১৩ নং আয়াতে মুনাফিক্বদের সামনে সত্যিকার ঈমানের একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে اٰمِنُوْا كَمَا اٰمَنَ النَّاسُ অর্থাৎ, অন্যান্য লোক যেভাবে ঈমান এনেছে, তোমরাও অনুরূপভাবে ঈমান আন। এখানে ‘নাস’ শব্দের দ্বারা সাহাবীগণকে বোঝানো হয়েছে। কেননা কুরআন অবতরণের যুগে তাঁরাই ঈমান এনেছিলেন। আর আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে সা’হাবীগণের ঈমানের অনুরূপ ঈমানই গ্রহণযোগ্য। যে বিষয়ে তাঁরা যেভাবে ঈমান এনেছিলেন অনুরূপ ঈমান যদি অন্যরা আনে তবেই তাকে ঈমান বলা হয়; অন্যথায় তাকে ঈমান বলা চলে না। এতে বোঝা গেল যে, সা’হাবীগণের ঈমানই ঈমানের কষ্টি পাথর। যার নিরিখে অবশিষ্ট সকল উম্মতের ঈমান পরীক্ষা করা হয়। এ কষ্টিপাথরের পরীক্ষায় যে ঈমান সঠিক প্রমাণিত না হয়, তাকে ঈমান বলা যায় না এবং অনুরূপ ঈমানদারকে মু’মিন বলা চলে না। এর বিপরীতে যত ভাল কাজই হোক না কেন, আর তা যত ভাল নিয়্যতেই করা হোক না কেন, আল্লাহ্‌র নিকট তা ঈমানরূপে স্বীকৃতি পায় না। সে যুগের মুনাফ্বিরা সা’হাবীগণকে বোকা বলে আখ্যায়িত করেছে। বস্তুতঃ এ ধরনের গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা সর্বযুগেই চলে আসছে। যারা ভ্রষ্টকে পথ দেখায়, তাদের ভাগ্যে সাধারণতঃ বোকা,অশিক্ষিত,মূর্খ প্রভৃতি আখ্যাই জুটে থাকে। কিন্তু কুরআন পরিস্কার ভাষায় ঘোষণা করেছ যে, এসব লোক নিজেরাই বোকা। কেননা, এমন উজ্জ্বল ও প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী থাকা সত্ত্বেও তাতে বিশ্বাস স্থাপন করার মত জ্ঞান-বুদ্ধি তাদের হয়নি।

১৪ নং আয়াতে মুনাফিক্বদের কপটতা ও দ্বিমুখী নীতির বর্ণানা দেয়া হয়েছে যে, তারা যখন মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে আমরা মুসলমান হয়েছি; ঈমান এনেছি। আর যখন তাদের দলের কাফিরদের সাথে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা তোমাদের সাথেই রয়েছি, মুসলামানদের সাথে উপহাস করার উদ্দেশ্যে এবং তাদের বোকা বানাবার জন্য মিশেছি।

১৫ নং আয়াতে তাদের এ বোকামীর উত্তর দেয়া হয়েছে। তারা মনে করে, আমরা মুসলমানদিগকে বোকা বানাচ্ছি। অথচ বাস্তবে তারা নিজেরাই বোকা সাজছে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে একটু ঢিল দিয়ে উপহাসের পাত্র করেছেন। প্রকাশ্যে তাদের কোন শাস্তি না হওয়াতে তারা আরো গাফলতীতে পতিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের উপহাস ও ঠাট্টার প্রত্যুত্তরে তাদের প্রতি এরূপ আচরণ করেছেন বলেই একে উপহাস বা বিদ্রূপ বলা হয়েছে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ