পৃষ্ঠা নং-১৩৯
সুপারিশ করে, তাই এ বিষয়টিও স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, এ ক্ষমতাও কারো নেই। তবে আল্লাহ্র কিছু খাস বান্দা আছেন, যাঁরা তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে তা করতে পারবেন, অন্যথায় নয়। ‘হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, রসূল (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ ‘হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম আমি সমস্ত উম্মতের জন্য সুপারিশ করবো। একে ‘মাক্বামে-মা‘হমূদ’ বলা হয়, যা হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্য খাস। অন্যের জন্য নয়।
ষষ্ঠ বাক্য- يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ অর্থাৎ, আল্লাহ তা‘আলা অগ্রপশ্চাত যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনা সম্পর্কে অবগত। অগ্রপশ্চাত বলতে এ অর্থও হতে পারে যে, তাদের জন্মের পূর্বে ও জন্মের পরের যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনাবলী আল্লাহ্র জানা রয়েছে। আর এ অর্থও হতে পারে যে, অগ্র বলতে সে অবস্থা বোঝানো হয়েছে যা মানুষের জন্য প্রকাশ্য, আর পশ্চাত বলতে বোঝানো হয়েছে যা অদৃশ্য। তাতে অর্থ হবে এই যে, কোন কোন বিষয় মানুষের জ্ঞানের আওতায় রয়েছে কিন্তু কোন কোন বিষয়ে তাদের জ্ঞান নেই। কিছু তাদের সামনে প্রকাশ্য আর কিছু গোপন। কিন্তু আল্লাহ্র ক্ষেত্রে সবই প্রকাশ্য। তাঁর জ্ঞান সে সমস্ত বিষয়ের উপরই পরিব্যাপ্ত। সুতরাং এ দু’টিতে কোন বিরোধ নেই। আয়াতের ব্যাপকতায় উভয় দিকই বোঝানো হয়।
সপ্তম বাক্য- وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ ۚ অর্থাৎ, মানুষ ও সমগ্র সৃষ্টির জ্ঞান আল্লাহ্র জ্ঞানের কোন একটি অংশবিশেষকেও পরিবেষ্টিত করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যাকে যে পরিমাণ জ্ঞান দান করেন শুধু ততটুকুই সে পেতে পারে। এতে বলা হয়েছে যে, সমগ্র সৃষ্টির অণু-পরমাণুর ব্যাপক জ্ঞান আল্লাহ্র জ্ঞানের আওতাভুক্ত, এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। মানুষ অথবা অন্য কোন সৃষ্টি এতে অংশীদার নয়।
অষ্টম বাক্য- وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ۖ অর্থাৎ, তাঁর কুরসী এত বড়, যার মধ্যে সাত আকাশ ও যমিন পরিবেষ্টিত রয়েছে। আল্লাহ্ উঠা-বসা আর স্থান-কাল থেকে মুক্ত। এ ধরনের আয়াতকে মানুষের কার্যকলাপ ও আচার-আচরণের সাথে তুলনা করা উচিত নয়। এর অবস্থা পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করা মানবজ্ঞানের উর্ধ্বে। তবে ‘হাদীসের বর্ণনা দ্বারা এতটুকু বোঝা যায় যে, ‘আরশ ও কুরসী এত বড় যে, তা সমগ্র আকাশ ও যমিনকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। ইবনে কাসীর হযরত আবূ যর গিফারী (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু)-এর উদ্বৃতিতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি হুযুর (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, কুরসী কি এবং কেমন? তিনি বলেছেন, যার এখতিয়ারে আমার প্রাণ তাঁর কসম, কুরসীর সাথে সাত আকাশ ও সাত যমিনের তুলনা একটি বিরাট ময়দানে ফেলে দেয়া একটি আংটির মত। অন্য এক বর্ণনাতে আছে যে, ‘আরশের তুলনায় কুরসীও অনুরূপ।
নবম বাক্য وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ۚ অর্থাৎ, আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষে এ দু’টি বৃহৎ সৃষ্টি, আসমান ও যমিনের হেফাজত করা কোন কঠিন কাজ বলে মনে হয় না। কারণ, এই অসাধারণ ও একক পরিপূর্ণ সত্তার পক্ষে এ কাজটি একান্তই সহজ ও অনায়াসসাধ্য।
দশম বাক্য وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ তিনি অতি উচ্চ ও অতি মহান। পূর্বের নয়টি বাক্যে আল্লাহ্র সত্তা ও গুণের পূর্ণতা বর্ণনা করা হয়েছে। তা দেখার এবং বোঝার পর প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তি বলতে বাধ্য হবে যে, সকল শান-শওকত, বড়ত্ত্ব ও মহত্ব এবং শক্তির একমাত্র মালিক আল্লাহ্ তা‘আলা। এ দশটি বাক্যে আল্লাহ্র ‘যাত’ ও সিফাতের পূর্ণ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
ইসলামকে যারা সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে তারা যেহেতু ধ্বংস ও প্রবঞ্চনা থেকে নিরাপদ হয়ে যায়, সেজন্য তাদেরকে এমন লোকের সাথে তুলনা করা হয়েছে যে, কোন শক্ত দড়ির বেষ্টনকে সুদৃঢ়ভাবে ধরে পতন থেকে মুক্তি পায়। আর এমন দড়ি ছিঁড়ে পড়ার যেমন ভয় থাকে না, তেমনিভাবে ইসলামেও কোন রকম ধ্বংস কিংবা ক্ষতি নেই। তবে দড়িটি যদি কেউ ছেড়ে দেয় তা যেমন স্বতন্ত্র কথা, তেমনিভাবে কেউ যদি ইসলামকে বর্জন করে, তবে তাও স্বতন্ত্র ব্যাপার।- (বায়ানুল-কুরআন)
এ আয়াত দেখে কোন কোন লোক প্রশ্ন করে যে, আয়াতের দ্বারা বোঝা যায়, ধর্মে কোন বল প্রয়োগ নেই। অথচ ইসলাম ধর্মে জিহাদ ও যুদ্ধের শিক্ষা দেয়া হয়েছে?
একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে, এমন প্রশ্ন যথার্থ নয়। কারণ, ইসলামে জিহাদ ও ক্বিতালের শিক্ষা মানুষকে ঈমান আনয়নের ব্যাপারে বাধ্য করার জন্য দেয়া হয়নি। যদি তাই হতো, তবে জিয্য়া করের বিনিময়ে কাফেরদেরকে নিজ দায়িত্বে আসার কোন প্রয়োজন ছিল না। ইসলামের জিহাদ ও ক্বিতাল ফিৎনা-ফাসাদ বন্ধ করার লক্ষ্যে করা হয়। কেননা, ফাসাদ আল্লাহ্র পছন্দনীয় নয়, অথচ কাফেররা ফাসাদের চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকে। তাই আল্লাহ্ ইরশাদ করেছেনঃ
وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا ۚ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ
“তারা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়, কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা ফাসাদকারীদেরকে পছন্দ করেন না।”
এজন্য আল্লাহ্ তা‘আলা জিহাদ ও ক্বিতালের মাধ্যমে এসব লোকের সৃষ্ট যাবতীয় অনাচার দূর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সেমতে জিহাদের মাধ্যমে অনাচারী জালেমদের হত্যা করা সাপ-বিচ্ছু ও অন্যান্য কষ্টদায়ক জীবজন্তু হত্যা করারই সমতূল্য।
ইসলাম জিহাদের ময়দানে স্ত্রীলোক, শিশু, বৃদ্ধ এবং অচল ব্যক্তিদের হত্যা করতে বিশেষভাবে নিষেধ করেছে। আর এমনিভাবে সে সমস্ত মানুষকেও হত্যা করা থেকে বিরত করেছে, যারা জিয্য়া কর দিয়ে আইন মান্য করতে আরম্ভ করেছে।
ইসলামের এ কার্য-পদ্ধতিতে বোঝা যায় যে, সে জিহাদ ও ক্বিতালের দ্বারা মানুষকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করে না, বরং এর দ্বারা দুনিয়া থেকে অন্যায়-অত্যাচার দূর করে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আদেশ দিয়েছে। হযরত ‘উমার (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) একজন বৃদ্ধা নাসারা স্ত্রীলোককে ইসলাম গ্রহণের দা’ওয়াত দিয়েছিলেন, তখন সে স্ত্রীলোক উত্তর দিল, আমি মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধা। শেষ জীবনে নিজের ধর্ম কেন ত্যাগ করবো? হযরত ‘উমার (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) একথা শুনেও তাকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেননি বরং এ আয়াত পাঠ করলেন لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ অর্থাৎ, ধর্মে কোন বল প্রয়োগের নিয়ম নেই। বাস্তব পক্ষে ঈমান গ্রহণে বল প্রয়োগ সম্ভবও নয়। কারণ ঈমানের সম্পর্ক বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে নয়। আর জিহাদ ও ক্বিতাল দ্বারা শুধু বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই প্রভাবিত হয়। সুতরাং এর দ্বারা ঈমান গ্রহণে বাধ্য করা সম্ভবই নয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, জিহাদ,ক্বিতালের নির্দেশ لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ আয়াতের পরিপন্থী নয়।- (মাযহারী)