আন-নিসা, আয়াত ১-১০

পৃষ্ঠা নং-২৩৫

জরুরী ছিল, যার ফলে নিকট ও দূরের বিভিন্ন সম্পর্ক একত্রিত হলে নিকটের আত্মীয়কে দূরের আত্মীয়ের উপর অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং নিকটবর্তী আত্মীয় বিদ্যমান থাকলে দূরবর্তী আত্মীয়কে বঞ্চিত করতে হবে। অবশ্য যদি কিছু আত্মীয় এমন থেকে থাকে যে, একই সময়ে সবাই নিকটবর্তী সাব্যস্ত হয়, যদিও নিকটতম হওয়ার কারণ বিভিন্ন, তবে সবাই ওয়ারিস হবে। যেমন, সন্তানদের সাথে পিতা-মাতা কিংবা স্ত্রী থাকা; এরা সবাই নিকটতম ওয়ারিস, যদিও ঐ নৈকট্যের কারণ বিভিন্ন।

اَقْرَبُوْنَ শব্দটি আরো একটি বিষয় ব্যক্ত করেছে যে, পুরুষদেরকে যেমন উত্তরাধিকারের হকদার মনে করা হয়, তেমনি নারী ও শিশুদেরকেও এ হক থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কেননা, সন্তানদের সম্পর্ক হোক কিংবা পিতা-মাতার সম্পর্ক হোক অথবা অন্য কোন সম্পর্ক হোক, প্রত্যেকটিতেই সম্পৃক্ততার মর্যাদা ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সমান। ছেলে যেমন পিতা-মাতা থেকে জন্মগ্রহন করে, তেমনি মেয়েও পিতা-মাতারই সন্তান। উত্তরাধিকার স্বত্ব সম্পর্কের উপর ভিত্তিশীল। কাজেই ছোট ছেলে কিংবা মেয়েকে বঞ্চিত করার কোন কারণই থাকতে পারে না।

اَقْرَبُوْنَ শব্দ থেকে আরো একটি বিষয় জানা গেল যে, ত্যাজ্য সম্পত্তির বন্টন প্রয়োজনের মাপকাঠিতে নয়; বরং আত্মীয়তার মাপকাঠিতে হবে। তাই আত্মীয়দের মধ্যে যে ব্যক্তি অধিক দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত, তাকে বেশী হকদার মনে করা জরুরী নয়। বরং সম্পর্কে যে ব্যক্তি মৃতের অধিক নিকটবর্তী হবে, সে দূরবর্তীর তুলনায় অধিক হকদার হবে, যদিও প্রয়োজন ও অভাব দূরবর্তীর বেশী হয়। আর যদি নিকটতম আত্মীয়তার মাপকাঠির করে নেয়া হয়, তবে তা কোন বিধানই হতে পারে না কেননা, নিকটতম আত্মীয়তা ছাড়া অন্য যে কোন মাপকাঠি সাময়িক চিন্তাপ্রসূত হবে। কারণ, দারিদ্র্য ও অভাব চিরস্থায়ী নয়। অবস্থা ও স্তর সব সময় পরিবর্তিত হতে থাকে। এমতাবস্থায় হকের দাবীদার অনেক বের হয়ে আসবে এবং ফয়সালাকারীদের পক্ষে এর ফয়সালা করা কঠিন হবে।

ইয়াতীম পৌত্রের উত্তরাধিকারত্বের প্রশ্নঃ আজকাল ইয়াতীম পৌত্রের উত্তরাধিকারত্বের প্রশ্নটি অহেতুক একটি বিতর্কিত প্রশ্নে পরিণত করা হয়েছে। অথচ কুরআনে উল্লেখিত মূলনীতির ভিত্তিতে এ প্রশ্নটির অকাট্য সমাধান আপনা-আপনি বের হয়ে আসে। পুত্রের তুলনায় পৌত্র অধিক অভাবগ্রস্ত হলেও اَقْرَبُوْنَ এর আইনের দৃষ্টিতে সে ওয়ারিস হতে পারে না। কেননা, পুত্রের উপস্থিতিতে সে নিকটতম আত্মীয় নয়। তবে তার অভাব দূর করার জন্যে অন্যান্য ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে। এমনি এক ব্যবস্থা পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হবে।

এ প্রশ্নে বর্তমান যুগের পাশ্চাত্যভক্ত নব্যশিক্ষিতদের ছাড়া কেউ দ্বিমত করেনি। সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায় আজ পর্যন্ত কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে একথাই বুঝে  এসেছে যে, পুত্র বিদ্যমান থাকা অবস্থায় পৌত্র উত্তরাধিকার স্বত্ব পাবে না, তার পিতা বিদ্যমান থাকুক অথবা মৃত্যুমুখে পতিত হোক।

উত্তরাধিকারের নির্ধারিত অংশ আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে মীমাংসিতঃ  আয়াতের শেষে বলা হয়েছেঃ نَصِيْبًا مَّفْرُوْضًا এতে একথাও ব্যক্ত করা হয়েছে যে, বিভিন্ন ওয়ারিসের জন্যে যে বিভিন্ন অংশ কুরআন নির্দিষ্ট করেছে, এগুলো আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্ধারিত অংশ। এতে কারো নিজস্ব অভিমত ও অনুমানের ভিত্তিতে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করার কোন অধিকার নেই।

উত্তরাধিকারিত্ব একটি বাধ্যতামূলক মালিকানাঃ نَصِيْبًا مَّفْرُوْضًا শব্দ থেকে আরো একটি মাসআলা জানা যায় যে, উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ওয়ারিসরা যে মালিকানা লাভ করে তা বাধ্যতামূলক। এতে ওয়ারিসের কবুল করা এবং সম্মত হওয়া জরুরী ও শর্ত নয়, বরং সে যদি মুখে স্পষ্টতঃ বলে যে, সে তার অংশ নেবে না, তবুও আইনতঃ সে নিজের অংশের মালিক হয়ে যায়। এটা ভিন্ন কথা যে, মালিক হওয়ার পর শরীয়তের বিধি অনুযায়ী অন্য কাউকে দান, বিক্রি, অথবা বিলি-বন্টন করে দিতে পারবে।

বঞ্চিত আত্মীয়দের মনস্তুষ্টি বিধান করা জরুরীঃ মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের মধ্যে এমন কিছু লোকও থাকবে, যারা শরীয়তের বিধি অনুযায়ী তার ত্যাজ্য সম্পত্তিতে অংশ পাবে না। বলাবাহুল্য, ফারায়েযের বিস্তারিত আইন-কানুন সম্পর্কে প্রত্যেকেই জ্ঞাত নয়। সাধারণভাবে প্রত্যেক আত্মীয়ই অংশ পাওয়ার আশা পোষণ করতে পারে। তাই যেসব আত্মীয় নিয়মানুযায়ী বঞ্চিত সাব্যস্ত হয়, বন্টনের সময় তারা বিষন্ন ও দুঃখিত হতে পারে; যদি তারা বন্টনের সময় মজলিসে উপস্থিত থাকে এবং বিশেষতঃ যখন তাদের মধ্যে কিছু ইয়াতীম, মিসকিন ও অভাবগ্রস্তও থাকে। এমতাবস্থায় যখন অন্যান্য আত্মীয় নিজ নিজ অংশ নিয়ে যায় আর তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখে তখন তাদের বেদনা, নৈরাশ্য ও মনোকষ্ট ভুক্তভোগী মাত্রই অনুমান করতে পারে।

এখন কুরআনী ব্যবস্থার সৌন্দর্যও লক্ষ্য করুন। একদিকে স্বয়ং কুরআনেরই বর্ণিত সুবিচারভিত্তিক বিধান এই যে, নিকটবর্তী আত্মীয় বর্তমান থাকলে দূরবর্তী আত্মীয়ে মনোবেদনা ও নৈরাশ্যকেও উপেক্ষা করা হয়নি। এর জন্য একটি স্বতন্ত্র আয়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছেঃ

“যেসব দূরবর্তী, ইয়াতীম, মিসকীন ত্যাজ্য সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যদি তারা বন্টনের সময় উপস্থিত থাকে, তবে তাদের অংশীদারদের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে এ মাল থেকে স্বেছায় তাদেরকে কিছু দিয়ে দেওয়া। এটা তাদের জন্যে এক প্রকার সদকা ও সওয়াবের কাজ।”

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ