আল-বাকারা ১৬-৩৬

পৃষ্ঠা নং-২৩

চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে অগ্রসর হল না, তারা কুরআনের অনুরূপ একটি সূরা এমনকি কয়েকটি ছত্রও তৈরী করতে পারল না। ভাষাশৈলী ও পান্ডিত্বের মাধ্যমে কুরআনের মোকাবেলা করার ব্যাপারে ‘আরবদের এহেন নীরবতাই প্রমাণ করে যে, কুরান মানবরচিত গ্রন্থ নয়, বরং তা আল্লাহ্‌র কালাম। মানুষ তো দূরের কথা, সমগ্র সৃষ্টিজগত মিলেও এ কালামের মোকাবেলা করতে পারে না।
‘আরববাসীরা যে এ ব্যাপারে শুধু নির্বাকই রয়েছে তাই নয়, তাদের একান্ত আলোচনায় এরূপ মন্তব্য করতেও তারা কুন্ঠিত হয়নি যে, এ কিতাব কোন মানুষের রচনা হতে পারে না। ‘আরবদের মধ্যে যাদের কিছুটা সুস্থ্য বিবেক ছিল তারা শুধু মুখেই একথা প্রকাশ করেনি, এরূপ স্বীকৃতির সাথে সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেকেই ইসলাম গ্রহণও করেছে। আবার কেউ কেউ পৈত্রিক ধর্মের প্রতি অন্ধ আবেগের কারণে অথবা বনী-আব্দে মানাফের প্রতি বিদ্বেষবশতঃ কুরআনকে আল্লাহ্‌র কালাম বলে স্বীকার করেও ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে।

কুরাইশদের ইতিহাসই সে সমস্ত ঘটনার সাক্ষী। তারই মধ্য থেকে এখানে কয়েকিট ঘটনার উল্লেখ করা হচ্ছে, যাতে অতি সহজে বুঝা যাবে যে, সমগ্র ‘আরববাসী কুরআনকে অদ্বিতীয় ও নযীরবিহীন কালাম বলে স্বীকার করেছে এবং এর নযীর পেশ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ হওয়ার ঝুঁকি নিতে সচেতনভাবে বিরত রয়েছে!

রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং কুরআন নাযিলের কথা মক্কার গন্ডী ছাড়িয়ে ’হিজাযের অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার পর বিরুদ্ধবাদীদের অন্তরে এরূপ সংশয়ের সৃষ্টি হলো যে, আসন্ন হজ্জ্বের মওসুমে ‘আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে ‘‘হাজীগণ যখন মক্কায় আগমন করবে, তখন তারা রসূলুল্ল-হ্ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কথা-বার্তা শুনে প্রভাবান্বিত না হয়ে পারবে না। এমতাবস্থায় এরূপ সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করার পন্থা নিরূপণ করার উদ্দেশ্যে মক্কার সম্ভ্রান্ত ক্বুরইশরা একটি বিশেষ পরামর্শ সভার আয়োজন করলো। এ বৈঠকে ‘আরবের বিশিষ্ট সরদারগণও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ওলীদ ইব্‌ন মুগ্বীরা বয়সে ও বিচক্ষণতায় ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। সবাই তার নিকট এ সমস্যার কথা উত্থাপন করলো। তারা বললো, এখন চারিদিক থেকে মানুষ আসবে এবং মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্কে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করবে। তাদের সেসব প্রশ্নের জবাবে আমরা কি বলবো? আপনি আমাদেরকে এমন একটি উত্তর বলে দিন, যেন আমরা সবাই একই কথা বলতে পারি।

অনেক ভাবন-চিন্তার পর তিনি উত্তর দিলেন, যদি তোমাদের কিছু বলতেই হয়, তবে তাঁকে জাদুকর বলতে পার। লোকদেরকে বলো যে, এ লোক জাদু-বলে পিতা-পুত্র ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন। সমবেত লোকেরা তখনকার মত প্রস্তাবে একমত ও নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। তখন থেকেই তারা অগন্তুকদের নিকট একথা বলতে আরম্ভ করলো, কিন্তু আল্লাহ্‌র জ্বালানো প্রদীপ কারো ফুৎকারে নির্বাপিত হবার নয়। ‘আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাধারণ লোকদের অনেকেই কুরআনের অমীয় বাণী শুনে মুসলামন হয়ে গেল। ফলে মক্কার বাইরেও ইসলামের বিস্তার সূচিত হলো। [খ্বসায়েসে কুবরা]

এমনিভাবে বিশিষ্ট ক্বুরইশ সরদার নযর ইব্‌ন হারেস তার স্বজাতিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আজ তোমরা এমন এক বিপদের সম্মুখীন হয়েছ, যা ইতিপূর্বে কখনও দেখা যায়নি। মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমাদেরই মধ্যে যৌবন অতিবাহিত করেছেন, তোমরা তাঁর চরিত্রমাধুরে্‌য বিমুগ্ধ ছিলে, তাঁকে তোমরা সবার চাইতে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করতে, আমানতদার বলে অভিহিত করতে! কিন্তু যখন তাঁর মাথার চুল সাদা হতে আরম্ভ করেছে, আর তিনি আল্লাহ্র কালাম তোমাদেরকে শোনাতে শুরু করেছেন, তখন তোমরা তাঁকে জাদুকর বলে অভিহিত করছ। আল্লাহ্র কসম; তিনি জাদুকর নন। আমি বহু জাদুকর দেখেছি, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষ করেছি, তাদের সঙ্গে মেলা-মেশা করেছি, কিন্তু মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কোন অবস্থাতেই তাদের মত নন। তিনি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। আরও জেনে রেখো! আমি অনেক জাদুকরের কথা-বার্তা শুনেছি, কিন্তু তাঁর কথা-বার্তা জাদুকরের কথা-বার্তার সাথে কোন বিচারেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তোমরা তাঁকে কবি বল, অথচ আমি অনেক কবি দেখেছি, এ বিদ্যা আয়ত্ত করেছি, অনেক বড় বড় কবির কবিতা শুনেছি, অনেক কবিতা আমার মুখস্থও আছে, কিন্তু তাঁর কালামের সাথে কবিদের কবিতার কোন সাদৃশ্য আমি খুঁজে পাইনি। কখনও কখনও তোমরা তাঁকে পাগল বল, তিনি পাগলও নন। আমি অনেক পাগল দেখেছি, তাদের পাগলামীপূর্ণ কথা-বার্তাও শুনেছি, কিন্তু তাঁর মধ্যে তাদের মত কোন লক্ষণই পাওয়া যায় না। হে আমার জাতি! তোমরা ন্যায়নীতির ভিত্তিতে এ ব্যাপারে চিন্তা কর, সহজে এড়িয়ে যাওয়ার মত ব্যক্তি তিনি নন।

হযরত আবূ বাক্‌র (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেছেন, আমার ভাই আনীস একবার মক্কায় গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে এসে আমাকে বলেছিলেন যে, মক্কায় এক ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহ্‌র রসূল বলে দাবী করছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সেখানকার মানুষ এ সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করে? তিনি উত্তর দিলেন, তাঁকে কেউ কবি কেউ পাগল, কেউবা জাদুকর বলে। আমার ভাই আনীস একজন বিশিষ্ট কবি এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞ লোক ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, আমি যতটুকু লক্ষ্য করেছি, মানুষের এসব কথা ভূল ও মিথ্যা। তাঁর কালাম কবিতাও নয়,  জাদুও নয়, আমার ধারণায় সে কালাম সত্য।

আবূ যর (রদ্বিয়াল্ল-হু ‘আনহু) বলেন যে, ভাইয়ের কথা শুনে আমি মক্কায় চলে এলাম। মসজিদে ‘হারামে অবস্থান করলাম এবং ত্রিশ দিন শুধু অপেক্ষা করেই অতিবাহিত করলাম। এ সময় যমযম কূপের পানি ব্যতীত আমি অন্য কিছুই পানাহার করিনি। কিন্তু এতে আমার ক্ষুধার কষ্ট অনুভব হয়নি! দূর্বলতাও উপলব্ধি করিনি। শেষ পর্যন্ত কা’বা প্রাঙ্গন থেকে বের হয়ে লোকের নিকট বললাম, আমি রোম ও পারস্যের বড় বড় জ্ঞানী-গুণী লোকদের অনেক কথা শুনেছি, অনেক জাদুকর দেখেছি, কিন্তু মু’হাম্মাদ (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণীর মত কোন বাণী আজও পর্যন্ত কোথাও শুনিনি। কাজেই সবাই আমার কথা শোন এবং তাঁর অনুসরণ কর। আবূ যরের এ প্রচারে উদ্বুদ্ধ হয়েই মক্কা বিজয়ের বছর তাঁর ক্বওমের প্রায় এক হাজার লোক মক্কায় গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।

ইসলাম ও রসূলের বড় শত্রু আবূ জাহ্ল্ এবং আখ্নাস ইব্‌ন শোরাইকও লোকচক্ষুর অগোচরে কুরআন শুনত, কুরআনের অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গি এবং অনন্য রচনারীতির প্রভাবে প্রভাবান্বিত হতো। কিন্তু গোত্রের লোকেরা যখন তাদেরকে বলতো যে, তোমরা যখন এ কালামের গুণ সম্পর্কে এতই অবগত এবং একে অদ্বিতীয় কালামরূপে বিশ্বাস কর, তখন কেন তা গ্রহণ করছ না? প্রত্তুত্তরে আবূ জাহ্‌ল্ বলতো, তোমরা জান যে, বনী আবদে মানাফ এবং আমাদের মধ্যে পূর্ব থেকেই বিরামহীন শত্রুতা চলে আসছে; তারা যখন কোন কাজে অগ্রসর হতে চায়, তখন আমরা তার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে বাধা দেই। উভয় গোত্রই সমপর্যায়ের। এমতবস্থায় তারা যখন বলছে যে, আমাদের মধ্যে এমন এক নবীর আভির্ভাব হয়েছে, যাঁর নিকট আল্লাহ্‌র বানী আসে, তখন আমরা-

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
সব বিভাগ