পৃষ্ঠা নং-২৫
অর্থাৎ, তারা কি নিজেরাই সৃষ্ট হয়েছে, না তারাই আকাশ ও যমীন সৃষ্টি করেছে? কোন কিছুতেই ওরা ইয়াক্বীন করছে না। তাদের নিকট কি তোমার পালনকর্তার ভান্ডারসমূহ গচ্ছিত রয়েছে, তারাই রক্ষক?
অষ্টম কারণঃ অষ্টম কারণ হচ্ছে, কুরআনকে বারংবার পাঠ করলেও মনে বিরক্তি আসে না। বরং যতই বেশী পাঠ করা যায়, ততই তাতে আগ্রহ বাড়তে থাকে। দুনিয়ার যত ভাল ও আকর্ষণীয় পুস্তকই হোক না কেন, বড়জোড় দু-চারবার পাঠ করার পর তা আর পড়তে মন চায় না, অন্যে পাঠ করলেও তা শুনতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু কুরআনের এ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, যত বেশী পাঠ করা হয়, ততই মনের আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে। অন্যের পাঠ শুনতেও আগ্রহ জন্মে।
নবম কারণঃ নবম কারণ হচ্ছে, কুরআন ঘোষণা করেছে যে, কুরআনের সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ্ গ্রহণ করেছেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এর মধ্যে বিন্দুবিসর্গ পরিমাণ পরিবর্তন-পরিবর্ধন না হয়ে তা সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ্ তা‘আলা এ ওয়া’দা এভাবে পূরণ করছেন যে, প্রত্যেক যুগে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছিলেন এবং রয়েছেন, যারা কুরআনকে এমনভাবে স্বীয় স্মৃতিপটে ধারণ করেছেন যে, এর প্রতিটি যের-যবর তথা স্বরচিহ্ন পর্যন্ত অবিকৃত রয়েছে। নাযিলের সময় থেকে চৌদ্দ শতাধিক বছর অতিবাহিত হয়েছে; এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও এ কিতাবে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন পরিলক্ষিত হয়নি। প্রতি যুগেই নারি-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে কুরআনের ‘হাফিয ছিলেন ও রয়েছেন। বড় বড় ‘আলিম যদি একটি যের-যবর বেশ-কম করেন, তবে ছোট বাচ্চারাও তাঁর ভূল ধরে ফেলে। পৃথিবীর কোন ধর্মীয় কিতাবের এমন সংরক্ষণ ব্যবস্থা সে ধর্মের লোকেরা এক দশমাংশও পেশ করতে পারবে না। আর কুরআনের মত নির্ভূল দৃষ্টান্ত বা নযীর স্থাপন করা তো অন্য কোন গ্রন্থ সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না। অনেক ধর্মীয় গ্রন্থ সম্বন্ধে এটা স্থির করাও মুশকিল যে, এ কিতাব কোন ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল এবং তাতে কয়টি অধ্যায় ছিল।
গ্রন্থাকারে প্রতি যুগে কুরআনের যত প্রচার ও প্রকাশ হয়েছে, অন্য কোন ধর্ম-গ্রন্থের ক্ষেত্রে তা হয়নি। অথচ ইতিহাস সাক্ষী যে, প্রতি যুগেই মুসলামানদের সংখ্যা কাফের-মুশরিকদের তুলনায় কম ছিল এবং প্রচার মাধ্যমও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকদের তুলানায় কম ছিল। এতদসত্ত্বেও কুরআনের প্রচার ও প্রকাশের তুলানায় অন্য কোন ধর্মগ্রন্থের প্রচার ও প্রকাশনা সম্ভব হয়নি। তারপরেও কুরআনের সংরক্ষণ আল্লাহ্ তা‘আলা শুধু গ্রন্থ ও পুস্তকেই সীমাবদ্ধ রাখেননি যা জ্বলে গেলে বা অন্য কোন কারণে নষ্ট হয়ে গেলে আর সংগ্রহ করার সম্ভাবনা থাকে না। তাই স্বীয় বান্দাগণের স্মৃতিপটেও সংরক্ষিত করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ না করুক সমগ্র বিশ্বের কুরআনও যদি কোন কারণে ধ্বংস হয়ে যায়, তবু এ গ্রন্থ পূর্বের ন্যায়ই সংরক্ষিত থাকবে। কয়েকজন ‘হাফিয একত্রে বসে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তা লিখে দিতে পারবেন (ইনশা-আল্ল-হ)। এ অদ্ভুত সংরক্ষণও আল-কুরআনেরই বিশেষত্ব এবং এ যে আল্লাহ্রই কালাম তার অন্যতম উজ্জ্বল প্রমাণ। যেভাবে আল্লহ্র সত্তা সর্বযুগে বিদ্যমান থাকবে, তাতে কোন সৃষ্টির হস্তক্ষেপের কোন ক্ষমতা নেই, অনুরূপভাবে তাঁর কালাম সকল সৃষ্টির রদ-বদলের ঊর্ধ্বে এবং সর্বযুগে বিদ্যমান থাকবে। কুরআনের এই ভবিষ্যদ্বানীর সত্যতা বিগত চৌদ্দশত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। এ প্রকাশ্য ‘মু‘জিযার পর কুরআন আল্লহ্র কালাম হওয়াতে কোন প্রকার সন্দেহ-সংশয় থাকতে পারে না।
দশম কারণঃ কুরআনে ‘ইল্ম ও জ্ঞানের যে সাগর পুঞ্জীভূত করা হয়েছে, অন্য কোন কিতাবে আজ পর্যন্ত তা করা হয়নি। ভবিষ্যতেও তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এই সংক্ষিপ্ত ও সীমিত শব্দসম্ভারের মধ্যে এত জ্ঞান ও বিষয়বস্তুর সমাবেশ ঘটেছে যে, তাতে সমগ্র সৃষ্টির সর্বকালের প্রয়োজন এবং মানবজীবনের প্রত্যেক দিক পরিপূর্ণভাবে আলোচিত হয়েছে। আর বিশ্ব-পরিচালনার সুন্দরতম নিয়ম এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের নির্ভূল বিধান বর্ণিত হয়েছ। এ ছাড়া মাথার উপরে ও নীচে যত সম্পদ রয়েছে সে সবের প্রসঙ্গ ছাড়াও জীব-বিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান এমনকি রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির সকল দিকের পথনির্দেশ সম্বলিত এমন সমাহার বিশ্বের অন্য কোন আসমানী কিতাবে দেখা যায় না।
শুধু আপাতঃদৃষ্টিতে পথনির্দেশই নয়, এর নমুনা পাওয়া এবং সে সব নির্দেশ একটা জাতির বাস্তব জীবনে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়ে তাদের জীবনধারা এমনকি ধ্যান-ধারণ, অভ্যাস এবং রুচিরও এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন দুনিয়ার অন্য কোন গ্রন্থের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে এমন নযীর আর একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা নিরক্ষর উম্মী জাতিকে জ্ঞানে, রুচিতে, সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে এত অল্পকালের মধ্যে এমন পরিবর্তিত করে দেয়ার নযীরও আর দ্বিতীয়টি নেই।
সংক্ষেপে এই হচ্ছে কুরআনের সেই বিস্ময় সৃষ্টিকারী প্রভাব, যাতে কুরআনকে আল্লাহ্র কালাম বলে প্রতিটি মানুষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। যাদের বুদ্ধি-বিবেচনা বিদ্বেষের কালিমায় সম্পূর্ণ কলূষিত হয়ে যায়নি, এমন কোন লোকই কুরআনের এ অনন্য সাধারণ মু’জিযা সম্পর্কে অকুন্ঠ স্বীকৃতি প্রদান করতে কার্পণ্য করেনি। যারা কুরআনকে জীবন বিধান হিসাবে গ্রহণ করেনি, এমন অনেক অ-মুসলিম লোকও কুরআনের এ নযীরবিহীন মু’জিযার কথা স্বীকার করেছেন। ফ্রান্সের বিখ্যাত মণীষী ডঃ মারড্রেসকে ফরাসী সরকারের পক্ষ থেকে কুরআনের বাষট্টিটি সূরা ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁর স্বীকারোক্তিও এ ব্যাপারে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘নিশ্চয়ই কুরআনের বর্ণনাভঙ্গি সৃষ্টিকর্তার বর্ণনাভঙ্গিরই স্বাক্ষর। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কুরআনে যেসব তথ্যাদি বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ্র বাণী ব্যতীত অন্য কোন বাণীতে তা থাকতে পারে না।’
এতে সন্দেহ পোষণকারীরাও যখন এর অনন্য সাধারণ প্রভাব লক্ষ্য করে, তখন তারাও এ কিতাবের সত্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়। বিশ্বের সর্বত্র শতাধিক কোটি মুসলামান ছড়িয়ে রয়েছে, তাদের মধ্যে কুরআনের বিশেষ প্রভাব দেখে খৃষ্টান মিশনগুলোতে কর্মরত সকলেই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, যেসব মুসলামন কুরআন বুঝে পড়ার সুযোগ লাভ করেছে, তাদের মধ্যে একটি লোকও ধর্মত্যাগী-মুরতাদ হয়নি।
মোটকথা, কুরআনের অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যথাযোগ্য বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব না হলেও সংক্ষিপ্তভাবে যতটুকু বলা হলো, এতেই সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, কুরআন আল্লাহ্রই কালাম এবং রসূলে আকরম (সল্লাল্ল-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর একটি সর্বশ্রেষ্ঠ ‘মু‘জিযা।